Thursday 22 June 2017

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ।


নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক

বাংলাদেশের সমাজে ভাবমূর্তি পূজার (Personality cult) বিষয়টি আছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার ক্ষেত্রে এই পার্সোনালিটি কাল্ট লক্ষ করা যায়।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বাংলা-বিহার-ওডিশায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধপ্রহসন আর ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহ, ইংরেজ সরকার যার নাম দিয়েছে সিপাহি বিদ্রোহ। এই একশ বছরের মধ্যে আসমুদ্রহিমাচল সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। এসব কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ও পলাশীর যুদ্ধপ্রহসনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা ভাষার ভূভাবে এবং সমগ্র ভারত উপমহাদেশে সবারই কর্তব্য, এই ইতিহাস ঘটনা সম্পর্কে যথাসম্ভব সঠিক ধারণা অর্জন।

সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় বসেছে, সেই মীরজাফর গোষ্ঠী ও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে সব সময় মিথ্যা প্রচার চালিয়েছে। ইংরেজ শাসকদের ও তাদের দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা-সংগ্রামে ব্যবহার উপযোগী সিরাজউদ্দৌলার অনুকূলে ভাবমূর্তি যাতে গড়ে না ওঠে, তার জন্য তখনকার জনগণের শত্রুরা তৎপর ছিল। সিরাজউদ্দৌলার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে, এখনকার মানদণ্ড অনুযায়ী, ভালো ও মন্দ দুই-ই ছিল। তাঁর গুণের দিক কম ছিল না।

আলিবর্দির পুত্রসন্তান না থাকায় তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকার অনিশ্চিত ছিল। তাঁর পরিবারে নানা অনাচার দেখা দিয়েছিল। শৈশব থেকেই সিরাজউদ্দৌলা অত্যন্ত সুদর্শন ও বুদ্ধিমান ছিলেন। আলিবর্দি তাঁকে খুব বেশি আদর করতেন এবং সব সময় সঙ্গে রাখতে চাইতেন। তার পর সিরাজউদ্দৌলা নবাব হোক—এটা যে তিনি চাইতেন, তা স্পষ্ট ছিল। এ জন্য সিরাজের দুই খালা তাঁর প্রতি ভীষণ ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং সব সময় তাঁর অমঙ্গল কামনা করতেন। রাজনীতিতে তাঁদের, বিশেষ করে ঘসেটি বেগমের প্রভাব ছিল।

 সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আলিবর্দি পরিবার যুক্ত ছিল। ক্ষমতাসীন হয়ে সিরাজউদ্দৌলা তাঁর দরবারে—আমাত্য, পরিষদ ও আমলাদের মধ্যে—কোনো শৃঙ্খলা প্রবর্তন করতে পারেননি। অনেকেই তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন না। তাঁর আচরণে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেত। সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতা সুসংহত করতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত History of Bengal গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ অধ্যায়ে যদুনাথ সরকার লিখেছেন : ‘ক্লাইভ যখন নবাবের ওপর আঘাত হানে, তখন দেখা যায়, মোগল সভ্যতা তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ভালো কিছু করার সামর্থ্য তখন তার আর নেই এবং তার অস্তিত্ব নিষ্প্রাণ। দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা তখন নৈরাশ্যজনকভাবে অসৎ ও অকর্মণ্য এবং একটি সংকীর্ণচেতা, স্বার্থপর, উদ্ধত, অথর্ব শাসকশ্রেণি দ্বারা চরম দারিদ্র্য, অজ্ঞতা ও নৈতিক অধঃপতনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। জড়বুদ্ধি লম্পটরা তখন ক্ষমতাহীন।

 সেনাবাহিনী বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে একেবারে অকেজো ও ঝাঁঝড়া হয়ে পড়েছিল। অভিজাত শ্রেণির বিপুল অনাচার ও লাম্পট্যের ফলে সাধারণ পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা হয়েছিল বিপন্ন এবং রাজদরবার ও অভিজাতবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত ইন্দ্রিয় উদ্দীপক সাহিত্য তাতে জুগিয়েছিল ইন্ধন। ধর্ম তখন পরিণত হয়েছিল সর্বপ্রকার পাপ ও অনাচারের রক্ষাকবচে।’ মুশিদাবাদের বাইরে সারা দেশের জমিদাররাও নবাবের প্রতি যথেষ্ট আনুগত না থেকে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সমগ্র ভারতে দিল্লির মোগল শাসনও অবক্ষয়ে নিপতিত হয়েছিল।

মীরজাফর মুর্শিদাবাদে নবাব হওয়ার পর রবার্ট ক্লাইভ ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি কমিটিতে ভাষণদানকালে সগর্বে বলেছিলেন : ‘লাখ লাখ লোক দাঁড়িয়ে দেখছিল সে ঘটনা। ইউরোপীয়দের ধ্বংস করার কোনো ইচ্ছা যদি তাদের থাকত, তাহলে কেবল লাঠি এবং ঢিলের সাহায্যেই তারা তা করতে পারত।’ এই উক্তিতে সে দিনের মুর্শিদাবাদের জনমনের পরিচয় আছে।
বাংলাদেশের আজকের বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস-অভিমুখী রাজনীতির, ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অভিমুখী রাজনীতির, দিল্লি অভিমুখী রাজনীতির বিস্ময়কর রকম মিল আছে সিরাজউদ্দৌলা-মীরজাফর-মীর কাসিম-সাইফউদ্দৌলা-নাজমউদ্দৌলার কালের মুক্তিবাদের রাজনীতির। কোন পরিণতির দিকে পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment