Thursday 25 May 2017

মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম



মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানবতাকে নিত্য যিনি শোনাইয়াছেন জাগরণের গান, উজ্জীবিত করিয়াছেন অভয়মন্ত্রে, তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি বিশেষণে তিনি সমধিক পরিচিত। আজ ১১ই জ্যৈষ্ঠ, এই মহান কবির ১১৬তম জন্মবার্ষিকী। নজরুল সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত অকুতোভয় তেজদীপ্ত এক জীবন সাধক।

তিনি গানের বুলবুল, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কলমযোদ্ধা। তিনি দুখু মিঞা, জীবনকে দেখিয়াছেন নিদারুণ দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে দীর্ণ-শীর্ণ হইতে। সেই কারণেই হয়তো শৈশব হইতেই তিনি ছিলেন বেপরোয়া এক জীবনসন্ধানী। জীবনসত্য অন্বেষণ করিতে তিনি ছুটিয়াছেন নিরন্তর। তিনি চঞ্চল, অস্থির, কখনওবা দারুণ অভিমানী। অভিমানই তাহাকে বিদ্রোহী বানাইয়াছে। সে কথা তিনি নিজেও স্বীকার করিয়াছেন। অন্যত্র তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘এই বাঁধনহারা মানুষটি ঘরোয়া আঙিনা পেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। যে নীড়ে জন্মেছে এই পলাতক, সেই নীড়কেই অস্বীকার করেছে সর্বপ্রথম উড়তে শিখেই।’ কখনও যাত্রা দল, কখনও লেটোর দলের সঙ্গে ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগত্টাকে’ পণ করিয়া ক্লান্তিহীন ছুটিয়াছেন দেশের নানা প্রান্তে।

দারিদ্র্যের কষাঘাত কাহাকে বলে, তাহা নজরুলের মতো আর কোন মহান কবি কী অনুভব ও অবলোকন করিয়াছেন? দারিদ্র্যের অভিশাপকে তিনি রূপান্তরিত করেন শক্তিতে। দারিদ্র্য তাহার নিকট হইয়া উঠিয়াছিল অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস; উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার। তিনি কণ্ঠে ঢালিয়াছেন তরল গরল। অমৃত তাঁহার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই উদ্ধত জিজ্ঞাসা তাঁহার, অমৃতে কি ফল? জ্বালা নাই, নেশা নাই, নাই উন্মাদনা। অমরার অমৃত-সাধনা তাঁহার কাছে দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। এই দুঃখের পৃথিবীতে অমৃতের সাধনা তাঁহার নহে। দারিদ্র্যের গরলে নীলকণ্ঠ হইবার জন্য, সেই যন্ত্রণায় দগ্ধ হইবার জন্যই যেন তাঁহার জন্ম। জীবন-সংগ্রামের পুরাণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি ও মানবিকতার অন্তর্নিহিত সত্যজগতে তিনি তাঁহার দৃষ্টিকে করেন অতলস্পর্শী। সেই চাঞ্চল্যেই তিনি একাধারে হইয়া উঠিয়াছেন কবি, কথাশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও সৈনিক। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বজ কণ্ঠের প্রতিফলন মেলে তাঁহার কবিতা ও গানে। বিদ্রোহের মঞ্চে তাঁহার প্রবেশ যেন অগ্নিবীণা হাতে করিয়া, ধূমকেতুর মতো তাহার প্রকাশ। ‘ধূমকেতু’ নামের রাজনৈতিক কাগজ তিনি প্রকাশ শুরু করিয়াছিলেন ১৯২২ সালে। জন্মলগ্নেই ‘ধূমকেতু’র মাধ্যমে তিনি তত্কালীন পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলিয়া ধরেন। ঘোষণা করেন, পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করিতে হইলে সকলের আগে সবাইকে ‘বিদ্রোহ’ করিতে হইবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাহার বজ্রকম্প দীপ্ততেজ দেখিয়া লিখিয়াছেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গ শিরে, উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ স্বদেশী আন্দোলনে নূতন কোনো আশা জাগানিয়া ঘটনা দেখিলে তিনি মাতিয়া উঠিতেন প্রলয়োল্লাসে—ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখির ঝড়।

তাঁহার চেতনা লোপজনিত অসুস্থতা প্রকাশ পাইবার কয়েক মাস পূর্বে, ১৯৪১ সালের এপ্রিলে, কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’তে জীবনের শেষ অভিভাষণ পাঠ করিতে গিয়া কবি তাঁহার জীবনের লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব দেখিয়া তিনি বলেন, প্রাণের ভেতরের যে সত্য, যে ধর্ম, তাহার উপর কোনো ধর্ম নাই। বাস্তবিকপক্ষেই তিনি আমাদের সেই চিরন্তন মানবতার সঙ্গীতই শোনাইয়াছেন নিরন্তর। তিনি গাহিয়াছেন সাম্যের গান। বজ্রনির্ঘোষ তিনি বলেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। আজ তাঁহার জন্ম-জয়ন্তীতে দিকে দিকে উচ্চারিত হউক মানবতা ও সাম্যের গান। সেই সাথে কামনা করি তাঁহার বিদেহী আত্মার অনন্ত শান্তি।

  The Daily Ittefaq সম্পাদকীয় ।

No comments:

Post a Comment