Thursday 4 May 2017

মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন ‘সকল অমৃত ফলের কল্পতরু’।


মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন ‘সকল অমৃত ফলের কল্পতরু’।

আবদুল লতিফ মাসুম |

সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নে ‘জেনারেশন গ্যাপ’ একটি তত্ত্ব। বাংলায় একে ‘প্রজন্ম দূরত্ব’ বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশকে এ রকম চিন্তা প্রসার লাভ করে। এ তত্ত্ব দ্বারা একটি প্রজন্ম থেকে চিন্তা-চেতনা, রাজনীতি-সমাজনীতি এবং বিশ্বাস ও মূল্যবোধে অন্য প্রজন্মের পার্থক্য বোঝানো হয়। কেতাবি ভাষায় একে ‘ইনস্টিটিউশনাল এইজ সেগ্রিগেশন’ বা ‘প্রাতিষ্ঠানিক প্রজন্ম বিচ্ছেদ’ বলা যেতে পারে। মওলানা আকরম খাঁ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বাস্তবতার আলোকে বিষয়টির যথার্থতা উপলব্ধি হলো। ব্রিটিশ আমলকে যদি প্রথম প্রজন্ম ধরা হয়, তাহলে পাকিস্তানি শাসন সময়কাল হতে পারে দ্বিতীয় প্রজন্ম এবং বাংলাদেশ আমল যথার্থভাবেই তৃতীয় প্রজন্মের সময়কাল বলে বিবেচনা করা যায়। মওলানা আকরম খাঁর জীবনকাল শতবর্ষব্যাপী। ১৮৬৮ সাল থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর জীবন পাকিস্তান আমল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হলেও মূল কার্যকাল ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগব্যাপী। সুতরাং তৃতীয় প্রজন্ম যদি তাঁকে ভুলে যায়, তাহলে সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেক্ষেত্রে ‘বণিক বার্তা’ বাংলার প্রবীণ পুরুষদের নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

এ জাতির জন্য যারা পাহাড় কেটে কেটে প্রশস্ত পথ তৈরি করেছেন, মওলানা আকরম খাঁ তাদের একজন পুরোধা পুরুষ। বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন এবং একটি স্বাধীন জাতি গঠনে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। সেকালে এ অঞ্চলের অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক মুক্তির জন্য তার শতবর্ষব্যাপী সংগ্রাম ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। সময়ের সাক্ষী ‘কাল পুরুষগণ’ তাঁর অবদানকে নানা অভিধায় অভিহিত করেছেন। ঔপনিবেশিক আমল থেকে স্বাধীনতা অর্জনের প্রান্তিক সময়ের প্রাগ্রসর নেতা আল্লামা আবুল হাসিম বলেন, ‘বাংলাদেশের যে কতিপয় মুসলিম মনীষী ও চিন্তাবিদ জাতীয় জীবনের এ ঘোর অন্ধকার যুগে জাতীয় সম্বিত ফিরাইয়া আনিবার সাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, মওলানা আকরম খাঁ তাদের অন্যতম’ (আবুল হাসেম: ১৯৬৮:৬৬)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জনক, বিশুদ্ধচারী রাজনীতিবিদ, ধ্রুপদ সাহিত্যিক, অগ্রসর চিন্তা নায়ক, যুক্তিবাদী ইসলামী চিন্তাবিদ এবং সফল সমাজ সংস্কারক। তাঁর সময়ের আর একজন প্রাজ্ঞ পুরুষ আবুল মুনসুর আহমেদের ভাষায়, মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন ‘সকল অমৃত ফলের কল্পতরু’। (আবুল মুনসুর আহমেদ: ১৯৮৬: বার)।

মওলানা আকরম খাঁ ১৮৬৮ সালের ৭ জুন ভারতের ২৪ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার অন্তর্গত হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মওলানা আবদুর বারী খাঁ। শিশুকালেই মহামারী কলেরায় একই দিনে তাঁর পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেন। এতিম আকরম খাঁ পরবর্তীকালে তাঁর নানার কাছে লালিত-পালিত হন। পীরালি বংশ নামে পরিচিত এরা ছিলেন মূলত পীর পরিবার। তাঁর পূর্বপুরুষদের একজন ছিলেন বালাকোটের শহীদ। ইসলামী ভাবধারার যে অংশ অব্যাহতভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধী ছিল, তাঁর বংশধারা তারই প্রতিনিধিত্ব করে। আকরম খাঁ গৃহশিক্ষকের নিকট প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা মাদ্রাসা থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রজীবনেই তার প্রতিবাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। মাদ্রাসা এবং পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত চেষ্টায় তিনি আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি ইংরেজিও ভালো জানতেন। তবে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না।

‘আমাদের স্মরণসীমার মধ্যে মুসলিম বাংলার বিগত আধা শতকের ওপর কালতক যারা দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য অবিরাম সংগ্রাম করেছেন, মওলানা আকরম খাঁর অবস্থান তাদের পয়লা কাতারে’ (ইব্রাহীম খাঁ: ১৯৮৬: ১২৪)। ঔপনিবেশিক-বিরোধী আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস তত দিনে বেশ অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, সমাজ সচেতনতা, এমনকি নিজস্ব ধর্মীয় বিষয়ে তারা ছিল অজ্ঞ। এ অনগ্রসরতা দূরীকরণের চেষ্টায় ‘মোহাম্মদী’ নামে একটি পত্রিকা বের হয়। মওলানা সাহেব এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি ‘মোহাম্মদী’কে ‘সাম্প্রদায়িক কাগজ হতে জাতীয় কাগজে পরিণত করেন।’ (অধ্যাপক মুহম্মদ মুনসুর উদ্দিন: ১৯৮৬ : ১৩৪)। পরে নিজ যোগ্যতায় তিনি পত্রিকার মালিকানা লাভ করেন। একসময় তার সম্পাদনায় একই অফিস হতে উর্দু ‘দৈনিক জামানা’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালের শেষ দিকে ‘দৈনিক সেবক’ নামে একটি বাংলা দৈনিক প্রকাশিত হয়। তখন জোরেশোরে ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন’ চলছে। সেই উত্তেজনার সময় তিনি ‘দৈনিক সেবকে’ একটি কড়া ব্রিটিশবিরোধী সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন।

 ফলে সেবকের জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়, প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং মওলানা আকরম খাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এ পরিস্থিতিতে সেবকের স্থানে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী দৈনিক মোহাম্মদীতে রূপান্তরিত হলো। চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে তত্কালীন মুসলমানদের মুখপত্র হিসেবে অবশেষে ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর ‘দৈনিক আজাদ’ আত্মপ্রকাশ করে। অল্প দিনের মধ্যেই ‘দৈনিক আজাদ’ বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ‘দৈনিক আজাদ’ পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। দেশ বিভাগ হওয়ার পর আরো এক বছর ‘দৈনিক আজাদ’-এর প্রকাশনা কলকাতা থেকেই হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ১৯ অক্টোবর সর্বপ্রথম ‘দৈনিক আজাদ’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।

প্রথমত. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এবং দ্বিতীয়ত. ১৯৪৭-পরবর্তী দেশ বিভাগ সময়কালে মওলানা আকরম খাঁ সংবাদপত্র জগতের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি এ দেশের নিপীড়িত মানুষের ধ্যান-ধারণা ও সুখ-দুঃখের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’, ‘দৈনিক জামানা’, ‘দৈনিক সেবক’ এবং অবশেষে ‘দৈনিক আজাদ’ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনা দান করে। মওলানা সাহেবের এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো একদল মেধাবী, পেশাগত এবং সৃজনশীল সাংবাদিক সৃষ্টি। যারা পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং অবশেষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।

মওলানা আকরম খাঁ উত্তরাধিকার সূত্রে উপনিবেশ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পরাধীন ভারতের গ্লানি দূর করার নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামে তিনি জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। কংগ্রেসের ভূমিকায় ক্রমে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ করে মুসলমানদের স্বার্থ অনুকূল ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। কিন্তু মওলানা সাহেব এ বিভক্তির বিরোধিতা করেন। মার্ক্সীয় দর্শন অনুযায়ী ‘অর্থনীতিই রাজনীতির নিয়ামক’। সম্ভবত কলকাতাকেন্দ্রিক পত্রপত্রিকা এবং পশ্চিম বাংলায় তাঁর সহায়-সম্পত্তি থাকার কারণে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। এ সময় প্রবীণ ভারতীয় নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দেশবন্ধু চিত্ররঞ্জন দাশের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর বিপরীতে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম লীগ’ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

 ১৯১৬ সালে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অবশেষে খেলাফত তথা তুরস্কের জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্ন হলে উপমহাদেশে সূচিত ‘খেলাফত আন্দোলনে’ আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের সহযোগী হিসেবে আকরম খাঁ গোটা ভারত পরিভ্রমণ করেন। ১৯২৪ সালে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এর দুই বছর পর ১৯২৬ সালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু হতাশাগ্রস্ত হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করেন। পরের বছর ১৯২৭ সালে ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির’ সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯২৯ সালে মতিলাল নেহরু প্রণীত রিপোর্ট মুসলমানদের স্বার্থের বিরোধী হওয়ায় মুসলিম লীগের সূচিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

 ১৯৩৫ সালে তিনি ‘বেঙ্গল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে’র সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ সালে সরাসরি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে স্যার ওয়াজিউর রহমানের ইন্তেকালের পর মওলানা আকরম খাঁ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি ওই সময়ের জটিল এবং দেশ বিভাগজনিত সমস্যাদি কুশলতার সঙ্গে অতিক্রম করেন। এ অতিক্রান্ত সময়ে তিনি সততা, নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সঙ্গে পাহাড় সমান সমস্যাদি মোকাবেলা করেন। মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ভাষায়, ‘মওলানা আকরম খাঁ অসামান্য মেধাসম্পন্ন একজন সাংবাদিকই নন, একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতাও। স্বাধীনতা-আন্দোলনের সময় তিনি যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জাতি তা কখনো ভুলতে পারে না’ (তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া: ১৯৮৬: ১৩৯)।

মওলানা আকরম খাঁ তার দীর্ঘ জীবনে সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন থাকেন। বাংলা ভাষা ছাড়াও তিনি আরবি, ফার্সিতে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ফার্সিতে কবিতা রচনা করতেন। তিনি স্ব-ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ দেখিয়েছেন। বাংলা ভাষায় তার অমর সৃষ্টি আল-কোরআনের অনুবাদ, হজরত মোহাম্মদের (সা.) জীবনী ‘মোস্তফা চরিত’, ‘সমস্যা ও সমাধান’, ‘মুসলিম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ ইত্যাদি। সাহিত্যে তাঁর ‘মোস্তফা চরিত’ ও ‘তাফছিরুল কোরআন’ সৌধতুল্য সাহিত্য কর্ম (মুজীবুর রহমান খাঁ: ১৯৮৬: ১১৬)।

 মওলানা সাহেবের আরো স্মরণীয় রচনার মধ্যে রয়েছে অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ— এছলামের রাজ্যশাসন বিধান, মুছলমানের জাতিত্ব ও সংস্কৃতি, এছলামের আদর্শ, হজরতের পাক-নবুয়ত সমাজসেবা এবং ব্যাক টু দ্য কোরআন। একজন ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে তিনি অনন্য অবদান রাখেন। এক্ষেত্রে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী ধারার প্রবর্তক। গতানুগতিকভাবে ব্যাখ্যা না করে তিনি ইমাম গাজ্জালির অনুসরণে যুক্তিবাদ অনুসরণ করেন। উদাহরণ হিসেবে মেরাজের ঘটনাকে তিনি শরীরী না বলে অশরীরী বা ‘মহান স্বপ্ন’ বলে ব্যাখ্যা করেন। অন্যদিকে ফেরাউনের নীল নদে ডুবে মৃত্যুবরণের ঘটনাকে ‘জোয়ার-ভাটা’র সঙ্গে তুলনা করে এ ঘটনাকে যৌক্তিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এতে ইসলামের ক্ল্যাসিকাল ব্যাখ্যাকারীরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে প্রগতিশীলরা তাঁর বক্তব্যকে নিছক ধর্মীয় বলে বাতিল করে দেয়। সাম্প্রদায়িক প্রতিপক্ষ তাকে ‘আক্রমণ খা’ বলে উপহাস করত। বস্তুত পক্ষে তিনি তাঁর সময় ও সমাজের তুলনায় বেশ অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন। একাডেমিক বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে ‘মুক্ত বুদ্ধির ধর্মীয় চিন্তাবিদ’ বলত (আবুল হাসেম : ১৯৮৬: ৬৭)।

মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন একজন মহান সংস্কারক। তিনি যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, তখন এদেশের মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছিল অনগ্রসর। একদিকে ব্রিটিশ শাসন, অন্যদিকে প্রতিবেশী অগ্রসর সম্প্রদায়ের বৈরী মনোভাব তাদের জন্য এক সংকটাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি করে। এমনকি মুসলমানরা তাদের স্বধর্ম সম্পর্কে অতটা সচেতন ছিল না। বিভিন্ন কুসংস্কার, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব তাদের জীবন ও ধর্মবোধকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। যেমন মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের অনুকূল ধারণা ছিল না। ছাত্রাবস্থায় তিনি বাংলায় সব শিক্ষা প্রচলনে উদ্যোগী হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের বিরুদ্ধে মওলানা আকরম খাঁ এবং তাঁর দৈনিক আজাদ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। সম্ভবত ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের চাপে তাদের এ ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে। মওলানা আকরম খাঁ বিশুদ্ধ ইসলামের অনুশীলনে উদ্যোগী হন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আঞ্জুমান-এ-উলামায়ে বাঙ্গালা’-এর মাধ্যমে তিনি মুসলিম জনগণকে যেমন রাজনীতি সচেতন করার চেষ্টা করেন, তেমনি ধর্মীয় কুসংস্কার মুক্ত করার চেষ্টা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘মাসিক আল-ইসলাম’ সঠিকভাবে ইসলামের ব্যাখা ও যুক্তি তুলে ধরেন।

মওলানা আকরম খাঁর বর্ণাঢ্য শতবর্ষব্যাপী জীবন ছিল বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর আত্মজাগৃতির ইতিহাস। সমকালীন শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘আলোকস্তম্ভ’ রূপে। ‘মওলানা সাহেবের বিরাট ব্যক্তিত্বরূপী সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিন্তানায়ক ও সমাজ সংস্করকের শ্রেষ্ঠ মহত্ গুণাবলির সমাবেশ ঘটিয়েছিল অপূর্ব সামঞ্জস্যে’ (আবুল মনসুর আহমদ: প্রাগুপ্ত)। তিনি অভিহিত হয়েছেন ‘মুসলিম বাংলার রেনেসাঁর অগ্রপথিক’, ‘বাঙ্গালী মুসলমানের রাজনৈতিক জনক’, ‘কিংবদন্তীর রাজা’, ‘বাংলা সাংবাদিকতার জনক’, ‘জীবন্ত ইতিহাস’, ইত্যাদি বিশেষণে। ইতিহাসে মওলানা আকরম খাঁর স্থান নির্ধারণে পুরনোরা আবেগাপ্লুত আর নবীনরা কুণ্ঠিত। মওলানা সাহেব নিজের স্থান নির্দেশ করেছিলেন নতুন-পুরনোর মাঝখানে। এক্ষেত্রে প্রফেসর আনিসুজ্জামানের উক্তিটি তাত্পর্যপূর্ণ: ‘প্রাচীনপন্থীদের তুলনায় মওলানা আকরম খাঁর ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল; আর আধুনিকদের তুলনায় তিনি ছিলেন রক্ষণশীল’ (প্রফেসর আনিসুজ্জামন: ১৯৮৬: ১৬৫)। প্রথিতযশা মার্কিন বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন, ‘Genius Is One Percent Inspiration, Ninety-Nine Percent Perspiration”। মওলানা আকরম খাঁ সম্পর্কে এ প্রবাদটি সর্বাংশে সত্য। অবশেষে কবি সুফিয়া কামালের ভাষায় প্রার্থনা— ‘জ্ঞানের সাধক তার মহত্ জীবনে/ গভীর সাধনালব্ধ সুচিন্তিত ধ্যানে/ যা কিছু পেয়েছে তারে ভরিয়া অঞ্জলি/ ছড়ায়ে দিয়েছে। সত্য প্রকাশে কেবলি/ প্রয়াস পেয়েছে বারবার/ স্রষ্টার অমৃত বাণী করেছে প্রচার/ যুগে যুগে সে বাণীর স্রোতধারা বয়ে/ কাল হতে কালান্তরে চলিবে/ তাহার স্মৃতি লয়ে’।

লেখক: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ            
   জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/107/মওলানা-আকরম-খাঁ--/

No comments:

Post a Comment