আহমদ ছফা চরম সত্যবাদী একজন মানুষ ।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী | ২২:৩৭:০০ মিনিট, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৬
আহমদ ছফা
১৯৮১ সনে প্রথম পরিচয় আমার ছেলেবেলার বন্ধু সাখাওয়াত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণসংযোগ বিভাগে অধ্যাপনা করত। দুই পরিবারের অমতে সাখাওয়াত ও তার এবং মালেকার বিয়ের মূল ঘটক ছিলাম আমি এবং ‘মাসিক কণ্ঠস্বরের’ শফিকখান। ছাত্রাবস্থায় বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এটি প্রথম বিয়ে। সাখাওয়াতের পরিচয়ে তার সহযোগী তৌহিদ আনওয়ার ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশনের কিছু গবেষণা কাজের জন্য প্রায় জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছে অবস্থিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংলগ্ন গ্রামে আসতেন এবং ফেরার সময় পরিবার পরিকল্পনায় গ্রামবাসীর আগ্রহের বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার ও প্যারামেডিকদের সঙ্গে আলাপ করতেন। আমরাও পরিবার পরিকল্পনার বিস্মৃতির জন্য মনোযোগ দিয়ে শুনতাম এবং তাকে শুনতাম কি করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র মেয়ে প্যারামেডিকদের দিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি প্রচার করে ও তার ফল অধ্যাপক তৌহিদ আনোয়ারকে শুনাতাম।
আমরা বিশ্বাস করতাম বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ না করা গেলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীর সম্পৃক্ততা দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক প্রক্রিয়া। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজের স্বীকৃতিতে ১৯৭৮ সনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ও পদক দেয়া হয়েছিল। ওই বছর একই স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ও পদক মওলানা ভাসানী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সংগীতজগতের রানী রুনা লায়লা এবং সামরিক বাহিনীর প্যাথলজি ল্যাবরেটরির পরিচালক মেজর জেনারেল (ডা.) এম আর চৌধুরীকে প্রদান করা হয়েছিল।
১৯৮১ সনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট পদে ওসমানী সাহেবের নির্বাচনের সময় আহমদ শরীফ, এনায়েতউল্লাহ খান, মনিরুজ্জামান মিয়া, জাসদের মাহমুদুর রহমান মান্না, বাসদের খালেকুজ্জামান প্রমুখের সঙ্গে তৌহিদ আনোয়ার ও কয়েক জায়গায় মিটিংয়ের জন্য গিয়েছেন। আহমদ ছফা এক শীতের বিকালে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে হাসিমুখে বললেন, দেখেন বাংলা সাহিত্য জগতের সূর্যকে ধরে এনেছি, আপনার দেশী ভাই। উত্তরে আমি বললাম, সূর্য কি এত ছোট বা উত্তাপহীন যে, দুই হাতের মুঠোয় ধরে আনা যায়। লক্ষ্য করলাম তৌহিদ আনোয়ারের সঙ্গী একটু রুষ্ট হয়েছেন। আমরা তিনজন ঢাকা আরিচা রোডসংলগ্ন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যান্টিন ‘সয়াবিন চা গরমে’ বসলাম। অতিথি হাতের বিড়িটা ছুড়ে ফেললেন। তৌহিদ পরিচয় করালেন, কবি ও গ্রেট গবেষক আহমদ ছফা। তার লেখা ‘বাঙ্গালি মুসলমানের মন’ সাহিত্য জগেক নাড়া দিয়েছে, হইচই শুরু হয়েছে। বাড়ি চট্টগ্রামে। আমি বললাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আহমদ কামালের কাছে আপনার উচ্চ প্রশংসা শুনেছি। অতিথি রাগতস্বরে বললেন, আপনার বাড়ি নাকি চট্টগ্রামে। কোথায়? চাটগাই ভাষা জানেন তো? আমি বললাম রাউজান থানার শেষ প্রান্তে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে কোয়েপাড়ায়। নবীন সেন, সূর্য সেনের নোয়াপাড়ার পাশের ইউনিয়নে। আহমদ ছফা বললেন, ‘কর্ণফুলীর অন্য পাড়ে কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের নাম শুনেছেন? কখনো গিয়েছেন, আমি সেই কলেজে শিক্ষকতা করেছি, আমার সঙ্গে কোয়েপাড়ার জসিমউদ্দিন হায়দার চৌধুরী অধ্যাপনা করতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে’। জিজ্ঞেস করলেন, তার নাম শুনেছেন? চেনেন নাকি? আমি বললাম, তিনি আমার ছোট চাচা, স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম, তিনি কয়েক বছরের বড়, তিনি ঢাকায় আমাদের বাসায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। আইউববিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে জেল খেটেছেন।
চায়ের ফাঁকে বিড়ি ধরাতে প্রয়াস পেলে আমি নিবৃত্ত করায় ছফা রেগে বললেন আমার ধূমপানে আপনার গা-জ্বালা করে কেন? আমি বিড়ি খাব। ইচ্ছেমতো খাব, আপনি না বলার কে? আমি বললাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোথাও ধূমপান করা যায় না। ধূমপান ভয়ানক ক্ষতির জিনিস। বিড়ির পরিবর্তে মুড়ি ভাজা খান, সিঙ্গাড়া মিষ্টি খান। রেগে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের ক্যান্টিনের এরূপ অদ্ভুত নাম কেন ‘সয়াবিন চা গরম’? বললাম স্মরণ আছে তো ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে। দেশে পুষ্টিহীনতা হ্রাসের লক্ষ্যে আমরা সয়াবিন চাষের উদ্যোগ নিই। সয়াবিনে ১৮ শতাংশ প্রোটিন প্রায় মাংসের সমান। চালে-গমে আছে ৭ শতাংশ অনধিক। সয়াবিনের বহুগুণ, সয়াবিন থেকে দুধও হয়। ১৯৭৪ সন থেকে গণস্বাস্থ্য কৃষিকর্মীরা সয়াবিন পিষে দুধ বানাতেন এবং পুষ্টিহীন শিশুদের খাওয়াতেন। সয়াবিনের দুধে এ ক্যান্টিনে চা বিক্রি শুরু হয় তখন থেকে। এজন্য এ ক্যান্টিনের নাম সয়াবিন চা গরম। একবার ইউনিসেফের বদান্যে আমদানিকৃত একটন সয়াবীজের একটিও অঙ্কুরিত না হওয়ায় চাষীরা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা খেসারি ডালের পরিবর্তে সয়াবিন চাষ করেছিল। ফাঙ্গাস আক্রমণে এ দুর্ভোগ হয়েছিল।
ছফা বললেন, সুকৌশলে দরিদ্র কৃষকের সর্বনাশ করছেন। কৃষকের মঙ্গল আপনাদের লক্ষ্য ছিল না। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে দেশের ক্ষতি করছেন। এনজিওরা বিশ্বব্যাংকের ম্যাকনামারার খাস এজেন্ট।
তারা দেশের মঙ্গল করে না, তারা দেশবাসীর ক্ষতি করে। এনজিওদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে। আপনাদের মতলব কি? কেন বিলেতের আয়েসি জীবন বাদ দিয়ে গণ্ড গ্রামে বসতি গড়েছেন? আপনার আসল উদ্দেশ্য কি? কার নির্দেশে বা কোন উদ্দেশ্যে এখানে আস্তানা গেড়েছেন? মেয়েদের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আপনাদের এত উত্সাহ? সেক্টর কমান্ডারদের আসার একটা কারণ খুঁজে পাই মুক্তিযুদ্ধের সময় একত্রে ছিলেন। তাহের, জলিল কেন আসতেন? সিরাজ সিকদারের সঙ্গে কি আপনার পুরনো ছাত্র ইউনিয়নের সম্পর্ক? ১৯৭৫ সনে আপনাদের পার্শ্ববর্তী রক্ষীবাহিনীর ছাউনির সামনে তো সিরাজ সিকদারের মরদেহ ফেলে রাখা হয়েছিল, দেখতে যাননি?
হাফেজী হুজুরের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক? তিনি কেন আপনার এখানে আসতেন? আমি চুপচাপ বসে হাসছিলাম প্রগতিশীলদের পুরনো চক্রান্ত থিয়োরি শুনে। ছফা চিত্কার করে বললেন, আপনাকে উত্তর দিতে হবে, আপনি কার লোক? কার এজেন্ট? সিএইএ? কেজবি? না চীনের?
ক্ষোভে বললেন, আমাকে ধূমপান করতে দিলেন না। কিন্তু সুলতানকে তো আপনার শান্তিনিকেতনে (ঠাট্টাচ্ছলে) দিনের পর দিন কেবল ধূমপান নয়, ধূমপানের চেয়ে অধিক ক্ষতিকর গাঁজা টানতে দিয়েছেন। তখন আপনার নীতি কি ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিবেকহীন না হলে তো এজেন্ট হওয়া যায় না।
উত্তর চাই। আমি আবার আসব। আহমদ ছফা পরবর্তীতে আরো কয়েকবার এসেছেন। বিড়ি খেতে না দেয়ার কারণে গায়ে পড়ে ঝগড়া শুরু করতেন। বলেছেন বিড়ি খেতে না দিন, চার মিনার টানতে দিন। সাহায্য চেয়েছেন তার স্কুলের জন্য। আপাতত দৃষ্টিতে বোহেমিয়ান ‘বাঁধনহীন মানুষ’ মনে হলেও আহমদ ছফা ছিলেন বহু বাঁধনে বাঁধা।
ছফা জেনেছিলেন শিল্পী সুলতানের সঙ্গে আমাদের নিয়ম ভাঙার কারণ। শিল্পী শেখ মুহাম্মদ (এসএম) সুলতান অনেক দিন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ছিলেন। গণপাঠশালার ছেলেমেয়েদের শেখাতেন চিত্রাঙ্কন, গল্প করতেন বাংলার প্রকৃতির, বাংলার ইতিহাসের এবং বাংলার কৃষকের শ্রম পরিশ্রম ও সংগ্রাম। তাই সুলতানের ছবির নারী স্বাস্থ্যবতী, পীনোন্নত স্তন, কিষাণ সুঠামকান্তি ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সংসারবিহীন সুলতানকে পীড়িত করত পুরোপুরি ধূমপানমুক্ত এলাকায় তার অন্যায় আবদার আমরা মেনে নিয়েছিলাম বলে। তিনি কখনো প্রকাশ্যে ধূমপান করেননি, গাঁজাও কখনো প্রকাশ্যে টানেননি। শান্তিনিকেতনতুল্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে না টানলেও, তার রুমের ভেতরে নিয়ম লঙ্ঘন তাকে পীড়িত করত। হঠাত্ যেমন এসেছিলেন, ঠিক তেমনি একদিন ঝড়ের মতো চলে গেলেন।
যাওয়ার সময় বললেন, দেয়ার মতো আমার কিছু নেই। আমার ছবিগুলো রেখে দিন। আমি বলেছিলাম, তা হয় না। এই অমূল্যধনের প্রকৃত স্থান শিল্পকলা একাডেমি, যেখানে সবাই জীবনের স্বাদ পাবে, ছফার ভাষায়, ‘সুলতানের মধ্যে দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো ও রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর কল্পনা ও কল্পনার বলিষ্ঠতার গভীর ছাপ খুঁজবে দর্শক।’
এসএম সুলতান যেন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যান, সেজন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে তারেক মাসুদের ‘আদম সুরাত’ চিত্রের অর্থায়নের মাধ্যমে।
চট্টগ্রামের মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, অধ্যাপক আবুল ফজল, কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহমদ শরীফের গ্রামের বাড়ির কয়েক মাইলবৃত্তের মধ্যে এক সাধারণ মুসলমান কৃষকবাড়ির ছেলে আহমেদ ছফা। প্রথমবারের মতো গ্রামের হাইস্কুল, নিকটবর্তী শহরের কলেজ ডিঙিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অনার্স কোর্সে ভর্তি হলো ষাটের দশকের প্রথমার্ধ্বে। শ্যামলকান্তি স্লিম তরুণের পরিচয়ের পরিধি ক্রমে বেড়ে চলল, বন্ধুত্ব হলো অনেকের সঙ্গে। অধ্যয়নকালে ড. আহমদ শরীফের মন্তব্য পছন্দ না হওয়ায় তিন বছর পড়েও অনার্স পরীক্ষা না দিয়ে বিএ পাস কোর্স পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ভর্তি হলো পলিটিক্যাল সায়েন্সের এমএ ক্লাসে।
ক্লাস করার চেয়ে আগ্রহী বেশি সাহিত্যচর্চা ও কবিতা লেখায়। অজস্র প্রেমের কবিতা লিখল, কিছু ছাপা হলো এবং কয়েকজনের সঙ্গে প্রেমে সখ্য হলো। চমক সৃষ্টি হলো ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাস প্রকাশ করে।
১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগেই নির্বাচিত হলো বাংলা একাডেমির তিন বছর মেয়াদের পিএইচডি ফেলোশিপ প্রোগ্রামে। পিএইচডি থিসিসের সুপারভাইজার হওয়ার জন্য অনুরোধ করার জন্য মার্চের শেষে উপস্থিত হলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সাহেবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে। প্রফেসর রাজ্জাক জিজ্ঞাসা করলেন নাম এবং থিসিসের বিষয়বস্তু। তরুণ বললেন, নিজের নাম ‘আহমদ ছফা’ এবং থিসিসের শিরোনাম The Growth of Middle Class in Bengal as it influenced its literature, Society and Economics from Eightcnth to Nineteen Fifty Eight. প্রফেসর রাজ্জাক বললেন, ‘এত সাগর সেচার কাম, কার বুদ্ধিতে এই গন্ধ মাদন মাথায় লইচেন’।
হাঁক দিলেন, ‘মৌলবি আহমদ ছফাকে’ এক কাপ চা দিয়ে যায় এবং আরো বললেন, আমি তো আপনার সুপারভাইজার হবার পারুম না, আমি তো দীর্ঘদিনের লেকচারার, সুপারভাইজার হবার জন্য দরকার নিদেনপক্ষে রিডার।
শুরু হয়ে গেল মুক্তি যুদ্ধ। মৌলবি আহমদ ছফা লিপিবদ্ধ করলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন সৃষ্টি হলো, লক্ষ্যে অস্পষ্টতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে। বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামের সৈনিকরা হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় যাজ্ঞা করতে গেল এবং তেজোদীপ্ত মুজিব চলে গেলেন পাকিস্তান কারাগারে’।
যুদ্ধশেষে ১৯৭২ সনের শুরুতে দেশে ফিরলেন আহমদ ছফা, অব্যাহত রাখলেন প্রতি সপ্তাহে গুরু ঢাকাইয়া পোলা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে সাক্ষাত্ ও আলোচনা। গুরুর কাছে আহমদ ছফা পরিণিত হলেন মৌলবি আহমদ ছফায়। ছফা গুরু থেকে অর্জন করলেন জ্ঞান এবং লিখলেন অসংখ্য প্রেমের কবিতা, অনেক ছোটগল্প ও উপন্যাস এবং বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ। আলোড়ন সৃষ্টি করল ‘বাঙ্গালি মুসলমানের মন’ , ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’, মরণ বিলাস, গাভী বৃত্তান্ত, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, যদ্যাপি আমার গুরু, সংকটে নানা চেহারা প্রভৃতি।
আহমদ ছফা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে লিখলেন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিসের’ মতো সাহিত্য সৃষ্টি হলো না। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক বড় লেখকের বই পড়েছি। তবে উল্লেখ্য যোগ্য বিশুদ্ধ বই দেখিনি। সৈয়দ শামসুল হক দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বিলেতের আয়েসি জীবন থেকে লিখলেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা, দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লেখা। এটাই তো হওয়ার কথা কারণ ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী কবি সাহিত্যিক, শিক্ষকরা কেউ ফ্রন্টে যাননি, সময় কাটিয়েছেন আড্ডা মেরে, ঝগড়া করে ও খুনসুটি করে। ভারত দায়িত্ব পালন করল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধাত্রী হিসেবে। কিছু তো মূল্য দিতে হবে। (’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর: একটি অনুভূতি) বিনিময়ে কি দিতে হচ্ছে? সাইলকের মতো ভারত যা নিচ্ছে, তা সর্বজনবিদিত, কারো অজানা নয়। বিনিময় মূল্য নিয়ে শঙ্কা ছিল শেখ মুজিব ও মওলানা ভাসানীর— ‘ইসলামাবাদের জিঞ্জির ভেঙেছি, নয়াদিল্লির পদানত হওয়ার জন্য নয়’।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সাড়ে পাঁচ বছর হ্যারাল্ড লাস্কির সরাসরি পিএইচডি ছাত্র ছিলেন, জ্ঞান আহরণ করেছেন কিন্তু থিসিস প্রকাশ করেননি। গুরুর মতো ছফার নিজের পিএইচডি লেখা শেষ হলো না। তবে তির্যক বক্তব্য ও লেখনীর কারণে বহু বন্ধু হয়ে গেল শত্রুসম। ছফা নিঃসংকোচে লিখলেন, দুর্নীতিপরায়ণ, সুযোগসন্ধানী ও অসত্ বুদ্ধিজীবীদের কথা। শেখ মুজিবুর রহমান এক পা এক পা করে স্বৈরাচারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন এই বুদ্ধিজীবীরা ‘তাঁকে বাহবা দিয়ে সপরিবারে নিহত হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছিলেন’।
তসলিমা নাসরীনের কবিতা নিম্নমানের, তাঁর লেখা সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়, দেশের ভেতরে বাইরে তসলিমার অভিভাবক এবং ভক্তের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নয়। মন্তব্য তসলিমার পক্ষে, না এলে ব্ল্যাকমেইল করার ব্যাপারে তাদের জুড়ি নেই ‘দাউদ হায়দার ছেলেটা শতকরা ৯০টা মিথ্যে কথা বলে। অসম্ভব চালাক। অন্যের কাছে নিজের দেশ ও ধর্মের নিন্দে করে সহানুভূতি আদায় করে (বিদেশের মাটিতে) বেঁচে থাকে’। ড. হুমায়ুন আজাদ স্ট্যান্ডবাজ, রুচিহীন, নির্লজ্জ ও পরশ্রীকাতর এবং পশ্চিম সাহিত্য চৌর্যবৃত্তি করে নিজ নামে চালায়।
ড. হুমায়ুন আজাদের নারীবহুল আলোচিত গ্রন্থ, এত জীবন্ত যে মাসে রক্তস্রাব হয়। সিমোন দ্য বোভেয়ারের সঙ্গে এত মিল পরবর্তী গ্রন্থ দ্বিতীয় লিঙ্গে। প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্র্যান্ড রাসেলের ২৯ বছর বয়সের লেখা ‘Why I am not a Christian’-এর বঙ্গীয় সংস্করণ হুমায়ুন আজাদের অপূর্ব চৌর্যবৃত্তি ‘আমার বিশ্বাস’। হুমায়ুন আজাদ বাহাদুর বটে। তার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী সৈয়দ শামসুল হককে ধরাশায়ী করলেন, বন্ধুর বইয়ের সমালোচনায়। ‘সৈয়দ হক যার লেখার কিছু কিছু অংশ আমার পছন্দ, বাংলাদেশের সবচেয়ে লিঙ্গবাদী লেখক, যার প্রধান প্রেরণা কাম যিনি নারীকে ভোগ্যপণ্যরূপে ব্যবহারে অক্লান্ত, যিনি আঙুল গোল করে তার ভেতর আরেক আঙুল ঢুকিয়ে জিগ জিগ মানুষের গল্প লিখেছেন’ (হায়রে হুমায়ুন আজাদ আপনার এমন কোমল হূদয়)
এক কালের ‘সুমিষ্ট’ বন্ধু হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কেও কটূক্তি করতে পিছপা হননি আহমদ ছফা। ‘নন্দিত নরক দিয়ে যাত্রা শুরু কিন্তু আজকাল পয়সার জন্য আজে বাজে লিখছেন’।
তবে বন্ধু ফরহাদ মজহারের সমালোচনা ছিল অত্যন্ত কোমল। ‘আমি নাম বদলাইনি ‘ছ’-এর স্থলে দন্ত ‘স’ বসাইনি’ কিন্তু ফরহাদ নাম বদলায়েছে। ফরহাদ ও ছফা সমবয়সী। দুজনে গ্রাম থেকে এসেছেন। দুজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ছফা মানবিক বিষয়ে, ফরহাদ বিজ্ঞানে পাস করে পাড়ি দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। উঁচু মহল নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ফরহাদ সহজে বিচরণ করতে পারেন সে সমাজে। ফরহাদের মা শিক্ষিকা। ছফার বাড়িতে শিক্ষার রেশ ছিল না। অজান্তে ছফাকে একটা হীনম্মন্যতা তাড়িত করত। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শামসুর রাহমান প্রমুখের লেখা জগতের এলিট ক্লাবে ছফার অবস্থান জুতসই ছিল না। ছফা ও ফরহাদের মার্কসীয় চিন্তায় জন্ম ও বিচরণ। প্রথম দিকে ফরহাদের এনজিও কার্যকলাপের কারণে কটূক্তি করলেও পরবর্তীতে ছফা নিজে ‘বাংলা জার্মান সম্প্রীতি’ নামে একটি এনজিও দাঁড় করিয়েছিলেন। নামিদামি শিক্ষক লেখকদের ছোটখাটো ত্রুটিতে শানিত তীর নিক্ষেপে ছফা দ্বিধা করেননি। একটি মাত্র ব্যতিক্রম ঢাকাইয়া গুরু অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। ধর্ম থেকে শুরু করে রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন অনন্য অসাধারণ। ‘ইসলাম ধর্ম কেবল পরকালের গুরুত্ব স্বীকার করে তাই নয়, ইহকালকে অস্বীকার করে না’। রাজ্জাক সাহেব মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তান দাবির সমর্থক ছিলেন। ভেবেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলার মুসলমান সমাজের উপকার হবে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ধারণাটিও রাজ্জাক সাহেবের মস্তক থেকে এসেছে। ছফা যথার্থই লিখেছেন ‘কিছুই না লিখে শুধু সাহচর্য’ সংস্পর্শের মাধ্যমে কত অকর্ষিত তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রশ্নশীলতার অঙ্কুর জাগিয়ে তুলেছেন, তা ভাবলে বিস্ময়ে আভিভূত না হয়ে উপায় থাকে না। (যদ্যাপি আমার গুরু)
মৌলবি আহমদ ছফার মর্মবেদনা
ছফার জীবনে প্রেম এসেছিল কয়েকবার, কিন্তু পূর্ণতা লাভ করেনি। নড়া দাঁতও ব্যথা দেয়, তুলে ফেললে ব্যথা থেকে মুক্তি কিন্তু স্থানটা শূন্য।
তিনটি ক্ষোভ জাজ্বল্যমান ছিল মৌলবি আহমদ ছফার অন্তরে। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের আতিথেয়তাকে আহমদ ছফা সবসময় স্মরণ রেখেছেন। ভারত-বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য ধাত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিল নির্বিঘ্নে। বিনিময়ে ভারত স্থগিত করিয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের নিরাপদ আশ্রয় ও প্রশিক্ষণস্থল। ভারতের অবারিত বাণিজ্য এবং প্রায় নিখরচায় বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ট্রানজিট এবং স্বাধীনতার পর পরই রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করে নির্বিচারে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, ক্রসফায়ার ও গুপ্তহত্যার প্রচলন ঠিক যেভাবে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন মাওবাদীদের ধ্বংস করা হয়েছিল। এটা শেষ কথা নয়।
বন্ধুরাষ্ট্র ভারত গঙ্গার পানিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে
ব্যবহার করে বাংলাদেশের অপূরণীয় সাধন করেছে, যার পরিমাণ হিরোশিমা নাগাসাকি ধ্বংসের ক্ষতির পরিমাণের চেয়ে বেশি।
প্রতি বছর ফারাক্কা বাঁধের কারণে ৫৪টি নদ-নদীর পানি খরার সময় বাংলাদেশে আসতে পারে না। মরুকরণ প্রক্রিয়া উত্তরবঙ্গ ছাড়িয়ে অন্যত্র বিস্তার করছে। (ফারাক্কা ষড়যন্ত্রের নানান মাত্রা)।
বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থান অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ভাবশিষ্য মৌলবি আহমদ ছফাকে ভয়ানকভাবে উদ্বেলিত ও বিচলিত করেছিল। খালেদা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য শেখ হাসিনার হরতাল অসহযোগ, সন্ত্রাস, পরবর্তীতে হাসিনার আমলে খালেদা জিয়ার সন্ত্রাসের ঘটনায় পুনরাবৃত্তিতে জনগণের অবস্থান গম পেষার জাঁতার দুই পাথরের মধ্যবর্তী স্থানটায়। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে দুখানি তলোয়ার দিয়ে টেলিভিশনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিন। দুজনে যুদ্ধ করুক। যে অন্যকে খুন করে জিততে পারবে আমরা তাকে ক্ষমতাসীন মহারানী হিসেবে মানব এবং অনুগত প্রজা হিসেবে জয়ধ্বনি করব। (তলোয়ার যুদ্ধে হাসিনা খালেদা যে পারে বিজয়ী হোক, মার্চ ১৯৯৬)
তৃতীয় মর্মবেদনা, আহমদ ছফা বহুবার চেষ্টা করেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে নিজের গ্রামের প্রবেশপথে মুক্তিযুদ্ধে নিহত একশত অনধিক নাগরিকের নাম বিলবোর্ডে লিখে স্থায়ীভাবে রাস্তায় পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করাতে পারেননি গ্রামবাসী ও সরকারকে দিয়ে। স্লোগানের ত্রিশ লাখ শহীদের প্রশ্ন ওঠালে বা ইতিহাস জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে জেল-জরিমানা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকা সমন্বিত রাখার লক্ষ্যে। জয়বাংলা।
লেখক: ট্রাস্টি গণবিশ্ববিদ্যালয়
https://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/164/আহমদ-ছফা--/
No comments:
Post a Comment