Thursday 4 May 2017

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সবার গুরু যিনি ।


অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সবার গুরু যিনি ।
ফিরোজ আহমেদ |

অধ্যাপক রাজ্জাক মূলত কতগুলো গল্প। স্মৃতি এবং শ্রুতির বাহনে তার বেশ খানিকটা উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের প্রজন্ম পর্যন্তও এসেছে।
অধ্যাপক রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য যারা পেয়েছেন, তাদের বড় অংশও আজ বিদায় নিয়েছেন কিংবা কর্মজীবন থেকে অবসরে। অধ্যাপক রাজ্জাকের গল্পগুলো বৃহত্তর কালের ব্যাপ্তিতে কি টিকে থাকবে, যখন তার স্নেহধন্যদের কাছ থেকে এই গল্পগুলো যারা পেয়েছেন, তারা আর অস্তিত্বমান থাকবেন না?
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক যেহেতু কতগুলো গল্পই, এই গল্পগুলোর নিজস্ব শক্তির ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতের মানুষের কাছে সেগুলো কতটুকু প্রাসঙ্গিক থাকবে। তিরিশের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশক পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ, সেগুলোর কুশীলব আর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনার মূল্যায়নে অধ্যাপক রাজ্জাকের সূত্রে জন্ম নেয়া এ গল্পগুলোর তাত্পর্য এত প্রবলভাবে অনুভূত হয় যে, হয়তো ভবিষ্যতে কখনো যদি আমাদের এ অঞ্চলের ইতিহাস লেখার মতো সুস্থিত সময় আর অবসর আসে, অধ্যাপক রাজ্জাক আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন।
২.
অধ্যাপক রাজ্জাকের অল্প ক’টি রচনা। পরিমাণের দিক দিয়ে ওই তালিকা অতি অকিঞ্চিত্কর, সন্দেহ নেই। দুঃখজনক যে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থে এ অল্প ক’টি রচনা ও বক্তৃতার নাম ও সময় যথাযথভাবে তালিকাবদ্ধ করা হয়নি, এটা কর্তব্য ছিল। এই কাজগুলোর মাঝে আছে তাঁর অসম্পূর্ণ পিএইচডি থিসিস ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া’। একটি প্রবন্ধের নাম ‘দ্য মাইন্ড অব দি এডুকেটেড মিডল ক্লাস ইন দ্য নাইনটিনথ সেঞ্চুরি’, প্রকাশিত হয়েছিল নিউ ভ্যালুজ পত্রিকায় ১৯৫৭ সালে। একটি প্রবন্ধের নাম মিলিটারি ইন পাকিস্তান, এটি তিনি পাঠ করেছিলেন হার্ভার্ডে ১৯৬০ সালে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় যে, প্রবন্ধটি সঙ্গে না নিয়েই তিনি দেশে ফিরে আসেন, এটি আর উদ্ধার করা যায়নি।

 অধ্যাপক রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থে স্মৃতিচারণে আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘তাঁর মূল বক্তব্য নাকি ছিল এই যে, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি হলে উন্নয়নশীল দেশে সামরিক শাসনের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং প্রতিরক্ষা বরাদ্দ একটা মাত্রা অতিক্রম করলে সামরিক শাসন অবশ্যই প্রবর্তিত হবে বলে ধরে নেয়া যায়।’ এর বাইরে আরেকটি বক্তৃতায় বলেছেন, সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কার গ্রন্থটিতে। এ বক্তৃতা দেয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে, ১৯৭০ সালে। বক্তৃতাটির নামটি গ্রন্থটিতে উল্লেখ নেই, তবে বিষয়বস্তু সম্পর্কে রাজ্জাক সাহেব ওই সাক্ষাত্কারটিতে জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি অনুন্নত দেশগুলোয়  রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে যেভাবে সীমাবদ্ধতার মাঝে ফেলে, তাই নিয়ে ওইদিন তিনি আলোচনা করেছিলেন। এর বাইরে স্মারকগ্রন্থে প্রকাশের তারিখবিহীনভাবে উল্লেখ আছে ‘এ নোট অন ডেভেলপমেন্ট প্লানিং ইন পাকিস্তান’ নামের আরেকটি রচনা। এর বিষয়বস্তুও একই, সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্র ও পরিকল্পনা। এছাড়া আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস, ১৯৮৫ সালে প্রধান অতিথির বক্তৃতা; ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমিতে প্রদত্ত ‘ভাষা, শ্রেণী ও সমাজ’ নামে একটি বক্তৃতা এবং ১৯৮৬ সালে সেলিনা হোসেন ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত একুশের স্মারকগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত একুশের আলোচনা-সভায় সভাপতির ভাষণ।
৩.
ধর্ম নয়, জাগতিক স্বার্থ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম মধ্যবিত্তদের বিবাদই যে সব সাম্প্রদায়িকতার মূল উত্স, স্বয়ং অধ্যাপক রাজ্জাকের এ উপলব্ধির পরিচয় পাওয়া যাবে তাকে নিয়ে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক সাবেক সহকর্মী আহরার আহমদের কথোপকথনের স্মৃতিচারণ থেকে:
‘অন্য একটি ঘটনায়, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা ঘরোয়া আলোচনায় আমি দুঃখ করছিলাম কীভাবে নির্বোধ এবং অশিক্ষিত লোকজন ভয়াবহ ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে অন্যদের প্রতি তাদের ঘৃণা লালন ও প্রকাশ করে। তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন আর দেখিয়ে দিলেন যে, সত্যিকারার্থে গরিব আর অশিক্ষিত লোকজন নয় (যারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যরা কি বিশ্বাস করে তার সামান্যই পরোয়া করে), বরং শিক্ষিত আর বুদ্ধিমান লোকজনই এই সব সংঘাত আর সহিংসতার অধিকাংশগুলোর জন্য দায়ী। তিনি দেখিয়ে দিলেন ব্রিটিশ শাসনে মধ্যবিত্তের বিকাশ এবং চাকরি আর ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতাই দেশে সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগির জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে।’ (অনুবাদ বর্তমান নিবন্ধকারের)
৪.
অধ্যাপক রাজ্জাকের সংবেদনশীলতার আঁচ পাওয়া যাবে আইউব খানের সামরিক শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জাকির হোসেনের একটা গল্পে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আবদুর রাজ্জাক তখন পূর্ব পাকিস্তানের পরিকল্পনা বোর্ডের সদস্য, এই দায়িত্বের সুবাদেই ৫৯ বা ৬০ সালের কোনো এক সময়ে জাকির হোসেনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। দীর্ঘ এই মোলাকাতের একদম শেষ পর্যায়ে আব্দুর রাজ্জাক অযাচিতভাবেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটা মৌলিক সংকট উত্থাপন করেন। জাকির হোসেনকে তিনি যা বলেন, সংক্ষেপে তা এই:
আবদুর রাজ্জাক যখন ১৯৩৬ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন, তখন আরবি-পার্সি ছাড়া ২০০-২৫০ জন শিক্ষকের মাঝে তিন-চার জন মুসলমান শিক্ষক। রাজ্জাক সাহেবের মতে এরা সকলেই তার চেয়ে যোগ্যতর হলেও এবং তখনো পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে অজস্র জিনিস শিখলেও একটা বিষয়ে রাজ্জাক সাহেব তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেন এবং তাঁর মতে, তিনিই সঠিক ছিলেন। তিনি মনে করতেন দেশের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম হিসেবে একটা সমস্যা আছে। এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এবং সেটা সমাধান করতে হবে। তার সহকর্মীরা সবাই মনে করতেন আসলে সমস্যাটা নাই, এটা তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্রের ফলে সৃষ্ট একটা বিভ্রম। রাজ্জাক মনে করেন এ সমস্যাকে স্বীকার করতে রাজি না হওয়ার কারণেই ৪৭ সংঘটিত হয়েছে। কংগ্রেস এ সমস্যা স্বীকার করতে বা হিন্দুদের সংখ্যাগুরু অংশ সত্যের মুখোমুখি হতে রাজি না হলে দেশভাগ অনিবার্য হতো না। ১৯৪৭ সালের পরও কিছু মানুষ বোঝার চেষ্টা করছেন পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান এর বৈরিতার একটি সমস্যা দেশে আছে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এই হুঁশিয়ারি দিয়েই তার আলাপটি শেষ করেন: কথাটা উল্লেখ করলেই এ মানুষগুলোকে বলা হয় তারা ভারত বা এমন কোন তৃতীয় পক্ষের ঘুঁটি, এটা ৪৭-এর আগেকার পুরনো দিনগুলোতে যে যুক্তিগুলো শোনা যেত, তার প্রায় হুবহু প্রতিলিপি। এবং এই মনোভঙ্গির কারণে ১৯৪৭ সালে যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, খুব সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে সেই পরিস্থিতির আবারো মুখোমুখি হতে হবে।
৫.
রচনার ক্ষুদ্র তালিকাতেও দেখা যাবে অধ্যাপক রাজ্জাকের আগ্রহের একটা বড় অংশ ছিল রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতা আইউব খান দখল করেন বহুসংখ্যক গণতান্ত্রিক সংস্কার ও প্রগতিশীল কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দেন। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও দলাদলিতে অতিষ্ঠ মধ্যবিত্ত পাকিস্তানিদের একটি বড় অংশ তার ওপর আস্থা এনেছিলেন। কিন্তু সামরিক বাহিনীর প্রতি এ মোহ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কোনো কালেই কাজ করেনি। এই নিয়ে বিচারপতি ইব্রাহিমের সঙ্গে আবদুর রাজ্জাকের গল্পটি স্মরণীয়।

বিচারপতি ইব্রাহিম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে বিচারপতি ইব্রাহিম অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপ করেন এর ফলাফল নিয়ে। রাজ্জাক পরিষ্কার জানিয়ে দেন সামরিক শাসন কোনো উন্নতি আনবে না। ইব্রাহিম বেশ বিস্মিত হন। তিনি বললেন, ‘আমি তো মনে করি এরা দেশের মঙ্গল করতে চায়। রাজনীতিকরা যে অবস্থায় দেশকে নিয়ে এসেছে তাতে এছাড়া আর কিছু উপায় ছিল না।’ এর কিছুদিন পর তিনি আইউব খানের মন্ত্রী হন। তখন আবার আমাকে ডাকলেন। ইব্রাহিম সাহেব বললেন, আপনি আমাকে একটু সাহায্য করবেন। আমি বললাম, আমি কি সাহায্য করতে পারি?

সাহায্যটা চাওয়া হয়েছিল সংবিধান প্রণয়নের জন্য। সংবিধান বিষয়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের অভিজ্ঞতা তিনি ব্যবহার করতে চাইছিলেন, কেননা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ইব্রাহিম সাহেবকে ‘তারা’ দায়িত্ব দিয়েছে: ‘তারা বলেছে, আমি যা করবো, তাই তারা গ্রহণ করবে।’ অধ্যাপক রাজ্জাক বিচারপতি ইব্রাহিম তাদের এ আশ্বাসটি বিশ্বাস করেন কিনা জানতে চাইলে ইব্রাহিম বিস্মিত হয়ে এই প্রশ্নের কারণ জানতে চান। রাজ্জাক সাহেব তাকে সোজা উত্তর দেন “আপনি সরল মানুষ তাই বিশ্বাস করছেন।” তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, সংবিধান যা করার তারাই করবে, বিচারপতি ইব্রাহিমকে কেবল সই করতে বলবে। বিচারপতি ইব্রাহিম অধ্যাপক রাজ্জাকের কথা বিশ্বাস করতে পারেননি।

কিন্তু ঠিক তাই ঘটেছিল। অধ্যাপক রাজ্জাক হার্ভার্ড থেকে ফেরার পর বিচারপতি ইব্রাহিম তাকে সাক্ষাতে জানান, ‘রাজ্জাক সাহেব, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। ওরা কী একটা তৈরি করেছে। আমার সঙ্গে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নাই। এখন বলছে, সই করো। আমি ওসব সইটই করবো না। আমি ঢাকা এসে বসে আছি।’

৬.
কিন্তু এই পাকিস্তান আন্দোলনেরই একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন অধ্যাপক রাজ্জাক। তার আকাঙ্ক্ষার পাকিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকদের পার্থক্য নিয়ে এই গল্পটা তিনি বলেছেন সরদার ফজলুল করিমকে।
“অধ্যাপক রাজ্জাক সহাস্যে বললেন, সে এক মজার ব্যাপার। এটা আবুল হাশিম সাহবের কাণ্ড। তিনি ইসলামিক  একাডেমিতে ‘হোয়াই আই ওয়ানটেড পাকিস্তান’ বলে বক্তৃতার একটা সিরিজ করেছিলেন। আমিই প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, এটা করুন। হাশিম সাহেব আমাকে বক্তৃতা দেবার দাবি করতে আমি বললাম, মোনেম খান একদিকের বক্তা হলে আমি আর একদিকের বক্তা হতে রাজি আছি। হাশিম সাহব বললেন, আমি অ্যারেঞ্জ করবো। কয়েকদিন পরে হাশিম সাহেব টেলিফোন করে বললেন, মোনেম খান রাজি হয়েছে। তারিখ দিয়ে বললেন, অমুক তারিখ ৫টার সময়ে ইসলামিক একাডেমির হলে বক্তৃতা হবে।
আমরা বললাম, অধ্যাপক রাজ্জাককে: হ্যাঁ, আমরা কাগজে একটা এর ঘোষণা দেখেছিলাম এবং ব্যাপারটাতে বেশ কৌতুকবোধ করেছিলাম।
অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন: হ্যাঁ, কিন্তু তারিখে দিন দু’টার দিকে হাশিম সাহেব বললেন: ভাই এ তো এক বিপদে পড়লাম। আমি আপনার বক্তৃতা ঘোষণা করেছি, এদিকে মোনেম খান বলেছেন, তাঁর অসুখ হয়েছে, তিনি মিটিংয়ে আসবেন না। ...আমরা অধ্যাপক রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করলাম: তবু কি আপনি সেদিন বক্তৃতা করেছিলেন?

: হ্যাঁ, আবুল হাশিমকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আমার বক্তৃতা করতে হয়েছিল। সে বক্তৃতার বোধহয় টেপ করা আছে ইসলামিক একাডেমিতে।
অধ্যাপক রাজ্জাক এ ব্যাপারে আরো বললেন: কিন্তু মজার ব্যাপার সেদিন রাতেই আমি রাজশাহী যাবার জন্য রাত ১১টার ট্রেনে উঠেছি। কিন্তু কি ব্যাপার? গাড়ি আর ছাড়ে না। কেন গাড়ি ছাড়ে না? কারণ গভর্নর মোনেম খান যাবেন ময়মনসিংহ। তিনি আসবেন, তবে গাড়ি ছাড়বে। আমি মনে মনে বললাম: মজার ব্যাপার তো! এই না দুপুরে মোনেম খান খবর পাঠিয়েছে যে তার অসুখ। মিটিংয়ে বক্তৃতা দিতে পারবে না। কিন্তু এখন তো বেশ সুস্থতার আলামত দেখা যাচ্ছে।”
৭.
মোনায়েম খান আর আবদুর রাজ্জাকদের আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন ছিল। ফলে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার প্রয়াস থেকেই এই বিভাজনটা স্পষ্ট হতে শুরু করে, সরদার ফজলুল করিমের সাক্ষাত্কার গ্রন্থটিতেই এ সূত্রপাতটা পাওয়া যাবে।

ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, পূর্ববঙ্গের অন্যতম নামজাদা রাজনীতিবিদ। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় পূর্ব বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় কী কী দাবি উত্থাপন করা উচিত, সেই বিষয়ে রাজ্জাকের শরণাপন্ন হন। প্রস্তাব করেন সংবিধান সভার বৈঠক চলার সময়ে পরামর্শ দিতে তাদের সঙ্গে করাচিতে যাবার। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক রাজি হন এই শর্তে যে, ফিরতি টিকিট রাখতে হবে, যাতে বনিবনা না হলে তিনি তত্ক্ষণাৎ ফিরে আসতে পারেন। করাচিতে  রাজ্জাক তাদের পরামর্শ দেন মুসলিম লীগের সভায় সামরিক বাহিনীর বিষয়টি তুলতে। প্রতিপক্ষ যদি উত্তরে জানায় যে, এটা কেন্দ্রীয় বিষয়, উত্তরে বলতে হবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থাকতে হবে। প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বে পূর্ব বাংলায় একটা বা দুটো ডিভিশনকে নিয়োগ ও গঠনের দায়িত্ব থাকতে হবে। মোহন মিয়াকে সব বুঝিয়ে দেয়া হলো এবং তিনি রাজিও হলেন।

এর পর প্রথম দিনের বৈঠক শেষে মোহন মিয়াকে অধ্যাপক রাজ্জাক জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, সামরিক বাহিনীর প্রশ্ন তোলা হয়নি। দ্বিতীয় দিনও একই উত্তর। রাজ্জাক সাহেব বিরক্তি প্রকাশ করায় তিনি কথা দিলেন তৃতীয় দিন তোলা হবে। কিন্তু তৃতীয় দিনও তোলা হলো না। এবার কারণ জানতে চাইলেই মোহন মিয়া উত্তেজিত হয়ে বলে বসলেন: আমি আপনার কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য না। পরের দিনও একই ঘটনা ঘটল, দলীয় সভাতে মোহন মিয়া সামরিক বাহিনীর প্রসঙ্গটি তুললেন না।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক রাজ্জাক বলতে থাকেন, মোহন মিয়া ভালো মানুষ নন, এই কথাটিই শোনা যায়, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এমন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ তিনি দেখেননি। সাক্ষাত্কার নিতে আসা ফজলে রাব্বী আর সরদার ফজলুল করিম উভয়ই জানতে চাইলেন, কেন তবে মোহন মিয়া সামরিক বাহিনীর প্রশ্নটি তোলেননি? এটা কি সাহসের অভাব? রাজ্জাক জানলেন, তখন নানা গণ্ডগোল, প্রধানমন্ত্রী, অমুক নবাব, তমুক জাঁদরেল বক্তা এদের সামনে মোহন মিয়ারা হীনম্মন্যতায় ভুগতেন, বললেন, ‘ওদের হালচালই আলাদা ব্যাপার। একটা অ্যাসেম্বলি মেম্বারের দশটা-পনেরটা গাড়ি। বেয়ানে এক কাপড় পইরা আসে, বিকালে আর এক কাপড় পইরা আসে। আর আপনাগো কাপড়-চোপড় হইলো একটা ছেঁড়া কোর্তা! কিন্তু অচিরেই পূর্ব বাংলার কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মোজাফফর আহমেদ, সাদেক আর আতাউর হোসেনকে করাচি আনা হলো, উপদেষ্টা পর্যায়ের আলোচনায় সমানে সমানে লড়ে দেখিয়ে দিলেন লাইসেন্স, পারমিট, বরাদ্দ, সক্ষমতা এই সব প্রশ্নে পূর্বাংশকে কতটা বঞ্চিত করা হয়েছে। আর ওখান থেকেই আওয়ামী লীগের চেতনা জাগল। তারা দেখল একটা পাকিস্তান তো হয় নাই।”
৮.
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে অধ্যাপক রাজ্জাক অনন্য। অধ্যাপক রওনক জাহান আবদুর রাজ্জাকের পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহে হার্ভার্ডে পড়তে গিয়েছিলেন, তার একটি ছোট্ট স্মৃতিচারণায় মিলবে এই গল্পটি:
“এরপর স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয় ১৯৬৮ সালে। আমি দেশে এসেছিলাম আমার পিএইচডি থিসিসের জন্য ডেটা কালেক্ট করতে। আমি স্যারের কাছে সেই বিষয়ে ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম। তখন স্যার আমাকে একটা কথা বলেছিলেন যেটা আমার সবসময় মনে হয়। তখন তো সিক্স পয়েন্টস (ছয় দফা) নিয়ে কথা হচ্ছে সবখানে। তো আমি সিক্স পয়েন্টস নিয়ে স্যারের মতামত জানতে চাইলাম। স্যার বললেন, ‘দেখেন, জাতি এখন অনেক আগায়ে গেছে। জাতি এখন আর সিক্স পয়েন্টস নিয়ে ভাবছে না, জাতি এখন স্বাধীনতার কথা ভাবছে।’ আমি কিন্তু সেই সময়ে অনেকের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু স্যার ছাড়া অন্য কেউ আমাকে জাতির এই যে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে বলেন নাই।”

অধ্যাপক রাজ্জাকের এই প্রজ্ঞা, ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার এ ক্ষমতা সম্পর্কে পাকিস্তান রাষ্ট্র ঠিকই অবগত ছিল। একাত্তরের পুরো সময়টা তাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তার স্মৃতিকথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শিক্ষক নিধনযজ্ঞে অধ্যাপক রাজ্জাকের নিহত হওয়ার ভুল সংবাদটি শ্রবণ করে মুষড়ে পড়ার কথা জানিয়েছিলেন।
অধ্যাপক রাজ্জাকের (১৯১৪-১৯৯৯) আরো অজস্র গল্প আছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে, বাংলাদেশের শাসকদের নিয়ে, হিন্দু-মুসলমান সংঘাত নিয়ে, সাহিত্য ও শিল্পকলা নিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে, রন্ধন শিল্প নিয়ে— বস্তুত আমাদের সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসে ৩০-৭০ পর্যন্ত তাঁর সক্রিয়তা জ্ঞানান্বেষী হিসেবে কেবল নয়, ঘটনার কেন্দ্রে থেকে জাতির হদস্পন্দনের গতি উপলব্ধির চেষ্টাই তিনি বরাবর করেছেন। ওই দশকগুলোয় অধিকাংশ গবেষক অধ্যাপক রাজ্জাকের চিন্তাসূত্রকে ব্যবহার করেছেন, কিংবা তার চিন্তার সঙ্গেই বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন। এমন তুলনারহিত উদাহরণেরই স্মারক তার গল্পগুলোই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভবিষ্যতের স্মৃতিতে।

লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলনের সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন

http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/135/অধ্যাপক-আবদুর-রাজ্জাক--/

No comments:

Post a Comment