Friday 23 June 2017

নবাব সিরাজ-উদ-দৌল­া প্রসঙ্গ ও পলাশী যুদ্ধের রক্তস্নাত ইতিহাস :



নবাব সিরাজ-উদ-দৌল­া প্রসঙ্গ ও পলাশী যুদ্ধের রক্তস্নাত ইতিহাস :

পলাশীর যুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলেই আমরা মীরজাফরের কথা বলি। কিন্তু নাম জানা-অজানা আরও কত যে মীরজাফর আছে তা একটু গবেষণার বিষয়, একটু সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবার বিষয়। বিহারের গভর্ণর যয়নুদ্দীনের পুত্র ছিলেন সিরাজ। নবাব আলীবর্দী খাঁর সুযোগ্য দৌহিত্র দেশপ্রেমিক সিরাজ যখন সিংহাসনে বসলেন তখন থেকেই তাকে উৎখাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন ইংরেজের পা চাঁটা গোলাম বাংলার নবাবেরা। হিন্দু রাজারা ইংরেজদেরকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, যেকোনভাবেই হোক নবাবকে সরিয়ে দিতে হবে। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর জন্য ইংরেজরা কলকাতার ঘাঁটি ফোট উইলিয়ম দূর্গ নির্মাণ করতে আরম্ভ করে। নবাবের কথা ইংরেজ বাবুরা তোয়াক্কা না করাতে নবাব বিদেশী ইংরেজকে আক্রমণ করেন এবং ভীষণভাবে পরাজিত করেন। এ যুদ্ধের সাথে জড়িত ‘Black Hole’ বা  অন্ধকূপের কাহিনী। সে কথায় পরে আসছি।

ইংরেজ বাহিনী কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার পর বাংলার স্বার্থান্বেষী বড় বড় ব্যবসায়ীরা (জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ) সিরাজের বিরুদ্ধে যোগ দেন। একেই বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। কুলাঙ্গার জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন সভা করা হয়। সেই সভায় স্ত্রী লোকের ছদ্মবেশে ইংরেজ দূত মি. ওয়াটসকে পাল্কিতে করে আনা হয়। সিরাজকে পরাজয়ের জন্য যত টাকা লাগবে তা দেওয়ার আশ্বাস দেন মি. ওয়াট্স। রাজা রাজবল্লভ সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমকে প্ররোচিত করেন ইংরেজকে সমর্থন করার জন্য। তাকে হাত করা গেলেও মীরজাফরকে হাত করা কষ্টকর হয়। তিনি প্রথমে বলেন, ‘আমি নবাব আলীবর্দীর শ্যালক, অতএব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা আমার আত্মীয়, কি করে তা সম্ভব?’ তখন উমিচাঁদ তাঁকে বোঝালেন, ‘আমরাতো আর সিরাজকে মেরে ফেলছি না অথবা আমরা নিজেরাও নবাব হচ্ছি না, শুধু নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে আপনাকে বসাতে চাইছি। কারণ আপনাকে শুধুমাত্র আমি নই; বরং ইংরেজরা এবং মুসলমানদের অনেকেই আর অমুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে’। উমিচাঁদের উষ্কানি যথেষ্ট কাজ দিল। মীর জাফর ইংরেজদের সাথে হাত মেলালেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ক্লাইভ মাত্র তিন হাজার দুই শত সেন্য নিয়ে যুদ্ধে নামেন। সেখানে সিরাজের সৈন্য পঞ্চাশ হাযার। যুদ্ধে সিরাজের জয় নিশ্চিত। কিন্তু মীর জাফর, রায় দুর্লভদের মত সেনাপতিরা যুদ্ধ না করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মীর মদন সিংহের মত যুদ্ধ করে নিহত হন। সিরাজ দিশেহারা হয়ে পড়লেন। মীর মদনের বীরত্বে মোহনলাল ও সিনফ্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মীরজাফর যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিলে যুদ্ধ অন্যদিকে মোড় নিল। এ সময় ক্লাইভ বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে বসল। নবাব বাহিনীর উপর বর্ষার মত গুলিবর্ষণ করতে লাগল। নবাব রাজমহলের দিকে যাওয়ার পথে ধরা পড়লেন। তাঁকে বন্দী করে নির্মমভাবে হত্যা করা হ’ল। বাংলার বিশ্বাসঘাতক সন্তানেরা বোঝেনি যে, এ পরাজয় শুধু বাংলার নয়, বরং সমগ্র ভারতের। আর ঐ জয় ইংরেজ ও ইংল্যান্ডের। ‘পলাশীর যুদ্ধ একটা যুদ্ধ নয়, যেন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ এমনটিই মন্তব্য  করেছেন শ্রী ঘোষ তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের ৫১৬ পৃষ্ঠায়।

এবার মিথ্যুক ইংরেজ অনুচর ‘অন্ধকূপ হত্যা’র কাহিনীর মূল নায়ক হলওয়েলের কথায় আসি, যিনি সিরাজের বিরুদ্ধে মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়েছিলেন। অনেক কাহিনী যে শুধু গাজাখুরে কাহিনী, তাঁর বাস্তব প্রমাণ হ’ল হলওয়েলের সৃষ্ট ‘অন্ধকূপ হত্যা’র কাহিনী। সিরাজবিদ্বেষী ইংরেজদের কল্পিত অন্ধকূপে প্রায় দুইশত জন লোকের বন্দীর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ভাবার বিষয় হ’ল সেই ঘরটির আয়তন ছিল মাত্র 18×14। এখানে জায়গা কম হওয়ার কারণে ১৪৬ জনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ধুরন্ধর প্রকৃতির ঐতিহাসিকরা পরে দেখলেন না যে, এত লোকের কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবেনা। তাই পরে ৬০ জনের কথা বলা হ’ল। এটাই হ’ল ইতিহাস। যেদিকে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে সেদিকে ভেসে যাচ্ছে ঐতিহাসিকের মূল্যবোধ। সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, বোধকরি, নষ্টদের হাতে গেছে অনেক আগ থেকেই, যার নমুনা আমরা ঐতিহাসিকদের থেকে পায়।

ঐতিহাসিকের বিষোদগার থেকে মুক্তি পাননি সিরাজ। শ্রী সুধীর কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সিরাজ অতিরিক্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি প্রায় নদীতে বন্যার সময় নৌকা হতে আরোহী উল্টিয়ে দিয়ে বা ডুবিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে এক দুই শত যুবক, যুবতী, স্ত্রী, বৃদ্ধ, শিশু, সাঁতার না জেনে জলে নিমজ্জিত হওয়ার নিষ্ঠুর দৃশ্যটি উপভোগ করে আনন্দ লাভ করতেন’। আর কত ছেলেভুলানো, মায়ে খেদানো ইতিহাস আমরা পড়ব! ইতিহাস বিকৃতির পথে আমরাই হতে পারি এক একজন আলোকবর্তিকা ও দিশারী। তাহ’লে অন্তত উদভ্রান্ত জাতি সত্য ইতিহাস খুঁজে পেতে পারবে। আল্লাহ আমাদের সেই অসাধ্য সাধনের তৌফিক দিন।              

গ্রন্থপঞ্জি :

১। চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা

২। ইতিহাসের ইতিহাস, ঐ।

৩। বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়, সুফিয়া আহমেদ।

৪। ওয়াহাবী আন্দোলন, আব্দুল মওদুদ।

৫। বাঙালি মুসলমানের মন, আহমদ ছফা।

৬। মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, মওলানা আকরম খাঁ।

৭। The Indian Musalmans, W.W. Hunter.

৮। উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা ও চেতনার ধারা, ওয়াকিল আহমদ।

৯।  নিবন্ধমালা, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র, (পঞ্চদশ খন্ড), ২০০৯।

১০। মৌলবাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, হায়দার আকবর খান রনো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩।

১১। রাজনীতিকোষ, হারুনুর রশীদ।

১২। বাংলাপিডিয়া।

[লেখক : এম.এ, ইংরেজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

- See more at: http://i-onlinemedia.net/4976#sthash.vRRcz8Pp.dpuf

No comments:

Post a Comment