Tuesday 13 June 2017

রবীন্দ্র সমালোচনা- অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কেন রবীন্দ্রনাথকে বড় মানুষ ভাবতেন না?


রবীন্দ্র সমালোচনা- অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কেন রবীন্দ্রনাথকে বড় মানুষ ভাবতেন না?
 সজল আহমেদ:

বাংলা সাহিত্যে পদার্পণ মানে আপনি ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে ফেলেছেন। বঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য পাঠ মানে-লবনহীন তরকারী। কোন এক অদৃশ্য হাত বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ পাঠ বাধ্যগত করেছেন। সেই ছোটবেলায় শুরু জাতীয় সংগীত "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" থেকেই আপনার আমার রবীন্দ্রনাথ পাঠ শুরু হয়েছে। এরপর "ব্যক্তিস্বাধীনতা" বোধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ইচ্ছা হোক আর অনিচ্ছা হোক রবীন্দ্রপাঠ বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক শ্রেণীর পাঠ্য বইতে রবীন্দ্রনাথ থাকবেই। সরকার পাল্টালে শ্রেণী বিশেষ প্রবন্ধ-কবিতা পাল্টে যায়, কোন কোন পূর্ববঙ্গের লেখকও হয়তো পাতা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

রাজনৈতিক দাঁড়িপাল্লায় এক সময় অদৃশ্য হয়ে যাবে আল-মাহমুদ ও সোনার নোলক। ইতোমধ্যে ফররুখ আহমেদকে খুঁজে পাচ্ছিনে পাঠ্য বইতে। কিন্তু পাঠ্যবইতে রবীন্দ্রনাথ থেকেই যাবে, থাকতেই হবে থাকা চাই-ই চাই। মাদ্রাসা শিক্ষাতেও রবীন্দ্রনাথ স্থান পেয়েছে শুনেছি। শুনে ভালোই লেগেছে। মাদ্রাসা ছাত্ররা স্যেকুলার হবে, মাদ্রাসা ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথ জানবে রবীন্দ্রনাথ পড়বে। রবীন্দ্রনাথ থাকবে তাদের কল্পনায় মহাপুরুষ হিসাবে। যদিও রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের জমিদার এবং তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটে পূর্ববঙ্গে থাকা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের প্রজাদের ছেলেমেয়ের জন্য কোন পাঠশালা, মক্তব বা অন্যকোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েননি বা তাতে সাহায্যও করেননি। তবুও রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবতেই কী ভালো লাগে! কেন রবীন্দ্রনাথকে বাধ্যতামূলক করা হল? এ প্রশ্নের জবাবে রবীন্দ্র ভক্তদের কাছ থেকে আমি যে জবাব পেয়েছি তা উদ্বৃত করলাম-
"রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) থাকবেই বা না কেন! এক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে যেভাবেই হোক তিনি বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি সারাটা জীবন দিয়েই গেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে বাঙ্গালীদের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৮টি নাটিকা, ৩৬টি প্রবন্ধ, ৯৫টি ছোটগল্প, ১৯১৫টি গান ও ২০০০টি ছবি উপহার দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যের গুণগত মান নিয়ে কে আছে প্রশ্ন তোলার? এখনো কি জন্ম হয়েছে সে ধূর্যটির?"।

হ্যাঁ বন্ধুটির দাবী একেবারে অমূলক নয়। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ নয়। কবি হিসাবে তিনি খুবই পরিশ্রমী ছিলেন, কারণ সাহিত্য করতে তিনি তাঁর জীবনে প্রচুর সময় পেয়েছেন যা অন্যরা খুবই কম পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যের জগতে। পারিবারিক সূত্রে জমিদার হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ধনসম্পদের কোন পিছুটান ছিলোনা। তাই সাহিত্যের পিছনে তিনি তাঁর সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন। কিংবা তাঁর লেখার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো কোন ধূর্যটি অবশিষ্ট নেই। থাকলেও তাঁরা চাপা পড়ে আছেন বা তাদের চাপা দেয়া হয়েছে। একথা সর্বমহলে সর্বজনবিদিত যে রবীন্দ্রনাথের লেখার কদর তাঁর নোবেল প্রাপ্তির পরে হয়েছে। এর আগে তাঁর কোন গ্রন্থ ফ্লপ হওয়ার ভয়ে কোন প্রকাশক ছাপতে চাইতো না। সে সময়কার সাহিত্যিকগণ রবীন্দ্রনাথকে নিতান্তই অশিক্ষিত ভাবতেন।
"ঠাকুর নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির পূর্বে প্রায় অশিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতেন। আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্রে ঠাকুরের একটি রচনা থেকে উদ্বৃতি দিয়ে সেটাকে বিশুদ্ধ ও সাধু বাংলায় লেখার নির্দেশ ছিল।" [জাস্টিস আব্দুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ; সংস্কৃতি রূপান্তর-পৃষ্ঠা ৪০৮]।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাতী সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, ১৩১৯ বঙ্গাব্দ কার্তিকের সাহিত্য সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে মন্তব্য করলেন,
"ইংল্যাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ সম্বর্দ্ধনার খবরে দেখিতেছি- ইংল্যাণ্ডের অনেক সুধী স্বীকার করিতেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও ভাবুক-এ বিষয়ে তাঁহার তুল্য দ্বিতীয় ব্যক্তি জগতে কোন দেশে নাই। আনন্দের কথা নয়? তবে কিনা দেশের লোক এতদিন তাহা বুঝতে পারে নাই। ইদানীং রবীন্দ্র ভক্তবৃন্দের বগলেই বিরাজ করেন দর্শন দুর্ঘট। বিস্ময়ের কথা এই যে, দেখিতে দেখিতে জগতের সাহিত্য এত দরিদ্র -প্রায় দেউলিয়া হইয়া গিয়াছে যে রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইলেন। কোন কোন সুধী এই জগতব্যাপী কবি জরিপের সার্ভেয়ার ছিলেন,তাহা বলিতে পারিনা। যাঁহারা আমাদের ধন্য করিলেন, তাঁহারাই ধন্য।" [জোতির্ময় রবী ও কালো মেঘের দল; পৃঃ ৯-১০]

পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হত কিন্তু গ্রন্থাকারে কবির লেখা সে নিজের টাকাতেই অথবা আত্মীয়েরা ছাপাতো। ১৮৯৬ সালে তাঁর ভাগ্নে একটি বই ছেপেছিল যা সেলফেই সাজানো ছিলো কেউ কেনেননি।
"শুনা যায়, সেই বইয়ের বোঝা সুদীর্ঘকাল দোকানের শেল্ফ ও তাঁহার চিত্ত কে ভারাতুর করিয়া বিরাজ করিতেছিল।" [ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ: অমিতাভ চৌধুরী-পৃঃ৭৮]
এমন সময়ও কবির অতিবাহিত হয়েছে যে, অর্ধেক দামে তাঁর বই বিক্রি করতে হয়েছে, বা এক তৃতীয়াংশ দামে তাঁর গ্রন্থের কপিরাইট বিক্রি করেছেন।

"১৮৯৬ সালে 'রবি মামার' প্রথম কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশ করেন তিনিই। তারপর বহুবছর রবীন্দ্রনাথ কে এ বিষয়ে অনেকটা নিজের উপরই নির্ভর করতে হয়েছে। নিজের খরচে তিনি বইয়ের পর বই ছেপেছেন। ….রবীন্দ্রনাথের বই অনেক সময় বিক্রি করতে হয়েছে অর্ধেক দামেও। তা নিয়ে সেকালে কম ঠাট্টা বিদ্রুপ হয়নি। …১৯০০ সালে কবির বন্ধু প্রিয়নাথ সেন কে তিনি লিখেছিলেন 'ভাই, একটা কাজের ভার দেব?…আমার গ্রন্থাবলি ও ক্ষণিকা পর্যন্ত সমস্ত কাব্যের কপিরাইট কাউকে ৬০০০ টাকায় কেনাতে পারো? আমার গ্রন্থাবলি যা আছে সে এক তৃতীয়াংশ দামে দিতে পারব(কারণ এটাতে সত্যের অধিকার আছে, আমি স্বাধীন নই, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে লোকে কিনবে সে ঠকবেনা। …আমার প্রস্তাবটা কি তোমার কাছে দুঃসাধ্য ঠেকেছে? যদি মনে কর ছোটগল্প এবং বউ ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি কাব্যগ্রন্থাবলীর চেয়ে খরিদ্দারের কাছে বেশি সুবিধাজনক প্রতিভাত হয় তাহলে তাতেও আমি প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস কাব্যগ্রন্থগুলোই লাভজনক। এই রকম নানা ঝামেলার মধ্যে কবির বই প্রকাশ করতে হয়েছে।" [ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ; অমিতাভ চৌধুরী-পৃঃ৭৯]।

কবির উপর এই অভিযোগও ছিলো যে তাঁর যাবতীয় সৃষ্টিই নকল! এই অভিযোগটি তোলেন -কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিশারদ তাঁর মিঠা কড়াতে। "জ্যোতির্ময় রবী ও কালো মেঘের দল" গ্রন্থের ১১১ পৃষ্ঠায় সুজিত কুমার সেনগুপ্ত একটি লেখায় দেন, "স্রেফ টাকার জোড়ে ওঁর লেখার কদর হয়।" আবার বলেন, "রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করেই অপহরণ।" কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিশারদ তাঁর মিঠে কড়াতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্যারোডি কবিতাও লিখলেন "রবিরাহু" ছদ্মনামে। "জ্যোতির্ময় রবী ও কালো মেঘের দল" গ্রন্থের সৌজন্যে আমি কবিতাগুচ্ছের উদ্বৃতি দিচ্ছি।
১নং কবিতাঃ
ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ বঙ্গের আদর্শ কবি।
শিখেছি তাঁহারি দেখে তোরা কেউ কবি হবি?
'কড়ি ও কোমল' পড় 'পুরো সুর' চাস্ যদি।
পড়ে যা আমার টোলে দেখে যা কবিত্ব নদী।
সে যে রবী-আমি রাহু,
তুল্য মূল্য সবাকার
ধনী সে-দরিদ্র আমি
সে আলো-এ অন্ধকার।
২নং কবিতাঃ
(১) মৌলিকতা পথের ধারে গড়াগড়ি খায়।
ও তার অনুবাদের বিষম ঠেলায় ব্রহ্মা লজ্জা পায়।।
চুনোগলি হার মেনেছে মৌলিকতা দেখে।
যত মুদিমালা বাংলা পড়ে রবি ঠাকুর লেখে।।
(২) আয় তোরা কে দেখতে যাবি,
ঠাকুর বাড়ির মস্ত কবি!!
হায়রে কপাল হায়রে অর্থ!
যার নাই তার সকল ব্যর্থ!!
(৩) কেমন ভাষা বিদ্যা খাসা
দেখ কেমন সং এগো
রোগা হাড়ে তাই বেঁচে গেল
প্রমাদ অঙ বঙ পঙে গো।

বিদ্যাবিশারদ বা অন্যান্য রবী-সমালোচকরা এ কথাটা একেবারেই যে বিদ্বেষ থেকে লিখেছেন বা যাচাই বাছাই না করেই বলে ফেলেছেন, এটা বলা বোকামী। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলী (দ্য সং অফারিংস) এর জন্য যখন নোবেল পেলেন তখন পশ্চিমা সাহিত্যিকগণ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ আনেন। তাঁর "দ্য সং অফারিংস" (গীতাঞ্জলী) এর ২৬ নং কবিতা ও ইংরেজী বাইবেলের "সং অফ সলোমন" এর ৫:২৬ নং শ্লোকের মিল দেখান তাঁরা। তাঁরা গীতাঞ্জলীর ৮৬ নং কবিতা ও খ্রীষ্টিও গান "Canticle" এর হুবহু মিল দেখান। "আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ" এর ১৪৫ নং পৃষ্ঠায় এর আলোচনা করেন শ্রী নীরদচন্দ্র চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথের প্রমাণিত একটি নকল কবিতা হলো "ভারত তীর্থ"। যা কবি "জালালুদ্দিন রুমি"র একটি কবিতার হুবহু নকল। নিচে দুটো কবিতা'ই উদ্বৃত করা হোলো:
বায্ আঁ,বায্ আঁ
হর আচে হাস্তী বায্ আঁ।
গর কাফির হর গবরওয়া
বোত পরস্তি বায্ আঁ।
ই দরগাহ মা দরগাহে
ন-উম্মিদ নীস্ত
শতবার গর তাওবাহ শিকস্তী বায্ আঁ
-জালালুদ্দিন রুমি
এই কবিতার নকল রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি হলো-
এসো হে আর্য,এসো হে অনার্য-
হিন্দু মুসলমান,
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ
এসো এসো খ্রীষ্টান।
মা'র অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা-
সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে
এই ভারতের সাগরতীরে।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [দ্রঃএ এক অন্য ইতিহাস;পৃঃ ১৬৯-৭০]।

রবীন্দ্রনাথের "চিত্রা" কাব্যের "এবার ফিরাও মোরে' এবং "মানসী" কাব্যের "বধূ' কবিতা দুটির ভাব ইংরেজ কবি শেলী ও ওয়ার্ডওয়ার্থের কবিতার নকল। [দ্রঃঐ] নারায়ণ বিশ্বাস এবং প্রিয়রঞ্জন সেন প্রমাণ করেন “গোরা” এবং “ঘরেবাইরে” নকল। কালী মোহন ধরে দেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার নকল। এবং অমিতাভ চৌধুরীর লেখায় প্রমাণিত হয়, যার জন্য কবি নোবেল পান সেই গীতাঞ্জলী নামটাই নকল করা! [দ্রঃঐ]। রবীন্দ্রনাথের একটি নকলের কথা বলেন আহমেদ ছফা তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন রাসেল, অশীষ এবং ব্রাত্য রাইসু।

বাউলদের নিয়ে কথা বলার ফাঁকে রাইসু বলেন-
"রাইসু: আমার মনে হয় ছফা ভাই, এইখানে বাউলরাই হইছে সবচেয়ে বড় এলিট।
ছফা: এলিটিজম হচ্ছে একটা জিনিস, যখন একটা অংশে নিজেদের আইডেনটিটি এসার্ট করতে করতে তাঁরা মনে করে যে দে আর বেস্ট ফর সামথিং। বাউলদের এই যে স্যেকুলেড মানসিকতা। এইটা আমি খুব অপছন্দ করি। দেখ, জেনরা মনে করে সমস্ত বস্তু সত্তার মধ্যে প্রাণ আছে। এই কাঠটার মধ্যেও প্রাণ আছে। প্রাণের যে ভেরিয়েশন, সেটা হচ্ছে ডিগ্রি এবং স্টেজের। সেজন্য উর্দুতে একটা শের আছে 'সে মুক্তাতেই নেই, সে পাথরেও নেই, সে নানা বর্ণে দীপ্ত'।
রাইসু: এটারই উল্টো করে রবীন্দ্রনাথ বলতেছেন, তোমারই স্পর্শে পান্না হল সবুজ।
ছফা: রবীন্দ্রনাথ এটা গ্যেটের সেকেন্ড পার্ট থেকে চুরি করছে।
রাইসু: রবীন্দ্রনাথ তো তাইলে বড় কিছু ছিল না।
ছফা: এগজাক্টলি, এই যে বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে তালি দেওয়ার ক্ষমতা এটাই মানুষকে বড় করে।"
[দ্রঃ উত্তরখন্ড আহমেদ ছফা; পৃঃ-২৩২; অধ্যায়-একদিন আহমদ ছফার বাসায় আমরা]।

রবীন্দ্রনাথের নকল বিষয়ক আলোচনা এখানেই সমাপ্ত করতে চাই। এ বিষয়ে লিখতে বসলে ছোটখাট একটা বই'ই হয়ে যাবে। যে বিষয়ে আজ লিখতে বসেছি সেটাই এখন সামনে আনা সমীচীন মনে করছি। প্রয়াত বাংলা সাহিত্যিক আহমেদ ছফা প্রণীত "যদ্যপি আমার গুরু" বইটি সম্প্রতি পাঠ করলাম। আহমেদ ছফা তাঁর গুরু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে দীর্ঘ জীবনে পরিচয়ে যে কথাবার্তা চালিয়েছেন তা তুলে ধরেছেন। বইটিকে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারের বই বলা যায়। বইটির পৃষ্ঠা ৬০-এ নজর পড়তেই চমকপ্রদ একটি কথা দৃষ্টিগোচর হলো। রবীন্দ্রনাথের বিষয় আলোচনা উঠলে ছফা জানতে চান রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে উনার মতামত। এছাড়াও ছফা রবীন্দ্রনাথ বড় মানুষ কি-না এর বিষয়ে ইঙ্গিত দিলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন,
"রবীন্দ্রনাথ বড় লেখক, মানুষ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর কিংবা তাঁর মত মানুষের ধারে কাছেও আসতে পারেন না। বড় লেখক আর বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে।"
জাতীয় অধ্যাপক এখানে কি বোঝাতে চেয়েছেন সেটা কারো বোঝার বাকি নেই। সমাজ সংস্কার বা সাহিত্যের উন্নতিতে রবীন্দ্রনাথের তেমন কোন হাত নেই। এই যে হালের রবীন্দ্রপ্রেমীদের উদ্ভট দাবী সেটা তিনি একেবারই ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছেন। রবীন্দ্র ভক্তরা দাবী করেন, "রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা বাঁচিয়ে রেখেছেন।" এ বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে আহমেদ ছফা প্রশ্ন করলে উনি নিঃসঙ্কোচে বলেন- "বাংলা ভাষাটা বাঁচাইয়া রাখছে চাষাভুষা, মুট মজুর-এরা কথা কয় দেইখ্যাই ত কবি কবিতা লিখতে পারে। "[দ্রঃ আহমেদ ছফার ঐ বই পৃঃ ৬০-৬১]।

এই কথাটির আরো ভালো বিশ্লেষণ করা যায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে। মানুষ হিসাবে তিনি বড় ছিলেন কি-না। বড় ভাইয়ের বৌয়ের সাথে পরকীয়া অতঃপর নিজের বিয়ে, বিয়ের পর কাদম্বরি (বৌদি) দেবীর আত্মহনন তাঁর বড় মানুষ হওয়ায় যথেষ্ঠ প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করেছে। এ বিষয়ে শ্রী নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখলেন- "১৮৮৩ সনের ডিসেম্বর মাসে ২২ বৎসর ৮ মাস বয়স্ক রবীন্দ্রনাথের সহিত একটি বারো বৎসরের বালিকার বিবাহ হয়। উহার চার মাসের মধ্যে ১৮৮৪ সনের এপ্রিল মাসে জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঁচিশ বৎসর বয়স্কা পত্নি কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করিলেন।"

 তিনি আরো লিখলেন- "জ্যোতিন্দ্রনাথের সংসারের সহিত রবীন্দ্রনাথ ১৮৮১ সনের মাঝামাঝি হইতে ১৮৮৩ সনে বিবাহ হইবার সময় পর্যন্ত যেভাবে যুক্ত ছিলেন তা হতে এই জনশ্রুতি বাঙালী সমাজে ভিত্তিহীন বলিয়া মনে হইলো না। তাহার উপরে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর সতেরো বৎসর পরে ১৯০১ সনে রবীন্দ্রনাথ 'নষ্টনীড়' গল্পটি প্রকাশ করিয়া এই জনশ্রুতির গৌণ প্রমাণ দিয়া ফেলিলেন।" [আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ -পৃঃ ২৭-২৮]
এই ফাঁকে বলে রাখি, রবীন্দ্রনাথকে বর্ণবাদ-বিরোধী হিসাবে উপস্থাপন করলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কোন নমঃশূদ্রের মেয়েকে স্ত্রী-রূপে গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালীনি দেবী ছিলেন পীরালী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। কাজেই জাতপাত প্রথা থেকে রবীন্দ্রনাথ বের হতে পেরেছিলেন কি-না সেও ভাববার বিষয়। সে সময় সাহিত্যাঙ্গনে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলো। কারণ, দুধে-আলতা, স্মার্ট বিলেত ফেরত জমিদার পুত্র রবীন্দ্রনাথের কপালে জুটলো কৃষ্ণাকায় এক অশিক্ষিত নারী! মৃণালীনির চেহারা সুরত তেমন ভালো না হলেও পীরালি ব্রাহ্মণ বলেই রবীন্দ্রনাথ একে বিয়ে করেন। এ নিয়ে হেমেন্দ্র প্রসাদ লেখেন- "বউ তেমন সুবিধের হয়নি। সুন্দরী নয় মোটেই।" মৃণালীনি দেবীর গায়ের রং যে তেমন ভালো ছিলোনা সে বিষয়ে হেমেন্দ্র প্রসাদ বলেন- "বউয়ের মুখশ্রী বা দেহের গঠন সাদা মাটা পাঁচপাঁচী।

 গায়ের রং শ্যামবর্ণ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।" তেমন শিক্ষিতও ছিলেন না দেবী। একমাত্র পীরালি ব্রাহ্মণ বলেই যে তিনি মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন এ নিয়ে হেমেন্দ্র প্রসাদ বলেন- "বাংলা অক্ষর পরিচয়টুকু বউয়ের কোন রকম হয়েছে। ঐ পরিবারে শিক্ষাদীক্ষার কোন চলন নেই। মুশকিল হলো এই যে, ধনী জমিদার হলেও পীরালি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে সবাই দিতে চায় না, কিনা।" মৃণালীনি দেবীর গায়ের রং, তাঁর বংশ মর্যাদা বা শিক্ষা-দীক্ষা টেনে আনার মানে এই না যে আমি তাঁকে ছোট করে দেখছি। রবীন্দ্রনাথ জাতপাতের উর্দ্ধে যেতে পেরেছিলেন কি-না সে বিষয়ে আলোকপাত করার জন্যই এ বিষয়টা টানলাম। রবীন্দ্রনাথ বর্ণবাদের উর্দ্ধেই যদি হবেন তাহলে তাঁর লেখা কাব্য নাটক, কবিতায় মুসলমানদের ম্লেচ্ছ, যবন বলবেন? তাঁর কন্ঠরোধ প্রবন্ধে মুসলমানদের নীচু জাত, ইতর, নিম্ন শ্রেণীর বলে মন্তব্য করেন [রবীন্দ্র রচনাবলীর ১০ম অংশের ৪২৮ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য ]। আরো বর্ণবাদ প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথ প্রণীত "ইংরেজী সহজ শিক্ষা"য়। আমি এখানে কিছু তুলে ধরছি সেখান থেকে শুধুমাত্র বাংলায়:
• "সুশ্রী মেয়েটির গাধা আছে। • গরীব ছেলেটির একটি নৌকো আছে। • নিষ্ঠুর মানুষটির একটি মাদুর আছে। • দরিদ্র মেয়েটির একটি ছোটো বিছানা আছে। • খাটো মানুষটির একটি সুন্দর পাখি আছে। • বিশ্রী ছেলেটির একটি উঁচু ডেস্ক আছে। • পাতলা মানুষটির (একটি) উঁচু বড় নাক আছে। • গরীব ছেলেটির একটি পুরানো খারাপ কলম আছে।" [পৃষ্ঠা ১৬ -ইংরেজী সহজ শিক্ষা; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]।

কাজেই রবীন্দ্রনাথকে বর্ণবাদ-বিরোধী বলা মূলো গিলানো ছাড়া আর কিছুতো ধরা যায় না। এছাড়াও তাঁর বড় হওয়ার বাঁধা হিসাবে ছিলো জমিদারগিরি, ইংরেজ-তোষণ, নোবেল নিয়ে তদবীর ফিকির, উদ্বৃতি না দিয়ে লেখার জোড়াতালি এবং ক্ষেত্র বিশেষ মুসলমান ও হিন্দু বিদ্বেষীতা। জমিদারগিরি ছিলো তাঁর অন্য আরেক রূপ। কবিতায় এই রূপ পাঠকরা দেখতে পাননা বিধায় রবীন্দ্রনাথের দুষ্টু স্বত্ত্বা তাঁরা দেখতে পান না কিংবা অত্যন্ত সুচারু ভাবে এড়িয়ে যান। শ্রী নীরদ চৌধুরী রবীন্দ্র বিদ্বেষীদের মত রবীন্দ্র ভক্তদের মধ্যেও একটা দিক দেখতে পেয়েছেন যে, এঁরা সুক্ষ্মভাবে রবীন্দ্রনাথের দোষ এড়িয়ে যান। কবি হিসাবে যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে "বড় মানুষ" হিসেবে পূজো করে আসছেন, "জমিদার" হিসাবে তাঁরা কি রবীন্দ্রনাথকে পূজো করতে পারবেন? রবীন্দ্রনাথ দফায় দফায় পূর্ববঙ্গ এস্টেট এর কর, খাজনা বৃদ্ধি করেছেন। তাঁর পাশাপাশি মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে পূজাপার্বণ এর খাজনা আদায় করেছেন বেআইনি ভাবে। এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু উদ্বৃতি দিচ্ছি- "১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা আদায়ও করেছিলেন। "[দ্রঃ- শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ ১৮, ১১৭]। রবীন্দ্রনাথ ২ বার করে খাজনা আদায় করতেন।

"সব জমিদার খাজনা আদায় করতেন একবার রবীন্দ্রনাথ করত দুইবার। একবার জমির খাজনা দ্বিতীয় বার কালী পূজার সময় চাদার নামে খাজনা।" [দ্রঃইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, লেখক সরকার শাহাবুদ্দীন আহমেদ ]

এখানে আলোচনার আগে তাঁর পিতামহ ও পিতা দেবেনের প্রজাহিতৌষিতা একটু তুলে ধরার দরকার পড়লো। ঠাকুর বংশের প্রজাপীড়নের কথা সাংবাদিক/বাউল কাঙাল হরিণাথ তাঁর গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় তুলে ধরেছিলেন। "কাঙাল হরিণাথের অপ্রকাশিত ডায়েরী, চতুষ্কোণ" আষাঢ় ১৩৭১ সংখ্যা থেকে তুলে ধরা হলো- "ইত্যাদি নানা প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইলো পুষ্করিণী প্রভৃতি জলাশয়স্থ মৎসের যেমন মা বাপ নাই; পশুপক্ষী ও মনুষ্য যে জন্তু যে প্রকারে পারে মৎস ধরিয়া ভক্ষণ করে; তদ্রুপ প্রজার স্বত্ত্ব হরণ করিতে সাধারণ মানুষ্য দূরে থাকুক যাহারা যোগী ঋষি ও মহা বৈষ্ণব বলিয়া সংবাদপত্র ও সভা সমিতিতে প্রসিদ্ধ, তাঁহারাও ক্ষৎক্ষামোদর।" পিতামহ দ্বারকানাথ আর পিতা মহর্ষি(!)দেবেন এর মত তিনিও প্রজাদের চাবুক পেটা করেছেন, পায়ে দলেছেন লাথি মেরেছেন এমনকি প্রজাদের বাড়িঘর ও জ্বালিয়ে দিয়েছেন! "কিন্তু তাঁর ঔদার্য ও মানবিক বোধের ঐশ্বর্য সত্বেও জমিদার ও জমিদারীর যে ঠাঁট যা সামন্ত সম্পর্কের একটি অঙ্গ, তা তিনি বর্জন করতে পারেন নি। জমিদারের ক্ষমতা আড়ম্বর ও দাপট সম্পর্কে প্রজাদের ভীতি থেকেই গেছে।" [ডক্টর পোদ্দার; পৃঃ২০]

রবীন্দ্র ভক্তরা একথা প্রচার করে বেড়ায়, প্রজাদের সুবিধার্থে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গে 'কৃষিব্যাঙ্ক' একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। মূলে কার সুবিধা হলো, কাদের ধন সম্পদ বৃদ্ধি পেলো সে কথা কোন রবীন্দ্র ভক্ত জানলেও আড়াল করে যাচ্ছেন নাকি জানেন না এ প্রশ্ন থেকেই গেলো। "কলকাতার কিছু বন্ধুবান্ধব যোগাড় করে তাঁদের সঙ্গে কবি নিজেকে যুক্ত করে একটি সুদের কারবার শুরু করেছিলেন-তার নাম দিয়েছিলেন 'কৃষিব্যাঙ্ক'। তাঁরা শতকরা সাত টাকা সুদ দিয়ে মূলধন যোগাড় করেছিলেন। আর কবি তাঁর জমিদারিতে গরীব প্রজাদের কাছ থেকে সুদ নিতেন শতকরা ১২ টাকা।" [ডক্টর পোদ্দার; পৃঃ২২]।

কবির জমিদার সত্ত্বার আলোচনায় কবিকে বড় মানুষ হিসাবে ভাবায় যথেষ্ট অসততা আছে। মূর্তিপূজো-বিরোধী মুসলমানদের কাছ থেকে মূর্তিপূজোর চাঁদা আদায়, আবার কবিতায় সেই মুসলমানদের ম্লেচ্ছ, যবন, নীচ ইত্যাদি বলে গালাগাল নিম্ন মানুষিকতা নয় কি? এছাড়াও কবি কলকাতায় করেছেন মুসলিম-বিরোধী জনসভা।
গোঁড়া হিন্দু কর্তৃক গরু বাঁচাতে পৃথিবীর মাটিতে ভারতবর্ষের পূণায় সর্বপ্রথম "গো রক্ষক্ষিণী সভা" নামে যে জনসভাটি ১৮৯৩ সনে হয় সেটির প্রতিষ্ঠা করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ! [দ্রঃএ এক অন্য ইতিহাস] তবে তিনি যে একমাত্র মুসলিম সম্বন্ধেই বিদ্বেষভরা লেখা লিখেছেন তা নয়। তাঁর কিছু কিছু বক্তব্যে তিনি হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু জাতীকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি! তাঁর নাটক “অচলায়তন”-এ তিনি হিন্দু ধর্মকে চরমভাবে আঘাত হানেন! আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ থেকে এর উদ্বৃতি দিচ্ছি- “রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মকে আঘাত করেছিলো তাঁর নাটক অচলায়তনে। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক -সুরেশচন্দ্র সমাজপতি এর বিরুদ্ধে লিখলেন-রবীন্দ্রনাথ মেটারলিঙ্ক হইতে পারেন, কিন্তু হিন্দুধর্ম সমাজকে আক্রমণ করিবার অধিকার তাহার নাই। “[আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ-পৃঃ৫৪]

ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির মহৎকর্মের কথা কে না জানে! কিন্তু আমাদের কবি মুসোলিনি-প্রেমে মজলেন যে তিনি তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেলেন! কবি একসময় ইতালি যান এবং সেখানে বসে ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির খুব প্রশংসাও করেন! সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর রবীন্দ্র রাজনীতি গ্রন্থের পৃষ্ঠা ১-এ এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন- "১৯২৬ সালে কবি ইতালি যান মুসোলিনির আমন্ত্রণে, এবং আথিথীয়তায় মুগ্ধ হয়ে মুসোলিনির প্রশংসা করেন।" ১৯০৫ সালে করলেন বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা। বিরোধিতা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে যে জনসভা হয় তাঁর সভাপতি ছিলেন স্বয়ং কবি। "শত হইলেও প্রজা। আর প্রজার বাচ্চারা কেন উচ্চশিক্ষিত হইব" এই মানুষিকতা আশাকরি কবির ভিতর ছিলো না। এসব নিয়ে কয়েকটি পর্বে লিখতে চাই। "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ এর অবস্থান" এবং "রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান" বিষয় দুটো পর্বাকারে লিখতে চাচ্ছি। এই দুটো বিষয়ে বিস্তারিত বলার ক্ষেত্র এখানে নয়।

নোবেল প্রাপ্তির আগে রবীন্দ্রনাথের যেমন লেখার কদর হয়নি তেমনি নোবেল প্রাপ্তির আগে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রকৃত রবীন্দ্রনাথ এর জন্ম হয়নি। তাই দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পরের লেখাগুলো আগের লেখার সাথে সাংঘর্ষিক। যে কারণে তিনি মুসলমানদের ম্লেচ্ছ, যবন, তস্কর বলে গালাগাল দিয়েছেন ঠিক একই কারণে তিনি মুসলমানদেরকে আবার হিন্দুদের চেয়ে একধাপ আগানো সহযোদ্ধা হিসাবে দেখেছেন। নোবেল প্রাপ্তির আগে উনি ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ(সঃ)কে নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বল্লেন-
"কোরআন পড়তে শুরু করেছিলুম কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি আর তোমাদের রসুলের জীবন চরিতও ভালো লাগেনি।" [ দ্রঃ বিতণ্ডা, লেখক সৈয়দ মুজিবুল্লা, পৃ -২২৯ ]

নোবেল প্রাপ্তির পর তিনি মুহম্মদ(সঃ)-এর প্রশংসায় ঈদে মিলাদুন্নবীতে লেখাও পাঠিয়েছেন। স্ববিরোধিতা বলি আর সুন্দর করে 'ভুল বুঝতে পারার জন্য' বলি এই কারণে রবীন্দ্রনাথকে 'বড় মানুষ' বলার বেলায় একটু ভেবেচিন্তেই বলতে হবে। যদি তাঁকে মুসলমানদের প্রতি পরবর্তীকালে সদয় হওয়ার জন্য বড় মানুষ বলি, কিংবা পরবর্তীকালে ইংরেজ বিরুদ্ধবাদ এর জন্য বড় মানুষ বলি তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, "পূর্ববঙ্গেরর প্রজাদের জন্য জমিদার সাহেব কি করেছিলেন?" পূর্ববঙ্গে জমিদারী করার সময় অভূতপূর্ব সম্মান (রবীন্দ্র পত্রাবলি পড়ুন) পাওয়ার পরও পূর্ববঙ্গের জন্য তিনি কি করেছেন বা কোন উপকারটায় এসেছেন? আরো প্রশ্ন থেকে যায়, কেন তিনি মুসলমানদের প্রতি পূর্বে বিষোদগার ছড়ালেন? কেন ইংরাজ তোষামোদ করলেন? নিজে শ্রেফ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য? যদি তাই হয় তাহলে বড় মানুষ তাঁকে কিভাবে বলব? রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার আগ পর্যন্ত ইংরেজদের নিয়ে 'টু' শব্দটি পর্যন্ত করেননি! বরঞ্চ বিভিন্ন ইস্যুতে বিপ্লবীদের খাটো করেছেন। এমন এমন সব কবিতা ইংরেজদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন যাতে ইংরেজদের অধিষ্ঠিত করেছেন "ভগবান" এর আসনে! ঠিক নোবেল প্রাপ্তির পরপরই কেন ইংরেজদের ভগবান থেকে যবনে নামালেন?

 এর আগে কেন করেন নি? কারণ কি এই যে, "রবীন্দ্রনাথ জানতেন একবার নোবেল পেলে সেটা আর ফেরৎ নেয়া যায় না, তাই তিনি এখন ইংরেজদের চৌদ্দপুরুষ করলেও পাছে নোবেল খোয়া যাবেনা!" এই ফাঁকে বলে রাখি, বলা হয় যে রবীন্দ্রনাথ নাকি কোন এক বিপ্লবী হত্যার প্রতিবাদে ইংরেজদের দেয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, নোবেলের মত 'নাইট' উপাধি একবার পেলে আর ত্যাগ করা যায়না! রবীন্দ্রনাথের ঐ একই সময় ইউসুফ আলী নামক স্যার উপাধিপ্রাপ্ত এক মুসলমানও নাইট উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু বিপ্লবের মুখে উনিও নাইট উপাধি ত্যাগ করতে চাইলেন। নাইট উপধি ত্যাগ নিয়মবহির্ভূত হওয়ায় উনি আর ত্যাগ করতে পারেননি। সেসময় রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগের খবর নিয়ে ভারতবর্ষে হুলস্থূল হয়ে গিয়েছিল। তাই স্যার ইউসুফ আলী রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে নাইট উপাধি ত্যাগের টিপস জানতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, শত চেষ্টা করেও এই উপাধি ইংরেজদের ফিরিয়ে দেয়া যায়নি। এই বিষয়ে "এ এক অন্য ইতিহাস" গ্রন্থে গ্রন্থাকার বিশদ আলোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও ইউসুফ আলীর চিঠির হুবহু ছবি দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে তাঁর স্ববিরোধিতা হোক আর সুন্দর করে 'ভুল' হোক, যে কোন কারণেই তাঁকে বড় মানুষ বলা যায় না।

 রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর বড় মানুষ হওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাই যাঁরা সাহিত্যের পাল্লায় ফেলে রবীন্দ্রনাথকে একজন বড় মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করছেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে প্রখ্যাত কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এর এই কথাটুকু রেখে লেখাটার সমাপ্তি ঘটালাম। সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর রবীন্দ্র রাজনীতি গ্রন্থে বলেন-
"ধরা যাক, একজন কথাশিল্পী এমন এক কাহিনী লিখলেন যেখানে প্রধান চরিত্র বিপ্লবী-বিদ্রোহী ও কুসংস্কারেরর বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে লেখক নিজে সুবিধাবাদী সমাজের শত্রুদের সঙ্গে একাসনে তাঁর অবস্থান এবং প্রগতিবিরোধী-তাহলে কি তাঁকে আমরা মহৎ ব্যক্তি বলব?"
http://shodalap.org/sajalahmed2222/34733/

No comments:

Post a Comment