Thursday 4 May 2017

পাকিস্তানী আখতার হামিদ খান বাংলাদেশের উন্নয়নে কুমিল্লায় বার্ড প্রতিষ্ঠা করেন ।


পাকিস্তানী আখতার হামিদ খান বাংলাদেশের উন্নয়নে কুমিল্লায় বার্ড প্রতিষ্ঠা করেন ।

সালেহউদ্দিন আহমেদ |

  আখতার হামিদ খান
আমাদের দেশের পল্লী উন্নয়নের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো আন্তরিক ও কার্যকরভাবে নিরূপণ করেছিলেন ড. আখতার হামিদ খান। গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা ও কাজ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) লাখো দরিদ্র ও অনগ্রসর মানুষের জীবনের পটপরিবর্তন করেছিল। তার কাজে প্রভাবিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রচেষ্টার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে ও উন্নয়ন খাতে কাজ করার সুবাদে ‘কুমিল্লা একাডেমির’ কাজ, বিশেষ করে ড. খানের কাজ আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) একজন সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে আমি ড. খানের কাজ খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগও ছিল।

বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে ড. আখতার হামিদ খান একজন সত্যিকারের পথিকৃত্। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) ১৯৮৪ সালে তিন খণ্ডে ড. আখতার হামিদ খানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো প্রকাশ করে। এ তিন খণ্ড পড়লে পাঠকরা ড. খানের দর্শন ও কাজের বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা পাবেন। এছাড়া যারা পল্লী উন্নয়নে অবদান রাখতে চান, তাদের জন্যও এ খণ্ডগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম (‘Works of Akther Hamid Khan’ Vol. I, II, III, BARD, Comilla, 1984)

কোনো তত্ত্ব বা কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে এর পেছনে প্রত্যেক মহান তাত্ত্বিক ও পরিকল্পকের একটি দার্শনিক চিন্তা থাকে। আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত না হলে ড. খানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পল্লী সমাজ পুনর্গঠনের মতো কঠিন কাজ করা সম্ভব হতো না। এজন্য তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে অশান্ত বিশ্ব, পরস্পরবিরোধী দর্শন ও শ্রেণীস্বার্থ। কিন্তু তার অধ্যবসায় ও মানবতার জন্য শক্তিশালী অনুভূতি তাকে এ কাজে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তিনি ছিলেন প্রচলিত প্রথাবিরোধী ব্যক্তি এবং তার প্রজন্ম যে পথে চলেছে, তিনি তা অনুসরণ করেননি, যা তার কর্মজীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। ড. আখতার হামিদ খান শিক্ষকতা করেছেন, নিয়োগ লাভ করেছিলেন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন পিছিয়ে পড়া পল্লী সমাজ পুনর্গঠনে। নিজের নিরাপত্তাহীন পরিবেশ-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা তাকে সব মানুষের জন্য, বিশেষ করে পল্লীর মানুষের জন্য ‘বেঁচে থাকার নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে উত্সাহিত করেছে। প্রায়ই পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় ‘বেঁচে থাকার নিরাপত্তা’র বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু ড. আখতার হামিদ খানের মধ্যে এ নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। তিনি পল্লী উন্নয়নের জন্য তত্ত্ব ও ব্যবহারিকের মধ্যে একটি অনন্য সমন্বয় সাধন করেছিলেন। ড. আখতার হামিদ খান নিজের অ্যাপ্রোচের বিষয়ে অনমনীয় বা উদ্ধত ছিলেন না। যুগ, সমাজ ও মানুষের প্রয়োজনে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।

উপমহাদেশের পল্লী উন্নয়নে বিভিন্ন অ্যাপ্রোচ রয়েছে, যেমন ব্যুরোক্রেটিক অ্যাপ্রোচ, মিশনারি অ্যাপ্রোচ, প্ল্যানিং অ্যাপ্রোচ প্রভৃতি। ড. খান এ ধরনের বিশেষ কোনো অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করেননি। এছাড়া তিনি পল্লী উন্নয়নে টেকনোক্র্যাট, রিফরমিস্ট বা রেডিক্যাল অ্যাপ্রোচের প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না, কারণ প্রায়ই এসব অ্যাপ্রোচে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে তত্ত্ব, লক্ষ্য ও কৌশল। ড. খানের অ্যাপ্রোচে তত্ত্ব ও মানবতার সমন্বয় ঘটেছে, যেমন তার কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মানুষ। ড. খান বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন কুমিল্লা মডেলের দুই স্তরবিশিষ্ট সমবায় পদক্ষেপ। এক কথায় বলতে গেলে, পল্লী উন্নয়নে তার অবদান ছিল অসামান্য।

১৯৩০ দশকে যুক্তরাষ্ট্রে সমাজভিত্তিক উন্নয়নের ধারণা প্রবর্তন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল পৌর পরিকল্পনায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ চিহ্নিত করা। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় ষাটের দশকের মধ্যে ভারতসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে এ ধারণাটি বাতিলের খাতায় চলে যায়। তবে ড. খান এ ধারণাটিকে একটি কর্মভিত্তিক প্রোগ্রামে রূপান্তর করেন, যার ভিত্তি ছিল সমাজের সবার অংশগ্রহণ ও তাদের নিজস্ব চাহিদার প্রাধিকার। এজন্য তিনি পল্লী উন্নয়নে কমিউনিটি পার্টিসিপাটরি অ্যাপ্রোচের (সিপিএ) পথিকৃত্ ছিলেন। পল্লী উন্নয়নের জন্য এ অ্যাপ্রোচ এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পল্লী মানুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য ড. খান গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থায় যেসব সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। মৌলিক ও ন্যূনতম শিক্ষা ছাড়া পল্লী মানুষেরা আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবে না এবং মাঠে গিয়ে তা কাজেও লাগাতে পারবে না। বর্তমানে ভোকেশনাল শিক্ষা থেকে প্রথাগত শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ড. খান এমনটা মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন শিক্ষা হবে মিশ্রিত সূচিপত্র, যেখানে থাকবে সাধারণ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, আধুনিক ভাবধারা ও ব্যবহারিক। এবং এটি গ্রামীণ সমাজে প্রচলন করতে হবে। ড. খানের আরেকটি অনন্য চিন্তা হলো, শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিকায়ন ব্যবস্থায় গ্রামের ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্তকরণ। গ্রামের মসজিদগুলোয় শিশুদের শিক্ষা দেয়া হয়। এ বিষয়ে ড. খান বলেন, কেন তাদের শুধু কোরআন শেখানো হবে? একই সঙ্গে কেন তাদের বাংলা ও অঙ্ক শেখানো হবে না?
কুমিল্লার গ্রামীণ নারীদের জন্য তিনি বিভিন্ন পাইলট প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন। তিনি গ্রামের মুসলমান নারীদের আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি যথার্থভাবেই মুসলিম নারীদের সমস্যা নিরূপণ করতে পেরেছিলেন। তিনি বলতেন, নারীদের নিম্নতর অবস্থান ও বিচ্ছিন্নতা মুসলমান সমাজের অন্যতম বড় সমস্যা। গ্রামীণ নারীদের মুক্তির প্রতি তার মনোভাব সমাজের, বিশেষ করে নারীদের জন্য আলোর দিশারী ছিল।
প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পল্লী উন্নয়নের জন্য তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, শুধু কর্মকর্তা হওয়ার বদলে আপনারা শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করুন। অন্যদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, শুধু পিটিশনকারী বা প্রতিবাদকারী হলেই চলবে না বরং আপনাদের সংগঠক, পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীও হতে হবে। তার এ মত বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক।

কুমিল্লা মডেলের মধ্য দিয়ে পরিবার পরিকল্পনায় ড. খান যে অবদান রেখেছিলেন, তা প্রকৃতপক্ষে কুমিল্লা মডেলের সমালোচক ও সমর্থক উভয় পক্ষই সার্বিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। অনেক চিন্তাবিদ পরিবার পরিকল্পনা ও ইসলামিক মূল্যবোধের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে কথা বললেও আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা প্রযুক্তি গ্রহণ করা বা না করা নিয়ে কেউ সার্বিক পথের সন্ধান দিতে পারেননি। ‘ইসলামিক ওপিনিয়নস অন কনট্রাসেপশন’ প্রবন্ধে ড. খান এ বিষয়ে দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের আলোকে তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত মুসলমান মনীষীর চিন্তাভাবনার উদ্ধৃত করেছেন। সেখান থেকে তিনি দেখিয়েছেন, সমাজের সার্বিক কল্যাণে প্রয়োজন পড়লে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ নিয়ে ধর্মের কোনো বাধা নেই। তার চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে পাইলট প্রজেক্টগুলোয়।

সত্যের সন্ধানে ড. খান প্রায়ই বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন, কথা বলেছেন বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে। তার একটি অনন্য কার্যকৌশল ছিল, আর তা হলো পল্লী উন্নয়নে অংশগ্রহণ-পর্যবেক্ষণ অ্যাপ্রোচ। রিকশাওয়ালার সঙ্গে আলোচনা বা গ্রামের কোনো এক সাধারণ বয়স্ক লোকের সঙ্গে আলোচনা, তার এ অ্যাপ্রোচের উদাহরণ। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়ায় তিনি অদূরদর্শী প্যাকেজ প্রোগ্রাম, এরিয়া ডেভেলপমেন্ট ও টার্গেট গ্রুপ অ্যাপ্রোচ থেকে উদ্বুদ্ধ ভুল ধারণা ও কৌশল সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে বলেছেন।

দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পল্লী উন্নয়নের বন্ধুর পথে একা চলেছেন ড. খান। তবে তার কাজের মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলেছিলেন একদল সত্ ও উদ্দীপনাপূর্ণ কর্মী বাহিনী। তিনি নিজেকে অখ্যায়িত করেছে ‘সিনিক্যাল আইডিয়ালিস্ট’ ও ‘পারমানেন্ট পিউপিল’ হিসেবে। আমি মনে করি তিনি একজন সংশয়বাদী, যিনি বিশ্বকে অধিক ভালো জানেন, কিন্তু সেটা তাকে সুখী করতে পারেনি, যেমনটা বুদ্ধ (নির্বাণের পূর্বে) জীবন ও সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি দেখে অসুখী হয়েছিলেন।
১৯৯৮ সালের ২০ ডিসেম্বর করাচিতে ড. আখতার হামিদ খানের নিজ বাসভবনে তার সঙ্গে স্মরণীয় সাক্ষািট এখনো মনে রয়েছে। ওই সাক্ষাতে আমরা উন্নয়ন-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ড. খান আবেগিভাবে কুমিল্লার দিনগুলোর কথা স্মরণ করেছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও শান্তিপ্রিয় দেশে পরিণত করার শক্তি এ দেশের জনগণের রয়েছে এবং এ দেশের উন্নয়ন খাতে কাজ করা নেতাদের ভেতর সে দূরদৃষ্টি ও দক্ষতা রয়েছে। ড. খান কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। কয়েক বছর আগে যখন ড. খান বেঁচে ছিলেন, তখন একটি জার্নালে তাকে নিয়ে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন পড়েছিলাম। শ্রীলংকার বিখ্যাত সাংবাদিক তারজি ভিটাচির ওই প্রতিবেদনে দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে একজন ব্যক্তি ‘খান’ পল্লী বাংলাদেশের চেহারা বদলে দিয়েছেন। ড. আখতার হামিদ খান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নে আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করা উচিত।

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/136/আখতার-হামিদ-খান--/

No comments:

Post a Comment