Thursday 4 May 2017

আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণকারী, একজন সংস্কারক।


আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণকারী, একজন সংস্কারক।

আন্দালিব রাশদী |

  আবুল মনসুর আহমদ
নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইলি কোন আক্কেলে?
ব্যাপারটা বিংশ শতকের একেবারে শুরুর দিককার। আবুল মনসুর আহমদ নিতান্তই শৈশবে। বয়স নয় কি দশ বছর। কিন্তু বেশ টনটনে আত্মমর্যাদাবোধ। তাঁর নিজ বাড়ির গুরুজনরা তো বটেই। গ্রামের মুরব্বিরাও নায়েব-আমলাদের সঙ্গে কথা বলার সময় দাঁড়িয়ে কথা বলেন। তারা নায়েব-আমলার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও নায়েব তাদের তুমি সম্বোধন করেন।

 জমিদারদের এই চাকুরে নায়েব মনে করেন, তার অধিক্ষেত্রে বসবাসরত সকলেই অতি অধস্তন গ্রামের সকলের ওপর এবং সবকিছুর ওপর তার অবাধ কর্তৃত্ব— এটা কেবল বিশ্বাস নয়, এর চর্চা নিত্যই ঘটে থাকে। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর একটি আত্মজৈবনিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস ও ভাষ্যসংবলিত গ্রন্থে লিখেছেন।
কাছারির নায়েব আমলাদের বড়শি বাওয়ার শখ ছিল খুব। সারা গাঁয়ের মাতব্বর প্রজাদের বড় বড় পুকুরে মাছ ধরিয়া বেড়ানো ছিল তাদের অভ্যাস। অধিকারও ছিল। গ্রামের মাতব্বরদেরও এই অভ্যাস ছিল। নিজেদের পুকুর ছাড়াও দল বাঁধিয়া অপরের পুকুরে বড়শি বাইতেন তারাও। কিন্তু পুকুরওয়ালাকে আগে খবর দিয়েই তারা তা করিতেন। কিন্তু নায়েব-আমলাদের জন্য পূর্ব অনুমতি দরকার ছিল না। বিনা খবরে তারা যেদিন যার পুকুরে ইচ্ছা যতজন খুশি বড়শি ফেলিতে পারিতেন।

একদিন তারা আবুল মনসুর আহমদ পরিবারের পুকুরে সহজাত অধিকার খাটিয়ে বড়শি ফেললেন। অপর প্রান্তে বালক নিজে বড়শি ফেলেছেন। নায়েব-আমলার ছড়ানো চারে মাছ আকৃষ্ট হচ্ছে না কিন্তু বালকের বড়শি একটার পর একটা মাছ ধরেই চলেছে। উঁচুস্বরে নায়েব বাহু জিজ্ঞেস করলেন, তোর আধার কীরে?
এই ‘তুই সম্বোধন শুনে বালক ক্রুদ্ধ হলেন, তবুও ক্রোধ চেপে রেখে বললেন, চিড়া।
নায়েব তাঁকে বললেন, ‘আমাকে একটা দিয়া যা ত/’
বালকের জবাব, ‘আমার সময় নাই, তোর দরকার থাকলে নিয়া যা।’
পাল্টা তুই সম্বোধন সঙ্গত কারণেই নায়েব মহোদয় হজম করতে পারলেন না।
বালক আবুল মনসুরকে যখন নায়েবের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হলো তিনি বললেন: ওরা তাহলে মুরব্বিদের তুমি বলে কেন? কাজেই নায়েব বাবু আগে মুরব্বিদের কাছে মাফ চান।

বালকের কাছে অপদস্ত নায়েব-আমলা আর কখনো এই পুকুরে না আসার প্রতিজ্ঞা করে সঙ্গীদের নিয়ে মুখে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।
কিছুটা দুর্বীনিত এই বালকের কাহিনীটি ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ থেকে নেয়া।
প্রাক ১৯৪৭ বাংলা এবং সাতচল্লিশোত্তর পাকিস্তান রাজনীতির যে বৈশিষ্ট— শঠতা, জন-প্রতারণা, ভুয়া মেনিফেস্টো মিথ্যে আশ্বাস আবুল মনসুর আহমদ ভেতর থেকে দেখেছেন এবং অবলীলায় তা লিখে গেছেন। আবার এই রাজনীতির ভেতর থেকেই গণআন্দোলন এবং স্বাধীনতা লড়াই কেমন করে দানা বেঁধেছে তিনি তাও তুলে ধরেছেন।
আবার লরেন্স জিরিঙ্গ-এর থিসিস ‘বাংলাদেশের রাজনীতি জনকল্যাণের দিকে নির্দেশিত নয়, বরং তা ব্যক্তিগত ও দলীয় লাভ এবং ক্ষমতালাভের জন্য পরিচালিত’— এটিও যে ভ্রান্ত নয়, আবুল মনসুর আহমদ সে সাক্ষ্যও দেন।

দুই.
লিওন বাতিস্তা আলবের্তি (১৪০৪-৭২) স্থপতি, চিত্রশিল্পী, কবি, গণিতবিদ এবং দক্ষ ঘোড়সওয়ার; তিনি বললেন ‘a man can do all things it he will’ ইউনিভার্সাল ম্যান কিংবা রেনেসাঁ ম্যানের ধারণাটি এখানেই মানুষ চাইলে, করলে সবকিছুই করতে পারে। মহামতি গ্যেটেও বিশ্বমানবের ওপর জোর দিয়েছেন। ইউনিভার্সাল ম্যানের প্রধান উদাহরণ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) একজন মানুষকে একাধিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সুকৃতির স্বাক্ষর রাখতে হবে।

কথাসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ আমার প্রিয় মানুষ হলেও আমি তাঁকে বিবেচনা করেছি চারজন মানুষ হিসেবে। সাফল্য কমবেশি চারজনেরই। আলবের্তি যে কথা বলেছেন, যে মানুষের ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি সম্ভবত তা-ই।
আমি একজন আবুল মনসুর আহমদের মধ্যে যে চারজনকে পেয়েছি গুরুত্বের ক্রম অনুসারে তারা হচ্ছেন:
৪. একজন রাজনীতিবিদ যিনি মন্ত্রী এমনকি ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন।
৩. প্রাক ১৯৪৭ এবং উত্তর ১৯৭১-এর একজন বস্তুনিষ্ঠ রাজনীতিক ভাষ্যকার।
২. একজন সফল কথাসাহিত্যিক।
১. পূর্ব বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণকারী, একজন সংস্কারক।
যে চারজন আবুল মনসুর আহমদকে আমরা শনাক্ত করেছি, তাদের প্রত্যেকেই পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখেন।

প্রাক-১৯৪৭ এবং ১৯৪৭-উত্তর রাজনীতিতে তাঁর প্রধান ভূমিকা পলিটিক্যাল নিগোশিয়েটর ও পলিটিক্যাল ক্যাটালিস্ট হিসেবে। রাম-শ্যাম-যদু-মধুরা মন্ত্রী হয়েছেন, বটতলার উকিলরা হামেশাই শপথের ডাক পেয়েছেন। চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের ভয়ে তটস্থ থাকতেন মন্ত্রীদের কেউ কেউ। হীনমানের গণপ্রতিনিধি ছিলেন বলেই হয়তো আজিজ আহমেদ মোক্তার থেকে মন্ত্রী হওয়া একজনকে ‘হ্যালো মিস্টার মুকটিয়ার’ বলার ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছেন।
দলিলপত্রে ১৫-২০ জন স্বাক্ষরদাতার একজন হিসেবে কেউ কেউ আস্ফাালন করে বেড়ান, কিন্তু সাতচল্লিশোত্তর পাকিস্তানে তখনকার পূর্ব বাংলায় যে একুশ দফা রাজনীতির গতি ও ধারা পাল্টে দিল, তার অন্যতম প্রণেতা আবুল মনসুর আহমদ— এটি তেমন উচ্চারিত হয় না।
পাকিস্তান কেমন রাষ্ট্র হবে— তার স্পষ্ট ধারণা তিনি পাকিস্তান হাসিলের অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৪৪-এ আনুষ্ঠানিক সভায় সভাপতি হিসেবে তিনি বলেছিলেন:
‘পাকিস্তান দাবিটা প্রধানত কালচারাল অটনমির দাবি। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার চেয়ে কালচারাল অটনমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই দিক হইতে পাকিস্তানের দাবি শুধু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক দাবি নয়, এটা গোটা ভারতের কালচারাল মাইনরিটির দাবি। ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দু হইতে আলাদা জাত তো বটেই, বাংলার মুসলমানরাও পশ্চিমা মুসলমানদের হইতে পৃথক জাত। শুধুমাত্র ধর্ম জাতীয়তার বুনিয়াদ হইতে পারে না।’
১৯৭১-এর রক্তাক্ত সংগ্রাম এ থিসিসটিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর রচনা কোনো সাহিত্যিকের কাজ নয়, রাজনীতিবিদেরও নয়, সাবেক কোনো মন্ত্রীরও নয়। এ কাজটি অনুসন্ধিত্সু একজন মানুষের, যিনি সাংবাদিকও এবং ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর প্রেক্ষাপট যার জানা।
আবুল মনসুর আহমদ আসলে সময়ের ভাষ্যকার। তিনি সময়ের ইতিহাস লিখেছেন, নিজস্ব টীকা-টিপ্পনীসহ। তাঁর আত্মকথার একাংশও এই গ্রন্থের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এটি একটি আকর গ্রন্থ। বাংলাদেশের শতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস হোক কি কেবল গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস হোক, সূত্রগ্রন্থ হিসেবে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ কাছে না পেলে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
এক জীবনে এমন একটি বই-ই যথেষ্ট।
তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা দাবি করে।

পূর্ব-বাংলা কিংবা বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতে যে বাংলা এবং ইসলাম— দুই মিশে আছে জোর গলায় আবুল মনসুর আহমদই তা বলেছেন। বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ ‘ইসলাম-শাঁই’ লজ্জা পেত এবং পান। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা যখন ধুতি ছেড়ে দিয়েছেন বাঙালি হওয়ার জন্য, ধুতি পরে তাদের কেউ কলকাতার পত্রিকা অফিস ঘুরে এসেছেন। আবার তারা প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হজ ডেলিগেশনের প্রতিনিধি হয়ে মক্কা শরিফ পৌঁছতে পারেন তো, হজরে আসওয়াদ একাই চুম্বনে চুম্বনে ভরে ফেলেন।
আবুল মনসুর আহমদ এই ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেননি।

তিন.
গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের অভাব কী, ভাই পাকিস্তানের অভাব কী? দিনাজপুরের চিকন চাল, ঢাকায় আছে গাওয়া ঘি— এ ধরনের ছড়া কিংবা গান হামেশাই শোনা যেত। এটি সম্ভবত কবি গোলাম মোস্তফার রচনা (ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশনের পাঁচ হাজারি দশ হাজারি বিল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে তকমাপ্রাপ্ত কেউ কেউ সানন্দে গ্রহণ করেছেন।) এই ছড়া কিংবা গানটির প্যারোডি বের হতে তেমন সময় লাগেনি। ‘পাকিস্তানের অভাব কী, ভাই পাকিস্তানের অভাব কী? ঢাকায় আছে গোলাম কবি পাকিস্তানের অভাব কী?’ সরকার-ভজা উঞ্ছজীবী কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর কমতি স্বাধীন বাংলাদেশেও নেই। গোলামির প্রতিযোগিতাই যখন মুখ্য, গোলাম কবি, গোলাম ঔপন্যাসিক, গোলাম প্রবন্ধকার এই ডামাডোলে আবুল মনসুর আহমদকে কে কবুল করত?

হালে শত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী বনাম সহস্র বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর শোডাউন দেয়ার সুযোগ কেউ পেয়েছেন, কেউ শুনেছেন, আগাছা-সুফলা দেশে সাকল্যে এগারশ বুদ্ধিজীবী বেঁচে থাকলে আবুল মনসুর আহমদকে এগারশ-র বাইরের একজন হিসেবে টিকে থাকতে হতো। ‘হুজুর কেবলা’র মতো আখ্যান পাঠের পর শতকিয়া বুদ্ধিজীবীরা আবুল মনসুর আহমদকে দলভুক্ত করার চেষ্টা করবেন বলে মনে করার কারণ নেই। আবার ‘ফুড কনফারেন্স’সহ তা রাজনীতিক ভাষ্য পাঠের পর হাজারি দল দলভুক্ত করার জন্য এই বিভীষণকে আমন্ত্রণ নিশ্চয়ই জানাতেন।
বেেঁচ থাকলে আবুল মনসুর আহমেদ হতেন হাতেগোনা কজন বুদ্ধিজীবীর একজন, যারা হাজার একশতে নাম লেখাননি।

আবুল মনসুর আহমদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা কমই হয়েছে। যারা করেছেন তাদের অনেকেই তার সাহিত্যকর্মে ‘ব্যঙ্গ’ ছাড়া আর তেমন কিছু খুঁজে পাননি। প্রযুক্তির কল্যাণে ইউটিউবে কয়েকটি আলোচনা অনুষ্ঠানে কেবল ‘ব্যঙ্গ গল্পকার’, ‘ব্যঙ্গ লেখক’ শুনে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। আবুল মনসুর আহমদ মোটেও ব্যঙ্গ লেখক নন। ব্যঙ্গ  ও শ্লেষ তিনি কখনো কখনো ব্যবহার করেছেন তার ভাষাকে বহন করার জন্য। তার কাহিনীকে পাঠকের কাজে ত্বরিত পৌঁছে দেয়ার জন্য এবং ব্যঙ্গত্মক চিত্রকল্প আমাদের কার কী অবস্থান তা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।

চার বিবির ভজনা
‘হুজুর কেবলা’ পাকিস্তান আমলে পাঠ্যবইতে ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ‘হুজুর কেবলা’কে খারিজ করেছেন সম্ভবত আপন দলের লেখকদের শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য। আবুল মনসুর আহমদ আপন দলের নন।

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালশালু’ (১৯৪৮-এ প্রকাশিত) নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে একটি উজ্জ্বল মাইলফলক। কিন্তু মোল্লাতন্ত্র ও লেবাসধারীদের ধর্মব্যবসা নিয়ে আরো প্রায় দুই দশক আগে যে সাহসী রচনা আবুল মনসুর আহমদ প্রকাশ করেছেন, এ কালের ‘শতকিয়া’ ও ‘হাজারি’ বুদ্ধিজীবীদের কেউ সে সাহস দেখাতে পারেন। ব্যঙ্গ ও শ্লেষ ব্যবহার করে হুজুরের মুখোশ উন্মোচনের হুজুর কেবলা ও বাংলা গল্পের একটি উজ্জ্বল মাইলফলক।

এমদাদ নামের যে চরিত্রটি কলেজ ম্যাগাজিনে জন স্টুয়ার্ট মিল, ডেভিড হিউম হার্বার্ট স্পেনসার এবং অগাস্ত কোতের ভাব চুরি করে অনেকবার খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করেছে, খোদার আরশ, ফেরেশতা, ওহি এবং হজরতে মেরাজ নিয়ে সারাক্ষণ হাসি-ঠাট্টা করেছে খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে বৃহত্তর অসহযোগে যোগ দিল। সিল্কের শার্ট ব্রাউন রঙের পামসু, চশমা, রিস্টওয়াচ, শেভিং স্টিক ও ব্রাশ, ক্ষুর, সোনার আংটি, টুথক্রিম ও টুথব্রাশ সব বিসর্জন দিয়ে কিছুকাল পর দেড় ইঞ্চি ঝাঁকড়া দাড়ি, সামনে-পেছনে সমান করে কাটা চুল, মাথায় গোল ন্যাকড়ার মতো একটি টুপিতে কান পর্যন্ত ঢেকে চটি জুতা পায়ে যখন বাড়ি রওনা হলো, পথে বহুলোক তাকে সালাম দিল।
এমদাদ ভাবল, ... ‘কলিযুগেও দুনিয়ার ধর্ম আছে।’
বুকের ভেতর হাহাকার নিয়ে এমদাদ অগত্যা ‘নামাজে বসিয়া খোদার নিকট হাত তুলিয়া কাঁদিবার বহু চেষ্টা করিল। চোখের পানির অপেক্ষায় আগে হইতে কান্নার মতো মুখ বিকৃত করিয়া রাখিল। কিন্তু পোড়া চোখের পানি কোনো মতেই আসিল না।’

গভীর রাত পর্যন্ত ‘এলহু’, ‘এলহু’ জিকির করা জনৈক পীরের স্থানীয় খলিফা সুফি সাহেবের শরণাপন্ন হওয়ার পর তিনি এমদাদের যে গোড়াতেই গলদ তা ধরে ফেললেন এবং বললেন, ‘পীর না ধরিয়া কি কেহ রুহানিয়াত্ হাসিল করিতে পারে?’ আরবি ও উর্দুতে হাদিস বয়ান করে মক্কেলের সুবিধার্থে বাংলায় বললেন, ‘জয্য়া ও সলুক খতম করিয়া ফানা লাভে সমর্থ হইয়াছেন এরূপ কামেল ও মোকাম্মেল, সালেক ও মজযুব পীরের দামন না ধরিয়া কেহ জমিরের রওশনি ও রুহের তরক্কি হাসেল করিতে পারে না।’
পীরের সামনে এমদাদ যখন হাজির হলো, দেখল পীরের মেহেদি রঞ্জিত দাড়ি-গোঁফের ভেতর দিয়ে পীর সাহেবের মুখ থেকে জ্যোতি বিকীর্ণ হচ্ছে।
ক’দিনের মধ্যেই এমদাদ আবিষ্কার করল পীর সাহের যথেষ্ট ভোজনরসিক এবং নারীতেও আসক্তি প্রবল। ‘পীর সাহেবের রুহানি শক্তি যত বেশিই থাকুক না কেন, তাঁর হজমশক্তি নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি।’
এশার নামাজের পর দাড়িতে চিরুনি এবং পোশাকে আতর লাগানো সুন্নত আর পীর সাহেব সুন্নতের বড় মো’তেকাদ।
ওয়াজ করার সময় পীর সাহেবের কাছে জয্বা আসতক, মুরিদদের ভাষায় এটাই ফানাফিল্লাহ।

তারপর?
আবুল মনসুর আহমদ তার অনুকরণীয় ভাষায় লিখলেন :
   এই ফানাফিল্লার সময় পীর সাহেব ‘জ্বলিয়া গোলাম’, ‘পুড়িয়া গেলাম’ বলিয়া চিত্কার করিয়া শুইয়া পড়িতেন। এই সময় পীর সাহেবের রুহ আলমে-খালক হইতে আলমে-আমার পৌঁছিয়া রুহে ইয়দানির সঙ্গে ফানা হইয়া যাইত এবং নূরে ইয়াদানি তাঁর চোখের ওপর আসিয়া পড়িত। কিন্তু সে নূরের জলওয়া পীর সাহেবের চক্ষে সহ্য হইত না বলিয়া তিনি এইরূপ চিত্কার করিতেন। তাই জযবার সময় একখণ্ড কালো মখমল দিয়া পীর সাহেবের চোখ-মুখ ঢাকিয়া দিয়া তাঁর হাত-পা টিপিয়া দিবার ওসিয়ত ছিল।
এই ঘটনা প্রায়ই ঘটত, বিশেষ করে জেনানা মহলে ওয়াজ করার সময় বেশিই হতো। পীর সাহেবের নেক নজর পড়েছে তারই মুরিদের ছেলে রজবের স্ত্রী কলিমনের ওপর।

কেরামতির ওপরই পীরের খ্যাতি ও মুরিদের ভক্তি ও সংখ্যাবৃদ্ধি নির্ভর করে। পীর সাহেব এবার মোরাকাবার তরকির দেখাবেন। তার প্রধান খলিফা সুফি সাহেবের রুহে শেষ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদের রুহ মোবারক নাজিল করার কেরামতি দেখাবার জন্য আগরবাতি, মেশক, জাফরান ও আতরের গন্ধে ম-ম করা দরবার কক্ষে বোতাম খুলে বুকের খানিকটা অংশ ফাঁক করে পবিত্র রুহ প্রবেশের পথ করে দেয়া হলো।
পবিত্র রুহ উপস্থিত হলে প্রধান খলিফা সুফি সাহেবের কম্পমান শরীর এক সময় মূর্ছিতের মতো লুটিয়ে পড়ল। সেই দেহ থেকে নবী-কণ্ঠ শোনা গেল, পীর সাহেবের শরিয়ত করে মারফত সন্ধান অর্থহীন।

কিন্তু শরিয়ত অবহেলার প্রশ্ন আসছে কেন?
আবারো পয়গম্বর কণ্ঠ সক্রিয় হয়ে উঠল:
অবহেলা কর নাই, কিন্তু পালনও কর-নাই। আমি শরিয়তে চার বিবি হালাল করিয়াছি। কিন্তু তোমার মাত্র তিন বিবি। যারা সাধারণ দুনিয়াদার মানুষ তাদের এক বিবি হইলেও চলিতে পারে। কিন্তু যারা রুহানি ফয়েজ হাসিল করিতে চায়, তাদের চার বিবি ছাড়া উপায় নাই। আমি চার বিবির ব্যবস্থা কেন করিয়াছি তোমরা কিছু বুঝিয়াছ? চার দিয়াই এ দুনিয়া, চার দিয়াই আখেরাত। চারদিকে যা দেখ, সবই খোদাতায়ালা চার চিজ দিয়া পয়দা করিয়াছেন। চার চিজ দিয়া খোদাতায়ালা আদম সৃষ্টি করিয়া তার হেদায়েতের চার কিতাব পাঠাইয়াছেন। সেই হেদায়েত পাইতে হইলে মানুষকে চার ইমামের চার মযহাব অনুসারে চার তরিকা মানিয়া চলিতে হয়। এভাবে মানুষকে চারের ফাঁদে ফেলিয়া খোদাতায়ালা চার কুরসির অন্তরালে লুকাইয়া আছেন। এই চারের পরদা ঠেলিয়া আলমে-আমার নূরে-ইজদানিতে ফানা হইতে হইবে, দুনিয়াতে চার বিবির ভজনা করিতে হইবে।
তারপর কিছুক্ষণ পীর সাহেব ও পয়গম্বর রাসুলুল্লাহর পবিত্র রুহের মধ্যে বাহাস চলতে থাকে।

 আল্লাহ-রাসূল ও ধর্মকে ব্যবহার করে পীর সাহেব মুরিদপুত্রের স্ত্রী কলিমনে উপগত হওয়ার প্রস্তুতি নেন। গল্পকার লিখছেন কলিমনের ঘন-ঘন মূর্ছার মধ্যে অতিশয় ত্রস্ততার সঙ্গে শুভকার্য সমাধা হইয়া গেল। এমদাদ স্তম্ভিত হইয়া বরবেশে সজ্জিত পীর সাহেবের দিকে চাহিয়া ছিল। তার চোখ হইতে আগুন ঠিকরাইয়া বাহির হইতেছিল।
ততক্ষণে খেলাফতিতে যোগ দেয়া এমদাদের সম্বিত ফিরেছে। হঠাত্ পরিবর্তিত এই মানুষটি এক লাফে মঞ্চে উঠে বরাসনে উপবিষ্ট হুজুর কেবলার মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি ধরে হেঁচকা টানে মেরে বলল: ‘রে ভণ্ড শয়তান! নিজের পাপ-বাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিল না?’
অমনি মার মার করে পীরের মুরিদ ও সাগরেদরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভূলুণ্ঠিত পীর সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে আসতাগফেরুল্লাহ পড়ে দাড়িতে আঙুল চালনা করে সম্ভবত চতুর্থ স্ত্রী লাভে শুকরিয়া আদায় করছিলেন।
হুজুর-কেবলার  মতো স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ, শিল্পসম্মত গল্প বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই।

ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্যের কমতি নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বক্তব্যদাতাদের অনেকের ভেতরেই কোনো না কোনো আদলে একজন হুজুর কেবলা বাস করেন, তাদের কীর্তি হুজুরের সাগরেদ-মুরিদদের মতো জনগণও কমবেশি জানে। সেজন্য এসব বক্তব্যের প্রভাব অতি সামান্যই।
আমরা সম্ভবত লিবারেশনের আগে বেশি লিবারেল ছিলাম, আবুল মনসুর আহমদ তাই মুরতাদ ঘোষিত হননি। গল্প লেখার জন্য অন্তত রাষ্ট্রীয় ‘টিকটিকি’ তাকে হেনস্তা করেনি। ‘হুজুর কেবলা’ হোক না আবার নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্য! মানুন আর নাই মানুন, ‘হুজুর কেবলা’ একটি ধ্রুপদ কাহিনী।
‘আদু ভাই’-এর কথা মনে পড়ে? তিনি বরাবর ক্লাস সেভেনেই পড়তেন। স্কুলের শিক্ষকদের কারো কারো তিনি সহপাঠী ছিলেন। আটাত্তর বছর আগে প্রকাশিত আবুল মনসুর আহমদের ‘আদু ভাই’ গল্পটি আদু ভাই-এরই গল্প? আমাদের নয়?
প্রযুক্তির মহাসড়কে পা দিয়েও আমরা মানুষ হিসেবে প্রমোশন পাচ্ছি না কেন? অনতিক্রম্য ক্লাস সেভেনেই রয়ে যাচ্ছে। আদু ভাই অন্তত ভালো মানুষ ছিলেন, আমরা হীন মানুষই রয়ে গেছি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/95/আবুল-মনসুর-আহমদ--/

No comments:

Post a Comment