যদ্যপি আমার গুরু - আহমদ ছফা
উনিশশো সত্তর সালে বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা বৃত্তি নিয়ে পি.এইচ.ডি করার প্রচেষ্টা চলাকালীন সময়ে অধ্যাপক আব্দূর রাজ্জাকের সাথে আহমদ ছফার প্রথম পরিচয় । ১৮০০-১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্য,সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব ’ বিষয়ের উপর গবেষণার জন্য বন্ধুদের পরামর্শে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরিচয় এবং তারপর ক্রমেই অন্তরঙ্গতা । অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্নেহ ছায়ায় ও দীর্ঘ সহচরে থেকে তিনি তাঁর সম্পর্কে বলেছেন - দৃষ্টিভঙ্গির সচ্ছতা নির্মানে, নিষ্কাম জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মত আমাকে অন্য কোন জীবিত বা মৃত মানুষ অতো প্রভাবিত করতে পারেনি । লেখক এখানে সহজ স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে তার গুরু বলে অভিহিত করেছেন । কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে লেখক বলেন, প্রফেসর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসতে পারার কারনে আমার ভাবনার পরিমন্ডল বিস্তৃততর হয়েছে, মানসজীবন ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধতর হয়েছে । রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অগাধ পান্ডিত্যে মুগ্ধ লেখক আহমদ ছফা তার অতীত থেকে যেসব মূল্যবান বিষয় স্মরণ করতে পেরেছেন তা নিয়েই তিনি রচনা করেছেন যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থটি ।
খুব সাদামাটা পোশাকের অধিকারী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের তীক্ষèদৃষ্টি ও ঢাকাইয়া বুলি উচ্চারনের বৈশিষ্ট্য বাহ্যিকভাবে তাকে আলাদা বৈচিত্র্যর অধিকারি করে তোলে। আজীবন অকৃতদার এই অধ্যাপক তার ছোট ভাইয়ের স;সারে থেকে নিয়মিত জ্ঞানচর্চা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার প্রতি তার খুুব একটা আগ্রহ ছিলো না। ক্লাসে পাঠ দেয়া ও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদানে ছিলো তার অনীহা, কিন্তু তারপরও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছেন। হুকা টানা ও দাবা খেলার প্রতি ছিল তার বিশেষ দূর্বলতা। তবে সবচেয়ে বেশী দূর্বল ছিলেন তিনি বিলাস ভোজনে। এমনকি দেশের বাইরে গেলে সেখান থেকেও তিনি অন্তত একটা খাবার মেনু রান্না করা শিখতেন। দোকানের বই ও খাদ্যাভ্যাস দেখে ঐ জাতির সভ্যতার স্তর নির্নয় করার মতবাদ দিয়েছেন তিনি।আহমদছফা এই বইয়ে যেমন অধ্যাপক রাজ্জাকের গুণাবলী তুলে ধরেছেন তেমনি তার দূর্বলতাগুলোকেও অকপটে স্বীকার করেছেন।
উল্লেখ করার মতো হলো, তিনি স উচ্চারন করতে পারতেন না। স কে ছ উচ্চারণ করতেন। লেখার প্রতি তার ছিল অনীহা এব; স্বভাব অনেকটাই একরোখা। খানিকটা অহ;কারীও বটে।তবে সবচেয়ে বড় ক্ষমতা ছিল মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। এজন্য শুধু দেশেই নয় বিদেশেরও অনেক গুণীজন তার প্রতি বিশেষভাবে মুগ্ধ ছিলেন। ইলাস্টেটেড পত্রিকায় তাকে নিয়ে কভার ষ্টোরি করা হয় এব; তাকে বা;লার ডায়োজিনিস্ বলে অভিহিত করা হয়। হেনরী কিসিন্জারের মতো দক্ষ কুটনীতিবিদ বা;লাদেশে এসে তার সাথে সাক্ষাত করেন এব; তাকে নিজের সহকর্মী হিসেবে অবহিত করেন। সাহিত্যপ্রিয় এই মানুষটি ঠিলেন নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দিনের অন্ধ ভক্ত। কবি জসীমউদ্দিন তার কাজের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করবে বলে ভবিষ্যতবাণী করে দূরদৃষ্টির প্রমাণ দেন।তবে উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন বা;লা গদ্যর বিকাশ । আর এ ক্ষেত্রে ব্যাকরণ রচনার কারণেই সে রামমোহনের কৃতিত্বের কথা বলেন।
উনিশ শতকের মানুষ হিসেবে তিনি বিদ্যাসাগর কে অভিহিত করেছেন সি;হপুরুষ বলে।তবে বঙ্কিম, কেশব, দেবেন ঠাকুর কে দায়ী করেছেন রিভাইভিলিজম এর বিকাশের জন্য।বঙ্কিমকে সমালোচনা করেছেন মুসলমানের টাকায় লেখাপড়া করে সারা জীবন মুসলমদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য, বিদ্যাসাগরের উপর তার অভিযোগ স;স্কৃত বহুল বা;লা চর্চার কারনে। তার চোখে রবীন্দ্রনাথ একজন বড় লেখক,তবে বড় মানুষ নয়। তিনি অনুভব করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাখাতের চাইতেও অন্যক্ষেত্রে আরও বেশী অবদান রেখেছে।পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও বা;লাদেশের মুক্তি স;গ্রাম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিনটি অবদানকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের মন্ত্রীসভা থেকে বাদপড়া ও স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতিতে বিরোধীদলের উপর দমননীতির কারনে শেখ মুজিবের সমালোচনা করে তিনি বলেন- ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার সুযোগ দিছিল, তিনি এইডা কামে লাগাইতে পারলেন না।মাওলানা ভাসানীর পলিটিক্যাল অসুখ , মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সত্য কথা না বলার অভ্যাস প্রভৃতি মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনীতির এতটা অবস্থা তুলে ধরেছেন। ফজলুল হককে রাজনীতির দক্ষ সৈনিক বলে অভিহিত করেছেন।বা;লাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্র“টিপূর্ণ দিকগুলো উল্লেখ করে তিনি বলেছেন- অহন আমাগো দরকার শক্তিশালী মিডল স্কুল।
হেইদিকে কারও নজর নাই। বাস্তবঅর্থেও আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বাড়ছে। তবে শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় অনেক দূর্বল। এছাড়াও বা;লাদেশের অভিজাত ও গণমানুষের ভাষা ব্যবহারের মধ্যে বিশাল পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। দেশ ও সমাজের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকার থেকেই তিনি বদরুদ্দিন উমর সহ আরো অনেককেই দেশের জন্য কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন। বাঙালি মুসলমানদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে সাবালক করার পিছনে তার অবদান অসামান্য বলে লেখক দাবি করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের পশ্চাদপদতা ও হিন্দুদের আধিপাত্য বিস্তারের প্রবনতা প্রকট হলে ( এমনকি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের নাম সীমিত পরিশরে ব্যবহার করা হতো ) তিনি মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্টের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ঠিক একই ভাবে অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তিনি ১৯৭১ এ স্বাধীন বা;লাদেশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এসব কারনেই মুসলিম লীগের প্রতি বিশেষ ধরনের দূর্বলতা থেকে তিনি তার তৎকালীন পি.এইচ.ডি সুপারভাইজার অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কিকে বলেছেন, ’’আই অ্যাম এ মেমবার অব মুসলীম লীগ এন্ড এ ফলোয়ার অব জিন্নাহ”।
কিন্তু তিনি সা¤প্রদায়িক ছিলেন না। নিম্নবর্ণের হিন্দু চিত্রশিল্পী সুলতানকে (এস এম সুলতান) প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে তার অবদান অনেক। শুধু তাই নয়, বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তৈরী না হওয়ায় তাদের শান্তিপূর্ণ দীর্ঘকালীন সহাব¯থান নিয়েও স;শয় প্রকাশ করেছেন তিনি। এছাড়া লেখকের বর্ণনায় রাশিয়ার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লেলিনের অর্ন্তদৃষ্টি, রাশিয়ার শিল্প বিপ্লব, মার্কসীয় দর্শন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের দূরদর্শীতার প্রমান পাওয়া যায়।
যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থটি আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে সব্যসাচী লেখক অহমদ ছফার একটি গভীর ও সরস রচনা। দীর্ঘদিনের সান্নিধ্যের কারণে ব্যক্তিগত দূর্বলতা থেকে অধ্যাপক রাজ্জাক হয়তো লেখকের বিশেষ কিছু অনুভূতি দখল করেছেন তবে তাঁর প্রতি দেশ ও বিদেশের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির শ্রদ্ধার বর্হিপ্রকাশই প্রমান করে, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন কি;বদন্তী। অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে রচিত এই গ্রন্থটিতে সেই সময়ের সমাজ, সমকালীন বিশ্ব ও রাজনীতির যে বিষয়গুলো উম্মোচিত হয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ একটি সামাজিক দলিল। ইতিহাসের সহজ প্রকাশ।
Amarboi.com
No comments:
Post a Comment