মুসলিম শাসন অবসানের পটভূমি
আমাদের জাতি সত্ত্বার বিকাশ ধারা বই থেকে ।
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা আকস্মিকভাবে ঘটেনি। এখানে মুসলিম শাসন অবসানের পটভূমিও তৈরি হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। পনের শতকের প্রথমার্ধে গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের শাসনামলে রাজা গণেশের রাজনৈতিক উত্থান-প্রচেষ্টা এবং আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর বর্ণহিন্দুরা দীর্ঘদিন থেকেই বাংলায় মুসলিম শাসন উৎখাতের স্বপ্ন দেখেছিল। সামনের সারিতে এসে নেতৃত্ব গ্রহণের হিম্মত তাদের ছিল না। তারা সব সময়ই ষড়যন্ত্রের পেছন দরজা ব্যবহারের অপেক্ষায় ছিল।
এই পটভূমিতে ১৪৯৮ সালের ২০ মে পর্তুগীজ নাবিক ডা গামা ভারতের মালাবার উপকূলে এসে পৌছেন। মুসলিম বণিকগণ তাকে সেখানে বাধা দেন। কিন্তু কালিকটের হিন্দু রাজা জামুরন তাকে অভ্যর্থনা জানান ও নিজ প্রসাদে আশ্রয় দেন। ছয়মাস পর ভাস্কো ডা গামার মাধ্যমে পর্তুগালের রাজার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে জামুরিন এই ঐশ্বর্যশালী দেশে বানির্জ করার জন্য পর্তুগীজ নাবিকদের আমন্ত্রণ জানান। এভাবে ভারতে ইউরোপীয় বণিকদের আগমনধারার সূচনা হয়।
১৫০২ সালে ভাস্কো ডা গামা দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষে এসে কোচিন ও কান্নানোরের রাজার সহযোগিতায় জামুরিনের রাজ্যে হামলা করেন। ১৫০৫ সালে পনের শ’ নাবিকসহ ফ্রান্সিককো দ্যা আলমেডিয়া এদেশে আসেন। মালাবার উপকূলে বণিক ও হজ্জযাত্রীদের জাহাজগুলি এই পর্তুগীজ দস্যুদের হামলাল লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। ১৫০৯ সালে আল ফানসো দ্যা আল বুকার্ক মালাবার উপকূলে প্রভাব বিস্তার করেন। ১৫১০ থেকে ১৫১৫ সালের মধ্যে কোচিন, দমন, দিউ পর্তুগীজ অধিকারে চলে যায়।
এক হাতে বাইবেল অন্য হাতে তরবারি
ইউরোপে ক্রসেডের পটভূমিতে পর্তুগীজরা ছিল চরম মুসলিমবিদ্বেষী। সেই পটভূমিতে পর্তুগীজরা মুসলিম ভারতে এসেছিল এক হাতে বাইবেল ও অন্য হাতে তরবারি নিয়ে।
ইউলিয়াম হান্টারের ভাষায়ঃ
They were not traders, but knighterrant and Crusaders…….. Their national temper had been formed in their contest with the Moors (Muslims) at home, (A Brief History of the Indian People, 1868, P-167)
ইংরেজ বণিকরা এদেশে প্রথম আসে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৬০২ সালে ডাচ, ১৬০৪ সালে ফরাসী, ১৬১২ সালে দিনেমার, ১৬৩৩ সালে স্পেনীয়, ১৭২৩ সালে আস্ট্রিয়, ১৭১৩১ সালে সুইডিশ এবং ১৭৫০ সালে ক্রশীয় বণিকরা বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে এদেশে আসে।
১৬২০ সাল থেকে ইংরেজ বণিকরা সুরাট, আজমীর ও পাটনায় সীমিত আকারে ব্যবসা করছিল। ১৬২৪ সালে তারা উড়িষ্যার বালাশেরে কুঠি স্থাপন করে। ১৬৫১ সালে ইংরেজরা হুগলীকে কুঠি স্থাপন করে। তখন থেকেই তারা বর্ণহিন্দু ব্যবসায়িক মিত্রদের সহযোগীতা নিয়ে এদেশের রাজনীতির দিকে হাত বাড়াতে শুরু করে।
১৬৮২ সালে উইলিয়াম হেজেজ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির এজন্ট নিযুক্ত হন। এরপর বাণিজ্যিক শর্ত লঙ্ঘন, সৈন্য ও অস্ত্র সমাবেশ, হুগলীতে দুর্গ নির্মাণ, কর প্রদানে কারচুপি, দেশীয় ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষ এবং বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানের কর্মচারীদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ১৬৮৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে সৈন্য বোঝাই জাহাজ এসে পৌছে বাংলার সুবাদার ও ভারত সম্রাটের সাথে শক্তি পরীক্ষার জন্য।
এর আগে ১৬৫৫-৫৬ সালের মধ্যে বার্ষিক কুড়ি পাউন্ড বেতনের রাইটার-এর চাকরি নিয়ে ভাগ্যন্বেষী জোব চার্নক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাসিমবাজার কুঠিতে যোগ দেন। দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৬৮৫ সালে তিনি হুগলী কুঠি’র চীফ এজেন্ট নিযুক্ত হন। হুগলী কুঠির বকেয়া শুল্ক বাবদ তেতাল্লিশ হাজার টাকা আদায়ের জন্য ঢাকার সুবাদার জোব চার্নকের বিরুদ্দে ডিক্রী জারি করেন এবং তাকে ঢাকায় তলব করেন। চার্নক কাসিমবাজারে পালিয়ে যান। সুবাদারের লোকেরা তাকে সেখানে ধাওয় করলে রাতের আঁধারে গা-ঢাকা দিয়ে তিনি হুগলীর কুড়ি মাইল দক্ষিণে জঙ্গলাকীর্ণ সুতানুটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। ১৬৮৭ সালে জোব চার্নক সুতানুটি থেকে পালিয়ে যান মাদ্রাজে।
ইংরেজদের নানা কুকর্মে রুষ্ট হয়ে শায়েস্তা খান বাংলায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খানের স্থলে ইবারহীম খাঁ সুবাদার হন। ইংরেজ বণিকরা অতীত অপকর্মের জন্য ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে বহু আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধা পুনরায় ফিরে পায়।
১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট জোব চার্নক তৃতীয় বারের মতো সুতানুটির ঘাটে অবতরণ করেন। কৌশলগত যাবতীয় সুবিধার দিক বিবেচনা করে তিনি সেখানেই কেন্দ্র স্থাপন করেন।
গঙ্গাতীরের ধান ক্ষেত, কলাবাগান, জলাভূমি ও কয়েকটি কুঁড়েঘর নিয়ে সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও ডিহি-কলকাতা নামক তিনটি স্যাঁতস্যাতে জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামকে কেন্দ্র করে তখন থেকেই ভারতের মুসলিম সাম্রজ্যের অভ্যন্তরে ইংরেজ ‘নাবিক, বণিক ও লোফার’ এবং তাদের এদেশেীয় বর্ণহিন্দু কোলাবোরেটদের ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিরূপে বেড়ে উঠতে থাকে শহর কলকাতা। এ. কে. রায়ের ভাষায়:
“The fair dealings of the English traders with Hindu marchatns and the latter’s faithfulness to the Company became the talk of the day.” ( A Short History of Calcutta)
এ ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিতে চারদিক থেকে যারা ভিড় করতে লাগলো তাদের পরিচয় হলো-
“They were mainly Hindus because it was easier to manage the submissibe Hindus than the refractory Muslims.” (History of the Freedom Movement of India)
আঠার শতকের শুরু থেকে ইংরেজ বণিক ও বর্ণহিন্দুদের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্কের সূত্র ধরে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। ১৭৩৬ থেকে ১৭৪০ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে তাদের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করে। তারা সকলেই ছিল হিন্দু। ১৭৩৯ সালে কাসিমবাজারে কোম্পানির সকল এদেশীয় কর্মচারীর পরিচয়ও ছিল অভিন্ন। এভাবেই ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্রমূলক মৈত্রী গড়ে ওঠে। মুসলিম শাসনেরে অবসান ছিল এ মৈত্রীজোটের অভিন্ন লক্ষ্য। এস.সি হিল তাঁর গ্রন্হ ‘বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭’- এ প্রমাণপঞ্জীসহ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
আলীবর্দী খান ১৭৪০ সালে শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। এর পর থেকেই তাঁকে একদিকে ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় মারাঠা বর্গী ও রোহিলাদের সাথে লড়াই চালাতে হয়। এই দ্বৈত সংকটের সুযোগে ১৭৫৪ সালে ইংরেজরা কলকাতায় উইলিয়ান দুর্গ নির্মাণ করে।
ইংরেজ কর্মচারীদের তখনকার চিঠিপত্র দেখা যায় যে, মুসলিম শাসন ধ্বংসের ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্র তখন পরিণত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। ১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চরম সুযোগ উপস্থিত হয়। তারা তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে প্রথমে ইয়ার লতীফকে পরে বিশেষ বিচেনায় মীর জাফরকে শিখণ্ডী হিসেবে বেছে নেয়।
১৭৫৭ সালের ১মে কলকাতায় ইংরেজ কমিটি তাদের বর্ণহিন্দু দালালদের সহায়তায় মীর জাফরের সাথে এগার দফা চুক্তিপত্র সম্পাদন করে। সেই ষড়যন্ত্রমূলক এগার দফা চুক্তির ভিত্তিতেই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম বাগানে যুদ্ধ প্রহসনের মধ্য দিয়ে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পতন হয়। সেই সাথে লুপ্ত হয় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা এবং কালক্রমে ভারতর্ষ- আসমুদ্র হিমাচল।
পলাশীর এই যুদ্ধকে কোন কোন হিন্দু লেখক ‘দেবাসুর সংগ্রাম’ নামে অভিহিত করেছেন। এখানে ‘দেবতা’ হলেন ক্লাইভ আর ‘অসুর’ রূপে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে জীবন দানকারী তরুন নবাব সিরাজকেই চিহ্নিত করা হয়। পলাশীর শোকাবহ বিপর্যয়কে কলকাতায় ‘পলাশীর বিজয়োৎসব’- রূপে পালন করা হয় এবং দুর্গাদেবীর অকাল-বোধনের মাধ্যমে বসন্তকালীন দুর্গোৎবকে শরাদীয় দুর্গোৎসবরূপে পালন করে ক্লাইভকে দেবতুল্য সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করা হয়।
মীর কাসিমের শেষ প্রতিরোধ
১৭৫৭ সালের ২৯ জুন পরাধীন দেশের পুতুল নবাবরূপে মসনদে বমেন মীর জাফর। ৩ জুলাই রাজকীয় শান-শওকতের সাথে দুইশ’ নৌকা বোঝাই সোনা-চাঁদি মুর্শিদাবাদ থেকে কলতাকা পাঠনো হয় ইংরেজদের ‘যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে। এভাবেই ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের সম্পদ লণ্ঠনের মাধ্যমে নগর কলকাতার উত্থান ঘটে।
ইংরেজদের পৌনঃপুনিক টাকার দাবি মিটাতে মীর জাফরের রাজকোষ শূন্য হয়। ইংরেজদের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য মীরজাফর ওলন্দাজদের সাথে মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা করেন। ইংরেজরা মীর জাফরকে সরিয়ে দিয়ে ১৭৬৫ সালের অক্টোবর মাসে তার জামাতা মীর কাসিমকে মসনদে বসায়।
মীর কাসিম তার অতীত ভূলের কাফফারা আদায় করতে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেন। দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন তিনি। ফলে ইংরেজদের সাথে শুরু হয় প্রত্যক্ষ লড়াই। ১৭৬৩ সালে যুদ্ধ হলো গিরিয়ায়, উদয়নালায়, পাটনায়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাসিম আশ্রয় নিলেন আযোধ্যায়। নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন তিনি। কিন্তু নবাব সুজাউদ্দৌলার মন্ত্রী বেণী বাহাদুর ও বেনারসের বলওয়ান সিংহ ইংরেজদের সাথে গোপন আঁতাতের পুরনো খেলায় লিপ্ত হয়। ফলে মীর কাসিম ও সুজাউদ্দৌলার যৌথ বাহিনী ১৭৬৪ সালের এপ্রিলের এক যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়।
এরপর ১৭৬৪ সালে ২২ অক্টোবর দিল্লীর সম্রাট, অযোধ্যায় নবাব ও মীর কাসিমের সম্মিলিত বাহিনী বখশারে ইংরেজদের মোকাবিলা করেন। এই যুদ্ধের সময়ও পুনরাবৃত্তি হলো একই নাটকের। সম্রাটের দেওয়ান সেতাব রায়, অযোধ্যার নবাবের মন্ত্রী বেণী বাহাদুর ও মীর কাসিমের খ্রিষ্ট্রান সেনাপতি মার্কাট ও আরাটোনার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সম্মিলিত বাহিনী ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে পরাস্ত হয়।
বখশারে বাংলার জনগণের ভাগ্যের চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গেল। বাংলাদেশে ইংরেজদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব কার্যত পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ক্লাইভ এক চুক্তির ভিত্তিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব প্রশাসনের ফরমান আদায় করে নিলেন।
অন্য দিকে ভগ্ন-হৃদয় মীর কাসিম দীর্গ বারো বছর মধ্য-ভারত সফর করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা চালান। ১৭৭৭ সালের ৬ জুন দিল্লীর আজমিরী দরজার বাইরে অজ্ঞাত পরিচয় মুসাফিররূপে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন মীর কাসিম। তার মাথার নিচে রাখা নামাঙ্কিত চাদর দেখেই বাংলার এই ভাগ্য-বিড়ম্বিত নবাবক সেদিন শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
১৭৯৬ সালে ঢাকার নামেমাত্র নবাব শামসউদ্দৌলা বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তর ভারত, আফগানিস্তান ও পারস্যের মুসলতান শাসকদের সাথে গোপন যোগাযোগের ভিত্তিতে ওমানের মস্কট থেকে আরব জাহাজে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনার ব্যবস্থা করেন। কয়েকটি জাহাজ কলকাতা বন্দরে আসে এবং সৈন্যরা শামসউদ্দৌলার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।
কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এই ‘ষড়যন্ত্রের’ আভাস পেয়ে ১৭৯৯ সালে শাসসউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে। নবাব শামসউদ্দৌলা ১৮৩১ সালে মারা যান।
No comments:
Post a Comment