পলাশী বিপর্যয়ের মূল কারণ ও ২৩ জুনের প্রেক্ষাপট
শনিবার ২৮ জুন ২০১৪ |
মো. জোবায়ের আলী জুয়েল : ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পূর্ববর্তী কয়েক দশকের ঘটনা প্রবাহ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অধিকার করে আছে। ইতিহাসের সাধারণ পাঠকদের কাছে একটা ধারণা, বরাবর বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রহীন ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং এই নিষ্ঠুর চরিত্রহীন সিরাজউদ্দৌলার লাম্পট্য-বিলাস ও বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের বেঈমানীর ফসলই হলো পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার মূল কারণ।
বাংলাদেশে এমনি একটা নিরেট মিথ্যা কথা গত কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। মীর জাফর অবশ্যই বিশ্বাসঘাতক ছিলেন, কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে তার চেয়ে বহুগুণ বড় ও সফল বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ধনকুবের জগৎশেঠ। মিথ্যা বার বার উচ্চারিত হলে সত্যের মতো শোনায়, অবশ্য পরে সত্যই জয়ী হয়। মীর জাফর, বিজাতি বিদেশী ইংরেজদেরকে কখনও আপন উদ্যোগে ডেকে আনেন নাই। সে কাজটি করেছিলেন জগৎশেঠ গোষ্ঠী ও তাদের সঙ্গী সাথীরা, তিনি ছিলেন শিখ-ি মাত্র।
সিরাজউদ্দৌলাকে সবাই নিষ্ঠুর ও চরিত্রহীন করেছেন? সব হিন্দু ঐতিহাসিকগণ এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন একটি দায়িত্ববোধহীন নিষ্ঠুর, দুশ্চরিত্র তরুণ। হিন্দুদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন তৎকালীন ঐতিহাসিক শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্র। তিনি সিরাজউদ্দৌলার প্রচলিত ধারার প্রতিবাদ করে সর্বপ্রথম বলেছেন, সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিন রাজত্ব করলেও দেশের শাসনকর্তা হিসাবে একাধারে তিনি ছিলেন ‘নিখাদ দেশপ্রেমিক’ অসম সাহসী যোদ্ধা, সকল বিপদে পরম ধৈর্য্যশীল, নিষ্ঠাবান, কঠোর নীতিবাদী, ধার্মিক, যে কোনো পরিণামের ঝুঁকি নিয়েও ওয়াদা রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। বাংলার নবাবের হিংহাসনে বসে তিনি কোন দিন মদ স্পর্শ করেনি।
কিন্তু তাঁর মন্ত্রীবর্গ, সেনাপতিমন্ডলী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দ সবাই ছিলেন তার বিরুদ্ধে ইংরেজের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যে অক্ষয় কুমার মৈত্র, সিরাজ সম্পর্কে এতো প্রশংসা করেছেন পরবর্তীতে তিনিও অনেকক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও সাহসী হতে পারেননি। তাকেও আর ৫জন স্বজাতি হিন্দু ঐতিহাসিকের মতই তথাকথিত গতিধারায় লিখতে হয়েছে। যিনি সিরাজের এতো প্রশংসা করেছেন, পরবর্তীতে তিনিও আবার তার চরিত্রে অপবাদ দিয়ে লিখেছেন-
‘প্রথম তারুণ্যে সিরাজ উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন এবং হিন্দু রাজা, মহারাজা ও কূলবালাদের উত্ত্যক্ত করতেন’। এব্যাপারে তিনি প্রচলিত গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শোনা একটা গল্প উল্লেখ করে বলেছেন,-
সুন্দরী তারা আজাম গঞ্জের (নাটোরের) রাণী ভবানীর কন্যা ছিলেন। লম্পট স্বভাব সিরাজউদ্দৌলা নৌকাযোগে একদিন ভাগিরথী নদীপথে ভ্রমণে যান। নৌকাযোগে নদীপথে যাবার সময় নাটোরের রাণী ভবানীর মুর্শিদাবাদস্থ ভাগীরথীর অপর তীরে বড় নগরের বাড়ির ছাদে তার সেই একমাত্র বিধবা কন্যা তারা আলুলায়িত কেশে দেখতে পেয়ে সিরাজ তাকে লোপাট করার চেষ্টা করেন। সিরাজের হাত হতে রক্ষা পাবার জন্য রাণী ভবানী তৎক্ষণাত ভাগীরথী তীরে কৌশল করে একটা বিরাট চিতা সাজিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে চারিদিকে প্রচার করেন যে, তার কন্যা হঠাৎ মারা গেছেন এবং তাকে সে চিতায় দাহ করা হয়েছে। এভাবে সিরাজকে প্রতারিত করে রাণী ভবানী সে যাত্রা রক্ষা পান। কি উদ্ভট গল্পের ফাঁদে এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার সৃষ্টি করা হয়েছে। সিরাজের মতো টগবগে দূরন্ত তরুণ নবাবের লালসাকে (তা’ যদি সত্য হতো) এভাবে বোকা বানিয়ে কি ঠেকানো সম্ভব ছিল। অবশ্য আমরা অনুমান করতে পারি, আসলে ‘অক্ষয় কুমার মৈত্র’ হিন্দু ঐতিহাসিকদের রোসানল থেকে নিজে পরিত্রাণ পাবার আশায় এবং তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসব আষাড়ে গল্প লিখতে হয়েছে।
এবারে একটু সিরাজের পলাশীর ইতিহাসের পেছনের দিকে যাওয়া যাক। ১৭২৭ইং সালে মুর্শীদকুলী খানের মৃত্যুর পর বাংলার বিত্তবান ও প্রভাবশালী একটি হিন্দু বণিক শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার দুর্বার আকাঙ্খা ও দেশীয় রাজা, মহারাজাদের সীমাহীন লোভ, লালসা ও হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসাবেই সিরাজের পতন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। সিরাজউদ্দৌলা বস্তুত এই সকল পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সিরাজের পতন ত্বরান্বিত কেন হলো? বলা যায় ব্যর্থতার কারণ নিহিত ছিল তার লোকজনের চারিত্রিক ত্রুটি, নবাবের নিজস্ব লোকজনের বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা। প্রভাবশালী বাঙালিদের স্বার্থপরতা।
সিরাজউদ্দৌলাকে নিষ্ঠুর প্রমাণ করার জন্য ইংরেজরা অন্ধকূপ হত্যার কথা উল্লেখ করেন। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল মাদ্রাজের ইংরেজ কুঠিকে উত্তেজিত করার জন্য ‘হলওয়েল’ বর্ণিত একটি কাল্পনিক অবাস্তব কাহিনী। তথাকথিত অন্ধকূপের স্বনামধন্য নায়ক ‘হলওয়েল’ ছিলেন এদেশের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মন্দ জ্ঞানের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কর্মচারী। ধুরন্ধর স্বার্থপর প্রকৃতির মানুষ। ক্লাইভের শূন্যস্থান দখলকারী এই হলওয়েল পরবর্তীতে ইংরেজ গভর্নর ভ্যান্সি চার্ট ও সেনাপতি কেলড়-এর মুর্শিদাবাদ আগমনের শুরুতেই তাদের সর্বদাই কুপরামর্শ দিয়ে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে মীর কাশিমের পক্ষাবলম্বন করে মীর জাফরকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে এমন কিছু অবাস্তব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অসত্য। সিরাজউদ্দৌলাকে ইতিহাসে নিষ্ঠুর প্রমাণ করার জন্য ‘হলওয়েল’ বর্ণিত সেই কাল্পনিক অবাস্তব কাহিনীটি এখানে তুলে ধরা হলো।
কলকাতা প্রথম যুদ্ধে বিজয়ী সিরাজউদ্দৌলা ১৩*১৪.১র্০র্ আয়তনের একটি জানালাবিহীন ছোট কামরায় ১৪৬ জন ইংরেজকে কারারুদ্ধ অবস্থায় কয়েদ করে রাখেন এবং সেই রাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাদের মধ্য থেকে ১২৩ জনের হৃদয়বিদারক মৃত্যু ঘটে। এতো ছোট জানালাহীন আয়তনের কামরায় ১৪৬ জন লোককে দূরমুজ মেরে ঠেসে গাদায় ভরে রাখলেও তা আটানো সম্ভব ছিল না। এরূপ বালকসুলভ বুদ্ধি ও ‘হলওয়েল’ নামক ইংরেজ তথা বৃটিশ বুদ্ধিজীবীগণের মগজে কেমন করে এই ভ্রান্ত ঘটনা ইতিহাসে ঠাঁই পেলো তা ভেবে আজও বিস্মিত হতে হয় আমাদের। সিরাজের জুলুমকে অকল্পনীয়ভাবে বড় করে দেখতে তারা এই ঘটনার অলীক জাল বিস্তার করেছেন। কিন্তু এই কাল্পনিক ঘটনাটি তারা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারেনি। থলের বিড়াল তাদের অবশ্যই বেরিয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে অন্ধকূপের কক্ষে ঠাঁই নিয়ে বেঁচে যাওয়া একজন সৈনিকের ডায়রী ও বক্তব্য থেকে প্রমাণ মিললো যে, প্রকৃতপক্ষে কামরাটির আয়তন ছিল ১৮ফুট*১৫ ফুট-১০ ইঞ্চি সাইজের। যুদ্ধ সমাপ্তির রজনীতে সুস্থ ও আহত মিলে মাত্র ৩৯ জন ইংরেজ গোরা সৈনিককে সেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কোন অবস্থাতেই কক্ষের দ্বার রুদ্ধ করা ছিল না। তবে সেখানে দক্ষ প্রহরী মোতায়েন করা হয়েছিল। চিকিৎসার অভাবে সে রাতে মাত্র ১৮ জন সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল।
নবাব সিরাজের চরিত্রের উপরে দোষারোপ করে তারা এরূপ অনেক মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কল্পকাহিনী তৈরি করেছেন। ফৈজু বালা’ নামক জনৈক বাঈজির মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাটিও তৎকালে এরূপ একটি সিরাজের চরিত্রের উপর কলঙ্ক লেপন করে ইংরেজদের বানানো মিথ্যা দুর্নাম রটনাপূর্বক গালগল্প। এখানে তাদের ভাষায় তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘সিরাজ এতবড় লম্পট ও জালিম ছিলেন যে, দিল্লী থেকে তৎকালীন ১ লাখ টাকা (বর্তমান মুদ্রা মান ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ফৈজু বালা না¤œী এক সুন্দরী বাঈজিকে মুর্শিদাবাদ এনে রক্ষিতা রাখেন। কিন্তু ফৈজু বালা সামান্য একজন সৈনিকের প্রতি প্রণয়াসক্ত হওয়ায় তাকে একটা ছোট ঘরে আটকে রেখে দরজা, জানালা ইটের দেয়াল গেঁথে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং প্রায় দীর্ঘ ১৮০ দিন পর ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে তার মৃত দেহের কঙ্কাল দেখে স্বয়ং নবাব সিরাজউদ্দৌলা উল্লাসে নৃত্য করতে থাকেন। কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখলেন না যে এ বানোয়াট গল্পটা কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য হবে।
তৎকালীন এদেশের কিছুসংখ্যক ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবী পলাশীর যুদ্ধের একশত বছর পর পলাশী যুদ্ধের কাল্পনিক ইতিহাস খাড়া করতে শুরু করলেন। সিরাজউদ্দৌলা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭৩৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিহারে।
সিরাজের পিতা পাটনার গভর্নর জয়নুদ্দীন এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলেই ১৭৫০ ইং সালে পাটনায় নিহত হন। তখন সিরাজের বয়স মাত্র ১৭ বছর। আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পূর্বে এই ১৭৫০ ইং সাল থেকেই ৬ বছর ধরে সে লক্ষ্যেই আলীবর্দী খাঁ তার আদরের নাতি সিরাজকে কোলের কাছে রেখে যুদ্ধ বিদ্যা, অশ্ব চালনা ও প্রশাসনিক কাজে তাকে প্রশিক্ষণ দান করেন। মৃত্যুর আগেই তিনি সিরাজকে মনসবদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। নাতী সিরাজউদ্দৌলা উচ্ছৃঙ্খল বিদ্রোহী হলে নানা তার প্রতি কোন সময় ¯েœহান্ধ হতেন না। নানা আলীবর্দী খানের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে রেখে নাতিকে গড়ে তুলে ১৯ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন পরিবারের আশৈশব পালিতা সুশিক্ষিতা পরমাসুন্দরী লুৎফুন্নেছার সাথে।
অত্যন্ত জাঁক-জমকপুর্ণভাবে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বিপুল উৎসব উদযাপন করে নাতীকে বিয়ে দেন। নবাব আলীবর্দীর জীবদ্দশায় সেই তরুণ এরূপ হৃদয়হীন, নোংরামী করার সুযোগ পেলেন কিভাবে? এটা অবশ্যই আমাদের সবারই অনুধাবন করতে হবে। নবাব সিরাজের মৃত্যুর পরে তার তরুণী বিধবা স্ত্রী চরিত্রহীন তরুণ মীরনের বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, সারা জীবন দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী ধরে তার প্রিয় স্বামীর কবরে “খোশবাগে” কুরআন শরীফ পড়ে পর্দার মধ্যে থেকে, অত্যন্ত শালীনতা বজায় রেখে, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন। কোন দুঃশ্চরিত্র, লম্পট স্বামীর অসতী স্ত্রী এমন করে কিনা তা’ আমাদের জানা নেই। আলীবর্দী খান বাংলার নবাব হন ১৭৪০ ইং সালে। তার কোন পুত্র সন্তান ছিলনা। তিন কন্যা-সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। পুত্র সন্তানহীন আলীবর্দীর বড় জামাতা নিঃসন্তান ঘষেটি বেগমের স্বামী ছিলেন ঢাকার গভর্নর নওয়াজেস আলী। মেঝো জামাতা শওকৎ জঙ্গের পিতা ছিলেন পূর্ণিয়ার গভর্নর সাইয়েদ আহম্মেদ ও ছোট জামাতা সিরাজের পিতা ছিলেন পাটনার গভর্নর জয়নুদ্দিন। আলীবর্দীর জীবদ্দশায় তাদের সবারই মৃত্যু ঘটে। সে কারণে তৎকালীন ষড়যন্ত্রকারী রাজা, মহারাজাদের মিলে যায় মোক্ষম সুযোগ।
এ সময়ই আলীবর্দীর মৃত্যুকালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সর্বত্রই চলেছিল রাজ্যে ঘোর অরাজকতা। ইংরেজদের সাথে এদেশের হিন্দু রাজা-মহারাজা, সেনাপতি, শেঠ, সামন্তদের সখ্যতা। চলেছিল বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র। সিরাজের নানা নবাব আলীবর্দী খাঁ ইন্তেকাল করেন ১৭৫৬ ইং সালের ১০ এপ্রিল আর পলাশী যুদ্ধে সিরাজ পরাভূত হন ১৭৫৭ ইং সালের ২৩ শে জুন তারিখে। সে হিসাবে তার নবাবী আমলের সর্বমোট আয়তন ছিল ১৪ মাস ১৪ দিন। এ সময়ের মধ্যে তাকে চতুর্দিকে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। আরাম, আয়েশ, আমোদ, প্রমোদ, লাম্পট্য লীলার জন্য একটি বিশেষ বয়স ও পরিমিত সময়ের প্রয়োজন হয়। আরো প্রয়োজন হয় একটা আয়েশী পরিবেশের। এর কোনোটি কি সে সময়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ছিল? আলীবর্দী খাঁ বাংলার নবাবের গদীতে যখন বসেন তখন তার বয়স ছিল ৬৬ বছর এবং সিরাজউদ্দৌলা তখন ৬/৭ বছরের শিশু। ৬৬ বছর বৃদ্ধের জন্য তখন হেরেমের বাঈজী ও বারবনিতার প্রয়োজন ছিল না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আলীবর্দী খাঁর জীবন চরিত্র ছিল ফুলের মতই পবিত্র। তার দাম্পত্য জীবন ছিল সামাজিকভাবে সুনিয়ন্ত্রিত। আলীবর্দী খার হেরেম ছিল তার পরিবার-পরিজন নিয়ে গঠিত অন্দর মহল। সেখানে বাঈজী বা বারবনিতা, হেরেম বালা ছিল না সুতরাং এ কথা অবলীলাক্রমে বলা যায় শৈশব ও কৈশরে লাম্পট্যের ট্রেনিং নেবার মত, রাজা-মহারাজাদের গড়ে দেয়া আর্য্য সুন্দরী বাঈজীদের নিয়ে গঠিত হেরেমের সংস্পর্শ স্বভাবতই পায়নি নবাব সিরাজউদ্দৌলা। যেমনটি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারী সূত্রে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর ও স¤্রাট শাহজাহান।
কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় আরোহণ করেই এই ১৪ মাস ১৪ দিনের
মধ্যে পূর্ণিয়া থেকে কোলকাতা হয়ে পলাশীর প্রান্তর পর্যন্ত কমপক্ষে ১২০০ মাইল দূর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে। পাঁচ, পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে। চতুর্দিকে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুতগতিতে পথ চলতে হয়েছে। দিন কাটাতে হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে, অশ্বপৃষ্ঠে, রাত কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে। নানাজীর উদ্যোগে সেই অল্প বয়সে বিবাহিত সিরাজের তখন আপন স্ত্রী লুৎফা, শিশু কন্যা জোহরার প্রতি ফিরে তাকাবারও তো তার কোন ফুরসৎ ছিল না। নাটকে আলেয়া না¤িœ আর্য্য সুন্দরীদের মোহাবিষ্ট জালে রূপাকৃষ্ট পতঙ্গের মত লাম্পট্য লীলায় সময় কাটাবার মত অবসর তিনি পেলেন কোথায়? এগুলো আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে আজ অবশ্যই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। স্বর্ণের অগ্নি-পরীক্ষায় তো ভীতির কারণ থাকতে পারে না? রাং, শিশা, দস্তা এতে ভয় পেতে পারে। সুতরাং নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সেকালে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই তার সম্বন্ধে আমাদের চুল চেরা বিচার বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের পঙ্কিল আবর্জনা থেকে হারিয়া যাওয়া সত্যকে সন্ধান করে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। সর্Ÿাগ্রে দেশের তরুণ প্রজন্ম ও বুদ্ধিজীবীগণকেই এই ইতিহাসের রহস্য উন্মোচন করার গুরু দায়িত্বকে কাঁধে নিতে হবে।
এবারে পলাশীর দুইশত বছরের পিছনের দিকে ফিরে দেখা যাক। মোগল স¤্রাট বাবর ও তার আমীর ওমরাহদের কোন লাম্পট্য লীলার হেরেম খানা ছিল না। হুমায়ুন ইরান থেকে হেরেম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে আসেন। ১৩ বছরের কিশোর আকবর ও সিংহাসনে আরোহণ করে পিতার পথ অনুসরণ করেন ও প্রবলভাবে সূরা ও হেরেমের সুন্দরী নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। স¤্রাটের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দিল্লীতে গড়ে উঠে বিশাল হেরেম খানা, একে একে রাজা, মহারাজারা অনেকেই তরুণ স¤্রাট আকবরের হাতে ভগ্নী ও কন্যা সম্প্রদান করেন। গড়ে তোলেন দিল্লীর বাদশাহ আকবরের সাথে নিকট সম্পর্ক। মুসলমান প-িত ফৈজী, আবুল ফজল প্রমুখ আমীর ওমরাহের প্রতিপক্ষে বীরবল, টোডরমল প্রমুখ হিন্দু সভাসদবর্গও আসন গ্রহণ করেন। শাহী দরবারে শুরু হয় কূটনীতির লড়াই। আকবরের আমল থেকে রাজপুত্র-রাজা মহারাজার এই নিকট আত্মীয়ের দাবিতে মোগল শাহীর অন্দর মহল ও দরবার দখল এবং সেনাবাহিনী করায়ত্ত করার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মোগলাই মুসলমানদের ঘরে ঘরে চলে বিলাস ব্যাভিচার সন্বিতহারা মুসলিম নামধারী লাম্পট্যরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও আত্মঘাতি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনে।
মানসিংহের পিতামহ জয়পুরের রাজা বিহারীমলের ছোটবোন জয়পুরী বেগমকে বিয়ে দেন ১৯ বছরের তরুণ স¤্রাট আকবরের সাথে। বিনিময়ে পিতা, পুত্র, পৌত্র তিনজনই আকবরের সেনাপতি পদে যোগদান করেন। বিকানীর ও জয়সল মীরের রাজারাও আকবরকে কন্যা সম্প্রদান করে তার পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করেন। মানসিংহের বোন রেবা রাণীকে বিয়ে দেন আকবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভাবি দিল্লীর স¤্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে, এবং তার নিজ কন্যাকে বিয়ে দেন স¤্রাট জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠপুত্র ভাবি স¤্রাট খসরুর সাথে। অতঃপর নিকট আত্মীয়ের দাবিতে মোগল বাহিনী প্রায় সবগুলি গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতির পদ দখল করেন কুলীন হিন্দু রাজা মহারাজারা।
ইরানী মুসলিম বণিকের হাতে লালিত ও মোগল বাহিনীতে বেড়ে উঠা দাক্ষিণাত্যের এককালের ব্রাহ্মণ সন্তান মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলায় প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা শুরু করেন (১৭১৭ ইং ১৭২৭ ইং পর্যন্ত)। মুর্শীদকুলী খাঁর সময় থেকে বাংলার সামরিক ব্যবস্থা ও পূর্ণ বিন্যস্ত হয়ে জমিদার নির্ভর হয়ে পড়ে। প্রভাবশালী বড় জমিদারদের অনেককে ৩, ৫ অথবা ৭ হাজারী মনসবদারী অর্থাৎ নিজস্ব সৈন্য রাখার অনুমতি দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে নবাবকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকে তারা জমিদারী রাজস্বের একটি বিশেষ অংশ দিয়ে নিজেদের অধিনে ৩, ৫ অথবা ৭ হাজার সৈন্যের সেনাবাহিনী রাখার অধিকার লাভ করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে এসব পরনির্ভরশীল সেনাবাহিনী যে নবাবের দিকেই সুযোগ বুঝে কামানের মুখ ঘুরিয়ে ধরতে পারে সে কথা সরল বিশ্বাসী নবাবরা হয়তো ঘুর্ণাক্ষরে ভেবে দেখেননি কোনদিন। পলাশীর মাঠে এ ধরনের সব মনসবদারী বিপদগামী সৈন্যরাই নবাবের দরবারে উপস্থিত ছিলেন। যারা তাদের বিশ্বাসঘাতক প্রভূদের ইঙ্গিতে পলাশির যুদ্ধে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ইংরেজ শত্রুর বিরুদ্ধে একটাও কামানের গোলা নিক্ষেপ করে নাই। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট পরাজিত হবার যে কয়টি কারণ নিহিত রয়েছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ বলে আমি মনে করি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আলী বর্দী খাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই (১৭৫৬ ইং সালের ১০ এপ্রিল তার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় রাজা-মহারাজা ও হিন্দু আমাত্যরা মেতে উঠলেন সর্বমুখী ষড়যন্ত্রে। ধনকুবের জগৎশেঠ, ধনকুবের ভিখন লাল পা-ে, দীওয়ান রামজীবন, ধনকুবের উমি চাঁদ, নদীয়ার রাজা মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্র, জমিদার কান্ত মুদী, মহার নন্দ কুমার প্রমুখ যারা সেখানে ছিলেন অংশ নিলেন ষড়যন্ত্রে। নবাবীর লোভ দেখিয়ে সামনে দাঁড় করালেন আলীবর্দী খাঁর বৈমাত্র ভগ্নিপতি বৃদ্ধ অপদার্থ মীর জাফরকে।
নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলেই তার শাসন কালেই ভূপৎ রায়, দর্পনারায়ণ, রঘুনন্দন, কিঙ্কর রায়, আলম চাঁদ, লাহেরী মল, দিলপৎ সিং প্রমুখ হিন্দু দেওয়ানী ও শাসন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন। মোটকথা মুর্শিদকুলী খাঁর উদার নীতির ফলেই এসব হিন্দু রাজামহারাজ বাংলার বুকে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। মুর্শিদকুলী খাঁর জামাতা ও উত্তরাধিকারী নবাব সুজাউদ্দিনের আমলেও আলম চাঁদ, জগৎশেঠ, যশোবন্ত রায় রাজবল্লভ, নন্দলাল এবং আরও অনেক হিন্দু রাজ কর্মচারী দায়িত্বপূর্ণ রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন জগৎশেঠ ও আরম চনদ্র মুর্শিদকুলী খাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খাঁর বিরুদ্ধে তার বিহারের গভর্নরকে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে বিদ্রোহ ঘটান এবং এই বিদ্রোহী আলীবর্দীর হাতেই ১৭৪০ ইং সালে সরফরাজ খাঁ পরাজিত ও নিহত হন। রাজা-মহারাজার সমর্থনে আলীবর্দী খাঁ বাংলার নবাব হন ১৭৪০ ইং সালে। ফলে স্বভাবতঃই নবাব আলীবর্দীর সময়ে রাজপদে হিন্দুদের আরও উন্নতি হয়। এই সময় চিনুরায়, বীরু দত্ত, কীরাত চাঁদ, উমেদ রায় যথাক্রমে খালাসা বিভাগের দীউয়ান ছিলেন। জানকী রাম ও রামনারায়ণ বিহারের দীউয়ান ও নায়েব সুবেদারের আসন লাভ করেছিলেন। রায়দুর্লভ উড়িষ্যার নায়েব সুবেদার এবং রাজা রাজবল্লভ জাহাঙ্গীর নগরের (ঢাকা) দেওয়ান নিযুক্ত হন। রাম রাম সিংহ গুপ্ত পুলিশ বিভাগের প্রধান ও শ্যামসুন্দর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন। সিরাজদ্দৌলা তাদের মাতামহের নীতি অনুসরণ করে মোহল লালকে প্রধানমন্ত্রী ও রাজা জানকী রামকে তার দীউয়ানের পদে নিযুক্ত করেন। রায় দুর্লভ, রাম নারায়ণ ও রাজা রাজ বল্লভও তার দরবারে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা মানিক চাঁদ ও মহারাজ নন্দ কুমারকে যথাক্রমে কোলকাতার ও হুগলীর ফৌজদার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার আমলে এরা সবাই তাদের স্ব স্ব আসনে বহাল ছিলেন। উপরšুÍ নবাবের দরবারে উপ-প্রধান সেনাপতি ছিলেন মহারাজা রায় দূর্লভ। পরবর্তীতে তারা সবাই পলাশীর যুদ্ধে বৃদ্ধ অথর্ব লোভী মীরজাফরকে বেঈমানীর বেদীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর নবাবের গদিতে বসে মীরজাফর। তারপর বাংলাদেশকে শোষণ করা হম্ব চাম্বিদিক থেকে অভাবনীয়ভাবে। দেশীয় রাজা-মহারাজা ও বৃটিশ বেনিয়াদের সহযোগিতায় সোনার বাংলায় চলে লুণ্ঠন ও রাহাজানি। মীরজাফর, জগৎশেঠ ও রাজবল্লভের প্রাপ্তির হিসাবটাই বড় হয়ে উঠে। দেশ ও জাতির অকল্পনীয় ক্ষতির দুয়ার এরাই খুলে দেন এবং ইতিহাসের কদাকার আবর্জনায় এরা নিক্ষিপ্ত হয়।
নবাবের উদার ছত্রছায়ায় সুদের ব্যবসায় অর্থলগ্নি করে এই স্বরূপ চাঁদ, জগৎশেঠ হয়েছিলেন ধনকুবের। নবাবের দরবারে সর্বগ্রাসী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই মহারাজা স্বরূপচাঁদ, জগৎশেঠ। পাঁচ পুরুষ ধরে নবাবদের দরবারে সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা এবং নিজেদের ক্রমবর্ধিষ্ণু বিশ্বাস ঘাতকতায় চক্র বৃদ্ধি হারে বেড়ে অপরিমেয় বিত্তের অধিকারী জগৎশেঠই ইংরেজকে বাংলার শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠার কাজে তৎকালীন সর্বঅধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সে সময়ে জগৎশেঠ পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ৪০ লাখ টাকা যা কিনা বর্তমানে বাংলাদেশের মুদ্রামানে ৮০০শত কোটি টাকারও বেশি। মুর্শিদাবাদের টাকশাল ছিল জগৎশেঠের একক এখতিয়ারভুক্ত। মুর্শিদাবাদ নবাবের দরবারে বেসরকারি ব্যক্তিত্ব হয়েও বিপুল ক্ষমতার অধিকারী চিলেন এই স্বরূপ চাঁদ, জগৎশেঠ। ১৭২৭ ইং সালে মুর্শিদকুলী খাঁর সাথে প্রথম বিশ্বাস ঘাতকতার আমল থেকে আলীবর্দী খাঁর পার্শ্বে অবস্থান করে পরবর্তীতে একে একে সিরাজের খালা ঘষেটি বেগম ঢাকার দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ, বিহারের গভর্নর জানকী রায়, পরবর্তী গভর্নর রামনারায়ণ, নবাবের দেওয়ান চিনু রায়, বীরুদত্ত, রায়ান কীরাত চাঁদ। সেনাবাহিনী প্রধান রায়দুর্লভ রাম, মানিক চাঁদ, হুগলীর দেওয়ান মহারাজ নন্দ কুমার প্রভৃতি আমাত্যের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। আমৃত্যু পর্যন্ত এই মাড়োয়ারী স্বরূপ চাঁদ, জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে প্রচ- প্রতাপে কলকাঠি ঘুরিয়েছেন, সকল কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করেছেন দক্ষতার সাথে। মুর্শিদকুলী খাঁর আমল থেকে গড়ে উঠা নব্য হিন্দু বণিক শ্রেণীকে ও বিদেশী বণিকদেরকে পুঁজি সরবরাহ করে সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের একক করায়ত্ত চলে আসে তার হাতে। এই সুবাদেই নবাবের দরবারে ডজন খানেক মন্ত্রী, বা প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন এইস্বরূপ চাঁদ, জগৎশেঠ।
আলীবর্দী খাঁর মৃত্যু হলে স্বরূপ চাঁদ জগৎশেঠ ও তার ভাই মাহতাব চাঁদ জগৎশেট দেখতে পান, যে, তরুণ, তেজী ও সুশিক্ষিত ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে তাদের অবাধ অধিকার খর্ব হবে। তাই কৌশলে এই স্বরুপ চাঁদ, জগৎশেঠ ও তার সঙ্গীরা এই মমেৃ রাজধানী মুর্শিদাবাদে ব্যাপকভাবে গুজব ও ভীতি ছড়িয়ে দেন যে, আহমদ শাহ আবদালী উত্তর ভারত জয় করে দিল্লী দখল করেই বিহার সীমান্ত আক্রমণ করবেন। তৎকালীন আবদালী ভীতি এত প্রকট আকার ধারণ করে যে, পলাশী যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালেই সিরাজউদ্দৌলা তার গঠিত সুসজ্জিত শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী নিয়ে বিহারের পশ্চিম সীমান্তে বিরাট সৈন্য বাহিনী সামবেশ করে এতে স্বভাবতই” নবাবের সৈন্য বাহিনী সম্পূর্ণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবাবকে মহারাজা, মনসবদার, জমিদারদের সরবরহকৃত সৈন্যদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। অন্যদিকে মুঘল মুসলমান প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ঘুষ বণ্টন করে স্বরূপ চাঁদ, জগৎশেঠ গোষ্ঠী নবাবের সৈন্যদের মধ্যে প্রবল বিভ্রান্তি ও বিভেদ সৃষ্টি করেন এবং কৌশলে সিরাজউদ্দৌলার আস্থাভাজন থেকে পলাশীর মাঠে তার সাথে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে যাত্রা করেন। উপ-প্রধান সেনাপতি রাজা রায় দুর্লভ ও তার সঙ্গী সাথীরাও এই ষড়যনেত্রর নাট্য খেলায় যুদ্ধক্ষেত্রে সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেন অর্থের বিনিময়ে এই স্বরূপ চাঁদ, জগৎশেঠ। দেশব্যাপী ষড়যন্ত্রে দিশেহারা হয়ে অসহায় নবাব জেনে-শুনেই তার অবিশ্বস্ত মনসবদারী সেনবাহিনী নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য উপস্থিত হন পলাশীর আ¤্রকাননে। পরিণতি যা হবার তাই হলো। সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হলেন ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো এই এক ঘণ্টার প্রহসন যুদ্ধে। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা।
উপসংহারে আমরা বলতে পারি আলী বর্দীখান কর্তৃক সিংহাসন লাভ এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে বিরোধিতা ও শত্রুতা লাভের ক্ষেত্রে সিরাজের নিজস্ব অবস্থান ও ভূমিকার কোন দোষই ছিল না। সিংহাসন লাভের অব্যাবহিত পর থেকেই নবাব সাহসিকতার সঙ্গে ঘষেটি বেগম ও শওকত জং-এর ব্যাপারে সটিক সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন নাই। দেশ ও সমাজের স্বকীয়তা রক্ষা করতে হলে, অবশ্যই আমাদের ১৭৫৭ ইং সালের পলাশীর যুদ্ধের বিপর্যের ন্যক্কারজনক ঘটনা ও ভয়াবহ দুর্যোগের কারণ এবং তার পরিণতির কথা সর্বদাই মনে রাখতে হবে। এসব আলোচনার মাধ্যমে একথাই অবলীলাক্রমে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইংরেজদের পালিত, অনুগ্রহপুষ্ট ও অনুসারী ঐতিহাসিকদের লেখায় নবাব সিরাজের চরিত্রের উপর যতই দোষারোপ ও কলঙ্ক লেপন করা হোক না কেন প্রকৃতপক্ষে এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। তার রাজত্বকালের স্বল্প সময়ে তিনি কখনই হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর ও চরিত্রহীন নবাব ছিলেন না।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার বিশ্লেষণ করলে একথাই প্রমাণিত হয় যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন একজন মহান দেশপ্রেমিক, সাহসী যোদ্ধা, রাজনৈতিক চরিত্রে অত্যন্ত সাহসী ও সূক্ষ্ম কূটনীতিবিদ এবং ব্যক্তিগত চরিত্রে সহজ, সরল ও বলিষ্ঠ নবাব। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা যদিও সাফল্য লাভ করেন নাই কিন্তু তিনি স্বদেশকে তুলে দেন নাই বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদের হাতে। একজন বিদেশী ঐতিহাসিকের ভাষায়Ñ “দেশই বরঞ্চ তাকে তার মাটির কোলের সাথে আবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি কখনও তার দেশের প্রজাতের সাথে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করেন নাই। কখনও স্বইচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেন নাই। পলাশী প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে এক মাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক।” সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।
প্রভাবশালী বাঙালীদের স্বার্থপরতা ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ। বাংলায় দক্ষিণ এশিয়ার বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠার দুর্বার আকাক্সক্ষা প্রশাসনিক কাজে নবাবের দরবারে সে সময়ে হিন্দু আধিপত্যের বিস্তার লাভ। নবাব পরিবারের কিছু কিছু ঘোর শত্রু বিভীষণের ক্ষমতার লোভ এবং মুর্শিদকুলী খাঁর এই উদার দাক্ষিণ্যে বেড়ে উঠা কুলিন হিন্দুরাজা, মহারাজা, সভাসদ সামরিক প্রশাসক রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের মুসলিম বিদ্বেষই পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতন, পরাজিত এবং নিহত হওয়ার অন্যতম মূল কারণ।
তথ্য সূত্র :
১. সিরাজ-উদ্-দৌলা : মৃণাল চক্রবর্তী।
২. মুসলিম আমলে বাংলার শাসন কর্তা : আসকার ইবনে শাইখ
৩. সিরাজউদ্দৌলা : অক্ষয় কুমার মৈত্রয়, প্রকাশ কাল ১৩০৪ বঙ্গাব্দ, কলকাতা
৪. হিস্ট্রি অব দি মুসলিম অব বেঙ্গল : ড. মোহর আলী
৫. নওয়াব, কোম্পানি ও পলাশীর যুদ্ধ : ড. কেএম মহসিন
৬. পলাশ কার চক্রান্ত : সুশীল চক্রবর্তী
লেখক : গবেষক, সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ।
http://www.dailysangram.com/post/150155-পলাশী-বিপর্যয়ের-মূল-কারণ-ও--২৩-জুনের-প্রেক্ষাপট
No comments:
Post a Comment