Thursday 25 May 2017

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের ৩০টি মজার ঘটনা


কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের ৩০টি মজার ঘটনা

কবি কাজী নজরুল ইসলামের রসবোধ সম্পর্কে তার লেখনীর মাধ্যমে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। কবিকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তারা সকলেই মুগ্ধ হতেন তার ভীষণ আয়েশী আড্ডাবাজ স্বভাব এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে খোশমেজাজে থাকতে পারার দুর্দান্ত ক্ষমতায়। আজ ২৫ মে কবির জন্মদিন। চলুন জেনে নেয়া যাক কবির জীবনের অনেক হাস্যরসপূর্ণ ঘটনার মধ্যে কয়েকটি।

১. কবি নজরুল তখন খুব ব্যস্ত। নিয়মিত গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে আসেন, গান লিখেন, সুর করেন, গান শিখিয়ে দেন। বেশীর ভাগ গান গাইছেন কে মল্লিক। একদিন এই কে মল্লিকের কাছে এক লোক এল। লোকটির নাম প্রফেসর জি দাস। এসে ধরল মল্লিককে, সে গান গাইতে চায়। গান গাইতে হলে তো পরীক্ষা দিতে হবে কোম্পানিতে, পরীক্ষা নেয়া হলো। ফলাফল, একেবারে অচল! গান নেওয়া হবে না শুনে ওখানেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন বেচারা প্রফেসর। কে মল্লিক যতই সান্তনা দেন, বেচারা ততই কাঁদেন। আওয়াজ শুনে এলেন কোম্পানির বড়বাবু। তিনি সব শুনে প্রফেসরকে বললেন, 'আপনার গলা এখনও ঠিক হয়নি। সুর-তাল-লয় ঠিক থাকছেনা, কদিন পর আসুন, দেখা যাক কী হয়।'

প্রফেসর লোকটি তখন বড়বাবুর কাছে কয়েকজনের নামে বিচার দিলেন যারা তাকে ফুঁসলিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। ওরা নাকি তাকে এও বলেছে যে তোমার গলা ভাল হলেও কে মল্লিক হিংসা করে তোমাকে গান গাইতে দিবে না। বড়বাবু বুঝলেন যে বেচারা খুব সরল মানুষ, তাকে যেভাবে বুঝানো হয়েছে সে বুঝেছে। প্রফেসরের কান্না আর থামছে না।

এমন সময় রুমে ঢুকলেন কাজী নজরুল। কী ব্যাপার? বলে তিনি মনোযোগী হলেন কান্নাকাটির কারণ জানতে। বড়বাবু আর কে মল্লিক তাকে সব খুলে বললেন। কবি তখন বললেন, বেচারা থেকে রেকর্ডের আশ্বাস দিয়ে যখন মিষ্টি খাওয়া হয়েছে, অতএব তার একটা গান রেকর্ড করতেই হবে।

কে মল্লিক বললেন, 'আরে কাজীদা, কী বলছেন আপনি? দেখছেন না লোকটা একজন পাগল।'

কবি উত্তর দিলেন, 'আরে মল্লিক, আমারা বাঙালীরাও কিন্তু কম হুজুগে নই, দেশটাও হুজুগে।' এই বলে কবি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'শোনো, তুমি কাল এসো, তোমাকে শিখিয়ে আমি রেকর্ড করিয়ে নিব।' কবি নজরুল বলে কথা। মল্লিক আর বড়বাবু তাকে ভাল করেই জানেন। কাজেই সবাই পরবর্তী কান্ড তামাশা দেখার অপেক্ষায় থাকলেন।

কবি গান রেকর্ডের সব ব্যবস্থা করলেন। গান লেখা হলো, কবি প্রফেসরকে বললেন যে এই গানের কথা যেন কেউ জানতে না পারে, যখন গান বাজারে আসবে তখনই শোনা যাবে প্রথম। রেকর্ডের সব ঠিকঠাক করে কবি বললেন, 'আচ্ছা, এবার গান ধরো--কলা গাড়ি যায় ভষড় ভষড়/ ছ্যাকরা গাড়ী যায় খচাং খচ/ ইচিং বিচিং জামাই চিচিং/ কুলকুচি দেয় করে ফচ...'

অদ্ভুত এমন গান শুনে উপস্থিত বাকি দুজন ওখানেই হাসতে লাগলেন, কবির কান্ড দেখে তারা ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলছেন। পরের দিন এর আরেক জোড়া লিখে আনলেন কবি, এবার অপর পিঠে রেকর্ড করালেন--'মরি হায় হায় হায়, কুব্জার কী রুপের বাহার দেখো।/ তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙা/ উপুড় করলে হয় সাঁকো।/ হরি ঘোষের চার নম্বর খুঁটো, মরি হায় হায় হায়...'

এ গানে প্রফেসরকে যে চতুষ্পদ বানানো হচ্ছে, তাও কেউ টের পেল না। খুব উৎসাহে প্রফেসর রিহার্সাল করতে থাকল। রেকর্ডিং ম্যানেজারকেও জানানো হলো না, কী গান কাকে দিয়ে রেকর্ড হচ্ছে। চরম গোপনে গান দুটো রেকর্ড হল, তারপর বাজারে ছাড়া হল।

বাজারে প্রকাশিত হওয়ার দু একদিন পর কবি মল্লিককে ডেকে বললেন, 'একটু দেখে আসুন তো বাজার থেকে, কেমন বিক্রি হচ্ছে গান দুটো?'

বাজারে খোঁজ নিয়ে এসে মল্লিক হাসতে হাসতে বললেন কবিকে, 'কাজীদা, খুব বিক্রি হচ্ছে অদ্ভুত গানদুটো। ক্রেতারা কিনছে আর গাইছে, কলা গাড়ী যায় ভষড় ভষড়...'

কোম্পানির ম্যানেজার তো দারুণ খুশী। বড়বাবুকে ডেকে বললেন, 'তুমি তো বলেছিলে, লোকটি পাগল। ওর গান তো বেশ সেল হচ্ছে, আরও দু একটা নাও না ওর গলায়...'

মল্লিক সাহেব দৌড়ে গিয়ে কাজীকে কর্তার প্রস্তাব জানালেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, 'মল্লিক সাহেব, এবার কিন্তু গালাগাল খেতে হবে, হুজুগে দেশে এসব একবারই চলে।' বলেই আবার জোরে হাসিতে ফেটে পড়লেন কাজী নজরুল ইসলাম।

২. একবার নজরুল গেছেন সিরাজগঞ্জে, আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর বাসায়। খাওয়া দাওয়ার পর সবাইকে দই দেয়া হলো। কিন্তু সে দই আবার বেজায় টক হয়ে গিয়েছিল। তা খেয়ে নজরুল আসাদউদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে চোখে-মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, ‘তুমি কি এই দই তেতুঁল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি?'

৩. কবির এক বন্ধু ছিল, শৈলেন নাম। কবি তার কাছ থেকে কেবল চা খেতেন। আর প্রতিদিন শৈলেনের কাছ থেকে চা খাওয়ার জন্য নিত্যনতুন ফন্দি আঁটতেন। একদিন আর কোনো ফন্দি-ফিকির না পেয়ে তিনি শৈলেনের কাছে গিয়ে বললেন, 'তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসেব করে রেখো, আপাতত দু পেয়ালা চা দাও।' শৈলেন তো অবাক! এ আবার কেমন কথা! অনেক টাকা পাওয়ার সঙ্গে দু পেয়ালা, মানে দুই কাপ চায়ের কী সম্পর্ক? তিনি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, 'দু পেয়ালা কেন?'

কবি বললেন, 'আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেলে টাকা হয় না। লাখ পেয়ালা হতে আমার এখনও দু পেয়ালা বাকি আছে।'

৪. খ্যাতিমান সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘নজরুল ছিলেন একাই একশো। চওড়া মজবুত জোরালো তার শরীর, লাল-ছিটে লাগা বড় বড় মদির তার চোখ, মনোহর মুখশ্রী, লম্বা ঝাঁকড়া চুল তার প্রাণের ফূর্তির মতোই অবাধ্য, গায়ে হলদে কিংবা কমলা রঙের পাঞ্জাবী এবং তার উপর কমলা কিংবা হলদে রঙের চাদর, দুটোই খদ্দরের। কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, 'আপনি রঙিন জামা পরেন কেন?' ‘সভায় অনেক লোকের মধ্যে যাতে চট করে চোখে পড়ে তাই’ বলে ভাঙা ভাঙা গলায় হো হো করে হেসে উঠেছেন তিনি। কথার চেয়ে বেশি তার হাসি, হাসির চেয়ে বেশি তার গান। একটি হারমোনিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমাণ চা এবং অনেকগুলো পান দিয়ে বসিয়ে দিতে পারলে সব ভুলে পাঁচ-ছয়-সাত ঘণ্টা একনাগাড়ে গান করতে থাকতেন। নজরুল যে ঘরে আড্ডা জমাতেন, সে ঘরে আর কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতো না।’

৫. অসামান্য প্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ইসলামি হামদ, নাত, গজল রচনা শুরু করলেন, তখনকার একটি ঘটনা । শিল্পী আব্বাসউদ্দিন একদিন অনেক খোঁজাখুজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় চলে গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন । নজরুল ইশারায় আব্বাসউদ্দিনকে বসতে বললেন । আব্বাসউদ্দিন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন ।

নজরুল বললেন 'কী, তাড়া আছে, যেতে হবে?'

আব্বাসউদ্দিন বললেন 'ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেবার জন্য। গজল না নিয়ে আজ যাওয়া হচ্ছে না।' (নজরুলকে যেহেতু বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে পাওয়া যেত না, তাই সবাই এইভাবে লেখা আদায় করত!)

নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন। এরপর আব্বাসউদ্দিন যথারীতি জোহরের নামাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল তাঁর হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন 'এই নাও তোমার গজল'। এই গজলটিই হলো--‘হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/ দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ...’

৬. ছোটদের জন্য পাঠ্যবই লিখতেন আলী আকবর সাহেব। একদিন নজরুল ইসলামকে একটি পান্ডুলিপি দেখিয়ে মতামত চাইলেন। পুরো পান্ডুলিপিটি পড়ে নজরুল বললেন, 'আপনার পান্ডুলিপির ছড়াগুলো ছোটদের উপযোগী হয়নি। যদি বলেন তো আমি একটা ছড়া লিখে দিতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুরোধ করলেন নজরুলকে একটি ছড়া লিখে দেয়ার জন্য। নজরুলও দু’খিলি পান মুখে পুরে লিখলেন সেই বিখ্যাত ‘লিচু চোর’--‘বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডালকুকুরে/ সেকি ব্যস করলো তাড়া/ বলি, থাম-একটু দাঁড়া...’

৭. পুতুলের মতো ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে অঞ্জলি। একদিন নজরুল বারান্দায় বসে আছেন। হঠাৎ তার চোখ পড়লো অঞ্জলির ওপর। নজরুল দেখলেন, একটা পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ-ঠোঁট উল্টিয়ে, হাত-পা নেড়ে অঞ্জলি যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। সেই কথা আর শেষই হতে চায় না। নজরুল ভাবলেন, নিশ্চয়ই কেউ পেয়ারা গাছে উঠেছে। তার কাছে কাকুতি-মিনতি করে অঞ্জলি পেয়ারা চাইছে, কিন্তু গাছের ওপর যে, সে পেয়ারা দিচ্ছে না। নজরুল তো ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি ভাবলেন, অঞ্জলির হয়ে পেয়ারা চাইবেন। ছেলেটা দেয় তো ভালো, না দিলে নিজেই পেয়ারা পেড়ে দেবেন। মজার ব্যাপার হলো, অঞ্জলির সামনে গিয়ে কবি নজরুল গাছের ওপর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তবে অঞ্জলি কথা বলছিলো কার সঙ্গে? নজরুল তখন অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?' অঞ্জলি বলল, 'কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।' কাঠবেড়ালীর সঙ্গে অঞ্জলির এই মান অভিমানের ঘটনাটি নজরুলকে এতোটাই চমৎকৃত করলো যে, এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য লিখলেন ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ নামের সেই কবিতা--‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও? বাতাবি লেবু? লাউ?...’

৮. সওগাত পত্রিকা অফিসের সান্ধ্য আড্ডায় নজরুল ছিলেন মধ্যমণি। তাই তার জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করে রাখা হতো। কে না জানে নজরুল চা-পান একটু বেশিই খেতেন। তাই চা এলেই তিনি চিত্কার করে বলে উঠতেন, ‘দে গরুর গা ধুইয়ে।’ এটা ছিল নজরুলের একটা কমিক গানের শিরোনাম। তত্কালীন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে কটাক্ষ করে তিনি এ হাসির গান লিখেছিলেন। আনন্দ প্রকাশের জন্য নজরুল এভাবে প্রায়ই বলে উঠতেন, 'দে গরুর গা ধুইয়ে!'

৯. নজরুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কিছু হিউমার ছিল। তিনি Aristocrate-এর বাংলা করেছিলেন, ‘আড়ষ্টকাক!’ যারা বক্তৃতা দিতে ভালোবাসতেন তাদের বলতেন, ‘বখতিয়ার খিলজী’, কোনো কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে তিনি বলতেন, ‘জানে দেও কন্ডাক্টর’। কবি নজরুল fun এবং পান-এ সমান অভ্যস্ত ছিলেন। তার একটি বিখ্যাত পানপাত্র ছিল (যেটাকে তিনি নিজেই ‘পানের সিন্দুক’ আখ্যা দিয়েছিলেন)। এই পানপাত্রে একশত পান থাকত। লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে একসাথে তিন-চারটা পান মুখে পুরতেন আর পিকদানিতে পানের পিক ফেলতেন। এই পান নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলের পান খাওয়া দেখে তাকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আপনি কি পানাসক্ত?’ নজরুল বললেন, ‘জ্বি না, আমি বেশ্যাসক্ত!’ নজরুলের এমন উত্তর শুনে ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। পরে নজরুল ব্যাখ্যা করলেন, 'পান একটু বেশি খাই তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ বেশি+আসক্ত=বেশ্যাসক্ত!'

oui

১০. নজরুল একবার মফস্বলের কোনো এক গ্রাম ঘুরে এসে সওগাত পত্রিকার মজলিসে বসে জোরে হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, ‘আল্লারে, বিল্লা এক্করে হাল্ দিয়া উত্কা মাইরা বাইরে পইড়্যা গেছে। আমি জমাইছি মেকুরডা চাইয়া দেহি বিল্লিডা।’ ঘরশুদ্ধ লোক হেসে অস্থির। পরে জানা গেল গ্রামে গিয়ে তিনি যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে নাকি রাতে এক কাণ্ড ঘটেছিল। জানালা দিয়ে একটি বিড়াল অন্য একটি বিড়ালকে তাড়া করে লাফ দিয়ে বাইরে গিয়ে পড়েছিল। কী হলো ভেবে বাড়ির একটা লোক গ্রাম্য ভাষায় এই কথাগুলো বলছিল। আর নজরুল তার হুবহ বয়ান করলেন।

১১. বার্ষিক সওগাত বেরোবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ মজলিসে নজরুল বলে বসলেন, ‘দশ মাস মাসিক বেরিয়ে এখন বার্ষিক বেরোচ্ছে!’

১২. নজরুলের গান রচনার আর রেকর্ডের আঁতুড়ঘর ছিল কলকাতার বিষ্ণু ভবন। সেখানে রিহার্সেল রুমে চা সাপ্লাই করতেন সুধীর নামে এক ব্যক্তি। তার প্রতি হুকুম ছিল প্রতি আধ ঘণ্টা পর পর কবির সামনে ‘হাফ কাপ চা’ রেখে যেতে। এই চায়ের রূপ দুধের স্বল্পতার কারণে কালচে-লাল রং ছিল, তাই কবি এর নাম দিয়েছিলেন ‘সুধীর বাবুর বদরক্ত!’

১৩. একজন অ-বাঙালি ভদ্রলোক কবির খুব ভক্ত ছিলেন। কবিকে তিনি অনেক সময় অনেকভাবে সাহায্য করতেন। কোনো একদিন কলকাতায় কবির বাড়িতে কয়েকজন অভ্যাগতর সঙ্গে কবি গল্পগুজব করছেন। সেই অ-বাঙালি ভদ্রলোকও ছিলেন। একসময় তার সঙ্গে কবির হিন্দি বনাম বাংলা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছিল। ভদ্রলোকটি হিন্দি ভাষার জন্য ওকালতি করছিলেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, ‘যাও! যাও! তোমাদের হিন্দি ভাষা তো কুকুর বেড়ালের ভাষা!’ শুনে ভদ্রলোকটি একটু ক্ষুণ্ন হয়ে বলে উঠলেন, ‘কেঁও?’ অমনি কবি বলে উঠলেন, ‘ওই দেখ কুকুরের ডাক ডাকলে!’ ভদ্রলোকটি কবির কথায় রাগ না করে হেসে বললেন, ‘হুয়া হুয়া!’ কবি বললেন, ‘ওই দেখ শিয়ালের ডাক ডাকলে, আমি ঠিক বলিনি?’ উপস্থিত সকলেই এই রসালাপে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লেন।

১৪. লোকের নাম নিয়েও ব্যঙ্গ করতেন নজরুল। তখনকার নূর লাইব্রেরির মঈনুদ্দীন হোসেনকে তিনি বলতেন, ‘রয়টার’। কারণ, হোসেন সাহেব যেকোনো খবর সবার আগে কলকাতার সব পত্রিকা অফিসে দিয়ে আসতেন। নজরুলের বন্ধু ‘মোসলেম ভারত’-এর আফজাল-উল-হককে তিনি ডাকতেন ‘ডাবজল’ বলে। ‘শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাসকে তিনি বলতেন, ‘সজনে ঘণ্ট খাস’। মোহাম্মদী ও সওগাতের দ্বন্দ্ব যখন চরমে, নজরুলকে মোহাম্মদী যখন ‘আজাজিল’ আখ্যা দেয়, তখন নজরুল আকরম খাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘বাগরম খাঁ’। মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে তিনি ডাকতেন ‘বুড়ো’ বলেন। কারণ তিনি যুবক হয়েও বুড়োদের মতো যুক্তি-তর্ক ছাড়া কথা বলতেন না। বিজলী ধর নামে কবির এক ভক্ত অটোগ্রাফ নিতে এলে তিনি লিখে দিলেন ‘বি-জলি’। মানে Be jolly, অর্থাৎ হাসিখুশির মধ্যে থাকো!

১৫. একবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডে গান দিতে এলেন এক লোক। লোকটিকে নজরুলের কাছে পাঠানো হলো তার গানের দৌড় পরীক্ষা করার জন্য। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে কবির সামনে বসলেন এবং গান শুরু না করে কথা শুরু করলেন। কার কাছে গান শিখেছেন, কবে তার গান শুনে কে প্রশংসা করেছে, তিনি কতখানি পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইত্যাদি। মাঝে একবার কবিকে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন, ‘আপনি কি ধানশ্রী ভৈরবী রাগের গান শুনেছেন? শোনেন নি বোধহয়। খুব রেয়ার। কেবল আমার কাছেই আছে।’ এইভাবে লোকটি গান না গেয়ে বকবক করেই যাচ্ছিল। নজরুল তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি তো দেখছি একটি জানোয়ার লোক।’ ‘কী বললেন?’ ভদ্রলোকটি নজরুলের কথায় বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। নজরুল বললেন, ‘না না অন্য কিছু মনে করবেন না, দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্বন্ধে ‘জানোয়ার’ শব্দটি প্রয়োগ করেছি!’ লোকটি হাঁ করে বসে রইল।

১৬. একবার নজরুলকে তাঁর বন্ধুরা খুঁজছেন। এ বাড়ি ও বাড়ি খোঁজা হচ্ছে। হঠাৎ দূর কোনো বাড়ি থেকে অট্টহাসির শব্দ কানে আসতেই নজরুলের খোঁজ মিলল। এমনই ছিল নজরুলের হাসির সুনাম।

নিজের হাস্যরসপূর্ণ চরিত্রকে নজরুল নিজেই তুলে ধরেছেন একটি হাসির গানে,

‘আমি দেখব হাসি

আমায় দেখলে পরে হাসতে হাসতে পেয়ে যাবে কাশি।

আমি হাসির হাঁসলী ফেরি করি এলে আমার হাসির দেশে

বুড়োরা সব ছোঁড়া হয়, আর ছোঁড়ারা যায় টেঁসে

আমার হাস-খালিতে বাড়ি, আমি হাসু-হানার মাসি।’

১৭. সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামকে ডাকতেন দাদু বলে। কবি আবার প্রায়ই সুফিয়া কামালের বাড়ি যেতেন। সেখানে গানের আসর বসত। সে আসরে সাহিত্য অনুরাগী অনেকেই থাকতেন। এ সময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। সাহিত্য অনুরাগীদের সঙ্গে মিশে কয়েকজন গোয়েন্দাও আসতেন। একদিন এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি জানি ঠিকঠিকই।’

কবিতার ধরন শুনে লোকটি মুখ লাল করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, ‘দাদু। তুমি একে চিনলে কী করে?’

‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’ নজরুলের উত্তর।

১৮. কাজী নজরুল ইসলাম একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন। পাশে সমবয়সী এক ভদ্রলোক হঠাৎ তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘এই শালা, তোর কাছে দেশলাই আছে?’

অপরিচিত এক লোকের এমন সম্ভাষণে কবি প্রথমে চমকে উঠলেন, তারপর বিরক্ত। কিন্তু পরক্ষণেই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে হেসে পকেট থেকে দেশলাইয়ের বাক্সটা তার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘লে বে শালা।’

ইটের বদলে পাটকেল খেয়ে অপরিচিত ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘পরিচয়ের একটু পরেই আমরা এই সম্ভাষণেই পৌঁছাতাম। তাই অনেক ভেবে ওখান থেকেই শুরু করেছি। কী, ঠিক করিনি?’

১৯. কাজী নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। একদিন তিনি ওখানে দোতলায় বসে আছেন। এমন সময় এক কমর্চারী এসে বললেন, ‘কাজীদা, ইন্দুদি (সংগীতশিল্পী ইন্দুবালা) আপনাকে নিচে ডাকছেন।’

এ কথা শুনে কবি সকৌতুকে বললেন, ‘আর কত নিচে নামব, ভাই?’

২০. যমুনাপারের শহর সিরাজগঞ্জে নিখিলবঙ্গ মুসলিম সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম সম্মেলনের সভাপতি। কবিকে উপলক্ষ করে দুপুরে বাংলোতে খাবারদাবারের ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। অতিথিরা সবাই খেতে বসেছেন। খাবার পরিবেশনকারী ছেলেটি কবিকে প্রথমে এক টুকরো ইলিশ দিলেন। প্রথম টুকরো শেষ হতেই দ্বিতীয় টুকরো তুলে দেওয়া হলো কবির পাতে। পদ্মার ইলিশ কবি খেতে লাগলেন পরম তৃপ্তিতে। এবার তৃতীয় টুকরো দেওয়ার জন্য ছেলেটি কাছে আসতেই কবি তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আরে, করছ কী? এত মাছ খেলে শেষকালে আমাকে বিড়ালে কামড়াবে যে!’

Untitled-1-Recovered

২১. প্রতিবেশীর মেয়ের আকিকা। বিশাল আয়োজন। বাড়িভর্তি লোকজনের আনাগোনা, আনন্দ-ফুর্তি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি দেখে তিনি অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। প্রতিবেশীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন রোগা-পটকা এক ঘোড়ার পিঠে বিদঘুটে চেহারার এক লোককে বসিয়ে। লোকটি দেখতেই শুধু বিদঘুটে নয়, তার পোশাকও অদ্ভুত—শতেক ছেঁড়া, ধুলাবালু মাখা। মুখভর্তি গোঁফদাড়ির জঙ্গল।

নজরুল বাড়ির গিন্নিকে ডেকে বললেন, ‘মাইজি, তোমার মেয়ের জন্য বর এনেছি। পছন্দ হয়নি?’

বাড়ির গিন্নি নজরুলের এমন রসিকতার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, ‘আমি তো বাপু ভেবে রেখেছি তোমার সঙ্গেই আমার মেয়ের বিয়ে দেব।’

বাড়িভর্তি মানুষের সামনে হঠাৎ উল্টো প্রস্তাব পেয়ে কিশোর নজরুলের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ঘোড়াসহ ওই বিদঘুটে লোকটিকে রেখেই দ্রুত চম্পট দিলেন সেখান থেকে।

২২. সাহিত্যরসিক গজেন ঘোষের বাড়িতে প্রায়ই তুমুল আড্ডা হতো। সে আড্ডায় কাজী নজরুল ইসলামও শরিক হতেন। একদিন হঠাৎ করে বলা-কওয়া নেই, কবি টেবিলের ওপর থেকে বই, অপ্রয়োজনীয় পুরোনো ময়লা কাগজপত্র সরাতে লাগলেন। তাতে ধুলো উড়তে লাগল। কবির কাণ্ড দেখে ঘোষমশাই বিচলিত হলেন, ‘আরে, করছ কী?’

নজরুল গম্ভীরভাবে বললেন, ‘অহল্যা উদ্ধার করছি।’

‘অহল্যা উদ্ধার?’

‘হ্যাঁ, এর কোমল হৃদয় পাষাণ হয়ে গেছে,’ নজরুল বললেন, ‘এর রিডগুলো পর্যন্ত টিপলে নামে না। এই পাষাণীর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করতেই হবে।’

আসলে টেবিলটি ছিল একটি অর্গ্যান।

২৩. নজরুলের গানের জলসায় পান থাকবে না, তা হয় না। পান আর গান—এ যেন একে অপরের পরিপূরক। একদিন আসরে বসে গানের ফাঁকে চা-মুড়ি পর্ব সেরে নজরুল পান মুখে দিতে যাবেন, এমন সময় এক ছোট্ট মেয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলল, ‘তুমি এত পান খাও কেন?’

নজরুল তার কথায় হো হো করে হেসে উঠে ততোধিক মিষ্টি স্বরে বললেন, ‘গান গাই যে!’

২৪. কবি নজরুল তখন থাকেন কৃ নগরে। তার বন্ধু মঈনুদ্দীন থাকেন বেচু ঠাকুরের গলিতে কারমাইকেল কলেজের হোস্টেলের পেছনে। তিনি একদিন দাওয়াত করলেন কবি নজরুলকে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কবিবন্ধু মইনুদ্দীনের বাসায় আয়োজন। খুব আহামরি কিছু নয়, তবে অন্যদিনের চেয়ে ভালো। নজরুল এলেন। সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলেন মঈনুদ্দীনের ঘর।

কবি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিরে?

বন্ধুর উত্তর, রান্নাঘর।

-আর ওটা?

-ওটা হলো পায়খানা।

কবি বলে উঠলেন, দূর শয়তান! পায়খানা কিরে? বল 'যায়খানা'। খানাতো ওখান দিয়েই যায় রে!!’ এটুকু বলেই হাসি। সে কী বিরাট প্রাণখোলা হাসি কবির। তার হাসির আওয়াজে জানালার কার্ণিশের আড়ালে বসে থাকা কবুতর পাখা মেলে ঝটপট করে উড়ে গেল।

২৫. পান জর্দা মুখে দিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন কবি নজরুল। এমন সময় এক লোক এল কবিকে সালাম করতে। দরজায় দাড়িঁয়ে সে বেশ জোরে আসসালামু আলাইকুম বলল। কবি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, 'আরে, দুর্গা দাসবাবুর মুখে আসসালামু আলাইকুম যে!'

উপস্থিত সবাই কবির এমন আজব কথা শুনে আগন্তুকের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে, লোকটি সত্যিই বাংলা নাট্যমঞ্চের বিখ্যাত নট দুর্গা দাসের মতো সুদর্শন। আগত লোকটি বিনীতভাবে বললেন, আমি বন্দোপধ্যায় নই, সৈয়দ। এই তো রায়পুরায় আমার বাড়ি।

একজন অচেনা মানুষকে এমন ভড়কে দিতে কবির আকস্মিক মন্তব্যে আবার হো হো করে হেসে গড়াল ঘরশুদ্ধ সব মানুষ।

২৬. গোপীনাথ নামে একজন ধুমকেতুর অফিসে এসে নানারকম আজব কান্ড দেখে কবিকে জিজ্ঞেস করে বসল, 'আপনাদের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে?'

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে কবি আবারও বলে উঠেন, 'দে গরুর গা ধুইয়ে, শোন, আনন্দ কোত্থেকে জাগে, তার উত্তর নেই, কিন্তু নিরানন্দ কেন হবে, তার উত্তর শুনতে চাই তোমার কাছে।'

গোপীনাথ জবাব দেয়, 'দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। এমন জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কীভাবে? প্রতিটি ইংরেজ আমাদের শত্রু, তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটবে আর আমরা হাসব, গাইব?'

ভরাট গলায় নজরুল তাকে বুঝালেন, 'এ শত্রুদের ভাসিয়ে দিতে হলে চাই প্রাণবন্যা, এরই আবাদ করছি আমরা এখানে।’ গোপীনাথ চুপ হয়ে শুনে ভাবুক হয়ে যায় কবির জবাব শুনে।

২৭. অনেকের হয়তো জানা নেই যে, আমাদের প্রিয় কবি নজরুল কিন্তু নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। অবাক হলেও কিছু করার নেই, কারণ তিনি ঐ নির্বাচনে জয়লাভ করেননি।

১৯২৬ সাল। মাসের নাম নভেম্বর। পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে কবি নজরুল কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্যপদপ্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দিতায় নেমেছিলেন। শুধু কি তাই, এ নির্বাচনী প্রচারের জন্য তিনি এসেছিলেন ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েক জায়গায়।

২৮. 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় এক কালে লিখতেন নজরুল। সেকালে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। কলকাতার এক বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী কবি নজরুলের কাছে এসে বায়না ধরলো, একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতে। কোম্পানিটির নাম ডোয়াকিন এন্ড সন্স। তাদের নির্মিত হারমোনিয়ামের জন্য কবি নজরুল তখনই কাগজ কলম নিয়ে বসে লিখে ফেললেন এই বিজ্ঞাপনটি--

'কি চান? ভাল হারমোনী??

কাজ কি গিয়ে-জার্মানী?

আসুন দেখুন এই খানে,

যেই সুর যেই গানে,

গান না কেন, দিব্যি তাই,

মিলবে আসুন এই হেথাই,

কিননি কিন, ডোয়ার কিন..

২৯. কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় আরেকটি কোম্পানি ছিল, বাহাদুর কোম্পানি। এটিও বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়ামের ব্যবসা করত। পত্রিকায় নজরুলের লেখা ডোয়াকিন কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে তারাও ছুটে এল কবি নজরুলের কাছে। তাদেরও দাবি, আমাদের জন্যও লিখে দিন এমন একটি বিজ্ঞাপন। কী আর করা? কবি আবারও লিখে ফেললেন--

'মিষ্টি বাহা বাহা সুর,

চান তো কিনুন ‘বাহাদুর’।

দুদিন পর বলবেনা কেউ-‘দূর দূর’,

যতই বাজান ততই মধুর মধুর সুর!!

করতে চান কি মনের প্রাণের আহা দূর?

একটি বার ভাই দেখুন তবে ‘বাহাদুর’,

যেমন মোহন দেখতে তেমনি শিরীন ভরাট,

বাহা সুর, চিনুন, কিনুন বাহাদুর।

এরপর কয়েক মাস ধরে একই পত্রিকায় এ দুটো বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল এক সাথে। কোম্পানিও ব্যবসা করেছিল দেদারসে।

৩০. পাড়ায় নতুন জামাই এসেছে। নজরুল বন্ধুদের নিয়ে ফন্দি আঁটলেন জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা খসাতে হবে। তিনি জামাইকে গিয়ে বললেন, 'নতুন জামাইদের দরমা পীরের দরগায় যেতে হয়। চলুন। নইলে অকল্যাণ হবে।'

নজরুলের বুদ্ধিতে একটা পোড়ো বাড়ির মধ্যে 'দরমা ঘর' আগে থেকেই লাল কাপড়ে ঢেকে রাখা হলো। জামাই সেখানে গিয়ে সালাম করে নগদ সালামি দিলেন। অথচ 'দরমা' মানে হলো হাঁস-মুরগির ঘর। যাই হোক, এবার বন্ধুরা মিছিল করে জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি এসে উপস্থিত হলো। গেটে দাঁড়িয়ে নজরুল ছড়া কাটতে শুরু করলেন :

মাসি গো মাসি

তোমার জামাইয়ের দেখ হাসি

দরমা পীরে সালাম দেওয়ালাম

খাওয়াও মোদের খাসি।
http://www.earki.com/jokes/joke/885/কাজী-নজরুল-ইসলামের-জীবনের-৩০টি-মজার-ঘটনা

বাংলা সিনেমার নজরুল



বাংলা সিনেমার নজরুল
আহমাদ মাযহার |
ধ্রুব (১৯৩৪)ছবিতে নবীন নারদের ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম
……
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নানাদিক-অভিমুখী সৃষ্টিমাতাল এক মানুষ। ভারতবর্ষের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের এমন এক যুগে তাঁর জন্ম যখন এ-অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সবে জেগে উঠতে শুরু করেছে। ইহজাগতিকতা ও মানবিকতার বোধ, অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা, তীব্র আত্মজাগরণাকাঙ্ক্ষা ও সিসৃক্ষার উদ্দীপনা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য তখন বাংলাদেশের বেশ কিছু মানুষের মধ্যেই স্ফুরিত হয়েছিল। সকলেই হয়তো স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার তুঙ্গকে স্পর্শ করতে পারেন নি, জীবনের সামগ্রিক সংগ্রামের চিহ্নও হয়তো উজ্জ্বলিত হতে পারে নি তাঁদের কারও কারও
—————————————————————–
রবীন্দ্রনাথের গান সঠিক সুরে গাওয়া হয়নি এই মর্মে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুমোদন বোর্ড গোরা (১৯৩৮) ছবিটি সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছিল। ফলে ছবি মুক্তির ব্যপারে সৃষ্টি হয়েছিল জটিলতা।… নজরুল কিছুমাত্র চিন্তা না করে ছবির ফিল্ম এবং প্রজেক্টর নিয়ে সোজা বিশ্বভারতীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কী-কাণ্ড বল তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন্‌ আক্কেলে তার দোষ ধরে। তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানে মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’ নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি খসড়া অনুমোদনপত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলেন।
—————————————————————-
জীবনে। কিন্তু স্বীকার করতে হবে যে এই অঞ্চলের বেশ কিছু ব্যক্তিমানুষের মধ্যে উপর্যুক্ত মানবিক বোধসমূহের জাগরণ দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছিল। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সেইসব মানুষদের মধ্যেও অগ্রগণ্য। বাংলার রেনেসাঁসের উপর্যুক্ত প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো বিপুলভাবে সমাহৃত হয়েছিল নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবনে। সামগ্রিকভাবে নজরুল সম্পর্কে এ-কথা মনে রাখলে আমাদের পক্ষে অনুভব করতে সুবিধা হবে চলচ্চিত্রের মতো নতুনতর শিল্পমাধ্যমে তাঁর যুক্ত হবার সূত্রকে।

সবাক চলচ্চিত্রের সূচনাকালের অর্থাৎ নজরুল যে-সময়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সে-সময়কার যে কোনও চলচ্চিত্র দেখতে বসলে আজকের চলচ্চিত্র দর্শকরা হয়তো অনুভব করবেন যে, তখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্র তার নিজস্ব ভাষা অর্জন করতে পারে নি। প্রেমাংকুর আতর্থী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো বাংলাভাষার শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকদের কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে নানা ভাবে যে যুক্ত ছিলেন সে-কথাও প্রসঙ্গত উল্লিখিত হতে দেখা যায়। নজরুলের যুক্ততাও তাঁদেরই সমসাময়িক কালে। কিন্তু আশির দশকের বা তার আগের লেখা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসধর্মী বইগুলোতে নজরুলের যুক্ততার কথা তেমনভাবে উল্লিখিত হতে দেখা যায় না। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের গবেষকবৃন্দ মূলত বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার তথ্যগুলো উদ্ঘাটন করেছেন। প্রসঙ্গত নজরুল গবেষক আসাদুল হক এবং অনুপম হায়াৎ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার সকল না হলেও অধিকাংশ খবর তাঁরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান প্রবন্ধের তথ্যভিত্তিও মূলত এই দুই নজরুল-গবেষকের বই কিংবা রচনাসমূহ।

চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার কালে ছবিতে বাস্তবতার অভাব ছিল, চিত্রনাট্য ছিল শিথিল, সংলাপ একদিকে ছিল আড়ষ্ট, অন্যদিকে সেকালের মঞ্চঘেঁষা। বেশ কিছু ছবি পাওয়া যায় যেগুলো হলিউডের অনুকরণে নির্মিত। সামাজিক ছবি, পৌরাণিক ও ধর্মমূলক ছব—সত্যজিৎ রায়ের মতে সে-সময়ের চলচ্চিত্র ছিল প্রধানত এই তিন রকম। কমবেশি এই তিনধরনের ছবির সঙ্গেই নজরুল যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ লেখক, সংগীতকার, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, গায়ক ও সংগঠক ইত্যাদি বিচিত্র ক্ষেত্রে। তবে প্রধানত যুক্ত ছিলেন সংগীতকার হিসাবেই। মনে রাখতে হবে যে, উনিশ শো বিশ তিরিশের দশকে বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলা গানের রেকর্ড বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে নজরুল ছিলেন রীতিমতো ঐ জগতের তারকাখ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তখনকার সেরা শিল্পীদের গ্রামোফোনের জন্য গান শেখাচ্ছিলেন তিনি। বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর লেখা ও সুরকরা গানের তখন তুমুল জনপ্রিয়তা। চলচ্চিত্রে তখন সবেমাত্র শব্দ যোজনার কারিগরি সুবিধা যুক্ত হয়েছে। নির্মাতারা চলচ্চিত্রে সংগীত সংযোজন করার মধ্যে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তা ছাড়া সেকালে কলকাতা কেন্দ্রিক পেশাদার নাট্যচর্চাও বিনোদনপ্রত্যাশীদের কাছে ছিল আদরণীয়। নজরুল নিজে নাট্যকার তো ছিলেনই, পেশাদার নাট্যচর্চার সঙ্গেও সংগীতসূত্রেই কিছুটা যুক্ততা ঘটেছিল তাঁর। চলচ্চিত্র নতুন শিল্পমাধ্যম হলেও নজরুলও তাঁর সৃষ্টিশীলতার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দেখতে পেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের নিকটসম্পর্ককে। সংগীত এবং নাটকে তাঁর সৃষ্টিশীলতা যে চলচ্চিত্রের কাজে আসবে তা নজরুল অনুভব করেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব হয়েছিল। শেখ দরবার আলম [অজানা নজরুল, ঢাকা (১৯৮৮)] উদ্ধৃত কলকাতার বঙ্গবাণী পত্রিকায় ১৯৩১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে আমরা জানতে পারি যে ম্যাডান থিয়েটার্সে চলচ্চিত্রের জন্য নজরুলকে সুরভাণ্ডারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সুরভাণ্ডারীর দায়িত্ব সংগীত পরিচালকের চেয়ে ওপরের স্তরের। সুরভাণ্ডারী হিসাবে তাঁর দায়িত্ব কী ছিল সে সম্পর্কে বঙ্গবাণীর সংবাদে আমরা জানতে পারি যে,

[…] ম্যাডান থিয়েটারস লিমিটেড বাঙ্গালা গানের টকি নির্মাণ করিতেছেন। প্রসিদ্ধ কবি ও সঙ্গীতকার নজরুল ইসলামকে সুর-ভাণ্ডারী নিযুক্ত করিয়াছেন। তাঁহাদের এ মনোনয়ন যথার্থ হইয়াছে, কারণ অধুনা বাঙ্গালার তরুণ কবিদের মধ্যে নজরুল ইসলাম রচয়িতা ও সুরকার হিসেবে শ্রেষ্ঠ। বর্তমানে কিছুকাল ম্যাডান কোম্পানী নট-নটীদের সুর পরীক্ষার জন্য কেবল গান-আবৃত্তির সবাক চিত্রই নির্মাণ করিবেন। পরে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি তাঁহারা সবাক করিয়া তুলিবেন বলিয়া শুনা যাইতেছে।
[দৈনিক বঙ্গবাণী, ৯ ফাল্গুন, ১৩৩৭, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১, কলকাতা]
সুরভাণ্ডারী পদে নজরুলকে নিয়োগ দেবার পর ১৯৩১ সালের প্রথম দিকেই ম্যাডান থিয়েটার্সের উদ্যোগে আনুমানিক তিরিশ চল্লিশটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল বলে আসাদুল হক এবং অনুপম হায়াৎ জানাচ্ছেন। বিভিন্ন সূত্রে ১৯৩১ সালে ম্যাডান থিয়েটার্স নির্মিত সবাক খণ্ড চিত্রগুলির মধ্যে কয়েকটির নামও পাওয়া গেছে। নাম জানা গেছে যে-সব ছবির সেগুলো হচ্ছে: ১. জামাই ষষ্ঠী ২. জোর বরাত ৩. ঋষির প্রেম ৪. তৃতীয় পক্ষ ৫. প্রহ্লাদ ৬. লায়লো। বঙ্গবাণীর সংবাদভাষ্যকে বিবেচনায় রাখলে সুরভাণ্ডারী হিসাবে এই ছবিগুলোর সঙ্গে নজরুলের যুক্ত থাকবার কথা। কিন্তু ছবিগুলোর সঙ্গে নজরুল কতটা যুক্ত ছিলেন সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত তথ্য এখনও জানাতে পারেন নি। অনুপম হায়াৎ ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত তাঁর চলচ্চিত্র জগতে নজরুল (১৯৯৮) বইয়ে লিখেছেন,

[…] কালীশ মুখোপাধ্যায় ও গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ বা অন্য কোন চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ ম্যাডান থিয়েটার্স কর্তৃক নির্মিত পরীক্ষামূলক সবাক খ-চিত্রে নজরুলের অংশগ্রহণ সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেন নি।
অনুপম হায়াৎ তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ে আরও জানাচ্ছেন ১৯৩৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল পায়োনীয়ার ফিল্ম কোম্পানির ফিল্ম ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। এ সংবাদ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত সওগাত পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল। অনুপম হায়াৎ সওগাত পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৮১, ঢাকা পত্রিকায় প্রকাশিত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘সওগাত ও নজরুল’ রচনার উদ্ধৃতি দেন। ঐ রচনায় উদ্ধৃত সওগাত-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল:

[…] কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ইনি সমপ্রতি পায়োনীয়ার ফিল্ম কোম্পানীর ফিল্ম ডিরেক্টার নিযুক্ত হইয়াছেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইতিপূর্বে আর কেহ ছায়াচিত্র জগতে এরূপ উচ্চ পদের অধিকারী হন নাই। আমরা কবিকে তাহার এই সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি।
তবে অশোককুমার মিত্রের লেখা ঢাকা থেকে প্রকাশিত নজরুল প্রতিভা পরিচিতি (১৯৬৯) বইয়ের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তাঁর লেখা পূর্বোক্ত বইয়েই অনুপম হয়াৎ আরও জানাচ্ছেন:

[…] ১৯৩১ সালের অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক সাফল্য লইয়া যখন সবাকচিত্র সর্বপ্রথম কলকাতায় চিত্রগৃহে আত্মপ্রকাশ করে এবং যখন কেবলমাত্র সংক্ষিপ্ত নমুনামূলক বাংলা সবাকচিত্র ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড কর্তৃক পরিবেশিত হয়; তখনই আমরা দেখিয়াছি সবাকচিত্রের মাধ্যমে কাজী নজরুলকে বলিতে শুনিয়াছি তাহার উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তি:
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ ও নারী
কোন ভেদাভেদ নাই।
বাংলা সবাক ছায়াচিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ইহার পরে ১৯৩৪ সালে পায়োনীয়ার ফিল্মের পূর্ণদৈর্ঘ্য ধ্রুব সবাকচিত্রেও তাহাকে এক সঙ্গীত মুখর ভূমিকায় দেখা গিয়েছে।

যে-কটি চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুলের যুক্ততার কথা আসাদুল হক এবং অনুপম হায়াৎ তাঁদের বইয়ে বা বিভিন্ন প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন সেগুলোর নাম নিচে দেয়া হল। সেই সঙ্গে দেয়া হল নজরুল কীভাবে যুক্ত ছিলেন তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
১. কপালকুণ্ডলা (১৯৩৩) ছবিতে নজরুল যুক্ত ছিলেন গীতিকার হিসাবে।
২. ধ্রুব (১৯৩৪) ছবিটির অন্যতম পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম; ছিলেন অন্যতম গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক। ছবিটি যেহেতু গান নির্ভর সেহেতু নজরুলের ভূমিকা ছিল এখানে ব্যাপক। ছবিতে ব্যবহৃত মোট ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গানই ছিল নজরুলের লেখা, ১টি গিরিশচন্দ্র ঘোষের, নজরুল নিজে ৩টি গান গেয়েছিলেন, একটি মাস্টার প্রবোধের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। বোধ হয় এই চলচ্চিত্রে নজরুলের নারদের ভূমিকায় অভিনয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলতে হবে। মুসলমান হয়েও নারদের ভূমিকায় নজরুল অভিনয় করে পরিচয় দিয়েছিলেন সাহসের। কারণ তখন মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক কারণে ও ধর্মীয় গোঁড়াদের ভয়ে চলচ্চিত্রে অংশ নিতেই ছদ্ম হিন্দু নামের আড়াল নিতেন। অনুপম হায়াতের মতে: ধ্রুবর মাধ্যমে নজরুল বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম চলচ্চিকার হিসাবে আবির্ভূত হন। খগেন্দ্রনাথ রায়কে উদ্ধৃত করে তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ে অনুপম হায়াৎ আরও জানাচ্ছেন:

[…] ধ্রুব ছবির অভিনয়ে নজরুল নতুনত্ব এনেছিলেন নারদ চরিত্রের মেকআপে। তিনি অশীতিপর নারদকে আটাশে নামিয়ে আনেন, পোশাকও বদলে ফেলেন। নজরুলের এই বিদ্রোহ ও নরনারদী রূপ নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন মহলে তুমুল সমালোচনা হয়। কিন্তু নজরুল তাঁর যুক্তি দিয়ে বলেছেন, আমি চিরতরুণ ও চিরসুন্দর প্রিয় নারদের রূপই দেবার চেষ্টা করেছি।
৩. পাতালপুরী (১৯৩৫) ছবিতে নজরুল ছিলেন গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক। বাল্যবন্ধু কথাসাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে নজরুল এই ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
৪. গ্রহের ফের (১৯৩৭) ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন নজরুল।
৫. বিদ্যাপতি [বাংলা] (১৯৩৮) ছবিতে নজরুলের যুক্ততা গীতিকার হিশেবে। রাইচাঁদ বড়াল নজরুল বিষয়ে স্মৃতিচারণের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, বিদ্যাপতি এবং সাপুড়ে ছায়াছবির চিত্রনাট্য ও সংলাপ কাজীদারই লেখা। [সূত্র: গানের কাগজ, কলকাতা, ৪র্থ বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৭৬]
৬. বিদ্যাপতি [হিন্দী] (১৯৩৮) ছবিতেও নজরুলের লেখা গান ব্যবহৃত হয়েছিল বলে জানা যায়।
৭. গোরা (১৯৩৮) রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ভিত্তিতে নির্মিত চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। কলকাতা থেকে আবদুল আজিজ আল আমান সম্পাদিত কাফেলা পত্রিকার [আশ্বিন সংখ্যা ১৩৮৯, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৮২, পৃষ্ঠা-৩৭] ‘মুক্তবিহঙ্গ-স্বর্ণপক্ষ ঈগল, নিতাই ঘটকের সাক্ষাৎকার’ রচনার তথ্য ব্যবহার করে আসাদুল হক জানাচ্ছেন যে, ছবি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর মুক্তি পাবার অল্পদিন আগে রবীন্দ্রনাথের গান সঠিক সুরে গাওয়া হয়নি এই মর্মে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুমোদন বোর্ড গোরা ছবিটি সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছিল। ফলে ছবি মুক্তির ব্যপারে সৃষ্টি হয়েছিল জটিলতা। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দেবদত্ত ফিল্মস এ ঘটনা নজরুলকে জানালে নজরুল কিছুমাত্র চিন্তা না করে ছবির ফিল্ম এবং প্রজেক্টর নিয়ে সোজা বিশ্বভারতীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কী-কাণ্ড বল তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন্‌ আক্কেলে তার দোষ ধরে। তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানে মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’ নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি খসড়া অনুমোদনপত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলেন। ছবিটি না দেখেই রবীন্দ্রনাথ অনুমতিপত্রে সম্মতি স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও নজরুলের লেখা এবং সুর করা গান ‘ঊষা এলো চুপি চুপি, সলাজ নিলাজ অনুরাগে’ এ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।
৮. সাপুড়ে [বাংলা] (১৯৩৯) ছবির ৭টি গান নজরুলের লেখা। এই গানগুলোর সুরও তাঁর নিজেরই করা। ময়মনসিংহ গীতিকার গল্প অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য এবং সংলাপও যে নজরুলেরই লেখা সে-ব্যাপারে রাইচাঁদ বড়ালের লেখার সাক্ষ্য আমরা আগেই দেখিয়েছি।
৯. সাপেড়া [হিন্দী] (১৯৩৯) ছবিটিও সাপুড়ে-এর পাশাপাশি নির্মিত হয়েছিল। বাংলা সাপুড়ে ছবির আর হিন্দি সাপেড়া নজরুলের কাহিনী অবলম্বনে গড়ে উঠেছে। ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল সংগীত (২০০৫) বইয়ে আসাদুল হক জানাচ্ছেন,

এই ছবির কাহিনীকার, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। সব গানের সুরকার নয় শুধু তাঁর নিজের রচিত গানের সুরকার তিনি ছিলেন। এ ছায়াছবির বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় নি। নজরুল কী কী অংশে কাজ করেছেন তা কারো স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়নি।
১০. নন্দিনী (১৯৪১) ছবির জন্য পরবর্তী কালে বিখ্যাত হয়েছিল এমন দুটি গান রেকর্ড হয়েছিল। একটি ‘চোখ গেল পাখিরে..’ অন্যটি ‘পদ্মার ঢেউরে..’ । শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘পদ্মার ঢেউরে..’ ব্যবহৃত হয় নি।
১১. চৌরঙ্গী [হিন্দী] (১৯৪২) চলচ্চিত্রের কটি গানের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল তা এখনও জানা যায়নি। নজরুল সংগীত (২০০৫) বইয়ে আসাদুল হক জানাচ্ছেন যে,

আমার সংগ্রহে একটি গ্রামোফোন রেকর্ড আছে এতে দুটো গান আছে গান দুটোর প্রথম লাইন যথাক্রমে: চৌরঙ্গী হ্যায় ইয়ে চৌরঙ্গী এবং সারাদিন ছাতপিঠী হাতুহুঁ দুখাইরে। গ্রামোফোন রেকর্ডের উপরে লেখা আছে-কথা ও সুর: কাজী নজরুল, বাকী গানগুলি রচনা করেনে জীগ্যর মুরাদাবাদী, মীর্জা গালিব, আরজু লাখনউভি, এবং প্রতাপ লাখনউভি। সার্বিক সঙ্গীত পরিচালনায় নজরুল।
ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের তথ্যসুত্রে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে জানান যে, এই ছবির জীগ্যার মুরাদাবাদী এবং মীর্জা গালিব এর গান দুটির সুর করেছেন নজরুল।
১২. চৌরঙ্গী [বাংলা] (১৯৪২) ছবিতে নজরুলের লেখা ও সুর করা ৮টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। ছবির সার্বিক সংগীত পরিচালনার দায়িত্বও ছিল তাঁর।
১৩. দিকশূল (১৯৪৩) ছবিতে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুরে নজরুলের ২ টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৪. অভিনয় নয় (১৯৪৫) ছবিতে গিরিন চক্রবর্তীর সুরে নজরুলের একটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। নজরুলের গানটি ছিল, ‘ও শাপলা ফুল নেব না, বাবলা ফুল এনে দে’। শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং শেফালি ঘোষের দ্বৈতকণ্ঠে গানটি গীত হয়েছে।
১৫. শহর থেকে দূরে [সাদাকালো, ৩৫ মি:মি:] (১৯৪৩) ছবির অন্যতম গীতিকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আসাদুল হক তাঁর খসড়া রচনায় জানিয়েছেন:

টাইটেলে নজরুলের নাম পাওয়া যায়। অভিনয়াংশে এক জায়গায় চেয়ারম্যানের পুত্র জুতা পালিশ করতে করতে নজরুলের—’কে বিদেশী বন উদাসী’ গানটির দুটি লাইন খালি গলায় গায়।
এই কটি চলচ্চিত্রে তাঁর সচেতন যুক্ততার পরিচয় পাওয়া যায়। শহর থেকে দূরে ছবিতে তাঁর স্বয়ং যুক্ততার ব্যাপারে আমার নিজের অবশ্য সন্দেহ আছে। পরবর্তীকালেও অনেক ছবিতে তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছে। সেগুলো চলচ্চিত্রের সঙ্গে সজ্ঞান যোগ নয় বলে সেগুলো এই রচনার উপজীব্য করা হয় নি।

এতক্ষণ চলচ্চিত্রে নজরুলের সম্পৃক্ততার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল তা থেকে এ-কথা নিশ্চয় করে বলা যায় যে তিনি পরিচালনা, কাহিনী চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, সংগীত পরিচালনা ও অভিনয়ে যুক্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে তাঁর সাংগীতিক ব্যক্তিত্বই সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নজরুল যখন বাংলার সংগীতাঙ্গনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন সেই সময়েই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অগ্রযাত্রায় চলচ্চিত্রে ধ্বনি সংযোজনের সুবিধা যুক্ত হয়। সামগ্রিক অবস্থা দৃষ্টে এ-কথা মনে করা গিয়েছিল যে চলচ্চিত্র মাধ্যমটির ওপর ধ্বনিশিল্পের প্রভাব বাড়বে। বাংলা গানের তখন যে স্বর্ণযুগ চলছিল তাতে গানের জগতের মানুষের ডাক পড়বারই কথা। সেই সূত্রে নজরুলের মতো সংগীতপ্রতিভার পক্ষে চলচ্চিত্রের অঙ্গনে আবির্ভাব ছিল খানিকটা অনিবার্য।

শুরুতে বলা হয়েছিল নজরুল ছিলেন রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল একজন মানুষ। সেই আলোকে এ-কথাও বলা যায় চলচ্চিত্র মাধ্যমে তাঁর অংশ নেয়া সেকালের মুসলিম সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি অংশ নিয়ে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্র যখন নিজস্ব শিল্পভাষায় কথা বলতে শেখে নি সে-সময় চলচ্চিত্রের মতো মাধ্যমে এত ব্যাপ্তভাবে তাঁর যুক্ত থাকাটাই ছিল বিপ্লবী ভূমিকার সমান। বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রযাত্রায় নজরুলের এই ভূমিকাও তাঁর অপরাপর ব্যক্তিত্বশালিতার পরিপূরক। সেজন্য চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর অংশগ্রহণকে কেবল নান্দনিক সাফল্য অন্বেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঠিক হবে না। দেখতে হবে সামাজিক অগ্রযাত্রার দৃষ্টিকোণ থেকেও। তবে যদি চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণকারী নজরুলের নান্দনিক সাফল্য খুঁজতে চাওয়া হয় তাহলে প্রধানত সুরস্রষ্টা নজরুলকেই উদ্ভাসিত দেখা যাবে।

১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬/২৫ মে ২০০৯

ahmadmazhar01@yahoo.com
http://arts.bdnews24.com/?p=2454

কাজী নজরুল ইসলাম: এক স্বয়ম্ভর সংগীতসভা



কাজী নজরুল ইসলাম: এক স্বয়ম্ভর সংগীতসভা
আবদুশ শাকুর |

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (১৮৬১-১৯৪১) যদি বলি মহাবাগ্মেয়কার, কাজী নজরুল ইসলামকে (১৮৯৯-১৯৭৬) বলতে হয় মহাসংগীতকার। রবীন্দ্রনাথ যদি হন বাংলা গানের প্রাণ, নজরুল তবে বাংলা গানের মন। এভাবে প্রাণ ও মনের দুই প্রতিনিধির ‘প্রাণমন লয়ে’ বাংলা গানের দেহটি গড়ে উঠেছে বলে এ-গানের আলোচনা প্রসঙ্গে দুজনের কথাই এসে পড়ে, যেন এক অনিবার্য পরম্পরাতেই। একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে।

১৯৭৩ সালে পিজি হাসপাতালে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের পরদিন সকালে আমাকে কেবিনে ফিরিয়ে আনার পরেই আমি এপাশ-ওপাশ মাথা খুঁড়ে কর্তব্যরত ডাক্তারের কাছে প্রাণে বাঁচার মিনতি জানাচ্ছিলাম এই বলে:

‘তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি ডক্টর। একটুখানি হলেও পানি দিন আমার কণ্ঠে!’

জবাবে নিশ্চিন্ত ডাক্তার মৃদু হেসে বলেছিলেন:

‘দেহের জলীয় চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনানুযায়ী পানি আমি আপনার ধমনীতে দিচ্ছি, ইন্ট্রাভিনাস ইনফিউশন পদ্ধতিতে। অতএব আপনি নিশ্চিত থাকুন—আপনার কণ্ঠ পানি বিলকুল না-পেলেও প্রাণ পুরোপুরিই পাচ্ছে। সুতরাং পানির অভাবে প্রাণে মরার কোনো কারণ নেই আপনার।’

বললাম:

‘প্রাণে বাঁচলে কি হবে ডাক্তার, তৃষ্ণার জ্বালা তো মিটছে না।’

বললেন:

‘ওটা মস্তিষ্কের তৃষ্ণা-কেন্দ্র দ্বারা সৃষ্ট সংবেদন, সে বেদন মেটাতে আমরা এ-মুহূর্তে পারব না। কতক্ষণে পারব তাও নির্ভর করবে অপারেশনোত্তর অনেক অজানা ফ্যাক্টর জানার ওপর। সুতরাং যত কষ্টই হোক, আজকের মতো সে-জ্বালা আপনাকে সয়েই যেতে হবে।’

পরের দিন সে-জ্বালা প্রথম বারের মতো মেটানোর সময়ে আমার সর্বশরীরে যেন পুলকের লহর বয়ে গেল এবং হঠাৎ মনে হল—কণ্ঠ দিয়ে যে-মধু এখন যাচ্ছে এ হচ্ছে নজরুলসংগীত। আর কাল বিকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ধমনি দিয়ে যে-সুধা যাচ্ছিল সে ছিল রবীন্দ্রসংগীত। অন্য কথায়, রবীন্দ্রসংগীতের কাব্যের লীলা প্রাণের পাওনা মেটালেও মনের চাহিদা মেটানোর জন্য নজরুলসংগীতের সুরের খেলা লাগে। কারণ রবীন্দ্রসংগীত প্রাণের আরাম হলে, নজরুলসংগীত মনের ব্যায়াম। দুয়ের মধ্যেকার এই বৈষম্য একেবারে বৈজিক, বরঞ্চ বলা যায় বংশগত। বংশ বলতে বোঝাচ্ছি সংগীতবংশ—ধ্রুপদ ও খেয়ালের।

খেয়াল ধারার নজরুলসংগীতই শুধু বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু, ধ্রুপদ ঘরানার রবীন্দ্রসংগীত নয়।

উনিশ শতকের বিশের দশকে কলকাতায় লেখক-গায়কদের দুটি বিখ্যাত আড্ডা ছিল। একটি মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতী-অফিসে, ‘ভারতীর আড্ডা’, যেখানে আসতেন—অতুলপ্রসাদ সেন, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ। অপরটি গজেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের বাড়ির ‘গজেনদার আড্ডা’। এখানে আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উস্তাদ কারামাতুল্লা খাঁ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নরেন্দ্রদেব প্রমুখ। দুটি আড্ডাতেই যাতায়াত ছিল নজরুলের।ওই সব আড্ডাতে নজরুলের তৎপরতা সম্পর্কে হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩) লিখেছেন:

‘নজরুল আসতে লাগলেন প্রত্যহ… ঝড়ের মত ঘরে ঢুকেই সবাইকে চমক দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’! কোন দিকে দৃকপাত না করে প্রবল পরাক্রমে আক্রমণ করেন টেবিল হারমোনিয়ামটাকে, তারপর মাথার ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে গাইতে থাকেন গানের পর গান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ’লে যায়, নজরুলের গান আর থামে না।… কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের উপরে ঘর, রাস্তায় জ’মে যেত জনতা। অনেক বড় বড় গায়ক সে ঘরে এসে গান গেয়েছেন, তবু তাঁদের গান শোনবার জন্য অত লোক দাঁড়িয়ে যেত না। কিন্তু নজরুলের গানের ভিতরে নিশ্চয়ই ছিল কোন বিশেষ আকর্ষণী শক্তি। তিনি তখনও নিয়মিতভাবে গান রচনা করে নিজের সুর দিয়ে গাইতে শুরু করেন নি।’ (যাঁদের দেখেছি, দ্বিতীয় পর্ব)।

মহর্ষির প্রপৌত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-৭৪) লাঙ্গল অফিসে নজরুলের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর যাত্রী গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে (অভিযান পাবলিশিং হাউস, কলিকাতা, ১৩৫৭) এবং নজরুলের গলার সুর সম্পর্কে লিখেছেন:

nazrul22.jpg‘…নজরুলের সঙ্গে আলাপ জমে গেলো। সে কবিতা পড়লো গান গেয়ে শোনালো। আমিও তাকে গান শোনালাম। কি ভালোই লেগেছিলো নজরুলকে সেই প্রথম আলাপে। সবল শরীর; ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটি যেন পেয়ালা, কখনো পেয়ালা খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সদাই ভরপুর।… গলার স্বরটি ছিলো খুব ভারী… কিন্তু সেই মোটা গলার সুরে ছিলো যাদু। ঢেউয়ের আঘাতের মতো, ঝড়ের ঝাপটার মতো তার গান আছড়ে পড়তো শ্রোতার বুকে।… প্রাণ ছিল তার ঐ হাসির মতোই প্রবল ও দরাজ।… প্রবল হতে সে ভয় পেত না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাংলাদেশে। এমন সহজ গতি, আবেগের আগুন-ভরা কবিতা বাংলা সাহিত্যে বিরল।… ‘লাঙ্গলে’ বের হলো নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি। একদিনের মধ্যে ‘লাঙ্গল’ সব বিক্রি হয়ে গেলো, সেই সংখ্যাটা আমাদের আবার ছাপতে হলো। নজরুলের কবিতাই ছিলো ‘লাঙ্গলে’র প্রধান আকর্ষণ।’ (পৃ. ১০৮, ‘কাজী নজরুল ইসলাম/জীবন ও সৃষ্টি’, রফিকুল ইসলাম)।

প্রসঙ্গত বুদ্ধদেব বসু তাঁর ১৯৪৪ সালে রচিত ও কালের পুতুল গ্রন্থে সংকলিত ‘নজরুল ইসলাম’-নামক প্রবন্ধে কাজীর গান গাওয়ার আকর্ষণ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে লেখেন:

‘কথার চেয়ে বেশি তাঁর হাসি, হাসির চেয়ে বেশি তাঁর গান। একটি হার্মোনিয়ম এবং যথেষ্ট পরিমাণে চা এবং পান দিয়ে একবার বসিয়ে দিতে পারলে তাঁকে দিয়ে একটানা পাঁচসাত ঘন্টা গান গাওয়ানো কিছুই নয়। গানে তাঁর আন্না নেই; ঘুমের সময় ছাড়া সবটুকু সময় গাইতে হলেও তিনি প্রস্তুত। কণ্ঠস্বর মধুর নয়, ভাঙা-ভাঙা খাদের গলা, কিন্তু গান গাওয়ায় এমন একটি আনন্দিত উৎসাহ, সমস্ত দেহ-মন-প্রাণের এমন একটি প্রেমের উচ্ছ্বাস ছিলো যে আমরা মুগ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনেছি। সে-সময়ে গান রচনা করতেও দেখেছি তাঁকে—হার্মোনিয়ম, কাগজ আর কলম নিয়ে বসেছেন, বাজাতে-বাজাতে গেয়েছেন, গাইতে গাইতে লিখেছেন। সুরের নেশায় এসেছে কথা, কথার ঠেলা সুরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেবারে ঢাকায় যেসব গান তিনি লিখেছিলেন সেগুলি প্রায় সবই স্বরলিপি সমেত ‘প্রগতি’তে বেরিয়েছিলো।’ (লেখাটি ১৯৬৬ সালে ভারবি প্রকাশিত বুদ্ধদেবের ‘প্রবন্ধ সংকলন’-এও অন্তর্ভুক্ত হয়)।

এক স্মৃতিচারণায় নজরুলের গলা এবং গাওয়ার আকর্ষণ সম্পর্কে অসাধারণ গায়ক ও বিরল সংগীতগুণী দিলীপকুমার রায় বলেন:

‘কত সভায় এবং চ্যারিটি কনসার্টেই না সে আমাদের গানের পরে এই ভাবের নানা গান গাইত ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে ভাঙা গলায়। কিন্তু এমন গাইত যে, ভাঙা গলাকেও ভাঙা মনে হত না আগুন ছুটিয়ে দিত সে। এমন প্রাণোন্মাদী গায়ক কি আর দেখব এ-মনমরা যুগে? সত্যি আমাদের অবাক লাগত ভাবতে ভাঙা গলায়ও কোন জাদুতে কাজী এমন অসম্ভবকে সম্ভব করত দিনের পর দিন—ভাবের ঢলে পাথরের বুকে আলোর ঝর্না বইয়ে।’ (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিচারণী তর্পণ, দিলীপ কুমার রায়, ধর্মবিজ্ঞান ও শ্রীঅরবিন্দ, বাক্সাহিত্য প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা)।

একই স্মৃতিচারণায় দিলীপ কুমার রায় সংগীতে নজরুলের অবদান প্রসঙ্গে বলেন:

‘ওর নানা কবিতা সুন্দর হলেও ওর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ হয়েছে ওর গানেই বলব। এ কথায় ওর অনুরাগীদের ক্ষুণ্ন হওয়া উচিত নয়। রবীন্দ্রনাথও কি বলেননি যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান তাঁর গান? কাজীর সম্বন্ধেও ঐ কথা। আর সেইজন্যেই আমার মনের সঙ্গে ওর মনের সুর পুরোপুরি মিলত এসে এই গানেরই অন্দরমহলে, কবিতার রঙমহলে নয়।’

এই সূত্রেই নজরুলের গানের প্রতি সমকালীন সংগীতসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে দিলীপকুমার রায় এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর বেশ মনে ধরেছিল নজরুলের গজলের লঘু রাগসাংগীতিক চাল, যা তাঁর গলায় খেলতোও দারুণ। এই শাস্ত্রীয় সংগীতের রসের বশেই পরে তিনি নজরুলের প্রায় সকল ধরনের গানই গাইতেন। বাংলায় উর্দু গজলের মতো গজল গানের প্রচলন হওয়া ছিল তাঁর খুবই কাম্য একটি বস্তু। নানা প্রসঙ্গে দিলীপ রায় তাঁর এই অভিপ্রায় জ্ঞাপনও করতেন। তাঁর কামনা ছিল শ্রেষ্ঠ ফার্সি কবিদের গজলের মানের বাংলা গজল। কেননা তাঁর মতে উর্দুতে উচ্চমানের কবি নেই (এ এক অপার বিস্ময়েরই ব্যাপার যে শ্রীরায়ের মতো দিল্লি-লখনৌ-ঘোরা একজন রসপণ্ডিত গালিব-মোমিন-জাওক-জাফরের মতো বিশ্বমানের কালজয়ী গজলিয়াদের রসাবধারণে বঞ্চিত ছিলেন)।

যাহোক, নজরুল রচিত গজল এক বিশিষ্ট রূপবন্ধরূপে বাংলা কাব্যসংগীতের আসর মাত করামাত্রই দিলীপকুমার রায় তা নিজের অলংকৃত কণ্ঠে তুলে নিয়ে স্বয়ং এই গানের প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কলকাতার বহু আসরে তিনি এই নবসংগীত যেমন কণ্ঠকার হিসেবে গেয়ে শুনিয়েছেন, তেমনি এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন ভাষ্যকার হিসেবে। নজরুলের গজলের শুদ্ধরূপে প্রচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে স্বরলিপি প্রণয়ন এবং তা পত্রপত্রিকায় মুদ্রণের ব্যাপারেও তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন সংগীতপ্রেমী দিলীপকুমার রায়। বাংলা গজল সম্পর্কে তিনি এতোই উৎসাহী ছিলেন যে নিজেও নজরুলের কয়েকটি গজলের স্বরলিপি প্রস্তুত করেন। তাঁর উদ্যোগেই রবীন্দ্র-পরিকরদের মধ্যেও নজরুলসংগীতের চর্চা প্রবেশ পায়—এমনকী রবীন্দ্রনাথের নিজের গানের রূপকার হিসেবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দসই শিল্পী সাহানা দেবীকেও নজরুলের গান গাইতে দেখা যায় (এলো ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে, নাচে সুনীল দরিয়া আজি দিল-দরিয়া পূর্ণিমা চাঁদ পেয়ে, মেগাফোন, জেএনজি ৭৬, ১৯৩৩)।

২.
কলকাতা-জীবনের প্রথমবর্ষে নজরুল ছিলেন সৌখিন গায়ক ও গীতিকার। সুর করার জন্য গান রচনা বা রচিত গানের সুর করা তখনও শুরু হয়নি তাঁর। তবে সে-পর্বও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অচিরেই এবং সেটা স্বদেশী গানের সূত্রে, যেটাকে তিনি সাম্যবাদী গানে রূপান্তরিত করে গণসংগীতের পথিকৃৎ হবার মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। নজরুল স্বদেশী হাওয়ায় তথা অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বেলিত হন কুমিল্লায়—করাচি থেকে ফেরার বছরখানেক পরে, ১৯২১ সালের জুন-জুলাই মাসে। তিনি তাঁর সদ্যরচিত দেশাত্মবোধক গান গাইলেন মিছিলমুখর কুমিল্লা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ‘এ কোন্ পাগল ছুটে এল বন্দিনী মা’র আঙ্গিনায়’। এ ছাড়াও সেসময় নজরুল আরও দুটি স্বদেশী গান ‘মরণবরণ’ (এস এস এস ওগো মরণ) এবং ‘বন্দী-বন্দনা’ (আজি রক্ত নিশি-ভোরে) রচনা করে কুমিল্লার টাউনহলে কংগ্রেসের সভায় গেয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন, যার অস্তিত্বই ছিল না বাংলার সংগীত-সংস্কৃতিতে এর আগে। একই বছরের নভেম্বর মাসে নজরুল পুনরায় ফিরে আসেন কুমিল্লায়। ২১ নভেম্বরে পালিত দেশব্যাপী হরতালের দিন তিনি মিছিলের পুরোভাগে শহর প্রদক্ষিণ করেন ‘জাগরণী’ গান গেয়ে—‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’।

ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফিরে নজরুল মাসটির শেষদিকে রচনা করেন স্বাদে গন্ধে বর্ণে ছন্দে বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে অদ্যাবধি অনতিক্রান্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা (বল বীর—বল উন্নত মম শির!) আর ‘ভাঙার গান’ (কারার ঐ লৌহ-কবাট ভেঙে ফেল্, কর রে লোপাট)। পরের বছর প্রমীলার সঙ্গে হৃদয় বিনিময়ের পর পর ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে ১৩২৯ সনের বাংলা নববর্ষের উৎসবকালে কুমিল্লাতেই রচিত হয় তাঁর আরেক অনতিক্রমণীয় কবিতা ও গান ‘প্রলয়োল্লাস’ (তোরা সব জয়ধ্বনি কর!)। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন সঙ্গী নবীন কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বদেশে সাম্যবাদকে আহ্বান করে রচেন এই গানটি। সেই মহাবিপ্লবের প্রেরণাতেই কলকাতায় ফিরে আগস্ট মাসে নজরুল স্বাধীনতাকামী অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু বের করেন।

nazrul23.jpgএর আগের মাসেই কবি তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’-শীর্ষক রূপক কবিতাটি মারফত পরাধীনতা নাশনের জন্যে মহিষাসুরমর্দিনীকে আহ্বান করেছিলেন (দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ ভূ-ভারত আজ কশাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী!…)। এহেন রাজদ্রোহ মুদ্রণের জন্য ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয় বিপ্লবী কবিকে। ১৯২৩ সালে রাজবন্দী নজরুল হুগলী জেলে রচনা করেন তাঁর অগ্নিঝরানো ‘শিকল-পরার গান’ (এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।/ এই শিকল প’রেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥)। অসহযোগ আন্দোলনের ফসল এসব স্বদেশী গান সংবলিত বিষের বাঁশী ও ভাঙার গান-নামক দুটি গ্রন্থেরই বিজাতীয় সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হওয়া প্রকারান্তরে দেশবাসীর ওপর নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের প্রচণ্ড প্রভাব স্বীকৃত হওয়া।

এই স্বীকৃতি অন্যভাবে জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকেও পেয়েছিলেন নজরুল। যেমন ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের ফরিদপুর অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সামনে নজরুল তাঁর জনপ্রিয় ‘চরকার গান’ স্বকণ্ঠে গেয়ে তাঁদের প্রাণঢালা প্রশংসা পেয়েছিলেন (ঘোর—ঘোর রে ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর)। ১৯২৬ সালের মে মাসে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার পটভূমিকায় কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্যে নজরুল রচনা করেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তাঁর অবিস্মরণীয় গান ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার!’ (দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!)। সম্মেলনে তিনি নিজে গানটি পরিবেশন করেন দিলীপকুমার রায় ও তাঁর সংগীতসম্প্রদায়ের সহযোগিতায়।

এর আগে মার্চ মাসে মাদারিপুরে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে তিনি রচনা করেন ‘ধীবরদের গান’ (আমরা নিচে প’ড়ে রইব না আর/ শোন্ রে ও ভাই জেলে,/ এবার উঠব রে সব ঠেলে!/ ঐ বিশ্বসভায় উঠল সবাই রে,/ ঐ মুটে-মজুর হেলে/ এবার উঠব রে সব ঠেলে ॥)। ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে নজরুল রচনা করেন ‘ছাত্রদলের গান’ (আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল/ মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান/ ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।/ আমরা ছাত্রদল ॥)। যুব-সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে তিনি মার্চের সুরে রচনা করেন ‘চল্ চল্ চল্’ (ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,/ নিম্নে উতলা ধরণী-তল,/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চল্ রে চল্ রে চল্/ চল্ চল্ চল্ ॥)। ‘টলমল টলমল পদভরে’, ‘অগ্রপথিক হে সেনাদল’ প্রভৃতি গানও নতুন ধারার সমরসংগীতের তাল-লয়ে গ্রথিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কবি নজরুল এই সব সম্মেলনের, গায়কদের তো বটেই, উদ্যোক্তাদেরও অন্যতম ছিলেন। এই দিকগুলির কারণেও বাংলার বরেণ্য বাগ্‌গেয়কারদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের স্থান অনন্য এবং অতুলনীয় (সাংগীতিক পরিভাষায় সংস্কৃত বাগ্‌গেয়কার-শব্দটি যুগপৎ কথাকার ও সুরকারকে বোঝায়)।

একই সময় নজরুল রচনা করেন তাঁর (সর্বহারা গ্রন্থে সংকলিত) সুবিখ্যাত কৃষক-শ্রমিকের গানগুলি। কংগ্রেসের ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’র (কিংবা স্বতন্ত্ররূপে নবগঠিত ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে’র) কিষাণ সভার জন্য তিনি রচনা করেন ‘কৃষাণের গান’ (ওঠ্ রে চাষী জগদ্বাসী ধর ক’ষে লাঙল।/ আমরা মর্‌তে আছি—ভাল ক’রেই মর্‌ব এবার চল্ ॥) নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে নজরুল রচনা করেন ‘শ্রমিকের গান’ (ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল!/ ধর্‌ হাতুড়ি, তোল্ কাঁধে শাবল ॥)। এসব গান সম্মেলনে স্বকণ্ঠে গেয়ে সমবেত জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা ছিল সমাজপরিবর্তন-কর্মী হিসেবে কবির পূর্বিতাপ্রাপ্ত কর্মসূচির অন্তর্গত—যার জন্য তিনি রোগশয্যা থেকেও ছুটে আসতেন জনসভায়।

কারণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সাম্যপ্রতিষ্ঠার চিন্তা ছিল তাঁর একসূত্রে গ্রথিত এবং সৃজনশীল সত্তার পাশাপাশি মননশীল সত্তায় প্রোথিত। শেষোক্ত গান দুটি সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র, ঠাকুরবাড়ির একমাত্র ‘বিপ্লবী’, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট নেতা, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-১৯৭৪) তাঁর যাত্রী গ্রন্থে লিখেছেন: ‘বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের গান ছিল না এর আগে, নজরুলই তার পথকার’। (মহর্ষির আরেক প্রপৌত্র সুভগেন্দ্রনাথ ওরফে সুভো ঠাকুর (১৯১২-৮৫) ছিলেন বাড়িটির একমাত্র ‘বিদ্রোহী’, যিনি লিখেছিলেন, ‘পোয়েট ট্যাগোর হন কে তোমার, জোড়াসাঁকোতেই থাক?/ বাবার খুড়ো যে হন শুনিয়াছি, মোর কেহ হয় নাকো’।)।

গণসংগীতের পথিকৃৎ কাজী নজরুল ১৩৩৪ সালের একই তারিখে, পয়লা বৈশাখে, একের পর এক রচনা করেন ‘অন্তর-ন্যাশনাল সংগীত’ (জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত !), ‘জাগর-তূর্য’ (ও রে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী!/ অলিখিত যত গল্প-কাহিনী তোরা যে নায়ক তারি ॥), ‘রক্ত-পতাকার গান’ (ওড়াও ওড়াও লাল নিশান!/ দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা/ ভরিয়া বাতাস জুড়িয়া বিমান!/ ওড়াও ওড়াও লাল নিশান ॥)। সামাজিক অন্যায়বিচারের জগদ্দল পাথর ভেঙে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে নজরুল এর আগে ১৩৩১ সালে ব্যান্ডের সুরে রচনা করেন ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল।/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল॥’। পরে ১৩৩৭ সালে রচনা করেন নারী-জাগরণী গান ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা। জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্তটিকা॥’। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ও বহুল উদ্ধৃত সাম্যবাদী কবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে তাঁর সাম্যবাদী গ্রন্থে (যেমন সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, চোর-ডাকাত, বারাঙ্গনা, মিথ্যাবাদী, নারী, রাজা-প্রজা, সাম্য ও কুলি-মজুর)।

লক্ষণীয় যে নজরুল ছিলেন, যাকে বলে, প্র্যাক্সিসের মানুষ। মানে নিতান্ত ভার্বালিস্ট বা বচনসর্বস্ব অথবা নিতান্ত অ্যাক্টিভিস্ট বা করণসর্বস্ব ছিলেন না—তিনি ছিলেন অ্যাক্টিভিস্ট-কাম-ভার্বালিস্ট। এজন্যে তাঁর সৃজনে এমন একক এক অথেন্টিসিটি বর্তাতো যা আর কারও রচনায় প্রত্যাশিতও ছিল না। নজরুল সংগ্রামী গান রচনা করতেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে মাঠে-বাটে সংগ্রাম করতে করতে (যেমন করতেন আর কেবল মুকুন্দ দাস, তবে তাঁর স্বর নজরুলের কণ্ঠের সঙ্গে তুলনীয় ছিল না), ঘরের কোণে বসে কলম পিষতে পিষতে নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ নজরুলের উদ্দীপনামূলক ও দেশাত্মবোধক গানগুলিকে উচ্চতম মান এবং স্থায়ী মূল্য দান করেছে। তাঁর সভায়-মিছিলে অংশগ্রহণ এবং কারাবরণ ও অনশন পালন—সবই ছিল দেশবন্দনামূলক মহান সৃজনকর্মের সক্রিয় প্রস্তুতিস্বরূপ। এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল-তনয় দিলীপকুমার রায়ের বয়ানে সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ১৯২৫ সালের দোসরা মে নেতাজী মান্দালয় থেকে একটি পত্রে লিখেছিলেন—”We do not perhaps realise the magnitude of the debt owed by Kazi Nazrul Islam’s verse to the living experience he had of jails” (পৃ. ১৩১, নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, ড. করুণাময় গোস্বামী)। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে আয়োজিত নজরুল-সংবর্ধনা সভাতেও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন:

‘তাঁর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মত বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গান গাইবার ইচ্ছা হত। আমাদের প্রাণ নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না। নজরুলকে বিদ্রোহী বলা হয়—এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব—তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়াই, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মত প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২)।

সংবর্ধনা-সভাটির সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন:

‘রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই, তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।’ উপসংহারে আচার্য রায় আরো বলেন, ‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সংগীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করিব। নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতিমানুষে পরিণত হইবে।’

৩.
তবে স্মরণ রাখতে হবে যে দেশাত্মবোধক গান রচনার এই কালটি ছিল নজরুলের গভীরভাবে সংগীতজগতে প্রবেশ করার পূর্বকাল। এ পর্বের গানগুলির সুর ছিল সহজসরল ও উদ্দীপনাময়, বাণীও ছিল সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকারের—যে-সমূলবদলের সংগ্রামী সৈনিকরূপে তিনি তখন সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ। সত্যিকার অর্থে সংগীতক্ষেত্রে অবতরণ তাঁর এর পরে—১৯২৬ সাল থেকে, যার শুরু গজলপর্ব দিয়ে। ১৯২৬-১৯২৮-এর কৃষ্ণনগরের জীবনে নজরুল শোষণমুক্তি ও সাম্যপ্রতিষ্ঠা অভিলাষী নতুন ধারার সাম্যবাদী গান রচনার সমসময়েই শুরু করেন নতুন ছন্দের নতুন বর্ণের নতুন স্বাদের নতুন আবেগের প্রেমের গান রচনা। গজল-নামে অভিষিক্ত রক্তমাংসের এই নতুন প্রেমের বন্যা চোখের পলকে প্লাবিত করে দিল প্রেমের গানের ক্ষমতাসীন মহারাজ রবীন্দ্রনাথের রাজধানী শহর-কলকাতাকেই।

লখ্নৌ প্রবাসী উর্দু-দাঁ অতুলপ্রসাদ সেন নজরুলের আগে কয়েকটি গজল রচনা করেছিলেন (যেমন ‘কে গো তুমি বিরহিণী, আমারে সম্ভাষিলে/ এ পোড়া পরান তরে এত ভালবাসিলে’, ‘রাতারাতি করল কে রে ভরা বাগান ফাঁকা/ রাঙা পায়ের চিহ্ন শুধু আঙিনাতে আঁকা’)। দু একটি গজল তাঁর ভালোও হয়েছে (যেমন ‘বলো গো সজনী, কেমনে ভুলিব তোমায়?/ যতন যাতনা বাড়ায়’, ‘কত গান তো হল গাওয়া/ আর মিছে কেন গাওয়াও?/ যদি দেখা নাহি দিবে/ তবে মিছে কেন চাওয়াও?’ তবে তাঁর শ্রেষ্ঠতম গজল ‘জল বলে চল মোর সাথে চল/ কখনো তোর আঁখিজল হবে না বিফল’ এখানে উল্লেখ্য নয় যেহেতু এটির সৃষ্টি নজরুলের ‘এত জল ও-কাজল-চোখে পাষাণী আন্লে বল কে।/ টলমল জল্-মোতির মালা দুলিছে ঝালর-পালকে’-গজলটির প্রেরণায় (বলেছেন দিলীপকুমার রায়)। এখানে বিশেষভাবে বলার কথাটি হল অতুলপ্রসাদ গজলের তরঙ্গই সৃষ্টি করতে পারেননি, ধারা রচনা করা তো পরের কথা।

নজরুল শুধু ১৩৩৩ থেকে ১৩৩৫—এ দুটি বছরেই অতুলের মোট গজলের চেয়ে অনেক বেশি গজল সৃষ্টি করে গজলের জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিয়েছেন বাংলা গানের জগতে। ১৩৩৩ সালে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ দিয়ে শুরু করে তিনি একের পর এক লিখে গিয়েছেন ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’, ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে’, ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’, ‘দুরন্ত বায়ু বহে পুরবঁইয়া’, ‘মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে’, ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি’, ‘এত জল ও কাজল চোখে’, ‘কেন কাঁদে পরাণ’, ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না’, ‘কে বিদেশী বন-উদাসী’, ‘নিশি ভোর হল জাগিয়া পরান পিয়া’ ইত্যাদি একসে-এক মনোহরণ গজল। ১৩৩৫ সালেও সমানে চলল তাঁর গজলবর্ষণ। যেমন ‘এ বাসি বাসরে আসিলে কে গো ছলিতে’, ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি-জল’, ‘কেন আন ফুল-ডোর আজি বিদায়-বেলা’, ‘কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া’ ইত্যাদি। এসব গজল প্রকাশিত হত প্রায়শ স্বরলিপিসহ (যার বেশ কিছু কবিকৃতও) শীর্ষস্থানীয় সকল পত্রিকায় (যেমন কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি, বঙ্গবাণী, নওরোজ, সওগাতে)।

নজরুলের গজল-সংকলনরূপে বিখ্যাত ‘বুলবুল’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে [পরপর প্রকাশিত ‘চোখের চাতক’ও গজল-খ্যাত]। তবে এ সময় তাঁর গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার ফলে রকমারি গানের চাহিদা গজলকে পেছনে ঠেলে দেয়। তবু এরই মধ্যে নজরুল গজলকে বাংলাগানের আসরে সম্মানিত একটি স্থায়ী আসন অর্জন করে দিতে পেরেছেন। পেরেছেন এ কারণে যে এর প্রস্তুতি তাঁর সম্পূর্ণ হয়েছিল অনেক আগেই, করাচি-বাসকালে—ফার্সি কাব্যপাঠ, বিশেষত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গজলিয়া পারশ্যের হাফিজের গজল পাঠ ও আবৃত্তি শোনা ও শেখার মাধ্যমে (সে-আবৃত্তি বাংলা কবিতা আবৃত্তির মতো নয়, সুরেলা আবৃত্তি—যাকে তাঁরা বলেন ‘তারান্নুম’-যুক্ত পাঠ)।

গজলের পথ বেয়েই নজরুল সংগীতের উপত্যকায় পৌঁছান। পৌঁছেই গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদান তাঁর সাহিত্যরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁকে সংগীতনগরের নাগরিক করেই রেখে দেয়। সেখানেই নজরুল বহু সংগীতগুণীর সৃজনশীল সান্নিধ্য এবং তৎপ্রসূত শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মওকা পান। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ঠুংরির ভাণ্ডারি জমিরুদ্দীন খাঁ, ঠুংরি-মুখড়ার খনি মঞ্জু সাহেব, মাস্তান গামা, ওস্তাদ কাদের বখশ, দবীর খাঁ, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ। সংগীতে পুষ্টিলাভ করার মানসে নজরুল রাগসংগীতের বিখ্যাত স্বাস্থ্যনিবাসেও যেতেন—যেমন খলিফা বদল খাঁ বা আফতাবে মওসিকী ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের সকাশে। তবে এঁদের জোগানের পরিমাণ তেমন বেশি ছিল না। বেশি ছিল নজরুলের বিধিদত্ত প্রতিভাপুষ্ট স্বশিক্ষা, ঠুংরি সম্রাট মৌজুদ্দীনের মতো। সেজন্য কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলার সংগীত জগতের শ্রেষ্ঠতম ‘আতায়ী’ উস্তাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না।

৪.
বস্তুতপক্ষে নজরুলের রাগসংগীতপ্রীতি জন্মগত বলেই সেই সংগীতে কৃতি তাঁর বিধিদত্ত। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গানটিও ছিল বসন্ত-সোহিনী রাগে ও দাদরা তালে রচিত (বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও)। সম্ভবত তাই রাগসংগীতের ভুবনে এ-আগন্তুকের কাছে বাংলা গান যা পেয়েছে—রাগসংগীতের ঐতিহ্যে লালিত বাকি চার প্রধানের কাছে সম্মিলিতভাবেও তা পায়নি। স্মর্তব্য যে নজরুল ছাড়া সকলেই জন্মেছিলেন ঐতিহ্যবাহী সংগীতচর্চাকারী পরিবারে।

রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরবাড়ি ছিল অন্যতম দেশখ্যাত সংগীতকেন্দ্র, যেখানে বিখ্যাত শাস্ত্রীয় কলাবতগণ থাকতেন এবং পরিবারের নতুন প্রজন্মকে তাদের শিশুকাল থেকেই গান শেখাতেন। বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদুনাথ ভট্টাচার্য, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর মতো স্বনামধন্য ধ্রুপদিয়াদের আবাল্য সান্নিধ্যে গড়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের সংগীতসত্তা। দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতজীবনের গোড়াপত্তন হয় টপ-খেয়ালিয়া ও গীতিরচয়িতা পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের তালিমে।

অতুলপ্রসাদ সেন গায়ক পিতার মৃত্যুর পর প্রতিপালিত হন গায়ক ও গীতিরচয়িতা মাতামহের আশ্রয়ে। কর্মজীবনের সূত্রে লখনৌ শহরে সুর ও বাণীর আবহাওয়াতেই ছিল তাঁর বসবাস। তাই আজীবন সংগীত রচনা করেন তিনি শাস্ত্রীয়সংগীতের স্বভূমিতে, রাগসংগীতিক পরিবেশে বসে। পাবনার সংগীতজ্ঞ কবির পুত্র রজনীকান্ত সেনের শৈশব-কৈশোরও সংগীতসমৃদ্ধ এবং আইনজীবী হিসেবে রাজশাহীর জীবনও ছিল তাঁর উচ্চমানের সাংগীতিক পরিমণ্ডলে।

প্রতিপক্ষে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামই জন্মেছিলেন দরিদ্রগৃহে এবং শিশুশ্রমিকের জীবনটিও কেটেছে তাঁর কঠোর সংগ্রামে আর কঠিন সঙ্কটে। অথচ ঐতিহ্য ব্যতিরেকেই এই স্বভাবশিল্পী সৃষ্টি করে গেছেন বাংলার সংগীত জগতে রাগসংগীতের কালজয়ী ধারাটি এবং পুষ্টও করে গেছেন প্রভূত পরিমাণে।

বাণীর বিচারে যে-শ্রেণীতেই জমা পড়ুক, সুরের বিন্যাসে রাগসাংগীতিক চারিত্র্য নজরুলের, কেবল গজলকেই নয়, সকল শ্রেণীর গানকেই শনাক্তযোগ্যভাবে ‘নজরুলিয়া’রূপ দিয়েছে। তবে এক কথায় বলতে গেলে ‘রাগপ্রধান গান’-নামক বিশেষ শ্রেণিটিই তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাগসাংগীতিক অবদান। এই গান হিন্দুস্তানী সংগীতরীতির প্রতিকৃতি কিংবা প্রতিধ্বনি নয়—এ এক রাগাশ্রয়ী সংগীতরীতিই বটে, তবে খাঁটি বাঙালি। এ-গানকে ‘শুদ্ধবাদী’ও বলা যায় এ-অর্থে যে এতে থাকে কেবল মৌলিক রাগরূপ ও রাগভাবসহ রাগাঙ্গীণ অলঙ্কৃতি—থাকে না সুরপ্রস্তারের বহুলতা, নানান ফাঁদের তানকর্তবের কৃত্রিমতা, দুরূহতার কার্দানি, জটিলতার প্রদর্শনী প্রভৃতি। সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার এই সংগীত-সংরূপটির জন্ম হয় উনিশ শো ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে—স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম এবং নামদাতা তাঁর সহযোগী কৃতী রাগসংগীতশিল্পী ও তাত্ত্বিক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলা একাডেমীর নজরুল রচনাবলী দশম খণ্ডে পূর্ণরূপে প্রকাশিতব্য নজরুলের ‘সুর ও শ্রুতি’-শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধটি সম্বন্ধে শ্রীকল্পতরু সেনগুপ্ত তাঁর নজরুল-গীতি অন্বেষা নামক গ্রন্থে বলেছেন:

‘এই রচনাটি অপ্রকাশিত। একটি বাঁধাই খাতায় কাজী নজরুল ইসলামের নিজের হাতের লেখায় পাওয়া গেছে। খাতায় তিনি এত দ্রুত লিখেছেন যে, কোথাও কোথাও পাঠোদ্ধারের অসুবিধা হয়েছে। রাগ-রাগিণী ও শ্রুতির চার্টগুলি তাঁর নিজের হাতে তৈরি। এই চার্টগুলি দেখে, অনুমান করা যায় শাস্ত্রীয় সংগীতের তুলনামূলক বিচারে তিনি কিরূপ আগ্রহী ছিলেন এবং কিরূপ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সংগীত-শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। একই খাতায় তিনি আরো কয়েকটি রাগের প্রকৃতি ও পরিচয় বর্ণনা করেছেন। খাতা-দৃষ্টে অনুমান হয় ১৯৩৫-৩৬ সালে তিনি এই লেখা আরম্ভ করেছিলেন।’

প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছে প্রখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব লখনৌর রাজা নবাব আলী রচিত এবং উনিশ শত বিশের দশকে প্রকাশিত মারিফুন্নাগমাত-নামক রাগসংগীত বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডের অনুসরণে। খণ্ডটির অধ্যায় ছিল তিনটি—স্বরাধ্যায়, রাগ অধ্যায় ও তাল অধ্যায়। স্বরাধ্যায়ে ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের সাধারণ উপপত্তিক বিষয়গুলি। রাগ অধ্যায়ে ছিল ১৫৩টি রাগের বিবরণ, স্বরবিস্তার ও একটি করে লক্ষণগীত। এতে করে অনেকগুলি রাগ সাধারণ্যের নাগালে চলে এল, যেগুলি ইতিপূর্বে বিভিন্ন ওস্তাদদের কুক্ষিগত ছিল। কবির সৃষ্টিধারায় এই গ্রন্থের প্রভাব অনুভব করা যায় ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে।

মারিফুন্নাগমাতে কবি দেড়শতাধিক রাগের লক্ষণগীতি হাতে পেলেন। অর্থাৎ রাগ পরিচয় ও স্বরবিস্তার ছাড়াও প্রত্যেক রাগের একটি করে গানের মডেল স্বরলিপিসহ হাতের কাছে পাওয়া গেল। এই মডেলগুলির কাঠামো বজায় রেখে কবি অনুরূপ বন্দিশে অনায়াসেই গান বাঁধতে পারতেন (রবীন্দ্রনাথ যেমন বেঁধেছেন তাঁর বহু ভাঙা-গান)। স্বরগুলো তো ছকে সাজানোই ছিল, তার নিচে পছন্দমতো বাংলা কথা বসিয়ে দিলে (রবীন্দ্রনাথ যেমন বসিয়ে দিয়েছেন, যথা ‘হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে’) খুব সহজে বহুসংখ্যক রাগভিত্তিক নজরুল-গীতির জন্ম হতো। কবি কিন্তু তা করেননি। কবি রাগভিত্তিক গান বেঁধেছেন রাগের ধ্যানমূর্তি মানসপটে প্রতিষ্ঠা করে নিয়ে। লক্ষণগীতির স্বরলিপিতে রাগ কূপের জলের মতো অকিঞ্চিৎকর হয়ে থাকে। রাগের মোহিনীমূর্তি আবির্ভূত হয় উপযুক্ত গুণীর কণ্ঠে অথবা যন্ত্রে। রাগ তখন রঙে রসে বৈভবে কলস্বিনী নদীর মতো অনুভবের জোয়ারে শ্রবণতট রসপ্লাবিত করে। রসের সেই মূর্তি কবি নিয়ত সন্ধান করেছেন উপযুক্ত গুণীজনের কাছে কখনো শিক্ষার্থী হয়ে, কখনো ফরমাশ করে, কখনো বা উৎকর্ণ শ্রোতার আসনে বসে। পুঁথির বিধান কবিকে রাগের ব্যাকরণ দিয়েছে, রাগের রসমাধুর্য দিয়েছেন শিল্পীজন। (‘নজরুল ও মারিফুন্নাগমাত’, অমলকুমার মিত্র, নজরুল একাডেমী পত্রিকা, ১৩৯৪, ঢাকা)।

কট্টর উর্দু ভাষায় লিখিত শাস্ত্রীয় সংগীতের জটিল বিষয়াদি অনুধাবন করে বস্তুসার স্বচ্ছ বঙ্গভাষায় স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিব্যক্তিতে সংগীতসমাজে পরিবেশন—ভাষা ও সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের সহজাত প্রতিভার একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্তই বটে।

৫.

ভক্তিসংগীতের দুটি ধারাতে নজরুলের কৃতি তুলনারহিত—হিন্দুধর্মসংগীতর আবহমান ধারা আর মুসলিমধর্মসংগীতের নতুন ধারা। হিন্দু ভক্তিসংগীতে তাঁর রচনার অসংখ্যতা ও বিষয়ের অজস্রতা এককথায় বিহ্বলকর। ঈশ্বরবন্দনামূলক গান যেমন—অন্তরে তুমি আছ চিরদিন, খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিশ্বব্যাপিয়া আছ তুমি জেনে, মন বলে তুমি আছ ভগবান, যুগ যুগ ধরি লোকে লোকে প্রভৃতি। শ্যামাসংগীত যেমন—শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা, মহাকালের কোলে এসে, শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা, আমার মা আছে রে সকল নামে, ওমা বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ, কে তোরে কি বলেছে মা, বল রে জবা বল, সংসারেরই দোলনাতে মা প্রভৃতি।

দুর্গাসংগীত যেমন—জয় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, এস আনন্দিতা ত্রিলোকবন্দিতা, মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা, ভবাণী শিবাণী দশপ্রহরণধারিণী, কে জানে মা তব মায়া মহামায়া রূপিণী ইত্যাদি। আগমনী গান বা উমাসংগীত যেমন—ওরে আলয়ে আজ মহালয়া, আমার উমা কই গিরিরাজ, তুই পাষাণগিরির মেয়ে হলি, বর্ষা গেল আশ্বিন এল উমা এল কই, মা হবি না মেয়ে হবি দে মা উমা বলে, কে সাজালে আমার মাকে বিসর্জনের বিদায় সাজে, ইত্যাদি। শিবসংগীত যেমন—গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভু, সৃজনছন্দে আনন্দে, জাগো অরুণ ভৈরব, প্রভৃতি।

কৃষ্ণসংগীত যেমন (নারায়ণরূপী কৃষ্ণ) জাগো শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, হে প্রবল প্রতাপ দর্পহারী, তিমিরবিদারী অলখবিহারী কৃষ্ণমুরারী আগত ঐ, প্রভৃতি। (গোপীবল্লভরূপী কৃষ্ণ) একি অপরূপ রূপের কুমার, আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম, সখি যায়নি তো শ্যাম মথুরায়, ব্রজগোপী খেলে হোরী, ইত্যাদি। ব্রজলীলা যেমন (কীর্তন) মুরালীধ্বনি শুনি ব্রজনারী, রাখ রাখ রাঙা পায় হে শ্যমরায়, শ্যামসুন্দর গিরিধারী, দোলে বনতমালের ঝুলনাতে কিশোরী কিশোর, সখি আমিই না হয় মান করেছিনু, মন মোর ছুটে যায় দ্বাপর যুগে প্রভৃতি। (ভজন) চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, প্রভু রাখ এ মিনতি, তোমার আমার এই বিরহ সইব কত আর, হে চিরসুন্দর বিশ্বচরাচর, হে মহামৌনী তব প্রশান্ত গম্ভীর বাণী শোনাবে কবে প্রভৃতি।

হিন্দুধর্মসংগীত বিভাগে নজরুলের গানে রচনার পরিমাণগত বিপুলতা, বিষয়বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা ও সুরৈশ্বর্যের উৎকৃষ্টতা তথা কাব্যসংগীতের সামগ্রিক উৎকর্ষের মাধ্যমে যুগপৎ আবহমান বাংলার হিন্দুপ্রভাব পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথের হাতে শীর্ষস্পর্শী ব্রাহ্মপ্রভাব তিরোহিত হয়েছে। এর একটা সাধারণ প্রমাণ এই যে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তম দুর্গাসংগীতটি নজরুলসংগীত যথা ‘কে জানে মা তব মায়া মহামায়ারূপিণী’। আরেকটা বিশেষ প্রমাণ এই যে গাজন-গম্ভীরা ইত্যাদি লোকসংগীতের উপজীব্য শিবের গীতকে ধ্রুপদ-খেয়াল অঙ্গপ্রধান কাব্যসংগীতে উন্নীত করেছেন কাজী নজরুল ইসলামই এবং বাংলার স্বল্পসংখ্যক শিবসংগীতের শ্রেষ্ঠতমটিও তাঁরই, যথা—গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু।

শ্যামাসংগীতে নজরুলের অবদান সম্পর্কে ডক্টর করুণাময় গোস্বামী লেখেন, ‘বলতে কি শ্যামাসংগীত রচয়িতারূপে রামপ্রসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাংগীতিক নান্দনিকতায় যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নজরুল তদপেক্ষা উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন। কেননা, কবি ও সুরস্রষ্টারূপে তিনি পূর্ববতী সংগীতরচয়িতাদের চেয়ে মহৎ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সে পরিচয় তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে রেখেছেন তাঁর গানে।’ (পৃ. ২৫৩, নজরুলগীতি প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী ১৯৯৬)। তিনি আরও বলেন, ‘হিন্দুধর্মসংগীত পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামের রচনা একদিকে যেমন বিপুল অপরদিকে তেমনি বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা এমনি বিস্ময়কর যে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অপর কোন বাঙালি কবির রচনাকর্মে হিন্দুধর্ম-সম্পৃক্ত বিষয়ের এমন বহুমুখী রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বর্তমান শতকের ত্রিশের দশকের পরবর্তীকালে গেয় জনপ্রিয় হিন্দুধর্ম সংগীতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই নজরুলের রচনা (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৩)।’

এই বিপুলতার উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে হরফ প্রকাশনীর অখণ্ড নজরুলগীতির ষষ্ঠ সংস্করণে এই শ্রেণিতে সংকলিত ৫৪২টি গানের সঙ্গে আরো অনেক গানই যুক্ত হচ্ছে নানাসূত্রে নিত্যপ্রাপ্ত নজরুলগীতির অশেষ ভাণ্ডার থেকে। আর বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে নজরুলের বেশুমার ভক্তিগীতিতে বন্দিত হয়েছেন কেবল শক্তিদেবী কালী নয়, বরং নানা রূপের নানা কালী—শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, নিত্যকালী, মহাকালী। তেমনি দুর্গাও গীত হয়েছেন চণ্ডী, কৌষিকী, শাকম্ভরী, সতী প্রভৃতি রূপে। শাক্ত ও বৈষ্ণবীয় দেবীকাহিনীর হেন অনুষঙ্গ নেই যা নজরুলের গানে আসেনি। পৌরাণিক বিষয়াবলীর এমন জম্পেশ সমাবেশ অন্য কোন সংগীতকারের রচনায় ঘটেনি।

৬.
নজরুল প্রবর্তিত ইসলামী গানের ধারাটিকে এখানে আমি বলব মুসলিমধর্মসংগীত যেহেতু এটি হিন্দুধর্মসংগীতের পরিপূরকরূপে বাংলার ভক্তিগীতির ধারাটিকে অভূতপূর্ব এক পরিপূর্ণতা দান করেছে। দুই শতের মতো গান দিয়ে মাত্র কয়েক বছরে তিনি বাংলা শীলিত সংগীতের ঐতিহ্যে ইসলামী ভক্তিসংগীতের ধারাটি সংযোজন করেন। সুদীর্ঘ কালের পরম্পরাগত চর্চার ফলে ভক্তিসংগীতের অন্যান্য শাখা যথা ব্রহ্মসংগীত, শ্যামাসংগীত, উমাসংগীত প্রভৃতি যে-উচ্চতায় উঠেছে—ইসলামী গানকে লোকসংগীতের পর্যায় থেকে রাগসংগীতের লেবাস পরিয়ে নজরুল এক হাতেই সেখানে উন্নীত করে দিয়ে ইসলামের নতুন এক সাংগীতিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

লোকসংগীত প্রভাবিত ইসলামী গানের উদাহরণ হচ্ছে—ওরে ও দরিয়ার মাঝি, পুবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া, এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি প্রভৃতি। রাগসংগীতের সুররঞ্জিত ইসলামী গানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে—মোহররমের চাঁদ এল ঐ, ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, সাহারাতে ফুটল রে ফুল, খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে, বক্ষে আমার কাবার ছবি, যাবি কে মদীনায়, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে প্রভৃতি। আল্লা-রসুলের প্রশস্তি, ধর্মীয় বিধান, ইসলামের ইতিহাস, এবাদত, বন্দেগী, মাযার, মসজিদ ইত্যাদি বিষয় অবলম্বন করে নজরুলের মুসলিমধর্মসংগীতমালা গ্রথিত। হামদ বা আল্লার জয়গানের উদাহরণ—তুমি অনেক দিলে খোদা দিলে অশেষ নিয়ামত, তুমি আশা পুরাও খোদা সবাই যখন নিরাশ করে, তোমারি মহিমা সব বিশ্বপালক করতার, রোজ হাশরে আল্লা আমার করো না বিচার ইত্যাদি।

এর মধ্যে মোনাজাতরূপে উল্লেখিত গানগুলির সুরবাণীর আবেদন সর্বজনীন এবং সর্বকালীন, যেমন ‘খোদা এই গরীবের শোনো শোনো মোনাজাত’, ‘শোনো শোনো ইয়া ইলাহী আমারি মোনাজাত’ ইত্যাদি। আবির্ভাব ও তিরোভাবসহ নবীমহিমা বিষয়ক নাত-শ্রেণির সংগীতে ইসলামী গানের শীর্ষে আরোহণ করে নজরুল তাঁর সাংগীতিক উচ্চতার প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামী গান উপহার দেন—যেমন মোহাম্মদ নাম যতই জপি, ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ, এ কোন মধুর শরাব দিলে ইত্যাদি। রমজান এবং ঈদ ছাড়াও নজরুল অবিস্মরণীয় যত গান রচনা করেন কাবা ও হজ্ব বিষয়ে যেমন দুখের সাহারা পার হয়ে আমি চলেছি কাবার পানে, পূবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া প্রভৃতি।

মসজিদ-আজান-নামাজ বিষয়ে—যেমন বাজল কি রে ভোরের শানাই, মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ, আঁধার মনের মিনারে মোর হে মুয়াজ্জিন দাও আজান প্রভৃতি। মোহররম বিষয়ে যেমন—মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়, ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়, ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে প্রভৃতি। ফাতেমা, আরব, মক্কা, মদীনা বিষয়ে যেমন—খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী বিশ্বদুলালী নবীনন্দিনী, দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে, সুদূর মক্কা মদীনার পথে আমি রাহি মুসাফির, ভেসে যায় হৃদয় আমার মদীনা পানে ইত্যাদি। মোট কথা বাংলা কাব্যসংগীতের দীর্ঘকালের লালিত ধারায় রাতারাতি একই মানের ইসলামী গানের যোজনা কাজী নজরুল ইসলামের এক অবিশ্বাস্য কীর্তি। তার ওপর রেকর্ড রিলিজমাত্রই এ-গানের বিস্ফোরক জনাদৃতির সূত্রে বিস্ময়কর বিপণন সাফল্য এক অকল্পনীয় ইতিহাসেরই সৃষ্টি করেছে।

নজরুলের নতুন সুরের এই মধুর সুরধুনী, ধর্ম কর্তৃক নিরুৎসাহিত মুসলমানদের এতোই সংগীতমনস্ক করে তোলে যে মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বঙ্গদেশে ইসলামী গানই হয়ে ওঠে রেকর্ড কোম্পানির বেস্টসেলার সিরিজ। ফলে নজরুলসৃষ্ট এই নবধারার গান রেকর্ড করার জন্য এত শিল্পীর প্রয়োজন পড়ে যে, ক্রেতার কথা ভেবে বহু হিন্দু গায়ক-গায়িকাকে মুসলিম নাম ধারণ করতে হয় রেকর্ডের লেবেলে। এই প্রক্রিয়ায় রেকর্ডের লেবেলে ধীরেন দাস হয়ে যান ‘গনি মিঞা’ (তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা করো হজরত, তোমারি প্রকাশ মহান এ নিখিল দুনিয়া জাহান, ঈদের খুশির তুফানে আজ ভাসলো দো-জাহান, মেষ চারণে যায় নবীকিশোর রাখাল বেশে, মারহাবা সৈয়দ মক্কী মদনী আল-আরবী, ফুরিয়ে এলো রমজানের এই মোবারক মাস, এসেছি তব দ্বারে ভক্তিশূন্য প্রাণে)।

ঊষারাণী হয়ে যান ‘রওশন আরা বেগম’ (আমার ধ্যানের ছবি আমার হজরত, নতুন চাঁদের তকবীর শোন কয় ডেকে ঐ মুয়াজ্জিন, হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ডাকে তুমি শুনিতে কি পাও, হে প্রিয় নবী রসূল আমার, তোমারি নূরের রওশনী মাখা নিখিল ভুবন, নিশিদিন জপে খোদা দুনিয়া জাহান)। সীতা দেবী হয়ে যান ‘দুলি বিবি’ (আমি বাণিজ্যেতে যাব এবার মদীনা শহর, ওগো মুরশীদ পীর বলো রসুল কোথায় থাকে)। হরিমতী দেবী হয়ে যান ‘সাকিনা বেগম’ (আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ, কেন তুমি কাঁদাও মোরে হে মদিনাওয়ালা, এলো এলো শবে বরাত তোরা জ্বাল রে বাতি, ভক্তিভরে পড় রে তোরা কলমা শাহাদাত, চীন আরব হিন্দুস্থান নিখিল ধরাধাম, নামাজ-রোজা হজ্জ-জাকাতের পসারিনী আমি, প্রিয় মোহ্রে নবুয়তধারী হে হজরত তরিতে উম্মতে এলে ধরায়, মসজিদে ঐ শোন রে আজান,)। গিরীণ চক্রবর্ত্তী হয়ে যান ‘সোনা মিয়া’ (ঈমান বাইন্ধা রাখ রে, মন রে মায়া জগতের মূল মায়া)। গিরীণবাবুই আবার আরেক গানের জন্য হয়ে যান গোলাম হায়দার এন্ড পার্টি (আল্লার নাম জপিও ভাই, ইয়া আল্লা তুমি রক্ষা কর)। তিনিই আরেক গানের জন্য হন সুজন মাঝি (আকাশের আর্শীতে ভাই পইরাছে মোর মনের ছায়া)। চিত্ত রায়কে হতে হয়েছে দেলওয়ার হোসেন (ক্ষমাসুন্দর আল্লা, মোদের ভয় দেখিও না আর, আল্লা রসূল তরু আর ফুল প্রেমিক হৃদয় জানে)।

এক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি বিড়ম্বিত হতে হয়েছিল মুনশী মহম্মদ কাসেমকে। খদ্দেরের রুচিসম্মত হওয়ার জন্য মহম্মদ কাসেম মল্লিককে অতুল-নজরুল প্রমুখের গান গাওয়ার জন্য প্রথমে হতে হয়েছিল কে. মল্লিক (‘ডাকে কোয়েলা বারে বারে’, ‘কেন কাঁদে পরাণ’, ‘কেন দিলে এ কাঁটা’ এবং হিন্দি জাতীয় গান গাওয়ার জন্য শঙ্কর মিশ্র (অম্বরে মেঘে মৃদঙ্গ বাজে জলদ তালে, দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মেলা, ও কে মুঠি মুঠি আবির কাননে ছড়ায়)। পরে আবার ইসলামী গান গাওয়ার জন্য তাঁকে হতে হল ‘মনু মিয়া’ (ও রে ও মদীনা বলতে পারিস কোন সে পথে তোর, দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে, আমিনা দুলাল নাচে হালিমার কোলে, তোমার নামের এ কি নেশা হে প্রিয় হজরত)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ইসলামী গান গাননি বলে তালাত মাহমুদ কেবল হিন্দু-নামেই নজরুলগীতি গেয়েছেন—তপনকুমার।

৭.
১৯৩৩ থেকে শুরু হয় নজরুলের আধুনিক ও লোকসংগীত ধারার সংগীতসৃষ্টির পর্ব। বিগত শতকের ত্রিশের দশকে প্রবর্তিত আধুনিক বাংলা গানের যে-মেলডি কিংবা সুরলহরী আজকের প্রজন্মকেও মাতায় বলে হালের গানের বাজারটি ‘রিমেকিঙে’র বাজার হয়ে দাঁড়ায়—সুরমূর্ছনা প্লাস শব্দগ্রন্থনার সে-মডেলটির প্রতিষ্ঠাতা কাজী নজরুল ইসলাম। জনসাধারণের মনমাতানো সুর ও শব্দের এই সহজ সরল সাংগীতিক বিন্যাসটি তিনি সৃষ্টি করেন প্রধানত গ্রামোফোন-বেতার ও সবাক সিনেমার ত্রিমুখী চাহিদার দ্রুতবর্ধিষ্ণু তাগিদে। বাংলাগানের ভুবনে চাহিদা কিংবা বাজারের ব্যাপারটি ১৯০৪ সালে এদেশে আসা গ্রামোফোন কোম্পানির নতুন সংযোজন। ১৯২৭ সালে যুক্ত হওয়া বেতারবাহিত গণসম্প্রচার মাধ্যমের দিবারাত্রির ক্ষুধা এবং ১৯৩১ সালে সবাক হওয়া চলচ্চিত্র মারফত বর্ধিত সংগীততৃষ্ণা নিবারণের কারণেও বহুগুণ বেড়েছে এই চাহিদা। এই তিনটি নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলার মহৎ সংগীতকারদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন কেবল নজরুলই।

[এ-কারণেই কি বাংলা গানের অন্যান্য শাখার বিখ্যাত শিল্পীদের রেকর্ডেও আমরা নজরুলসংগীত শুনতে পাই? যেমন সাহানা দেবীর রেকর্ডের কথা আগেই বলা হয়েছে। কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, কোথা তুই খুঁজিস ভগবান, মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর, আমি দ্বার খুলে আর রাখবো না পালিয়ে যাবো গো। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: না মিটিতে মনোসাধ যেয়ো না হে শ্যামচাঁদ, বৃথা প্রবোধ দিস নে ললিতে। পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: আর লুকাবি কোথায় মা কালী, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়। তালাত মাহমুদের কণ্ঠে এচএমভি’র রেকর্ডে: নিশি ভোর হল জাগিয়া পরাণ পিয়া, আসলো যখন ফুলের ফাগুন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এচএমভি’র রেকর্ডে: হে বিধাতা দুঃখ শোক মাঝে তোমারি পরশ রাজে প্রভৃতি।]

সারকথা, ত্রিশের দশকের সূচনায় সৃষ্ট সবিশেষ সাংগীতিক পরিস্থিতির নিজস্ব উত্তাপে গ্রামোফোন কোম্পানির সদ্য নিয়োজিত গীতিকার-সুরকার-প্রশিক্ষক কাজী নজরুল শব্দ ও সুরের যে-সুরমূর্ছনা বা সুতান সৃষ্টি করলেন তার নাম নিজেই কোথাও লিখলেন ‘মডার্ণ’ কোথাও লিখলেন ‘আধুনিক’ (আমার জানামতে পঞ্চপ্রধানের আর কেউ তাঁদের কোনো শ্রেণীর গানকে এই অভিধায় অভিহিত করেননি)। এই শিরোনামের মাধ্যমে নজরুল যেন বোঝাতে চাইলেন, এ গান কোনো নির্দিষ্ট সুর-শব্দ কিংবা রূপবন্ধের কাছে দায়বদ্ধ নয়, এ গান সাংগীতিক বিন্যাসে মুক্ত রীতির, এ গান জনচিত্ত অভিমুখী, এ গানের উৎসার হৃদয় থেকে, অভিসারও হৃদয়ের দিকে। সংগীতরচয়িতা হিসাবে বস্তুত এই সমস্ত গুণই নজরুলের বৈশিষ্ট্য।

গানে তিনি সর্বদা উপস্থিত শ্রোতাকেই সম্বোধন করেন। জনচিত্তমুখিতাই নজরুলসৃষ্ট নব্যআধুনিকতার মূলকথা। সংগীতে এত কালের অন্তর্মুখিতার বদলে নজরুল-আনীত বহির্মুখিতা তাঁর গানের তাৎক্ষণিক জনাদৃতি এবং শ্রোতৃসমাজের কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত সাড়া পাওয়ার একটা বড়ো কারণ। তাৎক্ষণিক সে-জনাদৃতি কালজয়ী হয়ে সমানে বিদ্যমান আছে অদ্যাবধি। নজরুল প্রবর্তিত সেই আধুনিক বাংলা গান তাই আজ বোদ্ধা মহলে ‘ধ্রুপদী আধুনিক’ বলে অভিহিত। হরফ প্রকাশনীর ‘অখণ্ড নজরুল গীতি’র ষষ্ঠ সংস্করণে নজরুলের আধুনিক গান সংকলিত হয়েছে ৭৮১টি। তবে চলমান আহরণের প্রক্রিয়ায় সংখ্যাটা বিপুলতর হবার কথা এবং হয়ে চলেছেও।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলা গান নজরুলের আবির্ভাব পর্যন্ত ছিল মোটামুটি সর্বজ্ঞশাসিত অর্থাৎ কথাকার, সুরকার ও রূপকার একই ব্যক্তি—যেমন রামপ্রসাদ, রামনিধি, রবীন্দ্রনাথ। প্রতিপক্ষে নজরুল তাঁর গানকে বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা মারফত সমৃদ্ধতম হয়ে ওঠার পথ করে দিলেন। যেমন কথাকার নজরুল গানের দাবির বিচারে গানবিশেষকে সুরারোপ করতে দিলেন কমলদাশগুপ্তকে কিংবা শৈলেশ দত্তগুপ্তকে এবং গাইতে দিলেন উস্তাদ জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীকে কিংবা অভিনেত্রী-গায়িকা কাননবালাকে। তবে স্মর্তব্য যে সংগীতের সামগ্রিক রূপবন্ধটির ‘নজরুলিয়া’ বৈশিষ্ট্যগুলি সংরক্ষিত থাকতো যেহেতু আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞগণ সকলেই ছিলেন—উদ্যাপিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী বাংলার অন্যতম প্রধান কাব্যসংগীতকার, কাজী নজরুল ইসলামের পরম ভক্ত পরিকর।

নজরুল প্রযোজিত—বিশেষজ্ঞ গীতিকার বিশেষজ্ঞ সুরকার ও বিশেষজ্ঞ রূপকার—এই তিন রত্নের সম্মিলিত অবদানে আধুনিক বাংলা গান উৎপাদিত হচ্ছে আজও। তবে মান থাকছে না ম্যাসপ্রোডাকশনের কারণে, যেজন্যে সৃজিত না-বলে উৎপাদিত হচ্ছে বলতে হল। এদেশে যথা-অর্থে আধুনিক গানের প্রথম মিউজিক কম্পোজার ও প্রডিউসার কাজী নজরুল ইসলাম। কথাটা বলেছেন সংগীতগুণী সুকুমার রায়। দিলীপকুমার রায়ও ঠিকই বলেছিলেন যে এর আগে মিউজিক কম্পোজিশনের কোনো কনসেপ্টই ছিল না আমাদের। তাই বলতে হয় সাবেক কালের শেষ প্রধান প্রতিনিধি যেমন নজরুল, আধুনিক কালের প্রথম প্রধান প্রতিনিধিও তিনিই।

নজরুলের কালজয়ী আধুনিক গানের কিছু উদাহরণ: অরুণ রাঙা গোলাপ কলি, আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া, আমায় নহে গো ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান, আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, আমি পূরব দেশের পুরনারী, আমি যার নূপুরের ছন্দ, কথা কও কও কথা থাকিও না চুপ করে, সবার কথা কইলে কবি, কেন মন বনে মালতী বল্লরী দোলে, গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, গানগুলি মোর আহত পাখির সম, চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়, জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ, তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, তুমি হাতখানি যবে রাখ মোর হাতের পরে, নাই চিনিলে আমায় তুমি রইব আধেক চেনা, বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে, বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ এক জনমের নহে, বিদায় সন্ধ্যা আসিল ঐ, মনে পড়ে আজ সে কোন্ জনমে বিদায় সন্ধ্যা বেলা, মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম, যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায়, যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, সাঁঝের পাখীরা ফিরিল কুলায় প্রভৃতি।

৮.

নজরুলসংগীত শব্দটা শুনেই অনুষঙ্গবাদীরা, লোকসংগীতের অঙ্গনটি টপকে, রাগসংগীতের ভাবানুষঙ্গে চলে যান এবং ভুলে বসেন যে লোকসুরই রাগসুরের মূলাধার। সেদিক থেকে আজন্ম রাগসংগীতপ্রেমী নজরুলের লোকসুরের সঙ্গে ছিল নাড়ির সম্পর্ক। সে-কারণে লোকসুরভিত্তিক বাংলা গানে তাঁর অবদান ছিল মৌলিক এবং উচ্চতম মানের। নজরুলের পূর্বে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে অতুলপ্রসাদ সেন পর্যন্ত লোকসংগীতের কেবল বাউল সুরাঙ্গ অবলম্বনে গান রচিত হয়।

কিন্তু নজরুলের রচনায় বাউল ছাড়াও ঝুমুর, ঝাপান, সারিসহ ভাটিয়ালী-ভাওয়াইয়া ইত্যাদি নানান সুরভঙ্গি এসে মিলে মিশে লোকসংগীতভিত্তিক আবহমান বাংলার গানের ধারাটিও অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তাঁর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান উপজাতীয় সুর ঝুমুরঢঙের নিবিড় এবং ব্যাপক ব্যবহার। তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যের অন্যতম কারণ—ঝুমুর অঞ্চলের লোক হওয়ার সুবাদে তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত এই লোকসুরটির প্রয়োগ নজরুলের জন্যে হয়েছিল খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে সৃষ্ট হয়েছে, এই বিশেষ লোকসুরমণ্ডিত অনেক কালজয়ী গান যেমন—এসো ঠাকুর মহুয়া বনে ছেড়ে বৃন্দাবন, কুনুর নদীর ধারে ঝুনুর ঝুনুর বাজে, ঝুম ঝুম ঝুমরা নাচ নেচে কে এল গো, তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে একা বসে থাকি, হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল, নিমফুলের মউ পিয়ে ঝিম হয়েছে ভোমরা, চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনি ঝিনি বাজে লো, ও ঝুমরো তীর-ধনুক নিয়ে বল না কোথায় যাস, এই রাঙামাটির পথে লো প্রভৃতি।

তেমনি আজও সমান জনপ্রিয় নজরুলের ঝাপান সুরভঙ্গির গান যেমন হলুদ গাঁদার ফুল, কথা কইবে না বউ, কলার মান্দাস বানিয়ে দাও গো শ্বশুর সওদাগর, ওঠাও ডেরা এবার দূরে যেতে হবে, চিকন কালো বেদের কুমার কোন পাহাড়ে যাও প্রভৃতি। নজরুলের বেদে-বেদেনীর গানেও পাওয়া যায় সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনা। মৌলিক সংগীতপ্রতিভা সাধারণ একটি লৌকিক সুরকে কেমন অলৌকিক সুরলোকে নিয়ে যেতে পারে—তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নজরুলের ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ গানটি।

ভাটিয়ালী ঢঙে অভিনব সুরযোগে নজরুলের মানের গান আর কেউ রচনা করেছেন বলে আমার মনে হয় না এবং এর প্রমাণ কেবল ইতিহাস সৃষ্টিকারী গান ‘পদ্মার ঢেউ রে’-ই নয়। এক্ষেত্রে তাঁর অনেক গানই অদ্যাবধি অনতিক্রান্ত যেমন, ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই ত নদীর খেলা’, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয়’, ‘আমার ভাঙা নায়ের বৈঠা ঠেলে’ ইত্যাদি। আর ভাওয়াইয়া ঢঙেও অমর হয়ে আছে তাঁর ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’, ‘পদ্মদীঘির ধারে ঐ সখি লো কমল দীঘির ধারে’ ইত্যাদি।

বিভিন্ন লোকসুরের বৈচিত্র্যবিলাসী নজরুল কিন্তু পূর্বসূরিদের ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত বাউল সুর প্রয়োগেও বহু কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন, যেমন—‘বাঁশি বাজায় কে কদমতলায় ওগো ললিতে’, ‘ভবের এই পাশা খেলায় খেলতে এলি হায় আনাড়ি’, ‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার দেউল আমার এই আপন দেহ’, ‘ওহে রাখাল রাজ! কি সাজে সাজালে আমায় আজ’, ‘অসীম আকাশ হাতড়ে ফিরে খুঁজিস রে তুই কাকে’, ‘তুমি দুঃখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি হরি’ প্রভৃতি। এ পর্যন্ত সংকলিত নজরুলের লোকসুরঋদ্ধ গানের সংখ্যাও কম নয়, প্রায় ১৫০। লোকসুরের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নানা রকম লাগসই সুর পুরে বহু কালজয়ী গান রচনা করার সুবাদে নজরুল পথিকৃৎ হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন লোকসংগীতের ক্ষেত্রেও।

কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণীয় হয়ে আছেন প্রকৃতি পর্যায়ের বহু অমর গানের কারণেও—বিশেষত বর্ষা, বসন্ত ও শরৎ ঋতু বিষয়ক (শরতের জন্য প্রধানত উমাসংগীত স্মর্তব্য)। উদাহরণ : (বর্ষা) এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, মেঘের হিন্দোলা দেয় পূব হাওয়াতে দোলা, এল বরষা শ্যাম সরসা প্রিয় দরশা, রুম্ ঝুম্ ঝুম বাদল নূপুর বোলে বোলে, (বসন্ত) আসে বসন্ত ফুলবনে, এল ঐ বনান্তে পাগল বসন্ত, ফুল ফাগুনের এল মরশুম, আজি দোল ফাগুনের দোল লেগেছে, বসন্তমুখর আজি, (শরৎ) এস শারদপ্রাতের পথিক এস শিউলি বিছানো পথে প্রভৃতি।

কমিক-রিলিফরূপী বিষ্কম্ভক কিংবা গর্ভনাটক ছাড়াও, হাস্যরস সিনেমা-নাটকের শক্তিশালী অঙ্গবিশেষ। এই রসের স্বভূমি নয় সংগীত। তবু পঞ্চপ্রধানের দুজন তাঁদের গানেও এর শক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন—দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ব্যঙ্গগীতিতে ও রজনীকান্ত সেন রঙ্গগীতিতে। এই দুইজনের হাসির হাট জমজমাট থাকতেই অসাধারণ দক্ষতায় নজরুল তাঁর ব্যঙ্গগীতি ও রঙ্গগীতির—এককথায় হাস্যগীতির—পশরা সাজিয়ে মাতিয়েছিলেন সমগ্র বাংলার আবালবৃদ্ধবণিতাকে। তবে এ প্রসঙ্গে এও স্মর্তব্য যে গুরুগণের তুলনায় নজরুল উপকরণগত সুযোগ পেয়েছিলেন অনেক বেশি, যেমন গ্রামোফোন-বেতার-চলচ্চিত্র, আরো পেয়েছিলেন অনেক বেশি প্রতিভাবান গায়কের দল যেমন রঞ্জিত রায়, হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিমল গুপ্ত (দাশগুপ্ত) প্রমুখ।

এক্ষেত্রেও নজরুলের অনেক গানই কালজয়ী হয়েছে গানগুলির উপজীব্য চিরন্তন বলে—যেমন, টিকি আর টুপিতে লেগেছে দ্বন্দ্ব, বদনা গাড়ুতে মুখোমুখি বসে, দয়া করে দয়াময়ী ফাঁসিয়ে দে এই ভুঁড়ি, দে গরুর গা ধুইয়ে, আমার খোকার মাসী, প্রিয়ার চেয়ে শালী ভাল, ওহো আজকে হইব মোর বিয়া, আমার হরিনামে রুচি পরিণামে লুচি, ও তুই উল্টো বুঝ্লি রাম, দুপেয়ে জীব ছিল গদাই বিবাহ না করে প্রভৃতি।

নজরুল নিজেও তাঁর কাব্যের চেয়ে সংগীতের উপর বেশি আস্থা রাখতেন। মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর ‘নজরুল স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন ‘আমার মনে আছে, একদিন শ্রীভূপতি মজুমদার বলেছিলেন—“নজরুল, কী তুমি এত ভালো গান গাও যে গান পেলেই মেতে ওঠ।” সেদিন নজরুল খুব আহত হয়েছিল। সে বলেছিল, “ভূপতি-দা আমার কবিতার যত খুশি সমালোচনা করুন। কিন্তু আমার গানের সম্বন্ধে কিছু বলবেন না।” (নজরুল-চরিতমানস, ড. সুশীলকুমার গুপ্ত, পৃ. ৩৪৯)।

তাঁর সংগীতের উৎকর্ষ সম্পর্কে নজরুল বরাবরই অবহিত ছিলেন। ১৯৩৮ সালে জনসাহিত্য সংসদের ভাষণে নজরুল বলেছিলেন, ‘সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই তবে এইটুকু মনে আছে, সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি। সঙ্গীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন—এ বিশ্বাস আমার আছে।’

একই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অভিন্ন উক্তিগুলিও এখানে উল্লেখ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সংগীত-বিভাগের অধ্যক্ষ হেমেন্দ্রলাল রায়ের ভ্রাতা মেঘেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজে আমায় বলিয়াছিলেন’, “তোমরা কবি টবি যা বলো বলতে পারো, কিন্তু গানেই আমি বড়।” (প্রাগুক্ত, পৃ.৩৫০)। ৭ মার্চ ১৯৩৪ কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লেখা পত্রে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমার কাব্যের কোনোকালে অনাদর হতেও পারে কিন্তু বাংলাদেশের লোককে আমার গান গাইতেই হবে—সেই গানের সুরগুলি যদি বিকৃত বা লুপ্ত হয় তবে তাতে দেশের ক্ষতি এ আমি অহংকার করেই বলতে পারি’।

কথাগুলি যাঁরা বলেছেন তাঁরা-যে নির্ভুল ভবিষ্যতদ্রষ্টা তা আজ একুশ শতকের শূন্য-দশকশেষেও বিশ্বের পঁচিশ কোটি বাঙালি এক বাক্যেই বলতে পারে।

৯.

বাংলার সংগীতজগতে কাজী নজরুল ইসলামের এতসব নবসংযোজনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন না-হওয়া ছিল বিস্ময়কর। তার বদলে অবমূল্যায়ন হওয়া ছিল হতভম্বকর। কিন্তু কেন? কারণ কি এই যে নজরুল মাত্র ষোল বছর সংগীত রচনা করার পরই সম্বিত হারান ১৯৪২ সালে? না। ট্র্যাজিডিটি বরং তাঁর মহৎ কীর্তির প্রতি বর্ধিত দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ হওয়ার কথা। বাস্তবে হয়েছে বিপরীত। যে-নজরুল বিশের দশকে বাংলার কাব্যজগতে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে ত্রিশের দশকে বাংলার সংগীতজগতের নায়করূপে বরিত হয়েছিলেন, সম্বিত হারানোর পর থেকে বারোটি বছর সে-নজরুলের শিল্পকর্ম তাঁর কর্মক্ষেত্র কলকাতাতেই সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে রইল।

নজরুল বিষয়ে প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করেন আজহারউদ্দীন খান (১৯৩০- ), ১৯৫৪ সালে তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে (প্রকাশক, ক্যালকাটা বুক ক্লাব, ডিমাই পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১২)। ৫০ বছর পর বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত, বহুগুণ পরিবর্ধিত সপ্তম সংস্করণও আলোকঋদ্ধ হওয়ার চেয়ে তথ্যসমৃদ্ধই হয়েছে বেশি (প্রকাশক, সুপ্রিম পাবলিশার্স, রয়েল পৃ. ৮০৮)। এর পর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ড. সুশীলকুমার গুপ্ত’র (১৯২৬-৯৭) ‘নজরুল-চরিতমানস’ গ্রন্থটি বাঙালীর সংস্কৃতিতে নজরুলের যথাযথ অবস্থান নির্ণয় করে সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বটে তবে বেশ কিছু বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। বর্তমানে বাজারে আছে কিছু নতুন তথ্য ও তত্ত্ব সংযোজিত গ্রন্থটির তৃতীয় দে’জ সংস্করণ। বইটি সংগীত-অংশে দীনতর। ক্রিয়াত্মক ও তত্ত্বীয় সংগীতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় আছে, তেমন পাঠকের মনে হবে ড. গুপ্ত’র অনেক ধারণাই ধার করা এবং ভুলে ভরা। কয়েকটা নমুনা:

‘বস্তুতঃ রবীন্দ্রসংগীতের সুরবৈচিত্র্য আর কোন ভারতীয় সুরকারের রচনায় দেখা যায় না।’ (পৃ.৩২০)।

‘আমার মনে হয় সবদিক বিচার করলে বীর্যব্যঞ্জক গানে নজরুল দ্বিজেন্দ্রলালের চেয়েও বড় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী।’ (পৃ. ৩৪৬)।

‘মানবিক প্রেমগীতির মধ্যে নজরুলের গজলগুলি সর্বোৎকৃষ্ট।… তাঁর অন্যান্য প্রেমগীতিতে রবীন্দ্রপ্রভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়।’ (পৃ. ৩৩৭)।

‘তাঁর শ্যামাসংগীত রামপ্রসাদের আদর্শে রচিত। কীর্তন, বাউল প্রভৃতি গানে নজরুলের উপর রবীন্দ্রপ্রভাব খুবই বেশী।’ (পৃ. ৩৩৭)।

তবু বহু মূল্যবান উপাত্তের আকর এই গ্রন্থদুটির ঐতিহাসিক ভূমিকা বিরাট, যথা—ওই হন্তারক দুর্দিনে বিস্ময়কর কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে দ্রুতবিস্মরণশীল কালটিতে সার্বিক তথ্যাবলী তুলে ধরা এবং তা দুই মলাটের ভেতরে সংরক্ষণ করা।

সমসময়ে নজরুলের রচনাবলী সংরক্ষণের হাল ধরেছিলেন নজরুল গবেষণার পথিকৃৎ আবদুল কাদির। তাঁর উদ্যোগে প্রথমে পাকিস্তান পাবলিকেশন্স থেকে নজরুল-পরিচিতি নামে প্রবন্ধসংকলন বের হয় ১৯৫৯ সালে এবং নজরুল রচনাসম্ভার প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে ঢাকা থেকে, তবে সম্পাদকের নাম ছাড়া। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ আবদুল কাদির সম্পাদিত বলে কলকাতার হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, কিন্তু সেটিও সম্পাদকের সমজদার প্রবেশক কিংবা রসগ্রাহী ভূমিকা ছাড়া।

চল্লি¬শের দশকের শেষ ও পঞ্চাশের দশকের প্রথমাংশে সম্বিতহারা নজরুলের শিল্প সম্পর্কিত চর্চা বিঘ্নিত হওয়ার বেশকিছু প্রসঙ্গবহির্ভূত কারণও ছিল যথা—মহাযুদ্ধ, মহাদুর্ভিক্ষ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, দেশভাগ, সংগীতশিল্পীসহ গুণীজনদের বিপুলহারে দেশান্তরী হওয়া ইত্যাদি। অনতিবিলম্বেই অবশ্য বিখ্যাত নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম ও তাঁর স্বামী নজরুলসংগীতের অন্যতম পুরোধাপুরুষ কমল দাশগুপ্ত কলকাতায় ফিরে গিয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের দিয়ে নজরুলগীতির এলপি বের করার উদ্যোগ নেন। প্রথমদিককার খ্যাতনামা নজরুলসংগীতশিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় লাভ সঙ্স অব নজরুল শীর্ষক প্রথম এলপি-টি সুপারহিট হতেই বলতে গেলে সেখানে নজরুলচর্চার পুনরভ্যুদয় হয় যথাযোগ্য উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে। ষাটের দশকের শুরুতে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় নজরুলের উদ্দীপনী সংগীতনিচয় কলকাতার বেতার ও মঞ্চ মারফত জনগণকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে এবং এই প্রক্রিয়ায় নজরুলচর্চাও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে।

তবে নজরুলচর্চার দ্বিতীয় অধ্যায় ইতিমধ্যেই স্থানান্তরিত হয়ে যায় কলকাতা থেকে ঢাকায়, বলা যায় একরকম অলক্ষ্যেই। অতঃপর নজরুলসংগীতের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে এদেশের বেতার-টিভি ছাড়াও ঢাকার ঐতিহাসিক কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, পঞ্চাশের দশকের বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ষাটের দশকের ছায়ানট, সংগীত মহাবিদ্যালয়, নজরুল একাডেমী, সত্তরের দশকের হিন্দোল, দোলনচাঁপা, সংগীতভবন প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়বস্তুবিশেষজ্ঞ সংগীতপ্রতিষ্ঠান। নজরলের সাহিত্য ও সংগীতের উভয় ক্ষেত্রেই অমূল্য অবদান রাখছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত নজরুল ইন্সটিটিউট। এইসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত অনুধ্যানের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীত সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে এবং বাংলাদেশেই। এখানে মূল্যবান কাজ করে যাচ্ছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নজরুলসাহিত্যে (কাজী নজরুল ইসলাম/জীবন ও সৃষ্টি, নজরুল প্রসঙ্গে প্রভৃতি) এবং ড. করুণাময় গোস্বামী নজরুলসংগীতে (নজরুল-গীতি প্রসঙ্গ, বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান ইত্যাদি)। ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দও নজরুল গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।

প্রকৃতপক্ষে সংগীতশিল্পী নজরুল হাঁটতেন জনতার মিছিলে—গান লিখতেন মজলিশে বসে, সুর করতেন রিহার্সেলরুমের কোলাহলে, গান গাইতেন ঘরোয়া জলসায়, কলকারখানায়, জনসভায়, গণমিছিলে। সংগীতসৃজনরত নজরুলকে দেখতে চাইলে পাঠক কবি জসীমউদ্দীনের চোখে একনজর দেখতে পারেন:

‘আমি দেখিয়াছি গ্রামোফোন কোম্পানীতে নানা ধরনের গানের হট্টগোলের মধ্যে কবি বসিয়া আছেন—সামনে হারমোনিয়ম—পাশে অনেকগুলি পান আর গরম চা। ছ’সাতজন নামকরা গায়ক বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়—একজনের চাই শ্যামাসংগীত, অপর জনের কীর্তন, একজনের ইসলামী সংগীত, অন্যজনের ভাটিয়ালী গান—আরেকজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান। এঁরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বাসিয়া আছেন। কবি তাঁহার মানস-লোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া আনিয়া তাঁহাদের করপুট ভরিয়া দিবেন। কবি ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম বাজাইতেছেন, আর গুন্গুন্ করিয়া গানের কথাগুলি গাহিয়া চলিয়াছেন। মাঝে মাঝে থামিয়া কথাগুলি লিখিয়া লইতেছেন। এইভাবে একই অধিবেশনে সাত-আটটি গান শুধু রচিত হইতেছে না—তাহার সুর সংযোজিত হইয়া উপযুক্ত শিষ্যের কণ্ঠে গিয়া আশ্রয় লইতেছে।’ (সংগীত-তত্ত্ব, নজরুল প্রসঙ্গ: দেবব্রত দত্ত সংগীত প্রভাকর, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)।

১০.
‘কাব্য ও সুরবৈভব একই সুরসূত্রে সম্পৃক্ত করে মালাকার (নজরুল) তাঁর উত্তরসুরীদের জন্য যে সুরগীতি সৃষ্টি করে গেছেন তার সত্যিকারের মূল্যায়ন আজও সম্ভব হয়নি। কবি নজরুল সংগীত জগতে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকার। যা, কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং এই সুরের যাদুস্পর্শ একদিন জনচিত্ত জয় করবেই।’ [ পৃ. ৪৮, সংগীত-তত্ত্ব (নজরুল প্রসঙ্গ), তৃতীয় সংস্করণ, দেবব্রত দত্ত, সংগীত প্রভাকর, ব্রতী প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯১]।

তা জনচিত্ত ইতোমধ্যেই জয় করেছে নজরুলসংগীত। বরং বলতে হয় যে একমাত্র নজরুলের গানই তার সহজসরল কথা, মনোরঞ্জক সুর ও স্বভাবগত গতিক্রিয়ার জাদুবলে জনচিত্ত বা আমজনতার চিত্ত জয় করেছে, যা রবীন্দ্রনাথের গান করেনি; তার জটিল ভাবগত ও গভীর প্রকৃতিগত কারণে। অথচ এই জনগণচিত্ত জয় করাটা গানের জন্য একান্তই জরুরি। কারণটা একটু সবিস্তারেই বলছি।

আধুনিক জীবনের অতি-দ্রুত গতি, বিহ্বল প্রকৃতি, রুদ্ধশ্বাস লয়-তাল, ভোগাসক্ত মানুষের ভোগজনিত ক্লান্তি, সর্বাত্মক প্রতিযোগিতার লাগাতার চাপ ইত্যাদির ক্রমপুঞ্জিত টেনশন ঈষৎ ভুলিয়ে রাখতে চারুশিল্পগুলির মধ্যে একমাত্র সংগীতই সক্ষম। পরিশ্রান্ত মনে সহজতর সাহিত্যের চেয়েও দুরূহতর সংগীতেরই উপভোগ সম্ভব হয়। কারণ, একমাত্র এই চারুশিল্পটিই পারে মগজকে না-খাটিয়েও হৃদয়কে মাতিয়ে তুলতে। কেবল সংগীতই পারে তার স্বয়ংক্রিয় চালিকাশক্তি দিয়ে ক্লিষ্ট চিত্তটিকে মুহূর্তে উদ্দীপ্ত করে দিতে।

শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরধ্বনি প্রস্তুতিহীন শ্রোতার মনকেও ব্যাকুল করতে পারে। নির্মিতিহীন পাঠকের মনের ওপর কাব্যশিল্পের আবৃত্তি তা করতে পারে না। একই কারণে, সিডি-রম্ বাদিত কাব্য-নাট্য-গল্প-উপন্যাসও পারে না এমপিথ্রি বাদিত সংগীতশিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে। কেননা, প্রি-রেকর্ডেড্ কাব্য-নাট্যাদি শ্রবণের সমান্তরাল ক্রিয়া হিসাবে অন্য কোনো কর্ম সম্পাদন করা চলে না—যেমন চলে সংগীতশ্রবণের পাশাপাশি। চিত্র, ভাস্কর্য প্রভৃতি চারুকলা তো আলোচ্য

নজরুল প্রতিভা


নজরুল প্রতিভা
বাবু রহমান |
কাজী নজরুল ইসলামের সৌভাগ্য, তিনি যখন কর্মে মগ্ন তখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে। আর যখন বাকরুদ্ধ হলেন- তখন প্রচারের বাইরে; এক সময় তা অন্ধবিবরে। কবির জীবিত অবস্থায় দিল্লী থেকে ১৯৩৮ সালে আখতার হোসেন রায়পুরী’র অনুবাদে ‘পীয়াম-ই-শাহাব’ শীর্ষক উর্দু ভাষায় নজরুল কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। জানা যায়, ছান্দসিক আব্দুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনা করেছেন কবির জীবদ্দশায়।

ইউটিউব থেকে: নজরুল ইসলামের ভিডিও ফুটেজের সাথে ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুলের গান

নজরুল চর্চার অন্ধকার যুগে–১৯৪৯ সালে, মহামানব কাজী আব্দুল ওদুদের (১৮৯৪-১৯৭০) কোলকাতার বর্মণ পাবলিশিং থেকে ‘নজরুল প্রতিভা’ নামে মূল্যায়নমূলক একটি চটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী রচিত ‘নজরুল সাহিত্যের ভূমিকা’ নামে ‘পাকিস্তান বুক স্টল’ থেকে আর একটি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘদিন দুষ্প্রাপ্যের খাতায় নাম রেখে নজরুল জন্মশতবর্ষে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে এর ২য় সংস্করণ হয়। ১৯৬২ সালে শহীদ আমীর হোসেন চৌধুরী রচিত নজরুল কাব্যে রাজনীতি গ্রন্থটি বহুকাল পর ‘আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরাম’ থেকে বের হয়।

আর নজরুলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৪টি গীতিগ্রন্থ এবং ৩টি স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে দুই বাংলায় নজরুল প্রায় বিশ বছর অনুপস্থিত। অবশ্য তথাকথিত পাকিস্তানে (বাংলাদেশের নাম বদল করে) মানুষ নজরুলকে ভারত থেকে আগত এক শ্রেণীর মোহাজের মুসলিম নজরুল প্রয়োজনীয় ব্যস্ত। ভারতে কংগ্রেসী আমলে অবহেলিত নজরুলকে কমরেড মুজাফফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩), কমল দাশ গুপ্ত ১৯১২-১৯৭৪), আব্দুস সালাম, মজহারুল ইসলাম (নবজাতক প্রকাশনী), কল্পতরু সেনগুপ্ত (১৯৮৬)-সহ একদল নজরুল প্রেমিক মহান নজরুলকে সামনে আনার প্রাথমিক প্রয়াস পান। সে ধারা ষাটের দশকের প্রথম পাদে বিলম্বিত লয়ে শুরু হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বেগবান হয়। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৬ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসায় সেই গতি আরও গতিশীল হয়ে আজো বহমান। নজরুলী যুগের পর থেকে মহা অন্ধকার, তারপর আবার আলোর রেখা দেখা যায়। জগৎ ঘটক (১৯০২-১৯৮৯), নিতাই ঘটক, কমল দাশগুপ্ত, কাজী অনিরুদ্ধ (১৯৩১-১৯৭৪), ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, মনোরঞ্জন সেন, নারায়ন চৌধুরী (১৯১২-১৯৯১) ও কল্পতরু সেনগুপ্ত (১৯১৬-২০০৩), নজরুলী নব জাগরণের প্রধান সৈনিক। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৯৩০-১৯৯২) ও অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় (১৯৩২-১৯৮৩) নব জাগরণের দুই প্রধান সুর শিল্পী। একজন আধুনিক গানের জগৎ ছেড়ে, আর একজন ডাক্তারী পেশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নজরুল সঙ্গীত প্রচার ও প্রসারে আমরণ যুদ্ধ করে গেছেন। নজরুল সঙ্গীতের নব ইতিহাসে এই দুই মহান কণ্ঠশিল্পীর অবদান বাঙালি জাতির জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এক কথায়, তারা নজরুল সঙ্গীতের পুনর্জন্ম দিয়েছেন। বহু গ্রামোফোন পিপাসু মানুষের হৃদয়ে স্পন্দিত হয়েছে। রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডিতে তা ধারণ করে সুর হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিনীর সুর লালিত্য বাংলা গানে কবি সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শিল্পের রূপ, রস ও গন্ধ নজরুল তাঁর রচিত বাণী ও সুরের মাধ্যমে তূরীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যার অনেক গান এখনো অশ্রুত, স্বরলিপিহীন, শ্রুতিবদ্ধহীন, অসুরারোপিত এবং অনাবিষ্কৃত।

ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক যাঁতাকলে পরে নজরুলের অবস্থা ‘ত্রাহি মধুসূদন’। আজ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশে প্রগতিশীলদের ভালবাসায় নজরুল সাহিত্য-সঙ্গীত স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত। বাংলা গানের নব জোয়ারে নজরুল সঙ্গীত এক বিশাল ক্যানভাস জুড়ে রয়েছে। নজরুলের স্বরচিত গ্রন্থ ছাড়া, তাঁর বন্ধুদের স্মৃতিকথায়, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায়, নতুন গবেষণায় এবং আদি সুরের মহিমায় বাংলা গান সর্বপ্লাবী। আজ অভিসন্দর্ভ রচনার সাথে সাথে বেশ কয়েকটি নজরুল বিষয়ক অভিধান প্রকাশিত হওয়ায় বিস্ময় জাগে–এতদিন কেন চাপা পড়েছিল এই সুর ভাণ্ডার। এক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আর প্রগতিশীল রাজনীতিকদের নজরুল চর্চায় অবহেলার কারণে এ ধারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বার বার। কিন্তু বর্তমান চর্চায়, নিম্নলিখিত নজরুল সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থগুলি দেখে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়–‘বিশ্ব ব্যাপিয়া আছ তুমি।’

ইউটিউব থেকে: নজরুল ইসলাম অভিনীত সিনেমা ‘ধ্রুব (১৯৩৪)’র ভিডিও ক্লিপ

ভাবতে অবাক লাগে যারা নজরুলের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করেনি, নজরুলকে কবি বলতে দ্বিধা করেছে, নজরুল সাহিত্যকে অবমূল্যায়ন করেছেন, নজরুলকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন–তারাই পরবর্তীকালে নজরুলকে সম্বর্ধনা দিয়েছেন; নজরুল তাদের চিনতে পারলে বিদ্রোহ করতেন এবং মেকি সম্বর্ধনায় রাজি হতেন না। এই উপমহাদেশের তথা সাড়া বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের জাতীয় কবিকে যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের জাতীয় কবি অভিধায় অভিষিক্ত করে নিজেরা গৌরবান্বিত হচ্ছেন, তখন শোষিতের বিশ্বকবিকে ছোট করছেন। তাদের অনেকেই নজরুল নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে, কেউ কেউ চেয়ারম্যান, কেউ কেউ নির্বাহী কর্মকর্তা সেজে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। হায়রে বাংলাদেশের নব্য নজরুল প্রেমিক! পৃথিবী তোমাদের ক্ষমা করলেও, অশরীরী নজরুল কিছু করতে না পারলেও প্রকৃত নজরুল গবেষক, শিল্পীরা তোমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না। তোমরা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ট্রাজেডি এই–যারা নজরুল সম্বন্ধে দুটি লাইনও লেখেনি- তাদের কেউ কেউ নজরুলী প্রতিষ্ঠানের কর্তা সেজে বসে। তবে বর্তমানে অনেকেই নজরুলকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়েছেন। নিজের ভাগ্য ফেরাতে নজরুল গবেষক, স্বরলিপিকার সেজেছেন। তাতে এসব অযোগ্য নজরুল গবেষকদের হাতে পড়ে নজরুলচর্চা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন! নিচে নজরুল সঙ্গীত নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থগুলির একটি তালিকা দেওয়া হলো:

বই (প্রথম প্রকাশ)
গানের সংখ্যা

বুলবুল, (প্রথম প্রকাশ- ১৯২৮)
৪৯টি

চোখের চাতক (প্রথম প্রকাশ- ১৯২৯)
৫৩টি

মহুয়ার গান (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩০)
১৫টি

নজরুল গীতিকা (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩০)
১২৭টি

চন্দ্রবিন্দু (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩১)
৬১টি

সুরসাকী (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩২)
৯৯টি

জুলফিকার (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩২)
২৪টি

বনগীতি (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩২)
৭১টি

গুল-বাগিচা (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৩)
৮৭টি

গীতি শতদল (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪)
১০১টি

গানের মালা (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪)
৯৫টি

নজরুল স্বরলিপি (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩১)
৩৫টি

সুরলিপি (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪)
৩১টি

সুরমুকুর (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪)
২৮টি

পরবর্তিতে প্রকাশিত গানের সংকলন:

নজরুল সঙ্গীত সম্ভার: নজরুল হস্তলিপি- বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ১৯৮২, গান- ১০৩।
নজরুল গীতি সন্ধানে সংগ্রহ– আব্দুস সাত্তার, শিল্পী কুটির, ১২ ফেব্রুয়ারি- ১৯৭০।
অপ্রকাশিত নজরুল, সম্পাদনা- আব্দুল আজীজ আল আমান, হরফ, (গান- ১৬৩), ১৭/১১/১৯৮৯, কোলকাতা।
জাগো সুন্দর চিরকিশোর, সম্পাদনা- ও সংগ্রহ- আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, আগস্ট ১৯৯১।
অপ্রকাশিত নজরুল-২, সম্পাদনা- ব্রহ্মমোহন ঠাকুর (গান- ৫৬) হরফ প্রকাশনী, ২৫ মে ১৯৯২, কোলকাতা।
নজরুলের হিন্দী গান, সংগ্রহ- আসাদুল হক, জুন ১৯৯৫, গান- ৮১, ঢাকা।
নজরুলের হারানো গানের খাতা, সম্পাদনা- মুহম্মদ নূরুল হুদা, নজরুল ইনস্টিটিউট, (গান- ১৬০), জুন ১৯৯৭।
কার গানের তরী যায় ভেসে, সম্পাদনা- আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, ১.৫.১৯৯৯, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহ, সংগ্রহ ও সম্পাদনা- রশিদুল নবী, নজরুল ইন্সটিটিউট, অক্টোবর-২০০৬, ঢাকা।
পাণ্ডুলিপি (নজরুল সঙ্গীত), সম্পাদনা- আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।
প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণা ও মূল্যায়ন:

নজরুল কাব্যগীতি বৈচিত্র্য ও মূল্যায়ন- ৬, বাঁধন সেনগুপ্ত, (২০/০৭/১৯৭৬), নবজাতক প্রকাশনী।
নজরুল গীতির নানাদিক, শম্ভুনাথ ঘোষ, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রা.লি., মে ১৯৭৭, কলকাতা।
কাজী নজরুলের গান, নারায়ন চৌধুরী, এ মুখার্জী এ- কোম্পানী প্রা. লি., জুন ১৯৭৭, কোলকাতা।
নজরুল সঙ্গীতের সুর বিকৃতি ও সুর সংরক্ষণ– ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, নবজাতক প্রকাশন, মে ১৯৯২।
নজরুলের গানের রাগ, আবুল আজাদ, প্রকাশক- নিজে, নভেম্বর ১৯৯৪, ঢাকা।
নজরুল গীতি আলোচনা, কল্পতরু সেনগুপ্ত, নজরুল একাডেমী, চুরুলিয়া, ১লা নভেম্বর, ১৯৯৫।
সঙ্গীত সংবিৎ, আব্দুশ শাকুর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জুন ১৯৯৭।
ইসলামী ঐতিহ্যে নজরুল সঙ্গীত– আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, জানুয়ারি ২০০০।
নজরুলের রাগভাবনা, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর- নজরুল ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০০০।
রঙ্গমঞ্চে নজরুল, অনুপম হায়াৎ, নজরুল ইনস্টিটিউট, ডিসেম্বর ২০০০।
নজরুলের গান: কবিতার স্বাদ, সফিকুন্নবী সামাদী, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, জানুয়ারি ২০০১।
নজরুল ও মা’ রিফুন্নাসমাত, বাবু রহমান, নজরুল ইনস্টিটিউট, মে ২০০১।
নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপিতে রাগ দর্শন, কৃষ্ণপদ মণ্ডল, নজরুল ইনস্টিটিউট, একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৪।
নব মূল্যায়নে নজরুল গীতি ও স্বরলিপি, সুকুমার মিত্র, পুনশ্চ, ২৬শে মে ২০০৫, কলকাতা।
নজরুল সঙ্গীতের নানা প্রসঙ্গ, বাবু রহমান, গতিধারা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭।
নজরুল সঙ্গীতের বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্য, মায়া রায়, ভাষা; আগরতলা, ত্রিপুরা, মার্চ ২০০৮।
সাক্ষাৎকার ও জীবন:

নজরুল গীতি অন্বেষা, কল্পতরু সেনগুপ্ত, এনবিএ প্রা. লি., জুলাই ১৯৭৭, কোলকাতা।
নজরুল সঙ্গীতের রূপকার, আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, জুলাই ১৯৯০, ঢাকা।
চলচ্চিত্রে নজরুল, আসাদুল হক, বাংলা একাডেমী, মে ১৯৯৩, ঢাকা।
বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, নভেম্বর ১৯৯৫।
বেতারে নজরুল ও তার গান, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, নবজাতক প্রকাশনী, ২৬শে মে ১৯৯৮।
নজরুল যখন বেতারে, আসাদুল হক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৯, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীতের অবিস্মরণীয় শিল্পী, আসাদুল হক, নজরুল একাডেমী, মে ১৯৯৯, ঢাকা।
সুধীজনের দৃষ্টিতে নজরুল সঙ্গীত, আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, মে ১৯৯৯, ঢাকা।
নজরুলের শ্রুতিধর ধীরেন দাস, আসাদুল হক, হাতে খড়ি, জানুয়ারি ২০০৪, ঢাকা।
কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক সাক্ষাৎকার, সম্পাদনা- আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল ইনস্টিটিউট, ২৭ আগস্ট ২০০৪, ঢাকা।
প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ:

সঙ্গীত পরিক্রমা, নারায়ন চৌধুরী, এ মুখার্জী এন্ড কো. প্রা. লি., ১৯৫৫।
বাংলা গানের গতিপথ, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, ডি.এম. লাইব্রেরি, ১৯৫৫, কলকাতা।
আমার জীবনের কথা, আব্বাস উদ্দীন, হরফ প্রকাশনী, মাশহুদা বেগম, ২৪ পরগণা।
সবারে আমি নমি, কাননবালা (অনুলিখন-সন্ধ্যা সেন), এম.সি. সরকার এ- সন্স প্রা.লি., ১৯৭৩।
বাংলার বুলবুল আঙ্গুরবালা, প্রশান্ত দাঁ, ভারতী বুক স্টল, জুন-১৯৮৩, কলকাতা।
স্মরণ-বরণ, গোপাল দাস মজুমদার, ডি.এম. লাইব্রেরি, ১৮ জুন, ১৯৮১, কলকাতা।
ইন্দুবালা, ড. বাধন সেন গুপ্ত, মৌসুমী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, কলকাতা।
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, শ্রী জগন্ময় মিত্র, ইন্ডিয়ান এসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রা. লি., ৭/২/৮৫।
আমার সঙ্গীত জীবন ও আনুষঙ্গিক জীবন, সন্তোষ সেন গুপ্ত, এ মুখার্জী এন্ড কোম্পানী প্রা. লি., বইমেলা, ১৯৮৬।
সুরের আগুন, গোলাম কুদ্দুস, দীপায়ন, ১৯৮৭, কলকাতা।
তুলসী লাহিড়ী, বিজিত কুমার দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমী, জুন ২০০৫, কলকাতা।
অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ, কল্যাণী কাজী, সাহিত্যম, মে ১৯৯৮, কলকাতা।
কাজীদার সঙ্গে (জগৎ ঘটক ও নিতাই ঘটক), সম্পাদনা- কল্পতরু সেনগুপ্ত, নজরুল একাডেমী, চুরুলিয়া, এপ্রিল ১৯৯৭, ভারত।
বিস্মৃত সুরশিল্পী কে মল্লিক, সংগ্রহ, সম্পাদনা, ভূমিকা: আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, অক্টোবর ২০০১।
ফৈয়াজী আলোকে নজরুল গীতি– কাকলী সেন, আদি নাথ ব্রাদার্স, বৈশাখ ১৪১৫ (২০০৮)।
বিমানে বিমানে আলোকের গানে, সিতাংশু শেখর ঘোষ, যোগমায়া প্রকাশনী, জানুয়ারি ২০০৩।
দুখু মিয়ার লেটো গান, মুহাম্মদ আয়ুব হোসেন, নজরুল ফাউন্ডেশন, বিশ্বকোষ পরিষদ, ৬ ডিসেম্বর ২০০৩, কোলকাতা।
অভিধানসমূহ:

নজরুল সঙ্গীত কোষ (আংশিক), সুরবাণী পত্রিকা, বাবু রহমান, ১৯৮৪, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীত অভিধান, আঃ সাহাব, নজরুল ইনস্টিটিউট, প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার, ২৫ মে ১৯৯৩।
নজরুল শব্দকোষ, আবুল কালাম মুস্তাফা, বাংলা একাডেমী, মে ১৯৯৩, প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী।
নজরুল গীতি সহায়িকা, কল্পতরু সেনগুপ্ত, প.রাজ্য.স.এ, জুন ১৯৯৭
নজরুল শব্দপঞ্জি, হাকিম আরিফ, নজরুল ইন্সটিটিউট, জুন ১৯৯৭, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীত কোষ, ব্রহ্মমোহন, বাণী প্রকাশ, জানুয়ারি ১৯৯৪।
নজরুল সঙ্গীত কোষ, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, নজরুল ইনস্টিটিউট, মে ২০০৯।
চাঁদেরে ঘিরি নাচে ধিরি ধিরি তারা অগণন, বাবু রহমান।
আর্টস-এ আরো লেখা

 নজরুলের হারিয়ে যাওয়া গান: “ওরে আশ্রয়হীন শান্তিবিহীন আছে তোরও ঠাঁই আছে…”
উপমহাদেশের সঙ্গীতকার কমল দাশগুপ্ত
শামসুর রাহমানের গান: ‘আমি প্রতিদিন তোমাকেই দেখি’
নজরুলসঙ্গীতের নবজন্মে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা
মানুহে মানুহর বাবে…: গানের পাখি ভূপেন হাজারিকা

…….

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: বাবু রহমান
ইমেইল: baburahman@gmail.com
http://arts.bdnews24.com/?p=3700&