Thursday 22 June 2017

পলাশী-উত্তর বাংলার চালচিত্র


পলাশী-উত্তর বাংলার চালচিত্র

আমাদের জাতি সত্ত্বার বিকাশ ধারা বই থেকে ।
১৭৫৭ সালে পলাশীতে সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্য-বিপর্যয় এবং ১৭৬৪ সালে বখশারে মীর কাসিমের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। স্বাধীনতা লোপ পাওয়ার সাথে সাথে ক্ষমতা চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নাম ক এক বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে। ফলে অতি অল্প সময়ের লুণ্ঠন-শোষণে বিপর্যস্ত হয় অর্থনীতিসহ জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ অরাজকতা ও বিপর্যয়। বিশেষ করে ভারতের পুরাতন শাসক মুসলমানরা যাতে আর কখনো মাথা তুলতে না পারে সেজন্য সব ব্যবস্থা পাকাপাকি করা হয়।

ইংরেজ ও তার এদেশীয় দালালদের লুণ্ঠন

ইংরেজরা দিল্লীর সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্ব আদায়েরা আনুষ্ঠানিক ফরমান আদায় করে ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট তারিখে। কিন্তু ১৭৫৭ সাল থেকেই তারা শাসন কর্তৃত্ব কক্ষিগত করেছিল। মীর জাফরকে ‘পুতুল নবাব’ সাজিয়ে লর্ড ক্লাইভ শুরু থেকেই ‘প্রকৃত নবাব’ সেজে বসেছিলেন। আর এই পুতুল নবাবীর সূচনাকাল থেকেই ইংরেজনা এদেশে ইতিহাসের নজীরবিহীন শোষণ ও লুণ্ঠনে লিপ্ত হয়েছিল।

খোদ লর্ড ক্লাইভ পলাশীর ‘যুদ্ধ জয়ের’ বখশিশ হিসেবে মীর জাফরের কাছ থেকে ২ লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে রাতারাতি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হন। মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছয়জন কর্মচারীকে ১,৫০,০০০ পাউন্ড উৎকোচ প্রদান করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের সদস্যরা প্রত্যেকে ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ পাউন্ড ঘুষ আদায় করেন। (পি. রবার্টস: হিস্টরী অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৩৮; ড. এম এ রহীম : বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৯)

কোম্পানির ও কলকাতার অধিবাসীদের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে এবং সৈন্য ও নৌবহরের ব্যয় বাবদ কোম্পানি আদায় করে মোট ২৫,৩১,০০০ পাউন্ড। তাছাড়া মীর কাফর ইংরেজ কর্মকর্তাদের খুশি করতে ৬,৬০,৩৭৫ পাউন্ড উপঢৌকন দেন। বিভিন্ন ইংরেজ কর্মচারী মীর জাফরের কাছ থেকে চব্বিশ পরগণা জেলার জমি ছাড়াও ৩০ লাখ পাউন্ড ‘ইনাম’ গ্রহণ করেছিল। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভকে ৩৪,৫৬৭ পাউন্ড বার্ষিক আয়ের দক্ষিণ কলকাতার জায়গীর প্রদান করা হয়। (ব্রিজেন কে গুপ্ত : সিরাজউদ্দৌলা এন্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পৃষ্ঠা ৪১)।

ইংরেজদের বিভিন্ন রূপ টাকার দাবি মেটাতে মীর জাফর রাজকোষ শূণ্য করে ফেলেছিলেন। মীর কাসিম এই ঋণ পরিশোধ এবং মসনদের বিনিময়ে কোম্পানির কর্মচারীদেরকে ২০০০,০০০ পাউন্ড দিয়েছিলেন। (ড. এম এ রহীম : পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৬)

মীর জাফরের পুত্র নাজমুদ্দৌলা ১৭৬৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর মসনদ লাভের জন্য কোম্পানির কর্মচারীদেরকে যে ঘুষ দেন তার পরিমাণ ছিল ৮,৭৫,০০০ টাকা। রেজা খান ২,৭৫,০০০ টাকার উৎকোচের বিনিময়ে এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক নবাবের নবাব-নাযিম নিযুক্ত হয়েছিলেন। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০)

উৎকোচ নামক দুর্নীতি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানী করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে ষাট লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল। এ কথা ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। (Fourth Parliamentry Report 1773, P-534; সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ৯)।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ বিলাতে নিয়ে যায়। ক্লাইভের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে তিনি নিজ আচরণ সমর্থন করে বলেন:

“পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর আমার যে অবস্থা হয়েছিল, তা আপনারা ভেবে দেখুন। একজন বড় রাজার ভাগ্য আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। একটি সমৃদ্ধ নগর আমার দয়ার প্রতিক্ষায় আছে। আমার মুখের সামান্য হাসিতে কৃতার্থ হওয়ার জন্য ধনী মহাজনরা একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। আমার দুই পাশে স্বর্ণ মণিমুক্তায় পূর্ণ সিন্দুকের সারি এবং এগুলি কেবল আমারই জন্য খোলা হয়েছে। (পার্লামেন্ট কমিটির) সভাপতি মহোদয়, এ মূহূর্তে আমি নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যাই যে, তখন আমি কিভাবে নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিলাম”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৬-১২৭)

বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে ইংরেজরা একা ছিল না। তাদের পাশে ছিল তাদের দীর্ঘ দিনের সহচর এদেশী দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়ানগোষ্ঠী। তাদের শোষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে কট্টর সাম্রাজ্যবাদী লর্ড ব্যারিংটন মেকলে স্বয়ং মন্তব্য করেছেনঃ

“কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের প্রভু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, নিজেদের জন্য, প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তারা দেশী লোকদের উৎপন্ন দ্রব্য অত্যন্ত কম দামে বেচতে এবং অন্যদিকে বিলাতি পণ্য খুবই চড়া দামে কিনতে বাধ্য করত। কোম্পানি তাদের অধীনে একদল দেশী কর্মচারী নিয়োগ করত। এই দেশীয় কর্মচারীরা যে এলাকায় যেত, সে এলাকা ছারখার করে দিত। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার উচ্চপদস্থ (ইংরেজ) মনিবের শক্তিতে বলীয়ান। আর এই মনিবদের প্রত্যেকের শক্তির উৎস ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। (তাদের ব্যাপক লুণ্ঠন ও শোষণের ফলে) শীঘ্রই কলকাতায় বিপুল ধন-সম্পদ স্তূপীকৃত হলো। সেই সাতে তিন কোটি মানুষ দুর্দশার শেষ ধাপে এসে দাঁড়ালো। বাংলার মানুষ শোষণ ও উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্হ একথা ঠিক, কিন্তু ও ধরনের (ভয়ঙ্কর) শোষন ও উৎপীড়ন তারাও কোনদিন দেখেনি”। (Macaulay : Essaya on Lord Clive, P-63; সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১০)

ইংরেজরা শাসন ক্ষমতা লাভের আগে দীর্ঘকাল চেষ্টা করেও তাদের পণ্য-ব্যবসা সমাজের গভীর অভ্যন্তরে বিস্তৃত করতে পারেনি। এদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজের কাঠামো অক্ষত রেখে তাদের এই ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করা সম্ভব ছিল না। আগে যা কখনো সম্ভব হয়নি, পলাশীর পরে এখন তা সম্ভব হলো। ইংরেজরা শাসন ক্ষমতা হাত পাওয়ার সাথে সাথে নজীরবিহীন ক্ষিপ্রতার সাথে বাংলা ও বিহারের প্রাচীন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজের এই ভিত্তি ও কাঠামোটাকে গুঁড়িয়ে দেয়।

এই সমাজকে ইংল্যান্ডের ক্রমবর্ধমান শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহের যন্ত্ররূপে ব্যবহারের প্রক্রিয়া হিসেবে তারা-

ক. ভুমি-রাজস্বের নতুন ব্যবস্থা চালু করে এবং

খ. ভূমি-রাজস্ব হিসেবে ফসল বা উৎপন্ন দ্রব্য আদায়ের প্রচলিত পদ্ধতির বদলে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।

ইংরেজ প্রবর্তিত এই নতুন ভূমি-ব্যবস্থা ও কর-ব্যবস্থা সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায় মন্তব্য করেন :

“এই দুই অস্ত্রের প্রচণ্ড ধ্বংসকারী আঘাতে অল্পকালের মধ্যেই বাংলা ও বিহারের প্রাচীন গ্রাম-সমাজের ভিত্তি ধূলিসাৎ হইল। বিহার ও বাংলা শ্মশান হইয়া গেল”। (সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১০)

ইংরেজ শাসনের আগে এ দেশের শাসকরা সমগ্র গ্রাম-সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। কোন ব্যক্তির কাছ থেকে নয়। চাষী জমির ফসলের দ্বারা গ্রাম-সমাজের মাধ্যমে এই রাজস্ব আদায় করত। ইংরেজরা গ্রাম-সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের এ ব্যবস্থআ লোপ করে কৃষকদের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং ফসলের বদলে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের রেওয়াজ চালু করে। এভাবে এদেশের প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ধ্বংস করে তারা সমগ্র ভূমি-ব্যবস্থা নতুনভাবে গড়ে তোলার আয়োজন করে। কৃষকদের কাছ থেকে যত খুশি খাজনা ও কর আদায় করে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এক নতুন জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়। এই জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য ইংরেজরা বাংলা ও বিহারের নিষ্ঠুরতম দস্যু সরদারদেরকে ‘নাযিম’ নিয়োগ করে।

নাযিম নামক এই দস্যুদের অত্যাচার ও লুণ্ঠন সম্পর্কে কোম্পানির দলিলপত্র থেকে জানা যায়। বাংলা ও বিহারের রাজস্ব কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ১৭৭২ সালের ৩ নভেম্বর ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরসকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন :

“নাযিমরা জমিদার ও কৃষকদের কাছ থেকে যত বেশি পারে কর আদায় করে নিচ্ছে। জমিদাররাও নাযিমদের কাছ থেকে চাষীদের লুণ্ঠন করার অবাধ অধিকার লাভ করেছে। নাযিমরা আবার তাদের সকলের (জমিদার ও কৃষকদের) সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার রাজকীয় বিশেষ অধিকারের বলে দেশের ধন-সম্পদ লুট করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছে”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২)

১৭৬৫-৬৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর সে বছরই তারা প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সে আদায়ের পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। ইংরেজদের রাজস্ব-নীতি ও ভূমি-ব্যবস্থা সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন :

“এই সকল ব্যবস্থার ফলে চাষীদের পিঠের ওপর বিভিন্ন প্রকারের পরগাছা শোষকদের একটা বিরাট পিরামিড চাপিয়ে বসে। এই পিরামিডের শীর্ষদেশে রহিল ইংরেজ বণিকরাজ, তার নীচে রহিল বিভিন্ন প্রকার উপস্বত্বভোগীর দলসহ জমিদারগোষ্ঠী। এই বিরাট পিরামিডের চাপে বাংলা ও বিহারের অসহায় কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে অনিবার্য ধ্বংসের মুখে এদে দাঁড়াল”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২)

ব্যবসায়ের নামে ‘প্রকাশ্য দস্যুতা’

বাংলার জনগণের কাছ থেকে ছিনেয়ে নেওয়া বিপুল ভূমি-রাজস্ব, কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করা ঘুষ, ব্যবসায়ের নামে ব্যক্তিগত লুণ্ঠন এবং এদেশের টাকা দিয়ে এখানে নামমাত্র মূল্যে পণ্য কিনে ইউরোপে চালান করা হতো। ফলে যে মুনাফা তারা লাভ করত, তার পরিমাণ ছিল অবিশ্বাস্য রকম স্ফীত। এ দেশের জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রাজস্বের টাকার একাংশ দিয়ে এ দেশেরই কারিগরদের তৈরি পণ্য-সম্ভার নামমাত্র মূল্যে কেড়ে নিয়ে ইউরোপে চালান দিয়ে মুনাফা করা হতো বিপুল অংকের টাকা। সমুদয় গ্রাম করত ‘কোম্পানি-লগ্নি’। এই অদ্ভুত লগ্নির চেহারা ছিলো :

“বাংলাদেশের জনগণের টাকা, বাংলার কারিগরদের তৈরি দ্রব্য, কিন্তু মুনাফা কোম্পানির। কার্লমার্কস, রেজিনাল্ড প্রমুখ লেখক এই ‘ব্যবসায়ের’ নাম দিয়েছেন ‘প্রকাশ্য দস্যুতা”। (পূর্বোক্ত)

ব্যবসায়ের নাম ইংরেজ বণিক কোম্পানির এই দস্যুতার মুখে বহু শিল্প-কারিগর উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য নিজেদের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলে অসহনীয় উৎপীড়ন থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে বন-জঙ্গলে পালিয়ে যায়। ১৭৫৮ থেকে ১৭৬৩- এই ছয় বছরে কৃষকদের সাথে কারিগরদের একটি অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয়। ইংরেজ লেখক রেজিনাল্ড রেনল্ডস লিখেছেন :

“ঐ সময়ের মধ্যে ঢাকার বিশ্বখ্যাত মসলিনের এক তৃতীয়াংশ কারিগর ইংরেজ বণিকদের শোষণ-পীড়নে অস্থির হয়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল”। (রেজিনাল্ড রেনল্ডস : সাহিবস ইন ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৫৪)

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর : মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ

ইংরেজদের নয়া রাজস্বনীতির কারণে কৃষকরা খাজনার টাকা যোগাড় করার তাকিদে বছরের খাদ্য-ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ইংরেজরা মুনাফা শিকারে সেরা সুযোগরূপে বেছে নেয় চালের মজুতদারীকে। তারা চালের একচেটিয়া ব্যবসা কুক্ষিগত করার জন্য বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ব্যবসা-কেন্দ্র খুলে ফসল ওঠার সাথে সাথে চাউল মজুদ করে রাখত। পরে সুযোগ বুঝে চাষীদের কাছে তাদেরই রক্ত পানি করা শ্রমের ফসল কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করত। তাদের এই একটি ব্যবস্থাই ‘ভারতের শস্য-ভাণ্ডার’ নামে খ্যাত, মোগল সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ প্রদেশ, যেখানে মুসলিম শাসনের দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ’ বছর মানুষ কখনো দুর্ভিক্ষের সাথে পরিচিত ছিল না, সেই বাংলা ও বিহারকে দুর্ভিক্ষের স্থায়ী কেন্দ্র পরিণত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

১৭৬৯ সালে ফসল ওঠার সাথে সাথে ইংরেজরা বাংলা ও বিহারের সকর ফসল কিনে ফেলে। সারা বছর মজুদ করে রেখে ১৭৭০ সালে (বাংলা ১১৭৬ সাল) সে খাদ্য-শস্য কয়েকগুণ বেশি দামে বেচতে শুরু করে। কয়েক বছরের নিষ্ঠুর শোষণে সর্বস্বান্ত কপর্দকশূণ্য কৃষক ও কারিগরদের পক্ষে এত চড়া দামে সে চাল কিনা সম্ভব ছিল না। ফলে বাংলা ও বিহারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুর শিকার হয়। তৎকালীর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হোস্টিংস-এর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চাশ লাখ।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত এই মহা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ লেখক ইয়ং হাসবেন্ড লিখেছেনঃ

“তাদের (ইংরেজ বণিকদের) মুনাফা শিকারের পরবর্তী উপায় হলো চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য এই পণ্যের জন্য তারা যে দাম চাইবে, তাই তারা পাবে।……. দেশে যা কিছু খাদ্য ছিল তা (ইংরেজ বণিকদের) একচেটিয়া দখলে চলে গেল। ……… খাধ্যের পরিমাণ যত কমতে লাগল, ততই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির-দুঃখময় জীবনের ওপর পতিত হলো এই পুঞ্জিভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু এটি এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের শুরু মাত্র। ………. দেশিয় জনশক্রদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষেণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ যে অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা ছিল, তা এমনকি ভারতবাসীরাও আর কখনো দেখেনি বা শুনেনি”।

তিনি আরো লিখেছেনঃ

“চরম খাদ্যভাবের এক বিভীষিকাময় ইঙ্গিত নিয়ে দেখা দিল ১৭৬৯ সাল। সাথে সাথে বাংলা ও বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক, তাদের সকল আমলা-গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল, সেখানেই দিন-রাত পরিশ্রমে ধান-চাল কিনতে লাগল। এই জঘন্যতম ব্যবসায় মুনাফা হলো এত শীঘ্র ও এতই বিপুল পরিমাণে যে, মুর্শিদাবাদের নবাব-দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূণ্য ইংরেজ ভদ্রলোক এ্হ ব্যবসা করে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রায় ষাট হাজার পাউন্ড ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন”। [Young Husband : Transactions in India (1786 ; P. 123-24]

‘মৃত্যু-ব্যবসায়ী’ ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় দালালদের সৃষ্ট এই ছিয়াত্তরের মহা-মন্বন্তর সম্পর্কে ইয়ং হাসবেন্ড মন্তব্য করেন :

“বাংলার সমগ্র ইতিহাসে এই দুর্ভিক্ষ এরূপ নতুন অধ্যায়ের যোজনা করেছে, যা মানব সমাজের সমস্ত অস্তিত্বকালব্যাপী ব্যবসানীতির এই ক্রর উদ্ভাবনা-শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে; অলঙ্ঘণীয় মানবাধিকারসমূহের ওপর কত ব্যাপক, গভীর ও কত নিষ্ঠুরভাবে অর্থ-লালসার উৎকট অনাটার চলতে পারে, এই অধ্যায়টি তারও কালজয়ী নির্দশন হয়ে থাকবে”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩১)

এ দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার বিবরণ দিয়ে এল. এস. এস. ও মলী লিখেছেন :

“চাষীরা ক্ষুধার জ্বালায় তাদের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হলো। কিন্তু কে তাদের কিনবে? কে তাদের খাওয়াবে? বহু এলাকায় জীবিত লোকেরা মরা মানুষের গোশত খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্ঠা করেছে। নদী-তীর লাশ আর মমূর্ষুদের দেহে ছেয়ে গিয়েছিল। মরার আগেই মুমূর্ষ লোকদের দেহের গোশত শিয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলত”। (L.S.S.O Molley : Bengal. Bihar and Orissa Under British Rule, P-113.)

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে পরবর্তী যুগের ইংরেজ লেখক উইলিয়াম হান্টার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন :

“১৭৬৯ সনের শীতকালে বাংলার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যার জের দুই পুরুষ ধরে চলে। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় ইতিহাস ছিল চমকপ্রদ সামরিক-সাফল্যে প্রাণবন্ত কোম্পানির প্রশংসাপত্রসহ ধারাবাহিক সংগ্রামগুলোর সমাহার। সুতরাং যুদ্ধ বা সংসদীয় বিতর্কের সাথে সংযোগহীন এই ঘটনা (দুর্ভিক্ষ) সম্পর্কে তাদের বক্তব্যের বিশেষ সম্পর্ক নেই বললেই চলে। …… ১৭৭০ সনের সারা গ্রীষ্মকাল জুড়ে গণমড়ক অব্যাহত থাকে। কৃষকরা গবাদিপশু বিক্রি করে দেয়: বিক্রি করে কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি; তারা বীজধান খেয়ে ফেলে; নিজেদের ছেলেমেয়েদের তারা বিক্রি করতে থাকে এবং তারপর তারও কোন ক্রেতা পাওয়া যায় না। তারা গাছের পাতা, ক্ষেতের ঘাস খেতে থাকে এবং ১৭৭০ সনের জুন মাসে দরবারের আবাসিক প্রতিনিধি শভ ভক্ষণের সত্যতা সমর্থন করেন। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত, রোগগ্রস্ত হতভাগ্যের দল দিবারাত্রি বড় বড় নগরগুলো পূর্ণ করতে থাকল। বছরের প্রথমে মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। …….. অর্ধমৃতদের সাথে শবদেহের অবিন্যস্ত স্তূপে পথ অবরুদ্ধ, নির্বিচারে কবর দিয়েও সমস্যার আশু সরাহা হলো না; এমন কি প্রাচ্যের ঝাড়ুদার হিসেবে খ্যাত শিয়াল-কুকুরের দলও সাফাইয়ের বিতৃষ্ণাকর কাজে ব্যর্থ হলো এবং অবশেষে পচাগলা শবদেহগুলো নাগরিকের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলল।…….. সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৭৭০ সনের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বিনষ্ট হয়। জুন মাসে মৃত্যু-সংখ্যা হিসেবে বলা হয় ‘সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি ষোল জনে ছয় জন মৃত’; এবং হিসাব করে দেখা হয় যে, ‘কৃষকসহ খাজনা প্রদানকারী জনসাধারণের অধিকাংশ ক্ষুধার জ্বালায় ধ্বংস হবে’। বর্ষাকালে (জুলাই হতে অক্টোবর) জনশূণ্যত এত প্রকট হয়ে উঠে যে, আতংকগ্রস্ত সরকার পরিচালক-সভার কাছে ‘দুর্ভিক্ষ দ্বারা বিনষ্ট কৃষক ও ক্ষুদে উৎপাদকদের (কারিগর) সংখ্যা ‘সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে”। [ডবলিউ ডবলিউ হান্টার : গ্রাম বাংলার ইতিকথা (এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল গ্রন্হের অসীম চট্টোপাধ্যায় কৃত তরজমা), পৃষ্ঠা ১০-১৭]

এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, এই নযীরবিহীন গণমৃত্যু সম্পর্কে ইংরেজরা কতটা নিরুদ্বেগ ও বেপরোয়া ছিল তার বিবরণও হান্টারের লেখায় বিধৃত। ইংরেজরা তাদের লুণ্ঠনের পরিমাণ সম্পর্কেই আগ্রহী ছিল। এদেশের মানুষের ব্যাপারে তাদের জাতীয় মানসিকতা ছিল অদ্ভুত রকমের হৃদয়হীন নির্লিপ্ততার।

হান্টার লিখেছেনঃ

“১৭৭২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ জনসাধারণ বাংলাকে একটা বিশাল গুদামখানা হিসাবে দেখত, যেখানে বেশ কছু দুঃসাহসী ইংরেজ মোটা লাভে এক বিশাল ব্যবসা চালাচ্ছে। বিপুল দেশীয় জনসংখ্যা সম্বন্ধে তারা সচেতন ছিল ঠিকই, এটা যেন তারা একটা আকস্মিক পরিস্থিতি বলে বিবেচনা করত এবং বর্তমানে আমরা নাটাল বা প্রিয়েরীলিয়নের অধিবাসীদের সম্পর্কে যে আগ্রহ বোধ করি, তার চেয়েও কম আগ্রহ তারা এ সম্বন্ধে বোধ করত”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭)

এ দেশের জনগণের ব্যাপারে ইংরেজদের মানসিকতার প্রমাণ পাওযা যায় দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে তাদের অবলম্বিত ব্যবস্থা থেকে। হান্টারের বিবরণ থেকে জানা যায়ঃ

“বিশ হাজার লোক যে জেলায় প্রতি মাসে মারা যাচ্ছে, সে জেলার ত্রাণ-কার্যের জন্য কোম্পানি-সরকার একশত পঞ্চাশ টাকা বরাদ্দ করে। চার লাখ উপবাসী মানুষের প্রতিদিনের সাহায্যের জন্য এক প্রাদেশিক পরিষদ ‘গভীর বিবেচনার পর মহানুভবতার সাথে’ দশ শিলিং মূল্যের চাউল অনুমোদন করেন। ‘অর্ধেক কৃষক ও প্রজা উপবাসে মারা যাবে’ এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও কোম্পানি কাউন্সিল তিন কোটি মানুষের ছয় মাসের নির্বাহের জন্য অনুদান ধার্য করেন চার হাজার পাউন্ড”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯)

এই অনুদান প্রকৃত ভুক্তভোগীর হাতে যায় কিনা, সে সম্পর্কেও হান্টার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

দুর্ভিক্ষের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে হান্টার লিখেছেনঃ

“ যে দেশের জনসাধারণ সম্পূর্ণ কৃষিজীবী, সেখানে গণমৃত্যুর ফলে আনুপাতিক হারে জমি অনাবাদি থাকে। বাংলাদেশের জনসাধারণের এক তৃতীয়াংশ মারা যায় এবং এক তৃতীয়াংশ আবাদি জমি দ্রুত পতিত জমিতে পরিণত হয়। দুর্ভিক্ষের তিন বছর পর এত বেশি জমি অকর্ষিত থাকে যে, দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রজাদেরকে বাস্তুত্যাগ করে পরিষদশাসিত এলাকায় আনার জন্য (কোম্পানি সরকারের) পরিষদ ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করে। দুর্ভিক্ষ –পরবর্তী প্রথম পনের বছরে জনশূন্যতা অবিচলিতভাবে বাড়তে থাকে। ঘাটতির সময়ে সবচে বড় বিপর্যয়ের শিকার হয় শিশুরা এবং ১৭৮৫ সন পর্যন্ত বৃদ্ধরা মারা যায়। কিন্তু তাদের শূন্যস্থান পুরণের জন্য নতুন কোন প্রজন্ম ছিল না। জমি পতিত পড়েই রইল এবং তিন বৎসরের সতর্ক তদন্তের পর ১৭৮৯ সনে লর্ড কর্ণওয়ালিস বাংলার কোম্পানির এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলের বন্যজন্তু-আকীর্ণ জঙ্গল বলে ঘোষণা করেন”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯-৩১)

সারা দেশে যখন মৃত্যুর এই বিভীষিকা চলছে, তখন ১৭৭২ সালে ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তৎকালীন বাংলা ও বিহারের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস লিখেনঃ

“প্রদেশের সমগ্র লোকসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু এবং তার ফলে চাষের চরম অবনতি সত্ত্বেও ১৭৭১ সালের নীট রাজস্ব আদায় এমনকি ১৭৬৮ সালের রাজস্বের চেয়ে বেশি হয়েছে। যে কোন লোকের পক্ষে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, এরূপ একটা ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে রাজস্ব তুলনামূলকভাবে কম আদায় হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না হওয়ার কারণ এই যে, সকল শক্তি দিয়ে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে”। (পূর্বোক্ত, পরিশিষ্ট)

এ প্রসঙ্গে হান্টার লিখেছেনঃ

“১৭৭২ সালে, পুরোনো চাষীরা মরীয়া হয়ে তাদের কাজ ছেড়ে দিলে তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং বকেয়া খাজনার দায়ে কলকতার ‘ঋণগ্রস্তদের কারাগারে’ তাদেরকে কয়েদ করা হয়। রাজস্ব নির্ধারণের প্রতিটি পর্যায়ে একই ঘটনা ঘটে। দুর্ভিক্ষের প্রায় ২০ বছর পর ব্রিটিশরা জেলার দায়িত্ব গ্রহণকালে জেলাগুলো বকেয়া খাজনাজনিত বন্দীতে পূর্ণ ছিল এবং কোনো বন্দীরই পুনঃমুক্তির কোনো আশা ছিল না্। দেশ যখন প্রতিটি বছরের সাথে আরো অধঃপতিত হচ্ছে তখন ইংরেজ সরকার ক্রমাগত বর্ধিত খাজনা দাবি করতে থাকে। ১৭৭১ সনে আবাদি জমির এক তৃতীয়াংশেরও বেশি জমি সরকারি হিসেবে পরিত্যক্ত বলে দেখানো হয়। ১৭৭৬ সনে এই হিসেবে সমগ্র আবাদি জমির অর্ধাংশেরও বেশি দাঁড়ায়, প্রতি সাত একর আবাদি জমির সাথে চার একর পতিত থাকে। অন্যদিকে কোম্পানির দাবি ১৭৭২ সনে ১০,০০,০০০ পাউন্ডের কম হতে বেড়ে ১৭৭৬ সনে প্রায় ১১,২০,০০০ পাউন্ডে দাঁড়ায়”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১-৩২)

বাংলায় ইংরেজ বণিক শ্রেণী, আর তাদের লুণ্ঠন-সহচর বর্ণহিন্দু রাজা-মহারাপা, জগতশেঠ-আলম চাঁদ প্রমুখ কোটিপতি লগ্নি-পুজির মালিক, তাদের আত্মীয়-স্বজন, নব্য বিত্তশালী এজেন্ট, বেনিয়া, নিলামে জমিদারী খরিদকারী নতুন বর্ণহিন্দু শহুরে জমিদার শ্রেণী, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তাদের দালাল, নায়েব, গামস্তা প্রভৃতি অর্থলগ্নীর দল তাদের গোলা, মড়াই, আড়ত, কাচারীতে সারা বাংলার খাদ্যশস্য মজুত রেখে যে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল, মানব সভ্যতার ইতিহাসে তার তুলনা নেই। স্বল্পকালের লুণ্টন-শোষণের মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। জগত শেঠ, আলম চাঁদ প্রমুখ কোটিপতিগোষ্ঠী এ সময় সম্পদের পাহাড় গড়েছিল। কেউ প্রত্যক্ষ মজুতকারবারী, কেউ বেনামী অংশীদার, আর কেউ অর্থের লগ্নিকারী। ইংরেজ বণিকশ্রেণীর শাসনকালের ইতিহাসে এই সময়কাল নিষ্ঠুরতার বিচারে তুলনাহীন। ইংরেজ বণিকশ্রেণীর এই অদ্ভুত শাসনকে ইংল্যান্ডের বাগ্মীশ্রেষ্ঠ এডমন্ড বার্ক মানব সভ্যতার ইতিহাসে ‘মৃত্যুর শাসন’ আর ওরাঙ ওটাঙ বা ‘নেকড়ের শাসন’ নামে অভিহিত করেছেন। (Speeches of Edmaund Bark)

কোম্পানি শাসনের এই ভয়াবহ রূপ দেখেই বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এ্যডাম স্মিথ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেনঃ

“কোন ব্যবসায়ী কোম্পানির একচেটিয়া শাসনই যেকোন দেশের বিভিন্ন প্রকার শাসন-ব্যবস্থার মধ্যে নিকৃষ্টতম শাসন”। (Adam Smith : Essays on Political Economy, P-131)

সমসাময়িক বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্হ সিয়ারুল মুতাআখখেরীন-প্রণেতা এই দুর্ভিক্ষের ফলে সৃষ্ট মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় কাতর হয়ে লিখেছেনঃ

“ইয়া আল্লাহ। তোমার দুঃখ-দুর্দশাক্লিষ্ট বান্দাহদের সাহায্যের জন্য একবার তুমি নেমে আস। এই অসহনীয় উৎপীড়ন থেকে তুমি তাদের উদ্ধার কর”। (গোলাম হুসাইন তাবাতাবাই : সিয়ারুল মুতাখাখেরীন- গোলাম হুসাইন খান অনূদিত)

ভূমি-ব্যবস্থার ধ্বংস ও কৃষক শোষণের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’

ইংরেজ ও এদেশীয় জনশক্রদের সৃষ্ট ছিয়াত্তরের ভয়াবহ মন্বন্তর বাংলা ও বিহারের প্রাচীন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজের শেষ চিহ্ন মুছে দিয়েছিল। ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞের এই পটভূমির ওপর দাঁড়িয়েই ইংরেজ বণিক-শাসকরা তাদের কৃষক-শোষণের ব্যবস্থা পাকাপাকি করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যাস্ত আইনের দ্বারা মুসলমানদের হাত থেকে সমস্ত ইজারা, জমিদারী, একে একে খসিয়ে ফেলে নতুন হিন্দু জমিদার ও তালুকদার শ্রেণীর আমদানি করা হয়। যেসব হিন্দু কর আদায়কারী ঐ সময় পর্যন্ত নিম্ন পদের চাকরিতে নিযুক্ ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয় (ডব্লিউ  ডব্লিউ হান্টার : দি ইন্ডিয়ান মুসলমান; এম. আনিসুজ্জামান অনূদিত পৃষ্ঠা ১৪১)। ফলে অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলো একেবারে উৎখাত হয়।

হেস্টিংস-এর চুক্তি (১৭৭২-৯৩) ও লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩) ফলে এদেশের বুনিয়াদি ও পুরনো জমিদারদের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভাগ্যজনক পরিবর্তন। নিলামের ডাকে যারা প্রচুর অর্থ দিতে পারতো, তাদেরকেই জমিদারী দেওয়া হতো। পুরনো জমিদারদের পক্ষে ইংরেজদের চাহিদা মাফিক অর্থ দেওয়া সম্ভব ছিল না।

প্রচুর জমানো টাকা নিয়ে এগিয়ে এল বেনিয়ান, গোমস্তা, মহাজন আর ব্যাংকের মালিকরা। লুণ্ঠন-শোষণের মাধ্যমে অর্জিত নগদ টাকার জোরে রাতারাতি তারা জমিদার হয়ে বসল। তাদের সকলেই ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু। তাদের গোত্রীয় পরিচয় দেব, মিত্র, বসাক, সিংহ, শেঠ, মল্লিক, শীল, তিলি বা সাহা। তাদের অনেকেরই পূর্ব পরিচয় তারা পুরাতন জমিদারদের নায়েব কিংবা গোমস্তা। আর তাদের অভিন্ন পরিচয় তারা বাংলা নব্য-প্রভু শাসকদের দালালরূপী লুটেরা-শোষক।

মুসলমান জমিদারদের জমিদারী দখল এবং মুসলমানদের লাখেরাজ সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যরা খ্রিস্টান পাদ্রীদের সাথে ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়। পাদ্রীদের পরার্শে কোম্পানি সরকার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আয়মা লাখেরাজ ও তৌজী লাখেরাজের দলিল-দস্তাবেজ ও সনদ-পাঞ্জা কোম্পানি সরকারে দাখিল করার জন্য এক আকস্মিক নির্দেশ জারি করে। মুসলমানদের অনেকেই এসব দলিল-পত্র মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দাখিল করতে পারল না। তাদের সমুদয় লাখেরাজ সম্পত্তি দখল করা হয়। এছাড়া মুসলমানদের অধিকাংশ জমিদারী পাদ্রীদের সুপারিশে কোম্পানি সরকার খাস করে নেয় এবং পরে তা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের বন্দোবস্ত দেয়। (আবদুল গফুর সিদ্দিকী : শহীদ তিতুমীর, পৃষ্ঠা ৪৫)

সুপ্রাচীনকাল থেকে এদেশে যে ভূমি-ব্যবস্থা ছিল, তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেল। অনুস্বত্বের অধিকারী নতুন জমিদাররা জমির পূর্ণস্বত্ব মালিকানা লাভ করল। কৃষকরা হলো তাদের অনুগ্রহ ও মর্জিম ওপর নির্ভরশীল।কৃষকরা শুধু জমি চাষ করার অনুমতি লাভ করল। জমিতে তাদের কোন স্বত্ব রইল না। কৃষকের স্বত্ব এবং ভূমি-ব্যবস্থার চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট থাকল না। এ ব্যবস্থার ফলে উপস্বত্বের অধিকারীরা পূর্ণস্বত্ব ভোগের দ্বারা কৃষকদের ওপর যে নির্মম নিষ্পেষণ চালায় তার বিবরণ তুলে ধরে আবদুল মওদুদ উল্লেখ করেছেনঃ

“এই নয়া ভূস্বামী সম্প্রদায়ের অত্যাচার এতখানি চরমে উঠেছিল যে, দাড়ি রাখার জন্য নতুন ট্যাক্স বসাতে তাদের অনেকের সংকোচ হয়নি”। (আবদুল মওদুদ : সিপাহী বিপ্লবের পটভূমি; ড, হাসান জামান সম্পাদিত ও নওরোজ কিতাবিস্তান প্রকাশিত, ‘শতাব্দী পরিক্রমা’, পৃষ্ঠা ৬১)

ইংরেজরা তাদের বর্ধিত রাজস্বের দাবি আদায় নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই জমিদারদের সাথে প্রথমে পাঁচসালা, এরপরে দশসালা ব্যবস্থা করে এবং ১৭৯৩ সালে ইংল্যান্ডের ভূমি-ব্যবস্থার অনুকরণে ‘চিরস্তায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তন করে। এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী জমিদাররা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে শাসকদের নিজস্ব রাজস্ব দিয়ে যথেচ্ছা পরিমাণে খাজনা আদায় ও জমি থেকে কৃষকদের উৎখাত ও উচ্ছেদ করার অবাধ অধিকার লাভ করে। জমির ওপর কৃষদের স্বত্ব অস্বীকার করে তাদেরকে জমিদারী শোষন-লুণ্ঠন ও নির্যাতনের স্থায়ী শিকারে পরিণত করা হয়।

মুসলিম শাসন আমলে বাংলার জমিদারদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হতো। তারা ছিলেন বিভিন্নভাবে জমির অধিকারী এবং রায়তদের কাছ থেকে খাজনা আদায়কারী সরকারি কর্মচারী মাত্র। নিজ নিজ এলাকায় সাধারণ ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলার নিষ্পত্তি করা এবং শাসন বিভাগের আংশিক দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত ছিল। জমিদাররা রায়তদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদয় করতে পারতেন না; কিংবা কোনরূপ অত্যাচার করতে পারতেন না। রায়ত ও জমিদারদের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখরার ব্যাপারে ফৌজদারগণ দায়িত্ব পালন করতেন। কোন কারণে জমিদাররা সরকারের অবাধ্য হলে বা জনসাধারণের প্রতি অত্যাচারী হলে তাদের জমিদারী ছিনিয়ে নেওয়া হতো। (মেসবাহুল হক : পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ, পৃষ্ঠা ২৯-৩০)

ইংরেজ বণিক শাসনে এই পুরো ব্যবস্থারই খোল-নলচে পাল্টে ফেলা হয়।

প্রথমত, মুসলিম আমলে ফসলের পরিমাণের ভিত্তিতে ফসলের মাধ্যমে খাজনা আদায় করা হতো। এখন জমির পরিমাণের ভিত্তিতে নগদ মুদ্রার মাধ্যমে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা চালু করা হলো।

দ্বিতীয়ত, ইংরেজদের নব-প্রবর্তিত ব্যবস্থায় জমির মালিকানার ওপর কৃষক বা গ্রাম্য পঞ্চায়েতের অধিকার রহিত হলো।

তৃতীয়ত, কোম্পানি সরকার খাজনা আদায়ের জন্য জমির মালিকানা ইজারা দিল বিভিন্ন ভয়ালরূপী যোগানদের কাছে। নিলামের ডাকে প্রচুর অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়ে পুরনো জমিদাররা পিছিয়ে গেল। সেখানে ইংরেজদের লুণ্ঠনবৃত্তির এদেশীয় সহচর এমন একটি নব্য পুঁজিপতি শ্রেণী অধিষ্ঠিত হলো, যাদের একমাত্র ঐতিহ্য ছিল ইংরেজদের তোষণের জোরে এদে্শের কৃষকদেরকে লুণ্ঠন করা। এই শ্রেণীর জমিদাররা সকলেই হিন্দু আর তাদের রায়তরা শতকরা পচাঁত্তর ভাগেরও বেশি মুসলমান। তারা জমির স্বত্ব হারিয়ে নবোত্থিত বর্ণহিন্দু লুটেরা জমিদারদের স্থায়ী শোষণ ও জুলুম-নিপীড়নের শিকারে পরিণত হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ ইংরেজদের বিভিন্ন পদক্ষেপকে ‘শঠতা’ বলে উল্লেখ করে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেনঃ

“বাংলায় ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় দিল্লীর বাদশাহর প্রধান রাজস্ব অফিসারের দায়িত্ব লাভের মাধ্যমে। মোটা অংকের উৎকোচ দেওয়ার পরিবর্তে তলোয়ারের জোরেই এই নিয়োগ আমরা ক্রয় করেছি। কিন্তু আমাদের পদের নাম ছিল বাদশাহের দেওয়ান বা প্রধান রাজস্ব অফিসার। এ কারণে মুসলমানরা মনে করে যে, মুসলমানের প্রবর্তিত বিধি-ব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে আমরা বাধ্য; কারণ ঐ বিধি-ব্যবস্থা প্রশাসনের দায়িত্ব আমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। আমার মতে এ সম্পর্কে সংশয়ের খুব কমই অবকাশ আছে যে, চুক্তি রচনার সময় উভয় পক্ষ এটাই বুঝেছি………….। পুরনো ব্যবস্থার ওপর যে প্রচণ্ড আঘাত আমরা হেনেছি সেটা বোধ করি শঠতার পর্যায়েই পড়ে এবং ইংরেজরা বা মুসলমানরা কেউই এর পরিণতি উপলব্ধি করতে পারেননি। এটা হচ্ছে লর্ড কর্ণওয়ালিস এবং জন শোর প্রবর্তিত এক গাদা সংস্কার কার্যক্রম, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায় বন্দোবস্তের মধ্যে যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে”। (ডবলিউ ডবলিউ হান্টার : দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা ১৩৯-৪০)

কোম্পানির সমর্থকরূপে নব্য জমিদার ও মহাজন

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার যে শোষণ-ব্যবস্থা চালূ হয় সে সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেনঃ

“বাংলাদেশের জমিদারদের দেয় মোট রাজস্বের পরিমাণ স্থির হইল চার কোটি দুই লক্ষ টাকা। কিন্তু এই বন্দোবস্তের প্রথম বছরেই জমিদারগোষ্ঠী কৃষকদের নিকট হইতে প্রায় তিনগুণ খাজনা ও কর আদায় করে। তখন হইতে জমিদারগোষ্ঠীর আদায় ক্রমশ বাড়িয়েই গিয়াছে। কিন্তু শাসকদের রাজস্ব অপরিবর্তিত রহিয়া গিয়াছে। এইভাবে ইংরেজ শাসকগণ তাহাদের লুণ্ঠনের একটা বিরাট অংশ ভাগ দিয়া এদেশে জমিদার নামক একদল স্থায়ী শাসককে তাহাদের রক্তাক্ত শাসন ও শোষণে চিরস্থায়ী সমর্থগোষ্ঠীরূপে সৃষ্টি করে”। (সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৬)

ইংরেজ শাসক ও তাদের সমর্থক জমিদারদের খাজনার দাবি মিটাতে কৃষকরা তাদের জমি ও বাড়িঘর বন্ধক রেখে ঋণ গ্রহণের জন্য মহাজনদরে শরণাপন্ন হয়। সুদে-আসলে সে ঋণ পরিশোধ করতে কৃষকরা ব্যর্থ হয়, আর মহাজনরা তাদের ঘরবাড়ি-জমি-জিরাত কেড়ে নেয়। এভাবে মহাজনরা কালক্রমে জমিদার হয়ে ওঠে এবং ইংরেজদের শোষণের যোগ্য অংশীদারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে পল্লী অঞ্চলের ব্যবসায়ী মহাজন মাত্রই হিন্দু। ইংরেজ শাসকদের সৃষ্ট এসব জমিদার-মহাজনরাই ছিল বাংলাদেশের নিরীহ সরল কৃষকদের প্রধান শক্র।

ঋণদান ছাড়া মহাজনদের অন্য একটি ভূমিকা ছিল। ফসল বিক্রি করতে হলে চাষীকে সেই মহাজনের কাছেই ধর্ণা দিতে হতো। ঋণ ও সুদের দাবি মিটাতে চাষীকে মহাজনের শোষণের স্থায়ী শিকার হয়ে থাকতে হতো। মহাজনের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও উপায় ছিল না। কখনো ক্ষেপে গিয়ে চাষীরা যাতে মহাজনগোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাতে না পারে, সে জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সর্বশক্তি দিয়ে মহাজনশ্রেণীকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়। এভাবে উনিশ শতকের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের কৃষকদের ওপর তিনটি ভয়ঙ্কর শোষক-শক্তি তাদের সমস্ত ভার নিয়ে চেপে বসে। বৃটিশরা আদায় করে তাদের খাজনা ও বিভিন্ন কর। আর মহজনরা কৃষকের বাকি ফসলের প্রায় সবটুকু কেড়ে নেয় তাদের ঋণের সুদ হিসাবে।

এ প্রসঙ্গে আর পি দত্ত উল্লেখ করেছেনঃ

“বৃটিশ-ভারতের একজন কৃষকের বার্ষিক গড়পড়তা আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। ট্যাক্স-খাজনা এবং মহাজনের ঋণ বা ঋণের সুদ পরিশোধ করার পর কৃষকের হাতে অবশিষ্ট থাকত মাত্র ১৩ থেকে ১৭ টাকা। অর্থাৎ আয়ের এক তৃতীয়াংশ হাতে নিয়ে কৃষকের সারা বছর কিভাবে চলবে সেই সমস্যার কথা ভাবতে হতো” (আর পি দত্ত : ইন্ডিয়া টু-ডে, পৃষ্ঠা ২৫১)

বাংলাদেশের লুটের টাকায় বিলাতে শিল্প-বিপ্লব

কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলাদেশের ভূমি-ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটল। জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে সৃষ্টি হলো ধ্বংসের বিভীষিকা। মোগল আমলের বাংলার সমৃদ্ধ সমাজ-কাঠামো ধ্বংস হলো এবং কোম্পানির অনুগ্রহপুষ্ট দালাল, বেনিয়া, মুৎসুদ্দি, নব জমিদার ও মহাজন নামক লুণ্ঠনকারীরা সমাজ-জীবনের সকল ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। ইংরেজ বেনিয়াদের এ সকল ভাগ্যন্বেষী অনুচর, দালাল ও মোসাহেবদের দস্যুব্রত্তির দৌরত্ম্যে দেশ জুড়ে ঘনিয়ে আসে শিল্পের ঘোরতর দুর্দিন।

এই নিব্য লুটেরা শোষক শ্রেণীটি সত্যিকার জমিদার যেমন হতে পারেনি, ব্যবসায়ী হিসেবেও তারা ছিল দালাল-পর্যায়ভুক্ত। কোম্পানির একাধিপত্যের দরুন তারা বহির্বাণিজ্যে যেমন নাক গলাতে পারেনি, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের বড় বড় দিকও তেমনি ইংরেজদের একচেটিয়া দখলে চলে গিয়েছিল। ফলে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যৈর সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ ছিল বিদেশীদের হাতে।

বাঙালি নব্য জমিদারগোষ্ঠী কৃষি ধ্বংস করল, কৃষকের সর্বনাশ ঘটালো, ব্যবসা হারাল, শিল্পকে অবহেলা করল, ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প কেড়ে বাড়ি-ঘর ও জমি-জমায় টাকা খাটাবার দিকে মন দিল। ফলে সমৃদ্ধ একটি জাতি সব দিক দিয়ে রিক্ত এবং নিঃস্ব হয়ে পড়ল। তাদের অগ্রগতির সকল দুয়ার রুদ্ধ হলো।

পলাশী যুদ্ধের পর থেকে বাংলা ও বিহারের সম্পদ লুট করে ইংরেজ বণিকগোষ্ঠী যে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ বিলাতে নিয়ে যায় তার ফলে ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়। ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লব আরো আগে শুরু হলেও ‌১৭৬০ সাল পর্যন্ত এর গতি ছিল মন্হর। কিন্তু বাংলার লুণ্ঠিত সম্পদ ইংল্যান্ডে পৌঁছতে শুরু করার পর থেকে সেখানে অতি দ্রুত বিভিন্ন কল-কারখানা গড়ে উঠতে থাকে”। (সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬-১৭)

মুসলিম শাসনামলে বাংলাদেশ ছিল একচেটিয়া রফতানিকারী দেশ। এদেশের পণ্য সম্ভার দিয়েই ইংল্যান্ডে ব্যবসা-বণিজ্য চলতো। ইংল্যান্ড বা ইউরোপের অন্য কোন দেশ থেকে পণ্যদ্রব্য এনে এদেশ বিক্রি করার কথা কেউ তখন কল্পনাও করতে পারেনি। বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার মতো উন্ন ত বস্ত্রশিল্প তখনো ইউরোপের কোন দেশে গড়ে ওঠেনি। ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের অবস্থা যে তখন খুবই শোচনীয় ছিল, তার বিবরণ দিয়ে ব্রুকস এডামস লিখেছেন:

“ব্যংক অব ইংল্যান্ড স্থাপিত হওয়ার ৫০ বছর পরও ব্যাংকের প্রচলিত নোটের মধ্যে সবচে বড় নোট ছিল ২০ পাউন্ডের নোট। ১৭৫০……. সমগ্র প্রদেশে বারোটার বেশি বাংক ছিল না। অথচ ১৭৯০ সাল নাগাদ শহরের প্রতিটি বাজারে ব্যাংক গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ থেকে রূপা আসার সাথে সাথে শুধুমাত্র অর্থের প্রচলন বেড়ে যায়নি, আন্দোলনও জোরদার হয়েছে”। (Brooks Adams : The Law of Civilization and decay; P. 203-4)

ব্রুকস এডামস শিল্প-বিপ্লবের পটভূমি তুরে ধরে লিখেছেন:

“পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশের লুণ্ঠিত ধন-রত্ন ইংল্যান্ডে আসতে লাগল। তখনই অবিলম্বে এর ফল বুঝা গেল। পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। তারপর থেকেই (ইংল্যান্ডে যে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, তার তুলনা বোধ হয় ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যাবে না। ১৭৬০ সালের সাগে ল্যাংকাশায়ারে বস্ত্র-শিল্পের যন্তপাতি এদেশের মতোই সহজ সাধারণ ছিল এবং ১৭৯০ সালে ইংল্যান্ডে লৌহ-শিল্পের অবস্থা ছিল আ রো শোচনীয়।………. ইংল্যান্ডে ভারতের ধন-সম্পদ পৌঁছার এবং ঋণ-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক শক্তি বা মূলধন ইংল্যান্ডের ছিল না”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫৯-২৬০)

ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রে ইংরেজ কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারের দরুন দেশীয় কারিগর ও শিল্পের সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটে। বিলাতের শিল্প-বিপ্লব এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের দরুন কোম্পানি-রাজের বদৌলতে বিলাতি বস্ত্র ও শিল্প-সম্ভারে দেশ ছেয়ে যায়। বেনিয়ারা কারিগর শ্রেণীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ফলে যারা ছিল শ্রমিক, তারাও জীবিকার একমাত্র পথ হিসেবে ভূমিচাষে এগিয়ে আসে।

ব্যবসাক্ষেত্রে বেনিয়া কুঠিগুলোকে কেন্দ্র করে বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, মুন্সি ও দেওয়ান নামে এক নতুন দালালশ্রেণূ গড়ে ওঠে। এই শ্রেণীটিও দেশীয় শিল্প ও কারিগরকে গলাটিপে মারা পথ প্রশস্ত করে।

নতুন আর্থিক বিন্যাসের ফলে যে ভূস্বাসী ও দালাল-শ্রেণীর উদ্ভব হলো তারা একজনও মুসলমান নয়, মুসলমানদের সে সমাজে প্রবেশাধিকার ছিল না। (আবদুল মওদুদ : সিপাহী বিপ্লবের পটভূমি; পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬২)

এ শ্রেণীটিই পরবর্তীকালে গণবিক্ষোভ ও জাতীয় জাগরণের প্রধান শত্র হিসেবে নিজ স্বার্থে সর্বদাই বৃটিশ শাসন টিকিয়ে রাখতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এ দালাল-শ্রেণীটির ভূমিকার কথা উইলিয়ান বেন্টিঙ্কও স্বীকার করেছেন। (A. B. Keiths : Speeches and Documents on Indian Policy Vol-1, p-2)

শিল্প-বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের কল-কারখানার জন্য কাঁচামালের চাহিদা দেখা দেয়। সে ব্যাপারেও ইংরেজদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল ভারতের প্রতি। অন্যদিকে তাদের কল-কারখানায় তৈরি পণ্য-সামগ্রী এদেশের বাজার ছেয়ে ফেলে। এভাবে বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রিটিশ মূলধনী শ্রেণীর পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় বিরাট বাজার ও কাঁচামালের অফুরান ভাণ্ডারে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নিজস্ব প্রাচীন শিল্পব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের বস্ত্র-শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে ভাতের বস্ত্র-শিল্পের ওপর তাদের আঘাত সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠুর হয়েছিল। বাংলাদেশ তথা ভারতের বস্ত্র উৎপাদনকারী কারিগররা কোম্পানির বণিকদের দ্বারা পূর্বেই প্রায় ক্রীতাদাসে পরিণত হয়েছিল। বস্ত্র ব্যবসায়ী ইংরেজ বণিকরা তাদের কাছ থেকে বাজারদরের অর্ধেক দামে ‘মসলিন’ ও ‘কেলিকো; কিনতো। পূর্বের সকল অত্যাচার ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের গ্রাস থেকে তাঁতীদের যে একটি অংশ কোন প্রকারে বেঁচেছিল, বিলাতি পণ্যের বাজারে পরিণত হওয়ার ফলে সে উৎপাদক শ্রেণীটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। যে ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিল, ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের যান্ত্রিক আঘাতে সে শিল্প এই পর্যায়ে বিলুপ্ত হলো। ইংরেজ বণিক-শাসকদের হাতে এদেশের শিল্প ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে কার্ল মার্কস মন্তব্য করেছেন:

“অনধিকার প্রবেশকারী ইংরেজরাই ভারতের তথা বাংলাদেশের তাঁত ও তকলী ভেঙ্গে চুরমার করে। ইংল্যান্ড ভারতের তুলাজাত দ্রব্য ইউরোপের বাজার থেকে বিতাড়িত করতে থাকে, তারপর হিন্দুস্থানকে পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলে। যে দেশ তুলার জন্মস্থান বলে চির পরিচিত, সে দেশটাকেই তারা শেস পর্যন্ত তুলা দিয়ে (অর্থাৎ তুলাজাত দ্রব্য দিয়ে) ছেয়ে ফেলে”। (Karl Marx : British Rule in India)

শিক্ষাক্ষেত্র মুসলমানদের বিপর্যয় ও হিন্দু-উত্থান

ব্রিটিশ শাসনে শিক্ষাক্ষেত্র মুসলমানরা সম্পূর্ণ পিছিয়ে পড়েছিল। সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনে এদেশে শিক্ষার যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, তা সম্পূর্ণরূপে ধুলিসাৎ হয়েছিল। ইংরেজরা শাসনভার গ্রহণ করার পর মুসলমানরা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণগুলো হল:

ক. ইংরেজ ও তার এদেশীয় সহচরদের সম্মিলিত লুণ্ঠন-শোষণের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুরবস্থা;

খ. ওয়াকফ বা লাখেরাজ সম্পত্তি বায়েজাফত করার ফলে মুসলিম শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়া;

গ. ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা-ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেতন-প্রথার প্রবর্তন;

ঘ. নতুন শিক্ষা-ব্যবস্থায় মুসলিম ছাত্রদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার অভাব;

ঙ. খ্রিস্টান মিশনারীদের পরামর্শ ও নির্দেশনায় ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা গ্রহণের ফলে ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা;

চ. মুসলমানদেরকে বিধর্মীদের কাছে শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করা;

ছ. শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম হিন্দুয়ানী ভাবধারায় ঢেলে সাজানো;

জ. মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারি সাহায্য ও প্রতিষ্ঠানিক সমর্থন থেকে বঞ্চিত হওয়া; এবং

ঝ. পলাশীর বিপর্যয়ের ফলে মুসলমানদের আহত আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তাদের ঐতিহ্যবিরোধী শিক্ষা-ব্যবস্থা ও বৈরী পরিবেশের সাথে একাত্ম হতে না পারা।

মুসলিম শাসনামল থেকেই মুসলমানরা বাদশাহ, সুলতান, নওয়াব ও তাদের বড় কর্মচারীদের প্রদত্ত জায়গীর, আয়মা, আল তমগা, মদদ মাশ প্রভৃতি লাখোরাজ সম্পত্তি ভোগ করতেন। এসব সম্পত্তির আয় দ্বারা শুধু তাদের ভরণ-পোষণই চলত না, অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ, ইমামবাড়া, মুসাফির-খানাসহ নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো।

ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার সময় বাংলার এক-চতুর্থাংশ সম্পত্তি ছিল নিষ্কর। ইংরেজরা ১৮২৮ সালে নিষ্কর ভূমি বাজেয়াফত আইন পাস করে এসব নিষ্কর সম্পত্তি কেড়ে নেয়। শুধু বাংলাদেশেই ‌১৮২৮ থেকে ‌১৮৪৫ সাল পর্যন্ত কয়েক বছরে অন্তত কুড়ি হাজার নিষ্কর সম্পত্তি বাজেয়াফত হয়। ফলে বহু প্রাচীন মুসলিম বংশ উৎখাত হয় এবং মসজিদ-মাদরাসা-খানকাহসহ অসংখ্য মুসলিম শিক্ষা ও জনহিতকর প্রতিষ্ঠান লুপ্ত হয়।

ম্যাক্সমুলার উল্লেখ করেছেন যে, ইংরেজদের ক্ষমতা দখলকালে বাংলায় আশি হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল। প্রতি চারশ’ লোকের জন্য তখন একটি মাদরাসা ছিল। বখতিয়ার খিলজী থেকে আলীবর্দী খান পর্যন্ত বিদ্যোৎসাহী মুসলিম শাসকদের আমলে এদেশ অসংখ্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। গৌড়, পাণ্ডুয়া, দরসবাড়ী, রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, সোনারগাঁও, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে বহু বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র। উপমহাদেশের বাইরে থেকেও উচ্চ শিক্ষার জন্য বহু ছাত্র বাংলার এসব শিক্ষাকেন্দ্রে জমায়েত হতেন।

ইংরেজদের গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপেরে ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়। ইসলামী শিক্ষার মহতী কেন্দ্ররূপে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার অবসান ঘটে। শিক্ষা-সংস্কৃতির সেই বিস্মৃত কেন্দ্রগুলোর সন্ধান লাভও এখন প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলো বন্দ হওয়ার পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারীদের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায়, খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইংরেজি শিক্ষার জন্য সরকারি অর্থ-সাহায্যে স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। (R. C. Majumder : Bengal in the Nineteenth Century, P-32)।

লর্ড টমাস ব্যারিংটন মেকলের পরামর্শে সৃষ্ট ১৮৩৫ সালে শিক্ষা সংক্রান্ত আইনবলে কেবলমাত্র ইংরেজি স্কুল ছাড়া অন্য কোন শি ক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি সাহায্য লাভের অনুপযুক্ত ঘোষিত হয়। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্য ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক থেকে মুসলমানদের চিন্তা-চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্হী ছিল। এ সম্পর্কে মেকলের উক্তি থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন:

“বর্তমানে আমাদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলতে হতে, সমাজে যারা শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। তারা রক্ত-মাংসের গড়নে ও দেহের রঙে ভারতীয় হবে বটে; কিন্তু রুচি, মতামত ও বুদ্ধির দিক দিয়ে হবে খাঁটি ইংরেজ”। (Woodrow : Macaulay’s Minutes on Education in India [1862])

এই মেকলের মেজাজ ও মানসিকতা সম্পর্কে তার আর একটি দম্ভোক্তি থেকে জানা যায়। তিনি একবার বলেছিলেন:

“ইউরোপীয় যে কোনও ভালো লাইব্রেরির একখানি মাত্র আলমারী ভারত ও আরবের সমগ্র দেশীয় সাহিত্যের চেয়েও বেশি মূল্যবান”।

১৮৩৭ সালে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজিকে সরকারি ভাষারূপে ঘোষণা করা হয়। ফলে মুসলমানদের সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ড অচল হয়ে পড়ে। ১৮৪৪ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন যে, ইংরেজিতে ডিগ্রীপ্রাপ্তরাই সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবে। ইংরেজদের এই সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তগুলো মুসলমানদের শিক্ষা-ব্যবস্থার ওপর একের পর এক আঘাত হানে।

১৮১৪ সালে ইংরেজ সরকার ভারতবাসীর শিক্ষার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করে। শিক্ষাখাতে তারা বার্ষিক এক লাখ টাকা ব্যয় বরাদ্দ করে। অথচ অন্যদিকে ১৮১৬ সালে তারা মুসলমানদের শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত হাজী মুহাম্মদ মুহসিন ওয়াকফ তহবিলের সাড়ে বাইশ লাখ টাকা হস্তগত করে।

মুসলমানরা ৫৫,০০০ টাকা বার্ষিক আয়ের সাড়ে বাইশ লাখ টাকার তাদের এই নিজস্ব তহবিল থেকে নিজেরাই যদি ব্যয় করতে পারত, তবে সরকারি সাহায্যের কপর্দকমাত্র ছাড়াই তারা সারা দেশে নিজেদের শিক্ষঅর অনেকাংশের ব্যয়-সংকুলান করতে পারত। কিন্তু ইংরেজ সরকার ধর্মীয় ও ওয়াকফ সম্পত্তির এই বিপুল অর্থ ১৮১৬ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত অর্ধ শতাব্দীর বশি সময় ধরে অমুসলমানদের জন্য ব্যয় করে। (নওয়ার আদুল লতিফের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালের ২৯ জুলাই সিদ্ধান্ত হয় যে, মুহসিন ফান্ডের টাকা নির্ধারিত মুসলিম শিক্ষা-বিস্তারে ব্যয় হবে।)

মুহসিন ফান্ডের সে বিরাট আয় থেকে ১৮৩৬ সালে ইংরেজি শিক্ষার জন্য হুগলী কলেজ খোলা হয়। ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেঝে কোন মুসলমান ছাত্র ভর্তির সুযোগ ছিল না। অথচ হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের (১৭৩২-১৮১২) দানের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হুগলী কলেঝে হিন্দুদের পড়ার সুযোগ থাকে অবারিত। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ৩০০ ছাত্রের মধ্যে বছরের পর বছর সেখানে এক ভাগও মুসলমান ছিল না।

চট্টগ্রামে মীর ইয়াহিয়া মুসলমানদের শিক্ষার জন্য যে বিপুল সম্পত্তি রেখে যান, কোম্পানি সরকার সে দানের টাকায় ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে। সে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্র প্রায় সকলেই ছিল হিন্দু।

নতুন গজিয়ে ওঠা হিন্দু জমিদার ও বিত্তশালী শ্রেণী শিক্ষা-বিস্তারের ক্ষেত্রে যে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে, তার নযীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইংরেজদের লুণ্ঠন-সহচর এই জমিদার ও ধনিক গোষ্ঠী শোষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছি নিজেদের মুসলিম-প্রধান জমিদারী এলাকায়। কিন্তু মুসলিম রায়ত-প্রজাদের কাছ খেকে লুটে নেওয়া ধন-সম্পদ থেকে স্কুল-কলেজ স্থাপনের জন্য ব্যয় করেছে হিন্দু-প্রধান অন্য এলাকায়। নোয়াখালীর জমিদার প্রতাপচন্দ্র কিংবা জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবার, সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে অভিন্ন ছিল। প্রতাপচন্দ্র মুসলিম প্রধান নিজ জমিদারী এলাকার শিক্ষার জন্য কোন কিছু না করে স্কুল কায়েম করেছেন বীরভূমে হিন্দু প্রধান এলাকায়। ঠাকুর পরিবারের জমদিারী ছিল পূর্ববাংলার বিভিন্ন এলাকায়; কিন্তু তারা থেকেছেন কলকাতায় এবং জমিদারীর আয় থেকে খরচ যা কিছু করেছেন সেখানেই।

খ্রিস্টান মিশনারী ও নব্য-পুঁজিপতি দালাল হিন্দুদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত দেশীয় ভাষা শিক্ষার স্কুল বাংলা পাঠশালাগুলোতে ‘বাংলা ভাষ্য’র নামে যা শিখানো হতো তা আসলে সংস্কৃতেরই নামান্তর। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত বাংলা যবানকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। পাঠ্য-পুস্তকের অধিকাংশ রচনা ছিল হিন্দু দেব-দেবীর পৌরণিক কাহিনী নিয়ে। ছাত্রদের জন্য ক্লাসে সরস্বতী-বন্দনা ছিল বাধ্যতামূলক।

১৮৪১ সাল পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ এলাকায় কোন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৮৪৬ সালে ঢাকার স্কুল-কলেজে ২৬৩ জন ছাত্রের মধ্যে মুসলমান ছিল মাত্র ১৮ জন। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মাত্র চার দশকের মধ্যে ছাত্র-সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় পচিঁশ গুণ। এই ছাত্রদের প্রায় সবাই বর্ণহিন্দু। ১৮৮১ সালে ১৭১২ জন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে ১৪৮০ জনই ছিল বাঙালি বর্ণহিন্দু। বাকিরা বিহারি, অসমীয় বা উড়িয়া। বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না। একই বছর গোটা উপমহাদেশে ৪২৩ জন এম এ ডিগ্রী লাভ করে। তার মধ্যে ৩৪০ জন ছিল বাঙালি বর্ণহিন্দু। ভারতবর্ষের অন্য সকল স্থানের ছাত্রদের সম্মিলিত সংখ্যা মাত্র ৮৩ জন। বাঙালি বর্ণহিন্দুদের এই উত্থান যে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদদের ফল, তা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।

ইংরেজদের শিক্ষানীতি সম্পর্কে হান্টার লিখেছেনঃ

“আমাদের প্রবর্তিত শিক্ষা-ব্যব্স্থা হিন্দুদেরকে শতাব্দীর নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে তাদের নিষ্ক্রিয় জনসাধারণকে মহৎ জাতিগত প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তুলতে পারলেও তা মুসলমানদের ঐতিহ্যের পরিপন্হি, তাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং তাদের ধর্মের কাছে ঘৃণার্হ। ……… আমাদের প্রবর্তিত জনশিক্ষা ব্যবস্থা যেমন তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমনি তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যে আর্থিক সাহায্য এতকাল তারা পেয়ে এসেছিল, তাও আমরা বিনষ্ট করেছি”। (ডবলিউ ডবলিউ হান্টার : দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা ১৫৪, ১৬০)

মুসলমানদের সর্বনাশের এ নাটকে ইংরেজ নায়কের পাশে ভিলেনরূপী বর্ণহিন্দুদের উত্থান ও জাগরণ সম্পর্কে সুরজিত দাশগুপ্তের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেনঃ

“ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাতে বৃহত্তর জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যারা অগ্রসর হলো, অর্থনৈতিক বিচারে তাদের নাম মধ্যবিত্ত শ্রেণী, রাষ্ট্রনৈতিক বিচারে তাদের নাম ব্রিটিশের সহযোগী, সাংস্কৃতিক বিচারে তাদের নাম পাশ্চাত্য শিক্ষিতশ্রেণী, সামাজিক বিচারে তাদের নাম হিন্দু সম্প্রদায়”। (সুরজিত দাশ গুপ্ত : ভারতবর্ষ ও ইসলাম; পৃষ্ঠা ১৬৯)

সুরজিত দাশগুপ্ত লিখেছেনঃ

“ব্রিটিশদের সৌভাগ্য গড়ে তোলার কাজে তিন প্রকার দেশীয় মানুষ সামর্থ্য ও সাহায্য যুগিয়েছে : পাইক সম্প্রদায় – এরা ব্রিটিশদের বাহুবল যুগিয়েছেদ; করণ সম্প্রদায় ও তৃতীয় এক ধরনের বিত্তবান সম্প্রদায়…… এরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এদেশীয় বাণিজ্য পরিচালনার ব্যাপারে যোগসূত্র বা দালাল হিসেবে কাজ করেছে। লক্ষণীয় যে, ধর্মের বিচারে ব্রিটিশদের সামর্থ্য ও সাহায্য যোগানদার এই তিন সম্প্রদায়ই হিন্দু ধর্মাবলম্বী”।

এ প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ প্রথম যুগে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের নীতি মুসলমান বিদ্বেষ এবং হিন্দু পক্ষপাতিত্বের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাই হিন্দুরা উচ্চশিক্ষঅর সুযোগ ও উৎসাহ পেয়েছে, যে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে এবং ইংরেজদের অধীনে কিছু কিছু মোটা বেতনের চাকরিও পেয়েছে। মুসলমানরা সে রকম সুযোগ-উৎসাহ পাননি।

সরকারি চাকরিঃ ‘মুসলমানদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই’

মুসলিম শাসনামলে রাষ্ট্রিয় চাকরির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। রাজস্ব আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সকল উল্লেখযোগ্য উচ্চপদে মুসলমানরাই নিযুক্ত ছিল। দেওয়ান পদে সব সময়ই মুসলমান কর্মচারি ছিল এবং প্রাদেশিক দেওয়ান অফিসে বহুসংখ্যক মুসলমান কর্মচারী কাজ করত। বাংলাদেশের ১৬৬০ টি পরগনায় আমিন, আলিম, কারকুন, খাজাঞ্চি, কানুনগো প্রভৃতি পদে হাজার হাজার মুসলমান কর্মচারী কাজ করত। ছোটখাট পদে ছিল হিন্দুরা। বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাযী, মুফতী, মীর-ই-আদল প্রভৃতি পদে মুসলমানরাই অধিকতর যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।

এভাবে বিভিন্ন সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদে যেসব মুসলমান কর্মরত ছিলেন, ইংরেজ আমলে তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়। পলাশীর পতনের পরপরই কোম্পানির নির্দেশে মীল জাফর আশি হাজার দেশীয় সৈন্যকে বরখাস্ত করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময় বাকি সৈন্যদেরও চাকরিচ্যুত করা হয়। সামারিক ও বেসামরিক সকল কর্মস্থল থেকে মুসলমানরা বিতাড়িত হয়। মুসলমানদের চাকরিচ্যুত করে বিভিন্ন সরকারি পদে হিন্দুদের নিযুক্ত করা হয়।

ইংরেজদের নিয়োগ-নীতির বদৌলতে সৃষ্ট অবস্থা সম্পর্কে হান্টার লিখেছেনঃ

“একশত বছর পূর্বে রাষ্ট্রীয় চাকরির সমস্ত পদ মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকারে ছিল। বর্তমান তাদের আনুপাতিক হার মোট সংখ্যার তেইশ ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। এটাও আবার শুধু মাত্র গেজেটেড চাকরির বেলায় প্রযোজ্য, সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। প্রেসিডেন্সী শহরের অপেক্ষাকৃত সাধারণ চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিয়োগ প্রায় সম্পূর্ণ রহিত হয়ে গেছে। ক’দিন আগে দেখা যায় যে, কোন একটা বিভাগে এমন একজনও কর্মচারী নেই, যে মুসলমানের ভাসা পড়তে জানে; এবং বস্তুত কলিকাতায় এখন কদাচিত এমন একটা সরাকির অফিস চোখে পড়বে, যেখানে চাপরাশি ও পিয়ন পদের উপরিস্তরে একজনও মুসলমান কর্মচারী বহাল আছে। এ রকম হওয়ার কারণ কি এই যে, মুসলমানদের চাইতে হিন্দুরা অধিকতর যোগ্য এবং তারাই সুবিচার পাওয়ার দাবি রাখে? অথবা ব্যাপারটা কি এই যে, বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে মুসলমানদের এত বেশি সুযোগ রয়েছে যে, সরকারি চাকরি গ্রহণে তারা অনিচ্ছুক এবং তাই চাকরির জায়গাটা তারা হিন্দুদের এখতিয়ারে ছেড়ে দিয়েছে? হিন্দুরা নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট মেধার অধিকারী, কিন্তু সরকারি কর্মক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করার জন্য যে রকমের সর্বজনীন ও অনন্য মেধা থাকা দরকার, বর্তমানে তা তাদের নেই এবং তাদের অতীত ইতিহাসও এ কথার পরিপন্হী। বাস্তব সত্য হলো এই যে, এদেশের শাসন-কর্তৃত্ব যখন আমাদের হাতে আসে তখন মুসলমানরাই ছিল উচ্চতর জাতি এবং শুধুমাত্র মনোবল ও বহুবলের বেলাতেই উচ্চতর নয় এমনকি রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় দক্ষতা এবং সরকার পরিচালনায় বাস্তব জ্ঞানের দিক থেকেও তারা ছিল উন্নততর জাতি। এ সত্ত্বেও মুসলমানদের জন্য এখন সরকারি চাকরি এবং বেসরকারি কর্মক্ষেত্র এই উভয় ক্ষেত্রেই প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে গছে”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৮)

১৮৬৯ সালের আইন-আদালতের চিত্র তুলে ধরে হান্টার লিখেছেনঃ

“মহামান্য রাণীর নিযুক্ত মোট ছয়জন আইন অফিসারের মধ্যে চারজন ইংরেজ ও দুই জন হিন্দু ছিল, মুসলমান একজনও ছিল না। হাইকোর্টের উচ্চতর গেজেটেড পদে মোট একুশ জন অফিসারের মধ্যে সাতজন ছিল হিন্দু, কিন্তু মুসলমান একজনও ছিল না। ব্যারিস্টারদের মধ্যে তিনজনি ছিল হিন্দু, মুসলমান একজন ও ছিল না। কিন্তু হাইকোর্টের উকিলের পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকাটা সর্বাধিক করুণ ইতিহাসের পরিচায়ক। বর্তমানে যারা জীবিত, তাদের সকলেরই মনে আছে যে, আইনের এই পেশাটা সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদেরই করায়ত্ত ছিল।………. ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে উকিল হিসেবে সনদ প্রাপ্তদের মধ্যে যারা ১৮৬৯ সালে জীবিত ছিল তাদের সবাই মুসলমান। এমনকি, ১৮৫১ সালেও যারা সনদ পেয়ে তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ইংরেজ ও হিন্দুর সম্মিলিত সংখ্যার সমান। এরপর থেকেই এ পেশায় নতুন ধরনের লোকদের সমাগম ঘটতে থাকে। ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে যোগ্যতার যাচাই শুরু হয়ে যায় এবং তালিকায় দেখা যাচ্ছে যে, ১৮৫২ সাল থেকে ১৮৫৮ সালে হিন্দুর সংখ্যা ছিল সাতাশ, কিন্তু মুসলমান একজনও ছিল না। শিক্ষানবীশ হিসেবে কর্মরত উদীয়মান আইনজীবীদের মধ্যে হিন্দু সংখ্যা ছিল ছাব্বিশ, কিন্তু মুসলমান শূন্যের কোঠায়”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০)

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসনে মুসলমানদের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে।

১৮৬৯ সাল ও তার ‌পর‌‌‌‌‌‌ব‌‌‌‌‌র্তী বছরগুলোর অবস্থার পর্যালোনায় দেখা যায়, চাকরি সর্বোচ্চ স্তরে আনুপাতিক হার ছিল মুলমান একজন আর হিন্দু দু’জন। এরপর মুসলমান একজন, হিন্দু তিনজন।

দ্বিতীয় স্তরে আগে ছিল মুসলমান দুই আর হিন্দু নয় জন, পরে মুসলমান এক আর হিন্দু দশজন।

তৃতীয় স্তরের চাকরিতে পূর্বে মুসলমান চারজন আর হিন্দু ও ইংরেজ মিলে সাতাশ জন, পরে মুসলমান তিন এবং হিন্দু ও ইংরেজ মিলে চব্বিশ জন।

নিম্ব স্তরে ১৮৬৯ সালে মুসলমান ছিল চার জন ও অন্যান্য ত্রিশ জন। পরে মুসলমান চারজন আর অন্যান্য ঊনচল্লিশ জন।

শিক্ষানবীশ স্তরে ১৮৬৯ সালে আটাশ জনের মধ্যে দু’জন মুসলমান আর পরবর্তীকালে সেখানে একজন ও মুসলমান নাই”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৬)

কলকাতা থেকে ফারসি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা ‘দুরবীন’ ১৮৬৯ সালে জুলই সংখ্যায় চাকরিক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা তুলে ধরে লিখেছেনঃ

“উচ্চস্তরের বা নিম্নস্তরের সকল চাকরি ক্রমান্বয়ে মুসলমানদেরহাত থেকে ছিনিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সরকার সকল শ্রেণীর প্রজাকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য। অথচ এমন সময় এসেছে, যখন মুসলমানদের না্ম আর সরকারি চাকরিয়াদের তালিকায় প্রকাশিত হচ্ছে না। কেবল তারাই চাকরির জায়গায় অপাঙক্তেয় সাব্যস্ত হয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবন কমিলনার অফিসে কতিপয় চাকরিতে লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, কিন্তু অফিকারটি সরকারি গেজেটে কর্মখালির যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তাতে বলা হয় যে, এই শূণ্যপদগুলিতে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিয়োগ করা হবে। মোট কথা হল, মুসলমানদের এতাটা নীচে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যে, সরকারি চাকরিতে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হাসিল করা সত্ত্বেও সরকারি বিজ্ঞপ্তি মারফত এটা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে য, তাদের জন্য কোন চাকরি খালি নেই। তাদের অসহায় অবস্থার প্রতি কারো দৃষ্টি নেই এবং এমনকি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতেও রাজি নয়”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩)

চাকরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের ওপর সবচে বড় আঘাতটি করা হয়েছিল অফিস-আদালতের ভাষারূপে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি চালূ করার মাধ্যমে। এই কাজে ইংরেজদের উদ্বদ্ধ করতে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইংরেজ সরকারের সমর্থক ইংরেজি শিক্ষিত নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের উচ্ছেদ করে একচেটিয়া অধিকার লাভের স্বার্থ-চিন্তাকে সামনে রেখে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজিকে অফিস আদালতের ভাষারূপে চালূ করার জন্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে এবং আরো বিভিন্নভাবে দাবি জানাতে থাকে।

দিল্লী সম্রাটের কাছ থেকে রাজা উপাধি নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে রাম মোহন রায় ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি চালূর পক্ষে ওকালতি করে আসেন। ইংরেজরা এই দাবি নিজেদের জন্যও সম্পূর্ণরূপে স্বার্থানুকূল বিবেচনা করে ১৮৩৭ সালে এক আকস্মিক আদেশ জারির মাধ্যমে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষারূপে ঘোষণা দেয়। এর ফলে সরকারি চাকরির প্রতিটি দুয়ার মুসলমানদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন ফারসি সরকারি ভাষারূপে চালূ থাকার কারণে এবং ইংরেজদের শিক্ষানীতি সকল দিক দিয়ে মুসলমানদের স্বার্থ, সামর্থ্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আঘাতরূপে বিবেচনা করার কারণেই মুসলমানরা এতকাল ইংরেজি শিক্ষা করেননি এবং তা করার জন্য কোন বাধ্যবাধকতাও অনুভব করেনি। জেমস লঙ মুসলমানদের ইংরেজি না শিকার একটি কারণ হিসেবে বলেছেনঃ

“খুব সঙ্গত কারণেই মুসলমানেরা আরবী ও ফারসি ভাষার জন্য গর্ব অনুভব করে। এই দু’টি ভাষা মুসলিম ধর্মের ও শাসনের বাণীবাহক এবং তাদের মহান ঐতিহ্যের ধারক ছিল। এই বিষয়ে তাদের অনুভূতি তখনও খুব প্রখর ছিল”। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍(‍‍‍‍‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ব‌‌া‌‌‌‌‌‌‍ঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পৃষ্ঠা ১৫৬)

মুসলমানদের ইংরেজি না শেখার পটভূমি তুলে ধরে দেলওয়ার হোসেন আহমদ ১৮৮০ সালে ‘দি ফিউচার অব দ মোহমেডানস অব বেঙ্গল’ নামক পুস্তিকায় ‘সাঈদ’ ছদ্মনামে লিখেছেনঃ

“The Aversion to English education is tracesble to race not felt by the Hindus, to their possession of a rich literature of their own, to their greater religious bigotry and partly to their povrty.” (The Calcutta, Review, Vol LXXIL. NO; CX LIV, 1881. P-V; ডক্টর ওয়াকিল‌ আহমদ : উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতরার ধারা, পৃষ্ঠা ৫৯)

মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণ না করার একটি কারণ ছিল অর্থনৈতিক। ইংরেজ ও তাদের সহযোগী দালাল হিন্দু জমিদারদের শাসন-শোষণে মুসলিম অভিজাতশ্রেণী নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণীর উত্থানের পাশাপাশি মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণী সম্পূর্ণরূপে রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। শহরের ব্যয়বহুল শিক্ষার জন্য সন্তানদের প্রেরণা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের ছিল না। এ প্রসঙ্গে সিসিল বিডন ১৮৫২ সালের ২৫ এপ্রিলের এক ‘মন্তব্যপত্রে’ লিখেছেনঃ

“মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে, তারা তাদের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ের উচ্চ বেতনের ব্যয়ভার বহন করতে পারেন। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের সেরূপ অর্থ দৈন্য ছিল না”। (ডক্টর ওয়াকিল আহমদ : উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানদের চিন্তা-চেতনার ধারা, পৃষ্ঠা ৫৯)

সার্বিক এ বরৈী পরিস্থিতিতে চাকরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে অবস্থা দাঁড়ায়, সে সম্পর্কে হান্টার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার ১৮৭১ সালে প্রদত্ত একটি তালিকা থেকে জানা যায়, সে সময়কার ২১১১ টি গেজেটেড পদে মুসলমান ছিল মাত্র ৯২ জন। আর ১৫টি ডিপার্টমেন্টের মধ্যে সর্বোচ্চ আটটিতে একজনও মুসলমান ছিল ন। (হান্টার, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৭)

চাকরিক্ষেত্রে মুসলমানদের অপসারিত করে হিন্দুদেরকে অধিষ্ঠিত করার পিছনে ইংরেজদের যে মানসিকতা কাজ করেছে, ‌‌১৮১৩ সালে সিলেক্ট কমিটির সামনে স্যার জন ম্যালকম-এর বক্তৃতা থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেনঃ

“ভারতের হিন্দুদের সহযোগিতাই আমাদের নিরাপত্তার প্রধান সহায়”।

লর্ড এডিনবরো একইভাবে সে মানসিকতা তুলে ধরেছেন। তিনি ১৮৪৩ সালে ডিউক অব ওয়েলিংটনকে এক পত্রে লিখেছেনঃ

“মুসলমানরা বরাবরই আমাদের শক্র। ভারতে আমাদের নীতি হতে হিন্দুদের প্রতি আমাদের হস্ত প্রসারিত রাখা”। (A. R. Mallick : British Policy and the Muslims in Bengal. P-64)


No comments:

Post a Comment