Saturday 20 May 2017

বিপ্লবী শিল্প ও রাজনৈতিক কাব্য: কাজী নজরুল ইসলাম

98b83-ghunpoka13_1401025738_1-481537_10200500780736484_582983662_n
বিপ্লবী শিল্প ও রাজনৈতিক কাব্য: কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) অবস্থান ছিল শিল্প, সংস্কৃতি আর রাজনীতির মধ্যে একটা ছেদবিন্দুতে। তিনি সব বিচারেই একজন বিপ্লবী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী, তিনি শিল্পের অনেক ধারায় কাজ করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কবিতা থেকে নাটক,
সংগীত থেকে দর্শন— সবখানেই পথপ্রদর্শক শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি শিল্পে নতুন ধরন অনুসন্ধান করেছেন, প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠকে তুলে এনেছেন, শিল্পকে উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আজীবন তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গোঁড়ামি ও শোষণ থেকে মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে দায়বদ্ধ রেখেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম যেকোনো ধরনের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন।
শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুতে তার এ বিশ্বাস পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। তার কাজের বিষয়গুলো ছিল— বিপ্লব, সম্মান, স্বাধীনতা, প্রেম ও সাম্য। নজরুল এমন মানবতায় বিশ্বাসী ছিলেন, যা জাতি, শ্রেণী ও লিঙ্গের সীমাকে অতিক্রম করেছিল। নজরুল সামাজিক ন্যায়বিচারের একজন স্বপ্নদর্শী। তাকে যে ‘বিদ্রোহী কবি’র অভিধা দেয়া হয়েছে, তা থেকেই তার কর্মকাণ্ড পরিষ্কার হয়ে ওঠে। নজরুলের সাংবাদিকতা ও কাব্যে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ব্রিটিশরাজ ও সাম্প্রদায়িকতার সাহসী সমালোচনা পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও কাজী নজরুল ইসলাম জাতি রাষ্ট্রের ধারণায় আবদ্ধ ছিলেন না, এটা বোঝা যায় যখন বলেন যে, তিনি এবং তার কাজ ‘দুনিয়াকে ধারণ’ করে।
ব্রিটিশ দখলদারিত্বের যুগে ভারতে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম; সেটা ছিল ভীষণ সংঘাত আর সংগ্রামের যুগ।
প্রকৃতপক্ষে কবি তারুণ্যের শুরুতেই পেয়েছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ১৮ বছর বয়সে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। করাচিতে অবস্থানকালে তরুণ নজরুল কবিতা ও কাব্য লেখা শুরু করেন। ১৯২০-এর দিকে কাজী নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। কলকাতা তখন ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এ যুগেই কবির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তার প্রথম উপন্যাস বাঁধনহারা প্রকাশ হয় ১৯২০ সালে। একই বছর নজরুলের কবিতা সংগ্রহও প্রকাশ হয়।
তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশ হয় ১৯২২ সালে, বিজলী পত্রিকায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের ধারণা সে সময়ে ক্রমেই তীব্র হতে থাকা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও উপনিবেশবাদবিরোধী ‘অসহযোগ’ আন্দোলনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। কবিতাটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছিল। এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি প্রাসঙ্গিক সংগীত হয়ে ওঠে। ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালে নজরুলের গান ও কবিতা আবারো স্বাধীনতার লড়াইয়ে ব্যবহার হয়। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৭২ সালে নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’র স্বীকৃতি পান।
পরবর্তী দুই দশকে কাজী নজরুল ইসলাম একজন সৃষ্টিশীল প্রতিরোধ শিল্পী-কর্মী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। নজরুল জীবনব্যাপী লড়াই করেছেন রাজনৈতিক অবিচার, লিঙ্গবৈষম্য, ধর্মীয় উগ্রবাদ, বর্ণবাদ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে।
কবি তার জীবন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পার করলেও তিনি তার অবস্থাকে উদযাপন করেছেন, এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন তিনি লেখেন: ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান/ তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান।’
অদম্য প্রাণশক্তির নজরুল বহু বাধার পাহাড় ডিঙিয়েছেন। নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবনের স্থায়িত্ব ছিল ২২ বছর এবং এ সংক্ষিপ্ত সময়কালে তিনি কয়েক হাজার গান ও কবিতা রচনা করেছেন। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তার সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনের ইতি ঘটে।
এ সময় কবি স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হন এবং তার স্থায়ী মানসিক ও শারীরিক বৈকল্য সৃষ্টি হয়। কবি-কর্মী ওয়াল্ট হুইটম্যান, পাবলো নেরুদা ও মায়া অ্যাঞ্জেলোর তুলনায় একজন উদ্ভাবনী, সমাজসচেতন এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় শিল্পী হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের কিংবদন্তি এখনো জীবন্ত। সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে থাকা আরো অনেক কবির মতো নজরুলও আবশ্যিকভাবে একজন মানবতাবাদী ছিলেন, তার ‘মানুষ’ কবিতায় এটা স্পষ্ট—
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
একই সঙ্গে নজরুলকে রোমান্টিক কবিদের সঙ্গেও তুলনা করা হয় (এলিজাবেথ ব্রাউনিং, শেলী ও কীটস)।
অনেক সময় একজন শিল্পীর পরীক্ষা হয় সময়ের সঙ্গে তার প্রাসঙ্গিকতা অব্যাহত থাকা না-থাকা নিয়ে। নিশ্চিতভাবে সমসাময়িক দুনিয়ার পরিস্থিতি— যেখানে দেখা যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত, গোঁড়া মৌলবাদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অসাম্য— বিশ শতকে নজরুলের সামাজিক-রাজনৈতিক জোট, ঐক্য ও শান্তির আহ্বান এই একুশ শতকেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। নজরুলের শিল্প যে কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো উন্মোচন করছে তা নয়, বরং একই সঙ্গে মানবাধিকারের বিভিন্ন ঘোষণাকেও তিনি দৃঢ়ভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন— এসবই চিন্তা ও শৈল্পিক সৌন্দর্য সরবরাহ করেছে, যা নতুন সামাজিক রাজনীতির ভিত নির্মাণ করেছে।
কাণ্ডারি হুঁশিয়ার
“দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত্?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যত্।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
আস্?ল এবার অনাগত প্রলয়-নেশায় নৃত্য-পাগল,
সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল!
মৃত্যু-গহন অন্ধকূপে, মহাকালের চণ্ড-রূপে ধূম্র-ধূপে
বজ -শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর!’

লেখক: শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব কানেক্টিকাট
ভাষান্তর: এস. এম. রশিদ


https://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/723/বিপ্লবী-শিল্প-ও-রাজনৈতিক-কাব্য:-কাজী-নজরুল-ইসলাম--/

No comments:

Post a Comment