Thursday 22 June 2017

পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজ শাসন

8dc6a-600x4001474395651_1466742991466

পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজ শাসন
সৈয়দ আছলাম হোসেন
পৃথিবীতে অনেক মানুষ ক্ষমতা হারানোর সাথে সাথে জীবনকেও হারাতে হয়েছে। এমনই একজন ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তিনি নবাব হয়েও আপন মানুষের হিংসাত্বক মনোভাবের ফলে ক্ষমতা নিজের জীবন এমনকি সমস্ত রাজ্য ইংরেজদের দখলে চলে গেল। এই করুণ ইতিহাস বাঙালিদের জীবনের এক মর্মান্তিক ঘটনা।
বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে বাংলার মাটিতে ইংরেজদের আগমন ঘটে। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসলেও ক্রমশ তারা স্থানীয় রাজনীতি ও শাসন কাজে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। ইংরেজরা বিভিন্ন ছলে, বলে, কলে, কৌশলে বাংলার ক্ষমতা তাদের হাতে নেয়ার চেষ্টা করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলায় ইংরেজ শাসনের সুচনা হয়। এর ফলে বাংলা রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারায়। এই শাসন বাংলার সমাজ সংস্কৃতিতে ও ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রায় দু’শো বছর বাংলার মাটিতে ইংরেজরা তাদের শাসন ব্যবস্থা বলবৎ রাখে।
নবাব আলীবর্দী খাঁর দৌহিত্র ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২২ বছর বয়সে বাংলার নবাব হন। এই তরুণ রাজনীতিবীদ রাজনীতির দাবা খেলায় টিকে থাকতে পারেন নি। সিংহাসনের আরোহন করেই তরুণ নবাবকে নানা ষড়যন্ত্র ও বিরোধী শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। তিনি দেশ শাসন করতে গিয়ে বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্রের মধ্যে একদিকে ছিল ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান শক্তি, অন্যদিকে বড় খালা ঘসেটি বেগম, সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের মতো ঘনিষ্টজনদের সাথে পাল্লা দিয়ে রাজ্য শাসন করা। তার সাথে যুক্ত ছিল রায় দুর্লভ এবং জগৎ শেঠের মতো প্রভাবশালী বনিকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। এই সময় ইংরেজরা যে বাণিজ্য করতো তাদের বাণিজ্যিক সংস্থার নাম ছিল ‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।’ ইংরেজরা বাঙালিদের উপর অন্যায়, অত্যাচার করতো। এরকম বিভিন্ন কারণে ই ংরেজদের সাথে নবাবের বিরোধ দেখা দেয়।
ইংরেজদের সাহায্যের হাত বাড়ায় নবাবের এর বিরোধী শক্তিগুলো। সবাই মিলে নবাবকে উৎখাতের চেষ্টা করতে থাকে। এসবের জের ধরে শেষ পর্যন্ত ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন ইংরেজ শক্তির সাথে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যদের পলাশীর আ¤্রকাননে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নবাবের পক্ষের সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। পরে তাকে হত্যা করা হয়। এ পরাজয় এর মধ্য দিয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পতন হয় ও বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় আমরা প্রায় দু’শো বছর পরাধীন ছিলাম। তখনকার সময় ইংরেজদের শাসন কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় যারা তাদের কথামত দেশ চালাবে এরকম লোক দিয়ে শাসন কাজ চালায়। তারা প্রথমে মীর জাফর ও পরে মীর কাশিমকে সিংহাসনে বসায়। কাশেম ছিলেন কিছুটা স্বাধীনচেতা। ফলে ইংরেজদের সাথে দু’বার যুদ্ধ হয়।
১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। এরপর থেকে ইংরেজরা পুরোপুরি ক্ষমতা দখল শুরু করে। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত একশত বছর এদেশে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলে, যা ইতিহাসে কোম্পানির শাসন নামে পরিচিত। এই কোম্পানির প্রথম শাসনকর্তা ছিলেন ‘লর্ড ক্লাইভ’। প্রায় একশত বছর পরে ১৮৫৭ সালে কোম্পানির নীতি ও শোষণের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রুহ দেখা দেয়। ইংরেজরা এই বিদ্রোহ দমন করলেও শাসন ব্যবস্থা আর আগের মতো চলতে পারে নি। কোম্পানির শাসন রদ করে ১৮৫৭ সালে বাংলাসহ ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ সরকার সরাসরি নিজ হাতে তুলে নেয়। যা চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। ‘ভাগ কর শাসন কর’ এ নীতি ছিল ইংরেজদের শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা এদেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, অঞ্চল ভেদে যেসব পার্থক্য ছিল তার ভিত্তিতে বিভেদ সৃষ্টি করত এবং তারা একজনকে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করত। তাদের শাসনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শোষণ ও নিজেদের লাভ।
প্রায় দু’শো বছরের এই শাসনকালে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ এদেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। বাংলার অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষি ও এক কালের তাত শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলার শিল্প, বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসংখ্য কারিগর বেকার হয়ে যায়। কোম্পানি শাসনের সময়ে ১৭৭০ (বাংলা ১১৭৬) সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যা ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মম্বন্তর’ নামে পরিচিত। ইংরেজ শাসনকে বাংলার মানুষ কিন্তু বিনা প্রতিরোধ মেনে নেয় নি।
আটারো শতকের শেষ ভাগ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলায়, একাধিক প্রতিরোধ আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যের রয়েছে ‘ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’, ‘তিতুমীরের বিদ্রোহ’, ‘ফরায়েজী আন্দোলন’, ‘সাওতাল বিদ্রোহ’ ইত্যাদি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহী ছিল প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই বিদ্রোহের মুল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা।
আধুনিক শিক্ষা ও গণজাগরণের ফলে উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে জাতীয়বাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। এরই ফলে এক সময় ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালে তৎকালীন বাংলা প্রদেশকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পুর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে বাংলায়। ফলে ইংরেজরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।
এই পটভূমিতে মুসলমান সমাজের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে ১৯০৬ সালে ঢাকায় ভারতীয় মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নেয়ার কারণে ক্ষদিরাম ও মাস্টারদাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। আর সফল অভিযান শেষে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়া এড়ানোর জন্য প্রীতিলতা স্বেচ্ছায় আত্বহুতি দিয়েছিলেন। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে একাধিক উল্লেখযোগ্য বাঙালি নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, শের-ই বাংলা একে ফজলুল হক প্রমুখ। এসব বহুমুখি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা এক সময় এদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। এ সময় বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীর মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার চেতনা আরোও বেগবান হয়। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ সময় নারী শিক্ষা বিস্তারে নিরলস পরিশ্রম করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়, ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
একটি পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ সে সময় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইংরেজ শাসন শেষ হলেও বাঙালিদের কপালের দুঃখ চিরতরে লাঘব হয় নি। পাকিস্তান এর দু’টি অংশ থেকে আমরা স্বাধীন হতে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে লক্ষ লক্ষ শহীদের জীবন দানের বিনিময়ে ১৭৫৭ সালে যে স্বাধীনতার সূর্য বাংলার আকাশে অস্তমিত হয়েছিল সেই সূর্য আবার স্বাধীন বাংলার আকাশ জুড়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর উদিত হল। ঘরের ভিতর শত্রু হলে বাহিরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব, একথা প্রমাণ হয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীতে আ¤্র কাননে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মীর জাফরসহ অনেকে মাতৃভূমির সাথে প্রতারণা করার কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পতন হয়। তাই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস বড়ই মর্মান্তিক বড়ই করুণ। এত ত্যাগ তিতিক্ষার পর অর্জিত এই স্বাধীন বাংলার পুর্ণভূমিকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। আমরা যাত ভুল করে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য বিপদ ডেকে এনেছি, এখন আমরা নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্ধেষ ভুলে সবাই আসুন হাতে হাত মিলিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাই। একদিন এই বাংলাদেশকে পৃথিবীর প্রথম সারির রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব হবে।
http://sylheterdak.com.bd/details.php?id=2187

No comments:

Post a Comment