'বাঙালী মুসলমানের মন' এবং পুথিসাহিত্যের নানাদিক।
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন:
আহমদ ছফা একজন সত্য ও নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক লেখক। তাঁর লেখনীতে দেশের মাটি এবং মানুষের ওপরে কাউকে তিনি ভাবতে পারেননি। তার মানে এই নয় যে, তিনি ভিন্ন দেশীয় সংস্কৃতি ও মানুষকে অবহেলার চোখে দেখেছেন। তাঁর প্রতিটি লেখার মূল বিষয়ই মানুষ। সেক্ষেত্রে নিজস্বতা বিকিয়ে দিয়ে কোনো কিছু তিনি লেখেননি। নিজস্বতা না থাকলে অস্তিত্ব হারিয়ে পরগাছায় পরিণত হতে হয়। সে উপলব্ধি থেকে তিনি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকেই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে স্থান দিয়েছেন। জোর করে তিনি শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন—এমনটিও নয়, কারণ আমাদের গৌরব করার মতো অনেক কিছু রয়েছে যা রঙিন ও কৃত্রিম চোখের কারণে আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এত কিছুর পরেও এই শক্তিশালী লেখক মাঝে মাঝে কিঞ্চিত্ ভুলও করেছেন। তবে 'বাঙালী মুসলমানের মন' প্রবন্ধে তিনি বাঙালি মুসলমানদের হীনম্মন্যতার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন যদিও এর বাস্তব ও যৌক্তিক কারণও রয়েছে যা তিনি তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন।
আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান বলতে যা বুঝাতে চেয়েছেন তার স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, 'ভারতে প্রধানত যোগপন্থি সুফিদের দ্বারা ইসলাম প্রচারিত হওয়ায় এদেশে ইসলামের শরিয়ত রূপ খুব দুর্বলভাবে ধৃত হয়েছে। ফলে স্থানীয়ভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরোধের কোনো উচ্চ দেয়াল তৈরি হতে পারেনি। এজন্যই বাংলাদেশের ইসলামকে অনেকেই স্থানীয় ইসলাম'১ বলে থাকেন। কারণ মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলের ফলে সামপ্রদায়িকতাকে দূর করার সর্বাত্মক প্রয়াস সে-সময়ে মুসলিম শাসকেরা করেছিলেন। তাই মধ্যযুগের মুসলিম সুফি ও সাধকদের ভূমিকা প্রসঙ্গে গোপাল হালদার যা বলেছেন প্রসঙ্গত তাও উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি মনে করেন, 'ইসলাম কোনো জাতির ধর্ম নয়, প্রচারশীল ধর্ম। উহা অন্যকে জয় করিয়াই ক্ষান্ত হয় না—কোলে টানিয়াও লয়। তাই ইসলামের বিজাতীয় ও বিজেতা প্রচারকের দল ভারতের জনগণকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করিল না।'২
প্রসঙ্গতই উল্লে¬খ করা প্রয়োজন, 'আমাদের বোঝানো হয়েছে যে, আমাদের নিজস্ব গর্বের কিছুই ছিল না, ইংরেজরা আমাদের পরিত্রাতা হয়ে এসেছে, তাদের যা সবই গর্বের সেগুলোই অনুকরণীয়। দুঃখের বিষয় তাদের সেই অপপ্রচারে আমরা প্রতারিত হয়েছিলাম'৩। যার ফলে আমরা সত্যকে অন্ধকারে রেখে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করি এবং বাংলা সাহিত্যের পুথিকে অবহেলা এবং মুসলিম পুঁথিসাহিত্যিকদের ও তাঁদের বিষয়বস্তু অযাচিত বলে মেনে নিয়েছি। তাই বলে একথা ভাবা উচিত নয়, মধ্যযুগের দেশপ্রেম রাজনৈতিক চেতনা থেকে মুক্ত।৪
পুঁথি লেখার উদ্দেশ্য আহমদ ছফার লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে, গর্ভ থেকে তুর্কি আক্রমণের ফলে আরেকটি নতুন সমাজ জন্মলাভ করেছে এবং সমাজের কল্যাণের প্রকাশের মধ্যে নতুন চলমানতার সঞ্চার হয়েছে, সেই নতুনভাবে চলমানতা অর্জনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন আত্মার পরিতৃপ্তি বিকাশ করার উদ্দেশ্যেই পুথি লেখকরা রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৭) স্বভাবতই 'নতুন নতুন সমাজে নিজস্ব নায়ক চাই, চাই নিজস্ব বীর। যাঁদের জীবন কথা আলোচনা করে দুঃখ, সান্ত্বনা, বিপদে ভরসা পাওয়া যায়। যারা তাদের আপনজন হবেন এবং একটি আদর্শায়িত উন্নত জীবনের বোধ সৃষ্টি করতে পারেন।' (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৭) ফলে এই পুথি সাহিত্যের 'চরিত্রসমূহ বিশ্বাসে এবং আচরণে স্বভাবে যতদূর আরবদেশীয় তার চাইতে বেশি এদেশীয়' (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৯) অতএব নিজস্ব দুঃখবোধ, সান্ত্বনা, দিক নির্দেশনা বা আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পেতে হলে স্বাভাবিকভাবে হিন্দু সামান্তবাদ হতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার প্রয়োজন। আর একটি উপলব্ধিবোধ থেকেই 'স্বদেশবাসীর কাছে স্বদেশি ভাষায় প্রমাণ করাই শ্রেয়'। (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৬)
তাই প্রসঙ্গক্রমে নিজস্ব সত্তা প্রমাণে মধ্যযুগের মুসলিম পুঁথিসাহিত্যিকগণকে অবহেলা করে বাংলার সঠিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়, কারণ যে সাহিত্য বিচারে যেমন বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তেমনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে সহায়তা করেছেন তা অস্বীকার বা অবহেলা করা মানেই হচ্ছে সে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা।
আহমদ ছফা মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্য বিশ্লে¬ষণ করতে গিয়ে বাঙালি মুসলমানদের শব্দ বাছাই ও এর যৌক্তিকতা অনুসন্ধান করেছেন। পুঁথিসাহিত্যিকদের মুসলিম ঐতিহাসিক চরিত্র অঙ্কনে হিন্দু দেবদেবী ও ব্রাহ্মণ চরিত্রের যে সমন্বয় ঘটানো হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেন। যেমন 'শহীদে কারবালা' বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, 'মনের তলাতে শিলাখণ্ডের মত পড়ে থাকে। তিনি (লেখক) যদি তাঁর বদলে ইরাকি, তুর্কি, ইহুদি, খ্রিষ্টান, তাতার, তুরানি ইত্যাদি যে কোন ধর্মের মানুষের সাথে সাক্ষাত্ ঘটিয়ে দিতেন সীমারের—তাহলে পাঠকের মনে কোন প্রশ্নই জাগত না। তিনি কারবালা থেকে দামেস্ক যাওয়ার পথে ধু-ধু মরু প্রান্তেরে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণকে আমদানি করলেন কোত্থেকে?'
তেমনিভাবে মধ্যযুগের প্রতিটি পুঁথিসাহিত্যে মুসলমান সাহিত্যিকরা অবাস্তব চরিত্রের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন কাহিনি তৈরি করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কিসের প্রয়োজনে মুসলিম ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহকে কোনো কোনো পর্যায়ে একেবারে পশু বা নরাধমের শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে? 'শহীদে কারবালা' বিশ্লেষণে আহমদ ছফা বলেছেন—'আর সকলের এমন এক ধনুকভাঙ্গা পণ যে, বাহুবলে যে পুরুষ হারাতে পারবে তাকে ছাড়া অন্য কারো কাছে বিয়ে বসতে মোটেই রাজি নন। মুহম্মদ হানিফা সংবাদ শুনে হাওয়ার বেগে সে দেশে ছুটে চলছেন, রণংদেহী হুংকার তুলেছেন। বীরাঙ্গনা ব্রাহ্মণ কন্যাদের বাহুবলে পরাস্ত করে ইসলাম ধর্ম কবুল করিয়ে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছেন।' ব্যাপারটা এতই পৌনঃপুনিকভাবে ঘটেছে যে মুহম্মদ হানিফাকে মনে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন কুলীন হিন্দু সন্তান, বিয়ে করে বেড়ানোই যার একমাত্র পেশা। এছাড়া হজরত আলীর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক হজরত আলীকে যে ভয়াবহ রূপে উপস্থাপন করেছেন তাও উল্লে¬খযোগ্য। তিনি মানুষ হিসাবে উদার মনের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর গুণগান সর্বসাধারণের জন্য অনুকরণীয় বলে বিবেচনা করা হয়। পুঁথি লেখক তাকে শক্তিমান এবং বীর দেখাতে গিয়ে পশুশক্তিতে বলীয়ান হূদকম্প সৃষ্টিকারী একজন প্রায় নারীলোলুপ মানুষের চিত্র অঙ্কন করেছেন। মুসলিম ওই সকল ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহকে এমন পর্যায়ে নামানোর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে, আহমদ ছফা 'বাঙালী মুসলমানদের মন' প্রবন্ধে এর বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষায়, 'যারা বাঙালী এবং একই সাথে মুসলমান তারাই বাঙালী মুসলমান'।
এছাড়াও সূদুর অতীত থেকেই এই বাংলাদেশে অনেক অধিবাসীই মুসলমান ছিলেন—যারা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং নৃতাত্ত্বিক ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যানুসারে ঠিক বাঙালি ছিলেন না। এর পাশাপাশি আরও এক ধরনের বাঙালি-মুসলমান সম্পর্ক তিনি উল্লে¬খ করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই আরব দেশসমূহ হতে এদেশে রাজকার্য পরিচালনা ও ব্যবসার জন্য এসে বাংলাদেশে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু ধর্মীয় দিক থেকে তাঁদের মুসলমান বলা হলেও বাঙালি বলা যায় না। তাই আহমদ ছফা এখানে বলেন, 'এই দেব-দেবীর পূজারীদের অত্যাচার এবং ঘৃণা থেকে অব্যাহতি পাবার আশায় তাঁদের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে বৌদ্ধধর্ম এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৮)' কেননা, নিম্নবর্ণের অধিকাংশ হিন্দু যুগ যুগ ধরে আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিপীড়িত হয়ে মুক্তির আশায় প্রথমে বৌদ্ধ ধর্ম ও পরে ইসলাম ধর্ম কবুল করেন।
'নতুন ধর্ম গ্রহণ ছিল একটি নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত একটা ব্যবহারিক পদক্ষেপ। (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ২০)' ফলে দীর্ঘ নির্যাতনের কারণে ওষ্ঠাগত জীবনে প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে এই শ্রেণী। তবে এই শ্রেণীটি হিন্দুসমাজের মতো নির্যাতনের চিন্তা না করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন এবং নানা কৌশল অবলম্বন করেন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে। তাই পূর্বপুরুষের নির্যাতনের জবাব দিতে গিয়ে 'মূলত বাঙালী সমাজের যে শ্রেণীটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং নতুন ধর্ম গ্রহণ করার কারণে, অধিকতর খোলাসা করে বলতে গেলে, মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুন তাঁদের মধ্যে নতুন আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ঘটেছিল। সেই শ্রেণীটিতেই ছিল পুঁথিসাহিত্যের পদের সীমাবদ্ধতা, তাঁরাই এর লেখক, পাঠক এবং সমঝদার (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ: ১৯)'। তাই ইসলামের দিকপালদের রচিত পুঁথিসাহিত্যে যেমন চরিত্রের ঐতিহাসিকতাকে পাওয়া যাবে না, তেমিন বাঙালি সমাজে প্রচলিত বীরদের সম্বন্ধে যে ছকবাঁধা ধারণা বর্তমান ছিল তাও পুরোপুরি উঠে আসেনি সে-সময়ের পুঁথিসাহিত্যে। দুটি মিলে একটি তৃতীয় বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। আসলে পুঁথিসাহিত্য হলো, দুটি পাশাপাশি সমাজ ব্যবস্থা এবং সামাজিক আদর্শের ঘাত-প্রতিঘাতে মুসলমান জনগণ যেভাবে সাড়া দিয়েছে তারই প্রতিফলন' (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ: ১৮)। কারণ পুরোনো সমাজের গর্ভ থেকে তুর্কী আক্রমণের ফলে আরেকটি নতুন সমাজ জন্মলাভ করেছে এবং সমাজের জনগণের একাংশের মধ্যে নতুন চলমানতার সঞ্চার হয়েছে সেই নতুনভাবে চলমানতা অর্জনকারীরা অনেক সময় 'কাফের বলতে হিন্দু, হিন্দু বলতে কাফের ধরে নিয়েছেন' বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৪)। সুতরাং ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহ দিয়ে স্বদেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর জোরারোপ করে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য হিন্দুরা যে সমস্ত বিষয় নিয়ে গর্ববোধ করত, সেই সমস্ত বিষয়ে মুসলিম লেখকেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ করে চিত্রায়িত করেছেন। যেমন আহমদ ছফা বলেছেন, 'হিন্দু সমাজের বীরেরা যদি পাতাল বিজয় করে বহাল তবিয়তে ফিরে আসতে পারেন, আমির হামজা দৈত্যের দেশে গমন করে তাদের শায়েস্তা করে আসতে পারেবেন না কেন?—হিন্দুদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণ যদি বৃন্দাবনে ষোলশত গোপীবালা নিয়ে লীলা করতে পারেন, মুহম্মদ হানিফার কি এতই দুর্বল হাওয়া উচিত্ যে মাত্র একটা ব্রাহ্মণ কন্যাকে সামলাতে পারবেন না' (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৬)
সুতরাং রাজনৈতিক বিচারে মধ্যযুগের মুসলিম পুঁথিসাহিত্যিকেরা ভুল করেছেন বলার অবকাশ নেই। ঠিক তেমনিভাবে সাহিত্যের ভুল বৈশিষ্ট্য অনুসারে এ সাহিত্য গুরুত্ব বহন করে। কারণ, পুথি-পুরাণের জগতে অলৌকিক কাণ্ড প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। সেজন্য পুঁথি-পুরাণের নায়কদের চরিত্র সম্ভব-অসম্ভব সব ধরনের ক্ষমতা এবং গুণগান আরোপ করাটাই বিধি। (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৩)। তাই পুথি-পুরাণের রচয়িতাদের পাল্ল¬ায় পড়ে বনের হিংস্র বাঘ, শিংওয়ালা হরিণ পর্যন্ত মানুষের ভাষায় কথা বলে, দুঃখে রোদন করে, কাটা মাথা তো কোন ছার। সুতরাং ধরে নেয়া ভালো, পুঁথি-পুরাণের জগতে জাগতিক নিয়মের পরোয়া না করে লোমহর্ষক ঘটনাবলী একের পর এক ঘটে যেতে থাকবে। (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ১৩-১৪)
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন নিম্নবর্গের অনেক হিন্দু লেখক। যার প্রেক্ষাপটে মুসলিম ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহের ব্যাঘাত ঘটেছে। সে সমস্ত লেখকদের আরবি, ফার্সি, ভাষাজ্ঞান ছিল না এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও তাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। স্বভাবতই ধরে নেয়া যায় যে, পরিষ্কার জ্ঞানের অভাবে পুঁথিসাহিত্যে এমন অবাস্তব ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটা যতনা সত্য তার চেয়ে রাজনৈতিক কারণটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ 'পুথি লেখকেরা ছিলেন এই জনগণেরই কণ্ঠ'। (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ: ২১)
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে সামপ্রদায়িক এই বিভক্তির প্রয়োজনীয়তা কি সমর্থনযোগ্য? জবাবে বলতে হয়, এর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই ছিল। প্রথমত, এটি নির্যাতিত মানুষের প্রতিবাদ। দ্বিতীয়ত, এটি কোনো সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির ফসল নয়। কারণ, 'হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সামপ্রদায়িকতার আদিতম উত্স।' (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ২৮) আহমদ ছফা যেমন আরও মনে করেন—'কাব্য সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার অনুসারে হয়তো এ সকল পুথির বিশেষ মূল্য নেই। কিন্তু বাঙালী মুসলমান সমাজের নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতান্ত্রিক গবেষণায় এসবের মূল্য যে অপরিসীম সে বলার অপেক্ষা রাখে না।' (বাঙালী মুসলমানের মন, পৃ. ২৯)
এই দীর্ঘ আলোচনার পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ কারণ। বিশেষত আহমদ ছফার 'বাঙালী মুসলমানের মন' পড়লে এমনিতেই বিষয়সমূহের পরিষ্কার ধারণা লাভ করা সম্ভব। তথাপি মধ্যযুগে মুসলিম শাসনের মাধ্যমে এদেশের নিযার্তিত, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সামপ্রদায়িক হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার মাধ্যমে নিজেকে বুদ্ধিভিত্তিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুথি সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ঠিক তেমনিভাবে মুসলিম শাসন অবসানের ফলে ইংরেজদের সহায়ক সেই সামপ্রদায়িক হিন্দু সমাজ রাজনৈতিক কূটকৌশল অবলম্বন করে পুঁথিসাহিত্যকে অবাঞ্ছিত সাহিত্য বা বটতলার সাহিত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর এ প্রয়াসে মুসলিম নামধারী কিছু হিন্দুত্ব বা পশ্চিমা চশমা পরা লেখক এর অপমৃত্যু ঘটিয়েছেন। কিন্তু এ সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
কবীর চৌধুরীর 'ভাষা ও শিক্ষার সংগ্রাম' নামক প্রবন্ধে (প্রথম আলো : শুক্রবারের সাময়িকী-১০-০৮-২০০৭) দাবি করেন, বাংলায় বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুসলিম পুঁথিসাহিত্যিকদের অবদান অনেক। সেই সাহিত্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালী মুসলমানদের মন বুঝার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ও এদেশের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করা প্রয়োজন।
সহায়ক গ্রন্থাবলী :
১. খোন্দকার মুজাম্মিল হক; মধ্যযুগের বাঙালা সাহিত্যে দেশপ্রেম: পরিপ্রেক্ষিত , পৃ. ১৪৬।
২. গোপাল হালদার : সংস্কৃতির রূপান্তর; ঢাকা ১৯৭৪ পৃ. ৮৬
৩. বরুন কুমার চক্রবর্তী; উডের রাজস্থান ও বাংলা সাহিত্য; কলিকতা, ১৩৮৮; পৃ:৩
৪. খোন্দকার মুজাম্মিল হক; মধ্যযুগের বাঙালা সাহিত্যে দেশপ্রেম: পরিপ্রেক্ষিত , পৃ:১৫৯
http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDdfMjZfMTNfNF8yNF8xXzU5MjEw
No comments:
Post a Comment