Thursday 22 June 2017

ভাষা ও সাহিত্য : মুসলিম সৃষ্টিধারায় বিপর্যয়



ভাষা ও সাহিত্য : মুসলিম সৃষ্টিধারায় বিপর্যয়

ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যে বাংলা ভাষার উন্নতি হয়েছে, তাতে মুসলিম শাসক, প্রচারক ও লেখকদের অবদান প্রধান হয়ে দেখা দেয়। ভৌগোলিক অঞ্চলরূপে বাংলাকে যেমনি মুসলিম শাসকগণ রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, তেমনি তাদের হাতেই মৃত ও অবহেলিত বাংলা ভাষা নবজীবন পেয়েছে। এমনকি বাংলা গদ্যের যে নমুনা, তাও মুসলিম শাসনামল থেকেই পাওয়া যায়। ষোল শতাব্দীর আগেই চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজের প্রয়োজনে গদ্যের খানিকটা প্রচলন ছিল। মুসলিম শাসনকালে সাহিত্যের প্রয়োজন ছাড়াও সরকারি দফতরখানা, খাজাঞ্চিখানা, কাজীর বিচারালয় ইত্যাদিতে বাংলা গদ্যের ব্যবহার ছিল। সেই গদ্যের পরিচয় জানিয়ে সুকুমার সেন লিখেছেনঃ

“ষোড়শ শতাব্দী হইতে বাংলা গদ্যে লেখা চিঠির নমুনা পাওয়া যাইতেছে। দলিল পাইতেছিল সপ্তাদশ শতাব্দী হইতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখা চিঠি ও দলিল অনেকগুলিই মিলিয়াছে। এই সময়ে লেখা দলিল এবং কাজ-কর্মের চিঠিতে আরবী-ফারসি শব্দের বড়ই আতিশয্য। এমনকি ভাষা ঠিক বাংলা বলতে বাধে”। (ডক্টর সুকুমার সেন : বাংলা সাহিত্যে গদ্য; মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ : মুসলিম সাংবাদিকতা ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪)

সুকুমার সেন বা পরবর্তীকালের বিভিন্ন পণ্ডিতের কাছে বাংলা ভাষার আদি গদ্য-রূপটি ‘বাংলা বলতে বাধলে’ও এটাই ছিল বাংলা ভাষার আদি অবস্থা। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবিদের মধ্যে যাঁরা উল্লেখযোগ্য-নারায়ন দেব, বিজয় গুপ্ত, দৌলত কাজী, ভারতচন্দ্র, সৈয়দ আলাউল, শ্রীকর নন্দী, হোসেন শাহ, পরাগল খাঁ, ছটি খাঁ, আবদুল গফুর, ফয়জুল্লাহ, মুন্সী মুহাম্মদ আবেদ আলী, মুন্সী আইজুদ্দীন, মুন্সী আসমত- প্রমুখের লেখায়ও আরবী-ফারসিবহুল বাংলা ভাষাই লক্ষ্য করা যায়।

বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন সম্পর্কে আবদুল গফুর সিদ্দিকী লিখেছেনঃ

“বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শনে আরবী-ফারসি শব্দের অকুণ্ঠিত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মহারাজ নন্দকুমার প্রভৃতির পত্রে এবং পরবর্তিকালে পাদ্রী জেকব বিশ্বাসের গদ্য রচনায় এইরূপটিই প্রকাশিত হইয়াছে। এই ভাষার সহিত পুঁথিত ভাষার পার্থক্য খুব বেশি নহে। অতএব, আরবী-ফারসিবহুল বাংলা যে কেবল অশিক্ষিত মুসলমান শায়েরদের রচনায়ই আবদ্ধ ছিল, তাহা নহে-তাহা আরও অধিক বিস্তৃত ও তাহার মুল আরও গভীরে প্রোথিত ছিল”। (আবদুল গফুর সিদ্দিকী : মাহে নও, কার্তিক, ১৩৬৩)

পলাশীর বিপর্যয়ের পর মুসলমানদের ব্যাপারে ইংরেজরা যে নীতি গ্রহণ করে, তার ফলে মুসলিম অভিজাতশ্রেণী বাংলা সাহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করার ক্ষমতা হারায়। ফোর্ট উইলিয়ামী ষড়যন্ত্র এবং ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে যে নতুন ভাষা ও সাহিত্যের আবির্ভাব ঘটে তাতে বাংলা ভাষার চেহারা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে ফেলার সযত্ন প্রয়াসের ছাপ লক্ষ করা যায়। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেক গ্রন্হমালা প্রকাশের মধ্য দিয়ে এবং ইংরেজ-প্রসাপুষ্ট ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে বাংলা ভাষার রূপ ও সাহিত্যের গতি পাল্টাতে শুরু করে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু সাহিত্যিক ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের এবং ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের এমন এক প্রেরণা যুক্ত হয়েছিল, যার সাথে বিপর্যস্ত মুসলমানদের কোন সম্পর্ক ছিল না। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হিন্দুর। হিন্দু সাহিত্য, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুর সমাজাদর্শই বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সবটুকু জায়গা জুড়ে ঠাঁই করে নিল। ভাষার সংস্কারে এবং বাংলা গদ্য-চর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিষ্টানরা এ সময় ব্যাপকভাবে এগিয়ে এসেছিল। তার পিছনে কাজ করেছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সুবিধা সৃষ্টির প্রেরণ। বর্ণ হিন্দুরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করার কারণেই ছাপাখানার ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলা ভাষার আদল পরিবর্তনের এ কাজটি এত ব্যাপক হলো, যার ফলে বাংলা হরফ ঠিক থাকল বটে, কিন্তু রক্তে-মাংসে সে ভাষা হয়ে উঠল অনেকাংশেই সংস্কৃত; যা ছিল আসলে বাংলা হরফে সংস্কৃত লেখারই নামান্তর। সংস্কৃত পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুদের হিংসা ও আক্রোশ এড়িয়ে সংস্কৃতের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল লড়াই করে বাংলা ভাষা তার অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা টিকিয়ে রেখেছিল। অথচ ইতিহাসের এই পর্যায়ে ইঙ্গ-হিন্দু মিলিত ষড়যন্ত্রের মুখে বাংলা ভাষা আখ্যায়িত হলো বৈরী সংস্কৃত ভাষারই দুহিতা নামে।

এ প্রসঙ্গে কাজী আমিনুল ইসলাম লিখেছেনঃ

“ইংরেজ আমলে রাজনৈতিক কারণে মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায়ের উচ্ছেদ ঘটে। ফলে বাংলা সহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করার লোক মুসলমানদের মধ্যে থাকল না। ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সাহিত্যের আবির্ভাব হলো, মঙ্গল-কাব্যরূপ সাহিত্য এগিয়ে গেল। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণকারী হিন্দুদের মধ্য হতেই আধুনিক সাহিত্যিক এগিয়ে এলেন। হিন্দু দেব-দেবীদের নাম জড়িয়ে যে সাহিত্য, তারই মধ্যে তারা বিচরণ করে আধুনিক সাহিত্যের মধ্যে বাংলাকে আনলেন। বাংলা সাহিত্যের গতি ঘুরে গেল। একচেটিয়াভাবে হিন্দুরা বাংলা সাহিত্যকে লালন করাতেই সাহিত্যের যে মুসলিম ঐতিহ্য, আচার-ব্যবহারের গন্ধ ছিল, তা সরে গেল। ভারতচন্দ্র হতে আরম্ভ করে নন্দনকুমার, জগতধীর রায় প্রভৃতির যে বাংলা ভাষার আরবী ফারসি শব্দের প্রাধান্য ছিল তা মুছে গেল। সেই থেকে ইংরেজি শিক্ষার ফলে হিন্দুরা বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে নিল”। (কাজী আমিনুল ইসলাম বাংলার রূপরেখা, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৬৭-৭০)

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এ মাড় পরিবর্তনের ফলে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়াল, বাংলা ভাষা মুসলমানদের মাতৃভাষা কি-না, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলমানের উত্তরাধিকার রয়েছে কি-না, সে সম্পর্কেও নানা দ্বিধা-সংশয় ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বাংলার মুসলমান বাঙালি, যখন হতে বাঙালির জন্ম (পাল-যুগ), তখন হতে তাদেরও জন্ম। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৭)

এই ঐতিহাসিক সত্যও অনেকেই বিস্মৃত হয়ে বসে। এ প্রসঙ্গেই মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ লিখেছেনঃ

“পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয়ের ফলে শুধু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রূপ পরিবর্তন এবং বাংলা গদ্যের চর্চায় বাঙালি মুসলমানের আত্মনিয়োগ ও সাধনার ব্যাপারটি বিলম্বিত ও বিড়ম্বিত হয়নি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাদের উত্তরাধিকার রয়েছে কি না এসব প্রশ্নও অনেক মুসলমান সাহিত্যিকের মনে নানা দ্বন্দ্ব, দ্বিধা-সংশয় ও আলোড়ন বিলোড়নের জন্ম দেয় এবং এ নিয়ে কম বাক-বিতণ্ডাও হয়নি”। (মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫)

বাংলা ভাষার এ অবস্থার জন্য পলাশীতে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয়ই যে কারণ ছিল, সে সম্পর্কে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেনঃ

“যদি পলাশীতে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য-বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়ত এই পুঁথির ভাষাই বাংলা হিন্দু-মুসলমানের পুস্তকের ভাষা হইত”। (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণ, শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্হে সংকলিত পৃষ্ঠা ৪২১)

ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক জীবনে অবক্ষয়

মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে ইসলামী শরীয়তের আলোকে নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের শিক্ষার ও সাংস্কৃতিক জীবনের উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক পল্লীতে মুফতী, কাজী, মুহতাসিব ও নায়েব নিযুক্ত করা হতো। তারা মুসলমানদেরকে শরীআতের বিধি-বিধান শিক্ষা দিতেন, তাদের ধর্মীয় সমস্যাগুলো সমাধান করতেন এবং ঈমান-আকীদার হেফাযতের ব্যাপারে দায়িত্ব পাণ করতেন, বিয়ে-শাদী পড়াতেন, জানাযা ও জুমআর নামায প্রভৃতিতে ইমামতি করতেন। এভাবে মুসলমানদের ইসলামী জীবনের সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে। এই স্বাভাবিক সামাজিক প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ফলে এ ক্ষেত্রে যে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করতে পীর-ফকীর-খন্দকার প্রভৃতি নামে একশ্রেণীর ‘ধর্মীয় নেতা’র আবির্ভাব ঘটে। তাদের প্রভাব নিজ নিজ মুরীদদের মধ্যেই সীমিত ছিল। সাধারণ মুসলিম জনগণের তত্ত্বাবধান তারা করতেন না।

মুসলিম সমাজে এ সময় বিভিন্ন বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটে। একদল স্বল্পশিক্ষিত পীর-ফকীর-খন্দকার এসব সমস্যার মোকাবিলা না করে বরং সেগুলোকে প্রশ্রয় দিতেন। ফলে বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে অবক্ষয় দেখা দেয়। তাদের বিপথগামী হওয়র পথ অবারিত হয়। প্রতিবেশি হিন্দুদের প্রভাবে ও অনুকরণে বুহু কুসংস্কার ও শরীআত পরিপন্হী রীতি-রেওয়াজ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। মুসলিম সমাজে প্রচ্ছন্নভাবে হিন্দু ধর্মীয় বহু অনুষ্ঠান ও সামাজিক আচার-আচরণ এ সময় ঢুকে পড়ে তাদের ধর্মীয় জীবনের অঙ্গীভূত হয়। অনেকে সেগুলোকে ইসলামী লেবাস পরিয়ে জাতে তোলার ব্যবস্থা করেন। মুসলিম সমাজে মা বরকত, ওলা বিবি ও শীতলা দেবীর পূজা, কালোজিরা পড়া, কাঞ্জিপাড়া, তাবীজ-কবজ ইত্যাদি বহু নতুন উপসর্গ বেশ শক্তিশালী হয়ে আসন গেড়ে বসে। হিন্দুদের মনসা পূজার অনুকরণে খোয়াজ খিজিরের পূজা, দূর্গাপূজা-দশোহরার অনুকরণে মুহররমের দশ তারিখে হাসান-হুসাইনের তাজিয়া বিসর্জন, হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পার্বণের অনুকরণে মুসলিম সমাজে নানা পার্বণ চালূ হয়।

পলাশীর পরাজয় মুসলিম সমাজ-জীবনে যে সর্বমুখী বিপর্যয় ও অভিশাপ বয়ে আনে সে সম্পর্কে ইংরেজ সরকারের বিশ্বস্ত মুখপাত্র ইউলিয়াম হান্টার ১৮৭২ সালে লিখেছেনঃ

“তারা (মুসলমানরা) অভিযোগ করেছে যে, তাদের ধর্ম প্রচারকদের সম্মানজনক জীবন-যাপনের একটি রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ………….. আমরা এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্তার প্রবর্তন করেছি, যার ফলে তাদের গোটা সম্প্রদায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে এবং তারা ভিক্ষাবৃত্তি ও অবমাননাকর জীবন যাপনের অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। …….. তাদের যে সমস্ত আইন অফিসার বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ধর্মীয় অনুমোদন দান করতেন এবং যারা স্মরণাতীতকাল থেকে ইসলামী পারিবারিক আইনের ব্যাখ্যা দান ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পালন করে এসেছেন, তাদের সবাইকে উচ্ছেদ করে আমরা হাজার হাজার পরিবারকে শোচনীয় দুরবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছি।…… মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য পালনের উপায়গুলি থেকে বঞ্চিত করে আমরা তাদের আত্মার ওপর পীড়ন চালাচ্ছি। অসদুদ্দেশ্যে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহার করেছি এবং তাদের শিক্ষা তহবিলের বিরাট অংক আমরা আত্মসাৎ করেছি। তারা প্রচার করে থাকে যে, আমরা যারা মুসলিম সাম্রাজ্যের ভৃত্য হিসেবে বাংলার মাটিতে পা রাখবার জায়গা পেয়েছিলাম, তারাই বিজয়ের সময় কোনরূপ পরদুঃখ-কাতরতা দেখাইনি এবং গর্বোদ্ধত রূঢতা প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের সাবেক প্রভূদেরকে কর্দমে প্রোথিত করেছি। এক কথায়, ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারকে সহানুভূতিহীন, অনুদান ও নিকৃষ্ট তহবিল তসরূফকারী এবং দীর্ঘ এক শতাব্দিব্যাপী অন্যায়কারী হিসেবে অভিযুক্ত করে থাকে”। (ডবলিউ ডবলিউ হান্টার : দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা ১২৭, ১২৮)

পলাশী যুদ্ধোত্তর বাংলার মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ডক্টর ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন :

“বস্তুত ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ে রাজক্ষমতা-চ্যুতি, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারির সংখ্যা হ্রাস, ১৮২৮ সালে বাজেয়াফত আইনে নিষ্কর ভূমির রায়তি স্বত্ব লোপ, ১৮৩৭ সালে ফারসির রাজভাষাচ্যুতি- পরপর এই চারটি বড় আঘাতে পূর্বের শাসকশ্রেণী নিঃস্ব-রিক্ত, নিরক্ষর, নিষ্ক্রিয়, নির্জীব জাতিতে পরিণত হয়। ইংরেজদের প্রশাসনিক আইন ও শিক্ষানীতির ফলেই এই রূপটি হয়েছে”। (ড. ওয়ালি আহমদ : উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তা-চেতনার ধারা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১)

ইংরেজরা বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে শঠতা, প্রতারণা, ষড়যন্ত্রে ও বিভেদ-নীতির আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্রের ভাগিদার হিন্দু শেঠ বেনিয়ারাও কখনো সে প্রতারণার শিকার হয়ে জব্দ হয়েছে। কিন্তু ইংরেজরা এই হিন্দু সম্প্রদায়কে তাদের নিরাপত্তার প্রধান সহায়ক বিবেচনা করে করে যেটুকু করুণা বর্ষণ করেছে, তার দ্বারা তাদের ঋণ শতকরা শত ভাগের বেশিই শোধ হয়েছে। বাংলার মুসলমানদের জন্য যা ছিল ইতিহাসের ভয়াবহতম বিপদ-বিপর্যয়, এই বর্ণহিন্দু শ্রেণীর জন্য তা ছিল প্রভূ পরিবর্তন এবং নব্য-প্রভুর কিঞ্চিত আশীর্বাদের জীবনের সকল দিক কানায় কানায় পূর্ণ ও পুষ্ট করার সুযোগ। সে কারণেই মুসলমানদের লাঞ্ছনার পটভূমিতে বঙ্কিম-গুরু ঈশ্বরগুপ্ত প্রমুখের কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হলো ইংরেজ-প্রভুর বিজয়-বন্দরা :

“ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়

মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়”।

No comments:

Post a Comment