আমাদের জাতীয় সংগীতসহ ২৩৪টি গান রবীন্দ্রনাথ অন্যের গান থেকে সুর ও কথা চুরি করেছেন ।
রবীন্দ্রনাথ বাইশ শ’-র উপরে গান লিখেছেন। বাঙালিরা গভীর ভক্তিভরে, সশ্রদ্ধ চিত্তে এগুলোকে শুনে থাকে, গেয়ে থাকে। এর ভাবসম্পদকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। পরম পূজনীয় ভেবে এর বিশুদ্ধতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু এরাই জানে না যে, রবীন্দ্রনাথের এই বাইশ শ’ গানের অনেকগুলোই বিশুদ্ধ নয়, রবীন্দ্রনাথের মৌলিক গান নয়। অন্য কোনো গানের সুর থেকে সরাসরি নকল করা বা সেগুলোকে ভেঙেচুরে রবীন্দ্রনাথ নিজের মত করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান আছে বিদেশী সুর থেকে নেয়া, অনেক গান আছে লোকসংগীত থেকে নেয়া, অনেক গান আছে বাউল সুর থেকে নেয়া। নিচে একটা বিদেশী গান দিচ্ছি। একটা খুব জনপ্রিয় রবীন্দ্র গানের সুর নেয়া হয়েছে এই গানটা থেকে। যাঁরা রবীন্দ্র সংগীত শোনেন, খুব বেশি দেরি হবে না তাঁদের সুরটাকে শনাক্ত করতে। যাঁরা পারবেন না তাঁদের জন্য রবীন্দ্রনাথের গানটাও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার নিচেই।
Ye banks and braes (স্কটল্যান্ডের ফোক গানের ইস্নিপ্স লিংক)
http://www.esnips.com/doc/8c8367b3-45fd-4a70-b291-aecbbbc15101/Yea-Banks-and-Breas

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলের ইস্নিপ্স লিংক

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA
গান দুটোর ইউটিউব লিঙ্ক
Ye banks and braes

ফুলে ফুলে ঢলে

পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত সাহিত্যিক বা সংগীত স্রষ্টাই অন্যের সৃষ্টি দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়। এতে দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথও তাঁর ভক্তদের ভাষায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তবে, হুবহু অন্যের সৃষ্টিকে নকল করা অর্থাৎ সরাসরি কুম্ভীলকতা বা চৌর্যবৃত্তি কীভাবে ‘অনুপ্ররেণাযোগ্য’ হয় সেটা অবশ্য আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের এই সমস্ত ‘অনুপ্রাণিত’ গানকে ভাঙা গান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গানের একটা তালিকা করেছিলেন। সেখানে তিনি ২৩৪টি গানকে ভাঙা গান হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। ইন্দিরা দেবীর বক্তব্যকে যদি সত্যি বলে ধরে নেই, তাহলেও দেখা যাচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গানের এক দশমাংশেরও বেশি অন্যের সৃষ্ট সুর থেকে ‘অনুপ্রাণিত’। যে রবীন্দ্রনাথে নিজেই অন্যদের সুরকে ভেঙেচুরে বা অবিকলভাবে নকল করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথের অনুসারীদের তাঁর গানকে অবিকৃত রাখা বা বিধিনিষেধের বেড়াজাল দিয়ে বিশুদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা যে অনুচিত এবং অভব্য কাজ, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
রবীন্দ্রনাথ এই রকম অনুপ্রাণিত হতে গিয়ে বহু দেশী-বিদেশী সুরস্রষ্টার সৃষ্ট সম্পদকে নিজে ব্যবহার করেছেন। হিন্দি ছবির কিছু নির্লজ্জ সুরকারেরা যেমন অন্যের সুর বেমালুম ‘আত্মীকরণ’ করেন (প্রীতম যেমন মেরে দিয়েছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানের সুর), ব্যাপারটা সেরকমেরই। এঁরা বিগত হয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথের অন্যায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে এই অনুপ্রাণিত হওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সে বিষয়ে যাওয়ার আগে আসুন একটা গান শুনি। এই গানটির সুরকে শনাক্ত করতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের কোনো মানুষেরই বিন্দুমাত্র সমস্যা হবার কথা নয়। কারণ, এই সুরটা আমরা অহরহ শুনি, গভীর আবেগে এই সুরের গাওয়া গানটার সাথে গলা মেলাই।
গগন হরকরার আমি কোথায় পাবো তারে গানের ইস্নিপ্স লিংক

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA
এবার আসুন মূল গানটা শুনি, বহুবার শোনা এবং গীত গান এটি।
আমার সোনার বাংলা গানের ইস্নিপ্স লিংক

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA
অবাক হচ্ছেন, বিস্মিত হচ্ছেন, তাই না? ভাবছেন কার এত বড় দুঃসাহস যে, এরকম করে অবিকল রবীন্দ্রনাথের গানের সুরটাকে, আমাদের জাতীয় সংগীতটাকে নকল করেছে। কিন্তু আপনাদের এই অবাক এবং বিস্ময়ের মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যাবে যখন জানবেন যে ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ এই গান রচিত হয়েছিল এবং এর সুর করা হয়েছিল আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত এবং সুর করার অনেক আগে। চাপাবাজি নয়, মিথ্যাচার নয়, সত্যের অপলাপ নয়। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির রচয়িতা এবং সুরকার একজন হতদরিদ্র ডাক পিওন। গগন হরকরা তাঁর নাম। লালনের সমসাময়িক, কুষ্টিয়ার এক বাউল তিনি। কীভাবে গগন হরকরার সুরকে নিজের নামিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালিয়ে দিয়েছিলেন, আসুন সে বিষয়টা দেখি আমরা।
রবীন্দ্রনাথদের পৈত্রিক জমিদারী ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী দেখাশোনার জন্য এখানে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চারপুরুষ ধরে তাঁদের জমিদারীর প্রজাদের উপর পীড়ন চালিয়েছেন জোড়াসাকোর এই ঠাকুর পরিবারটি। তিনিও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কবি হিসাবে তিনি যত রোমান্টিকই হোন না কেন, বৈষয়িক বিষয়ে তাঁর স্বার্থবুদ্ধি ছিল একেবারে টনটনে। ১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা আদায়ও করেছিলেন [শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃ. ১৮, ১১৭]। নতুন জমিদারী ক্রয় করেছিলেন [মার্টিন কোম্পানী থেকে নদীয়ার ডেব্রাকোল ক্রয়]। করবৃদ্ধি ও বলপ্রয়োগে কর আদায়ের ফলে প্রজাবিদ্রোহ ঘটলে তাও তিনি সাফল্যের সঙ্গে দমন করেন। বিশশতকের বিশ দশকে প্রজাপীড়ক শোষক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে শিলাইদহের ইসমাইল মোল্লার নেতৃত্বে দু’শঘর প্রজার বিদ্রোহ এ সূত্রে উল্লেখ। [অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ শারদীয়া, ১৩৮২।]
তাঁর এই বুর্জোয়া, শোষণপ্রিয় মানসিকতার ছাপ পড়েছে তাঁর লেখালেখিতেও। রবীন্দ্রনাথের সীমাহীন রচনাতে সাধারণ মানুষ প্রায় অনুপস্থিতই বলা চলে। সামান্য যেটুকু এসেছে, সেটা নিজেকে গরীবের পক্ষের লোক হিসাবে প্রমাণের তাগিদ থেকেই এসেছে, আন্তরিকতা থেকে নয়। আজীবন শোষক হয়ে শোষিতের পক্ষে কলম ধরাটা একটু কষ্টকরই বটে। আহমদ শরীফ তাঁর ‘রবীন্দ্র সাহিত্য ও গণমানব’ প্রবন্ধে লিখেছেন:
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের গভীরে প্রোথিত সামন্ত-বেণে-বুর্জোয়াচেতনা ও স্বার্থবোধ শেষাবধি পরিহার করতে সমর্থ হননি। একজন কারখানা মালিক যেমন তার শ্রমিকদের দাবি আদায়ের মিছিলে সামিল হতে পারে না, সামন্ত বেণে-বুর্জোয়া-জমিদার রবীন্দ্রনাথও তেমনি পারেননি দুস্থ-দুঃখী-চাষী-মজুরের শোষণ-পীড়ণ জর্জরিত জীবনের আলেখ্য আঁকতে। এ হচ্ছে শ্রেণীক ও ব্যক্তিক স্বার্থ চেতনার বন্ধন। নইলে যে রবীন্দ্রনাথ প্রমত্তা পদ্মায় জেলে-মাঝিকে ডুবে মরতে দেখেছেন, পদ্মার যমুনার তীর ভাঙনে হাজার হাজার গরিব চাষী-মজুরকে নিঃস্ব হতে উদ্বাস্তু হতে দেখেছেন, দেখেছেন স্বচ্ছল চাষীকে সপরিবারে পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে, প্রত্যক্ষ করেছেন দুর্ভিক্ষে অনাহারে-অপুষ্টিতে-তুচ্ছ রোগে ভুগে ভুগে অকালে অপমৃত্যু কবলিত হতে হাজার হাজার নিঃস্ব-নিরন্ন-নিরক্ষর-নির্বিরোধ মানুষকে। আরো দেখেছেন তাঁরই হুকুমে বা সম্মতিতে তাঁরই গোমস্তাদের খাজনার দায়ে তাঁরই গরিব প্রজার ঘটি-বাটি ক্রোক করতে, প্রজাকে ভিটে-ছাড়া করতে, বারবার দেখেছেন ঝড়-খরা-বন্যা তাড়িতি মানুষের চরম দুঃখ-দুর্দশা ও অপমৃত্যু–সেই রবীন্দ্রনাথের বিপুল-বিচিত্র রচনায় এদের নাম-নিশানা মাত্র নেই কেন! বোঝা গেল, শোষক তিনি যত বড়ো মহাপুরুষই হোন, শোষিতের পক্ষে লড়াই দূরে থাক, তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশেও অনীহ।
শুধু সহানুভূতি প্রকাশে অনিচ্ছুকই নন, নিজেদের শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন তিনি। ফলে, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। জমিদারী প্রথা যে প্রজা মঙ্গলের জন্য উত্তম সেটাকেই বিশ্বাস করতেন তিনি। সেকারণেই বলেছেন, “জমিদারী উঠে গেলে গাঁয়ের লোকেরা জমি নিয়ে লাঠালাঠি কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে মরবে। [প্রমথ চোধুরী–রায়তের কথা]
রবীন্দ্রনাথের প্রজা পীড়নের কাহিনি কিছুটা জানা যায় আহমদ শরীফের ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের প্রজাপীড়ন সম্পর্কে জানার জন্য তিনি তাঁর ছাত্র আবুল আহসান চৌধুরীকে চিঠি লিখে তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। আহমদ শরীফের চিঠির উত্তরে আবুল আহসান চৌধুরী এ বিষয়ে নানা তথ্য দিয়ে একটা পত্র লেখেন। আহমদ শরীফ তাঁর প্রবন্ধের তথ্য নির্দেশ অংশে সেই চিঠিটা হুবহু প্রকাশ করেছিলেন। সেই চিঠিটা এরকম:
শ্রদ্ধাভাজনেষু
স্যার, সালাম জানবেন। অসুস্থতার জন্যে আপনার চিঠির জবাব দিতে কয়েকদিন দেরী হলো। অনুগ্রহ করে মাফ করবেন আমাকে।
ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকার কোন বর্ষ কোন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা আমার সঠিক জানা নেই। আমাদের কাছে গ্রামবার্তার যে ফাইল আছে, তাতে এই সংবাদ নেই। প্রজাপীড়নের এই সংবাদ-সূত্রটি পাওয়া যায় কাঙাল-শিষ্য ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র একটি প্রবন্ধে। কাঙালের মৃত্যুর পর অক্ষয় কুমারের এই প্রবন্ধটি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে মৈত্রেয়বাবু কাঙাল হরিনাথের সংবাদপত্র পরিচালনায় সততা ও সাহসের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রজাপীড়নের সংবাদ ‘গ্রামবার্তায়’ প্রকাশের উল্লেখ করেন। ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার সম্পর্কে হরিনাথ নিজে অক্ষয়কুমারকে যে পত্র লেখেন, তিনি এই প্রবন্ধে তা উদ্ধৃত করে দেন। এই প্রবন্ধ প্রকাশের ফলে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ রুষ্ট ও অপ্রসন্ন হন এবং তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়কে বলে অক্ষয়কুমারের ‘রানী ভবানী’ গ্রন্থপ্রকাশের অর্থ-সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করান। কাঙাল-পুত্র সতীশচন্দ্র মজুমদার সূত্রে জানা যায়, ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ-প্রকাশের অপরাধে (?) তাঁরা লাঠিয়াল-গুণ্ডা লাগিয়ে কাঙালকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। এইসব ঘটনা ঠাকুর জমিদারীর ইতিহাসের দুঃখজনক কালো অধ্যায়।
এ ছাড়া অন্যত্র যেমন মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘হিতকরী’ পত্রিকায়, ঠাকুর-জমিদাররা যে প্রজাসাধারণের দুঃখ-কষ্ট মোচনে তেমন তৎপর ও মনোযোগী ছিলেন না তার ইঙ্গিত আছে। ঠাকুরবাবুরা তাঁদের জমিদারী এলাকায় গো-কোরবানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং এই নির্দেশ অমান্যকারীদের নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। শিলাইদহ ঠাকুর-জমিদারীর এই ভূস্বামী-স্বার্থরক্ষার কৌশল-ব্যবস্থা ও প্রজাপীড়নের ঐতিহ্য চারপুরুষের, দ্বারকানাথ থেকে সুরেন্দ্রনাথ পর্যন্ত। কাঙাল হরিনাথের দিনলিপিতেও এর ইঙ্গিত মেলে।
শিলাইদহ জমিদারীতে রবীন্দ্রনাথের আমলেও কিছু অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। চরের মুসলমান প্রজাদের ঢিঢ করবার জন্যে নমঃশুদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক-বুদ্ধিও রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। এ-ছাড়া পুত্র রথীন্দ্রনাথের নিরীক্ষামূলক শখের কৃষি-খামারের প্রয়োজনে গরীব মুসলমান চাষীর ভিটেমাটি দখল করে তার পরিবর্তে তাকে চরের জমি বরাদ্দের মহানুভবতাও রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শন করেছিলেন। এ-সব কথা ও কাহিনী উক্ত জীবনীকারদের যত্ন ও সৌজন্যে চাপা পড়ে গেছে। সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরতে গেলে অনেককেই হয়তো সাম্প্রদায়িক বা রবীন্দ্র-বিদ্বেষী শিরোপা, নয়তো সুভো ঠাকুরের (বিস্মৃতিচারণার প্রতিক্রিয়া দ্রষ্টব্য) মতো ধিক্কার ও তিরস্কার অর্জন করতে হবে।
ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়নের বিষয়ে আমি রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের জীবনের নিপুণ ভাষ্যকার শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারীকে (তিনি নিজে শিলাইদহবাসী ও ঠাকুর-এস্টেটের কর্মচারী ছিলেন এবং এই বিষয়গুলো জানতেন) চিঠিপত্রে নানা প্রশ্ন করে ছিলাম। তিনি এ-সব জিজ্ঞাসার জবাব এড়িয়ে ও অস্বীকার করে এই ধরনের কৌতূহলকে রবীন্দ্র-বিদ্বেষী বলে অভিহিত করেছিলেন।
উপরি-বর্ণিত বিষয়গুলোর কিছু কিছু তথ্য আমার সংগ্রহে আছে। আপনার প্রয়োজন হলে সেগুলো পাঠাতে পারি। আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। এই বিষয়ে আপনি কোন প্রবন্ধ লিখেছেন কী না জানিয়ে বাধিত করবেন। আমার গবেষণার কাজ (‘মীর মশাররফ হোসেনের শিল্পকর্ম ও সমাজচিন্তা’) চালিয়ে যাচ্ছি। এ বছরের মধ্যে থিসিস জমা দেবো এমন আশা আছে। আমার লেখার কাজে আপনার প্রশ্রয় ও প্রেরণার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আপনার জবার প্রত্যাশায় রইলাম। আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সালাম জানিয়ে শেষ করি।
স্নেহসিক্ত,
আবুল আহসান চৌধুরী
এই শিলাইদহ, শাহজাদপুরে জমিদারী দেখাশোনা করতে গিয়েই বাউলদের সংস্পর্শে আসেন রবীন্দ্রনাথ। বাউলদের গান শুনে সেগুলোর ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। শুধু মুগ্ধই নন, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল গানের সুর রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের গানের মধ্যে নিয়ে আসেন। তাঁর নিজের ভাষাতেই:
আমার লেখা যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন বাউল-পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল-সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময় আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। (শান্তিদেব ঘোষ- রবীন্দ্রসংগীত)
এখানেই গগন হরকরার সাথে পরিচয় ঘটে রবীন্দ্রনাথের। গগন হরকরার জন্ম শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রামে। কাজ করতেন ডাক বিভাগে ডাক হরকরা হিসাবে। তিনি একজন বিশিষ্ট বাউল গীতিকার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রায়শই গগন হরকরাকে কাছারিতে ডেকে নিয়ে আসতেন গান শোনার জন্য। গগন হরকরাও সানন্দে গান শুনিয়ে যেতেন তাঁদের জমিদারবাবুকে। গ্রামের এই সহজ সরল বাউল তখনও ভাবেন নি জমিদারবাবুর মনের মধ্যে কী রয়েছে। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ এই গানটার অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লেখেন আমার সোনার বাংলা বলে। এই অবিশ্বাস্য কথাটা যাঁদের বিশ্বাস হচ্ছে না, তাঁদের জন্য গগন হরকরার আমি কোথায় পাবো তারের গীতি কবিতাটা এখানে তুলে দিচ্ছি, সেই সাথে আমার সোনার বাংলার গীতিও। আপনারা মিলিয়ে দেখতে পারেন।
আমি কোথায় পাব তারে
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে–
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায় রে –
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে –
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে –
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানুস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথায় ব্যথিত
আমার সোনার বাংলা
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে–
(মরি হায়, হায় রে)
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে,
(আমি) কি দেখেছি মধুর হাসি।।
কী শোভা, কী ছায়া গো,
কী স্নেহ, কী মায়া গো–
কী আঁচল বিছায়েছ
বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।।
মা তোর মুখের বাণী
আমার কানে লাগে
সুধার মতো–
(মরি হায়, হায় রে)
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে
আমি নয়ন জলে ভাসি।।
শুধু এই গানের কাঠামো অনুসরণে কবিতা রচনা করেই ক্ষান্ত হন নি তিনি। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আমার সোনার বাংলাতে হুবহু গগন হরকরার সৃষ্ট সুর বসিয়ে দেন। আমাদের জানামতে গগন হরকরা সেই সময় জীবিত থাকার পরেও তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া বা তাঁকে জানানোর প্রয়োজনটুকুও তিনি বোধ করেন নি। এ যেন তাঁর নিজের লিখিত দুই বিঘা জমির সেই জমিদারের মত। রাজা হয়েও ‘যার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। এত বড় একজন কবি এবং সংগীতকার হয়েও গ্রামের একজন দরিদ্র ব্যক্তির মেধাপ্রসূত সম্পদকে চুরি করতে তাঁর বিন্দুমাত্রও বাধে নি। যোগাযোগের অপ্রতুলতা এবং এখনকার মত তথ্যের অবাধ প্রবাহ সেই সময়ে না থাকার কারণে কারো পক্ষেই এত বড় একটা চুরি ধরা সম্ভবপর হয় নি। পরে যখন বিষয়টা জানা গেছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ পরিণত হয়ে গিয়েছেন মহাকাশস্পর্শী এক মহীরুহে। তাঁর বিশাল এক স্তাবকবাহিনী তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই স্তাবকবাহিনী তাঁদের পূজনীয় ঠাকুরকে বাঁচানোর জন্য গালভরা এক শব্দ ‘অনুপ্রেরণা’কে বেছে নিয়েছেন, ‘ভাঙা গানে’র ভরাট ঢালের আড়ালে অত্যন্ত সুকৌশলে নিয়ে গিয়েছেন শতাব্দীর সেরা চৌর্যবৃত্তিকে।
http://arts.bdnews24.com/?p=3955
No comments:
Post a Comment