১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব
পলাশী বিপর্যয়ের ঠিক একশ বছর পর ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। শত বছর ধরে এদেশের আযাদী পাগলা মুসলমানরা যে নিরন্তর বিদ্রোহ পরিচালনা করে ‘ রাণীর বিদ্রোহী প্রজা’ অভিধা লাভ করেছিলেন, সিপাহী বিপ্লব নামে পরিচিত আযাদীর লড়াই ছিল তারই অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কগণই ছিলেন সিপাহী বিপ্লবের মূল শক্তি ও অনুপ্রেরণা। ১৮৩১ সালে বালাকোটের সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর বাহিনীর বিপর্যয়ের পর জিহাদের বিপ্লবী ভাবধারায় উজ্জীবিত নেতৃবৃন্দ উপমহাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর অন্যতম অনুসারী হাফিয কাসিম।
জিহাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যে জেনারেল বখত খান, মওলানা আহমদ উল্লাহ শাহ ও মওলানা ফজলে হক খায়বাদী দিল্লী কেন্দ্রে, হাজী ইমদাদউল্লাহ ও তাঁর অনুসারীগণ শামেলী, সাহারানপুর ও থানাভবনে সক্রিয় ছিলেন। হাফিয কাসিমের অনুসারী নেতৃস্থানীয় মুজাহিদদের মধ্যে দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা কাসিম নানুতুভী, মওলানা রশীদ আহমদ গাংগোহী, মওলানা মোহাম্মদ মুনীর প্রমুখ বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশ,দিল্লী ও কানপুরসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এসব কেন্দ্রের মধ্যে এক সুগ্রন্হিত যোগসূত্র বিদ্যমান ছিল।
জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক মওলানা আহমদউল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৬৫ সাল থেকেই বিপ্লব ও বিদ্রোহের সংকেতবাহী চাপাতি রুটি ও রক্তজবা ফুল বিতরণ শুরু হয়ে যায়। এক গ্রামের নেতার হাত থেকে দ্রুত অন্য নেতার হাতে ঘুরছিল বিপ্লবের ইঙ্গিতবাহী চাপাতি রুটি। এক সৈন্য আরেক সৈন্যের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন রক্ত-রঙিন আযাদী বিপ্লবের ইঙ্গিতবাহী জবা ফুল। সে কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। দিল্লী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সবখানে বিপ্লবীদের কার্যক্রমের খবর প্রতিদিনই সতর্কতার সাথে পৌঁছে যাচ্ছিল।
১৮৫৭ সালের এপ্রিল মাসে মওলানা আহমদউল্লাহর বিরুদ্দে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারপত্র বিলির অপরাধ প্রমাণ করে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ৈ শহীদ করা হয়। তার আগে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ভ ও সংগঠিত করেন। ১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে মাদ্রাজে এক বক্তৃতায় তিনি বলেনঃ
“দেশবাসী, আপনারা জেগে উঠুন। ফিরিঙ্গি কাফেরদের উৎখাত করতে আপনরারা সংঘবদ্ধ হোন। এই কাফেররা ন্যায়ক পদদলিত করেছে, আমাদের স্বরাজ্য তারা লুণ্ঠন করেছে। এই কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সে সংগ্রাম হবে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য জিহাদ”।
জিহাদ আন্দোলনের অসংখ্য বিপ্লভী নেতা এ সময় হিন্দুস্থানের প্রত্যন্ত এলাকায় এমনিভাবে দেশবাসীকে আযাদী পুনরুদ্ধারের লড়ইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বদ্ধ করছিলেন। দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ যাফরও জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কদের সংগ্রাম দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে এ সময় এক ঘোষণাপত্র প্রচার করেন এবং বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানান।
১৮৫৭ সালে সারা ভারতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহের সূচনা হয় ইংরেজ শাসনের রাজধানী কলকাতার ব্যারাকপুরে। বাংলায় সে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, যশোর প্রভৃতি স্থানে। ঢাকার বিদ্রোহ চলাকালে একজন ইংরেজ সৈন্য নিহত ও চারজন আহত হয়। অন্য দিকে ৪০ জন দেশীয় সিপাহীসহ বহু আহত হয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য ১৮৫৭ সালে লালবাগের যে স্থানটিতে সেদিন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্ত ঝরেছিল, সে স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ইংরেজরা সেখানে কারাগার নির্মাণ করে, যা এখনো বিদ্যমান। ইংরেজদের হাতে বন্দী বিপ্লবী মুসলমান সিপাহীদের ষাট জনকে সদরঘাটের অদূরে ‘আন্টাঘর ময়াদনে’ গাছের শাখায় ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁদের লাশ মাসের পর মাস সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়েছিল বিপ্লবকামী জনগণকে আতঙ্কিত করার জন্য। সেই আন্টাঘর ময়দানই এখন ‘বাহাদুর শাহ পার্ক নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি স্মৃতির মিনাররূপে তা আজো আমাদের পূর্বপুরুষদের মহান আত্মদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
১৮৭৫ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজরা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা দুদু মিয়াকে প্রেফতার করে এ জন্য যে, তাঁর আহ্বানে যে কোন মুহূর্তে পঞ্চাশ হাজার লোক সাড়া দিতে এবং তিনি তাদেরকে যা আদেশ দেবেন, তারা তাই করতে প্রস্তুত ছিল।
১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রামকে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে বিকৃত করার চেষ্টা করা হলেও এই বিদ্রোহের পেছনে আযাদী পাগল বেসামরিক মুসলিম বিপ্লবীদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল। একথা কোন কোন ইংরেজ লেখকও স্বীকার করেছেন। স্যার জেমস আউটরামের মতেও বিপ্লবী মুসরমানগণই ছিলেন এই বিদ্রোহের মূল শক্তি। বিদ্রোহ দমনের কাজে নিয়োজিত দু’জন ইংরেজ সৈন্য ১৮৫৭ সালে বেনামীতে লেখা বিদ্রোহের ইতিহাস বইয়ে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলীকে এই ঘটনার সাথে যুক্ত করেছেন। তাঁরা লিখেছেনঃ
“রাজ্যচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলী ১৮৫৬ সালের এপ্রিলে কলকাতায় নির্বাসিত হন এবং তিনি ব্রিটিশ শাসন উৎখানের উপায় তালাশ করতে থাকেন। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং সৈন্যদের সমর্থন আদায়ের জন্যী তিনি চেষ্টা চালাতে থাকেন। অযোধ্যার নবাবের সভাসদ ও অনুচরগণ সন্দেহাতীতভাবে এই বিদ্রোহে যুক্ত ছিলেন”।
১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পর ইংরেজরা জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর নির্যাতন শুরু করে। বিদ্রোহের শাস্তিস্বরূপ কতজনের যে ফাঁসি হলো, কত লোকের হলো কারাবাস, সে হিসাব পাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরবাসে দণ্ডিতদের সংখ্যাই ছিল দশ হাজারের বেশি।
জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক আন্দামান-বন্দী মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী লিখেছেনঃ
“স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তবেই কোন হিন্দুকে আটক করা হতো, কিন্তু পালাতে পারেনি এমন একজন মুসলমনাও সে দিন বাঁচেনি”।
আপসহীন বিপ্লবী ধারার অবসান
সিপাহী বিপ্লবের পর ১৮৫৮ সালে জিহাদ আন্দোলনের নেতা মওলানা ইনায়েত আলী এবং ১৮৬২ সালে ফরায়েজী আন্দোলনের নায়ক দুদু মিয়া ইন্তেকাল করেন। বিপ্লবোত্তর ব্যাপক মুসলিম নির্যাতনের পটভূমিতে এবং আন্দোলনের দুই প্রধান কান্ডারীর ইনতেকালের পর এই দু’টি আন্দোলনের ধারা কিছুটা দুর্বলভাবে হলেও আরো বহু দিন অব্যাহত থাকে। ১৮৬৬ সালে জিহাদী বিপ্লবীগণের উদ্যোগে তাঁদের আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটিরূপে দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই জিহাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চলতে থাকে। অন্যদিকে দুদু মিয়ার পুত্র গাজীউদ্দীন হায়দার ১৮৬২ সাল পর্যন্ত এবং আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়া ১৮৬৪ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। এ সময়ও ফরায়েজী আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান ছিল।
১৮৬৪ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত তথাকথিত ‘ওয়াহাবী মামলাগুলো থেকে জানা যায় যে, সে সময় পর্যন্ত বাংলায় জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের ধারা চালু ছিল। এ সময়ও বিভিন্ন গ্রামে ফরায়েজীদের একজন করে প্রতিনিধি নিযুক্ত ছিলেন এবং বিচার-ফয়সালা থেকে শুরু করে জনগণের শাসনকার্যের বিরাট অংশ তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯০১ সালের জনসংখ্যা জরিপে দেখানো হয়েছে যে, বগুড়ায় ফরায়েজীরা তখনো সক্রিয়। সরকারবিরোধী জিহাদের জন্য তাঁরা চাঁদা তুলতেন এবং প্রতিটি ফরায়েজী পরিবারে জিহাদের জন্য মুষ্টি-চাল রাখা হতো।
নয়া মিয়ার পুত্র খান বাহাদুর সাঈদউদ্দীন আহমদ ১৮৮৩ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত এবং এর পর তাঁর পুত্র আবু খালিদ রাশিদউদ্দিন ওরফে বাদশাহ মিয়া (মৃ. ১৯৫১) ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সাঈদউদ্দীন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন। বাদশাহ মিয়া খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যোগ দেন।
সূত্র :
আমাদের জাতি সত্ত্বার বিকাশ ধারা লেখক :
মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান
No comments:
Post a Comment