Friday 5 May 2017

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বাঙালি মুসলমানের সাংবাদিকতা, সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃৎ



মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন
বাঙালি মুসলমানের সাংবাদিকতা, সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃৎ

শানজিদ অর্ণব |


বাঙালি মুসলমানের সাংবাদিকতা, সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃৎ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৮৮৮ সালের নভেম্বরে, কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর থানার পাইকারদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। এক কথায় তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত মানুষ। শিক্ষা অর্জনের পেছনে তাঁর বাবার যথেষ্ট অবদান ছিল। সেকালে মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ ছিল নিন্দনীয়। এমনকি বাংলা শিক্ষাতেও আপত্তি ছিল।

কিন্তু নাসিরউদ্দীনের পিতা তাঁর সন্তানকে ভালোভাবে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা দিতে চাইলেন। তাই মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের পর পুত্রকে এক হিন্দু পণ্ডিতের অধীনে শিক্ষা নিতে পাঠশালায় পাঠালেন। পাঠশালা শেষে এবার পুত্রকে পাঠালেন এক ইংরেজি স্কুলে। সেই হরিনাথ হাইস্কুলের ৩০০ ছাত্রের মধ্যে নাসিরউদ্দীনসহ মাত্র তিন-চারজন মুসলমান শিক্ষার্থী ছিলেন।  স্কুলে থাকতেই নাসিরউদ্দীন খবরের কাগজ, ছবির বই, নাটক, যাত্রাগানের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতেন। সে আমলে মুসলমানদের জন্য নাটক, যাত্রাগানে যাওয়াটা এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। এসব অনুষ্ঠানে গেলে সামাজিক শাস্তিরও ব্যবস্থা ছিল। তার পরও আগ্রহের আতিশয্যে সোহরাব-রোস্তমের দৃশ্যে অভিনয় করলেন। এ খবর পৌঁছাল তার বাবার কানে। নাসিরউদ্দীনকে কান ধরে উঠবস করে শাস্তি পেতে হলো। কিন্তু  তিনি দমলেন না। তাঁর মন-প্রাণজুড়ে তখন নাটক, যাত্রা, বই, ছবি আর আবৃত্তি। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তিনি প্রথম অনুধাবন করেন যে, মুসলমান লেখকদের বই কিংবা পত্রপত্রিকা একেবারেই নেই। তাঁর ক্লাসের এক ধনী হিন্দু পরিবারের ছেলের কাছে অনেক পত্রিকা এবং বই ছিল। একবার নাসিরউদ্দীন সেই ছেলের কাছে একটা ছোটদের মাসিক পত্রিকা পড়তে চেয়ে অপমানিত হয়েছিলেন। সেই ছেলে তাঁকে বলেছিল, ‘তোদের মুসলমানদের কি আছে!

 আমার এসব নিয়ে টানাটানি করিস কেন?’ এর পর গেলেন লাইব্রেরিতে খোঁজ নিতে যে, মুসলমান লেখকদের গল্প-উপন্যাসের বই কিংবা পত্রিকা আছে কিনা। কিন্তু জবাব পেয়ে নাসিরউদ্দীন হতাশ হলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সেই স্কুলপড়ুয়া নাসিরউদ্দীনের মনের বেদনা এবং পরিস্থিতি বদলানোর সংকল্পই কয়েক বছর পরে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। তাঁর নিজের কথায়— ‘সেদিন মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। এত বড় একটা জাতি, এত বড় একটা সমাজ, তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, অথচ তাদের বাংলা কোনো পত্রপত্রিকা নেই! এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল। মাথায় কেবলই ঘুরপাক খেত ব্যাপারটা। ওই বয়সেই ছবির বই কিংবা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখতাম। রাতে ঘুম হতো না।’
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার ঠিক আগে নাসিরউদ্দীন পিতৃহারা হলেন। একাডেমিক পড়াশোনার পাট সেখানেই চুকে গেল। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সংসার চালানোর দায় মাথায় এসে পড়ল। কিছুদিন কাঁচা সুপারি স্টক করে বিক্রি করলেন। এর পর স্থানীয় স্টিমার ঘাটের স্টেশনমাস্টার তাকে অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি দিলেন। কিছুদিন পর কাজ শুরু করলেন বীমা এজেন্ট হিসেবে। তখনকার দিনে মুসলমান সমাজে বীমা করা বা ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগকে গুনাহর কাজ বলে বিবেচনা করা হতো।

বিশেষত মোল্লারা এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতেন। কিছুদিন কাজ করে নাসিরউদ্দীনের হাতে বেশকিছু টাকা জমে গেল, অর্থাৎ তাঁর কাজ ভালোই চলছিল। কিন্তু তার পর নিজেই বুঝলেন, এ কাজ তার জন্য নয়। ‘কিন্তু এই যে আমি টাকা-পয়সা, অর্থ উপার্জন করছি, এটা আমার মনে শান্তি দিচ্ছিল না। তিন বছরের মাথাতেই আমি হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কেবল সাহিত্য নিয়ে ভাবনা। এসব নিয়েই আলোচনা করে সময় পার করি। এই অবস্থায় একদিন ঠিক করলাম, দেখি চেষ্টা করে আমাদের মুসলমান সমাজ থেকে একটা পত্রিকা বের করা যায় কি না? এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমি একদিন সোজা কলকাতা চলে গেলাম। ১৯১৭ সালে আমি সেখানে গিয়েছিলাম।’ অচেনা কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে লাগলেন পত্রিকার পরিকল্পনা নিয়ে। বিলেতি ম্যাগাজিন, প্রবাসীসহ বিভিন্ন কিছু ঘেঁটে নিজের পত্রিকার একটা মডেল মনে মনে দাঁড় করিয়ে ফেললেন। নাসিরউদ্দীনের ইচ্ছা আধুনিক মেজাজের পত্রিকা বানাবেন, পত্রিকায় ছবি থাকবে আর লেখাগুলো হবে চিন্তা উসকে দিতে পারে এমন। সমস্যা হলো লেখা জোগাড় করতে গিয়ে। যার কাছেই যান, তার কাছেই বহুদিন ধরে চর্চিত বিষয়গুলো নিয়ে লেখার ধারণা শুনতে পান। আধুনিক, নতুন ভাবনার বড় অভাব তখন মুসলিম মানসে।

 নাসিরউদ্দীন লেখা চেয়ে চিঠি পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কাছে। এসব তত্পরতার মাঝেই আমরা টের পাই নাসিরউদ্দীনের প্রচেষ্টা তার স্বপ্নের মতোই বড় ছিল। যা-ই হোক, এবার তো পত্রিকার নাম ঠিক করতে হয়। সেকালে মুসলমানদের যে ক’টি পত্রিকা ছিল, সেগুলোর নাম সবই আরবি ভাষায়। এ রীতিও ভাঙলেন নাসিরউদ্দীন। বাংলা অভিধান থেকে পত্রিকার নাম রাখলেন সওগাত, যার অর্থ আন্তরিকভাবে দেয়া উপহার। লেখা আনতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যদুনাথ সরকারের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। মুসলিম লেখকদের পাশাপাশি হিন্দু লেখকদের লেখাও নিলেন। ১৯১৮ সালের ২ ডিসেম্বর (অগ্রহায়ণ, ১৩২৫ বঙ্গাব্দ) মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো সচিত্র মাসিক পত্রিকা সওগাত। নাসিরউদ্দীন নিজে মনে করতেন এই সওগাত পত্রিকাকে ঘিরেই তাঁর যত অর্জন।

 সম্পাদক হিসেবে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং প্রগতিশীলতার প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। এজন্য তিনি সওগাতের প্রথম সংখ্যায় সাতটি নীতিও ঘোষণা করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল বেগম রোকেয়া এবং পরবর্তী পাতায় মানকুমারী বসুর কবিতা। তিন বছর চলল সওগাত। তখনো লোকসান দিতে হচ্ছিল নাসিরউদ্দীনকে। বেশ দেনাও হয়ে গিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে সওগাত সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হলো। নাসিরউদ্দীন আবার ফিরে গেলেন বীমা কোম্পানির কাজে। সেখানে কাজ করে সওগাতের দেনা শোধ করলেন। এর পর কিছু টাকা জমলে আবার নেমে পড়লেন সওগাত প্রকাশে। এবার সমমনা লেখকদের সঙ্গে নেয়ার চেষ্টা করলেন। সঙ্গে পেলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল মনসুর আহমদকে।
সওগাত কেন্দ্র করে শুধু মুসলিম সমাজেই নয় বরং বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালির চিন্তার জগতে আলোড়ন উঠেছিল। পত্রিকায় ছবি ছাপা, স্বাধীন চিন্তাপ্রসূত লেখায় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন ধর্মীয় রক্ষণশীলরা। ‘মওলানা-মৌলবিরা সব সময় আমাদের গালিগালাজ করেছেন। কিন্তু আমরা তা ভ্রুক্ষেপ করিনি। সওগাত-এর লেখকদের দল মানেই যাঁরা বয়সে তরুণ, তাঁরা।

 যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন বা যাঁরা আধুনিক চিন্তার সাথে যুক্ত আছেন, এমন তরুণ-যুবারাই যোগ দিয়েছেন সওগাত-এর দলে।’ এমনকি শুরুর দিকে মওলানা আকরম খাঁও সওগাতকে গ্রহণ করতে পারেননি। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ লিখতেন ইসলামের ইতিহাস এবং দর্শন নিয়ে; আর তাই তাঁর লেখা নিয়ে মুসলিমদের পত্রিকাগুলো আগ্রহী ছিল না। এগিয়ে এলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ পারস্য প্রতিভার সব প্রবন্ধই সওগাতে ছাপা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম লেখা নাসিরউদ্দীনই ছেপেছিলেন তাঁর সওগাত পত্রিকায়। লাঙল পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পর নজরুলের বেশ করুণ দশা। খবর পেয়ে নাসিরউদ্দীন নিজে খরচ দিয়ে নজরুলকে কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। সওগাতের অফিসে নজরুলকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে কবি-সাহিত্যিকদের তুমুল আড্ডা, গান। সুফিয়া কামালের প্রথম কবিতাও ছাপলেন নাসিরউদ্দীন। সেকালে এ ছিল এক দারুণ সাহসিকতা, প্রথা ভাঙা! মুসলিম মেয়েদের লেখা বাইরে ছাপা হলে বেপর্দার কাজ হবে— এমন ছিল সে সময়ের ধারণা। সেই অচলায়তন ভাঙার দায়িত্ব পালন করেন নাসিরউদ্দীন। সুফিয়া কামালের প্রথম কবিতাটি সম্পাদনা করেছিলেন নাসিরউদ্দীন এবং নজরুল দুজনে মিলে।

এর পর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন আরেক বিপ্লব সম্পন্ন করলেন। প্রথমে সওগাতে ‘মহিলা জগত’ বিভাগ করে সেখানে লেখিকাদের লেখা এবং ছবি ছাপা হলো। শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। ইসলাম থাকবে না— এমন রবও উঠল। এমন জটিল পরিস্থিতিতেও নাসিরউদ্দীন পিছু হটলেন না বরং আরো বড় পদক্ষেপ নিলেন। শুধু লেখিকাদের লেখা এবং ছবি নিয়ে বের করলেন ‘মহিলা সওগাত’। সমালোচকদের জবাব দিতে নিজের স্ত্রীর ছবিও ছাপলেন সে সংখ্যায়। এ ‘মহিলা সওগাত’ এক স্মরণীয় ইতিহাস হয়ে থাকবে। সওগাতে নিয়মিত লিখেছেন বেগম রোকেয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ এবং আবুল ফজল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন সওগাতে।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের আরেকটি কাজ ছিল বাংলায় প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। নাসিরউদ্দীনের হাতে প্রতিষ্ঠিত এ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। প্রতিষ্ঠার চার মাসের মাথায় বেগমের সম্পাদিকার দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের একমাত্র কন্যা নূরজাহান বেগম। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে বেগম পত্রিকার অফিস ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ‘বোর্ড অব ট্রাস্টি’-র সদস্য এবং ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’-এর বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমির সম্মাননা পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে একুশে পদক এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান। ১৯৭৬ সালে সৃজনশীল লেখক ও সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করতে তিনি নিজ নামে নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক প্রদান শুরু করেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৯৯৪ সালের ২১ মে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক

http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/128/মোহাম্মদ-নাসিরউদ্দীন--/

No comments:

Post a Comment