১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি
বালাকোটের সাময়িক ব্যর্থতা নেতৃবৃন্দের শাহাদাত ও পরবর্তী পর্যায়ে মোজাহিদ বাহিনীর উপর ইংরেজদের অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও এই সংগ্রামী বাহিনীর কর্মীরা নিশ্চুপ বসে থাকেননি। তাঁরা বিভিন্নভাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা-আদর্শ প্রচার ও ইংরেজ বিরোধী ত্রাস সৃষ্টি করে গেছেন। শাহ আবদুল আজীজ কর্তৃক প্রচারিত সেই ‘দারুল হরবের ফতওয়া’ এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারই ফলশ্রুতি হিসাবে তাঁর অনুসারীগণ কর্তৃক স্বল্পকালস্থায়ী ‘ইসলামী রাষ্ট্র গঠন’ ও ‘বালাকোটের লড়াই’ এবং উক্ত লড়াইয়ের পর কর্মীদের বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে ইংরেজ-বিরোধী ভাব জাগ্রত করা –এই সব কিছুই ঐতিহাসিক ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছে –যার সূচনা করেছিলেন শূকরের চর্বিমিশ্রিত বন্দুকের টোটা ব্যবহার ইত্যাদিকে উলক্ষ্য করে বেরাকটুরের মুসলিম সৈনিকগণ। এ বিপ্লবকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করলেও মূলতঃ সেটাই ছিলো হিমালয়ান উপমহাদেশে প্রথম বলিষ্ঠ আজাদী আন্দোলন এবং অবিভক্ত ভারত থেকৈ ইংরেজদের বিতাড়িত করার লক্ষ্যে তাদের প্রতি এক প্রচণ্ড আঘাত।
কিন্তু ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস, এক শ্রেণীর লোকের বিশ্বাসঘাতকতা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, অনৈক্য ইত্যাদি কারণে মুসলমানদের এ বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ বিপ্লবের নায়ক ছিলেন একমাত্র মুসলিম আলেম সমাজই, যা কোনো কোনো হিন্দু নেতা ও ইংরেজ লেখক হান্টারও তথ্যাবলী সহকারে লিখে গেছেন।
বিপ্লবে জড়িত শত শত আলেমের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন নেতা
মওলানা এনায়েত আলী, মওলানা আহমদুল্লাহ, মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা জাফর থানেশ্বরী, মওলানা সাখাওয়াত আলী, সাইয়েদ আহমদ তাহের, শাহ মাযহার আলী, চট্টগ্রামের সুফী নূর মুহাম্মদ, মোমেনশাহীর শেখ গোলাম আলী, কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ, সাইয়েদ মুহাম্মদ ইয়াকুব, শেখ হামদানী, মওলভী ওয়াজুদ্দীন, মওলানা নেজামুদ্দীন দেহলভী, সাইয়েধ নাসের আলী, মিয়া ইহসান উল্লাহ, শেখ মুয়াজ্জেম, হাকীম মুগীসুদ্দীন, মুনাওয়ার খান, সাইয়েদ মুরতজা হোসাইন, মওলানা মুহাম্মদ আলী দেহলভী, মওলানা ফসীত গাজীপুরী, সাইয়েদ আবদুল বাকী, মওলানা আবদুল হাই, মওলানা মুফতি এনায়েত আহমদ, শাহ আহমদ সাঈদ, ঢাকার মওঃ আজীমুদ্দীন, কুমিল্লার মওলানা আশেকুল্লাহ ও বরিশালের মওঃ আমীনুদ্দীন।
মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা জাফর থানেশ্বরী ও মওলানা খায়রাবাদী বিপ্লবের ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ফাঁসির দণ্ড প্রাপ্ত হন। এ দণ্ডাদেশ শুনে তাঁরা ‘সাক্ষাত জান্নাতে পৌঁছার সুযোগ লাভে’ আনন্দ প্রকাশ করায় ইংরেজ সরকার তাদেরকে সুযোগ থেকে ‘বঞ্চিত’ করার উদ্দেশ্যে আন্দামানে নির্বাসিত করেন।
আলেমদের বিপ্লব উত্তর ভূমিকা
১৮৫৭ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর গোটা উপমহাদেশের মুসলিম জীবনে সবচাইতে ঘোর দুর্দিন নেমে আসে। হিন্দুরা ইতিপূর্বেই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি ও মুসলিম বিদ্বেষ হেতু ইংরেজদের চাটুকারিতায় লেগে গিয়েছিল। ইংরেজদের আশঙ্কা ছিলো একমাত্র সেই মুসলমানদের পক্ষ থেকেই –যাদের হাত থেকে তারা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলো। বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের বিপ্লব তাদেরকে মুসলমানদের ব্যাপারে অধিক সতর্ক করে দেয়। তাই মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনের ন্যায় তাদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনও সংকীর্ণ ও দুর্বিসহ হয়ে ওঠে –যাবতীয় অধিকার থেকে তাদের করা হয় বঞ্চিত। ইংরেজগণ বিপ্লবের জন্যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই দায়ী করে তাদেরই ওপর জুলুম-নির্যাতনের চরম স্টিম রোলার চালাতে থাকে। বিপ্লবের নায়ক আলেমগণ ও সাধারণ মুসলমান এজন্যেই ইংরেজদের রোষাণলে পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেন, কেউ মাল্টা বা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন, কেউ দীর্ঘকাল যাবত কারা-অন্তরালে আঁধার কক্ষে তিলে তিলে ক্ষয় হন। (১৮৬৩-৬৭ খৃঃ)। বস্তুত এ রোষানল প্রশমিত করার জন্যেই স্যার সাইয়েদ বিদ্রোহের অন্য রকম ব্যাখ্যা দানের চেষ্টা করেন।
এবার আন্দোলন দু’ধারায় চলতে থাকে
স্থানে স্থানে ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র ও গুপ্ত জেহাদী প্রতিষ্ঠান
প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বালাকোট আন্দোলনে মোজাহিদগণ সংগ্রামের পথ ছেড়ে দেননি। একদিকে তাঁরা সীমান্তে ইয়াগিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন, অপর দিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহর সুযোগ্য বংশধর ও সাইয়েদ সাহেবের মন্ত্রশিষ্য মওলানা শাহ ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে পূর্ব থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ইংরেজদের চক্ষু এড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা ও জেহাদের অনুকূলে কাজ চলতে থাকে। তাঁরা সতর্কতার সহিত সে কাজ চালিয়ে যেতেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানে স্থানে মাদ্রাসা কায়েম ও ধর্মীয় সভাসমিতির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার কাজ করতেন। এ সঙ্গে খুব সন্তর্পণে জিহাদী প্রচারণা ও ইসলামী জাগরণকে উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
দারুল উলুম দেওবন্দ সহ অগণিত প্রতিষ্ঠাত কায়েম হলো
বস্তুতঃ সে প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই আমরা বিশ্ব বিখ্যাত উচ্চ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্ব-বিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানসমূহ দেখতে পাই। এগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ে আরও অসংখ্য শিক্ষা ও গুপ্ত জেহাদী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যতের জন্যে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়। উত্তরকালে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ও ‘খেলাফত আন্দোলন’কে উপলক্ষ্য করে মুসলমানদের মধ্যে আযাদী আন্দোলনের যে সাড়া জাগে এবং ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাক্সিতান নামক যে রাষ্ট্রটি অর্জিত হয়, এই প্রত্যেকটি কাজেই ঐ সব প্রতিষ্ঠানের অপরিসীম অবদান রয়েছে।
বালাকোট ও পাকিস্তান আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন ছিল না
বালাকোট কেন্দ্রিক সংগ্রাম আর ৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোন আন্দোলন ছিল না। বরং শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর প্রেরণায় তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী, সাইয়েদ আহমদ শহীদ, মওলানা ইসমাইল শহীদ দেহলভী ও মওলানা আবদুল হাই প্রমুখ ইসলাশী আন্দোলনের বীর সিপাহীগণ যেই আপোষহীন সংগ্রাম করেছিলেন, এটা ছিলো সেই আন্দোলনেরই পরিশিষ্ট। এ সব নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে যে সুমহান লক্ষ্য আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অমূল্য জীবন আহুতি দিতে হয়েছিল, উপমহাদেশের মুসলমানগণ কায়েদে আজম মুহাম্মদ আল জিন্নাহ, মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ও মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবানের মধ্যে তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিল। কায়েদে আজম দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে একাধিকবার ঘোষণা করেছেন যে, “পাকিস্তানের আদর্শ হবে একমাত্র ইসলাম। চৌদ্দশো বছর পূর্বেই আল কুরআন আমাদের শাসনতন্ত্র তৈরী হয়ে আছে”।
No comments:
Post a Comment