হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদার গণতন্ত্রের চর্চায় পথপ্রদর্শক ও রাজনৈতিক শিক্ষকের স্থান দখল করে আছেন।
মমতাজ উদ্দীন পাটোয়ারী |
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
ব্রিটিশ-ভারতবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে ক’জন নেতা কালকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাদের মধ্যে অন্যতম। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে ১৯২০ সালে, শেষ হয়েছে ১৯৬৩ সালে। এই সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাংলা ও বাঙালির অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের আন্দোলন, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর উদারবাদী গণতন্ত্রের ধারায় পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার গঠনে মেধা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের মতো অসাম্প্রদায়িক দল গঠন, নেতৃত্ব দেয়া এবং বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার বেড়ে ওঠায় গুরুর মতো প্রভাব বিস্তার করেছেন। উদার গণতন্ত্রের চর্চায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পথপ্রদর্শক ও রাজনৈতিক শিক্ষকের স্থান দখল করে আছেন। সে কারণে পূর্ব বাংলার অধিবাসী না হওয়া সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দীকে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালপুরুষ হিসেবেই ইতিহাস প্রদর্শন করছে। এত বড় রাজনৈতিক নেতারূপে তার উত্থান, বিকাশ ও ঐতিহাসিক অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাজনীতি সচেতনসহ সাধারণ মানুষের পর্যায়ে থাকা খুবই জরুরি। এ বিষয়ে বর্তমান নিবন্ধে সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জন্মগ্রহণ করেছেন কলকাতায়, ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে। তার পিতার নাম ব্যারিস্টার জাহিদুর রহিম জাহিদ সোহরাওয়ার্দী, মায়ের নাম খাদিস্তা আকতার। পরিবারটি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে ২০০ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে বসতি স্থাপন করে। তবে প্রথম দিকে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ধর্ম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখলেও উনিশ শতকে এ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষা, আইন পেশা এবং সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরিতে যুক্ত থেকেছেন। ঢাকায়ও তাদের কেউ কেউ চাকরিতে ছিলেন। হোসেন শহীদের পিতা প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী, পরে বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গীয় পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তার পাণ্ডিত্যের জন্য ব্রিটিশরা তাকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করে। কিছুদিন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের ডিনের দায়িত্বও পালন করেন। মা খাদিস্তা আকতার একজন কবি ছিলেন, নারীশিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, ১৯০৯ সালে কলকাতায় সোহরাওয়ার্দীয়া বেগম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। হোসেন শহীদের প্রাথমিক শিক্ষা মামা স্যার আবদুল্লাহ মামুন সোহরাওয়ার্দীর তত্ত্বাবধায়নে সম্পন্ন হয়। তিনি তার শিক্ষার ভিতকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। তার বড় ভাই হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯০-১৯৬৫) লেখাপড়ায় ছিলেন প্রখর মেধাবী, জানতেন ১২টি ভাষা, বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন, পরে তিনি ভারতবর্ষে ফিরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন, দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানে চলে যান, কূটনেতিক দায়িত্বও পালন করেন।
অন্যদিকে হোসেন শহীদ প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯০৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন, ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এখান থেকে ১৯০৯ সালে এফএ এবং ১৯১১ সালে বিএসসি অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবিতে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। পরিবারের ইচ্ছায় তিনি উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য ১৯১৩ সালে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তার সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।
তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন। ১৯১৯ সালে তার মা মারা যান। ১৯২০ সালে তিনি গ্রেস ইন বার থেকে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন শেষে দেশে ফিরে আসেন। তবে ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব, যুদ্ধোত্তর ইউরোপের রাজনৈতিক সংকট তার তরুণ মানস গঠনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ইংল্যান্ডের আলোকিত মানুষের সঙ্গে যেমন তার পরিচয় ঘটে, একইভাবে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব তরুণ ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য যান, তাদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, বাঙালি তরুণদের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। বস্তুত বিশ শতকের শুরুর বিশ্ববাস্তবতাকে ইংল্যান্ডে বসে সাত বছর ধরে দেখা, বোঝা ও করণীয় নির্ধারণ করেই তিনি ১৯২০ সালে দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফেরার পর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার আবদুর রহিমের কন্যা নিয়াজ ফাতেমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এই ঘরে তাদের এক পুত্র ও এক কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। ১৯২২ সালে স্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে হোসেন শহীদের জীবনে বড় ধরনের বিপত্তি ঘটে। তার পুত্র শাহাব সোহরাওয়ার্দীও মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে পড়তে এসে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালমৃত্যুবরণ করেন।
পরিবারের বিয়োগান্ত ঘটনার কোনোটিই হোসেন শহীদকে তার লক্ষ্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। দেশে ফিরেই তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে খিদিরপুর শ্রমিক অঞ্চল থেকে বঙ্গীয় আইনসভার প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়ে সদস্য নির্বাচিত হন। ওই আইনসভার সভাপতি ছিলেন নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২৮ বছর বয়সের তরুণ ব্যারিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অত্যন্ত তীক্ষ� যুক্তিসহ বক্তৃতা করেন, যা সব সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সভাতেই ভারতীয়দের দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘বেত্রাঘাত বিল’ উপস্থাপন করলে সোহরাওয়ার্দী ব্রিটিশ সরকারের কড়া সমালোচনা করেন এবং হুঁশিয়ার করে দেন এই বলে যে, ভারতবর্ষের মানুষ কারো দাস নয় বরং সভ্যতার যেকোনো মাপকাঠিতে এখানকার মানুষজন অত্যন্ত সভ্য ও উন্নত। সুতরাং, বেত্রাঘাত ব্যবস্থা চালু করা হলে ভারতবর্ষে এর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। বাঙালি কংগ্রেস নেতারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তাদের দলে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনিও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার সাহচর্যে এসে সোহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে অনেক বেশি সক্রিয় হতে থাকেন।
১৯২৩ সালে দেশবন্ধু স্বরাজ পার্টি গঠন করলে সোহরাওয়ার্দী তাকে সমর্থন দেন। দেশবন্ধু তরুণ উদীয়মান নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর ওপর আস্থাশীল ছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় স্বরাজ দলের ডেপুটি লিডার হিসেবে তিনি তরুণ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মনোনীত করেন। ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় আইনসভার দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে স্বরাজ পার্টি ৪২টি আসন লাভ করে। সোহরাওয়ার্দী উত্তর কলকাতার আসন থেকে নির্বাচিত হন। তবে দেশবন্ধু বঙ্গের ক্ষমতায় না বসে বিরোধী দলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। দেশবন্ধু স্বরাজ পার্টির মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমদের তৈরির জন্য দলকে সংগঠিত করার চিন্তা থেকেই ক্ষমতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালি পশ্চাত্পদ মুসলমানদের তুলে আনা গেলে বাংলা তথা ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো অর্জন সম্ভব হতে পারে। বেঙ্গল প্যাক্ট (বাংলা চুক্তি) চুক্তিনামা সেই লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হয়, যাতে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষার সুযোগ, চাকরির সুযোগ, পৃথক নির্বাচন, মুসলমানদের ওপর যুক্ত নির্বাচন চাপিয়ে না দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়।
সোহরাওয়ার্দীও এতে স্বাক্ষর করেন। বেঙ্গল প্যাক্ট অনুযায়ী ১৯২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কলকাতা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দেশবন্ধু মেয়র এবং সোহরাওয়ার্দী ডেপুটি মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় লাভ করেন। বাংলার রাজনীতিতে দেশবন্ধু-সোহরাওয়ার্দীর যুগল নেতৃত্ব নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। কিন্তু ১৯২৫ সালের ১৬ জুন দেশবন্ধুর মৃত্যু বড় ধরনের ছেদ সৃষ্টি করে। তবে সোহরাওয়ার্দী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরোধা দেশবন্ধুর আদর্শকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। শেখ মুজিব সেই ধারার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বেড়ে উঠে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হন। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর সুভাষ চন্দ্র বসু ও সোহরাওয়ার্দী হাল ধরার চেষ্টা করলেও সাম্প্রদায়িক বিরোধবোধে দেশবন্ধুর অনুপস্থিতি প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯২৬ সালে দাঙ্গা ঠেকানো যায়নি। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিষয়টি অগ্রসর নেতাদের দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সোহরাওয়ার্দী ১৯২৭ সালে প্রজা ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি প্রায় ৩৬টি ট্রেড ইউনিয়নকে একত্র করে ১৯২৭ সালেই জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করেন। তিনি অবশ্য কমিউনিস্ট ধারার শ্রমিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না, তবে অসাম্প্রদায়িক ধারার ধারক হিসেবেই শ্রমিকশ্রেণীকে রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি চতুর্থবারের মতো কলকাতা থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন। তিনি আইন পরিষদে স্বতন্ত্র মুসলিম পার্টি গঠন করেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির যুগে সোহরাওয়ার্দী কিছুটা স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখে অগ্রসর হন। প্রজা পার্টি গঠিত হলে তাতে যোগ দেন। ত্রিশের দশকের শুরুতে তিনি ব্যাপক রাজনৈতিক সফর করে গোটা বাংলা চষে বেড়ান। পূর্ব বাংলাকে এ সময় তার ভালোভাবে জানা, সাধারণ মানুষকে বোঝার সুযোগ ঘটে। অবশ্য জিন্নাহর অনুরোধে তিনি এরই মধ্যে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি লন্ডন গোলটেবিলে যোগদান করেন। এতে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করেন। সোহরাওয়ার্দী কলকাতাকে ভারতবর্ষের রাজনীতির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে তা সফল হয়নি। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন গৃহীত হলে রাজনীতির মোড় ঘুরে যায়। ভোট, ক্ষমতা ইত্যাদি ভারতবর্ষে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। তাতে নানা আবরণে রাজনীতি, দল, নেতৃত্ব এবং জনগণের বিভাজন ও মেরুকরণ ঘটতে থাকে। সোহরাওয়ার্দী কলকাতার দুটি আসনে জয়লাভ করেন। ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী যোগদান করেন। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত্ নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর আবির্ভাবের পদধ্বনি শোনা গেল। বাংলার কৃষক, শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশে সোহরাওয়ার্দী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জুন গোপালগঞ্জে হক-সোহরাওয়ার্দী আসেন। সেখানেই তরুণ শেখ মুজিবের পরিচয় ঘটে এই দুই বাঘা নেতার সঙ্গে, যা অচিরেই প্রগাঢ় হতে থাকে। একসময় সোহরাওয়ার্দীর পরম স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব, যা বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন তথা স্বাধীন দেশ লাভের রাজনীতিকেই অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে সাহায্য করে। মুজিবের রাজনীতির শিক্ষক হিসেবে সোহরাওয়ার্দী স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন নির্মাণে সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মুসলিম লীগ ঢাকার আহসান মঞ্জিলে আবদ্ধ হয়ে থাকার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে যে ক’জন দলটিকে তা থেকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী অন্যতম ছিলেন। এদিকে প্রগতিশীলতা দানে তিনি, আবুল হাশেমসহ অনেকেই কাজ করেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে। নানা ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠন করতে সক্ষম হন। এর পর ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ। নানা রক্তপাত, সাম্প্রদায়িকতার বিস্ফোরণকে হজম ও প্রত্যক্ষ করেই সবকিছু মেনে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সফল করতে পারেননি যুক্ত বাংলার পরিকল্পনা। এর অনেকটাই তখন ছিল স্রোতের বিপরীতে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রতিভাধর নেতা হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষাকারীর তকমা লাগিয়ে তাকে নিষ্প্রভ করার ষড়যন্ত্রে অনেকটাই পাকিস্তান রাষ্ট্র সফল হয়েছিল। তিনি যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা হলেও ফ্রন্ট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি, পাকিস্তান গণতন্ত্রের ভাবাদর্শে হাঁটার বিশ্বাস নিয়ে জন্ম লাভ করেনি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাবাদর্শের তোড়ে গণতন্ত্রকে ভেসে যেতে হলো। সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতারা ক্ষমতাহীন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু পাকিস্তানকে গণতন্ত্রে নির্মাণ করার ক্ষমতা তার হাতে ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান সেই ক্ষমতা আগেই দখলে রেখে দিয়েছিল, ফলে বিশ শতকের অন্যতম প্রতিভাধর একজন অসাম্প্রদায়িক নেতা হয়েও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে রাখা হলো, নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো। তবে শেখ মুজিবের মতো ভাবশিষ্যকে এবং আওয়ামী লীগকে রেখে দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তিনি অমরত্ব লাভের কাজটি নীরবেই করে গেছেন।
লেখক: অধ্যাপক ও ডিন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/99/হোসেন-শহীদ-সোহরাওয়ার্দী--/
No comments:
Post a Comment