Saturday 24 June 2017

বাংলায় ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের উচ্চভিলাষ।



বাংলায় ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের উচ্চভিলাষ।

বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস বই থেকে ।
বাংলার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ইংরেজগণ কোলকাতায় দুর্গ নির্মাণের কাজ ব্যাপকভাবে চালাতে থাকে। বাংলার নবাব আলীবর্দী খান তখন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং এই দুর্বলতার সুযোগে সুচতুর ইংরেজগণ তাদের দুর্গ নির্মানের কাজ দ্রুততার সাথে করে যাচ্ছিল। আর তাদের এ কাজে সাহস ও উৎসাহ যোগাচ্ছিল বাংলার হিন্দু শেঠ ও বেনিয়া শ্রেণী। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত বাংলায় ইংরেজদের যে ব্যভসা দান বেঁধে উঠেছিল, তার দালাল ও কর্মচারী হিসাবে কাজ ক’রে একশ্রেণীর হিন্দু প্রভূত অর্থশালী ও প্রভাবশালী হয়ে পড়েছিল। উপরন্তু তারা নবাব আমলে রাজস্ব প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদেও অধিষ্ঠিত ছিল। সুদী মহাজনী ও ব্যাংক ব্যবসার মাধ্যমেও তারা অর্থনীতি ক্ষেত্রে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত।

 তারা মুসলিম শাসন মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের সাহসও তাদের ছিলনা এবং এটাকে তারা অবস্থার প্রেক্ষিতে সংগতও মনে করতোনা। তাই মুসলিম শাসনের অবসান ঘটাতে হলে ইংরেজদের সাহায্য সহযোগীতা ব্যতীত গত্যন্তর ছিলনা। ইংরেজরা এ সুবর্ণ সুযোগ ভালোভাবেই গ্রহণ করে। প্রশাসন ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুদের এতটা প্রভাব হয়ে পড়েছিল যে, তারা হয়ে পড়েছিল বাংলার নবাবদের ভাগ্যবিধাতা (Kingmakers)। ১৭২৭ খৃষ্টাব্দে মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র সরফরাজ খানকে উত্তরাধিকার মনোনিত করা হলে হিন্দু প্রধানগণ বাধা দান করে। কারণ তাঁকে তারা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে করতো। তারা সরফরাজ খানের পিতা সুজাউদ্দীনকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর শাসন কালে (১৭২৭-৩৯ খৃঃ) এ সকল হিন্দু শেঠ বেনিয়াগণ প্রকৃতপক্ষে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্ত হয়ে পড়ে। তাদের দলপতি আলম চাঁদ ও জগতশেঠ হয়ে পড়েছিল দেশেল প্রকৃত শাসক (Defactoruler)।

সুজাউদ্দীনের মৃত্যুরপর এ ষড়যন্ত্রকারী দলটি উড়িষ্যার নায়েব নবাব আলীবর্দী খানকে বাংলার সিংহাসন লাভে সাহায্য করে। তাঁর আমলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চরমে পৌঁছে। এ অবস্থার সুযোগে মারাঠাগণ বার বার বাংলার উপর চড়াও করে। বেগতিক দেখে আলীবর্দী খান এসব প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। ফলে রায় দুর্লভ রায়, মাহতাব রায়, স্বরূপ চাঁদ, রাজা জানকী রায়, রাজা রাম নারায়ণ, রাজা মানিক চাঁদ প্রভৃতির নেতৃত্বে এ দলটি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়ে। মুর্শিদকুলী খানের পর সম্ভ্রান্ত মুসলিম রাজকর্মচারীর সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে পেতে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে এবং এ সময়ে কার্যতঃ তাদেরকে যবনিকার অন্তরালে নিক্ষেপ করা হয়। জগনশেঠ-মানিকচাঁদ দলটি শুধু নবাবের অধীনে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করতে পারতো। অতএব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সংগে যোগসাজসে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটাতে পারলেই মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিহিংসার বহ্নি নির্বাপিত হয়।

জগৎশেঠ-মানিকচাঁদ চক্রের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দুজাতির দু’টি লক্ষ্য ছিল। একটি রাজনৈতিক –অপরটি অর্থনৈতিক। বাংলার শাসন পরিবর্তণ বা হস্তান্তরের দ্বারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থকরণ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভ। এ দু’টি লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে কোম্পানীর সংগে মৈত্রীবদ্ধ হতে তারা ছিল সদাপ্রস্তুত ও অত্যন্ত আগ্রহশীল।

পক্ষান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও তাদের ব্যবসায় প্রসার ও উন্নতিকল্পে হিন্দুদের কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ ছিল। কারণ তাদের ব্যবস বাণিজ্য হিন্দু দালাল গোমস্তা ও ঠিকাদারদের সাহায্য ব্যতীত কিছুকেই চলতে পারতো না। উপরন্তু ১৭৩৬-৪০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত কোলকাতায় তাদের মূলধন বিনিয়োগে ৫২ জন স্থানীয় বণিকদের অংশ ছিল এবং তারা সকলেই হিন্দু। কাশিমবাজারের কারখানা স্থাপনে ২৫ জন হিন্দু বণিকের অংশ ছিল এবং তারা সকলেই হিন্দু। কাশিমবাজারের কারখানা স্থাপনে ২৫ জন হিন্দু বণিকের সাথে ছিল তারা সংশ্লিষ্ট। শুধু ঢাকায় তাদের ১২ জন অংশীদারের মধ্যে দু’জন ছিল মাত্র মুসলমান। (সিরাজউদ্দৌলার পতন –ডঃ মোহর আলী)

কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গের সামরিক ইঞ্জিনিয়ার কর্ণেল স্কটের নিকট লিখিত এক পত্রে চার্লস এফ. নোবল বলেন যে, -হিন্দু রাজাগণ ও অধিবাসীবৃন্দ মুসলিম শাসরে প্রতি ছিল অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ। এ শাসনের অবসান কিভাবে ঘটানো যায় –এ ছিল তাদের গোপন অভিলাষ। ইংরেজদের দ্বারা কোন বিপ্লব সংঘটন সম্ভব হলে তারা তাদের সাথে যোগদান করবে বলে অভিমত প্রকাশ করে।

নোবল বলেন, -“উর্মিচাঁদ আমাদের বিরাট কাজে লাগবে বলে আমি মনে করি। হিন্দু রাজা ও জমসাধারণের উপর পুরোহিত নিমু গোঁসাই –এর যথেষ্ট প্রভাব আছে। বিরাট সংখ্যার সশস্ত্র একটি দল তার একান্ত অনুগত। সন্যাসী দলকেও আমরা আমাদের কাজে লাগাতে পারি। নিমু গোঁসাই –এর দ্বারা এ কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস আছে”।

নিমু গোঁসাই কর্ণেল স্কটকে দেশের পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর ও পরামর্শ দিত এবং বলতো যে –দরকার হলে ইংরেজদের সাহায্যে সে মাত্র চার দিনের মধ্যে এক হাজার সশস্ত্র লোক হাজির করতে পারবে। (সিরাজদ্দৌলার পতন –ডঃ মোহর আলী, পৃঃ ১১)

মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু জাতির পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ফলে বাংলায় সন্যাসী আন্দোলনের নামে গোপনে একটি সশস্ত্র দলগঠন করা হয়েছিল এবং তারাও মুসলিম শাসন অবসানে সহায়ক হয়েছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল কোলকাতায় দুর্গ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করে। অপরদিকে বাংলার নবাবের নিকটে যে জমিদারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লাভ করে তার উপরে সার্বভৌম অধিকারও তারা প্রতিষ্ঠিত করে। দেশের আইনে অপরাধীগণ শাস্তি এড়াবার জন্যে কোম্পানীর জমিদারীর অধীনে আশ্রয় লাভ করতে থাকে। এ সকল অপরাধী সকলেই ছিল হিন্দু। চোরাচালানের অপরাধে দোষী রামকৃষ্ণ শেঠ নামক জনৈক ব্যবসায়ীকে কোম্পানী আশ্রয় দান করে এবং নবাবের হাতে তাকে সমর্পণ করার নির্দেশ কোম্পানী অমান্য করে। এমনি নবাবের আরও বহু আইনসম্মত নির্দেশ তারা লংঘন করে। তাছাড়া তারা ব্যবসা সংক্রান্ত বহু চুক্তি লংঘন করে।

ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, কুকর্ম ও হীন আচরণ নবাব আলীবর্দীর জানা ছিলনা তা নয়। তবে শয্যাশায়ী মরণোন্মুখ নবাবের কিছু করার ক্ষমতা ছিলনা। তাঁর ভাবী উত্তরাধিকারী সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদের ষড়যন্ত্র বানচাল করতে চেয়েছিলেন বলে তিনি তাদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। আলীবর্দীর পর দু’জন বাংলার সিংহাসনের দাবীদার হয়ে পড়েন। আলীবর্দীর বিধবা কন্যা ঘেসেটি বেগম এবং পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জং। ইংরেজগণ ঘেসেটি বেগমের দাবী সমর্থন করে। বেগম ও তার দেওয়ান রাজবল্লভ তাদের যাবতীয় ধসম্পদ নিরাপদে সঞ্চিত করার জন্যে কোলকাতায় কোম্পানীর তত্ত্বাবধানে রাখেন। রাজবল্লভকে কোম্পানীর আশ্রয়ে প্রেরণ করে। কৃষ্ণবল্লভবে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজগণ নবাবের সংগে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং ঘেসেটি বেগমের বিশ হাজার সৈন্যসহ সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্যে উদ্ধুদ্ধ করে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করে। এ সবকিছুই জানার পর সিজার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না করে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হন। কিন্তু তাঁর কোন কতায় কর্ণপাত করতে ইংরেজগণ প্রস্তুত ছিলনা।

জনৈক ইংরেজ কারখানার মালিক William Tooke বলেন যে, প্রাচ্যের প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী নতুন রাজাভিষেকের পর বিদেশী নাগরিকগণ বিভিন্ন উপঢৌকনাদিসহ নতুন বাদশাহ বা নবারের সাথে সাক্ষাৎ করে থাকে। কিন্তু এই প্রথমবার তারা এ প্রথা লংঘন করে। তিনি আরও বলেন, কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দান এবং তাকে নবাবের হাতে সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি এটাই প্রমাণ করে যে, সিরাজদ্দৌলার রাজনৈতিক শত্রুর সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভীর যোগসাজস ছিল যার জন্যে তারা এতটা ঔদ্ধত্য দেখাতে সাহস করে। (হিলের ইতিহাস, ১ম খন্ড ও সিরাজউদ্দৌলার পতন –ডঃ মোহর আলী)

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বাংলা সরকারের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের অনুরূপ। সিরাজদ্দৌলা তাদের সাথে একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার সকল প্রকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত করেন। তিনি এ ব্যাপারে হুগলীর জনৈক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজেদকে যে পত্র দেন (১লা জুন, ১৭৫৬) তার মর্ম নিম্নরূপঃ

প্রধানতঃ তিনটি কারণে ইংরেজদেরকে এ দেশে আর থাকার অনুমতি দেয়া যেতে পারেনা। প্রথম কারণ এই যে, তারা দেশের আইন লংঘন ক’রে কোলকাতায় একটি সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করেছে। দ্বিতীয়তঃ তারা ব্যবসায় চুক্তি ভংগ করে অসদুপায় অবলম্বন করেছে এবং ব্যবসা-কর ফাঁকি দিয়ে সরকারের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে। তৃতীয়তঃ একজন সরকারী তহবিল আত্মসাৎকারীকে আশ্রয় দিয়ে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছে।

তেসরা জুন সিরাজদ্দৌলা কাশিমবাজারস্থ ইংরেজদের কারখানা দখল করে একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্যে চাপ দেন। কারখানা দখলের পর তিনি একটা উদারতা প্রদর্শন করেন যে, কারখানাটি তালাবদ্ধ করে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেন যাতে করে তা লুণ্ঠিত হতে না পারে। উইলিয়ম ওয়াটস এবং ম্যাথু কলেট ছিলেন এ কারখানার পরিচালক এবং তাঁরাই উপরোক্ত মন্তব্য করেন- (হিলের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড)

কাশিমবাজার কারখানার সমুদয় কর্মচারীকে সিরাজ মুক্ত করে দেন। শুধুমাত্র ওয়াটস এবং কলেটকে সাথে করে কোলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রার পূর্বে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্যে বার বার পত্র লিখেন। কিন্তু তারা মোটেই কর্ণপান করেনা। বরঞ্চ একটা সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার জন্যে তারা সদাপ্রস্তুত থাকে। দাক্ষিণাত্য থেকে সাকরিক সাহায্য লাভের পর তাদের সাহস অনেকখানি বেড়ে যায়। নবাবের কোলকাতা পৌঁছাবার এক সপ্তাহ পূর্বে হুগলী নদীর নিম্নভাবে অবস্থিত থানা দুর্গ এবং হুগলী ও কোলকাতার মধ্যবর্তী সুখ সাগর দখলের জন্যে ড্রেক সৈন্য প্রেরণ করে। নবাব কর্তৃক প্রেরিত অগ্রবর্তী দল উভয়স্থানে ইংরেবদের আক্রমণ প্রতিহত করে।

১৬ই জুন ত্রিশ হাজার সৈন্যসহ সিরাজ ফোর্ট উইলিয়ামের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন। দু’দিন ধরে যুদ্ধের পর ড্রেক তার মূল সেনাবাহিনীসহ ফলতায় পলায়ক করে। পলায়নের সুবিধার জন্যে হলওয়েলকে যুদ্ধে নিয়োজিত রাখা হয় এবং বলা হয় যে-পরদিন সেও যেন তার মুষ্ঠিমেয় সৈন্যসহ ফলতায় আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু, হলওয়েল নবাবের সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির সামনে উইলিয়াম টুক (William Tokke) যে সাক্ষ্য দান করে তাতে বলা হয় যে, আত্মসমর্পণকারী ইংরেজ সৈন্যদের প্রতি কোন প্রকার দুর্ব্যবহার করা হয়নি। (হিলের ইতিহাস ১ম খন্ড)। রাত্রি বেলায় প্রচুর মদ্যপানের পর কিছু সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করলে তাদেরকে ১৮”১৪” মাপের একটি কক্ষে আবদ্ধ রাখা হয়। অবাধ্য ও দুর্বিনীত সৈন্যদের আবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যেই কক্ষটি তাদেরই দ্বারা নির্মিত হয়েছিল; চল্লিশ থেকে ষাট জনকে এতে আবদ্ধ রাখা হয়। যুদ্ধে অত্যধিক পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে জন বিশেক সৈন্য প্রাণত্যাগ করে। এ ঘটনাকে অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত করে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান দেয়া হয়েছে। এ কাল্পনিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে বিজয়ী শাসকগণ হলওয়েল মনুমেন্ট নামক একটি স্মৃতিস্তম্ভ কোলকাতায় ডালহাউসি স্কোয়ারে স্থাপন করে। এ স্তম্ভটি নবাব একটি স্মৃতিস্তম্ভ কোলকাতায় ডালহাইসি স্কোয়ারে স্থাপন করে। এ স্তম্ভটি নবাব সিরাজদ্দৌলার কাল্পনিক কলংক-কালিমা বহন করে বিংশতি শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। উদ্দেশ্যমূলক ও নিছক বিদ্বেষাত্মক প্রচারনার উৎস এ স্তম্ভটি তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৯৩৭ সালের পুর্বেই ভেঙে দেয়া হয়।

যাহোক, হলওয়েল এবং অন্য তিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্যান্য সকলের মুক্তি দেয়া হয়। ২৪মে জুন মানিক চাঁদকে কোলকাতার শাসনকার্যে নিয়োজিত করে সিরাজদ্দৌলা হলওয়েল ও তার তিনজন সাথীসহ মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তণ করেন। ২৬শে জুন অবশিষ্ট ইংরেজ সৈন্যগণ কোলকাতা থেকে ফলতা গমন করে।

৩০শে জুন সিরাজদ্দৌলা ফোর্ট সেন্টজর্জের গভর্ণর জর্জ পিগটকে পত্র লিখেন। তার মর্ম ছিল এই যে, ইংরেজগণ যদি একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় উপনীত হয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতালাভেল উচ্চাভিলাষ পরিত্যাগ করে ব্যবসার শর্তাবলী মেন চলতে থাকে, তাহলে তাদেরকে বাংলায় ব্যবসায় পূর্ণ ব্যবসার পূর্ণ সুযোগ দেয়া হবে।

ফলতার ইংরেজগণ
সিরাজদ্দৌলা আন্তরিকতার সাথে চেয়েছিলেন ইংরেজদের সংগে একটা ন্যায়সংগত মীমাংসায় উপনীত হতে। কিন্তু তাদের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ফলতার বসে স্থানীয় হিন্দু প্রধানদের সাথে যে ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করা হচ্ছিল তার থেকে তাদের মনোভাব ব্যক্ত হয়।

মাদ্রাজ থেকে যে সামরিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল, রজার ড্রেক তার প্রতীক্ষায় দিন গুণতে থাকে। এদিকে নবাবকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ৬ই জুলাই একটা মীমাংসার জন্যে তারা কথাবার্তা শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যে ছিলনা কোন আন্তরিকতা। মাদ্রাজ থেকে সামরিক সাহায্য এলেই তারা পুনরায় শক্তি পরীক্ষায় লেগে যাবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রধানগণ ও বণিকশ্রেণী সকল প্রকারে ইংরেজদেরকে উৎসাহিত করতে থাকে। বিশেষ করে খাজা ওয়াজেদের প্রধান সহকারী শিব বাবু নামক জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তি সর্বদা ইংরেজদেরকে একথা বলতে থাকে যে, নবাব সিরাজদ্দৌলা আর তাদেরকে কিছুতে ব্যবসায় সুযোগ সুবিধা দিবার পাত্র নন।

 কোলকাতায় পরাজয় বরণ করার পর কোন মীমাংসায় উপনীত হওয়া তাদের জন্যে কিছুতেই সম্মানজনক নয়। গোবিন্দরাম নামে অন্য একটি লোক সিরাজদ্দৌলার কোলকাতা অভিযানের সময় পথে বৃক্ষ উৎপাটন করে রেখে বাধার সৃষ্টি করেছিল। সে এখন ইংরেজদের পক্ষে গোপন তথ্য সরবরাহের কাজ শুরু করে। কোলকাতার শাসনভার যে মানিকচাঁদের উপর অর্পিত হয়েছিল, সে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফলতায় অবস্থিত ইংরেজদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করতে থাকে। সে নবারের কাছে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য পেশ করতে থাকে যে ইংরেজরা একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্যে লালায়িত। অল্প সৈন্য নিয়ে কিছু করা যাবেনা চিন্তা করে মেজর কিলপ্যাট্রিক আপাততঃ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে এবং মাদ্রাজ থেকে বৃহত্তর সামরিক সাহায্য ও নৌবহর তলব করে। ১৭৫৬ সালের ১৫ই আগষ্ট বিলপ্যাট্রিক নবাবকে জানায় যে, তারা তাঁর অনুগ্রহপ্রার্থী। অপরদিকে ইংরেজদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য মানিক চাঁদ, জগতশেঠ ও অন্যান্য হিন্দু প্রধানদেরকে অনুরোধ করে পত্র লিখে।

মানিক চাঁদের মিথ্যা আশ্বাসবাণীতে নবাব বিভ্রান্ত হন এবং বলেন যে, ইংরেজরা যুদ্ধ করতে না চাইলে তাদেরকে ব্যবসায় সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেয় হবে। নবাবের বলতে গেলে নৌশক্তি বলে কিছুই ছিলনা। বিদেশী বণিকদেরকে বাংলার ভূখন্ড থেকে বিতাড়িত করে দিলেও, সমুদ্র উপকূল থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করার ক্ষমতা নবাবের ছিলনা। ইংরেজগণ এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। দ্বিতীয়তঃ সিরাজদ্দৌলার সামনে নতুন এক বিপদ দেখা দেয়। পুর্নিয়ার শওকত জং মোগল সম্রাটের নিকট থেকে এক ফরমান লাভ করতে সমর্থ হয় –যার বলে তাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়। ইংরেজগণ শওকত জং-এর পক্ষ অবলম্বন করে তার বিজয়ের আশা পোষণ করছিল। কিন্তু ৬ই আগষ্টের যুদ্ধে শওকত জং নিহত হওয়ায় তাদের সে আশা আপাততঃ ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

আগষ্টের মাঝামাঝি ড্রেক এবং কিলপ্যাট্রিক কর্তৃক কোলকাতার পতন সম্পর্কে লিখিত পত্রের জবাবে যথেষ্ট পরিমাণে সামরিক সাহায্য ইংলন্ড থেকে মাদ্রাজ এসে পৌঁছে। সেপ্টেম্বরে কোম্পানীর দুটি জাহাজ চেষ্টারফিল্ড ও ওয়ালপোল মাদ্রাজ পৌঁছে যায়। অক্টোবরে ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল রবার্ট ক্লাইভ এবং এডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভিযান বাংলায় প্রেরণের সিদ্ধান্ত করে। বাংলায় পৌঁছাবার পরপরই প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু করার জন্যে কর্ণেল ক্লাইভকে নির্দেশ দেয়া হয়। ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ঢাকা, পুর্ণিয়া এবং কটকের ডিপুটি নবাবদেরকে ক্লাইভের সাথে সহযোগিতা করার অনুরোদ জানিয়ে পত্র দেয়া হয়। অপরদিকে ইংরেজদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে নবাবকেও পত্র দেয়া হয়। উক্ত কাউন্সলের গভর্ণর জর্জ পিগটের পত্রে বলা হয়ঃ আমি একজন শক্তিশালী সর্দার পাঠাচ্ছি যার নাম ক্লাইভ। সৈন্য ও পদাতিক বাহিনীসহ সে যাচ্ছে এবং আমার স্থলে শাসন চালাবে। আমাদের যে ক্ষতি করা হয়েছে তার সন্তোষজনক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আপনি নিশ্চয় জেনে থাকবেন যে, আমরা যুদ্ধে সর্বত্রই জয়ী হয়েছি। (হিলের ইতিহাস, ১ম খন্ড)

এ পত্রের মর্ম পরিস্কার যে, মীমাংসার আর কোন পথ রইলোনা। ১৫ই ডিসেম্বর ক্লাইভ ফলতায় পৌঁছে। মানিকচাঁদ কোম্পানীর প্রতি যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সাহায্য সহযোগিতা করে, তার জন্যে তাকে ধন্যবাদ জানি সেইদিনই ক্লাইভ তাকে পত্র লিখে। ক্লাইভের নিরাপদে পৌঁছার আনন্দ প্রকাশ করে মানিকচাঁদ পত্রের জবাব দান করে। সে আরও জানায় যে, সে কোম্পানীর যথাসাধ্য খেদমতে আত্মনিয়োগ করবে। উপরন্তু গোপন তথ্য আদান প্রদানের জন্যে সে রাধাকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তিকে ক্লাইভের নিকট প্রেরন করে। বাংলার বিরুদ্ধে বাংগালীর এর চেয়ে অধিকতর বিশ্বাসঘাতকতা আর কি হতে পারে?

No comments:

Post a Comment