Sunday 21 May 2017

নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম


নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম

ড. আবুল আজাদ।।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার বিদ্রোহী কবি। প্রেম ও প্রকৃতির কবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবিও। যদিও জাতীয় কবির অভিধাটি নজরুল ইসলামের জন্য খুব বড় মাপের কোনো গৌরবজনক অলংকার নয়। বিশ্বসাহিত্যের বড় মাপের অনেক মহৎ কবি-সাহিত্যিকই কোনো দেশের জাতীয় কবি বা সাহিত্যিক ছিলেন না। এ জন্য তাদের গৌরব কোনো অংশেই কমে যায়নি। প্রতিভাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের অর্থ তার মৌলিক বিকাশের পথকে শ¬থ করা। কালের অভিরুচি শিল্পীসত্তাকে বরাবরই বিকশিত করে প্রকৃতির নির্যাসে। মানবের হৃদয় মথিত রূপ-রস-কল্পনা কাল থেকে কালান্তরিত হয়ে সৃষ্টি করে মেধা ও মননের নতুন দিগন্ত। শিল্পীর স্বাধীনতার সার্থকতা সেখানেই।

নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে জাতীয় কবি অভিধার চেয়েও বড় যা কিছু গৌরবের তা হচ্ছে, বিশ্বের দেশে দেশে শোষিত নির্যাতীত মানুষের মধ্যে শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে আত্মজাগরণ এবং অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা। এটিই হয়েছে বিশ্বময় নজরুল ইসলামের বড় কীর্তি ও পরিচয়। এই কবিই কি বিস্ময়করভাবেই না নিজেকে সমর্পণ করলেন প্রকৃতির কাছে। লিখলেন অজস্র প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা-গান। জীবনের শেষ অভিভাষণে বললেনও, ‘... আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম।’

বৈচিত্র্যময় এক বিরল প্রতিভা নজরুল ইসলাম। বীর রস, করুণ রস, হাস্যরস কি ছিলো না তাঁর সৃষ্টির ভাণ্ডারে? বেদনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত কবি জগৎ ব্রহ্মাণ্ডের জন্য রেখে গেলেন এক মহৎ উত্তরাধিকার। পরাধীন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য একাধারে ছিলেন বিদ্রোহী, অসহায় নিরন্ন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামী-রাজনীতিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চলচ্চিত্রকার এবং প্রেম ও প্রকৃতির কবি ছিলেন তিনি। এমন বিচিত্র প্রতিভার, বড় মাপের মানুষটির অন্তরের নিভৃত কোনটি কেমন ছিলো, কোন সে মহীয়সীর পদভারে স্পন্দিত-মথিত হয়েছিল তাঁর হৃদয় মন্দির- এ যাবৎ এ সম্পর্কে খুব একটা খোঁজ-খবর আমরা করিনি। অথচ লক্ষ-কোটি মানুষের প্রিয় কবি এই কাজী নজরুল ইসলাম।

যে কালে নজরুল ইসলামের জন্ম, সেটি ছিলো স্বদেশী-খেলাফৎ ও স্বরাজ আন্দোলনের যুগ। সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশের হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে দেশময় চলছে আন্দোলন সংগ্রাম। তার মধ্যে প্রবল ধারাটি ছিলো গান্ধীজীর অহিংস-অসহযোগ কর্মসূচি। কবি প্রথম দিকে এই ধারাকে সমর্থন করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রকাশ্যেই সশস্ত্র বিপ¬বী আন্দোলনের চরম ধারাকে সমর্থন করেন। এক পর্যায়ে এই আন্দোলনকে সর্বাত্মক সফল করতে আপামর দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গণ-আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই আন্দোলনে পিছিয়ে থাকা স্বধর্মের মুসলমান সম্প্রদায়কে জাগাতে ইসলামী চেতনার গান রচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে কবি বলেছেনও, বাংলার তিন কোটি মুসলমান-যারা লিখতে-পড়তে জানে না-অশিক্ষিত, কিন্তু গান বোঝে। তাঁদের জাগাতেই তাঁর এই প্রয়াস।

আপাদমস্তক প্রতিবাদী এই মানুষটির জীবনেও প্রেম ছিলো, ছিলো ভালোবাসা। অন্তরের নিভৃত কোণে এই কবিও গেঁথেছেন বিনি সুতার মালা। মানব ধর্মে মহীয়ান এই কবিও হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে আপন করে পেতে চেয়েছেন প্রিয়তমাকে। অপ্রাপ্তির দংশন তাঁকে জর্জরিত করেছে ঠিকই, কিন্তু ধ্বংস করতে পারেনি। খাঁটি সোনা বানিয়েছে। কালের ঝঞ্ঝায় কবি হয়তো বিদ্রোহী হয়েছেন, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এই অভিধায়। কিন্তু প্রেমিক সত্তাটিও তাঁর বিস্মৃত হবার নয়।

জগতের সব বড় মাপের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর জীবনেই প্রেম-ভালোবাসার বিচিত্র উপাখ্যান লক্ষ্য করা যায়। কেউ দয়িতাকে পেয়ে সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসার মহাকাব্য। কেউবা হারিয়ে লিখেছেন করুণ রাগের অমর উপাখ্যান। এঁদের জীবনের মহৎ সব শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির প্রেরণার উৎসই হয়ে আছেন তাদের দয়িতারা। বিশ্বসাহিত্যের দিকপালদের দিকে তাকালে এর পর্যাপ্ত নজির লক্ষ্য করা যায়। ফ্যানি ব্রাউনের গভীর প্রেমে উদ্বেলিত হয়ে ছিলেন কিট্স। এমিলিয়াকে আপন করে পেতে কবি শেলী আমৃত্যু প্রতীক্ষায় থাকেন।

 বিয়েত্রেয়ীচের জন্য দান্তের অপেক্ষার পালাটিও ছিলো দীর্ঘ। অৎৎবঃঃব ঠধষষড়হ এর সঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ার্থের ছিলো দীর্ঘ প্রণয়। কোলরিচ আজীবন বিভোর ছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের বোন সারাহর প্রেমে। কিন্তু কোনদিনই তাঁর সে প্রণয় পরিণতির মুখ দেখেনি। কবি বায়রনকে সৎবোন অংঃধৎঃ এর সঙ্গে প্রেম করার কারণে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। লরাকে ঘিরে বেড়ে উঠেছিল পেত্রাকের প্রেমিক জীবন। জনাথন সুইফটের ঝঃবষষধ এবং ইয়েটস-এর মডগান তাদের সাহিত্যিক জীবনে অপরিসীম প্রভাবের সৃষ্টি করেছিলেন। জগৎ বিখ্যাত এমনই তরো আরো অনেক রথি কবি-সাহিত্যিকের নামোলে¬খ করা যায়- এডমন্ড স্পেন্সার, স্যার ফিলিপ সিডনি, জনডান, ব্রাউনিং এরা সকলেই ছিলেন প্রেমের পূজারী, দয়িতা আরাধ্য পুরুষ।

আমাদের চণ্ডীদাসের রামী, মাইকেল মধুসূদন দত্তের হেনরিয়েটা এবং রবি ঠাকুরের কাদম্বরীকেইবা এ প্রসেঙ্গ স্মরণ না করা কোনো? তেমনিভাবে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনেও লক্ষ্য করি নার্গিস-প্রমীলার উপস্থিতি, ফজিলাতুন্নেসার জন্য অপরিসীম একাগ্রতা। রানু সোম, উমা মৈত্রদের কণ্ঠদানের ভেতরে আপন সত্তা বিকাশের এক দুর্বিনীত ঝড় আর জাহানারার ভক্তি আকুলতার কাছে আত্মসমর্পণ।

সেই সঙ্গে লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কবির বাস্তব জীবনের প্রতিপার্শ্বের অনেক প্রিয়তম চরিত্ররাও তাঁর সাহিত্য-সঙ্গীতে ঠাঁই করে নিয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে কবির অন্তর জীবনের বিস্মৃতপ্রায় এই অধ্যায়টি অনুসন্ধানের প্রয়াস নেয়া হয়েছে।

নজরুলের জীবনে প্রণয়ের প্রথম ইঙ্গিতটি লক্ষ্য করা যায় ১৯২২ সালে। এ বছর ১মার্চ/১৩২৮ বঙ্গাব্দের ফালগুনে কলকাতার মোসলেম পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকশিত হয় তাঁর ‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থটি। এটি কবির প্রথম প্রকাশিত বই। এতে মোট ৬টি গল্প স্থান পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে ব্যথার দান, ‘হেনা’, ‘বাদল-বরিষণে’, ‘ঘুমের ঘোরে’, ‘অতৃপ্ত কামনা’ ও ‘রাজবন্দীর চিঠি’। এই বইটির উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন, ‘মানসী আমার!/মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম ব’লে/ক্ষমা করনি,/তাই বুকের কাঁটা দিয়ে/প্রায়শ্চিত্ত ক’রলুম।’

কে এই মানসী কবির? স্বর্ণলতা গঙ্গোপাধ্যায়? আসানসোলের দারোগার মেয়ে এই স্বর্ণলতাদের আদি নিবাস বাংলাদেশের খুলনায়। এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।

বক্ষমান নিবন্ধটি প্রধানত কবির প্রেমিকা বা যাদের কবি প্রেম নিবেদন করেছিলেন এবং যাদের নিয়ে কবি রচনা করেছেন অজস্র প্রেমের কবিতা- গান, তাঁদের কেন্দ্র করে রচিত হলেও মাতৃসমা কিছু নারীর অপরিসীম প্রভাব ছিলো কবির ওপর এবং কবিও এঁদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। এঁদের স্নেহ, আপত্য শাসন আর বুকে আগলে রাখার মমত্ববোধই কবিকে জীবনের অনেক কঠিন সঙ্কট মোকাবিলায় পথের নির্দেশ দিয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা যায় এবং তা তাঁর জন্মদাত্রী মা জাহেদা খাতুনকে নিয়ে। কিশোর বয়সে সেই যে গৃহত্যাগ করলেন কবি, তারপর মায়ের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর পল্টন থেকে ফিরে ১৯২০ সালে একবার চুরুলিয়া গেলে। এরপর আর কোনদিন কবির মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। মাতা-পুত্রের সম্পর্কে কেন এই টানাপোড়েন তার বিস্তারিত জানা যায়নি। বাড়ির কিছু পরিবেশ এক্ষেত্রে কবিকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। কিন্তু তারও বিশদ তথ্য কোথাও নেই। পরিণত বয়সেও কবি মায়ের সঙ্গে এই সম্পর্কের টানাপোড়েনের ক্ষতকে অতিক্রম করতে পারেন নি।

১৯২৩ সালে কারাগারে পুত্রের অনশনের সংবাদ পেয়ে মা জাহেদা খাতুন চুরুলিয়া থেকে ছুটে গিয়ে ছিলেন হুগলি জেল গেটে অনশন ভাঙিয়ে পুত্রের জীবন রক্ষা করতে। কিন্তু কবি মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেন নি। কেউ কেউ এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, মায়ের অনুরোধ কবি ফেলতে পারবেন না বলেই সাক্ষাৎ করেন নি। কিন্তু যখন দেখা যায় প্রমীলার কাকীমা বিরজাসুন্দরী দেবী এসে নজরুলকে অনশন ভাঙাতে বাধ্য করেন, তখন এই যুক্তি আর কাজ করে না। উপরন্তু ১৯২৮ সালের ৩০ মে চুরুলিয়ায় মৃত্যুবরণের আগে মা জাহেদা খাতুন পুত্র নজরুলকে এক নজর দেখার জন্য অন্তিম বাসনা প্রকাশ করেন। এই খবর নজরুলের কাছে পৌছা সত্ত্বেও অভিমানী কবি মৃত্যুপথযাত্রী মাকে দেখতে যাননি। জীবদ্দশায় কবি কখনোই এ সম্পর্কে মুখ খোলেন নি। ফলে নজরুল জীবনে এটি আজো অমীমাংসিত অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে।

এরপর আসে বিরজাসুন্দরী দেবীর কথা। ইনি নজরুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের মা এবং প্রমীলার কাকীমা। আগেই উল্লে¬খ করা হয়েছে যে, ১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দৌলতপুর যাবার পথে খান সাহেবের পূর্ব পরিচিত এই বীরেনদের বাড়িতে উঠে ছিলেন নজরুল। প্রথম যাত্রায় এ বাড়িতে ছিলেন ৪/৫ দিন। দৌলতপুরে ৩/৪ মাস কাটানোর পর নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেলে নজরুল ‘মা’ সম্বোধন করে তাঁর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সপরিবারে বিরজাসুন্দরী দেবীকে দৌলতপুরে নিয়ে গিয়ে ছিলেন। বিয়ে নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হলে নজরুল যখন রাতের শেষ প্রহরে একা ফিরতে উদ্যত হন, বিরাজ দেবী তখন পুত্র বীরেনকে নজরুলের সঙ্গে দিয়ে পাঠান।


কুমিল্লায় এসে নজরুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিরাজ দেবী তাঁর এই পথে কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানকে আন্তরিক সেবা শুশ্রষা ও মমতা দিয়ে দ্রুত সারিয়ে তোলেন। যদিও প্রমীলার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিরজা দেবী ঘোর আপত্তি করে ছিলেন, কলকাতা পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন প্রমীলা এবং তার মা গিরিবালা দেবীকে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু সে যে সামাজিক চাপে, সংস্কারের ভয়ে, নিজের দুই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে- তা উপলব্ধি করতে কোনো অসুবিধা হয় না।


নজরুল-প্রমীলার বিয়ে হয়ে যাবার কিছু দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সর্বহারা’। কবি এই গ্রন্থটি বিরজা দেবীকে উৎসর্গ করে ‘উৎসর্গ’ কবিতাটিতে লিখেছেন,

মা (বিরজাসুন্দরী দেবী)র / শ্রীচরণারবিন্দে/ সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।/ তুমি কোনদিন কারো করনি বিচার,/ কারও দাওনি দোষ। ব্যথা-বারিধির/ কুলে ব’সে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরনীর/ ... .../ হয়ত ভুলেছ মাগো, কোন একদিন,/ এমনি চলিতে পথে মরু-বেদুইন-/ শিশু এক এসেছিল। শ্রান্ত কণ্ঠে তাঁর/ ব’লেছিল গলা ধ’রে- ‘মা হবে আমার?’/ ... .../ সর্বসহা কন্যা মোর। সর্বহারা মাতা।/ শূন্য নাহি রহে কভু মাতা ও বিধাতা।/ হারা-বুকে আজ তব ফিরিয়াছে যারা-/ হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’।


বিরজা দেবী সপরিবারে কলকাতা চলে আসার পর কবি নিয়মিত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এই মহীয়সী নারী দেহত্যাগ করেন। নজরুল এ সময় তাঁর শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন।

এরপর আসে প্রমীলার মা কবির শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর কথা। এই মহীয়সী নারীর আন্তরিক প্রয়াস ও কঠিন মনোভাবের কারণেই শত প্রতিকূলতার ভেতরও নজরুল-প্রমীলার বিবাহ সম্ভব হয়েছিল। স্বীয় সিদ্ধান্ত থেকে তাঁকে কেউ টলাতে পারেনি। সমাজ, সংস্কার, রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার বন্ধন সব পেছনে ফেলে রেখে মেয়েকে নিয়ে তিনি একা কুমিল¬া থেকে কলকাতা চলে এসে ছিলেন এবং নিরুদ্দেশ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মেয়ের সংসারকে আগলে রেখে ছিলেন।

 নজরুলের ঘনিষ্ঠজনরাই মন্তব্য করেছেন, মাতৃসমা এই দেবী শুরুতে কবির সংসারের হাল না ধরলে কোথায় ভেসে যেতো কবির সংসার। আর কবিও বুঝি সংসারে একজন সার্বক্ষণিক অভিভাবক পেয়ে দেশময় চষে বেড়িয়েছেন। যখন যেখানে খুশি ছুটে গেছেন। মাসের পর মাস কাটিয়েছেন এখানে সেখানে দেশের কাজে, স্বজাতির কল্যাণে- যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মজাগরণের চেতনা সৃষ্টি করতে। সংসার জীবনে কবির এই বহির্মুখী দিনগুলোতে গিরিবালা দেবীই সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অনেক প্রকাশকের কাছে কবির পাওনা আদায়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন।

এই মহীয়সী নারী সম্পর্কেও অপবাদ রটাতে বাঁধেনি নজরুলেরই কিছু ঘনিষ্ঠ জনের। দুর্নামের বিষয় ছিলো গিরিবালা দেবীর স্বেচ্ছাচার ও বেহিসেবীপনা। এই অপবাদ রটনাকারীদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য হলেও গিরিবালা দেবী প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে ছিলেন। ১৯৪২ সালে কবি নির্বাক হয়ে যাওয়ায় তাঁর পক্ষেও শাশুড়ির জন্য কিছু করা বা অপবাদ রটনাকারীদের দমন করা সম্ভব ছিলো না। প্রমীলা দেবীও এ সময় পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। ফলে লোকের কুৎসায় যন্ত্রণাবিদ্ধ গিরিবালা দেবী শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়ে ছিলেন।

আরো এক মহীয়সী নারী মিসেস এম. রহমান এর কাছ থেকে নজরুল অপরিসীম মাতৃস্নেহ অর্জন করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মুসাম্মৎ মাসুদা খাতুন (জন্ম ১৮৮৪ সালে, মৃত্যু ১৯২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর)। সমকালে যে দু’চারজন মুসলিম বাঙালি রমণী পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে মুসলমান নারী সম্প্রদায়ের মধ্যে জাগরণের সূচনা করেন- মিসেস এম. রহমান ছিলেন তাদের অন্যতম।
নজরুল ইসলাম এই মহীয়সী নারীকে কি পরিমাণ শ্রদ্ধা করতেন, তার একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে কবির ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থে। কবি এই বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন মিসেস এম. রহমানকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছেন,

‘বাঙালার অগ্নি-নাগিনী মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কুল-গৌরব/আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা/ মিসেস এম. রহমান সাহেবার/ পবিত্র চরণারবিন্দে’
‘উৎসর্গ’ কবিতার শেষপাদে কবি উল্লেখ করেন,

‘তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু তোমার মাতা,/ তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্ব-জননী! তোমার আঁচল পাতা/ নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে; বিষ শুধু তোমা দহে,/ ফণা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণীর ভার বহে!-/ আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে/ সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে,/ নহে তার তরে, - সব সন্তানে তুমি যে বেসেছে ভালো/ তোমার মানিক সকলের মুখে দেয় যে সমান আলো,/ শুধু মাতা নহ, জগন্মাতার আসনে বসেছ তুমি, -/ সেই গৌরবে জননী আমার, তোমার চরণ চুমি।’

১৩৩১ এর ১৬ শ্রাবণ হুগলিতে রচিত এই কবিতার নীচে কবি লিখেছেন,
    ‘তোমার নাগ-শিশু-/ নজরুল ইসলাম।’
    এই বইটি নজরুল ইসলামের বিপ¬বাত্মক বিদ্রোহ চেতনার সবিশেষ উলে¬খযোগ্য গস্খন্থ।
১৯২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মিসেস এম. রহমান মৃত্যুবরণ করেন। এই মর্মান্তিক সংবাদ পেয়ে ১৩৩৩ এর ১৫ পৌষ কৃষ্ণনগরে বসেই কবি স্বল্পায়ু এই মহীয়সী নারীর স্মরণে রচনা করেন ‘মিসেস এম. রহমান’ শীর্ষক দীর্ঘ শোকবন্দনা। এর শেষ স্তবকে নজরুল তাঁর হৃদয়ের সমস্ত আবেগ-বেদনা-শ্রদ্ধা তুলে ধরে লেখেন,
‘যাহাদের তরে অকালে, আম্মা, জান্ দিলে কোরবান/ তাদের জাগায় সার্থক হোক তোমার আত্মদান।/ মধ্যপথে মা তোমার প্রাণের নিবিল যে দীপ-শিখা,/ জ্বলুক নিখিল- নারী- সীমন্তে হয়ে তাই জয়টিকা!/ বন্দিনীদের বেদনার মাঝে বাঁচিয়া আছ মা তুমি,/ চিরজীবী মেয়ে, তবু যাই ঐ কবরের ধুলি চুমি!/ মৃত্যুর পানে চলিতে আছিলে জীবনের পথ দিয়া,/ জীবনের পানে চলিছ কি আজ মৃত্যুরে পারাইয়া।’

মিসেস এম. রহমান স্নেহ-মমতা ও মায়ার বন্ধন দ্বারা কত গভীরভাবে আগলে রেখে ছিলেন নজরুল ইসলামকে, নজরুল কর্তৃক তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘বিষের বাঁশী’ উৎসর্গ করাসহ মৃত্যুর পর রচিত কবিতা থেকেই তা প্রতীয়মান হয়। বস্তুত এইসব মহীয়সী নারীদের স্নেহ-ভালোবাসাই কবিকে তাঁর উদ্দেশ্যে অটুট রাখতে প্রেরণা যুগিয়েছে বরাবর।

চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকেও নজরুল সীমাহীন শ্রদ্ধা করতেন। বাসন্তী দেবীও বিদ্রোহী কবি নজরুলের প্রতি অপরিসীম মমতা বোধ করতেন। ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘বাঙলার কথা’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। একই বছর ১০ ডিসেম্বর সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করলে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী কাগজের হাল ধরেন। পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই মহীয়সী নারী সেদিন প্রাণান্তকর প্রয়াস চালান। এ প্রসঙ্গে মুজফ্ফর আহমদ জানিয়েছেন,
‘কাজী বাসন্তী দেবীর ডাক পেয়ে যথারীতি ‘ভাঙার গান’ কবিতাটি লিখে পাঠালেন। বাসন্তী দেবীর বাড়িতে একদিন খেতেও গিয়ে ছিলেন নজরুল।’
১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২ আষাঢ় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ দার্জিলিঙে পরলোক গমন করেন। এ সময় কবি হুগলিতে বসবাস করছিলেন। বিদ্যুৎগতিতে মহৎপ্রাণ চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে।

 হুগলিতে বসেই পর দিন ৩ আষাঢ় কবি রচনা করেন ‘অর্ঘ্য’ কবিতাটি। এরপর ৬ আষাঢ় আরিয়াদহে রচনা করেন ‘অকাল সন্ধ্যা’। ১৩৩২ এর শ্রাবণ সংখ্যা ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় এটি মুদ্রিত হয়। শিরোনামের সঙ্গে লেখা ছিলো ‘জয়-জয়ন্তী কীর্তন-একতালা’। আর পাদটীকায় উলে¬খ ছিলো ‘স্বর্গীয় দেশবন্ধুর শোক যাত্রার গান।’ ১১ আষাড় কবি হুগলিতে পুনরায় রচনা করেন ‘ইন্দ্র-পতন’। ১৬ ও ১৭ আষাঢ় যথাক্রমে লেখেন ‘সান্ত্বনা’ ও ‘রাজভিখারী’ কবিতা দুটি। এর মধ্যে
‘সান্ত্বনা’ ‘বিজলী’ পত্রিকার ৫ম বর্ষ ৩১শ সংখ্যায় (আষাঢ় ১৩৩২) এবং ‘রাজভিখারী’ ‘কলে¬াল’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবি হৃদয়ের অর্ঘ্য এসব কবিতা-গান নিয়ে ১৩৩২ এর শ্রাবণে প্রকাশিত হয়েছে ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থটি। এর ‘উৎসর্গ-পত্র’ কবি রচনা করেন নিম্নরূপভাবে, ‘উৎসর্গ/ মাতা বাসন্তী দেবীর শ্রীশ্রীচরনারবিন্দে/ - নজরুল ইসলাম।’
চট্টগ্রামের শামসুননাহার মাহমুদের (১৯০৮-৬৪) সঙ্গে কবির ছিলো স্নেহের সম্পর্ক। এই মহীয়সী নারীর একেবারে কিশোরী বয়সেই পরিচয় হয় কবির সঙ্গে।

 শামসুন নাহারের জন্ম ১৯০৮ সালে বর্তমান ফেনী জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। চট্টগ্রামের তামাকুমন্ডির হবীবুল¬াহ বাহার (১৯০৬-৬৫) চৌধুরী ছিলেন বেগম শামসুন নাহারের ভাই। বাহার সাহেব একাধারে ছিলেন লেখক, ‘বুলবুল’ পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক, ক্রীড়াবিদ-সংগঠক। রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি এবং মন্ত্রীত্বের পদও অলংকৃত করেন। শামসুননাহার ছিলেন পিতৃহীনা। চট্টগ্রামের তামাকুমন্ডিস্থ নানা খান বাহাদুর আবদুল আজিজের বাড়িতে তিনি মা ও ভাই হবীবুল¬াহর সঙ্গে প্রতিপালিত হন। শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠে ডাক্তার খাস্তগীর স্কুলে লেখাপড়ার সূচনাও তাঁর নানার বাড়িতেই।
মোট ৩ বার চট্টগ্রাম সফরকালে প্রথম দু’বার ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে কবি বাহার নাহারদের বাড়িতেই ওঠেন। এখানে বসেই কবি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কিছু অমর সৃষ্টি। তারমধ্যে উলে¬খযোগ্য হচ্ছে ‘সিন্ধু’, ‘শীতের সিন্ধু’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘অনামিকা’, ‘কর্ণফুলী’, ‘মিলন-মোহনায়’, ‘সাতভাই চম্পা’ এবং অন্তত দু’টি বিখ্যাত অভিভাষণ যথা, ‘প্রতি নমস্কার’ ও ‘মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা’।

চট্টগ্রাম থেকে ফিরেই কবি প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার কাব্য ‘সিন্ধু হিন্দোল’। ডি-এম. লাইব্রেরির গোপাল দাশ কর্তৃক ১৯২৭ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এই বইটি কবি উৎসগ করেন চট্টগ্রামের দুই ভাই-বোন বাহার ও নাহারকে। উৎসর্গ পত্রটি ছিলো নিম্নরূপ, ‘উৎসগ/ - আমার এ লেখাগুলি/ বাহার ও নাহারকে দিলাম -/ কে তোমাদের ভালো?/ ‘বাহার/ আন গুল্শানে গুল্, ‘নাহার’ আন আলো।/ ‘বাহার’ এলে মাটির রসে ভিজিয়ে সবুজ প্রাণ,/ ‘নাহার’ এলে রাত্রি চিরে জ্যোতির অভিযান।/ তোমরা দু’টি ফুলের দুলাল, আলোয় দুলালী,/ একটি বোঁটায় ফুটলি এসে,- নয়ন ভুলালি!/ নামে নাগাল পাইনে তোদের নাগাল পেল বাণী।/ তোদের মাঝে আকাশ ধরা করছে কানাকানি।’
কবিতার নিচে রচনার স্থান হিসেবে উলে¬খ রয়েছে ‘তামাকুমন্ডি, চট্টগ্রাম’, তারিখ ৩১ জুলাই ১৯২৬। উৎসর্গ পৃষ্ঠার আগে ৩০ জুলাই ১৯২৬ তারিখের ডেটলাইনে একই স্থানের রেফারেন্সে দু’টি কবিতার লাইন উলে¬খ করেছেন কবি।

যা নিম্নরূপ,
‘আলোর মত জ্বলে ওঠ। উষার মত ফোটো!/ তিমির চিরে জ্যোতির মত প্রকাশ হ’য়ে ওঠ!’
এর আগে ১৯২৪ সালে বিয়ের পর কবি যখন সপরিবারে হুগলিতে বসবাস করছেন, সে সময় কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু খান মইনুদ্দীনের (১৯০১-৮১) সঙ্গে হবীবুল¬াহ বাহর একদিন কবির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। আরজি পেশ করেন, ছোট বোন শামসুননাহারের ‘পুণ্যময়ী’ গ্রন্থের জন্য আশীর্বাণীর। নজরুল নিম্নরূপে আশীর্বাণীটি লিখে দেন,
‘কল্যাণীয়া শামসুননাহার/ জয়যুক্তাসু,/ শত নিষেধের সিন্ধুর মাঝে/ অন্তরালের অন্তরীপ,/ তারি বুকে নারী বসে আছে জ্বালি/ বিপদ বাতির সিন্ধুদীপ।/ শাশ্বত সেই দীপান্বিতার/ দীপ হতে আঁখি দীপ বরি/ আসিয়াছ তুমি অরুণিমা আলো/ প্রভাতী তারার টিপ পরি।/ ... ’

প্রথমবার চট্টগ্রাম থেকে ফিরে ১৯২৬ সালের ১১ আগষ্ট কবি কৃষ্ণনগর থেকে নাহারকে তাঁর চিঠির একটি দীর্ঘ উত্তর লেখেন। ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘বুলবুল’ পত্রিকায় চিঠি শিরোনামে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। চিঠির শেষে পাদটীকায় উলে¬খ করা হয়, ‘চিঠিখানি কবি নজরুল ইসলাম তাঁর প্রতি শ্রদ্ধান্বিতা কোন বালিকাকে কয়েক বছর আগে লিখে ছিলেন।’
চট্টগ্রামে নজরুলের এই সফরগুলো এবং বাহার-নাহারদের বাড়িতে অবস্থানের পাশাপাশি সেখানে রচিত কবিতা-গানগুলোর মধ্যে ‘বিস্ময়কর এবং চির অমর’ কিছু সৃষ্টি রয়েছে। তারমধ্যে সবিশেষ উলে¬খযোগ্য ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’। বাহার-নাহারদের তামাকুমন্ডির বাসার যে ঘরটিতে নজরুলকে থাকতে দেয়া হয়েছিল, তার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ত এই গুবাক তরুর সারি। এইসব গুবাক তরুকে নিয়েই করি রচনা করেন ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’। এর কয়েকটি চির-অমর পংক্তি হচ্ছে,
‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু/ আর আমি জাগিব না/ কোলাহল করি সারা দিনমান/ কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা/ নিশ্চল-নিশ্চুপ / আপনার মনে পুড়িব একাকী/ গন্ধ বিধূর ধূপ।’

আরো বহু নারীর মাতৃস্নেহ- মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন কবি। অগ্নিনাগিনী কন্যা হেমপ্রভা তেমনি আরেক উলে¬খযোগ্য নারী। তাকে নিয়ে কবি রচনা করেন ‘হেমপ্রভা’ কবিতাটি। উদ্ধৃতিটি বিবেচ্য, ‘হেমপ্রভা/ কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া/ আসিলে আলোক-জননী।/ প্রভায় তোমার উদিল প্রভাত/ হেম-প্রভ হ’ল ধরণী॥/ ভগ্ন দুর্গে ঘুমায়ে রক্ষী/এলে কি মা তাই বিজয়-লক্ষ্মী,/‘ময় ভূখা হুঁ’র ক্রন্দন-রবে/ নাচায়ে তুলিলে ধমনী॥/ এস বাঙলার চাঁদ- সুলতানা/ বীর-মাতা বীর-জায়া গো/ তোমাতে পড়েছে সকল কালের/ বীর-নারীদের জায়া গো/ তোমাতে পড়েছে সকল কালের/ বীর-নারীদের ছায়া গো।/ শিব-সাথে সতী শিবানী সাজিয়া/ ফিরিছ শ্মশানে জীবন মাগিয়া,/ তব আগমনে নব-বাঙলার/ কাটুক আঁধার রজনী॥’

১৯২৬ সালে এই কবিতাটি রচিত হলেও এরমধ্যে কবির ১৯২২ সালের ‘ধূমকেতু’র বিপ¬বী চেতনার প্রত্যক্ষ ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ঐ যে ‘ময় ভূখা হুঁ’র ক্রন্দন রবে/ নাচায়ে তুলিলে ধমনী।’ ইতোপূর্বে এই ‘ময় ভূখা হুঁ’ শিরোনামে ‘ধূমকেতু’তে তীব্র জ্বালাময়ী ভাষায় বিপ¬বাত্মক প্রবন্ধ লিখে ছিলেন কবি।
এ পর্যায়ে কবি জীবনের একটি করুণ অধ্যায়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। ‘ধূমকেতু’ মামলায় কারামুক্ত হয়ে কবি কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা চলে গিয়ে ছিলেন কুমিল¬ায় প্রিয়তমা প্রমীলার সান্নিধ্যে। কলকাতায় তাঁর যেসব বন্ধু তাঁকে কারামুক্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কবির সাক্ষাৎ না পেয়ে তাঁরা বিস্ময়ে হতবাক এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠলেন।

এ প্রসঙ্গে ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থে খান মঈনুদ্দীন
বিস্তারিত উলে¬খ করেছেন। কুমিল¬া থেকে ফিরে কবি মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদিনীপুর শাখার এই একাদশ অধিবেশনটি ১৯২৪ সালের ২২ থেকে ২৫ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত চার দিন ধরে চলে। নজরুল এর সবকটি অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ‘ ..... এই সভাকে কেন্দ্র করে একটি করুণ ঘটনা ঘটে। মেদিনীপুর নিবাসী আজহারউদ্দীন খান ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থে লিখেছেন, তাঁর গান ও আবৃত্তিতে মুগ্ধ হয়ে জনৈক হিন্দু মহিলা নিজ গলার হার খুলে নজরুলকে উপহার দেন। তখনকার সমাজ এই সামান্য জিনিসটাকে সুস্থচিত্তে ও খোলাভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি, মুসলমান তরুণের উপর হিন্দু মেয়ের এই টান তাঁর পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজন ধিক্কারের চোখে দেখে ছিলেন। সমাজের গঞ্জনায় অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েটি নাইট্রিক এসিড পান করে আত্মহত্যা করে।

কারামুক্ত হওয়ার পর কলকাতায় কবির বন্ধুরা তাঁকে যে সংবর্ধনা জানাতে চেয়ে ছিলেন, মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মেলনে পক্ষান্তরে তারই প্রতিধ্বনি ঘটলেও কবির প্রতি অনুরক্তা জনৈকা হিন্দু রমণীর আত্মহত্যার মর্মান্তিক পরিণতিটি বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার সাম্প্রদায়িক বিভেদভাবের কুৎসিত দিকটিকেই ফুটিয়ে তুলেছে। অনেক অনুসন্ধান সত্ত্বেও আত্মহত্যাকারী মহিলার নামটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। যারা এ বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন, তারাও সচেতনভাবেই নামটি এড়িয়ে গেছেন- সম্ভবত ঐ মহিলার পরিবারকে সামাজিক গঞ্জনার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে।
দেওঘর থেকে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে ফিরে এলেও দ্বিতীয়বার ‘নবযুগে’ কাজ করতে যাওয়ার সময়টাতে নজরুল আফজালুল হক সাহেবের সঙ্গে ছিলেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই বত্রিশ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ অফিসে পুনরায় মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে থাকতে আসেন। এখানেই পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয় নজরুলের। খান সাহেব নজরুলকে নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল¬া জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামে বেড়াতে যান। এখানে খান সাহেবের বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে নজরুলের প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

নার্গিসকে নিয়ে কবি বেশ কটি কবিতা-গানও রচনা করেন। এ ধরনের উলে¬খযোগ্য একটি কবিতা হচ্ছে,
‘নার্গিস-বাগম মে         বাহার কি আগ মে     ভরা দিল দাগ মে-/ কাঁহা মেরি পিয়ারা, আও আও পিয়ারা।/ দুরু দুরু ছাতিয়া ক্যায়সে এ রাতিয়া কাটু বিনু সাথিয়া/ ঘাবরায়ে জিয়ারা, তড়পত জিয়ারা।/ ...’
কিন্তু পল¬ীবালা সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার বানু যে কবির এ আকুলতার কাছে উদ্দাম ঝড়ের ন্যায় ধরা দেন না। লজ্জাবতী নারীর নিরুত্তাপ অথচ ইঙ্গিতময় অভিসার কবিকে আরো বেশি আকুল করে তোলে। ‘ফুল-কুড়ি’ কবিতায় কবির সে আকুলতা লক্ষ্য করা যায়। কবিতাটি দৌলতপুরে রচিত এবং ‘পূবের হাওয়া’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। উদ্ধৃতি বিবেচ্য, ‘আর পারিনে সাধতে লো সই এক-ফোঁটা এই ছুড়িকে/ ফুটবে না যে ফোটাবে কে বল লো সে ফুল কুড়িকে।/ ঘোমটা-চাপা পারুল-কলি/ বৃথাই তা’রে সাধলো অলি,/ পাশ দিয়ে হায় শ্বাস ফেলে যায় হুতাশবাতাস ঢলি।’

‘দুপুর অভিসার’ কতিাটিতেও নজরুল-নার্গিসের প্রণয় লীলার ব্যঞ্জনা পরিলক্ষ্য। দৌলতপুর ছেড়ে, নার্গিসকে ত্যাগ করে চলে আসার দীর্ঘ ১৫ বছর পর নজরুল নার্গিসের একটি মিনতিপূর্ণ চিঠি পান। সময়ের হিসেব বিবেচনা করে দেখা যায়, এই চিঠি নার্গিস কবিকে লিখে ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের অল্প কিছুদিন আগে। কবি এই চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে শৈলজানন্দ উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকে পত্রখানা পড়তে দেন। পড়ার পরে নজরুলকে পত্রোত্তর দিতে বলার অল্পক্ষণের ভিতরে কবি একটি গান লিখে শৈলজানন্দের হাতে দিয়ে বলেন, এইতো পত্রোত্তর দেওয়া হলো। পত্রোত্তরের সঙ্গে এই গানটিও নজরুল নার্গিস বেগমকে পাঠিয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। (কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা। ৩য় সংস্করণ। পৃ: ১২৩) গানটি শিল্পী সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত গ্রামোফোন কোম্পানীর রেকর্ডে গেয়ে ছিলেন।
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/ কেন মনে রাখ তারে।/ ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।/ আমি গান গাহি আপনার দুখে,/ তুমি কেন আসি দাঁড়াও সমুখে,/ আলেয়ার মত ডাকিও না আর/ নিশীথ-অন্ধকারে।’

নার্গিসের পত্রের উত্তর কেবল গানের মাধ্যমেই পরিপূর্ণভাবে দেয়া সম্ভব ছিলো না- এটা কবি নিষ্ঠার সঙ্গেই উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই কলকাতার ১০৬ নং আপার চিৎপুর রোডের গ্রামোফোন রিহার্সেল রুম থেকে নার্গিসকে একটি চিঠিও লিখে ছিলেন কবি।
প্রমীলার সঙ্গে নজরুল ইসলামের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯২১ সালের মার্চ মাসে। আলী আকবর খানের সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়ি দৌলতপুর গমনের পথে কবি কুমিল¬ায় খান সাহেবের স্কুল জীবনের বন্ধু শ্রী বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় এসে ওঠেন। বীরেন্দ্রর বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন ত্রিপুরা জেলার কোর্ট অব ওয়ার্ডের ইন্সপেক্টর। আর দোলন ওরফে প্রমীলা হচ্ছেন বীরেন্দ্রর জ্যেঠতুত বোন। আলী আকবর খানের বন্ধু হিসেবে বীরেন্দ্রদের বাড়িতে এটা নজরুল ইসলামের প্রথম পদার্পণ হলেও প্রথম যাত্রায় দৌলতপুর গমনের পথে যে ৪/৫ দিন কবি এ বাড়িতে ছিলেন, তার মধ্যেই বাড়ির সকলকে আপন করে নিলেন।

গৃহকর্তা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তও এই যুবক সৈনিক কবিকে নিজ বাড়িতে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। আর্থিক দিক থেকে খুব একটা স্বচ্ছল ছিলো না পরিবারটি, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতোমধ্যেই ভারতজোড়া খ্যাতি কুড়িয়েছেন যে কবি, তাঁকে নিজ বাড়িতে পেয়ে ইন্দ্রকুমার সন্তুষ্টই হলেন। খবর পেয়ে কবিকে দেখতে আসলেন শহরের তরুণ-যুবক আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এদের সবাইকে হাসিমুখে বরণ করছেন তিনি। এদিকে ইন্দ্রকুমারের স্ত্রী, বীরেন্দ্রর মা বিরজাসুন্দরী দেবীকে ‘মা’ ডেকে মন্ত্রমুগ্ধই করে ফেললেন কবি এবং মৃত্যু অবধি এই মহীয়সী নারীই নজরুল ইসলামের মায়ের আসন জুড়ে থাকলেন।

 এ বাড়ির প্রতিটি সদস্যের উপস্থিতিতে আন্তরিক পরিবেশে গান গেয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করে প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন। কবির কুমিল¬া জীবনের অকৃত্রিমভক্ত সুলতান মাহমুদ লিখেছেন,
‘ ..... নজরুল কুমিল¬া থাকাকালে সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পারলাম যে নজরুলের সঙ্গে তাঁর ভাবী পতœী কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তার পূর্বরাগ চলছে। নজরুল আমাকে নিতান্ত ছেলে মানুষ মনে করতেন। খেয়ালী কবি অসাবধান মুহূর্তে আমার মতো এক অসমবয়স্ক ভক্তের কাছে নিঃসঙ্কোচে তাঁর পূর্বরাগের অনেক কথাই বলতেন। কোনো কোনো সময় আমাকে দৌত্যকার্য করতে হতো। এই দৌত্যকার্যে আমি কোনও দিন তাঁর বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি। কবি মনে করতেন, আমি কিছুই বুঝি না। আমি কিন্তু সবই বুঝতাম, তবে মুখ ফুঁটে রা’টি করিনি। অবস্থা বিপর্যয়ে কোন নদীর জল কোন সাগরে গড়াবে তাই শুধু ভাবতাম।

কবি একদিন মার্চ মাসের প্রথম ভাগে আমার হোস্টেলে কবিতা লিখতে বসলেন। আর কোন দিন তিনি হোস্টেলে বসে কবিতা লিখেন নি। আমি নিকটে গেলে বললেন, ‘প্রেমপত্র নয়, কবিতা।’ এ কথার পর আমি কামরার বাইরে গিয়ে নজরুলের চায়ের জোগাড় করলাম ও ঝারু মোল¬ার কামরাতেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম।
প্রায় আধঘণ্টা পর কবি আমাকে ডাকলেন ও কবিতাটি যে কাগজে লিখে ছিলেন সে কাগজটা ভাঁজ করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমি যেন সেটা তখনই দুলীর হাতে পৌঁছে দিয়ে আসি। তাঁর নাকি তখন সোনারং কম্পাউণ্ডে যাবার কথা। সেখান থেকে অতীন্দ্রমোহন রায়কে নিয়ে তিনি কুমিল¬া চকবাজারের ধারে গোমতীর তীরে এক ফকিরের সন্নিধানে যাবেন। বোধহয়, সে ফকিরকে লোকে ‘বাশাডার ফকির’ বলতো। আমি বললাম, - ‘কবিতা পড়তে পারি?’ তিনি বললেন, - ‘খুউব পড়তে পার’।

 ততক্ষণে চা এসে গেলো। তিনি চায়ে চুমুক দিলেন, আমি মনে মনে কবিতাটি পড়লাম। কবিতাটির নাম ‘বিজয়িনী’। কবিতাটি উদ্ধৃতি করছি। ‘হে মোর রানী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।/ আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।/ আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী/ দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হ’য়ে উঠে ভারী,/ এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি/ এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে॥/ ওগো জীবন- দেবি!/ আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,/ আজ বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!/ আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চূড়ে,/ বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,/ যত তুণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,/ আমি   বিজয়ী আজ নয়ন জলে ভেসে।’
ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে, ১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বার কবির ঢাকা সফরের সময়। এই পরিচয় কবির দিক থেকে ক্রমে পরিণয়ের দিকে ধাবিত হলেও ফজিলাতুন্নেসা সাড়া দেন না। ব্যাকুল কবি ফজিলাকে নিয়ে একের পর এক গান-কবিতা লিখতে লাগলেন।

 বন্ধু মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে চিঠি লিখে ফজিলার খবরাখবর জানতে চাইতেন। কবির এই উদ্বেগাকুলতা দেখে মোতাহার হোসেন এক সময় প্রমাদ গুণলেন। কিন্তু নজরুল দমার পাত্র নন। ফজিলাতুন্নেসার অব্যাহত উপেক্ষার প্রেক্ষাপটে কবি বেশ কিছু কবিতা-গান রচনা করেন। তার মধ্যে সবিশেষ উলে¬খযোগ্য দীর্ঘ কবিতা ‘এ মোর অহঙ্কার’। এতে কবি প্রিয়াকে না পাওয়ার বেদনাধারা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার,/ তোমায় আমি করব সৃজন, এ মোর অহঙ্কার।/ এমনি চোখের দৃষ্টি দিয়া/ তোমায় যারা দেখল প্রিয়া,/ তাদের কাছে তুমি তুমিই। আমার স্বপনে/ তুমি নিখিল রূপের রানী মানস-আসনে! ...।’

আদি ঢাকার বনেদীপাড়া বনগ্রামের অধিবাসী ছিলেন রানু সোম। সুমিষ্ট কণ্ঠের জন্য ১৩ বছর বয়সেই গান গেয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ রায়ের কাছে প্রথম তাঁর নজরুল গীতির হাতেখড়ি। ইতোমধ্যে ক’খানা গ্রামোফোন রেকর্ডও বেরিয়ে গেছে। কলকাতায় নজরুল দিলীপ রায়ের কাছেই ঢাকার মেয়ে রানু সোমের কথা প্রথম জানতে পারেন। পরবর্তী জীবনে রানু সোম কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং প্রতিভা বসু নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে ঢাকায় এসে কাজী মোতাহার হোসেনের সহায়তায় ঠিকানা খুঁজে নিজেই একদিন নজরুল উপস্থিত হন রানুদের বাড়িতে।

প্রথম সন্ধ্যায় গুরু দর্শনের রেশ কাটিয়ে না উঠতেই কিশোরী প্রতিভা পরের সকালে পুনরায় চমকিত হলেন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। দরজায় তখন দাঁড়িয়ে নজরুল ইসলাম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এসে পড়লাম বুঝলে? বেলা বাড়তে দিলে কি আর উপায় আছে? সব ছেলেরা ঠিক ভিড় করবে, ধরে নিয়ে যাবে কোথাও। এখান থেকে ফিরে গিয়ে কাল রাত্তিরে একটা গান লিখেছি, এক্ষুণি শিখিয়ে দিতে হবে। নাও, নাও, শীগগির চা খেয়ে নাও। আবার ভুল হয়ে যাবে।’
সেই সাত সকালেই শুরু হয়ে গেলো প্রতিভার গান শেখার পালা। রাতের লেখা গানটি তুলতে লাগলেন কবি ..... ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়,/ আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়।’

প্রতিভা জানাচ্ছেন, ‘এই গানটি লিখেছেন রাতে। দেখা গেলো তখনো তার বয়ান ও সুরারোপ সম্পূর্ণ হয়নি, আমাকে শেখাতে শেখাতেই বাকীটা ঠিক করে নিলেন। পকেট থেকে কলম বেরুলো, কাটাকুটি কাগজ বেরুলো, গলা থেকে সুর বেরুলো, গানে সম্পূর্ণতা এলো। দিন তিনেক বাদে আর একটি গান তৈরি হল, - ‘এত জল ও কাজ চোখে পাষাণী আনলে বল কে।’
যখন গানে বসতেন অবিশ্রান্ত চা খেতেন বলে আমার মা মাঝে মাঝেই অপ্রত্যাশিতভাবে এককাপ চা এনে দিতেন হাতে, আহল¬াদে আটখানা হয়ে উঠতেন, ‘নাহ মার মতো মেয়ে হয় না’- সেদিন গেয়ে উঠলেন,  ‘এতো চা ঐ পেয়ালায় এমন করে আনলে বলো কে? এইটুকু থেকেই পরের দিন ঐ গান রচিত হয়ে এলো।’

এভাবেই নজরুলের কাছে রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসুর গান শেখার পালা শুরু। এ যাত্রায় নজরুল প্রায় মাস খানেক ঢাকায় থাকেন এবং প্রায় প্রতিদিনই রানুকে গান শেখাতে তাদের বনগ্রামের বাসায় যেতেন। এমনই এক গানের জলসায় ১৩৩৫ সালের ৭ আষাঢ় রানুদের বাড়িতে বসেই ‘শ্রীমতি রানু সোম কল্যাণীয়াসু’ কে উদ্দেশ্য করে লিখলেন, ‘মাটির উর্ধ্বে গান গেয়ে ফেরে/ স্বরগের যত পাখি,/ তোমার কণ্ঠে গিয়াছে তাহারা/ তাদের কণ্ঠ রাখি’।/ যে গন্ধর্ব-লোকের স্বপন/ হেরি’ মোরা নিশিদিন,/ তুমি আনিয়াছ কণ্ঠ ভরিয়া/ তাদের মুরলী বীণ।/ তুমি আনিয়াছ শুধু সুরে সুরে/ ভাষাহীন আবেদন,/ যে সুর মায়ায় বিকশিয়া ওঠে/ শশী তারা অগণন।/ যে সুরে স্বরগে স্তব-গান গাহে/ সুন্দর সুরধুনী/ অসুন্দর এই ধরায় তোমায়/ কণ্ঠে সে গান শুনি।’  ‘কবিদা’।

রচনার দীর্ঘ ষোল বছর পর ‘কবিতা’ পত্রিকার নজরুল সংখ্যায় প্রথম এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল কার্তিক-পৌষ ১৩৫১। এটি ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী নতুন সংস্করণের তৃতীয় খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, ১৩৩৫ এর ৭ আষাঢ় উক্ত কবিতাটি রচনার পরের বছর ১৩৩৬ এর অগ্রহায়ণে কলকাতার ডি.এম. লাইব্রেরি কবির ‘চোখের চাতক’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করে। এটি কবি প্রতিভা বসুকে উৎসর্গ করে ‘উৎসর্গ-পত্রে’ লিখেছেন,
‘কল্যাণীয় বীণাকণ্ঠী/ শ্রীমতি প্রতিভা সোম/ জয়যুক্তাসু।’

১৯২৮ সালটি নজরুল ইসলামের জীবনে নানা কারণে বৈচিত্রময়। এ বছর ঢাকায় কবির সঙ্গে তিন গুণী তরুণীর ঘনিষ্ঠতা হয়। এদের প্রথম দু’জন ফজিলাতুন্নেসা ও রানু সোম (প্রতিভা বসু)। যাদের কথা ইতোমধ্যেই বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় জন উমা মৈত্র। উমার পিতা অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ছিলেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল। তিনি খুব ভালো কবিতা লিখতেন। গান এবং সনেটও লিখে ছিলেন বেশ কিছু। ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীতও গাইতেন। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট এবং ছবি আঁকাসহ ভালো পিয়ানো বাজাতেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে উমা মৈত্র, ডাক নাম ‘নোটন’। এই গুণী তরুণীও একাধারে ছিলেন সুন্দরী-বিদূষী এবং সেতার বাজাতে সিদ্ধহস্ত। তাঁর ওস্তাদ ছিলেন বিখ্যাত সেতারী হায়দার আলী। ভালো ছবিও আঁকতেন নোটন। টেনিস ও দাবা খেলাতেও ছিলেন পারদর্শিনী। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা না পেলেও অথবা এ বিষয়ে আগ্রহী না হলেও নজরুল ইসলাম ও দিলীপ কুমার রায়ের গানের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে সেতারে সঙ্গত করতেন।

নোটনের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন বিলাতী ধাঁচের ব্রাহ্মণ, বন্ধুবৎসল ও উদার মনের অধিকারী। দেশের বিখ্যাত সব শিক্ষাবিদ, শিল্পী সাহিত্যিকরা ছিলেন এঁদের পারিবারিক বন্ধু। এদের মধ্যে উলে¬খযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন, সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দাবাড়– কাজী মোতাহার হোসেন, গণিতের অধ্যাপক বঙ্কিমদাশ ব্যানার্জী প্রমুখ। সেই সুবাদে নজরুল ইসলামও হয়ে উঠে ছিলেন মৈত্র পরিবারের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। হিন্দু-মুসলমানের কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিলো না এই পরিবারে। উভয় ধর্মের গুণী মানুষরাই এই পরিবারে সজ্জন ব্যবহার ও উষ্ণ অভ্যর্থনা পেতেন।

উমা মৈত্র ওরফে নোটন ছিলেন অভিজাত ব্যক্তিত্ব ও শান্ত স্বভাবের ‘অপূর্ব সুন্দরী’ রমণী। অধ্যাপক মোতাহার হোসেন একে ‘কাব্য প্রেরণাদায়ী আনন্দের নির্ঝরিণী’ ‘চযধহঃড়স ড়ভ ফবষরমযঃ’ রূপে মন্তব্য করেন। নজরুল সে যাত্রায় নোটনকে বেশ কিছু গান শেখান। এর মধ্যে উলে¬খযোগ্য কয়েকটি গান হচ্ছে,
১.    ‘নিশি ভোর হ’ল জাগিয়া/ পরান-প্রিয়া।/ কাঁদে ‘পিউ কাহা’ পাপিয়া/ পরান পিয়া॥’
২.    ‘আজি এ কুসুম-হার/ সহি কেমনে।/ ঝরিল যে ধুলায়/ চির-অবহেলায়/ কেন এ অবহেলায়/ পড়ে তা’রে মনে॥’
৩.    ‘বসিয়া বিজনে/ কেন একা মনে/ পানিয়া ভরণে/ চললো গোরী।/ চল জলে চল/ কাঁদে বনতল,/ ডাকে ছলছল/ জল-লহরি॥’

    বাংলা সঙ্গীতের জগতে সমকালে এই গানগুলো বহুল প্রচারিত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ ধরনের আরো বহু বিখ্যাত গানের সঙ্গে নোটন নজরুলের সাথে সেতারে সঙ্গত করেন।
গান শেখাতে ও শোনাতে গিয়ে নজরুল কি নোটনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলেন? ভালোবেসে ফেলে ছিলেন নোটন ওরফে উমা মৈত্রকে? এ প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার। কিন্তু যখনই নজরুল জীবনে নারীর প্রসঙ্গ এসেছে বা কবি জীবনের প্রেমের অধ্যায় আলোচিত হয়েছে তখনই নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে। ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর একাধিক প্রবন্ধ-রচনায় নোটন তথা উমা মৈত্রের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর এই উদ্ধৃতি পরবর্তীতে নজরুল গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রায় সব নজরুল গবেষকই নোটন প্রসঙ্গকে গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন। যদিও নার্গিসকে, প্রমীলা বা ফজিলাতুন্নেসাকে যে ভাষায় কবি প্রেম নিবেদন করেছেন- উমা মৈত্রের ক্ষেত্রে সে ভাষা বা অনুভূতি প্রকাশের কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া না গেলেও ‘গানের আড়াল’ কবিতাটি উমার প্রতি কবির দুর্বলতাকেই অনেকাংশে প্রকাশ করেছে।

 ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে পরবর্তীতে কবিতাটি সঙ্কলিত হয়েছে। উদ্ধৃতি বিবেচ্য, ‘তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি- মোর কণ্ঠের গান-/ এইটুকু শুধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?/ অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়,/ গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?’
এ প্রসঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘ ..... কিন্তু নোটনের কাছ থেকে কোন রকম সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। তাঁর মুখের ভাবে স্বীকৃতির বিন্দুমাত্র চিহ্ন ফুটে উঠেনি কখনো। যেন দা ভিঞ্চির মোনালিসার মত তিনি ছিলেন সকল ধরা-ছোঁয়ার বাইরের এক মূর্তিমতী রহস্য। কারও কারও হয়ত মনে হতে পারে উলে¬খিত কবিতাটি প্রতিভা সোম ওরফে রানুকে উপলক্ষ করে লেখা; কিন্তু আমার আদৌ সন্দেহ নেই যে কবি তাঁর কাব্য প্রেরণাদাত্রীর পরিচয়টিকে যথাসাধ্য গোপন করার চেষ্টা করেছেন। কেবল নোটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অন্তরঙ্গতার জন্য নির্বাক আবেদনের যতটা প্রয়োজন ছিল অন্যের বেলায় ততটা ছিল না।’

নোটন প্রসঙ্গে স্মরণীয় আরো একটি উলে¬খযোগ্য গান হচ্ছে, ‘নাই পরিলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো জবার ফুল’। তবে মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, রানুর কণ্ঠে ‘অপূর্ব দ্যোতনায় রূপলাভ করত’ নিজের গজলটি, ‘কে বিদেশী/ বন-উদাসী/ বাঁশের বাঁশি/ বাজাও বনে।/ সুর-সোহাগে/ তন্দ্রা লাগে/ কুসুম-বাগের/ গুল-বদনে॥’
নজরুল ইসলামের সঙ্গে জাহানার চৌধুরীর পরিচয়ের সূত্র তাঁর ভাই আলতাফ চৌধুরী। সে কথার উলে¬খও করেছেন জাহানারা বেগম চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণে। এ প্রসঙ্গে ১৯৮৫ সালে রচিত ‘নজরুল স্মৃতি’ প্রবন্ধে আলতাফ চৌধুরী লিখেছেন, ‘কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৩০ সালে। কলকাতার পার্ক সার্কাসে তখন আমরা থাকতাম। নজরুলের বন্ধু নলিনীকান্ত সরকার আমাদের বাড়ি কোটাল পুকুরের (সাঁওতাল পরগণা) নিকটস্থ নিমতিতা (মুর্শিদাবাদ) গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ছেলে বেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন উনি।

উনি বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। গানের টিউশনিও করতেন। সঙ্গীত শিল্পী আর সাহিত্যিক মহলেই কাটতো তাঁর সারা দিন। সেই নলিনীদাই কাজী নজরুলকে আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। প্রথম দিনই দেখলাম, নজরুলের মনোভাব হচ্ছে সবাই তাঁর আত্মীয়। নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ক্রমেই গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হতে দেরি হলো না। তখন আমি আমাদের মা আর জাহানারা এক বাড়িতে থাকতাম।
জাহানারা বেগম লিখেছেন, ‘..... গানের প্রতি আমার খুব আকর্ষণ ছিলো, কিন্তু গলা ছিলো না। কবিতার ওপর ঝোঁক ছিলো সবচেয়ে বেশি। তাই নতুন কবিতার জন্যে কবিদাকে তাগাদা দিতাম সব সময়, কিন্তু প্রায়ই কোনো মাসিকপত্র সম্পাদক বা প্রকাশক আগেই তা হস্তগত করে ফেলতেন। একদিন তাঁকে বললুম, ‘আপনি লেখেন আপনার গোপালদার (ডি.এম. লাইব্রেরী) জন্যে, কালিকা প্রেসের শরৎবাবুর জন্যে, তাঁরা ছাপাবেন তখন আমি পড়তে পাবো। তা হতে পারে না। আমি খাতা দেবো আপনি তাতে লিখবেন, আমি কোনদিন সে কবিতা কাউকে ছাপাতে দেবো না। তা আমার একান্ত নিজের থাকবে। ওঁরা সবাই হলেন দোকানদার। কিন্তু আমি তো আপনার ভক্ত। আমার সৌভাগ্য, ভক্তের প্রার্থনা মঞ্জুর হলো।

কবি জাহানারা বেগমকে লাল কাপড়ে মোড়ানো যে খাতায় বিভিন্ন সময়ে কবিতা, গান লিখে দিয়েছেন, তার উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে, ‘মীরাকে’/ ‘নজরুল ইসলাম।’/ ‘দার্জ্জিলিঙ’।
মীরা জাহানারা চৌধুরীর ডাক নাম। উপরের স্মৃতিচারণে জাহানার প্রথম কোথায় কবির হাতে গানের খাতাটি তুলে দেন তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া না গেলেও এই খাতাটিতে কবি প্রথম লেখেন দার্জিলিঙে। উৎসর্গ পৃষ্ঠাই এর প্রমাণ। কিন্তু পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও বর্ণনা থেকে মনে হয় কলকাতার ল্যান্সডাউনের বাসায়ই জাহানারা কবিকে খাতাটি দিয়ে ছিলেন। তা হলে কি ঐ মহামূল্যবান খাতাটির প্রথম দিককার কিছু পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে? অথবা কোথাও ছাপার জন্য দেয়ার উদ্দেশ্যে খুলে নেয়া হয়েছে?

ঐ গানের খাতায় মীরাকে উৎসর্গ করা নজরুলের মোট ৮টি কবিতা ও ৭টি গান রয়েছে। এগুলোর প্রথম কলি/  শিরোনাম এবং রচনা স্থান ও তারিখ হচ্ছে নিম্নরূপ-  কবিতা- ১. সুন্দর তুমি, নয়ন তোমার মানস-নীলোৎপল।/ ২. আমার ধেয়ান-কমলে আলতো রাখিয়া চরণখানি।/ ৩. সুন্দর তনু, সুন্দর মন,হৃদয় পাষাণ কেন?/ ৪. আমার অশ্র“-বর্ষার শেষে ইন্দ্রধনু মায়া।/ ৫. ওপার হইতে আসিয়াছে ভেলা, বাজিছে বিদায়-বাঁশি।/ ৬. এপারেতে একলা আমি মধ্যে আমার বাণীর ধারা।/ ৭. তুমি বুঝিবে না মোরে।/ ৮. রৌদ্রোজ্জ্বল দিবসে তোমার আসিনি সজল মেঘের ছায়া।/ গান- ১. এলে কি স্বপন-মায়া আবার আমায় গান গাওয়াতে।/ ২. আমি অগ্নিশিখা, মোরে বাসিয়া ভালো।/ ৩. আজ গানে গানে ঢাকব আমার গভীর অভিমান।/ ৪. থাক সুন্দর মিথ্যা আমার।/ ৫. সাগরে যে জোয়ার জাগে জানে না তা চাঁদ।/ ৭. প্রিয় তুমি কোথায় আজি।/

এই কবিতা-গানগুলোর প্রত্যাশিত সঙ্কলনটি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে। কবির জন্মশতবর্ষে আব্দুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদনায় নজরুল ইনস্টিটিউট এটি প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের ভূমিকাংশে জাহানারা বেগম চৌধুরী উলে¬খ করেন, ‘কাজী নজরুল ইসলামের এই অপ্রকাশিত কবিতাগুলো তাঁর স্নেহের দান স্বরূপ তিনি আমাকে দিয়ে ছিলেন। এতদিন একান্ত ব্যক্তিগত অমূল্য সম্পদের মতোই এগুলো কৃপণের মতো নিজের কাছে বন্ধ করে রেখে ছিলাম। এতদিন এগুলো অজ্ঞাত ছিল, আজ তাদের আলোর মাঝে মুক্ত করে দিয়ে প্রকাশ করার সময় এসেছে।’

গান শেখাতে গিয়ে অন্যান্যের মতো শিল্পী কানন দেবীর সঙ্গেও নজরুল ইসলামের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে সমকালে নানা কথা রটে শিল্পী মহলে। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই রটনাকারীদের অগ্রজের ভূমিকা পালন করেন সজনীকান্ত দাশ গং এবং ‘শনিবারের চিঠি’ পক্ষ। ঔৎসুক্য সৃষ্টিকারী এসব মুখরোচক রটনা অবশ্য বেশি দিন বাজার মাত করে রাখতে পারে নি। খুব অল্পকালের মধ্যেই কবির সজ্জনরা বাস্তব উপলব্ধি করে ফেলতেন। ফলে নতুন রটনায় মেতে উঠতো ‘শনিবারের চিঠি’। এই পত্রিকাটির একমাত্র কাজই ছিলো নজরুলের বিরোধিতা করা এবং বিরোধিতার নামে কুৎসা রটানো। ঢাকার বনগ্রামে রানুকে গান শেখাতে গিয়ে সজনীকান্তের কুকর্মে কবি কি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই না পড়ে ছিলেন। সে যাত্রায় দস্তুরমতো দৈহিকভাবে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন কবি হিন্দু যুবকদের দ্বারা।
কানন দেবীকে ঘিরে কবিকে নিয়েও এমন একটি সংবাদ রটানো হয়েছিল যে, কবিকে কলকাতায় কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতে অবশ্যই পাওয়া যাবে। অথচ কানন দেবীর সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিলো গুরু-শিষ্যার। গান শেখার জরুরি প্রয়োজনে কানন দেবীর আকুলতার কাছে পরাভূত হয়েই কবি তাঁর বাড়ি যেতেন। নিত্য নতুন গানের সুর তুলে দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতো শিষ্যার বাড়িতে। গ্রামোফোন রেকর্ডের রিহার্সাল রোম বা আর দশটা গানের তালিমের ক্ষেত্রে কবির যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে, কানন দেবীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অথবা সুর ভাজতে ভাজতে গভীর রাত হয়ে যাওয়ায় শিষ্যার গৃহে অবস্থানের ঘটনাকেই নিন্দুকেরা কুৎসিত রটনার উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছে।

মেগাফোন কোম্পানীর স্বত্বাধিকারী জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ এর মাধ্যমে কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় কানন দেবীর। এরপর গুরুকে শিষ্যা তাঁর কণ্ঠ দিয়ে মুগ্ধ করে তোলেন এবং কবির অনেক বিখ্যাত গানেই কণ্ঠ দিয়েছেন কানন দেবী।  এরমধ্যে উলে-খযোগ্য হচেছ ১৯৩৯ সালের মে মাসে চিত্রায়িত ‘সাপুড়ে’ চলচ্চিত্রের গানগুলো। মেগাফোনে রেকর্ডকৃত এই চলচ্চিত্রের একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ/ঐ পাহাড়ের ঝর্ণা আমি। ঘরে নাহি রই গো ....।’
‘কবি প্রণাম’ প্রবন্ধে ১৯৩০ এর দশকের এইসব নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করে কানন দেবী জানাচ্ছেন, ‘এক দিন জে. এন. ঘোষ মেগাফোনের রিহার্সাল রুমে কবির (নজরুল ইসলাম) সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

 ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে চেয়ে দেখি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্র লোক হার্মোনিয়ামের সামনে বসে আস্তে আস্তে বাজাতে বাজাতে গুন গুন করে সুর ভাঁজছেন চোখ বুঁজে। কখনও এ ধার ও ধার তাকাচ্ছেন, কিন্তু কোনো কিছুর উপরই ঠিক যেন মন নেই। এক সময় হার্মোনিয়াম থামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। দীপ্ত দুটি চোখের উজ্জ্বলতার মধ্যেই যেন তাঁর ব্যক্তিত্ব কথা বলে উঠল। ঐ চোখ দুটিই যেন তাঁকে দেখিয়ে দেয়। ....
আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘ডাগর চোখে দেখছ কি? আমি হলাম ঘটক, জানো? এক দেশ থেকে সুর, অন্য দেশের কথা। এই দুই দেশের এই বর-কনেকে এক করতে হবে। কিন্তু দু’টির জাত আলাদা হলে চলবে না, তা হলেই বে-বন্তি। বুঝলে কিছু? ....

ছবির গান ও সুর বাঁধার সময়ও দেখেছি কত প্রচণ্ড আনন্দের মধ্যে কি প্রবল ভাবেই না কবি বেঁচে উঠতেন, যখন একটা গানের কথা ও সুর ঠিক তাঁর মনের মত হয়ে উঠত। মানুষ কোনো প্রিয় খাদ্য যেমন রসিয়ে রসিয়ে আস্বাদ করে, কাজী সাহেব যেন তেমনি করেই নিজের গানকে আস্বাদ করতেন।’
‘বিদ্যাপতি’ চরিত্রের কিছু গানও কানন দেবী নজরুলের কাছে দীক্ষা নেন। এ ধরনের একটি উলে¬খযোগ্য গান হচ্ছে ‘সখি কে বলে পীরিতি ভালো’ (জে. এন. জি. ৫২২৭)।’ ‘কথা কইবেনা বউ’ কানন দেবীর কণ্ঠে কবির আর একটি উলে¬খযোগ্য গান (জে.এন.জি. ৫৩৮০)।
শুধু কানন দেবীই নন, কবির কাছে গান শিখেছেন আরো অনেক ভারত বিখ্যাত বাংলা সঙ্গীতের রানীকুল। এদের মধ্যে উলে-খযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন ইন্দুবালা দেবী, আঙ্গুর বালা দেবী, বিজনবালা ঘোষ দস্তিদার, সুপ্রভা সরকার ও ফিরোজা বেগম প্রমুখ। সঙ্গীতের আধুনিক যুগে পৌঁছেও নতুনদের কাছে এরা অনুকরণীয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নজরুলের গানকে এঁরা আজো চির আবেদনময়ী করে রেখেছেন, এই বিরল কৃতিত্বের  প্রধান কারণ মনে হয় কবি নিজের হাতে এঁদের গান শিখিয়েছেন।

যে অর্থে রানু সোম, উমা মৈত্র বা জাহানারা বেগম চৌধুরীকে গান শেখাতে গিয়ে কবি তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন, তাঁদের নিয়ে গান লিখেছেন, এমনকি বইও উৎসর্গ করেছেন, কানন দেবী, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, বিজনবালা, সুপ্রভা সরকার বা ফিরোজা বেগম এর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। এর কারণ রানু, উমা, জাহানাদের কবি গান শিখিয়েছেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। ওটি ছিলো তাঁর উঠতি সময়। নিজের গানকে মিষ্টি কণ্ঠে জনপ্রিয় করতে কবির ভেতর সে সময় প্রবল তাগিদও কাজ করেছে। পক্ষান্তরে বাংলা সঙ্গীত জগতে নজরুল যখন প্রতিষ্ঠিত এবং গ্রামোফোন রেকর্ড  কোম্পানীতে পেশাদার কম্পোজার হিসেবে কাজ করছেন, সে সময় পেশাগত প্রয়োজনেই কানন দেবী, ইন্দুবালা, আঙ্গুর বালা, বিজনবালা, সুপ্রভা সরকার বা ফিরোজা বেগমরা গ্রামোফোন কোম্পানীতে কবির কাছে গান শিখতে গেছেন। কবিও পেশাগত দায়িত্ব হিসেবেই এঁদের গান শিখিয়েছেন। এ কারণেই রানু, উমা বা জাহানারাদের সঙ্গে এঁদের অবস্থান বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে পার্থক্য গোচর হয়।

লক্ষণীয় দ্রষ্টব্য হচ্ছে, জীবনের নানা স্তরে কবির সঙ্গে বিভিন্ন নারীর বিচিত্রসব সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তারমধ্যে কেউ হয়েছেন জননী স্বরূপা, কেউবা প্রেয়সী অথবা ভগিনী। এর মধ্যে যখন যে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন কবি, তখনই তার আরাধনার চূড়ান্ত করেছেন। মাতৃভক্তির ক্ষেত্রে কবিকে যেমন আকুল হতে দেখা যায়, প্রেয়সীকে কাছে পাবার জন্যেও তেমনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন কবি। তবে তাঁর মাতৃভক্তি সকল ক্ষেত্রে অক্ষুণœ থাকলেও নিজের জন্মদাত্রী জননী এই পুত্রভক্তির অঞ্জলি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। একইভাবে প্রিয়তমা প্রেয়সীর জন্য হৃদয় তাঁর হাহাকার করে উঠলেও এ সম্পর্কে বিরূপ অনুভূতিও কখনো কখনো তাঁর কবি মনকে তাড়িত করেছে। নারী সম্পর্কে কবির মনোভাবের এই পার্থক্যের কারণ নিঃসন্দেহে তাঁর রক্তে-মাংসে গড়া দেহ-মন এবং দয়িতার ছলচাতুরীও বটে।

নারীকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কবি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। তারমধ্যে ‘নারী’ নামেই তাঁর একাধিক কবিতা রয়েছে। এর একটি ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে, অপরটি ‘শেষ সওগাত’ এ সঙ্কলিত হয়েছে। এছাড়াও অজস্র প্রেমের কবিতা-গানে নারী  সম্পর্কে কবি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। যার অধিকাংশই অনুকূল মনোভাবের প্রকাশে অলংকৃত, কিছু কিছু অবশ্য ব্যতিক্রম, বিতশ্রদ্ধ উপলব্ধির প্রকাশও রয়েছে।

ড. আবুল আজাদঃ ডেপুটি রেজিষ্ট্রার (উচ্চ শিক্ষা ও বৃত্তি) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইমেইলঃ abulazad1961@gmail.com

- See more at: http://protidinersylhet.com/single/258#sthash.mkUUIs19.dpuf

No comments:

Post a Comment