Saturday 13 May 2017

বৃটিশ ভারতে প্রথম আযাদী সংগ্রাম ১৮৫৭


বৃটিশ ভারতে প্রথম আযাদী সংগ্রাম ১৮৫৭

 লেখক :  আব্বাস আলী খান।  বই: বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ।  
আঠারো শ’ সাতান্ন খৃষ্টাব্দে সারা ভারতব্যাপী এক প্রচন্ড ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়। শাসকগোষ্ঠী তার নাম দিয়েছে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’। ১৮৫৭ সনে সিপাহী, জততা, মুজাহেদীন মিলে যে সংগ্রাম শুরু করেছিল তাতে এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূল আলোড়িত হ’য়েছিল। শাসকদের দৃষ্টিতে একে ‘বিদ্রোহ’ বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ছিল বৈদেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সত্যিকার আযাদীর সংগ্রাম।

ভারতবর্ষে বিগত দুই শতকের মধ্যে তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা বিশেষ স্মরণীয়। এ তিনটি ঘটনা সংঘটিত হয় ১৭৫৭, ১৮৫৭ এবং ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে। ১৭৫৭ সনে সংঘটিত হয় পলাশীর যুদ্ধ। ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকাতর মাধ্যমে যুদ্ধ না করেও সুচতুর ক্লাইভ জয়লাভ করে এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের অবসান ঘটায়। পলাশীল অভিযান ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফল। অবশ্য এর জন্যে মীর জাফর আলীকে দাঁড় করানো হ’য়েছিল শিখন্ডীরূপে। ১৮৫৭ সনে সংঘটিত হয় পলাশীল যুদ্ধ। ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকার মাধ্যমে যুদ্ধ না করেও সুচতুর ক্লাইভ জয়লাভ করে এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের অবসান ঘটায়। পলাশীর অভিযান ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফল। অবশ্য এর জন্যে মীর জাফর আলীকে দাঁড় করানো হ’য়েছিল শিখন্ডীরূপে। ১৮৫৭ সনের সংগ্রাম চিল সিপাহী জনতার সংগ্রাম –ভারতভূমিকে স্বেচ্ছাচারী ব্রিটিশ শাসকদের গোলামীর শৃংখল থেকে মুক্ত করার। তার নব্বই বছর পরে ১৯৪৭ সনে ভারথীয় মুসলমানদের সংগ্রাম ছিল ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু শাসনের অধীন না হ’য়ে নিজস্ব স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার। মুসলমান বিজয় লাভ করেছিল শেষোক্ত সংগ্রামে।

আঠারো শ’ সাতান্ন সালের আযাদী সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস বিকৃত করা এখানে উদ্দেশ্য নয়। সংক্ষেপে তার পটভূমি, সংগ্রামের বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলী এবং পরাজয়ের মূল কারণসমূহ উল্লেখ করাই এ নিবন্ধের লক্ষ্য।

পটভূমিকা

এ সংগ্রামের পটভূমিকা ও কারণ নির্ণয় করতে হেল আমাদের আরও একশ বছর পেছনের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি ফেরাতে হবে। পলাশীর যুদ্ধের পর মুসলমানের শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতাই হাতছাড়া হয়নি। বরঞ্চ তার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় সত্তা, আর্থিক অবস্থা, শিক্ষাদীক্ষা ও তাহজিব তামাদ্দুনও বিপন্ন হ’য়ে পড়ে। মুসলিম শাসন আমলে ইংরেজ বণিকরা ভারতে এসেছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের নাম করে। ব্যবসায় সুযোগ সুবিধা লাভেল জন্যে তারা মুসলমান বাদশাহের দুয়ারে ধর্ণা দিতো এবং তাঁদের করুণা লাভের আশায় দিন গুণতো। মুসলমান বাদশাহগণ উদার মনোভাব সহারে তাদেরকে এ দেশে ব্যবসায় পূর্ণ সুযোগ সুবিধা দান করেন। কিন্তু তারা এ সুযোগের বার বার অপব্যবহার করতে থাকে। যার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে কথনো কখনো কঠোর ব্যবস্থাও অবলম্বন করতে হয়। এত করে মুসলমান বাদশাহগণ ও মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধেই তাদের মানে এক প্রতিহিংসার বহ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়। তারা এ দেশে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজদন্ড হস্তগত করার পরিকল্পনা করে। তাদের এ পরিকল্পনার ইন্ধন যোগায় বাংলার মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ।

অদৃষ্টের পরিহাস এই যে সেই ইংরেজ বণিকরাই যখন বাংলা ও দিল্লির মসনদ অধিকার করে বসে, তখন তারা ভারতের পূর্বতন মালিকদেরকে, যাদের কৃপায় তারা এ দেশে ব্যবসায় জাল বিস্তার করতে পেরেছিল, তাদেরকে ঘৃণা ও সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলো। মুসলমনাদেরকে তাদের রাজ্য বিস্তারে প্রতিবন্ধক মনে করে তাদের প্রতি অবলম্বন করলো চরম দমননীতি। পক্ষান্তরে তাদের করুণা ও আশীর্বাদ শত ধারায় বর্ষিত হতে লাগলো হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর।

অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গোটা মুসলমান সমাজকে নিষ্পেষিত ও নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেছিল ইংরেজ শাসকগণ। মুসলমান আমলে সকল প্রকার সরকারী চাকুরীতে সিংহভাগ ছিল মুসলমানদের। ইংরেজ এদেশের মালিক মোখতার হওয়ার পর ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সকল বিভাগের চাকুরী থেকে বিতাড়িত হতে লাগলো। শেষে সরকারের বিঘোষিত নীতিই এই হ’য়ে দাঁড়ালো যে, কোনও বিভাগে চাকুরী খালি হ’লেই বিজ্ঞাপনে এ কথার বিশেষভাবে উল্রেখ থাকতো যে মুসলমান ব্যতীত অন্য কেউ প্রার্থী হ’তে পারে। দ্বিতীয়তঃ ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত আইন পাশ করে মুসলমান বাদশাহগণ কর্তৃক প্রদত্ত সকলপ্রকার জায়গীর, আয়মা, লাখেরাজ, আলতমগা, মদদে মায়াশ প্রভৃতি ভূসম্পদ মুসলশানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পথের ভিখারীতে পরিণত করে। একমাত্র বাংলাদেশেই অন্যূন পঞ্চাশ হাজার ও ইনাম কমিশন দ্বারা দাক্ষিণাত্যের বিশ হাজার লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের বহু লক্ষ টাকা আয়ের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি সরকার অন্যায়ভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রকৃত হকদারকে বঞ্চিত করে। সরকারের এসব দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেল ফলে বহু প্রাচীন মুসলিম পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষঅ ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তৃতীয়তঃ বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যান্ত আইন দ্বারা মুসলমানদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেল। বাংলার কৃষকদের মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ছিল মুসলমান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণী হলো হিন্দু এবং জমির একচ্ছত্র মালিক। কৃষককুল হলো তাদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল। তাদের শুধু জমি চাষের অনুমতি রইলো, জমির উপর কোন অধিকার বা স্বত্ব রইলো না। হিন্দু জমিদারগণ প্রজাদের নানাভাবে রক্ত শোষণ করতে লাগলো। জমির উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধি, আবহাওয়া, সেলামী, নজরানা, বিভিন্ন প্রকারের কর প্রভৃতির দ্বারা কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো। যেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর প্রমুখ মনীষীগণ। এসব আলোচনা যথাস্থানে করা হয়েছে।

চতুর্থতঃ ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার অংগন থেকেও মুসলমানদেরকে বহু দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ব্যবসা ও শিল্পবাণিজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।

আবদুল মওদূদ বলেণ, “দেশীয় কারিগর শ্রেণীকে নির্মমভাবে পেষণ করে দেশীয় শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়া হয়। তার দরুন শ্রমজীবীদের জীবিকার পথ একমাত্র ভূমি কর্ষণ ব্যতীত আর কিছু ই খোলা রইলোনা। আর ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বণিক-রাজের কুঠিরগুলিতে আশ্রয়ে নতুন দালাল শ্রেণীর ব্যবসায়ীও জন্মলাভ করলো বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, মুন্সী, দেওয়ান উপাধিতে। বহির্বাণিজ্যে ও অন্তর্বাণিজ্যে সবদিক দখল করে যে দালাল শ্রেণীর জন্মদান করলো, তারাও হয়ে উঠলো স্বার্থ ভোগের লোভে দেশীয় শিল্প ও কারিগরির প্রতি বিরূপ। এই নতুন আর্থিক বিন্যাসের ফলে যে নতুন ভূস্বামী ও দালাল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো, তাদের একজনও মুসলমান নয় –মুসলমানদের সে সমাজে প্রবেশাধিকারও ছিলনা এবং এই সম্প্রদায়ই ছিল বিস্তৃত গণবিক্ষোভ বা জাতীয় জাগরণের প্রধান শত্রু। এ কথা লর্ড বেন্টিংকও স্বীকার করে গেছেন-

“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে সত্য, তবে এর দ্বারা জনগণের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশালী বড়ো একদল ধনী ভূস্বামী সম্পদায়ের সৃষ্টি হয়। তার একটি বড়ো সুবিধা এই যে, যদি ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লবের ফলে শাসনকার্যেরনির্বিঘ্নতা ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এই সম্প্রদায়ই নিজেদের স্বার্থে সর্বদাই ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখার জন্যে প্রস্তুত থাকবে”।

-[সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ (শতাব্দী পরিক্রমা), পৃঃ ৬২]।

এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ বলেন-

“এ মতবাদের সমর্থক এ দেশীয় লোকেরও অভাব নেই। এই সেদিনও বিশ্বভারতীতে বাংলার জনগণ সম্বদ্ধে বক্তৃতাকালে কাজী আবদুল ওদুদ সাহেব বলেছেনঃ সেদিনে বাংলাদেশে অন্ততঃ বাংলার প্রাণকেন্দ্রে কোলকাতায় সিপাহী বিদ্রোহের কোন প্রভাব অনুভূত হয়তি। হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখার্জি এই বিদ্রোহ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, সিপাহী বিদ্রোহ কেবলমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিপাহীদের কর্মমাত্র, দেশের প্রজাবর্গের সহিত তাহার কোনও সম্পর্ক নাই। প্রজাকুল ইংরেজ গভর্ণমেন্টের প্রতি অনুরক্ত ও কৃতজ্ঞ এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে”।

কাজী সাহেব আরও বলেন হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদকের মত যে মোটের উপর সেদিনের বাংলাদেশের মত ছিল, তার একটি ভালো প্রমাণ –বিদ্যাসাগর ও দেবেন্দ্রনাথের মতো স্বাধীনচেতা বাঙালীরাও সেদিন সিপাহী বিদ্রোহ সম্বন্ধে কোন রকম কৌতুহল দেখাননি। …সিপাহী বিদ্রোহ সেদিন শিক্ষিত বাঙালীকে সাড়া দেয়নি, অশিক্ষিত, হিন্দু বাঙালীকে নাড়া দেয়নি”। (সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ৫৮)।

কাজী সাহেবের মন্তব্যও ঠিক এবং হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদকের মন্তব্যও ঠিক। কাজী সাহেবের ‘বাঙালী’ এবং হরিশ মুখার্জির ‘প্রজাকুল’ বলতে হিন্দু সম্প্রদায়কেই বুঝানো হয়েছে। অবশ্য একথা সত্য যে কতিপয় ব্যতিক্রম ব্যতীত বাংলা ও ভাতের গোটা হিন্দু সম্প্রদায় সিপাহী বিদ্রোহ তথা ভারতের আযাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। বাংলার বাইরে যেসব হিন্দু এ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন, ইংরেজ সরকার তাঁদের স্বার্থে চরম আঘাত হেনেছিল। বিশেষ করেন বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে যাবে কোন দুঃখে? ব্রিটিশ সরকারই তাদেরকে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল, দেশের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধার দ্বার তাদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের স্থানে তাদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। তারাই চিল ইংরেজ প্রভুদের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু ও শুভাকাংখী। পক্ষান্তরে মুসলমানরা চিল সন্দেহভাজন ও শত্রু। সুতরাং বিদ্যাসাগর দেবেন্দ্রনাথ তথা হিন্দু প্রজাকুল ইংরেজ গভর্ণমেন্টের প্রতি অনুরক্ত ও কৃতজ্ঞ থাকবে এবং তাদের রাজভক্তি অবিচল থাকবে এটাই ত অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ কারণেই সংগ্রামে পরাজয় বরণ করার পর একমাত্র ভারতের মুসলমানরাই ব্রিটিশের রোষবহ্নিতে প্রজ্জ্বলিত হয়, তাদেরকে পাইকারীভাবে হত্যা করা হয়, সকল প্রকার স্থাবর অস্থাবর সম্পদ থেকে উৎখাত করা হয়, জেল, ফাঁসী, যাবজ্জীবন কারাদন্ড তাদেরকে ভোগ করতে হয়।

স্যার সাইয়েদ আহমদ খান তাঁর ‘রিসালা আসবাবে বাগওয়াতে হিন্দ’ নামক পুস্তিকায় ‘সিপাহী বিপ্লবের’ কিছু কারণ নির্ণয় করেছেন। সাইয়েদ সাহেব ছিলেন একজন ব্রিটিশ অনুগত সরকারী কর্মচারী। তিনি যে সময়ে বিজনৌরে চাকুরীরত ছিলেন, তখন বিপ্লব শুরু হয়। বিপ্লবীগণ জেলখানার দ্বার ভেঙে খাদ্যদ্রব্য লুণ্ঠন করে। এ সময়ে স্যার সাইয়েদ বহু বিপন্ন ইংরেজের প্রাণ রক্ষা করেন।

স্যার সাইয়েদ  আহমদ তাঁর পুস্তিকায় বিপ্লবের কারণ বর্ণনার পূর্বে একথা বলেন যে, জেহাদের উদ্দেশ্যে বিপ্লবীগণ সংগ্রামে যোগদান করেনি, তাঁর মতে যারা জেহাদের ধ্বনি তুলেছিল তারা কোন ধার্মিক অথবা শাস্ত্রবিদ ছিল না। তারা ছিল নীতিভ্রষ্ট ও মদোন্মত্ত ইতর শ্রেণীর লোক (Depraved and filthy bacchanals)। সাইয়েধ আহদমের সাথে অতীত ও বর্তমানের কোন মুসলমানই একমত ছিল না এবং নয়। অবশ্য তাঁর চোখের সামনে যেসব লুঠতরাজ ও হত্যাকান্ড হয়েছিল, তা দেখেই তিনি এরূপ মন্তব্য করেন থাকবেন। তবে যারা কয়েক দশক পূর্ব থেকে মুসলমানদের মধ্যে জেহাদের প্রেরণা সঞ্চারিত করে রেখেছিলেন, সাতান্নোর বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ ছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ বিপ্লব কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত হয়নি। আপামর জনসাধারণ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুদ্র আক্রোশে ফেটে পড়েছিল কোন বালাই ছিল না তাদের দ্বারাই লুঠ-তরাজ ও পৈশাচিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার জেহাদী মনোভাব ও প্রেরণা নিযে যাঁরা কয়েক দশক যাবত সংগ্রাম চালিয়েছেন তাঁদের পক্ষ থেকে এমন আচরণের কোনই দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি।

যাহোক আসল কথায় ফিরে আসা যাক। সাইয়েদ আহমদ সিপাহী বিপ্লবের যে সব কারণ বর্ণনা করেন, তা নিম্নরূপ-

১। কোম্পানী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রচন্ড বিক্ষোভের কারণ হলো খৃষ্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরিতকরণ তৎপরতা। সকলের এটাই ছিল সাধারণ বিশ্বাস যে ইংরেজ সরকার ক্রমশঃ এবং নিশ্চিতরূপে এ দেশবাসীকে খৃষ্টানধর্মে দীক্ষিত করে ছাড়বে। গোপনে গোপটনে তাদের এ পরিকল্পনা এগিয়ে চলছিল এবং জনগণের দারিদ্র ও অজ্ঞতার দরুন তাদেরকে একসময় খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগটি ফলাও করে প্রচার করা হয়, যখন ১৮৩৭ সালের দুর্ভিক্ষে বিরাট সংখ্যক এতিম শিশুকে খৃষ্টান রূপে প্রতিপালনের জন্যে মিশনারীদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। ১৮৫৬ সালে কোলকাতায় অবস্থিত বড়োলাটের ভবন থেকে এডমন্ড নামক জনৈক কর্মচারী কোম্পানীর সকল স্তরের কর্মচারীদের নিকটে এই মর্মে এক পত্র প্রেরণ করে খৃষ্টান ধর্মের সত্যতার উপরে চিন্তাভাবনা করার জন্যে চাপ সৃষ্টি করে। উপরন্তু তাদের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা হয় আধুনিক যানবাহনের সাহায্যে খৃষ্টধর্মের আধ্যাত্মিক বন্ধনের ভিত্তিতে ভারতীয় ঐক্যের চূড়ান্ত রূপ দেয়ার জন্যে। স্বধর্মত্যাগীরেদ জন্যে এ এক সাধারণ আহবাদ বলে এর ব্যাখ্যা করা হয় এবং এ সন্দেহ প্রমাণিত হয় যখন দেখা গেল যে সরকারের পক্ষ থেকে মিশনারীদের নিয়োগপত্র এবং সরকারী তহবিল থেকে তাদের বেতন দেয়া হতে থাকে। উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ দরাজহন্তে মিশনারী তহবিল থেকে তাদের বেতন দেয়া হতে থাকে। উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ দরাজহস্তে মিশনারী তহবিলে অর্থ সাহায্য করতে থাকে এবং অধঃস্ত ভারতীয় কর্মচারীদের সাথে ধর্মীয় বিতর্কে অবতীর্ণ হয়। তারা নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদেরকে তাদের বাড়ী গিয়ে খৃষ্টাধর্মের প্রচার-প্রচারণা শ্রবণ করতে বাধ্য করে। মিশনারীগণ অত্য ধর্মের প্রতি অশালীন উক্তি সম্বলিত প্রচার পুস্তিকা জনসাধারণের মধ্যে প্রকাশ্যে ছড়াতে থাকে। ১৮৫৪ সালের সরকারী নীতি অনুসারে সকল মিশনারী স্কুল সরকারী সাহায্য লাভ করবে বলে যত্রযত্র ব্যাঙেল ছাতার মতো মিশনারী স্কুল গজাতে থাকে। সরকারী কর্মচারীগণ প্রায়ই এসব স্কুল পরিদর্শনে যেতো এবং এই বলে বাইবেল পড়তে ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করতো যে খৃষ্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে। গ্রাম্য স্কুলগুলিতে শুধুমাত্র উর্দু পড়ানো হতো এবং আরবী ফার্সী পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।

২। একই রান্নায় সকল সম্প্রদায়ের কয়েদীদেরকে খানা খাওয়ানো হতো। এ ছিল তাদের চিরাটরিত বর্ণ প্রথার পরিপন্থী। ১৯৫০ সালে একটি আইনের মাধ্যমে এ কথা ঘোষণা করা হয় যে স্বধর্ম ত্যাগকারীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে আইনতঃ দন্ডনীয়। এতে করে কারো একথা আর বুঝতে বাকি রইলো না যে এ আইনের দ্বারা খৃষ্টধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে। ১৮৫৬ সালের একটি আইন দ্বারা বিধবা বিবাহকে উৎসাহিত করা হয়। এর দ্বারা হিন্দুধর্মে আঘাত করা হয়।

৩। সুদী মহাজদ শ্রেণীর অর্থ শোষণের অদম্য লালসা এবং প্রজাদের উপর অতিরিক্ত বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় এবং তারা ব্রিটিশ আনুগত্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। বিচার প্রার্থনার জন্যে স্ট্যাম্পপ্রথার প্রচলন সুবিচার বিক্রয় করা অথবা সুবিচার অস্বীকার করা বলে বিবেচিত হয়। কোন কোন প্রদেশে বিচারকদেরকে স্বেচ্ছাচারমূলক ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

৪। কোম্পানী শাসনের অধীন লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ দ্বারা অসংখ্য পরিবার ধ্বংস করা হয়। দেশীয় শিল্পবাণিজ্য ধ্বংস করা হয় এবং দেশের অর্থনীতিতকে দেউলিয়া করা হয়।

৫। সর্বশেষ কারণ হিসাবে স্যার সাইয়েদ বলেন যে, মুসলমানদেরকে উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরী থেকে অপসারিত করা হয়েছিল। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দ্বারা সরকারী পদগুলিতে যোগ্য লোক নিয়োগই আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি এমনসব লোক দ্বারা পূরণ করা হতো –যারা ছিল ‘নীচ বংশজা’ (Low form), ইতর-অমার্জিত (Vulgar) ও অশিষ্ট (ill-bed)। এরা জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে না।

-(Muslim Separatism in India, Abdul Hamid, pp 2-4 and 6)।

সাইয়েদ আহমদ তাঁর পুস্তিকায় উপহংহারে এ বিপ্লব বিদ্রোহের সমাধান পেশ করেছেন। তিনি বলেনঃ

“The solution to these difficulties lay in bringing the ruler and the ruled closer together by the admission of Indian members of the Legislature to ensure that the laws passed by this body satisfied the needs of the country and were not nerely academic. I do not wise to enter into the question as to how the ignorant and uneducated people of Hindustan could be allowed to share in the delibratins of the Legislative Council,of as to how they should be selected to form an assembly like the British Parliament. These are knotty points” Ibid-p.4)।

-“ভারতীয় সদস্যদেরকে আইন সভায় গ্রহণ করে শাসক এবং শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করতে পারলেই এসব বিরোধের মীমাংসা হতে পারে। আইনগুলি যাতে অবাস্তব ও অকার্যকর না হয় সেজন্যে এ নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে যে, আইন সভায় সেবস আইন পাশ হবে তা যেন দেশের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। আমি অবশ্য এ বির্কে অবতীর্ণ হতে চাই না যে ভারতের অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ লোকদেরকে কিভাবে আইন সভায় আলোচনার সুযোগ দেয়া হবে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ন্যায় একটি আইন সভায় কিভাবে তাদেরকে বেছে নেয়া হবে”।

শাসক এবং শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক যে মোটেই ভালো ছিল না, বরঞ্চ শাসক শ্রেণী ভাতবাসীকে ঘৃণার চোখে দেখতো তার একটি দৃষ্টান্ত আলতাফ হোসেন হালী তাঁর ‘হায়াতে জাবিদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ১৮৬৭ সালে আগ্রায় একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এবং তারপর গভর্নরের ‘দরবার’ অনুষ্ঠান পালিত হয়। আগরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ দেন যে, দরবারে ইউরোপীয়গণ ও ভারতীয়গণ পৃথকভাবে তাদের আসন গ্রহণ করবে। একজন সম্ভ্রান্ত ভারতীয় অতিথি আসন খালি দেখে জনৈক ব্রিটিশ কর্মচারীর জন্যে চিহ্নিত আসনে উপবেশন করেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে উক্ত আসন ছেড়ে দিয়ে আপন লোকদের মধ্যে স্থান করে নিতে আদেশ করা হয়। স্যার সাইয়েদ এতে অত্যন্ত অপমান বোধ করলেন এবং এ ধরনের বর্ণবিদ্বেষের নির্লজ্জ অভিব্যক্তিতে তিনি অন্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। এ নিয়ে একজন ব্রিটিশ কর্মচারীর সাথে বেশ কথা কাটাকাটিও হলো। জনৈক থর্নহিল এতে যেন জ্বলে পুড়ে গেল এবং ক্রোধে গর গর কের বলতে লাগলো –“You did your worst in the meeting. ‘Hio do you expect to be seated on terms of equality with us and our women folk” (সিপাহী বিদ্রোহে তোমরা জঘন্যতম আচরণ করেছ। এর পর কি করে আশা করতে পার যে তোমরা আমাদের এবং আমাদের মেয়ে লোকরেদ সাথে সমতার ভিত্তিতে বসবে?) সাইয়েদ আহমদ রাগে অপমানে সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যান। তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এর জন্যে খুব অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তার জন্যে তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়।

-(Muslim Separatism in India, A Hamid. P,6)।

এসব বিবরণ থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আঠারো শ’সাতান্ন সালে সারা ভারত যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুদ্ররোষে ফেটে পড়েছিল, তার কারণ ছিল বহু ও নানাবিধ।শতাব্দীর পুঞ্জিভূত আক্রোশে অগ্নেয়গিরি ন্যায় বিস্ফোরিত হয়েছিল সাতান্নো সনে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ, শাহ মুজাহিদগণ যে জেহাদী প্রেরণার সঞ্চার করে রেখেছিলেন তা যেন বারুদের স্তূপে দিয়াশলাইয়ের কাজ করলো। চারদিকে দাউ দাউ করে বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠলো। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হ’য়ে যে যেখানে পেরেছে সংগ্রামে যোগদান করেছে। সিপাহীদের অধিকাংশই সত্যিকার ইসলামী চরিত্র না থাকার কথা তাদের সাথে যোগ দিয়েছে সাধারণ মানুষ –কৃষক, মজুর, সরকারী বেসরকারী বহু কর্মচারী। কোন আদর্শবান কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে এ সংগ্রাম পরিচালিত হয়নি। উপরন্তু অনেক সুযোগ সন্ধানীও এসে ভিড়েছে এ আন্দোরনে। সে কারণে কোথাও কোথাও ইসলামী নীতি লংঘিত হেছ, হয়েছে লুঠ-তরাজ ও অপ্রয়োজনীয় হত্যাকান্ড। নবী মুস্তাফার (সা) জীবদ্দশায় বহু যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, খোলাফায়ে রাশেদীনের স্বর্ণময় যুগে দেশের পর দেম বিজিত হয়েছে, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, নূরুদ্দীন যঙ্গী যুদ্ধের পর যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু সবের কোথাও ইসলামী নীতি লংঘিত হয়নি, মানবীয় অধিকারের প্রতি হস্তক্ষেপ করা হয়নি, অন্যায় ও অবাঞ্চিত রক্তপান করা হয়নি। সাইয়েদ আহমদ শহীদও তাঁর দীক্ষাপ্রাপ্ত অনুসারীদের দ্বারা কোন নীতিবিরোধী আচরণ পরিলক্ষিত হয়নি।

ইংরেজ সরকারের কতিপয় দমনমূলক কার্যকলাপ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে। ১৮৪৩ সালে আমীরদের হাত থেকে সিন্ধুদেশ ইংরেজ সরকার গ্রাস করে। উনপঞ্চাশ সালে লর্ড ডালহৌসি গোটা পাঞ্জাব প্রদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে ফেলেন। ইতিপূর্বে কোম্পানী সরকার এক আইন প্রণয়ন করে অপুত্রক রাজার গৃহীত দত্তক পুত্রের উত্তরাধিকার বাতলি করে দেয়। এই স্বত্বলোপ (Doctrine Lapse) নীতি অনুযায়ী লর্ড ডালহৌসি সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর প্রভৃতি রাজ্য হস্তগত করেন। উপরন্তু আঞ্জোর, কর্ণাট প্রবৃতি রাজ্যের রাজাগণের দত্তক পুত্রদের বৃত্তি বন্ধ করে দেন। ১৮১৮ সালে যুদ্ধের পর রাজ্যহারা পেশওয়া দ্বিতীয় বাজীরাও বার্ষিক আট লক্ষ টাকা বৃত্তি নিয়ে কানপুরের নিকটস্থ বিঠুরে বাস করছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্রের বৃত্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৮৫০ সালে ডালহৌসি নবদীক্ষিত খৃষ্টানদেরকে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দিয়ে আইন প্রণয়ন করলে তার প্রতিবাদে একমাত্র কোলকাতা শহরের সাট হাজার নাগরিকের স্বাক্ষরিত এক স্মারকলিপি বড়োলাটের নিকট পেশ করে কোন ফল হয়নি। তার ফলে জনসাধারণের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে ইংরেজ সরকার এ দেশবাসীকে খৃষ্টানধর্মে দীক্ষিত করতে ইচ্ছুক। ১৮৫৬ সালে ডালহৌসি মুসলমানদের শেষ স্বাধীন রাজ্য অযোধ্যা অন্যায়ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে ফেলেন, হতভাগ্য অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় ধনসম্পদ, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর দুই লক্ষ টাকা মূল্যে হস্তলিখিত গ্রন্থাদি প্রকাশ্য নীলামে বিক্রী করে কোম্পানীর কোষাগার পূর্ণ করা হয়। এর চেয়েও অধিকতর পৈমাচিক ব্যবহার ও বর্বরতা করা হয় অন্তঃপূরবাসিনী বেগমের সাথে। তাঁদেরকে বলপূর্বক অন্তঃপূর থেকে বাইরে এতে তাঁদের মূল্যবান দ্রব্যাদি বিনষ্ট ও লুণ্ঠন করা হয়। বার্ষিক বার লক্ষ টাকার বৃত্তির বিনিময়ে নিরীহ নবাবকে কোলকাতা এনে অবরুদ্ধ করা হয়। এই পৈশাচিক কার্য সম্পাদন করতে স্যার চার্লস আউটরাম স্বয়ং অযোধ্যায় যান। তিনি স্বীকার করেছেনযে এ নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত কাজ দেখে তাঁর নিজের রক্ষী বাহিনীর সিপাহীদের মনে গভীর ক্ষোভ ও দুঃখের সঞ্চার হয়েছিল। এসব নিষ্ঠুরতা, মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের অদম্য লালসায় নিপীড়ন নিষ্পেষণ মর্মন্তুদ হাহাকার ও আর্তনাদের রূপ ধারণ করে ভারতের আকাশ বাতাস মথিত করে এবং সাতান্ন সালে বিরাট বিপ্লব রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

Annals of the Indian Rebellion, Sir J.W. Kaey প্রণীত History of the Sepoy War এবং Col.J.B.Malleson প্রণীত History of the Indian Mutiny গ্রন্থে সিপাহী বিপ্লবের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। বিপ্লবের সুস্পষ্ট পূর্বাভাস পাওয়া যায় ১৮৫৭ সালের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন বাংলার ব্যারাকপুরে। ২২ শে জানুয়ারী দমদম থেকে ম্যাস্কেটারী স্কুলের ক্যাপ্টেন রাইট (Captain Wright) জানান যে, নতুন এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ চর্বিযুক্ত করার জন্যে যেসব উপাদান ব্যবহৃত হয়, সে সম্পর্কে সিপাহীদের মনে দারুণ ক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। ২৮ শে জানুয়ারী ব্যারাকপুর সেনানিবাস থেকে মেজর জেনারেল হিয়ার্সে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেলকে জানালেন যে, কোলকাতার বিধবা বিবাহ বিরোধীদের প্রচারণার ফলে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, সিপাহীদেরকে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে এবং এ উদ্দেশ্যেই এনফিল্ড রাইফেলের নতুন কার্তুজ বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কার্তুজে গরু ও শুকরের চর্বি মিশ্রিত আছে এবং তা দাঁতে কেটে ব্যবহার করতে হ। এতে করে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মচ্যুত হয়ে যাবে। হিয়ার্সে আরও জানান যে, রাণীগঞ্জের একজন সার্জেন্রে বাংলা এবং ব্যারাকটুর টেলিগ্রাফ অফিসারসহ তিনটি বাংলো অগ্নিতে ভস্মীভূত করা হয়েছে।

১১ই ফেব্রুয়ারী হিয়ার্সে পুনরায় ভারত সরকারের সেক্রেটারীকে জানানঃ

আমরা ব্যারাকপুরে বিস্ফোরণোন্মুখ মাইনের উপর বাস করছি।

২৬শে ফেব্রুয়ারী বহরমপুরের ১৮ নং পল্টন, প্যারেডের সময় কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে। লেঃ কর্ণেল মিচেল তখন কঠোর ভাষায় সিপাহীদেরকে বলেন যে, কার্তুজ ব্যবহার না করলে তাদেরকে চীন ও রেঙ্গুনে পাঠানো হবে। সিপাহীগণ এতে অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং বিদেশে মৃত্যুবরণ করার চেয় স্বদেশে মৃত্যুবরনকেই শ্রেয় মনে করে। তাদের এ অবাধ্যতার জন্যে তাদেরকে বহরমপুর থেকে ব্যারাকপুর নিয়ে গিয়ে পল্টন ভেঙে দেয়া হয়। এই ১৯ নং পল্টনের এক হাজার সিপাহীর মধ্যে চিল ব্রাহ্মণ ৪০৯ জন, রাজপুত ২৫০ জন, মুসলমান ১৫০ জন এবং অবশিষ্ট ছিল নিম্নশ্রেণীর হিন্দু।

তাদেরকে সুসজ্জিত কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে নিরস্ত্র করে ৮৫নং গোরা পল্টনের পাহারায় ফলতাঘাট পার করে দেয়া হয়। এ নিরস্ত্রীকরণ কার্য সম্পাদন করা হয় ৩১শে মার্চ।

এর থেকে বুঝা যায় যে, বাংলার সিপাহীদের বিদ্রোহের প্রধান এবং প্রত্যক্ষ কারণ (Immediate cause) হলো তাদেরকে চর্বিমিশ্রিত কার্তুজ ব্যবহার করতে বাধ্য করা। এ সব সিপাহীদের মধ্যে অধিকাংশ চিল বর্ণহিন্দু ও ব্রাহ্মণ।

ইতিমধ্যে মার্চের শেষের দিকে এক সংবাদ রটলো যে, জাহাজ বোঝাই গোরা সৈন্য ব্যারাকপুর আসছে বিদ্রোহীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য। ৩৪ নং পল্টনের ৫নং কোম্টপানীর জনৈক মংগল পান্ডে এ সংবাদ শুনে ভাবলো যে, তাদের সর্বনাশের সময় আসন্ন। তখন সে উন্মুত্ত প্রায় হয়ে অস্ত্র হাতে বাইরে আসে এবং সার্জেন্ট জেনারেল হিউসন ও হিয়ার্সেকে লক্ষ্য করে গুলী ছোঁড়ে। কিন্তু লক্ষভ্রষ্ট হয়। বিচারে পান্ডের ফাঁসী হয়। ৬ই মে ৩৪ নং পল্টন পাইকারীভাবে বরখাস্ত করা হয়।

বহরমপুরের সংবাদ দ্রুতবেগে আম্বালায় পৌঁছে। সেখানকার ছাউনীগুলি অগ্নি সংযোগে ভস্মীভূত করা হয়। নগিনার নবাব আহমদুল্লাহ খানের নেতৃত্বে ১লা মে বিজনৌরে বিপ্লব শুরু হয়। ৩০শে মে সেনানিবাসে ৪৮ নং পল্টনের সিপাহীরা ইউরোপীয়দের বাংলোগুলি ভস্মীভূত করে দেয়। সম্মুখ সমরে স্যার হেনরি লরেন্সের সৈন্যরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। ইংরেজ সৈন্যরা অগত্যা রেসিডেন্সিতি আশ্রয় গ্রহণ করে তিন মাসকাল অবরুদ্দ অবস্থায় কাটায়।

একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, আঠারো শ সাতান্ন সালের আযাদী সংগ্রামের বহু দৃশ্যপট যবনিকার অন্তরালে রয়েছে। সিকান্দার দারা শিকোহ বলেনঃ

বিপ্লবের এক চরম পর্যায়ে দিলওয়ার জং মৌলভী আমদুল্লাহর প্রচেষ্টায় বিরলিজিস কাদেরকে অযোধ্যার সিংহাসনে বসানো হয় এবং অভিভাবিকারূপে বেগম হজরত মহল দেশের শাসন কার্য তত্ত্বাবধানের ভার গ্রহণ করেন।

আহমদুল্লাহ শাহ ও হজরত ব্রিটিম ফৌজের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। …শাহ শাহেব মুহাম্মদীপুরে ‘ইসলামী হুকুমত’ কায়েম করেন। শাহাজাদা ফিরোজশাহ ও রানা রাও সেই হুকুমতের উজীর নিযুক্ত হন। সেনাপতি পদে নিযুক্ত হন জেনারেল বখত খান।

…কিন্তু ফিরোজ শাহ নিজেই বাদশাহ হবার স্বপ্ন দেখছিলেন। ফলে আহমদুল্লাহ এখানেও বেশী দিন টিকতে পারেননি। রাজা বলদেব সিংহের আমন্ত্রণক্রমে তিনি গডডি অভিমুখে রওয়ানা হন। একদিন বিশ্বাসঘাতকদের প্ররোচনায় তিনি হাতীর পিঠে আরোহণ করেন এবং সেই অবস্থায় শত্রুর গুলীতে শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁর শির খন্ডিত করে কোতোয়ালীতে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং দেহ খন্ড বিখন্ড করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কয়েকদিন পর আহমদপুর মহল্লায় তাঁর পরিবত্র শির দাফন করা হয়। আহমদুল্লাহ শাহের হত্যাকারীকে রাজা (বলবেদ সিং) পঞ্চাশ হাজার টাকা বখশিশ দেন। -(শতাব্দী পরিক্রমা, পৃঃ ১৪৭-৪৮)

সাতান্নো সালে ভারতের সংগ্রাম স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তার একটি কারণ হলো কতিপয় স্বার্থান্বেষীর চরম বিশ্বাসঘাতকতা।

এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ তৈরীর প্রধান কারখানা ছিল মীরাটে। সেখানে তৃতীয় অশ্বারোহীর ৮৫ জন সিপাহী নতুন কার্তুজ স্পর্শ করতে অস্বীকার করলে তাদেরকে সামরিক বিচারান্তে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় ৯ই মে কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন সন্ধ্যায় সিপাহী জনতার গোলাগুলীর আওয়াজে চরিদিক মুখরিত হয়। তারা কারাগার থেকে ৮৫ জন শৃংখলাবদ্ধ সিপাহীকে মুক্ত করে আনে এবং ইউরোপীয়দের বাংলোগুলি ভস্মীভূত করে। এ ব্যাপারে শহর ও সদর বাজারের অধিবাসীগণই সিপাহীদের চেয়ে অধিকতর তৎপরতা প্রদর্শন করে। সাইয়েদ হাসান আলী বেরেলভী ছিলেন বিপ্লবীদের পরিচালক। উন্মুক্ত জনতা-সিপাহী এখানে একটি মারাত্মক ভুল করে। তারা ইউরোপীয় দুটি রেজিমেন্ট, সেনানিবাস ও অস্ত্রাগারের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে রাতে দিল্লীর পথে রওয়ানা হয়।

যাহোক তারা চল্লিম মাইল পথ অতিক্রম করে কোন প্রকারে দিল্লী নগরীতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তৎকালে দিল্লীতে ৩৮, ৫৪ ও ৭৪ নং তিনটি পদাতিক বাহিনী ও দুটি কোম্পানীতে মোট ৩৫০০০ দেশীয় সৈন্য এবং ৫০ জন ইংরেজ অফিসার ছিল। সকাল সাতটায় একদল বিপ্লবী অশ্বারোহী বাহাদুর শাহের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলো। ক্যাপ্টেন ডগলাস, বেসিডেন্ট ব্রেজার ও ম্যাজিস্ট্রেট হ্যাবিনসন তাদের বাধা দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলো। বিকেল তিনটায় বিপ্লবীগণ যখন অস্ত্রাগারের দুই স্থানে প্রবেশ করে, তখন অবস্থা বেগতিক দেখে বারুদাগারের প্রধান লেঃ উইলোবীর আদেশে স্কালী (Scully) বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন দিল্লী নগরীতে কিয়ামত শুরু হয়। প্রচন্ড শব্দে বারুদখানা উড়ে যায়। আশেপাশের প্রায় পাঁচ’শ লোক মৃত্যুবরণ করলো। বহু অগ্নিদগ্ধ হলো। বিপ্লবীগণ তখন ক্ষিপ্ত হ’য়ে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন শুরু করলো। ধনাগার লুণ্ঠন করে ২১লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা হস্তগত করা হলো এবং তা বাদশাহের হেফাজতে রাখা হলো। রাত্রে একুশটি কামান পর পর গর্জে উঠলো এবং এভাবে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের প্রতি রাজকীয় অভিবাদন (Salute) জ্ঞাপন করা হলো।

১২ই মে বাদশাহ স্বয়ং হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ করে নগর পরিদর্শন করেন এবং বাজারের দোকানপাট খোলার ব্যবস্থা করেন। শাহজাদাগণকে নগরের বিভিন্ন তোরণে শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়।

১৬ই মে কয়েকজন বিপ্লবী সিপাহী একটি সীলমোহরযুক্ত গোপন পত্রে বাহশাহকে জানায় যে, বাদশাহের চিকিৎসক হাকিম আহসান উল্লাহ এবং পরষদ নবাব মাহবুব আলী খান ব্রিটিশের সংগে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন যে, পত্রখানি জাল। এতে করে বাদশাহ প্রতারিত হন। শাহাজাদাগণ পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক এবং পৌত্র মীর্জা আবু বকর অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক হন। শাহজাদা মীর্জা জওয়ান বখন প্রধান উজির নিযুক্ত হন। হাকিম আহসানউল্লাহ মীর্জা আবু বকরকে দিল্লী থেকে অপসারণের অভিসন্ধি করে মীরাট অধিনায়ক পদে নিয়োগ করার ব্যবস্থা করেন। ৩১শে মে তাঁর সৈন্যরা প্রয়োজনীয় গোলাবারুদের অভাবে হিন্দান নদীর তীরে ইংরেজদের কাছে পরাজয় বরণ করে।

বিদ্রোহের আগুন চারদিকে দাউ দাউ কের জ্বলছে। ফিরোজপুর, বেরেলী, কানপুর, জৌনপুর, সীতাপুর প্রভৃতি স্থানে দেশীয় সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছে। কানপুরের সমস্ত ইউরোপীয় সৈন্যরা দুটি সামরিক হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল। সেনাপতি স্যার হিউ হুইলার ৬ই জুন খবর পেলেন যে, বিদ্রোহীগণ আশ্রয়ঘাঁটি আক্রমণ করবে। নানা সাহেবের ‘সফেদা কুঠি’ বিপ্লবীদের মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রণাদাতা ছিলেন আজিমুল্লাহ খান, সেনাপতি টিকা সিংহ, তাতিয়াটোপী, জওলাপ্রসাদ, বালরাও। বাবা ভট্ট ও মিনাবাই জাতীয় বাহিনীর পরিচালনা ভার গ্রহণ করেছেন। ‘সফেদা কুঠি’ থেকে ইউরোপীয় নারী ও শিশুদেরকে ‘বিবিঘরে’ স্থানান্তরিত করা হলো, কর্নেল হ্যাডলাক ৬৪ নং গোরা পল্টনসহ কানপুর অভিমুখে রওয়ানা হন। ফতেহপুর জওলাপ্রসাদের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। রণাঙ্গনে বালরাওয়ের সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে সেনাপতি রেন্ড নিহত হন। বিজয় উর্লাসে উত্মত্ত হয়ে দেশীয় সৈন্যরা বিবিগরে আকট নারী শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ নির্মম নীতিবিরুদ্ধ হত্যাকান্ডে মর্মাহত হয়ে আজিমুল্লাহ খান কানপুর ত্যাগ কের লক্ষ্ণৌ চলে যান এবং মৌলভী আহমদুল্লাহর মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি নেপালে ইন্তেকাল করেন।

এর থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, যাঁরা দেশকে বিদেশী শাসনমুক্ত করার জন্যে আল্লাহর পথে জেহাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হন, তাঁরা অন্যায় হত্যাকান্ড ও নীতিবিরোধী তৎপরতা থেকে দূরে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল সহনমীলতা, খোদাভীতি এবং একমাত্র খোদার সন্তুষ্টি লাভ ছিল তাঁদের লক্ষ্য। “যাঁরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর। কিন্তু সীমালংঘন করো না। কারণ সীমালংঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না”-

খোদার এ বাণীর মর্যাদা রক্ষা করে তাঁরা চলবার চেষ্টা করেছেন।

যাহোক, ইংরেজরা ওদিকে মোটেই চুপ করে বসে ছিল না। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্য সংগ্রহের কাজ শুরু করলো। চীন, সিংহল ও অন্যান্য স্থান থেকে ইউরোপীয়দেরকে এবং পার্বত্য প্রদেশ থেকে গুখাদেরকে আনা হলো। পারস্য থেকে তিনটি বাহিনী বাংলায় আনা হলো। দিল্লীর অদূরে এক টিলায় ইংরেজ সৈন্যরা সমবেত হয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করলো। উভয় পক্ষ চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলো। ২৯শে মে ইংরেজ পক্ষের রাজা নরেন্দ্র সিংহের কিছু সংখ্যক শিখ সৈন্য বিপ্লবীদের দলে যোগ দেয়। তখন ইংরেজরা শিখদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্যে অতীত ইতিহাসের আঁস্তাকুড় ঘেঁটে হীন প্রচারণা শুরু করলো। এ ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতক রজব আলী ইংরেজদের সহায়ক হয়। সে সম্রাটের দরবার থেকে সম্রাট পক্ষীয় গোপন তথ্য ইংরেজদেরকে সরবরাহ করতো, হাকিম আহসানউল্লাহর সাথেও তার আঁতাত সৃষ্টি হলো।

দুর্ভাগ্যবশতঃ দিল্লীতে প্রবল বর্ষা দেখা দিল। নগরে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব ঘটলো। দ্রব্যসামগ্রী মহার্ঘ হলো। ওদিকে ইংরেজরা দিল্লীর চারদিকে অবরোধ সৃষ্টি করে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজণীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ বন্ধ করে দি। ২৩শে জুন ইংরেজরা সবজীমন্ডী দখল করলো। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বেরেলী বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল মুহাম্ম বখত খান চারটি পদাতিক বাহিনী, ৭ শত অশ্বারোহী সৈন্য, ১৪টি হস্তী, প্রচুর অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ দিল্লীতে উপনীত হলেন। তখন দিল্লীতে মোট সৈন্যসংক্যা হলো ৯০০০০। কিন্তু উজিরাবাদ অস্ত্রশালা দস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার কেল্লায় গুলাবারুদের অভাব ঘটলো। আগষ্ট হঠাৎ এক বিস্ফোরণে বারুদ কারখানা উড়ে গেল। হাকিম আসহাসউল্লাহর এতে কারসাজি ছিল বলে সকলের সন্দেহ হলো। কিন্তু সে ইতিমধ্যেই পলায়ন করেছে বলে তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশ্য হাকিমের গৃহ লুণ্ঠিত হলো। ৭ই সেপ্টেম্বর ইংরেজ সেনাপতি উইলসনের নির্দেশে দিল্লীর সকল ফটকের দিকে কামান স্থাপন করা হলো। ১১ই সেপ্টেম্বর সেসব কামান থেকে প্রচন্ড গোলা বর্ষণ শুরু করলো। পুনঃ পুনঃ গোলার আঘাতে অবমেষে কাশ্মীর ফকট ধসে পড়লো। ১৮ই সেপ্টেম্বর দেওয়ানই খাসের ফটক বন্ধ করে দেয়া হলো। জেনারেল বখত খান অসীম বীরত্ব সহকারে শত্রু নিপান করতে থাকেন। কিন্তু মীর্জা মুগল যেখানে সৈন্য চালনা করেন সেখানেই বিপর্যয় ঘটে। ইংরেজদের গোলার আঘাতে নগর প্রাচীর দুই স্থানে ভেঙে গেল। জাতীয় বাহিনীর মধ্যে চরম বিশৃংখলা দেখা দিল। ২০শে সেপ্টেম্বর জেনারেল বখত খান বাদশাহকে বল্লেন, “বারদিকেই বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র। আমাদের সকল পরিকল্পনাই শত্রুর গোচরীভূত হচ্ছে। হাজার হাজার রোহিলা এখনো প্রাণ দিতে প্রস্তুত। আপনি বাইরে আসুন, আমরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ জয় করব”।

মিন্তু মীর্জা এলাহী বখশ ও বেগম জিনতমহল সম্মত না হওয়ায় বাদশাহ জেনারেল বখত খানের আবেদন অগ্রাহ্য করেন। অগত্যা বখত খান অযোধ্যায় গিয়ে আহমদুল্লহার বাহিনীতে যোগদান করে লক্ষ্ণৌ ও শাহাজাহানপুরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু চারদিকে যখন বিপর্যয়ের কালো ছায়া নেমে এলো, তখন তিনি ভগ্নহৃদয়ে নেপাল উপত্যকায় গিয়ে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন।

বিশ্বাসঘাতক হাকিম আহসানউল্লাহ খান, শেখ রজব আলী ও মীর্জা এলাহী বখশের গুপ্তচরবৃত্তির ফলেই সম্রাট বাহাদুর শাহ, বেগম জিনতমহল ও শাহাজাদা জওয়ান বখত ক্যাপ্টেন হডসনের হাতে বন্দী হন। তিনজন শাহজাদা হুমায়ুন মকবেরাতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখান থেকে তাদেরকে বন্দী করে আনার সময় পথে নমপিশাচ হডসন তাদেরকে স্বহস্তে গুলী করে হত্যা করেন। আতংক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁদের লাশ কোতোয়ালীর সামনে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হলো। অতঃপর ইংরেজরা দিল্লী নগরী ভয়াবহ শ্মশানে পরিণত করলো। নিরীহ নাগরিকদের মৃতদেহে শহরের রাজপথ ভরে গেল।

চারদিকে বিপ্লব দমনের জন্যে তারা সর্বত্র পৈশাচিক নরমেধ যজ্ঞ শুরু করলো। আলীগড়, এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, বেরেলী, কানপুর ফতেহপুর, ঝাঁসি, গোয়ালিয়র, দানাপুর, ছোটনাগপুর প্রভৃতি বিপ্লব কেন্দ্রগুলিতে তারা অমানুষিক উৎপীড়ন ও নিধনযজ্ঞ শুরু করলো।

চট্টগ্রামের সিপাহীরা বিপ্লব শুরু করতেই ইংরেজরা অরণ্য পথে পলায়ন করে প্রাণ রক্ষা করে। সিপাহীরা নির্বিবাদে ধনাগার লুণ্ঠন করে, বন্দীদেরকে মুক্ত করে, সেনানিবাস বষ্মীভূত করে এবং বারুদঘর উড়িয়ে দিয়ে বন্যাপথ দিয়ে, সিলেট ও পাহাড়ের দিকে চলে যায়।

২২শে নভেম্বর প্রাতঃকালে ঢাকা শহরে নৃশংস কান্ড অনুষ্ঠিত হয়, ইংরেজরা অতর্কিত লালকেল্লা আক্রমণ করে। সেখানে বিপ্লবীদের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়, অবশেষে বিপ্লবীগণ নদী সাঁতরিয়ে পলায়ন করে, যারা ধরা পড়লো তাদেরকে আন্ডাঘর ময়দানে (বর্তমান বাহাদুরশাহ পার্ক), সদরঘাট, লালবাগ ও চকবাজারে এনে ফাঁসী দেয়া হলো।

স্যার জন লরেন্সের নির্দেশে গঠিত একটি মিলিটারী কমিশন সম্রাট বাহাদুর শাহের বিচার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এই যে তিনি নিজেকে ভারত সম্রাট বলে ঘোষণা করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ইতিহাসের এ এক নির্মম পরিহাস যে, গৃহস্বামী হলো দস্যু এবং দস্যু হলো গৃহস্বামী। ঐতিহাসিক সত্য এই যে, ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী স্বাক্ষরকৃত এক চুক্তির মাধ্যমে ভারত সম্রাটকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার আধার বলে স্বীকার করে নেয়। তারপর কোম্পানী এবং সম্রাটের মধ্যে আর কোন চুক্তি সম্পাদি হয়নি। অতএব প্রকৃতপক্ষে সম্রাট বাহাদুর শাহই ছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রকৃত আইনগত শাসক এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীই রাজকর্তৃত্বের বিরুদ্ধে করেছিল নিমকহারামী ও বিদ্রোহ। অতএব যা ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম, কায়েমী স্বার্তের দল তার নাত দিল বিদ্রোহ। মিলিটারী কমিশনের বিচারে ভারতে কয়েক শতাব্দী যাবত মুসলিম শাসনের শেষ চিহ্নটুকু চিরদিনের জন্যে বিলুপ্ত হলো।

ভারতের এ আযাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল প্রধানতঃ যে ক’টি কারণে তা হলো-

এক –ইংরেজদের উন্নত ধরনের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুকাবেলায় বিপ্লবীদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল পুরাতন ও অসময়োপযোগী।

দুই –দেশীয় সৈন্যদের মধ্যে ছিল ঐক্য ও শৃংখলার অভাব।

তিন –চট্টগ্রাম, ঢাকা, ব্যারাকপুর, বহরমপুর থেকে আরম্ভ করে দিল্লী পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলের সর্বত্র স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিপ্লব শুরু হলেও তাদের ছিলনা কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সকলের মধ্যে কোন পারস্পরিক যোগসূত্রও ছিল না।

চার –কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের ক্রিয়াকলাপ বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে বিপর্যয় এনেছিল। বিপ্লবীদের সকল প্রকার গোপন তথ্য শত্রুপক্ষকে সরবরাহ করা হতো এবং চরম মুহুর্তে দুই দুই বার বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা বারুদখানা বিস্ফোরিত হওয়ার দেশীয় সৈন্যগণ গোলাবারুদের অভাবের সম্মুখীন হয়।

পাঁচ –দেশীয় সৈন্যদের অনেকের মধ্যে আদর্শ চরিত্রের অভাব ছিল। অনেক অবাঞ্ছিত লোক লুঠতরাজ ও অন্যায় হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্যে বিপ্লবীদের দলে যোগদান করে। তার সাথে যুক্ত হ’য়েছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস।

ছয় –হায়দারাবাদ, গোয়ালিয়ার, নেপাল এবং শিখ প্রভৃতি শক্তিগুলি বলতে গেলে ছিল নিষ্ক্রিয় বা ইংরেজদের পক্ষে।

সাত –দেশীয় নৈন্যদের ইংরেজকে হটাও ছাড়া অন্য কোন মহান আদর্শ ছিল না। সাইয়েদ আহমদ শহীদের সময় থেকে যাঁরা এদেশে মুসলমানদের মধ্যে জেহাদের প্রেরণা জাগ্রত করে রেখেছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে কোন সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বেই বিপ্লব শুরু হয়েছিল এবং এ বিপ্লবী কর্মধারা ছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

এ আযাদী আন্দোলন সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও এর পরিনাম ফল হয়েছে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। যুদ্ধকালে স্থানে স্থানে উন্মত্ত দেশীয় সিপাহীদের দ্বারা কিছু পৈশাচিক ক্রিয়াকান্ড সংঘটিত হয়েছিল সত্য। কিন্তু ইংরেজরা যে পৈশাচিকতার সাথে তার প্রতিশোধ নিয়েছে, তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক বিরাট কলংকের অধ্যায় সংযোজিত করেছে। মুসলিশ মুজাহেদীন তার পরও এক দশক কাল ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।

ঊনবিংশতি শতাব্দীর ছয় দশকের পর ভারতে যে নীরব ও শাস্ত অবস্থা বিরাজ করছিল, তাকে বলা যেতে পারে সমাধিক্ষেত্রের নীরবতা। আযাদী আন্দোলনের জন্যে এককভাবে দায়ী করা হয় তৎকালীন ভারতের মুসলমানদেরকে। ফলে ব্রিটিশের রুদ্র আক্রোশে, তাদের অত্যাচার নিষ্পেষণে জর্জরিত হয় মুসলিম সমাজ। সুদূর বাংলা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত মুসলমাদেরকে পাইকারীভাবে ধরপাকড়, জেল-ফাঁসি, দ্বীপান্তর, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ প্রভৃতির দ্বারা মুসলিম সমাজে নেমে এসেছিল সমাধিক্ষেত্রের নীরব নিথর কালোছায়া। কিন্তু তথাপি এ নীরবতা ছিল সামরিক। সুদীর্ঘকালের সংগ্রামে মুসলমানরা স্বাধীনতা প্রেমের যে উজ্জ্বল আদর্শ তুলে ধরেছিল তা ইতিহাসের পাতায় অক্ষর হ’য়ে রইলো। এই মহান আদর্শই পরবর্তীকালে ভারতবাসীকে উজ্জীবিত করেছিল। যার ফলস্বরূপ আঠারো শ’ সাতান্ন সালের নব্বই বছর পর ভারতবাসী ইংরেজের গোলামীর শৃংখলে চিরতরে ছিন্ন করতে সক্ষম হয়।

কিন্তু তথাপি এ সত্য অনস্বীকার্য যে, সাইয়েদ আহমদ শহীদের সংগ্রাম, ফারায়েজী আন্দোলন ও তিতুমীরের সংগ্রাম, আঠারো শ’ সাতান্নোর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরবর্তীকারে সীমান্তে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম ব্যর্থতার পর্যবসিত হওয়ার পর ভারতের মুসলিম জাতি এক চরম দুর্গতি ও দুর্দিনের সম্মুখীন হয়। এ দুঃসময়ে স্যার সাইয়েদ আহমদ খানের ভূমিকা মুসলমানদের দুর্দশা দূরীকরণে বিশেষ অবদান রাখে।

No comments:

Post a Comment