Thursday 25 May 2017

বাংলা সিনেমার নজরুল



বাংলা সিনেমার নজরুল
আহমাদ মাযহার |
ধ্রুব (১৯৩৪)ছবিতে নবীন নারদের ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম
……
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নানাদিক-অভিমুখী সৃষ্টিমাতাল এক মানুষ। ভারতবর্ষের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের এমন এক যুগে তাঁর জন্ম যখন এ-অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সবে জেগে উঠতে শুরু করেছে। ইহজাগতিকতা ও মানবিকতার বোধ, অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা, তীব্র আত্মজাগরণাকাঙ্ক্ষা ও সিসৃক্ষার উদ্দীপনা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য তখন বাংলাদেশের বেশ কিছু মানুষের মধ্যেই স্ফুরিত হয়েছিল। সকলেই হয়তো স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার তুঙ্গকে স্পর্শ করতে পারেন নি, জীবনের সামগ্রিক সংগ্রামের চিহ্নও হয়তো উজ্জ্বলিত হতে পারে নি তাঁদের কারও কারও
—————————————————————–
রবীন্দ্রনাথের গান সঠিক সুরে গাওয়া হয়নি এই মর্মে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুমোদন বোর্ড গোরা (১৯৩৮) ছবিটি সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছিল। ফলে ছবি মুক্তির ব্যপারে সৃষ্টি হয়েছিল জটিলতা।… নজরুল কিছুমাত্র চিন্তা না করে ছবির ফিল্ম এবং প্রজেক্টর নিয়ে সোজা বিশ্বভারতীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কী-কাণ্ড বল তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন্‌ আক্কেলে তার দোষ ধরে। তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানে মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’ নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি খসড়া অনুমোদনপত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলেন।
—————————————————————-
জীবনে। কিন্তু স্বীকার করতে হবে যে এই অঞ্চলের বেশ কিছু ব্যক্তিমানুষের মধ্যে উপর্যুক্ত মানবিক বোধসমূহের জাগরণ দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছিল। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সেইসব মানুষদের মধ্যেও অগ্রগণ্য। বাংলার রেনেসাঁসের উপর্যুক্ত প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো বিপুলভাবে সমাহৃত হয়েছিল নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবনে। সামগ্রিকভাবে নজরুল সম্পর্কে এ-কথা মনে রাখলে আমাদের পক্ষে অনুভব করতে সুবিধা হবে চলচ্চিত্রের মতো নতুনতর শিল্পমাধ্যমে তাঁর যুক্ত হবার সূত্রকে।

সবাক চলচ্চিত্রের সূচনাকালের অর্থাৎ নজরুল যে-সময়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সে-সময়কার যে কোনও চলচ্চিত্র দেখতে বসলে আজকের চলচ্চিত্র দর্শকরা হয়তো অনুভব করবেন যে, তখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্র তার নিজস্ব ভাষা অর্জন করতে পারে নি। প্রেমাংকুর আতর্থী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো বাংলাভাষার শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকদের কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে নানা ভাবে যে যুক্ত ছিলেন সে-কথাও প্রসঙ্গত উল্লিখিত হতে দেখা যায়। নজরুলের যুক্ততাও তাঁদেরই সমসাময়িক কালে। কিন্তু আশির দশকের বা তার আগের লেখা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসধর্মী বইগুলোতে নজরুলের যুক্ততার কথা তেমনভাবে উল্লিখিত হতে দেখা যায় না। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের গবেষকবৃন্দ মূলত বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার তথ্যগুলো উদ্ঘাটন করেছেন। প্রসঙ্গত নজরুল গবেষক আসাদুল হক এবং অনুপম হায়াৎ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার সকল না হলেও অধিকাংশ খবর তাঁরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান প্রবন্ধের তথ্যভিত্তিও মূলত এই দুই নজরুল-গবেষকের বই কিংবা রচনাসমূহ।

চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার কালে ছবিতে বাস্তবতার অভাব ছিল, চিত্রনাট্য ছিল শিথিল, সংলাপ একদিকে ছিল আড়ষ্ট, অন্যদিকে সেকালের মঞ্চঘেঁষা। বেশ কিছু ছবি পাওয়া যায় যেগুলো হলিউডের অনুকরণে নির্মিত। সামাজিক ছবি, পৌরাণিক ও ধর্মমূলক ছব—সত্যজিৎ রায়ের মতে সে-সময়ের চলচ্চিত্র ছিল প্রধানত এই তিন রকম। কমবেশি এই তিনধরনের ছবির সঙ্গেই নজরুল যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ লেখক, সংগীতকার, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, গায়ক ও সংগঠক ইত্যাদি বিচিত্র ক্ষেত্রে। তবে প্রধানত যুক্ত ছিলেন সংগীতকার হিসাবেই। মনে রাখতে হবে যে, উনিশ শো বিশ তিরিশের দশকে বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলা গানের রেকর্ড বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে নজরুল ছিলেন রীতিমতো ঐ জগতের তারকাখ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তখনকার সেরা শিল্পীদের গ্রামোফোনের জন্য গান শেখাচ্ছিলেন তিনি। বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর লেখা ও সুরকরা গানের তখন তুমুল জনপ্রিয়তা। চলচ্চিত্রে তখন সবেমাত্র শব্দ যোজনার কারিগরি সুবিধা যুক্ত হয়েছে। নির্মাতারা চলচ্চিত্রে সংগীত সংযোজন করার মধ্যে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তা ছাড়া সেকালে কলকাতা কেন্দ্রিক পেশাদার নাট্যচর্চাও বিনোদনপ্রত্যাশীদের কাছে ছিল আদরণীয়। নজরুল নিজে নাট্যকার তো ছিলেনই, পেশাদার নাট্যচর্চার সঙ্গেও সংগীতসূত্রেই কিছুটা যুক্ততা ঘটেছিল তাঁর। চলচ্চিত্র নতুন শিল্পমাধ্যম হলেও নজরুলও তাঁর সৃষ্টিশীলতার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দেখতে পেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের নিকটসম্পর্ককে। সংগীত এবং নাটকে তাঁর সৃষ্টিশীলতা যে চলচ্চিত্রের কাজে আসবে তা নজরুল অনুভব করেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব হয়েছিল। শেখ দরবার আলম [অজানা নজরুল, ঢাকা (১৯৮৮)] উদ্ধৃত কলকাতার বঙ্গবাণী পত্রিকায় ১৯৩১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে আমরা জানতে পারি যে ম্যাডান থিয়েটার্সে চলচ্চিত্রের জন্য নজরুলকে সুরভাণ্ডারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সুরভাণ্ডারীর দায়িত্ব সংগীত পরিচালকের চেয়ে ওপরের স্তরের। সুরভাণ্ডারী হিসাবে তাঁর দায়িত্ব কী ছিল সে সম্পর্কে বঙ্গবাণীর সংবাদে আমরা জানতে পারি যে,

[…] ম্যাডান থিয়েটারস লিমিটেড বাঙ্গালা গানের টকি নির্মাণ করিতেছেন। প্রসিদ্ধ কবি ও সঙ্গীতকার নজরুল ইসলামকে সুর-ভাণ্ডারী নিযুক্ত করিয়াছেন। তাঁহাদের এ মনোনয়ন যথার্থ হইয়াছে, কারণ অধুনা বাঙ্গালার তরুণ কবিদের মধ্যে নজরুল ইসলাম রচয়িতা ও সুরকার হিসেবে শ্রেষ্ঠ। বর্তমানে কিছুকাল ম্যাডান কোম্পানী নট-নটীদের সুর পরীক্ষার জন্য কেবল গান-আবৃত্তির সবাক চিত্রই নির্মাণ করিবেন। পরে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি তাঁহারা সবাক করিয়া তুলিবেন বলিয়া শুনা যাইতেছে।
[দৈনিক বঙ্গবাণী, ৯ ফাল্গুন, ১৩৩৭, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১, কলকাতা]
সুরভাণ্ডারী পদে নজরুলকে নিয়োগ দেবার পর ১৯৩১ সালের প্রথম দিকেই ম্যাডান থিয়েটার্সের উদ্যোগে আনুমানিক তিরিশ চল্লিশটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল বলে আসাদুল হক এবং অনুপম হায়াৎ জানাচ্ছেন। বিভিন্ন সূত্রে ১৯৩১ সালে ম্যাডান থিয়েটার্স নির্মিত সবাক খণ্ড চিত্রগুলির মধ্যে কয়েকটির নামও পাওয়া গেছে। নাম জানা গেছে যে-সব ছবির সেগুলো হচ্ছে: ১. জামাই ষষ্ঠী ২. জোর বরাত ৩. ঋষির প্রেম ৪. তৃতীয় পক্ষ ৫. প্রহ্লাদ ৬. লায়লো। বঙ্গবাণীর সংবাদভাষ্যকে বিবেচনায় রাখলে সুরভাণ্ডারী হিসাবে এই ছবিগুলোর সঙ্গে নজরুলের যুক্ত থাকবার কথা। কিন্তু ছবিগুলোর সঙ্গে নজরুল কতটা যুক্ত ছিলেন সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত তথ্য এখনও জানাতে পারেন নি। অনুপম হায়াৎ ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত তাঁর চলচ্চিত্র জগতে নজরুল (১৯৯৮) বইয়ে লিখেছেন,

[…] কালীশ মুখোপাধ্যায় ও গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ বা অন্য কোন চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ ম্যাডান থিয়েটার্স কর্তৃক নির্মিত পরীক্ষামূলক সবাক খ-চিত্রে নজরুলের অংশগ্রহণ সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেন নি।
অনুপম হায়াৎ তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ে আরও জানাচ্ছেন ১৯৩৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল পায়োনীয়ার ফিল্ম কোম্পানির ফিল্ম ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। এ সংবাদ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত সওগাত পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল। অনুপম হায়াৎ সওগাত পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৮১, ঢাকা পত্রিকায় প্রকাশিত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘সওগাত ও নজরুল’ রচনার উদ্ধৃতি দেন। ঐ রচনায় উদ্ধৃত সওগাত-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল:

[…] কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ইনি সমপ্রতি পায়োনীয়ার ফিল্ম কোম্পানীর ফিল্ম ডিরেক্টার নিযুক্ত হইয়াছেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইতিপূর্বে আর কেহ ছায়াচিত্র জগতে এরূপ উচ্চ পদের অধিকারী হন নাই। আমরা কবিকে তাহার এই সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি।
তবে অশোককুমার মিত্রের লেখা ঢাকা থেকে প্রকাশিত নজরুল প্রতিভা পরিচিতি (১৯৬৯) বইয়ের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তাঁর লেখা পূর্বোক্ত বইয়েই অনুপম হয়াৎ আরও জানাচ্ছেন:

[…] ১৯৩১ সালের অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক সাফল্য লইয়া যখন সবাকচিত্র সর্বপ্রথম কলকাতায় চিত্রগৃহে আত্মপ্রকাশ করে এবং যখন কেবলমাত্র সংক্ষিপ্ত নমুনামূলক বাংলা সবাকচিত্র ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড কর্তৃক পরিবেশিত হয়; তখনই আমরা দেখিয়াছি সবাকচিত্রের মাধ্যমে কাজী নজরুলকে বলিতে শুনিয়াছি তাহার উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তি:
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ ও নারী
কোন ভেদাভেদ নাই।
বাংলা সবাক ছায়াচিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ইহার পরে ১৯৩৪ সালে পায়োনীয়ার ফিল্মের পূর্ণদৈর্ঘ্য ধ্রুব সবাকচিত্রেও তাহাকে এক সঙ্গীত মুখর ভূমিকায় দেখা গিয়েছে।

যে-কটি চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার কথা আসাদুল হক এবং অনুপম হায়াৎ তাঁদের বইয়ে বা বিভিন্ন প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন সেগুলোর নাম নিচে দেয়া হল। সেই সঙ্গে দেয়া হল নজরুল কীভাবে যুক্ত ছিলেন তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
১. কপালকুণ্ডলা (১৯৩৩) ছবিতে নজরুল যুক্ত ছিলেন গীতিকার হিসাবে।
২. ধ্রুব (১৯৩৪) ছবিটির অন্যতম পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম; ছিলেন অন্যতম গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক। ছবিটি যেহেতু গান নির্ভর সেহেতু নজরুলের ভূমিকা ছিল এখানে ব্যাপক। ছবিতে ব্যবহৃত মোট ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গানই ছিল নজরুলের লেখা, ১টি গিরিশচন্দ্র ঘোষের, নজরুল নিজে ৩টি গান গেয়েছিলেন, একটি মাস্টার প্রবোধের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। বোধ হয় এই চলচ্চিত্রে নজরুলের নারদের ভূমিকায় অভিনয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলতে হবে। মুসলমান হয়েও নারদের ভূমিকায় নজরুল অভিনয় করে পরিচয় দিয়েছিলেন সাহসের। কারণ তখন মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক কারণে ও ধর্মীয় গোঁড়াদের ভয়ে চলচ্চিত্রে অংশ নিতেই ছদ্ম হিন্দু নামের আড়াল নিতেন। অনুপম হায়াতের মতে: ধ্রুবর মাধ্যমে নজরুল বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম চলচ্চিকার হিসাবে আবির্ভূত হন। খগেন্দ্রনাথ রায়কে উদ্ধৃত করে তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ে অনুপম হায়াৎ আরও জানাচ্ছেন:

[…] ধ্রুব ছবির অভিনয়ে নজরুল নতুনত্ব এনেছিলেন নারদ চরিত্রের মেকআপে। তিনি অশীতিপর নারদকে আটাশে নামিয়ে আনেন, পোশাকও বদলে ফেলেন। নজরুলের এই বিদ্রোহ ও নরনারদী রূপ নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন মহলে তুমুল সমালোচনা হয়। কিন্তু নজরুল তাঁর যুক্তি দিয়ে বলেছেন, আমি চিরতরুণ ও চিরসুন্দর প্রিয় নারদের রূপই দেবার চেষ্টা করেছি।
৩. পাতালপুরী (১৯৩৫) ছবিতে নজরুল ছিলেন গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক। বাল্যবন্ধু কথাসাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে নজরুল এই ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
৪. গ্রহের ফের (১৯৩৭) ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন নজরুল।
৫. বিদ্যাপতি [বাংলা] (১৯৩৮) ছবিতে নজরুলের যুক্ততা গীতিকার হিশেবে। রাইচাঁদ বড়াল নজরুল বিষয়ে স্মৃতিচারণের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, বিদ্যাপতি এবং সাপুড়ে ছায়াছবির চিত্রনাট্য ও সংলাপ কাজীদারই লেখা। [সূত্র: গানের কাগজ, কলকাতা, ৪র্থ বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৭৬]
৬. বিদ্যাপতি [হিন্দী] (১৯৩৮) ছবিতেও নজরুলের লেখা গান ব্যবহৃত হয়েছিল বলে জানা যায়।
৭. গোরা (১৯৩৮) রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ভিত্তিতে নির্মিত চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। কলকাতা থেকে আবদুল আজিজ আল আমান সম্পাদিত কাফেলা পত্রিকার [আশ্বিন সংখ্যা ১৩৮৯, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৮২, পৃষ্ঠা-৩৭] ‘মুক্তবিহঙ্গ-স্বর্ণপক্ষ ঈগল, নিতাই ঘটকের সাক্ষাৎকার’ রচনার তথ্য ব্যবহার করে আসাদুল হক জানাচ্ছেন যে, ছবি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর মুক্তি পাবার অল্পদিন আগে রবীন্দ্রনাথের গান সঠিক সুরে গাওয়া হয়নি এই মর্মে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুমোদন বোর্ড গোরা ছবিটি সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছিল। ফলে ছবি মুক্তির ব্যপারে সৃষ্টি হয়েছিল জটিলতা। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দেবদত্ত ফিল্মস এ ঘটনা নজরুলকে জানালে নজরুল কিছুমাত্র চিন্তা না করে ছবির ফিল্ম এবং প্রজেক্টর নিয়ে সোজা বিশ্বভারতীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কী-কাণ্ড বল তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন্‌ আক্কেলে তার দোষ ধরে। তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানে মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’ নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি খসড়া অনুমোদনপত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলেন। ছবিটি না দেখেই রবীন্দ্রনাথ অনুমতিপত্রে সম্মতি স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও নজরুলের লেখা এবং সুর করা গান ‘ঊষা এলো চুপি চুপি, সলাজ নিলাজ অনুরাগে’ এ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।
৮. সাপুড়ে [বাংলা] (১৯৩৯) ছবির ৭টি গান নজরুলের লেখা। এই গানগুলোর সুরও তাঁর নিজেরই করা। ময়মনসিংহ গীতিকার গল্প অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য এবং সংলাপও যে নজরুলেরই লেখা সে-ব্যাপারে রাইচাঁদ বড়ালের লেখার সাক্ষ্য আমরা আগেই দেখিয়েছি।
৯. সাপেড়া [হিন্দী] (১৯৩৯) ছবিটিও সাপুড়ে-এর পাশাপাশি নির্মিত হয়েছিল। বাংলা সাপুড়ে ছবির আর হিন্দি সাপেড়া নজরুলের কাহিনী অবলম্বনে গড়ে উঠেছে। ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল সংগীত (২০০৫) বইয়ে আসাদুল হক জানাচ্ছেন,

এই ছবির কাহিনীকার, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। সব গানের সুরকার নয় শুধু তাঁর নিজের রচিত গানের সুরকার তিনি ছিলেন। এ ছায়াছবির বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় নি। নজরুল কী কী অংশে কাজ করেছেন তা কারো স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়নি।
১০. নন্দিনী (১৯৪১) ছবির জন্য পরবর্তী কালে বিখ্যাত হয়েছিল এমন দুটি গান রেকর্ড হয়েছিল। একটি ‘চোখ গেল পাখিরে..’ অন্যটি ‘পদ্মার ঢেউরে..’ । শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘পদ্মার ঢেউরে..’ ব্যবহৃত হয় নি।
১১. চৌরঙ্গী [হিন্দী] (১৯৪২) চলচ্চিত্রের কটি গানের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল তা এখনও জানা যায়নি। নজরুল সংগীত (২০০৫) বইয়ে আসাদুল হক জানাচ্ছেন যে,

আমার সংগ্রহে একটি গ্রামোফোন রেকর্ড আছে এতে দুটো গান আছে গান দুটোর প্রথম লাইন যথাক্রমে: চৌরঙ্গী হ্যায় ইয়ে চৌরঙ্গী এবং সারাদিন ছাতপিঠী হাতুহুঁ দুখাইরে। গ্রামোফোন রেকর্ডের উপরে লেখা আছে-কথা ও সুর: কাজী নজরুল, বাকী গানগুলি রচনা করেনে জীগ্যর মুরাদাবাদী, মীর্জা গালিব, আরজু লাখনউভি, এবং প্রতাপ লাখনউভি। সার্বিক সঙ্গীত পরিচালনায় নজরুল।
ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের তথ্যসুত্রে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে জানান যে, এই ছবির জীগ্যার মুরাদাবাদী এবং মীর্জা গালিব এর গান দুটির সুর করেছেন নজরুল।
১২. চৌরঙ্গী [বাংলা] (১৯৪২) ছবিতে নজরুলের লেখা ও সুর করা ৮টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। ছবির সার্বিক সংগীত পরিচালনার দায়িত্বও ছিল তাঁর।
১৩. দিকশূল (১৯৪৩) ছবিতে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুরে নজরুলের ২ টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৪. অভিনয় নয় (১৯৪৫) ছবিতে গিরিন চক্রবর্তীর সুরে নজরুলের একটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। নজরুলের গানটি ছিল, ‘ও শাপলা ফুল নেব না, বাবলা ফুল এনে দে’। শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং শেফালি ঘোষের দ্বৈতকণ্ঠে গানটি গীত হয়েছে।
১৫. শহর থেকে দূরে [সাদাকালো, ৩৫ মি:মি:] (১৯৪৩) ছবির অন্যতম গীতিকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আসাদুল হক তাঁর খসড়া রচনায় জানিয়েছেন:

টাইটেলে নজরুলের নাম পাওয়া যায়। অভিনয়াংশে এক জায়গায় চেয়ারম্যানের পুত্র জুতা পালিশ করতে করতে নজরুলের—’কে বিদেশী বন উদাসী’ গানটির দুটি লাইন খালি গলায় গায়।
এই কটি চলচ্চিত্রে তাঁর সচেতন যুক্ততার পরিচয় পাওয়া যায়। শহর থেকে দূরে ছবিতে তাঁর স্বয়ং যুক্ততার ব্যাপারে আমার নিজের অবশ্য সন্দেহ আছে। পরবর্তীকালেও অনেক ছবিতে তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছে। সেগুলো চলচ্চিত্রের সঙ্গে সজ্ঞান যোগ নয় বলে সেগুলো এই রচনার উপজীব্য করা হয় নি।

এতক্ষণ চলচ্চিত্রে নজরুলের সম্পৃক্ততার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল তা থেকে এ-কথা নিশ্চয় করে বলা যায় যে তিনি পরিচালনা, কাহিনী চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, সংগীত পরিচালনা ও অভিনয়ে যুক্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে তাঁর সাংগীতিক ব্যক্তিত্বই সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নজরুল যখন বাংলার সংগীতাঙ্গনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন সেই সময়েই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অগ্রযাত্রায় চলচ্চিত্রে ধ্বনি সংযোজনের সুবিধা যুক্ত হয়। সামগ্রিক অবস্থা দৃষ্টে এ-কথা মনে করা গিয়েছিল যে চলচ্চিত্র মাধ্যমটির ওপর ধ্বনিশিল্পের প্রভাব বাড়বে। বাংলা গানের তখন যে স্বর্ণযুগ চলছিল তাতে গানের জগতের মানুষের ডাক পড়বারই কথা। সেই সূত্রে নজরুলের মতো সংগীতপ্রতিভার পক্ষে চলচ্চিত্রের অঙ্গনে আবির্ভাব ছিল খানিকটা অনিবার্য।

শুরুতে বলা হয়েছিল নজরুল ছিলেন রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল একজন মানুষ। সেই আলোকে এ-কথাও বলা যায় চলচ্চিত্র মাধ্যমে তাঁর অংশ নেয়া সেকালের মুসলিম সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি অংশ নিয়ে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্র যখন নিজস্ব শিল্পভাষায় কথা বলতে শেখে নি সে-সময় চলচ্চিত্রের মতো মাধ্যমে এত ব্যাপ্তভাবে তাঁর যুক্ত থাকাটাই ছিল বিপ্লবী ভূমিকার সমান। বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রযাত্রায় নজরুলের এই ভূমিকাও তাঁর অপরাপর ব্যক্তিত্বশালিতার পরিপূরক। সেজন্য চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর অংশগ্রহণকে কেবল নান্দনিক সাফল্য অন্বেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঠিক হবে না। দেখতে হবে সামাজিক অগ্রযাত্রার দৃষ্টিকোণ থেকেও। তবে যদি চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণকারী নজরুলের নান্দনিক সাফল্য খুঁজতে চাওয়া হয় তাহলে প্রধানত সুরস্রষ্টা নজরুলকেই উদ্ভাসিত দেখা যাবে।

১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬/২৫ মে ২০০৯

ahmadmazhar01@yahoo.com
http://arts.bdnews24.com/?p=2454

No comments:

Post a Comment