আমার নজরুল-চর্চা
মোহাম্মদ আবদুল কাইউম
আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি নজরুলকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পাইনি। তবে, সারা জীবন আমি নজরুল-চর্চায় নিবেদিত থেকে ধন্য হয়েছি। মূলত নজরুল-চর্চার নব নব দিগন্ত সন্ধানে আমি সর্বদাই রত ছিলাম।
আমার পিতা মোহম্মদ কাসেম অবশ্য ধন্য হয়েছিলেন নজরুলের সান্নিধ্য লাভ করে। ১৯২৬ সালে নজরুল যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন আমার পিতা, আবদুল কাদির ও আবদুল মজিদ (পরবর্তীকালে সাহিত্য রত্ন) নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে যান। সম্ভবত মোহাম্মদ কাসেম একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা জানালে নজরুল পত্রিকার নামকরণ করেন ‘অভিযান’। পরে ‘অভিযান’ নামে একটি কবিতাও রচনা করে দেন, যা ১৩৩৩-এর ভাদ্র মাসে ‘অভিযান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্রে নজরুলের লেখা এটি প্রথম কবিতা। পরবর্তীকালে কলকাতা থেকে ১৯৩৩ সালে মোহাম্মদ কাসেমের ‘আগামীবারে সমাপ্য’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হলে নজরুল সমকালীন ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় এ উপন্যাসের একটি সমালোচনায় গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। স্বাভাবিকভাবে আমাদের গৃহে নজরুল-চর্চার একটি পারিবারিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছিল।
বাল্যকালে নজরুলের কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করি। ১৯৩৯ সালে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের বার্ষিক সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাটি আবৃত্তি করে বিশেষ পুরস্কার লাভ করি। পরবর্তীকালে আমি নজরুলের বিভিন্ন কবিতা আবৃত্তি করে বিশেষ প্রশংসিত হয়েছি। আমার প্রিয় কবিতা ছিল নজরুলের ‘সিন্ধু’, ‘খালেদ’ ও ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’।
১৯৫০ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হই। এ সময় পিতৃ-সুহৃদ আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্নের সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের গ্রন্থ রেজিস্ট্রেশন বিভাগে উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। রেজিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে প্রকাশিত ব্রিটিশ আমলের ‘বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগে’র নাম শুনেছিলাম। আবদুল মজিদ জানালেন বিশ শতকের প্রথমার্ধের দুষ্প্রাপ্য বেঙ্গল লাইব্রেরির ক্যাটালগ তাঁর হেফাজতে আছে। আমি জানতাম বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থাদির নাম ও প্রকাশকাল সন্ধানে গবেষকদের কাছে ছিল এটি আকর-গ্রন্থ। বিশ শতকের মুসলমান লেখকদের, বিশেষ করে নজরুলের, বিভিন্ন গ্রন্থের নাম ও প্রকাশকাল জানার জন্য আমি বিশেষ আগ্রহী হই। আবদুল মজিদ চাচার আমন্ত্রণে ইডেন বিল্ডিংয়ের নির্দিষ্ট এক ব্যারাকে প্রায় প্রতি দিন আমি যাওয়া-আসা শুরু করি। ১৯২১ ও পরবর্তী বিভিন্ন সালের বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ দেখে প্রয়োজনীয় তথ্য আমি লিখতে শুরু করি। নজরুলের প্রায় সবগুলো গ্রন্থেরই নাম এবং প্রকাশকাল জানতে পারি।
নজরুল নিয়ে প্রকৃত গবেষণা তখন শুরু হয়নি। এমন কি ১৩৫১-এর আগে নজরুলের পূর্ণ গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়নের চেষ্টাও দেখিনি। বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার নজরুল সংখ্যা প্রকাশ করেন। এটি প্রথম নজরুল সংখ্যা এবং এই সংখ্যায় মুদ্রিত নজরুল গ্রন্থপঞ্জি বা নজরুলের গ্রন্থাবলির তালিকাও প্রথম। ১৯৫১ সালে নজরুল জন্মবার্ষিকী সংখ্যা ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায় ‘কবিতা’ পত্রিকা থেকে নজরুলের গ্রন্থপঞ্জি প্রকাশ করে। ইতিমধ্যে আমি বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় নজরুলের গ্রন্থাবলি সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য পাই। ১৯২২ সালে প্রকাশিত নজরুলের ‘অগ্নি-বীণা’-কেই তাঁর প্রথম গ্রন্থ বলেই সকলে জানতো। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় দেখলাম ‘ব্যথার দান’ গ্রন্থটি নজরুলের প্রথম গ্রন্থ (প্রকাশকাল, ১ মার্চ, ১৯২২)। অগ্নি-বীণার প্রকাশকাল হচ্ছে ২৫ অক্টোবর, ১৯২২। নজরুলের অপরিজ্ঞাত দুটি বইয়ের নামও বেঙ্গল লাইব্রেরি তালিকায় আমি দেখতে পাই। বই দুটি হচ্ছে ‘মহুয়ার গান’ (প্রকাশকাল, ১ জানুয়ারি, ১৯৩০) ও ‘নির্ঝর’ (প্রকাশকাল, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৩৯)। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ‘সোনার বাংলা’র গ্রন্থপঞ্জিটি আমি দেখি। আমার জানা নতুন তথ্যাদি নিয়ে সংশোধিত নজরুল-গ্রন্থপঞ্জি ১৯৫২ সালে নজরুল জন্মবার্ষিকী সংখ্যা ‘সোনার বাংলা’য় প্রকাশ করি।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এটি আমার প্রথম রচনা, নজরুল চর্চায় আমারও প্রথম পদক্ষেপ। আমার পিতৃ-বন্ধু মাহ্ফুজুর রহমান খান কলকাতায় নজরুলের ‘জুলফিকার’ ও ‘বনগীতি’ প্রকাশ করেন। এ দুটি গ্রন্থও একই বছর প্রকাশিত হয় (আশ্বিন ১৩৩৯)। তাঁর বাড়ি ছিল সিরাজদি খান গ্রামে। ঢাকায় এলে তিনি আমাদের বাড়ি আরমানিটোলার ‘খায়রুন মহলে’ উঠতেন। নজরুল-সুহৃদ মাহ্ফুজুর রহমানের সংগ্রহে কবির প্রায় সবগুলি গ্রন্থেরই প্রথম সংস্করণ ছিল। গ্রামে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নজরুলের বইগুলি আমাদের বাড়িতে রাখতেন। নজরুলের এই দুষ্প্রাপ্য বইগুলি দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। এ সময় ১৯৫৩-৫৪ সালে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান আমার পিতা মোহাম্মদ কাসেমের অনুরোধে নজরুল ইসলাম সম্পর্কে একটি আলোচনা-গ্রন্থ লিখতে শুরু করেন। তিনি এ গ্রন্থ রচনায় মাহ্ফুজুর রহমানের সংগ্রহটি ব্যবহার করেন। আলী আহসান স্যার ‘সোনার বাংলা’য় প্রকাশিত আমার লেখাটি দেখেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর ‘নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থে পরিশিষ্টের নজরুল গ্রন্থপঞ্জিটি লিখতে বলেন। আমি প্রায় ৭পৃষ্ঠাব্যাপী এই গ্রন্থপঞ্জিতে ‘নির্ঝর’-সহ নজরুলের ৪৯টি গ্রন্থের তালিকা প্রদান করি এবং প্রায় ১৬টি গ্রন্থের সূচিপত্র তুলে ধরি।
বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় পাওয়া নতুন একটি তথ্য এতে অন্তর্ভুক্ত করি। তা হচ্ছে ১৯২৮ সালে দুই প্রকাশক (বর্মণ পাবলিশিং হাউস ও ডি. এম লাইব্রেরী) কর্তৃক প্রকাশিত ‘সঞ্চিতা’ কাব্যের দুটি পৃথক সংস্করণের কথা, যা ইতিপূর্বে কেউ কোথাও উল্লেখ করেননি। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় জানা যায়, বর্মণ পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত ‘সঞ্চিতা’য় ছিল অগ্নি-বীণা, ঝিঙ্গেফুল, সর্ব্বহারা, ফণিমনসা, ছায়ানট, দোলন চাঁপা, সিন্ধু-হিন্দোল ও চিত্তনামা থেকে নির্বাচিত কবিতা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৩০ এবং প্রকাশের তারিখ ২রা অক্টোবর, ১৯২৮। ডি, এম, লাইব্রেরি কর্তৃক প্রকাশিত ‘সঞ্চিতায়’, অগ্নি-বীণা, দোলন চাঁপা, ছায়ানট, সর্ব্বহারা, ফণিমনসা, সিন্ধু-হিন্দোল, চিত্ত-নামা, ঝিঙ্গেফুল, বুলবুল ও জিঞ্জীর থেকে কবিতা সঙ্কলিত হয়েছিল। পৃষ্ঠাসংখ্যা- ২২৩, মূল্য আড়াই টাকা।
পরবর্তিকালে আমি ‘বেঙ্গল লাইব্রেরী ও কাজী নজরুল ইসলাম’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করি। এই প্রবন্ধে আমি ‘বেঙ্গল লাইব্রেরী ক্যাটালগে’ নজরুলের বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পর্কে যে সব তথ্য সংগ্রহ করি, তা তুলে ধরি।
১৯৫২ সালে ‘পি. ই. এন’-এর উদ্যোগে ঢাকার কার্জন হলে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় নজরুল-জয়ন্তী পালিত হয়। দু’দিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন তদানীন্তন পূর্ব বাংলার গভর্ণর মালিক ফিরোজ খান নুন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও শিল্পীবৃন্দ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে আমি নজরুলের ‘খালেদ’ কবিতাটি আবৃত্তি করি। অনুষ্ঠানপত্রে আমার দেওয়া শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা নজরুল-প্রতিকৃতি মুদ্রিত হয়েছিল।
বাংলা একাডেমিতে ১৯৬১-এর জানুয়ারি মাসে আমি ‘সহকারী সঙ্কলক’ পদে যোগদান করি। সে বৎসরই ২৫-শে মে বাংলা একাডেমী সপ্তাহব্যাপী নজরুল-জয়ন্তীর আয়োজন করে। আলোচনা-সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও এই নজরুল-জয়ন্তীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল নজরুল প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীর পেছনে ছিল আমার উদ্যোগ ও সক্রিয় সহযোগিতা। ‘বাংলা একাডেমীর ইতিহাস’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লেখা হয়- ‘কবির প্রকাশিত সমস্ত গ্রন্থ, সম্পাদিত পত্রিকা, এগুলির প্রথম সংস্করণ, নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, কবির বিভিন্ন বয়সের আলোকচিত্র, কবি ও তাঁর সাহিত্য বিষয়ে লিখিত পুস্তক ও প্রবন্ধাদি নিয়ে এই নজরুল প্রদর্শনী ছিল অভিনব এবং সারাদেশে সর্বপ্রথম’। বলা বাহুল্য, আমার সংগ্রহ থেকে নজরুলের কয়েকটি রচনার পাণ্ডুলিপিও এ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
১৯৬৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগদান করার পর সেখানেও ১৯৬৮ সালে আমার উৎসাহ ও সহযোগিতায় নজরুল-জয়ন্তী উৎসব হয়। নজরুলের কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ প্রদর্শন ছাড়াও এ অনুষ্ঠানে প্রলম্বিত পোস্টারে নজরুলের জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি তুলে ধরা হয়। ১৯৭৭ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র মুক্তমঞ্চে নজরুল-জয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এতে আমার লেখা ‘নজরুল গীতিতে ভাব ও সুরের বৈচিত্র্য’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করি। প্রবন্ধটি ১৬ মে তারিখের ‘বেতার বাংলা’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত উচ্চতর গবেষণা-ব্যপদেশে আমি লণ্ডনে অবস্থান করি। সেখানে ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে নজরুলের একটি অপরিজ্ঞাত ‘মহুয়ার গান’ গ্রন্থটি আমার নজরে পড়ে। আমি সম্পূর্ণ কাব্যটি লিখে নিয়ে আসি। ১৯৯০ সালে বসন্ত ১৩৯৬ সংখ্যা নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকায় ‘নজরুল ইসলামের মহুয়ার গান’ প্রবন্ধটি আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালে ঢাকা, ত্রিশাল ও দরিরামপুরে জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মবার্ষিকীতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করি। উল্লেখযোগ্য দুটি প্রবন্ধ ছিল ‘নজরুল সাহিত্যে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতি’ এবং ‘নজরুল সাহিত্যে লোকজ উপাদান’।
নজরুল সুহৃদ ও ‘নজরুল সাহিত্যর ভাণ্ডারী’ নামে অভিহিত কবি আবদুল কাদির বিভিন্ন প্রবন্ধে এবং তৎসম্পাদিত নজরুল রচনাবলির পরিশিষ্টে গ্রন্থ-পরিচয় শাখায় নজরুলের বিভিন্ন কবিতার পাঠভেদ বা পাঠান্তর নিয়ে অনেক তথ্য প্রকাশ করেন। প্রবন্ধগুলি আমার কৌতূহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইতিপূর্বে আমি হাতে লেখা পুঁথিতে পাঠভেদ নিয়ে একটি গবেষণা-গ্রন্থ প্রকাশ করি। স্বভাবতই আমিও নজরুল সাহিত্যে পাঠভেদ নিয়ে গবেষণায় প্রবৃত্ত হই। আমার সহপাঠী বন্ধু আলাউদ্দিন আল্ আজাদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। তাঁর অনুরোধে আমি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পত্রিকা ‘পাণ্ডুলিপি’র জন্য ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও মোসলেম ভারত’ শীর্ষক প্রায় ৩৫ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ এক প্রবন্ধ রচনা করি। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় নজরুলের প্রকাশিত প্রায় ২২টি কবিতা ও গান গ্রন্থে অন্তর্ভুক্তির সময় যে পাঠান্তর ঘটে আমি তা তুলে ধরি।
এই পাঠভেদ আলোচনায় গবেষক হিসেবে আমি প্রভূত আনন্দ লাভ করি। লক্ষ করা যায় ‘হাফিজের গজল অবলম্বনে’ ‘বোধন’ নামে ‘মোসলেম ভারতে’ যে কবিতাটি প্রকাশিত হয়, তা ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত করার সময় ‘অবলম্বনে’ কথাটির বদলে লেখা হয় ‘হাফিজের গজলের ভাবছায়া’। পরাধীন ভারতের পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কবি মূলের ‘দুঃখ কি ভাই, হারানো য়ুসোফ্ কিনানে আবার আসিবে ফিরে’-র বদলে ‘বিষের বাঁশী’তে লিখেছেন ‘দুঃখ কি ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে’। নজরুল ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতার বানানও সংশোধন করেন। বিশেষ করে আরবি-মূল শব্দের বানান, যেখানে ফারসি-মূল করা হয়েছিল, সে গুলো তিনি গ্রন্থে প্রকাশকালে আরবি-মূল বানান রেখেছেন। যেমন- ‘সাত-ইল-আরব’, ‘হায়দ’র, ‘কেয়ামত’ ইত্যাদি স্থলে লেখা হয়েছে- ‘শাত্-ইল-আরব’, ‘হাইদর’, ‘কিয়ামত’।
নজরুলের লেখা ‘কোরবানী’ কবিতায় আমরা দেখি সেকালে আরবি ফারসি শব্দে ‘ণ-ত্ব বিধান’ অনুসরণের যে অযৌক্তিক প্রথা প্রচলিত ছিল, নজরুল তা অনুসরণ করেননি। ‘কোরবানী’ কবিতায় নজরুল (প্রথম সংস্করণে) লিখেছিলেন ‘ওরে হত্যা নয়, আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্-বো-ধন’। সম্ভবত সত্যেন্দ্রনাথের একটি চরণের (‘সত্যাগ্রহে লাঞ্ছনা করো’) অনুসরণে সত্যাগ্রহ বানানটি কবি গ্রহণ করেন। গান্ধীজির আন্দোলনেরও নাম সত্যাগ্রহ। ‘অগ্নি-বীণার’ তৃতীয় ও চতুর্থ সংস্করণে কবি-প্রদত্ত বানান ‘সত্য-গ্রহ’ পরিলক্ষিত হয়। কবি এই নতুন শব্দটি নির্মাণ করেন- ‘সত্য-গ্রহ’ (সত্য+গ্রহ) অর্থাৎ সত্যের ধারণ বা উপলব্ধি। পরবর্তীকালে কবির অসুস্থ অবস্থায় প্রকাশিত বিভিন্ন (১১শ, ১২শ ও ১৫শ) সংস্করণে ‘সত্যাগ্রহ’ বানানটি লক্ষ করা যায়। আব্দুল কাদির সম্পাদিত প্রথম (১৩৭৩) এবং নতুন সংস্করণ(১৪০০) নজরুল রচণাবলীর- ‘সত্য-গ্রহ’ বানানটিই গৃহীত হয়। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর নজরুল জন্মশতবার্ষিক সংস্করণে (১৯৬৬)‘সত্যাগ্রহ’ বানানটিই মুদ্রিত হয়েছে।
পাঠসমালোচনার ধারায় আমি আরো কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করি। যথা- ১. ‘ধূমকেতু ও লাঙল পত্রিকা’য় নজরুলের কবিতা ঃ পাঠান্তর প্রসঙ্গ’, ২. ‘নজরুলের দুটি সমান্তরাল কাব্য’ এবং ৩. ‘সবুজ বাঙলায় প্রকাশিত কবিতা ও গান’। এই প্রবন্ধগুলোতে নজরুলের পাঠ-পরিবর্তনের মধ্যে কৌতূহলোদ্দীপক অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নজরুলের একটি কবিতা- ‘ল্যাবেন্ডিশ’ বাহিনীর-বিজাতীয় সঙ্গীত’। ল্যাবেন্ডিশ শব্দটি সম্ভবত নজরুলেই প্রথম ব্যবহার। প্রসঙ্গত বলা যায়, শব্দটি প্রচলিত বাংলা ও ইংরেজি কোনো অভিধানে নেই। তবে শব্দটি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সম্পাদিত ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে’ রয়েছে। এর মূল ফারসি (না আনদেশ>)। এই কবিতায় হরতাল শব্দের সুন্দর ব্যবহার লক্ষ করা যায়- ‘বাজে করতাল- আজ হরতাল/ডাকে আত্মা যে খাঁচা-ছাড়’!
পাঠসমালোচনা বিষয়ে আমার আর একটি প্রবন্ধ ‘নজরুলের দুটি সমান্তরাল কাব্য : পাঠসমালোচনার নিরিখে’। নজরুল ইসলাম রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত দু’টি কাব্যকে আমি ‘সমান্তরাল কাব্য’ বলে আখ্যায়িত করেছি। এ দু’টি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘ছায়ানট’ ও ‘পূবের হাওয়া’। দু’টি গ্রন্থই ১৩৩২ সালে প্রকাশিত হয়। ‘ছায়ানট’ গ্রন্থে প্রকাশকাল মুদ্রিত হয় ১৯২৫। ‘পূবের হাওয়া’ কাব্য ১৯২৬ সালে প্রকাশ পায়।
একই কবিতা দু’টি কাব্যে সমান্তরালভাবে মুদ্রিত হয়। এর পেছনে কারো ব্যবসায়িক কূটবুদ্ধি বা শৈথিল্য ক্রিয়াশীল ছিল কিনা সে রহস্য আমাদের অজানা। সাহিত্য-সমালোচক আবুল মান্নান সৈয়দ এক গ্রন্থের কবিতা এভাবে অন্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করাকে ‘কবিতা চালাচালি’ ব’লে আখ্যায়িত করেন। জীবনানন্দ দাশ-এর ‘বনলতা সেন’ এবং ‘মহা পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ দুটিতে এ ধরনের ‘কবিতা চালাচালি’ তিনি লক্ষ করেছেন। নজরুলের ‘ছায়ানট’ ও ‘পূবের হাওয়া’ কাব্য দুটির প্রথম সংস্করণের কপি আমার কাছে ছিল। তাই এ দুটির পাঠ সমালোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।
আমার আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হচ্ছে ‘ঢাকা-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি-চর্চায় নজরুল’। এই প্রবন্ধটি রচনা করে যে আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়েছি তা আমার কাছে ছিল অভূতপূর্ব। প্রবন্ধটি নজরুল ইন্সটিটিউটে ১৯৯৮ এর ২৬ অক্টোবরে এক বিশেষ আলোচনা-সভায় পঠিত হয়। পরে প্রবন্ধটি নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত ‘নজরুল জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থে’র (২৫ মে, ২০০০) অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে এক যুগান্তর সৃষ্টি হয়। এই যুগান্তর সৃষ্টিকারী পরিমণ্ডলে ১৯২৬ সালে নজরুল ঢাকায় আসেন। তখন নজরুল অবশ্য বাংলা সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে বহুল বিদিত। নজরুলকে দেখার জন্য, তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য অথবা তাঁর মুখের বাণী শোনার জন্য ঢাকাবাসীর সে কি ব্যাকুলতা! বুদ্ধদেব বসুর রচনায় নজরুলের সম্মানার্থে আয়োজিত এমনি এক সভার বর্ণনায় লেখা হয়- “তাঁর জন্য আমি জগন্নাথ হলে যে সভাটি আহ্বান করেছিলাম তাতে ভিড় জমেছিল প্রচুর, দূর শহর থেকে ইডেন কলেজের অধ্যাপিকারাও এসেছিলেন, তাঁর গান ও কবিতা আবৃত্তি শুনে সকলেই মুগ্ধ ; মৃত অথবা বৃদ্ধ অথবা প্রতিষ্ঠানীভূত না-হওয়া পর্যন্ত কবিদের বিষয়ে যাঁরা স্বাস্থ্যকরভাবে সন্দিগ্ধ, সেসব প্রাজ্ঞদেরও মানতে হয়েছিল যে, লোকটার মধ্যে কিছু আছে।”
নজরুল যখন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র সভায় গজল গান গেয়ে ও ‘খালেদ’ কবিতা আবৃত্তি করে শোনান, তখন “কয়েকজন স্থিতিশীল মৌলবী সাহেবের চোখ দিয়ে নাকি অশ্রু বের হয়েছিল”। সে সময়ে এক বইয়ের দোকানেও সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল- ‘এখানে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম ও অতি আধুনিক লেখকেদের বই পাওয়া যায়’। ঢাকার ‘প্রগতি’ পত্রিকা নজরুলের বেশ কয়েকটি গান প্রকাশ করে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করে।
১৯৯৯-এর ২৫ মে, জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের বর্ষব্যাপী কর্মসূচি প্রণীত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার লেখা ‘শতবর্ষে নজরুল’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করি। এতে নজরুলের জীবন ও সাহিত্যের একটি সালতামামী মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়। ১৯৯৯ সালে আমার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রবন্ধ হচ্ছে- ‘নজরুল রচিত প্রশস্তি কবিতা’, ‘নজরুল ইসলামের সাংবাদিক জীবন’, ‘নজরুল সাহিত্যে লোকজ উপাদান’ এবং ‘নজরুলের অভিভাষণ’।
নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উৎসব পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে (১০ জুলাই, ১৯৯৯) এবং কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি (১৩ জুলাই ১৯৯৯)-তেও অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে সাহিত্যিক ও শিল্পীর একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেন। এতে আমি অন্যতম সদস্য রূপে যোগদান করি। এ উপলক্ষে ‘নজরুল চর্চার ধারা ও প্রকৃতি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ আমি রচনা করি এবং তা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে পড়ি। প্রবন্ধটি নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকার নজরুল জন্মশতবর্ষ সংখ্যায় (ডিসেম্বর, ১৯৯৯) প্রকাশিত হয়।
১৯২৯-এর ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে বিপুল জনসমাবেশে নজরুল ইসলাম-সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। এই সংবর্ধনা-সভার বিস্তৃত বিবরণ ‘সাপ্তাহিক সওগাত’-এর এক বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সংখ্যাটি আমার সংগ্রহে ছিল। তা ভিত্তি করেই ‘নজরুল সংবর্ধনা’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করি।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল- এই দু’টি নাম আমাদের সামনে নানা প্রসঙ্গে উপস্থিত হয় বিচিত্ররূপে, নানা মহিমায়। তাঁরা প্রত্যেকেই আপন আপন ভুবনে স্বতন্ত্র ও অনন্য। কিন্তু এই দুই কবির জীবন-চর্যায় দেখবো, কী আশ্চর্য সাযুজ্য- কী মনোরম যোগাযোগ। এ বিষয় নিয়ে আমি ‘দুই কবি’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করি। প্রবন্ধটি নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ : নজরুল’ শীর্ষক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ প্রবন্ধে আমরা লক্ষ করেছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) উভয়েই দীর্ঘজীবী ছিলেন, যদিও দীর্ঘকাল অসুস্থতার কারণে নজরুলের সাহিত্য-জীবন ছিল স্বল্পকালীন। বাল্য বয়সে দু’জনেরই কবিতা রচনার প্রথম সূত্রপাত। মাত্র তেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দশ বছর বয়সেই নজরুল লেটো দলের গান রচনা করেছেন। সাহিত্য যেখানে জীবনেরই প্রতিচ্ছবি, সেখানে উভয়েই উপন্যাসের কাহিনীতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ বা ‘চার অধ্যায়’ এবং নজরুলের ‘কুহেলিকা’ বা ‘মৃত্যুক্ষুধা’য় রাজনৈতিক ভাবাপন্ন বা বিপ্লবী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ যেমন পদ্মার কবি, তেমনই নজরুল সিন্ধুর কবি। দুজনের মধ্যে কৌতুকময় সাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থ (১৮৯০) উৎসর্গ করেছিলেন নামহীন কোন নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে। কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর ‘ব্যথার দান’ (১৯২২) গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন আর এক অজ্ঞাতনামা মানসীকে।
দুই কবির সাযুজ্য নিয়ে অনুরূপ আর একটি প্রবন্ধ আমি রচনা করি- ‘কবি হাফিজ ও নজরুল’। এঁদের একজন বাংলার কবি, আরেকজন সুদূর ইরানের কবি। নজরুল বিংশ শতাব্দীর কবি, আর হাফিজ চৌদ্দ শতকের কবি। আমি এই দুজনের মধ্যে দেশ ও কালের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও লক্ষ করেছি এঁরা দুজনেই সাযুজ্যের আশ্চর্য সূত্রে আবদ্ধ।
হাফিজ ও নজরুল উভয়ের বাল্যজীবন দীর্ঘকাল পর্যন্ত অতীতের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে আবৃত ছিল। নজরুলের বাল্যজীবনের অপরিজ্ঞাত কাহিনী জানতে আমাদের কয়েক যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই দুই কবির অল্প বয়সেই পিতৃবিয়োগ হয়। পারিবারিক অবস্থা কারোরই ভালো ছিল না। সঙ্কটের মধ্য দিয়ে তাঁদের বাল্যজীবন অতিক্রান্ত হয়। উভয়ের সমগ্র জীবনও কেটেছে বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে। কথিত আছে যে, হাফিজের মৃত্যুর পর কেউ কেউ হাফিজকে বিধর্মী ব’লে তাঁর জানাজা পাঠে অস্বীকার করেন। আমরা জানি, কবি নজরুলকেও কাফের আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এভাবেই আমরা হাফিজ ও নজরুলের জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে নানা মেলবন্ধন খুঁজে পেয়েছি।
‘সাময়িকপত্রে সাহিত্যিক প্রসঙ্গ’ নামে একটি গবেষণায় আমি বিভিন্ন সাহিত্যিক সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করি। পরে ‘সাময়িকপত্রে সাহিত্যিক প্রসঙ্গ’ নামে আমার একটি গ্রন্থ (প্রথম খণ্ড জুলাই, ১৯৯০) প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ডটি যন্ত্রস্থ। এ দুটি খণ্ডে নজরুল সম্পর্কে ৩৫টি সংবাদ সঙ্কলিত হয়েছে।
ঢাকার পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশে’ ‘অতর্কিত আক্রমণ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়- ‘গত রবিবার রাত্রিতে বনগ্রামের পথে প্রায় ১০টার সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অতি গুরুতররূপে প্রহৃত হইয়াছেন (ঢা. প্র.-১৭ আষাঢ় ১৩৩৫ ঃ ১-৭-২৮)’। কারা এবং কেন নজরুলের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল, তার উল্লেখ না থাকলেও এখানে সে ঘটনার তারিখটি পাওয়া যায়- ১০ আষাঢ় ১৩৩৫, ২৪ জুন, ১৯২৮, যা ইতোপূর্বে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। একই সংবাদে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। নজরুল-সুহৃদ বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতিকথায় সে ঘটনার কথা লিখেছেন এভাবে- “সেবার ঢাকায় সুধীজনের মধ্যে নজরুলকে নিয়ে কাড়াকাড়ি, জনসাধারণ তাঁর গান শুনে আত্মহারা, কেবল কতিপয় দুর্জন দুশমনের পক্ষে তাঁর প্রতিপত্তি এত দুঃসহ হলো যে তারা শেষ পর্যন্ত তাঁর উপর গায়ের জোরে গুণ্ডামি করে ঢাকার ইতিহাসে এক সঙ্গে অনেকটা কালি ঢেলে দিল।”
নজরুলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও নিন্দা করে ‘শনিবারের চিঠি’ যে নিন্দনীয় ভূমিকা রেখেছিল তা সর্বজনবিদিত। এর প্রতিবাদে নজরুল ছাড়া আর কেউ সোচ্চার হননি। বুদ্ধদেব বসু ও অজিত কুমার দত্ত সম্পাদিত সমকালীন ‘প্রগতি’ পত্রিকায় আমরা এই প্রথম মন্তব্য দেখি-
“ব্যঙ্গ ও কটূক্তি করবার জন্যই তাঁরা উন্মুখ, তাই অনিন্দনীয় যে কিছু থাকতে পারে, এ কথা তাঁরা আমলেই আনতে চাইতেন না। নইলে নজরুল ইসলামের গজল গানগুলোর প্যারডি করতে নিশ্চয়ই তাঁদের হাত কাঁপতো।”
ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যেভাবে নজরুলকে বরণ করে নিয়েছিল, তা আমি ‘ঢাকার সাময়িকপত্রে নজরুল প্রসঙ্গ’ শিরোনামে স্বতন্ত্র এক প্রবন্ধে তুলে ধরেছি।
আমরা লক্ষ করেছি, বাংলা সাহিত্যে একমাত্র নজরুলেরই প্রায় ১০টি গ্রন্থ (‘অগ্নিবীণা’, ‘যুগবাণী’,‘ বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, ‘চিত্তনামা’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’, ‘রুদ্রমঙ্গল’, ‘ফণি-মনসা’, ‘প্রলয়-শিখা’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’) তদানীন্তন ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল অথবা তার উদ্যোগ নিয়েছিল। এ কথা আমরা বিভিন্ন গ্রন্থে বা প্রবন্ধে ফলাও করে প্রকাশ করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তখন কোনো প্রকাশক নজরুলের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। প্রকাশক বা মুদ্রাকর হতে কেউ চায়নি, হয়তো ভয়ে বা অর্থলগ্নিতে লোকসানের আশঙ্কায়। এই দুঃখজনক চিত্র নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নূর লাইব্রেরির মঈনউদ্দীন হোসায়ন নজরুলের ‘প্রলয়-শিখা’ কাব্যের বাজেয়াপ্তি প্রত্যাহারে পর দ্বিতীয় সংস্করণের (আগস্ট, ১৯৪৯) ভূমিকায় প্রকাশ করেছেন-
“গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি দেখিয়া প্রকাশকগণ বুঝিলেন যে, এই গ্রন্থের লেখক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক কেহই বিদেশী সরকারের আক্রোশ হইতে অব্যাহতি পাইবেন না। বস্তুত কোনো প্রকাশক গ্রন্থ ছাপাইয়া সরকারি রোষের কবলে পড়িতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু বিদ্রোহী কবি নজরুল তাহাতেও দমিলেন না। তিনি নিজের নামে ও নিজের দায়িত্বে ‘প্রলয়-শিখা’ প্রকাশ করিলেন- অর্থাৎ নিজেই প্রকাশক ও মুদ্রাকর হইলেন। কবির এই ত্রিমূর্তিরূপ বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব ব্যাপার।”
লক্ষণীয় বিষয়, বাজেয়াপ্তি প্রত্যাহারের পরও বইগুলো পুনর্মুদ্রণে কেউ আগ্রহী হননি। একমাত্র মঈনউদ্দীন হোসায়ন ‘অগ্নি-বীণা’, ‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘প্রলয়-শিখা’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’র পুনর্মুদ্রণে বা দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে এগিয়ে আসেন। এ সব তথ্য আমার ‘প্রকাশকের ভূমিকায় নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করেছি।
১৯৫২ সালে আমার নজরুল-চর্চার সূত্রপাত থেকে আজ পর্যন্ত নজরুল সম্পর্কে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করে চলেছি। বিভিন্ন সেমিনারে বা আলোচনা সভায়ও নজরুল সম্পর্কে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। আমি আমার বিভিন্ন প্রবন্ধের বাইরে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছি- ‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’ (প্রথম সংস্করণ জুলাই, ২০০২, পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৪) এবং ‘নজরুল-সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ (ডিসেম্বর, ২০০৭)। আমি আমার বিভিন্ন রচনায় নজরুলকে নানা ভাবে দেখার চেষ্টা করেছি, নতুন তথ্য উদ্ঘাটনে প্রয়াস পেয়েছি। এমন কি অনালোচিত কিছু বিষয় নিয়েও লিখেছি, যেমন ‘নজরুল ইসলামের আলোকচিত্র’, ‘নজরুল গ্রন্থের প্রচ্ছদ’ এবং ‘ডাকটিকেটে নজরুল’।
নজরুল ইসলামের ‘নির্ঝর’ গ্রন্থটিকে আমি ‘ভাগ্য-বিড়ম্বিত গ্রন্থ’ আখ্যা দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখি (প্রথম আলো, ২৪ মে, ২০১৩)। ১৩৪৫ সালে নজরুলের ‘নির্ঝর’ প্রকাশিত হয়। নাম-পৃষ্ঠাসহ সম্পূর্ণ মুদ্রিত ‘নির্ঝর’ গ্রন্থ পরবর্তীকালে বাজারে বের হয়নি। লক্ষ করা যায়, বিক্রয়ের জন্য ‘নির্ঝর’ বাজারে প্রচারিত না হলেও গ্রন্থটি অপ্রকাশিত থাকেনি। গ্রন্থ-প্রকাশ ও গ্রন্থ-বিপননের জন্য ‘সরকারী গ্রন্থ-রেজিস্ট্রেশন’ প্রক্রিয়ায় ‘নির্ঝর’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ রেজিস্ট্রেশনের তালিকায় ১৯৩৯ সালের ২৩শে জানুয়ারী গ্রন্থটির প্রকাশকাল চিহ্নিত হয়। (দ্রষ্টব্য- বেঙ্গল লাইব্রেরী ক্যাটালগ, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ম ত্রৈমাসিক খণ্ড, ক্রমিক সংখ্যা ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১০৯)। সুতরাং এ-বিষয়ে আমরা নিশ্চিত যে, ‘নির্ঝর’-এর প্রকাশকাল ১৯৩৯, ২৩ জানুয়ারী।
নজরুলের পাঁচ খানি বাজেয়াপ্তকৃত গ্রন্থের অন্যতম ‘প্রলয় শিখা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩০ আগস্টে। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা রাজরোষে পতিত হয় এবং ১৯৩১ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর বাজেয়াপ্ত হয়। ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩১) কাব্যে মোট ২০টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতে ৪টি উল্লেখযোগ্য কবিতা রয়েছে, যথা- নমস্কার, হবে জয়, পূজা-অভিনয় ও চাষার গান। আরও লক্ষণীয়, নজরুলের নির্ঝর কাব্য (১৯৩৯) গ্রন্থেও এই ৪টি কবিতা রয়েছে। এই ৪টি কবিতার অন্তর্ভুক্তি সম্ভবত লেখকের অজ্ঞাত-সারেই ঘটেছে। কারণ, এর পরিণতি সম্পর্কে নজরুলের অবশ্যই অবহিত থাকার কথা। নজরুলকে সম্ভবত কেউ সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাই ‘নির্ঝর’ সম্পূর্ণ মুদ্রিত হওয়া সত্ত্বেও কাব্যটি বাজারে অপ্রকাশিত থাকে। ১৯৪৫ সালে ‘প্রলয় শিখা’ গ্রন্থের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ‘প্রলয় শিখা’ পুনর্মুদ্রিত হয়। নজরুলের গ্রন্থস্বত্ত্বের উত্তারাধিকারী খিলখিল কাজীর অনুমতিক্রমে নজরুল ইন্সটিটিউট ‘নির্ঝর’ কাব্যের ৩টি সংস্করণ ইতিমধ্যে প্রকাশ করেন (যথাক্রমে, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, জুলাই ২০০১, জানুয়ারি ২০০৮)।
কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড স্থাপিত হলে আবদুল কাদির সম্পাদিত ৫ খণ্ডে সমাপ্ত নজরুল রচনাবলী প্রকাশিত হয়। পিতৃবন্ধু আবদুল কাদিরের সঙ্গে আমারও পরিচয় হয়। তিনি সর্বদাই আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। এই রচনাবলী সম্পাদনাকালে আমি তাঁকে নজরুলের কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ দেখতে দিয়েছিলাম। কোনো কোনো খণ্ডের ভূমিকায় তার উল্লেখ রয়েছে। ‘নজরুল সুহৃদ ও নজরুল গবেষক আবদুল কাদির’ নামেও আমি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করি। নজরুল সুহৃদ মোঃ নাসিরউদ্দীন সম্পর্কেও ‘একালের মাগন ঠাকুর’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করি। নজরুলকে তাঁর প্রথম জীবনে কিভাবে তিনি সাহিত্য-চর্চায় উৎসাহিত করেছিলেন তা এই প্রবন্ধে বিবৃত হয়েছে।
পরবর্তীকালে (১৯৯৩) বাংলা একাডেমী আবদুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলীরই সংহত পূর্ণাঙ্গ, কালানুক্রমিক ও পরিমার্জিত রূপে নজরুল রচনাবলী প্রকাশ করে। এই সংস্করণের সম্পাদনা-পরিষদে আমি অন্যতম সদস্য ছিলাম।
নজরুল সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য আমাকে ‘নজরুল পুরস্কার’ প্রদান করেছে নজরুল ইন্সটিটিউট (২০০৭), নজরুল একাডেমী (২০০৯) এবং ত্রিশালের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়(২০১০)।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, আমি দীর্ঘকাল (১৯৯৮ থেকে অদ্যাবধি) ধরে নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরূপে নজরুল-চর্চার দিগন্তকে সম্প্রসারিত করতে সচেষ্ট হয়েছি। নজরুল ইন্সটিটিউট গ্রন্থাগারকে একটি জাতীয় আর্কাইভ্সে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আমি আমাদের সংগৃহীত নজরুলের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদি ও নজরুল-বিষয়ে রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা উপহারস্বরূপ প্রদান করেছি। সংখ্যা প্রায় ৭০ টি (নজরুল ১০ টি প্রথম সংস্করণসহ)। এছাড়াও জাতীয় আর্কাইভ্সে প্রদান করেছি নজরুল-বিষয়ক ১৩ টি গ্রন্থ (নজরুলের ৪ টি গ্রন্থের প্রথম সংস্করণসহ)। এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত হয়েছে নজরুল বিষয়ক ১১৬ টি গ্রন্থ। আশা করি, এ-ব্যাপারে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসবেন।http://suprobhat.com/আমার-নজরুল-চর্চা/#
No comments:
Post a Comment