Thursday 22 June 2017

উনিশ শতকের কলকাতায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন


উনিশ শতকের কলকাতায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

বাংলায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের সূচনা থেকে একদিকে সরা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল, অন্যদিকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দখল সম্প্রসারিত হচ্ছিল। তারা শুধু অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেনি। এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় জীবনের দিকেও থাবা বিস্তার করেছিল। বাংলার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে নতুন বাংলা গদ্যধারার বিকাশ ঘটে। কলকাতাকেন্দ্রীক সদ্য বিকশিত বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রতিভূ সাহিত্যিক ও সংস্কৃত পণ্ডিতেরা এ কাজে পরম উৎসাহে অংশ নেন। জনগণের মুখের ভাষার আদলে গড়ে ওঠা বাংলাকে বর্জন করে, সম্পূর্ণরূপে মুসলমানী ছাঁচ বাঁচিয়ে তারা এক নতুন গদ্যভাষা নির্মঅণ করেন। ভারতচন্দ্র থেকে শুরু করে নন্দনকুমার, জগতধীর রায়ের সাহিত্যে মুসলমানের যবানী ভাষার যে প্রভাবটুকু ছিল, তা-ও তারা পরম যত্মে ধুয়ে-মুছে সাফ করে ফেলেন। এভাবেই খ্রিস্টান পাদ্রী ও তাদের জুনিয়র পার্টনার বর্ণহিন্দু পুরোহিতদের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার চেহরা বদলে গলে। মৃত সংস্কৃত ভাষা গৌরব লাভ করল একটি জীবন্ত, চলিষ্ণু ভাষার ‘জন্মদায়িনী’রূপে, আর বাংলা ভাষার পরিচয় ঘটল ‘সংস্কৃতের দুহিতা’ নামে। বাংলা ভাষার এই মোড় পরিবর্তনের কার্যকরণ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায় : ‘পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয়’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেনঃ

“বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূত্রপাত হলো বৈদেশীর ফরমাসে এবং তার সূত্রধর হলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা ভাষার সঙ্গে যাদের ভাসুর-ভাদ্র বৌয়ের সম্বন্ধ”।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ‘বৈদেশীর ফরমাসে’‘সংস্কৃত সূত্রধর’দের দ্বারা করাত-চেরা হয়ে যে সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলা গদ্যের সূচনা হলো, খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সে ভাষায়ই তখন থেকে পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু হয়। বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িকপত্রে মাসিক ‘দিগদর্শন’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালের এপ্রিলে। সম্পাদক একজন ইংরেজ পাদ্রী। নাম জন ক্লার্ক মার্শম্যান। তাঁরই সম্পাদনায় মাত্র এক মাস পর প্রকাশিত হয় আরো একটি সাময়িকপত্র- ‘সমাচার দর্পন’, ১৮১৯ সালের ডিসেম্বরে। কলকাতার ব্যাপ্টিস্ট মিশন সোসাইটি প্রকাশ করে একটি ইংরেজি-বাংলা দ্বি-ভাষিক মাসিকপত্র ‘গসপেল ম্যাগাজিন’। ১৮২২ সালে শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত হয় ‘খ্রিস্টের রাজ্যবৃদ্ধি’। খ্রিস্টধর্মের বানী প্রচারের প্রেরণা নিয়ে এই অত্যল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো সাময়িকপত্রের জন্ম একটি লক্ষণীয় বিষয়। ইংরেজদের রাজ্য বিস্তারের সাফল্যকে অবলম্বন করে এভাবে তাদের ধর্ম-কৃষ্টির বিজয় অর্জনের হাতিয়ারূপেই এ সকল সাময়িকপত্র চিহ্নিত।

খ্রিস্ট ধর্মের বাণীবাহী এসব সাময়িকপত্রের পাশাপাশি এ সময় থেকেই হিন্দু ধর্মের মহিমা প্রচার, হিন্দু সমাজের সংস্কার ও হিন্দু ধর্মীয় পনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণীর মুখপত্ররূপে বিভিন্ন সাময়িকপত্র প্রকাশ পেতে থাকে। এগুলোর মধ্যে ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ (১৮১৮), ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ (১৮২১), ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১), ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ (১৮২২) সাপ্তাহিক ‘শাস্ত্র প্রকাশ’ (১৮৩০), ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১), ‘সম্বাদ সুধাকর’ (১৮৩১) প্রভৃতি পত্রিকা বর্ণহিন্দুদের প্রকাশিত প্রথম যুগের সাময়িকপত্ররূপে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইংরেজদের দেওয়ানী, বেনিয়ানী, মুৎসুদ্দীগিরি, ঠিকাদারি ও অন্য আরো অনেক প্রকার দালালি করে কলকতাকে কেন্দ্র করে বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণীর বিকাশ ঘটে; তাদের জীবনে আসে রেনেসাঁ বা নব জাগতি। ফলে তাদের হাতে এই নতুন গণ-মাধ্যমটি নানা রূপ-বৈচিত্র্যে পল্লবিত হয়ে ওঠে।

১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত একশ’ বছর ধরে বাংলার মুসলমানগণ ছিলেন বিদেশী বেনিয়া ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধরত। তখন বর্ণ-হিন্দুরা নযীরবিহীন দালালির মাধ্যমে এদেশে ইংরেজ শাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করছিল। উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার বর্ণ-হিন্দু মধ্য-শ্রেণীটি ইউরোপীয় শিক্ষা-সভ্যতার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগ এই শ্রেণীটির নেতৃত্বেই বর্ণহিন্দুদের নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ এই রেনেসাঁর নায়ক। ‌১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলো। ১৮৩৯ সালে রামমোহন রায় দিল্লীর সম্রাটের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে রাজ-দরবারে আবেদন জানালেন রাষ্ট্রভাষা ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজি চালুর জন্য। ১৮৩৭ সালে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি চালুর ফলে মুসলমানদের জন্য সরকারি চাকরির দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় বাংলায় জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের পতাকাতলে বাংলার মুসলমানরা একদিকে সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, অন্য দিকে হিন্দু জমিদাররা ১৮৩৭ সালেই প্রতিষ্ঠা করে ‘বেঙ্গল-ইন্ডিয়া সোসাইটি’। সারা ভারত জুড়ে যখন ইংরেজ উৎখাতের বিপ্লবী প্রস্তুতি চলছে তখন ১৮৫৩ সালে হিন্দু জমিদাররা প্রতিষ্ঠা করে ‘বেঙ্গল ল্যান্ড লর্ডস এসোসিয়েশন’। আর ১৮৫৬ সালে কলকাতার নব-উত্থিত বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে ইঙ্গ-হিন্দু স্বার্থের দুর্গরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’।

সিপাহী বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতির সুযোগে নবোত্থিত হিন্দু মধ্যশ্রেণীটি ব্যাপকভাবে ইংরজ প্রশাসনে প্রবেশের সুযোগ লাভ করে। তাদের বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি-স্বার্থপরতা ক্রমশ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ-লোলুপতায় রূপ পেতে থাকে।

উইলিয়াম জোনস, ম্যাক্সমুলার, কর্ণেল টড প্রমুখ ইংরেজ লেখকের চরম মুসলিম-বিদ্বেষী ও প্রাচীন হিন্দু-ঐতিহ্যভিত্তিক রচনাসমূহকে উপজীব্য করে উনিশ শতকের মধ্যভাগে হিন্দু সমাজে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু হয়। এভাবেই তাদের ধর্মীয় জাতীয়তারও সূচনা হয়। সাম্প্রদায়িক স্বার্থ-চেতনার ভিত্তিতে তাদের জাতীয় মানস গড়ে উঠতে থাকে। রাজনারায়ণ বসু, ননীগোপাল মিত্র প্রমুখ এই নতুন হিন্দু জাতীয়তাবাদের বাণীবাহকদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখ লেখক মুসলিম শাসনকে নির্বিচারে ‘অত্যাচারী শাসন’ বলে আখ্যায়িত করেন। তারা ইংরেজ শাসনের প্রশংসায় মুখর ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে যেসব রাজপুত, মারাঠা ও শিখ মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তাদেরকে এই লেখকরা বীরের মর্যদায় অভিষিক্ত করেন। এই অভিন্ন ধারার অনুসারী বঙ্কিমচন্দ্রের মতো লেখকরা হিন্দুদের হিন্দুয়ানী রক্ষার জন্য ‘নেড়ে দেড়ে যবনদের বাবুইয়ের বাসা ভাঙ্গিয়া যবনপুরী ছারখার করিয়া নদীর জলে ফেলিয়া দিবার’ উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে থাকেন। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের বৃহদংশ জুড়ে বিপন্ন মুসলমানদেরকে একেবারে কর্দমে পুতে ফেলার আহ্বান প্রচার হতে থাকে। মুসলিম বিদ্বেষ প্রচারের পাশাপাশি হিন্দুরা একদিকে ইংরেজ তোষণ অন্য দিকে নিজ সম্প্রদায়ের জাগরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমিতি-সংগঠন কায়েম করতে থাকেন।

উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শ্রেণীটির পরিচয় দিয়ে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেনঃ

“ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের বঙ্গ সমাজ ছিল প্রধানত দুইটি মূলশ্রেণী লইয়া। ইহাদের একটি ইংরেকসৃষ্ট ভূস্বামী গোষ্ঠী এবং অপরটি কৃষিকাজে নিযুক্ত কৃষক সম্প্রদায়। ……… তৎকালের বিপুল কারিগর সম্প্রদায়ও কৃষক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজ শাসনের কৃপায় জমিদার শ্রেণী সমাজ-শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং ভূমির পত্তনি-ব্যবস্থার মারফত জমিদার শ্রেণীর সহিত অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ (তালুকদার) মধ্যশ্রেণীটিও জমিদারদের সহকর্মীরূপে সমাজের উচ্চ সীমায় আরূঢ় হইয়াছিল। ব্যয়বহুল ইংরেজি শিক্ষা ও জাতীয় সংস্কৃতি এই সমবেত ভূস্বামী গোষ্ঠীর একচেটিয়া অধিকারে পরিণত হওয়ায় সমাজের উপর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইহারা যথেষ্ট শক্তিশালী হইয়া উঠে। …. ইহাদের জাতীয় চৈতন্য মোহাচ্ছন্ন ছিল বলিয়াই সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেছিল, তখন মধ্যশ্রেণীর উভয় অংশ, বিশেষত প্রতক্রিয়াশীল অংশ সংগ্রামরত কৃষকের সহিত যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য তাহাদের সমগ্র ধনবল ও জনবল নিয়োগ করিয়াছিল”। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯)

এই মধ্যশ্রেণীর নেতৃত্বেই উনিশ শতকের মধ্যভাগে কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুদের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। রামমোহন রায় এই আন্দোলনের জনক। এটি ছিল নব্যসৃষ্ট জমিদারদের আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন। রামমোহন রায় এই আন্দোলনের জনক। এটি ছিল নব্যসৃষ্ট জমিদারদের আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকোনন্দ- এরা সবাই এই রেনেসাঁর নায়ক এবং ‘কৃষক সংগ্রামের ভয়ে ভীত জমিদার ও মধ্যশ্রেণীর’ প্রধান মুখপাত্ররূপেই তাদের মূল পরিচয়। বর্ণহিন্দু জাগরণের এই নায়করা উনিশ শতকে যে জাতীয়তাবাদের আদর্শ স্থাপন করেন, তা ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। জাতি বলতে তারা বুঝতের হিন্দু জাতি। তাদের আদর্শেই কলকাতার বর্ণহিন্দু নেতাদের পরিচালনায় বিকাশ লাভ করেছে বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই এই জাতীয় আন্দোলন ছিল মুলত হিন্দু জাতীয় আন্দোলন। কেননা উনিশ শতকের বাংলার নবজাগৃতির নামে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যা কিছু আলোড়ন, তার অবলম্বন ছিল হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবনের বাণী।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণীটি ইউরোপীয় শিক্ষা-সভ্যতার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই উঠতি বর্ণহিন্দুদের পাশ্চাত্যমুখী প্রবণতা কেটে যেতে থাকে। তার পরিবর্তে সেখানে ভারতের প্রাচীন সভ্যতার ও ধর্মের প্রতি জেগে ওঠে নতুন আকর্ষণ। শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের মাঝে হিন্দু দর্শন, হিন্দু সাহিত্য ও হিন্দু শিল্পের প্রতি একটা গর্বের ভাব জেগে ওঠে। ক্রমশ প্রাচীন হিন্দু-ধর্মীয় আদর্শ অব্যাহত রাখার জন্য নতুন নতুন সংগঠন কায়েক হয়। এগুলো সনাতন হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য ও আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে থাকে। এই সামাজিক পরিবেশে হিন্দু ধর্ম পুনরুজ্জীবনের প্রধান নায়করূপে স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব ঘটে। তিনি হিন্দু মধ্যশ্রেণীর কাছে হিন্দু ধর্মীয় আদর্শের শ্রেষ্ঠত্বের বাণী প্রচার করেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘নব্য হিন্দুবাদ’ প্রচারের মাধ্যমে সনাতন হিন্দু ধর্ম পুনরুজ্জীবনের যে কাজ শুর করেছিলেন, বিবেকানন্দ তা বহুদূর এগিয়ে নেন। তার শিক্ষাকেই বর্ণহিন্দুরা তাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করে। এই জাতীয়তাবাদের মূল কথা ছিলঃ

“স্বদেশ সম্বন্ধে গৌরববোধ, হিন্দু আদর্শের পুনরুত্তান এবং ভারতীয় প্রাচীন আধ্যাত্মিক ধারণার সমষ্টিবদ্ধ রূপ”।

বিপিনচন্দ্র পালের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদের চরমপন্হি প্রবক্তাগণও বিবেকানন্দকেই তাদের রাজনৈতিক গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক কর্মবৃন্দ, বিশেষত সন্ত্রাসবাদীরা তাঁর ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়।

‌১৯০১ সালে বিবেকানন্দ ঢাকা এলে তাঁর সাথে এখানকার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের লোকদের ঘনিষ্ট আলোচনা হয়। সে আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন এবং ভারতকে রাম-রাজত্বে পরিণত করার ব্যাপারে বল প্রয়োগের নীতিতে আস্থাবান ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ

“……… প্রথম কাজ প্রথম করিতে হইবে। শরীর গঠন ও দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপাইয়া পড়া তরুণ বাংলার প্রাথমিক কর্তব্য। শরীর-সাধনা এমনকি ভগবতগীতা পাঠ করা অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুঃসাহসিক নেশা-পৌরুষ, তেজস্বিতা, অর্থাৎ বীরনীতি দুর্বলের রক্ষা ও উদ্ধারের জন্য নিযুক্ত করা কর্তব্য। …… হে বঙ্গের তরুণ দল, তোমরা ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাঈদের আদর্শ অনুসরণ কর। …. জনগণের মধ্যে যাও, অস্পৃশ্যতা দূর কর, ব্যায়ামাগার ও গ্রন্হাগার প্রতিষ্ঠা কর। বঙ্কিমের রচনা বারংবার পাঠ কর, আর তাঁদের দেশভক্তি ও সনাতন ধর্মের অনুসরণ কর”। (ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত : স্বামী বিবেকানন্দ- পেট্রিয়ট এন্ড প্রফেট)

বিবেকানন্দ সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেনঃ

“তথাকথিত সমাজবাদী স্বামীজির মতে…… ধর্মীয় ভাবধারার প্লাবনই ভারতে সাম্যবাদ ও রাজনৈতিক জাগরণের পক্ষে অপরিহার্য। অবশ্য এই ধর্মীয় প্লাবন যে পুনর্গঠিত হিন্দু ধর্মের অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র প্রবর্তিত ও রামকৃষ্ণ পরমহংস কর্তৃক পরিবর্তিত নব হিন্দুবাদেরই প্লাবন তা বলাই বাহুল্য’। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২১৭)

১৮৫৩ সালে কলকাতায় অবিভক্ত বাংলার বনেদি হিন্দু জমিদারদের উদ্যোগে বেঙ্গল ল্যান্ডলর্ডস এসোসিয়েশন গঠিত হয়। এরপর কলকাতার বাঙালি হিন্দু বিত্তশালী জমিদার ও বণিক শ্রেণীর উদ্যোগে তাদের স্বার্থ রক্ষার দুর্গরূপে ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন। এই সমিতির সকল সদস্য ছিলেন ইংরেজদের দ্বারা সদ্য-সৃষ্ট জমিদার, ব্যবসায়ী ও ধনিক গোষ্ঠীর লোক। অভিজাত ও জমিদার ছাড়া অন্যদের এই সমিতিতে প্রবেশাধিকার ছিল না। এই সমিতির সদস্যরাই আইন সভার সদস্য হতেন। ‌‌১৮৬২ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত এই সমিতির ৩ জন সদস্য বঙ্গীয় বিধান সভার সদস্য হয়েছেন। তাঁরাই দেশের কৃষি, বাণিজ্য ও পশা বিষয়ক স্বার্থসমূহের প্রতিনিধিত্ব করতেন। এ বিষয়ে আব্দুল মওদুদ লিখেছেনঃ

“তাদের মধ্যে ঠাকুর বংশই ছিল অগ্রগণ্য। বিশাল জমিদারি, বিপুল ব্যবসায় ও অফুরন্ত ধনসম্পদের অধিকারী হিসেবে এই বংশটির ঐতিহ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা মুখরিত। প্রিন্স দ্বারকানাথের ভ্রাতা মহারাজা রমানাথ ঠাকুর এই সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন দশ বছর এবং ১৮৬৬ সালে বঙ্গীয় বিধান সভার ও ১৮৭৩ সালে ভারতীয় বিধান সভার সভ্য নির্বাচিত হন। ব্রাহ্ম সমাজের উৎসাহী নেতা হিসেবে এবং কলকাতা কর্পোরেশনের সভ্য হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা ছিল। প্রসন্নকুমার ঠাকুর সরকারি ও অন্যান্য সূত্রে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন ও ১৮৬৩ সালে বঙ্গীয় বিধান সভঅর সভ্য হন। মহারাজ বাহাদুর স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ১৮৭০ সালে বঙ্গীয় বিধান সভার ও ১৮৭৭ সালে ভারত বিধান সভার সভ্য হন। সামান্য বেনে-নন্দন রামগোপাল ঘোষ বাণিজ্যলব্ধ অর্থবলে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স শিক্ষা সভার ১৮৪৫ সালে ও বঙ্গীয় বিধান সভার ১৮৬২ সালে সভ্য হন। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন উপরিউক্ত এসোসিয়েশনের বিশিষ্ট সভ্য এবং ব্রিটিশ সাহায্য ও অনুগ্রহ-ধন্য কলকাতার নব্য ‘রইস”। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃষ্ঠা ১৬৮)

১৮৬৬ সালে কলকাতার বাঙালি বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা ও ইংরেজ রাজশক্তিকে মদদ যোগানোর লক্ষ্যে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় রাজনারায়ণ বসুর নেতৃত্বে ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ কায়েম হয়। এই সংস্তাটির অনুষ্ঠান-পত্রে ‘হিন্দু ব্যায়াম’, ‘হিন্দু চিকিৎসা বিদ্যা’ ও ‘হিন্দু শাস্ত্র’ অবলম্বনে সমাজ সংস্কার করার আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বানের ভিত্তিতে ‌১৮৬৭ সালের ‌১২ এপ্রিল (বাংলা ‌১২৩৭ সনের চৈত্র সংক্রান্তির দিন) বেলাগাছিয়ায় ডানকান সাহেবের বাগানবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্শীবাদে জ্যোতিরন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র, নাট্যকার মনোমোহন বসু প্রমুখের উদ্যোগে ‘হিন্দু মেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্ণহিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে আত্মানির্ভরশীল করা এই মেলার লক্ষ্য বলে ঘোষিত হয়। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মোট ১৪ বার এই মেলায় বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতাকেন্দ্রক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণীর রাজনৈতিক দাবি-দাওয়াগুলো ‘আলোচনা ও পরামর্শের ভিত্তিতে, আদায়ের লক্ষ্যে পদচ্যুত প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ বা ‘ভারত সভা’।

১৮৮২ সালে ভারতীয় বিধান সভায় ‘ইলবার্ট বিল’ নামে একটি বিল পেশ হয়। এই বিলে বিধান ছিল, দেশীয় হাকিমদের কাছেও ইউরোপীয়দের বিচার হতে পারবে। ইউরোপীয়রা এই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুর করে। এই আন্দোলন অন্যায় জেনেও ইংরেজ সরকার নতি স্বীকার করে এবং বিলের উদ্দেশ্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। হিন্দু মধ্যবিত্তরা এই বিলের পক্ষে আন্দোলন করে। ইলবার্ট বিল সম্পর্কিত জটিলতাকে কেন্দ্র করে ১৮৮৩ সালে ন্যাশনাল কনফারেন্স স্থাপিত হয়। অবশেষে ইংরেজ প্রাক্তন সিভিলিয়ান এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম-এর উদ্যোগে এবং গভর্নর জেনারেল ডাফরিনের পরামর্শে ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে বোম্বে শহরে এক বৈঠকের মাধ্যমে জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। এ বিষয়ে রজনী পাম দত্ত লিখেছেনঃ

“প্রকৃতপক্ষে বড় লাটের সাহায্যে সংগোপনে রচিত পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ উদ্যোগ ও পরিচালনায় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হইয়াছিল ক্রমবর্ধমান বিরুদ্ধে শক্তি এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্রোধ হইতে ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার অস্ত্ররূপে”। (ইন্ডিয়া টুডে)

‌১৮৮৬ সালে ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যশ্রেণী এভাবেই উনিশ শতকের আশির দশক নাগাদ একটি বিকশিত স্তরে উন্নীত হয়। আবদুল মওদুদ এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ

“এই আমলে আমরা হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে দেখেছি, পশ্চিমের খোলা দ্বার দিয়ে যেসব উপহার এসেছে সে-স তারাই উজাড়ভাবে আত্মসাৎ করেছে, নতুন ভাবধারা গ্রহণ করে আত্মীকরণ করেছে এবং সম্প্রসারণও করেছে। সারা উপমহাদেশের নব্য-শিক্ষিত সম্প্রদায়কে একত্রিত এবং সংহত করেছে। নতুন পাশ্চাত্য শিক্ষ তাদের একটা সাধারণ ভাষা দিয়েছে, সাধারণ ভাবধারা দিয়েছে এবং সাধারণ জ্ঞানও দিয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক ট্রাডিশনের পাশাপাশি। নতুন প্রেসও বহির্বিশ্বের ভাবধারা ও কর্মধারার সংস্পর্শে এনেছে এদেশবাসীকে এবং তার প্রতিক্রিয়াও সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থায় মাদ্রাজ দিল্লীর সঙ্গে যখন-তখন কথা বলছে, বোম্বাই বলছে কলকাতার সঙ্গে। এভাবে নতুন শিক্ষানীতির প্রবর্তনের পর ইলবার্ট বিল উপস্থাপিত হওয়ার সময় (১৮৮২) পর্যন্ত পাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে হিন্দু সমাজ-দেহের মধ্যম স্তর থেকে এমন একটা সুসংহত একই স্বার্থডোরে জড়িত শ্রেণীর উদ্ভব হলো, যারা সর্বভারতে একই শিক্ষা, একই ভাবধারা ও একই মূল্যবোধ প্রবর্তিত ক করল নিজেদের গণ্ডির মধ্যে। অবশ্য এ শ্রেণী ছিল বিরাট সমাজ-দেহের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কিন্তু ক্ষুদ্র হলেও তেজোদ্দীপ্ত ও বিস্ফোরণ-উন্মুখ। এটিকে বলা যায় হিন্দু ভারতের নতুন আত্মা এবং এই নতুন আত্মার মুখেই অতঃপর হিন্দু ভারতের প্রাণের বাণী শোনা যেত এবং সে বাণী সমগ্র হিন্দু জাতির অন্তরের কথা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করত”। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃষ্ঠা ১৮২-৮৩)

১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্মের পর থেকে শুরু করে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণিহিন্দু ও মারাঠা ব্রাহ্মণদের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থের এক সেতুবন্ধ তৈরী হয়। মহারাস্ট্রে স্থাপিত দেশীয় বস্ত্র-শিল্পের সমর্থক মারাঠা ব্রাহ্মণ ও কলকাতার বর্ণহিন্দুরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষে শাসকগোষ্ঠীর সাথে চরম বোঝাপড়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এ সময়। এম আর আখতার মুকুল এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ

“বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বঙ্গীয় এলাকার বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের মনমানসিকতা যখন দিনে স্যুট-প্যান্ট আর সন্ধ্যায় ধুতি, ঠিক তখনই মহারাষ্ট্রিয় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এদের সেতুবন্ধ রচিত হলো। এই সম্প্রদায়ের চোখে তখন ভবিষ্যতের বিরাট স্বপ্ন”। (কলিকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী)

কলকাতার বর্ণহিন্দুদের চিন্তা-ভাবনার স্তরে স্তরে এ সময় হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা ডালপালা বিস্তার করেছিল। এ বিষয়ে ডক্টর পুলিন দাশ লিখেছেনঃ

“১৮৬৬ সালে ব্রাহ্ম সমাজ দু’ভাগ বিভক্ত হয়ে এক ভাগ কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ ও অপর অংশ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় আদি ব্রাহ্ম সমাজ নামে চিহ্নিত হয়। …… দেবেন্দ্রনাথের পৌরহিত্যে আদি ব্রাহ্মসমাজের রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদক’ বিখ্যাত বক্তৃতা দেন (১৮৭২)। ‘বংদগদর্শন’- বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক রাজনারায়নের বক্তৃতার উচ্ছাসিত প্রশস্তি প্রকাশিত হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে বঙ্কিমচন্দ্রকেও দেখা যায় হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যয়ন ও অলোচনায় নিবিষ্ট হতে। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রচার’ পত্রিকা হিন্দু ধর্মের প্রচারমাধ্যম হয়ে ওঠে। দয়ানন্দ স্বরস্বতী প্রতিষ্ঠিত আর্য সমাজ (১৮৭৫) আন্দোলন হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। বেদকে অভ্রান্ত গণ্য করে দয়ানন্দ হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যার দ্বারা হিন্দু ধর্মের প্রতি শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। লালা হংসরাজ, লালা লাজপত রায়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ অতঃপর দয়ানন্দ প্রবর্তিত মতবাদের অনুপ্রেরণা জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘প্রচার’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের আরও কয়েকটি পত্র-পত্রিকা বিশেষ করে ‘বংগবাসী’, ‘নবজীবনী’ হিন্দু ধর্মের পুনরভ্যুত্থান প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। …. বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি বৈষ্ণব ভক্তিবাদে আকৃষ্ট হন। বঙ্গদেশের শিক্ষিত সাধারণের কাছে দয়ানন্দ পরিচিত হয়েছিলেন কেশবচন্দ্রের মাধ্যমে। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ ও ‘সুলভ সমাচার’ পত্রে প্রধানত কেশবচন্দ্রের রচনা-ধারার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহিমা প্রকাশ পেতে থাকে। হিন্দুর যে পৌত্তলিকতা নব্য শিক্ষিতদের দ্বারা সম্পূর্ণ বিবর্জিত হয়েছিল, রামকৃষ্ণ ছিলেন সেই পুতুল পূজারী। গ্রাম্য ব্রাহ্মণের প্রতি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, মহেন্দ্র সরকার, অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রভৃতির ন্যায় ভিন্ন মার্গী বহু গুণীজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের দৃষ্টান্তে পৌত্তলিক হিন্দুর আত্মপ্রসাদ লাভের যথেষ্ট সুযোগ মিলল”। (বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক)

এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল লিখেছেনঃ

“ঊনবিংশ শতাব্দীর আট দশকের সূচনায় হিন্দু পুনরুত্থানের মাহেন্দ্রক্ষণ। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত চাতুর্যে এতদিন ধরে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতায় আপ্লুত রক্ষণশীল সনাতন হিন্দু ধর্মরূপী যে চারাবৃক্ষে জলসিঞ্চন করছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে এসে কলিকাতায় সখারাম গণেশ দেউঙ্কর আর ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের উদ্যোগে সকলের দৃষ্টিগোচর হলো। আসলে এটাই হচ্ছে বঙ্গীয় এলাকার শতাব্দীকালের বিষবৃক্ষ। … ঊনবিংশ শতাব্দীর আট দশকে কলিকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ‘উদার ও সংস্কারপন্হি মন-মানসিকতা’ উচ্ছিষ্টের মতো নর্দমায় নিক্ষিপ্ত করেছে। মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে মেকলের ভবিষ্যতবাণীর সঙ্গে যুক্ত হলো ‘সনাতন হিন্দু ধর্মের’ শ্রেষ্ঠত্ব, আর ‘হিন্দু বাহুবলের আবরণ”। (কলিকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী)

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু লেখকরা হিন্দু পুনর্জাগরণমূলক কবিতা, গান আর নাটকে ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে রাজপুতদের সাথে মোগল বিরোধকে উপজীব্য করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন। লে. কর্নেল জেমস টড-এর রচিত ‘এনালস এন্ড এন্টিকস অব রাজস্থান’ নামক বইটি ছিল শত বছর ধরে হিন্দু লেখকদের অবলম্বন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার যে চারণ গীতিকে ‘আফিমখোরদের গাল-গল্প’ বলে অবহেলা করেছেন, টড-এর তা-ই ছিল উপজীব্য। মোগলদের সাথে রাজপুত জাতির আত্মরক্ষামূলক ও সমঝোতামূলক লড়াইকে ঘিরে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় মনে করে উনিশ শতকের শেষ প্রান্তি এসে হিন্দু লেখকরা নযর ফেরালেন মারাঠা দস্যু ‘পার্বত্য মুষিক’ ছত্রপতি শিবাজীর প্রতি। শিবাজীর ব্যক্তিত্ব, শোর্য-বীর্যের কাহিনী ও বীরগাঁথা অবলম্বনে এ সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদী পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর নেতৃত্ব নিলেন কংগ্রেসের চরম দক্ষিণপন্হি নেতা মারাঠা-ব্রাহ্মণ বালগঙ্গাধর তিলক। ১৮৯৩ সালে তিনি ‘গণপতি উৎসব’ প্রবর্তন করলেন। তার উদ্যোগে মহারাষ্ট্রের রায়গড়ে ১৮৯৬ সালের ১৫ এপ্রিল ‘শিবাজী উৎসব’-এর আয়োজন করা হয়। এর পরের বছর পুনা শহরে বিপুল উৎসাহ- উদ্দীপনার মধ্যে তিনদিনব্যাপী শিবাজী উৎসব পালিত হয়। তিলক ছত্রপতি শিবাজীর রাজ্যাভিষেক উৎসবেরও প্রচলন করেন। শিবাজী ছিলেন ভবানী দেবীর ভক্ত। তাই ভবানী পূজা শিবাজী উৎসবের মূল অঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত হলো। মারাঠাদের অনুসরণে ১৯০২ সাল নাগাদ কলকাতায় শিবাজী উৎসবের সূচনা হলো। এর পরেই বাংলা সাহিত্য, নাটক, কবিতা আর গানগুলো ছত্রপতি শিবাজীর জয়গানে মুখরিত হলো। বাঙালিত্বের নামে হিন্দু বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু রিবাইভালিজম-এর মাধ্যমে সর্ব ভারতীয় ভিত্তিতে হিন্দু জাতীয়তা প্রতিষ্ঠাই ছিল তখনকার কলকাতাকেন্দ্রিক প্রায় সকল বর্ণহিন্দুর অভিন্ন লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ড. প্রভাকুমার গোম্বামী ‘দেশাত্মবোধক ঐতিহাসিক বাংলা নাটক’ বইয়ে তখনকার অবস্থা চিত্রিত করে লিখেছেনঃ

“মোগলের বিরুদ্ধে রাজপুতদের সংগ্রামের কাহিনী যেমন আমাদের দেশাত্মবোধের প্রেরণা যুগিয়েছে, ঠিক তেমনি প্রেরণা যুগিয়েছে মোগলের বিরুদ্ধে শিবাজীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম কাহিনী। শিবাজীকে অবলম্বন করে জাতীয় ভাবাবেগ তখন তুঙ্গে উঠেছে। চার বছর ধরে শিবাজী উৎসব চলছিল কলকাতা শহরে। চরমপন্হি স্বাদেশিকরা বিশেষ করে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়-এর উদ্যোগে যে শিবাজী উৎসব সম্পন্ন হলো তার অঙ্গ স্বরূপ ছিল ভবানী পূজা। শিবাজী উৎসবে ভবানী মূর্তি নির্মাণ করে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবালূতাকে উত্তেজিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন জাতীয় নেতারা। সে যুগের জাতীয়তাবাদ বহুলাংশেই হিন্দু জাতীয়তাবাদে পর্যবসিত হয়েছিল। তাই শীবাজীকে ‘জাতীয় বীর’ রূপে সহজেই প্রতিষ্ঠা করা গেল”।

No comments:

Post a Comment