নজরুল জীবনে নারী। (জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রেমিকা ও স্ত্রীগণ :
“এই বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”।
কাজী নজরুল ইসলাম -যাকে অনেকগুলি অভিধায় অভিহিত করা হয়- বিদ্রোহী কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি, ইসলামী কবি বা মুসলমানের কবি, সাম্যের কবি, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কবি। সবগুলি বিশেষণই তার ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। কিন্তু আমার কাছে তিনি হচ্ছেন, লড়াকু একজন ব্যক্তি যিনি নিজের ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিয়েছিলেন। যিনি হার মানিয়েছিলেন সময়কে, নিজের জন্মগত দুর্ভাগ্যকে। আমার কাছে নজরুল মানে লড়াই করে যাওয়া- সকল পরিস্থিতিতে, সকল স্থানে, সকল সময়ে।
এই দ্রোহ, সাম্য আর প্রেমের কবিও প্রেমে পরেছিলেন। বাজিয়েছিলেন বাশি, লিখেছেন কবিতা, গান, গল্প আর কিছু অসাধারণ চিঠি- রমণীর মন পাবার আশায়। তার জীবনে তিনজন নারীর আগমন সুস্পষ্ট। তারা হলেন-
১। সৈয়দা খানম;
২। প্রমীলা সেনগুপ্তা;
৩। ফজিলতুন্নেসা জোহা।
১। সৈয়দা খানম - ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল
কুমিল্লার দৌলতপুরের বিখ্যান খান বংশের সন্তান আলী আকবর খান। তিনি পেশায় ছিলেন একজন সৈনিক (ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় থাকাকালীন অবসর নেন) এবং পরবর্তীতে একজন গ্রন্থ প্রকাশক। তিনি মূলত শিশু শিক্ষার বই প্রকাশ করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন।
কারো কারো মতে, তাদের পরিচয় হয়, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর, অর্থাৎ ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে নৌশেরার ট্রেনিং শেষে ১৯১৯ সালের দিকে নজরুল করাচিতে অবস্থান করছিলেন। সম্ভবত তখনই আলী আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। নজরুলের সৈনিক পদমর্যাদা তখন ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার, আলী আকবর ক্যাপ্টেন।
পরিচয়ের শুরু থেকেই তিনি চাচ্ছিলেন, নজরুলকে হাতে কব্জায় রাখতে, কারন শিশু সাহিত্যে নজরুল সিদ্ধহস্ত। তাকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিলে ভালো বাজার পাওয়া যাবে, আর টাকা-পয়সার ব্যাপারে নজরুল চিরকালই উদাসীন। আড্ডাবাজ নজরুল ভালোভাবেই মিশে যান আলী আকবর খানের সাথে কিন্তু নজরুলের বন্ধু কমরেড মোজাফর আহমেদের এটা পছন্দ হচ্ছিলো না, কারন তিনি জানতেন আলী আকবর খান খুব চতুর।
নজরুলের সাথে সম্পর্ক গভীর কিংবা তার উপর প্রভাব বিস্তার করার মানসে আলী আকবর খান নজরুলকে কুমিল্লায় নিয়ে আসেন বেড়ানোর নাম করে। ১৯২১ সালে (বাংলা ২৩ চৈত্র ১৩২৭) নজরুল তার বন্ধুদের না জানিয়েই মুরাদনগরের দৌলতপুরে আসেন। এখানে তাকে দেয়া হয় উষ্ণ সংবর্ধনা, নির্মান করা হয় তোরন।
ছবিঃ দৌলতপুরে এই বাড়িতেই ছিলেন নজরুল।
কলকাতা থেকে ট্রেনে কুমিল্লা আসেন তারা, সেইখানে আলী আকবর খান প্রথমে নজরুলকে নিয়ে উঠেন তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের সাথে থাকতেন তার মা বিরজা সুন্দরী দেবী (যার আদর-ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে নজরুলও মা ডাকতেন ) আর তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবীও থাকতেন তার মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তাকে নিয়ে, যিনি দোলন নামেও পরিচিত ছিলেন। চার-পাচদিন এখানে কাটিয়ে তারা দৌলতপুরে চলে আসেন।
খাঁন বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে মুন্সী বাড়িতে বিয়ে দেন আলী আকবর খাঁনের বোন আসমতের নেসাকে। বাবার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় এবং আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আসমতের নেসা প্রায়সই বাবার বাড়ি থাকতেন, সেই সাথে তাঁর মেয়ে সৈয়দা খাতুনও। এক পর্যায়ে সৈয়দা খাতুনের বড় ভাই জব্বার মুন্সীর সাথে মামা নেজাবত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খাঁনমের বিয়ের দিন স্থির হয় ১৯২১ সালের ৫ মে (বাংলা ২২বৈশাখ)। সেই বিয়েতে যোগ দেন নজরুল। জনশ্রুতি আছে এবং ঐতিহাসিকদের মতেও ওই দিনই যুবক নজরুলের প্রথম দেখা হয় ভাইয়ের বিয়েতে আসা ষোড়শী সৈয়দা খাতুনের সাথে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সখ্যতা। নজরুল ইরানী ফুলের নামে তাঁর নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম। নার্গিসের রূপ মাধুরী ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে দৌলতপুরে দীর্ঘ ৭১ দিন অবস্থান করেন নজরুল। অন্য আরেকটি মতে, নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে।
ছবিঃ নার্গিস ফুল।
নার্গিসের প্রতি নজরুলের মুগ্ধতা চোখ এড়ায় না চতুর আলী আকবর খানের। তারই একান্ত ইচ্ছায় ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় নজরুল-নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। ধুমধাম করে বিয়েও হয়, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন সেইখানে। আর নজরুলের পক্ষে তার অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী।
কিন্তু বিয়ের আসর থেকে আকদ হবার পরে পরেই তিনি রহস্যজনক কারনেই তিনি উঠে চলে আসেন। কারো কারো মতে কাবিনের শর্ত নিয়ে ঝামেলার কারনে রগচটা নজরুল রাগ করে চলে আসেন। কাবিনে শর্ত ছিলো তাকে ঘর জামাই থাকতে হবে। সেই যে চলে আসেন তিনি আর ফিরে যাননি দৌলতপুরে। অনেকে মনে করেন, রগ কমলে হয়ত নজরুল ফিরে যেতেন দৌলতপুরে কিন্তু বিরজা সুন্দরী দেবীর প্ররোচনার কারনে আর তার ফেরা হয়নি।
কোন কোন মতে, নজরুলের সাথে নার্গিসের বাসরও হয়েছিলো বলে জানা যায়।
নজরুল চলে যাবার পরও নার্গিস তাঁর জন্য ১৬ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। এক পর্যায়ে মামাতো ভাই নোয়াজ্জস আলী টুক্কু খাঁন (তৎকালীন ইউপি ভাইস প্রেসিডেন্ট) কোলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছ থেকে এক প্রকার জোর পূর্বকই বিয়ের তালাক নামায় স্বাক্ষর আনেন (১৯৩৭ সালে)। অতঃপর জোর করেই নার্গিসকে বিয়ে দেন ঢাকার হাসানবাদের ছেলে, কবি আজিজুল হাকিমের সাথে। তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে ডা. আজাদ ফিরোজ ইউরোপের মেঞ্চেস্টারে চিকিৎসক এবং মেয়ে শাহানারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নার্গিস মারা যান ১৯৮৫ সালে, তাকে সমাহিত করাহয় ম্যানচেস্টারে।
১৯২৪ সালে নজরুল বিয়ে করেন, প্রমিলা দেবীকে। কিন্তু তিনি কি ভুলতে পরেছিলেন নার্গিসকে, তার প্রথম প্রেমকে?? চলুন জানি তার নিজের মুখেই- তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না- আমি ‘ধূমকেতুর’ বিষ্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না...” ( নার্গিসকে লেখা নজরুলের চিঠির অংশ)।
"যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে"।
বলা যায় নার্গিসই একমাত্র নারী, যার কল্যাণে পৃথিবীতে নজরুলের মতো একজন বিখ্যাত কবির সৃষ্টি হয়েছিলো।এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য কবিতা গুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অ-বেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি।
২। কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা দেবী - মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর
ছবিঃ প্রমীলা দেবী।
প্রমীলা সেনগুপ্তা বা দোলন বিয়ের পর যার নাম হয় প্রমীলা দেবী তার সাথে নজরুল ইসলামের পরিচয় পর্ব আগেই বর্ণনা করা হয়েছে।
আকবর আলী খান ছাড়া কুমিল্লাতে নজরুলের পরিচিত বলতে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত (কিভাবে পরিচয় আগেই বলা হয়েছে)। তাই নজরুল রাগ করে বিয়ের আসর থেকে উঠেন বীরেন্দ্রকুমারের বাড়িতেই। রাতে তিনি ও বীরেন পায়ে হেটে চলে আসেন, কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। আর বিরজা সুন্দরী দেবী ও অন্যরা (প্রমীলা দেবীসহ) নজরুলের বিয়ে দাওয়াতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন দৌলতপুরে। তারা পরের দিন বাসায় ফেরেন।
দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে এসে এবং কয়েকদিনের মানসিক পরিশ্রমের কারনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেন বাড়ির সবার যত্নে তিনি সেরে উঠেন। এইসময়ই নজরুল কিশোরী প্রমীলার প্রেমে পড়েন। এটা হতে পারে প্রমীলার সেবা যত্নে মুগ্ধ হয়ে কিংবা তার প্রথম প্রেমের স্মৃতি হতে মুক্তি পাওয়ার আকুলতা।
১৮ জুন নজরুল কান্দিরপাড়ে চলে আসেন, আর ৬ জুলাই কমরেড মুজফ্ফর আহমদ কুমিল্লায় আসেন। এতকিছু ঘটে গেলো নজরুল জীবনে তার বন্ধুরা প্রায় কিছুই জানত না, কারন কলকাতা থেকে আসা সব চিঠি আলী আকবর খান লুকিয়ে রাখতেন। যদিও আলী আকবর খান চিঠি দিয়ে নজরুলের বিয়ের কথা কলকাতার প্রায় সবাইকে জানিয়েছেন এবং অনেকেই অভিনন্দন জানিয়ে নজরুলকে চিঠি লিখছিলেন এমনকি অনেকে সংবাদপত্রে অভিনন্দন বার্তা ও কবিতাও প্রকাশ করেছিলেন। ৮ জুন ১৯২১ সালে মুজফ্ফর আহমদ কবিকে নিয়ে কলকাতায় ফিরেন।
ঐ বছরের নভেম্বর মাসের দিকে দ্বিতীয়বারের মত কবি আবার কান্দিরপাড়ে আসেন এবং এক মাস সময় থাকেন। এই সময়ই কবি সৃষ্টি করেন তার অমর সৃষ্টি “বিদ্রোহী” কবিতা, পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে তিনি আবার কুমিল্লা আসেন। এইবার তার যাত্রা নির্বিঘ্ন ছিলো না। হিন্দু বাড়িতে মুসলিম ছেলের আসা যাওয়া বা হিন্দু মেয়ের সাথে তার প্রেম গোঁড়া হিন্দু সমাজের যুবকেরা মেনে নিতে পারে নাই, তাদের আক্রোশে স্বীকার হন তিনি এমনকি শারীরিকভাবেও হেনস্তা করেন তাকে।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।/
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়।
কবি এইসময় বিহার অবস্থানরত হতে গিরিবালা দেবীকে ও প্রমীলা দেবীকে কুমিল্লা পৌঁছে দিতে আসলে তিনি কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার সেই বিখ্যাত জবানবন্দীটি প্রদান করেন।
"আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে..."।
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। হুগলি জেলে থাকাকালে তিনি বন্দিদের উপর রক্ষীদের অন্যায় আচরনের বিরুদ্ধে গিয়ে অনশন করেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে তার করেন, Give up hunger strike, our literature claims you. (এইসময়েই রবীন্দ্রনাথ বসন্ত গীতিনাট্যটি কবিকে উৎসর্গ করেন)। কিন্তু নজরুল অনশন ভাংগলেন না, এমন কি তার আপন মাতা জাহেদা খাতুনও পারেন নি, কিন্তু বিরজা সুন্দরী দেবী পেরেছিলেন তার অনশন ভাঙতে।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সরাসরি কুমিল্লা চলে আসেন। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কবি চিন্তা করেন তিনি এইবার প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করবেন। কিন্তু প্রথমেই সমস্যা হয়, বিয়ে কোন ধর্মমতে হবে, সিভিল ম্যারিজ আইনে বিয়ে হতে গেলে পাত্র-পাত্রী একই ধর্মের হতে হয়। আবার ইসলাম ধর্মমতে বিয়ে হচ্ছে না, যেহেতু প্রমীলা দেবী তার ধর্ম ত্যাগে রাজী নয়। কিন্তু প্রেম তো জাতি-ধর্ম মানে না। কবি তখন যুক্তি দেন,
“...আহলে কেতাবিদিগের সংগে ক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া ইসলাম আইন মনে অসিদ্ধ নয়। এখন কথা হচ্ছে হিন্দুগন ‘আহলে কিতাব’ কিনা? একচলক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন। এই সকল পয়গম্বর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষেও পয়গম্বরের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। অতএব, এ বিয়ে হওয়া সম্ভবত আইন মনে অন্যায় হবে না”।
অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল খুব সাদামাটাভাবে কলকাতায় তাদের বিয়ে হয়। এই বিয়ের পরে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ভীষণভাবে খেপে উঠে, অনেক পত্রিকায় (যেমন প্রবাসী পত্রিকা) তার লেখাও নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলাসেনগুপ্ত দীর্ঘ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকার পরে মৃত্যু বরণ করেন।
হে মোর রানী ! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
‘হার-মানা-হার’
৩। ফজিলতুন্নেসা জোহা-তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি
নার্গিস ও প্রমীলা দেবী ছিলেন সাধারণ মানুষ, সমাজে তাদের তেমন কোন পরিচয় নাই কাজী নজরুলের প্রেমিকা বা স্ত্রী ছাড়া। কিন্তু ফজিলতুন্নেসা ছিলেন আপনগুনে ভাস্মর। তিনি খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গনিতে স্নাতক প্রথম মহিলা। তিনিই তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান। ছিলেন ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ।
এতো গেলো তার গুনের পরিচয়, কেমন ছিলেন দেখতে তিনি। বিখ্যাত দাবাড়ু, পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ও তৎকালীন সময়ে গনিত বিভাগের শিক্ষিক কাজী মোতাহের হোসেন তার রুপের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাক্পটু মেয়ে।
নজরুল প্রেমের এই অংশটা মূলত ছিলো, একদিক থেকে। নজরুল নিজেই ভালোবেসে গেছেন, কিন্তু ভালোবাসা পাননি। আর এইপ্রেমের কাহিনী সবারই অজানা থাকত, যদি কাজী মোতাহের হোসেনকে লেখা নজরুলের সাতটি চিঠি না পাওয়া যেত। অবশ্য নজরুল ফজিলতুন্নেসাকেও একটি চিঠি লিখেন এবং তিনি কোন দিন কবিকে এই চিঠির উত্তর দেন নাই। নজরুলের এই প্রেমের স্বাক্ষী মাত্র তিনজন-মোতাহের হোসেন, ফজিলতুন্নেসা ও কবি স্বয়ং।
দুই বছরের বড় মোতাহের হোসেনের সাথে (কবি ডাকতেন মতিহার) পরিচয় ১৯২০-২১ সালে কলিকাতায় হলেও তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ১৯২৭ সালে কবি যখন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেষনে যোগদানের জন্য প্রথমবারের মত ঢাকায় এসে মোতাহের হোসেনের সরকারী বাসা বর্ধমান হাউজে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) আতিথেয়তা গ্রহণ করেন- যেখানে মোতাহের হোসেন পরিবারসহ থাকতেন, আর এই বাসাতেই ফজিলতুন্নেসা বিকেলে আসতেন মোতাহের হোসেনের স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর সাথে বিকেলে গল্প করতে। মোতাহের হোসেন ফজিলতুন্নেসাকে আপন বোনের মত দেখতেন।
১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বার আবার যখন কবি ঢাকায় আসেন তখন ফজিলতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভবিষত বলে দিতে পারেন। তাই তিনি মোতাহের হোসেনকে অনুরোধ করেন কবিকে নিয়ে তার বাসায় যাবার জন্য। ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। সেই বাসাতেই মোতাহের হোসেন কবিকে নিয়ে যান এবং তাদের দুইজনের পরিচয় হয় এবং কবি প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পরে যান। সেদিন রাতেই কবি মোতাহেরকে (তারা দুইজন একই ঘরে ঘুমাতেন) ঘুমে রেখে ফজিলতুন্নেসার বাসায় যান এবং প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর তিনি কলকাতায় ফিরে যান এবং ফজিলতুন্নেসাকে চিঠি লিখেন কিন্তু কোন উত্তর পাননি। একইসাথে তিনি মোতাহের হোসেনকে একের পরে এক চিঠি (মোট সাতটি) লিখছেন, যার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে ছিলো ফজিলতুন্নেসার প্রতি তার আকুলতার কথা। এই চিঠিগুলো কতখানি মোতাহেরকে লেখা আর কতখানি ফজিলতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে লেখা তা এক গবেষনার বিষয়। এই চিঠিগুলোর একটি থেকে জানা যায় নজরুল তার “সঞ্চিতা” কাব্যসংকলনটি ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফজিলতুন্নেসা অনুমতি দেননি। এটি পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়।
নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে ‘’বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ নাম দেওয়া হয়)।
বিদেশে পড়ার সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্র পুত্র সলিসিটর শামসোদ্দোহার সাথে পরিচয় ঘটে এবং তারা উভয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রতিশ্রুত হন। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর (হুমায়ূন আহমদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকীনের দাদু)ঘটকালিতে ফজিলতুন্নেসা ও শামসোদ্দোহার বিয়ে সম্পন্ন হয়। যদিও বাবার অসুস্থতার জন্য তিনি তার পিএইডি সম্পুর্ন না করেই দেশে ফিরেন।
বাদল বায়ে মোর
নিভিয়া গেছে বাতি।
তোমার ঘরে আজ
উৎসবের রাতি।।
(বিয়ের খবর শুনে নজরুলের লেখা কবিতা)
ফজিলতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ কম-বেশি দুই বছর স্থায়ী হয়। কাজী মোতাহের হোসেন এই ব্যাপারে বলেন,
“ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়” ।
ফজিলতুন্নেসা জোহা ১৯৭৬ সালের ২১ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন।
কিছু গুঞ্জন, কিছু মিথঃ
ঢাকার আরও দুই মেয়েঃ
বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দীলিপ রায় ঢাকায় এসে রানু সোম (পরে বিখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু নাম ধারন করেন ) এর গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাকে নজরুল গীতি শেখাতে শুরে করেন। একদিন দীলিপ রায় নজরুলকে রানু সোমের বাসায় নিয়ে যান। পরে নজরুল নিজেই তাকে গান শিখাতে শুরু করেন এবং তাদের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। যা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি এবং ঢাকাতেই কিছু হিন্দু যুবক তাকে আক্রমন করেন।
ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্রের সাথেও নজরুলকে নিয়ে প্রেমের গুঞ্জন ছিলো।
একজন সম্পাদিকাঃ
“বর্ষবাণী” নামক একটি বার্ষিক পত্রিকা বের করতেন পশ্চিমবজ্ঞের মেয়ে জাহানারা বেগম চৌধুরী (ডাকনাম মীরা), যাতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সব লেখকেরই লেখা ছাপা হয়েছে। মীরার সাথে দার্জিলিং এ গিয়ে নজরুলের পরিচয় হয়।
তার কাছে নজরুলের কয়েকটি কবিতা ও গানের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়, যেখানে তাকে নিয়ে লেখা কবির কয়েকটি কবিতাও ছিলো।
দেশখ্যাত একজনঃ
ছবিঃকানন দেবী।
কানন দেবী বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন। তাকে নিয়ে নজরুলের সাথে প্রেমের গুঞ্জন ছিলো। তখন বলা হত, নজরুলকে কোথাও পাওয়া না গেলেও কানন দেবীর বাসায় পাওয়া যাবে।
আর এইসব গুঞ্জন সৃষ্টি ও প্রচারে সবসময়ই আগ্রনী ভুমিকা পালন করেছে, “শনিবারের চিঠি”র সম্পাদক সজনীকান্ত।
প্রথম তিনজনের প্রতি নজরুলের প্রেম প্রমাণিত সত্য, কিন্তু পরের চারজনের ব্যাপারটা মনে হয় নেহাতই গুঞ্জন। তখন অনলাইন পত্রিকা আর ফেইসবুক না থাকলেও মুখরোচক খবর ছড়ানোর মত সম্পাদক আর পত্রিকার অভাব ছিলো না, ছিলো না মানুষেরও।
উপসংহারে বলতে চাই, ভাগ্যিস নজরুল বার বার প্রেমে পড়েছিলেন, না হলে এমন সুন্দর সুন্দর প্রেমের গান আমরা কোথায় পেতাম।
কৃতজ্ঞতাঃ
১।তৌহিন হাসান- নজরুলের পত্রাবলী। মুলত এই বইটা থেকেই ৯০% সাহায্য নেয়া হয়েছে।
২। ইউকিপিডিয়া।
৩।স্মৃতিপটে নজরুল -স্মৃতিকথা; কাজী মোতাহার হোসেন।
৪। নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম: ড. আবুল আজাদ
http://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/ghunpoka13/29953056
No comments:
Post a Comment