বিভাজনের পশ্চাৎপট বঙ্গভঙ্গ ১৯৪৭
সম্পাদনা : দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
বিংশ শতাব্দীতে বাংলা দু’বার ভাগ হয়েছে। ১৯০৫ সালে এবং তার ৪২ বছর বাদে ফের আর একবার। প্রথম বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালি বৰ্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠ অংশ মস্ত জাতীয়তাবাদী আন্দােলন গড়ে তোলেন, ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্রের উদ্গম ঘটে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের একটি সন্ত্রাসবাদী ধারাও বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্পন্দিত হয়। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ প্রভুরা সেই বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেন। জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা সেই বিজয় নিয়ে প্রচুর আনন্দ-আস্ফালন করেন।
একশো বছর পেরিয়ে যাবার পর, যা ইতিহাসচর্চায় অনিবার্য, কিছু কিছু নতুন ভাবনার সূত্রপাত হয়েছে। আখেরে বাঙালি হিন্দুদের সেই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দােলন প্রকৃত বিজয়ের সূচনা করেছিল কিনা, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। এমনকী অনেকে এমন কথাও বলছেন, বাঙালি হিন্দুরা পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের খর্পরে পড়ে যাওয়ার আতঙ্কবশত যে ধরনের আন্দােলনে নিজেদের নিযুক্ত করেছিলেন তার অন্তিম পরিণামেই কিন্তু চার দশক বাদে গোটা দেশটা ভাগ হয়ে গেল। স্বাধীনতা এল, একটি কদর্য ও বিষন্ন খণ্ডিত রূপ নিয়ে।
১৯৪৭ সালের দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ নিয়েও পুনর্বিবেচনা শুরু হচ্ছে, এটা আশার কথা। কারণ, এই অধ্যায়ের ইতিহাসের পর্যাপ্ত ও বিস্তৃত বিশ্লেষণ আজ পর্যন্ত তেমন হয়নি। উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুরা প্রথম বঙ্গভঙ্গ রুখে দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের কিন্তু তারাই প্রধান উদ্যোক্তা। অনেকে অবশ্য বলবেন, কগ্রেস নেতৃত্ব দেশভাগ মেনে নেওয়ার পর বাঙালি হিন্দুদের অন্য উপায় কিছু ছিল না। প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল তথা কলকাতা মহানগরী জুড়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় কিছুতেই ভারত থেকে বিচ্যুত হতে চাইছিলেন না।
তা হলেও স্বাধীনতার পর প্রায় সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও কিছু কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। এবারও কি বাঙালি হিন্দুরা একটু তড়িঘড়ি নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেননি? পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী হিন্দুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা কতটুকু ভেবেছিলেন? হয়ত অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল, তাহলেও শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাসিম সম্মিলিতভাবে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব করে যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন তা যতটা অধৈর্যের সাথে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তা নিয়েও সম্ভবত নতুন বিবেচনা প্রয়োজন। তাছাড়া, একথা অস্বীকার করাও মুশকিল হবে যে এতদিন পর্যন্ত যে ধরনের ইতিহাস রচিত হয়েছে সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনায় ও বিন্যাসে উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের ধ্যান-ধারণার প্রভাব যতটা লক্ষিত হয়, ইসলাম সম্প্রদায়ভুক্তদের বক্তব্য প্রতিতুলনায় অতি সংক্ষিপ্তরূপে বিধূত, কেউ কেউ বলবেন, বিকৃত রূপেও।
আমরা ইতিহাসকে নতুন করে গড়তে পারি না, কিন্তু মাঝে-মধ্যে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ভবিষ্যতের পথ নিরূপণের অবশ্যই সহায়ক হতে পারে। সেদিক থেকে বিচার করলে ‘বিভাজনের পশ্চাৎপট’ সংকলনটি একটি জরুরি সামাজিক কর্তব্য পালনের প্রয়াস। এই গ্রন্থের অন্তৰ্ভুক্ত প্ৰবন্ধগুলি হয়ত আলোচিত বিভিন্ন বিষয়ে শেষ কথা বলছে না, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোচনার প্রধান প্রধান সূত্রগুলি ধরিয়ে দিতে সাহায্য করছে। বেশ কিছু তথ্য যা প্রাচীন গ্রন্থাগার ও পুরনো সংবাদপত্রের শবাধারে শায়িত ছিল, নতুন করে তারা দৃষ্টিগোচর হল। আরো অনেক তথ্য সম্ভবত এখানে-ওখানে লুকিয়ে আছে। ‘বিভাজনের পশ্চাৎপট’ সংকলনটির প্রকাশন আশা করি সেইসব তথ্য উন্মোচনে উৎসাহ যোগাবে। গবেষণা চলুক, আলোচনা অব্যাহত থাক, পুরনো তর্কগুলি নতুন করে উত্থাপিত হােক। সামাজিক প্রজ্ঞা এই সমস্ত কিছু থেকেই প্রসারিত হবে। জ্ঞানচর্চার তাই-ই তো প্রধান লক্ষ্য, অন্তত তেমনটাই তো হওয়া উচিত।
সংকলনটিতে যে লেখাগুলো রয়েছে;
বিভাজনের পটভূমি - দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
বঙ্গবিভাগের কুশীলব - দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
বাংলায় লিগ রাজনীতি - পার্থপ্রতিম সেনগুপ্ত
বিভাগ-পূর্ব বাংলার কৃষিব্যবস্থা ও রাজনীতি - গৌতম রায়
দেশভাগ ও ভারতের কমিউনিস্ট পাটি - বিশ্বরূপ দাশগুপ্ত
বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের ছায়াপাত - তারক সরকার
বাঙালি ভাগ, বাংলা ভাগ এবং সাহিত্যচর্চা - মিহির সেনগুপ্ত
স্বাধীন বঙ্গের স্বপ্ন - দীপঙ্কর রক্ষিত
গোলাম সারওয়ার ও নোয়াখালির দাঙ্গা - গৌতম রায়
পূর্ব বাংলার পাকিস্তান প্রাপ্তি স্বাধীনতা’র প্ৰাথমিক উপলব্ধি ও জনগণের প্রতিক্রিয়া - ড. আহমেদ কামাল
ঘটনাক্রম (১৯০৫-১৯৪৭)
Amarboi.com
No comments:
Post a Comment