Friday 5 May 2017

‘কাশ্মীর দখল করতে গিয়ে অন্য প্রদেশ হারানো লাগতে পারে’



‘কাশ্মীর দখল করতে গিয়ে অন্য প্রদেশ হারানো লাগতে পারে’



১৯৪৭ সালে কাশ্মীর যখন ভারতে যোগদানে সম্মত হয় তখন থেকেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা মুকুটের একটি অলংকার হয়ে আছে। একটি ধর্মের জন্য তৈরি দেশ পাকিস্তানের অবিকল প্রতিরূপ হতে যাচ্ছিল না ভারত। এর পরিবর্তে বহুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ছিল ভারতের মূল বিশ্বাস এবং সব ধর্মের জন্য ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়েই কাশ্মীরকে গ্রহণ করেছিল ভারত। কিন্তু আজ যদি ধর্মনিরপেক্ষ ভারত একটি অঘোষিত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয় তাহলে কাশ্মীর অধিগ্রহণের প্রেক্ষাপটটি কি ভুল মনে হবে না?

কাশ্মীর আমাদের, কিন্তু কাশ্মীরের জিহাদী এবং ইন্টারনেটে সরব জাতীয়তাবাদীদের ইঙ্গিত হল তারা ভারতের অধিবাসী হবার চেয়ে তাদের স্ব-শাসনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। আজ কাশ্মীর একটি সেনানিবাসে পরিণত। সেখানে লক্ষ লোক নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক। ২৪ ঘণ্টা পুলিশি নিয়ন্ত্রণে সেখানকার অধিবাসীরা। কাশ্মীরের তরুণরা পেলেট গানে অন্ধ হয় এবং সেখানকার পাথর নিক্ষেপকারীরা ভারতের সেনাবাহিনীর সামনে রক্তাক্ষয়ী সংঘাতেও দাঁড়িয়ে থাকে অবিচল। কাশ্মীরে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যর্থ হয়েছে এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বকেই (হিন্দু এবং মুসলিম দুই জাতি একসাথে থাকতে পারে না) সেখানে বিজয়ী বলে মনে হচ্ছে।

একটি সেনা জীপের সামনে এক কাশ্মীরিকে বেঁধে রাখার দৃশ্যটি ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়ে গেছে। সামরিক মেশিনের বিরুদ্ধে এটি ব্যক্তিগত শক্তিহীনতার এক পাঠ্য প্রতীক যা তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ট্যাংকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা ওই নির্ভীক ব্যক্তির মানবমূর্তিসম নিদর্শনের সাথে তুলনীয়। প্রতিবাদকারী এবং সেনাবাহিনী উভয়ই এর বলি। কাশ্মীরিদের তাড়া করছে প্রতিদিনকার অবিচার, কারাবরণ আর মৃত্যু। দেয়ালে পিঠ ঠেকা তীব্র প্রতিবাদকারী তরুণদের তরঙ্গসম প্রতিরোধে অবসন্ন সৈন্যরা তাদের সহ্যশক্তির সীমায় দাঁড়িয়ে। প্রকৃতপক্ষে, কাশ্মীরের সংকটটি বৈচিত্র্য মেনে নেয়ার জন্য ভারতের অসামর্থতার বাস্তবতাই প্রদর্শন করে। তাদের কাছে মুসলমানরা কেবলমাত্র গ্রহণযোগ্য হয় যখন তারা সংখ্যায় কম থাকে কিন্তু কাশ্মীর বা উত্তরপ্রদেশের মত বড় সংখ্যক হলে নয়।

কাশ্মীরে আজাদি আন্দোলন এখন আর রাজনৈতিক মনোভাবে আটকে নেই বরং তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এটি ইসলামী পরিচয়-কেন্দ্রিক মতাদর্শিক যুদ্ধে পরিণত। নেহেরুর আদর্শের এই পতনে কি জিন্নাহর আত্মা গোপনে হাসছে?

পাকিস্তানের জন্য কাশ্মীরের বিভাজন এক অসমাপ্ত এজেন্ডা। ‘হিন্দু শাসনের’ প্রতি তাদের ঘৃণা একটি সন্ত্রাসী যন্ত্রের জন্ম দিচ্ছে। তবুও ভারতীয় রাজ্য কখনোই কাশ্মীরি মুসলমানদের নাগরিকত্ব সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। জাঠ প্রতিবাদও সহিংস হয়ে উঠেছে। হার্ডিক প্যাটেলের নেতৃত্বাধিন বিক্ষোভ বাড়িঘর পুড়ানো পর্যন্ত চলে গেছে। কিন্তু হরিয়ানা বা গুজরাটে পেলেট বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছে কি? না, কারণ কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের মত গুজরাটি বা জাঠদের পাকিস্তানি এজেন্ট হিসেবে দেখা হয় না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো পাকিস্তানি ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ কি শুধু ভারতীয় সেনা ও বন্দুক ঢেলে দিয়ে ঠেকানো যাবে? এর পরিবর্তে কাশ্মীরি মুসলমানদের কি ভারতীয় প্রকৃত নাগরিক হিসেবে গণ্য করা যায় না? কাশ্মীর ভারতের এক ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ মনোভাবের মধ্যে বন্দী। আমলাতান্ত্রিক সন্দেহ, কুসংস্কারের ফাঁদ, এবং এক ধরণের আইনি অস্থিরতা যেকোনো সাধারণ নাগরিকের প্রতিবাদকে একটি ভয়ানক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ হিসেবে দেখার সন্ত্রস্ততা সৃষ্টি করেছে। কাশ্মীরি যুবকরা কখন সাধারণ মানুষ হওয়া বন্ধ করেছে? কখন তারা সবাই ‘মডিউল’ বা ‘স্লিপার সেল’ বা ‘অপারেটিভ’ হয়ে ওঠেছে? অতি নাটুকে বানানো কেচ্ছা কাহিনীই এখন কাশ্মীরের ব্যাপারে ভারতের ধারণার রূপ তৈরি করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলাম মূলত সুফি বা আহমাদিয়াদের মত ভিন্নমতকে মুছে দিয়ে একটি অবিভক্ততার মধ্যে তাদের বিশ্বাসীকে একত্রিত করার চেষ্টা করে। একইভাবে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ বর্ণ ও আঞ্চলিক পরিচয় না ধরে সর্বসমেত হিন্দুত্বের একই ছাতার নিচে আনতে চায়। গরুর মাংস খাওয়া, যুক্তিবাদী, স্লোগান-ধ্বনিত ছাত্ররা এই জাতীয়তাবাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর কাশ্মীরী মুসলমানরাও নয়। তবুও মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি একটি ঐতিহাসিক সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিজেপি-পিডিপি জোট একটি সাফল্য পেতে পারত। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ হিন্দু জম্মু ও মুসলিম উপত্যকার মধ্যকার ফাটল অনেক বেশী গভীর যা মানুষকে পরিবর্তিত না করে শুধু রাজনৈতিক কলাকৌশল দিয়ে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। যেখানে বাজপেয়ি ইনসানিয়াতের কথা বলেছিলেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন সেখানে মোদী “সন্ত্রাস বনাম পর্যটন” সাদাকালো এক চক্রের মধ্যে নিজেকে বন্দী করছেন। মুদ্রা রহিতকরণের মত বড় ঝুঁকি গ্রহণকারী ব্যক্তি কাশ্মীরে ঝুঁকি থেকে বিমুখ হয়েছেন। ভারতের বাকি অংশের প্রভাবশালী হিন্দুত্ব এবং কাশ্মীরের রাজনৈতিক শূন্যতা বিশ্বাসের সঙ্কটের দিকে নিয়ে গেছে আমাদের।

বোরহান ওয়ানির হত্যার মধ্যে গত বছর এই উপত্যকায় এক গণবিস্ফোরণ ঘটেছে এবং পেলেট গান ‘ভারতীয় দখল’ এর একটি প্রতীক হয়ে ওঠেছে। এখন পর্যন্ত পেলেট গানের শিকারগ্রস্তদের মধ্যে ১৪ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। শপিয়ানের ১৪ বছর বয়সী ইনশা মালিক এখনও বিছানায় শুয়ে আছে, তার দুই চোখই অন্ধ। কাশ্মীরি ছাত্ররা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রতিদিনই বৈষম্যের মুখোমুখি হয়। ভারতীয় রাষ্ট্র কীভাবে কাশ্মীরি মুসলিমকে দেখে তার আরেকটি উদাহরণ হল মোহাম্মদ রফিক শাহের ১২ বছরের জন্য ভুলভাবে বন্দী থাকার ঘটনা। যাকে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও দোষী বলে গণ্য করা হচ্ছে।

কাশ্মীরের মাটিতে শাসন ও ন্যায়বিচার প্রদান সবসময়ই ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ হিসাবে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতার একটি পরীক্ষা হয়ে থাকবে। এখনও পর্যন্ত যে পরীক্ষায় ভারত ব্যর্থ হয়েছে। আজ গো-রক্ষাকারীরা একদিকে হিন্দু ক্রোধ প্রতিফলিত করে, অন্যদিকে পাথর নিক্ষেপকারীরা মুসলিমদের দুর্দশা প্রতিফলন করে। আর তা শেষ পর্যন্ত ভারতের মধ্যে একটি নৃশংস বিভক্তিরই প্রকাশ ঘটায়। কাশ্মীর সংকট সমগ্র ভারতের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের এক ব্যাপক পতন। সম্ভবত জিন্নাহই সঠিক ছিলেন । সম্ভবত মহাত্মা গান্ধী একটি অসম্ভব স্বপ্ন দেখেছিলেন। সম্ভবত ভারতের জন্য নেহেরুর ধারণা একটি কল্পলোক ছিল মাত্র।

[টাইমস অফ ইন্ডিয়া থেকে এসএএম স্টাফ অনুদিত]
http://somoy.net/opinion/45368

No comments:

Post a Comment