ভারতীয় সিরিয়াল আগ্রাসন স্টার জলসা, পরিবার ও রাজনীতি
কাকন রেজা
star jalsha কয়েকদিন আগে ই-প্রথম আলোর একটি খবরে দুঃখিত হব না বিস্মিত হব বুঝতে পারছিলাম না। খবরটির শিরোনাম ছিল এরকম ‘স্টার জলসা দেখা নিয়ে মারামারি, হাসপাতালে স্বামী-স্ত্রী’।
খবরটিতে বলা হয়েছে, যশোরের ঘোপ বেলতলা এলাকার রিকশা চালক আব্দুর রহমান ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ‘কিরণমালা’ দেখতে দুপুরে রিকশা চালানো বাদ দিয়ে বাড়িতে আসে। এ নিয়ে স্ত্রী লিপির সাথে তার বাদানুবাদের এক পর্যায়ে সে স্ত্রীকে দরজা আটকানোর ‘খিল’ দিয়ে আঘাত করে। স্ত্রী লিপিও উত্তেজিত হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। ফলে দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ভারতীয় সিরিয়াল নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। কয়েকটি চ্যানেল বন্ধে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলতে গেলে অবশ্য অঙ্ক কষে কথা বলতে হয়। বিচার বিভাগ নিয়েও একই কথা। তবে ভারতীয় সিরিয়াল আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির প্রায় বারোটা বাজাতে চলেছে এ নিয়ে খুব বেশি দ্বিধা আমজনতার মধ্যে নেই। আমাদের দেশের মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষেরা ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাবে আজকাল রীতিমতো তথাকথিত উচ্চবিত্তের ‘প্রগতিশীল’ জীবন-যাপনের জোর চেষ্টা করছে। আর এই ‘চেষ্টা বিষয়ক’ জটিলতায় ঘটছে নানা বিপত্তি।
ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতে ‘পরকীয়া’ একটি স্বাভাবিক বিষয়। অবশ্য আমাদের দেশেও অনেকে কবিতার পঙক্তিতে বলেন, ‘পরকীয়া প্রেমে কোনো পাপ নেই’। অবশ্য এমন যারা লিখেন বা উদ্ধৃত করেন, তারা হয়তো ‘প্রেম ও কাম’ এর পার্থক্যটা গুলিয়ে ফেলেন। সে যা হোক আমাদের দেশের আবহমান সংস্কৃতি কোনো কালেই ‘পরকীয়া’ জাতীয় জিনিষকে গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করেনি নারী পুরুষের কথিত ‘প্রগতিশীলতা’ তথা অবাধ যৌনতার ‘লীলা কেত্তন’কে। সুতরাং কিছু কথিত ‘সংস্কৃতিবান’ ব্যক্তি প্রগতিশীলতার ধোঁয়া তুলে কোরাস গাইলেও ভারতীয় সিরিয়ালে দেখানো ঘরে পরিবারে অসম সম্পর্কের ব্যাপারটি এদেশে নিশ্চিত পরিত্যক্ত হবে।
ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। বন্ধু রাষ্ট্র। আমাদের স্বাধীনতার সময় সহযোগিতা করায় আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আর আমাদের ভূখণ্ডের মানুষ বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে জানে। প্রয়োজনে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে নিজের জীবনের বাজিও রাখতে পারে এই মাটির মানুষ। কিন্তু বন্ধুত্বের পথ যখন ক্রমেই ‘বন্ধুর’ করে দেওয়া হয় তখনই ব্যাপারটা জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতীয় সিরিয়াল যেমন আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ক্রমেই বিষিয়ে তুলছে। মানুষ বাধ্য হয়েছে হাইকোর্টের স্মরণাপন্ন হতে। রিট করা হয়েছে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের জন্য। আমাদের রাজনৈতিক জীবনও তো ক্রমেই বিষিয়ে উঠছে। ভারতীয় চ্যানেলে যেমন পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত উস্কে দেয়ার মতো নানা কাহিনী সাজাচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক কিছু কাহিনীতেও আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত উস্কে উঠছে। ক্রমেই রাজনৈতিক জীবন অযোগ্য হচ্ছে যাপনের। এখন মনে হচ্ছে ‘বন্ধুত্বের ছলনা’ বড়ই পীড়াদায়ক। এখন ‘আমি তার ছলনায় ভুলব না’ জাতীয় গান গাওয়া ছাড়া অনেক রাজনৈতিক দলেরই তেমন কোনো উপায় হাতে নেই।
এক সময় আমাদের রাজনৈতিক জীবন ছিল সহমর্মিতার, সহযোগিতার। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৯০-এর গণআন্দোলন পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল গৌরবময়। সম্প্রতি ভার্চ্যুয়াল জগতে একটি ছবি বারবার প্রদর্শিত হচ্ছে। ছবিতে ৯০-এর গণআন্দোলনকালীন একটি মিছিলে বেগম খালেদা জিয়া, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে একই কাতারে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। অনেকে এটিকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে প্রচার করছেন। যাদের ইচ্ছা তারা করুন, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ভাই এই ধারণাটি তো সত্যি সেসময় পরস্পরের রাজনৈতিক সম্পর্ক আর নির্ভরশীলতার কারণেই গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। আর এখন ভারতীয় সিরিয়ালের কল্যাণে আমাদের পারিবারিক সামাজিক জীবনে ঘটা দ্বন্দ্ব সংঘাত রাজনীতিতেও সওয়ার হয়েছে।
শুধু পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নয় নিজ দলগুলোর মধ্যেও চলছে আভ্যন্তরীণ সংঘাত। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যারা মূলত ‘বন্ধুর ছলনা’য় এই মুহূর্তে কুপোকাত, তাদের মধ্যে অহরহই দেখা মিলছে ‘ড্রামাটিক’ দ্বন্দ্ব সংঘাতের। হামলা-মামলায় পর্যুদস্ত দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। জনগণের একটি বিশাল অংশ এখনও দলটির সমর্থক। কিন্তু ভারতীয় সিরিয়ালের মতো বা কল্যাণে নিজেদের এলোমেলো সংসার তারা কোনোভাবেই গুছিয়ে উঠতে পারছে না। সিরিয়ালের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারলেই দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এমন আশা দলটির অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই করেন।
বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতটি খুব বোঝা যায় না। দলটির প্রধান স্বয়ং বলেছেন, দলের ত্যাগী নেতারাই দলটিকে রক্ষা করেছে। কথাটি আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে সত্যি। দলের অসংখ্য ত্যাগী নেতা দলটিকে ধরে রেখেছেন। তবে যে দল ক্ষমতায় থাকে তার ভেতরের দ্বন্দ্ব খুব একটা প্রকাশ হয় না। নিচের দিকের হালুয়া রুটির দ্বন্দ্ব হয়তো চোখে পড়ে কিন্তু মূল অংশের দ্বন্দ্ব থাকে খোলসে আবদ্ধ। যা হোক, ভারতীয় সিরিয়াল নিয়ে কথা বলছিলাম। বলছিলাম ভারতীয় সিরিয়াল নিয়ে দ্বন্দ্বে স্বামী স্ত্রীর মারামারিতে শেষ পর্যন্ত দুজনেই হাসপাতালে এমন খবরের কথা। মাঝে চলে এসেছে রাজনীতি। বাংলাদেশিরা এমনিতেই খুব রাজনীতি সচেতন।
ফলে আমিও পারিবারিক মারামারির মধ্যে রাজনীতি নিয়ে এসেছি স্বভাবের দোষে। যে দেশে সিরাজদ্দৌলা, তিতুমীর, ঈশা খাঁ, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিব, জিয়া’র মতো ক্ষণজন্মা মানুষেরা জন্মেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন সেদেশের মানুষের মধ্যে রাজনীতি তো থাকবেই। কেউ বা কারা যদি সেদেশের মানুষকে রাজনীতিমুক্ত করতে চায় তাহলে তারা আছেন বোকার স্বর্গে। আমার ছোট ভাইসম একজন চাকরি করেন পুলিশে; তিনি মজা করে মাঝে মাঝে বলেন, ‘পাগলের সুখ মনে মনে’ অনেকটা এরকম আর কী।
ফুটনোট: বিদ্রোহ ও বিদ্রোহী কবি নজরুলের দেশ এই বাংলাদেশ। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এই ‘বঙ্গ’ কখনও পরাভব মানেনি। আর্যদের দ্বারা এ দেশের মানুষ শোষিত হয়েছে কিন্তু শাসিত হয়নি কখনও। সুতরাং এখানে সিরিয়াল দেখিয়েই হোক আর যে করেই হোক পরিবার ও দেশের মধ্যে কেওয়াজ সৃষ্টির প্রচেষ্টা প্রাথমিক সফলতা পেলেও তা যে শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকবে না এটা নিশ্চিত। ইতিহাসও তাই বলে।
কাকন রেজা: সাংবাদিক।
http://www.uttorbangla.com/94773#.WQybpqDTXqB
No comments:
Post a Comment