Saturday 24 June 2017

সিরাজদ্দৌলার পতনের পর বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা।



সিরাজদ্দৌলার পতনের পর বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা।

বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস বই থেকে ।
পলাশী ও বকসারের যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লির নামমাত্র মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী মঞ্জুর করার পর এ অঞ্চলের উপরে তাদের আইনগত অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলার যে চিত্র ফুটে উঠে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নৈরাশ্যজনক। পলাশী যুদ্ধের পর মীর জাফর প্রভৃতি নামমাত্র নবাব থাকলেও সামরিক শক্তির নিয়স্তা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ১৭৬৫ সালের পর দেশের অর্থনীতিও সম্পূর্ণ তাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলার মুসলিম সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছিল সর্বাপেক্ষা ও সর্বদিক দিয়ে।

সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে উমিচাঁদ-মীর জাফরের সাথে কোম্পানীর যে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার অর্থনৈতিক দাবী পূরণ করতে দিয়ে বাংলার রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। পূর্বে বলা হয়েছৈ যে, এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানীকে ভূয়া ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয় একশ’ লক্ষ টাকা। ইউরোপীয়দেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনীয়দেরকে সাত লক্ষ টাকা। বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পূর্বেই ক্লাইভকে দিতে হয় বায়ান্ন লক্ষ টাকা (Fall of Sirajuddowla-Dr. Mohar Ali)।

মীর জাফরের ভূয়া নবাব হিসাবে বাংলার মসনদে আরোহণ করার পর কোম্পানীর দাবী উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। মীর জাফর, তাদেরকে প্রীত ও সন্তুষ্ট রাখতে বাধ্য হয়। রাজস্ব বিভাগ কোম্পানীর পরিচালনাধীন হওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে হিন্দু ও ইংরেজ আদায়কারীগন অতিমাত্রায় শোষণ নিষ্পেষণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে কোম্পানীর রাজকোষে পূর্ণ করতে থাকে। ইতিপূর্বে প্রজাদের নিকট থেকে আদায়কৃত সকল অর্থ দেশের জনগণের মধ্যে তাদেরই জন্যে ব্যয়িত হতো। তখন থেকে ইংল্যান্ডের ব্যাংকে ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলিতে স্থানান্তরিক হতে থাকে।

১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক প্রাণত্যাগ করে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের বেলায় কোন প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শিত হয়নি। দুর্ভিক্ষ যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন পূর্বের বৎসরের তুলনায় ছয় লক্ষ টাকা অধিক রাজস্ব আদায় করা হয়, বাংলা ও বিহার থেকে পরবর্তী বছর অতিরিক্ত চৌদ্দ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। মানব সন্তানেরা যখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল, তখন তাদের রক্ত শোষণ করে পৈশাচিক উল্লাসে নৃত্য করছিল ইংরেজ ও তাদের রাজস্ব আদায়কারীগণ। এসব রাজস্ব আদায়কারী ছিল কোলকাতার হিন্দু বেনিয়াগণ, সুদী মহাজন ও ব্যবসায়ীগণ। মানবতার প্রতি এর চেয়ে অধিক নির্মমতা ও পৈশাচিকতা আর কি হতে পারে? (Baden Power-Land system etc. –British Policy & the Muslim in Bengal-A.R Mallick)।

আর এক ঘৃণিত পন্থায় এদেশের অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করা হতো। কোম্পানী এবং তাদের কর্মচারীগণ যাকে খুশী তাকে নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতো এবং যাকে খুশী তাদে ক্ষমতাচ্যুত করতো। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আট-ন’ বছরে এ ব্যাপারে কোম্পানী ও তার দেশী-বিদেশী কর্মচারীদের পকেটে যায় কমপক্ষে ৬২,৬১,১৬৫ পাউন্ড। প্রত্যেক নবাব কোম্পানীকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দানের পরও বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতো।

আবদুল মওদুদ বলেনঃ

পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী দল কী মহামূল্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজদন্ড এ দেশবাসীর জন্য ক্রয় করেছিল, তার সঠিক খতিয়ান আজও নির্ণীত হয়নি। হওয়া সম্ভব নয়। কারণ –কেবল লিখিত বিবরণ থেকে তার কিছুটা পরিমাণ জ্ঞাত হওয়া সম্ভব। কিন্তু হিসাবের বাইরে যে বিপুল অর্থ সাগর পারে চালান হয়ে গেছে, কিভাবে তার পরিমাপ করা যাবে?

ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো –সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামোটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংলন্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা (I.O Miller, quoted by Misra, p.15)।

মুর্শিদাবাদের খাযাঞ্চিখানা থেকে পাওয়া গেল পনর লক্ষ পাউন্ডের টাকা, অবশ্য বহুমূল্য মণিমাণিক্য দিয়ে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ স্থলসেনা ও নৌসেনা পেলো চার লক্ষ পাউন্ড; সিলেক্ট কমিটির ছয়জন সদস্য পেলেন নয় লক্ষ পাউন্ড; কাউন্সিল মেম্বররা পেলেন প্রত্যেকে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার পাউন্ড; আর খোদ ক্লাইভ পেলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড, তাছাড়া ত্রিশ হাজার পাউন্ড বার্ষিক আয়ের জমিদারীসহ বাহশাহ প্রদত্ত উপাধি ‘সাবাত জং’। অবশ্য পলাশী বিজয়ী ক্লাইভের ভাষায় ‘তিনি এতো সংসম দেখিয়ে নিজেই আশ্চর্য’। মীর কাসিম দিয়েছেন নগদ দু’লক্ষ পাউন্ড কাউন্সিলের সাহায্যের জন্যে। মীর জাফর নন্দন নজমদ্দৌলা দিয়েছেন এক লক্ষ উনচল্লিশ হাজার পাউন্ড। এছাড়া সাধারণ সৈনিক, কুঠিয়াল ইংরেজ কত লক্ষ মুদ্রা আত্মসাৎ করেছে, বলা দুঃসাধ্য। বিখ্যাত জরিপবিদ জেমস রেনেল ১৭৬৪ সালে বাইশ বছর বয়সে বার্ষিক হাজার পাউন্ডে নিযুক্ত হন, এবং ১৭৭৭ সালে বিলাত ফিরে যান ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে। এ থেকেই অনুমেয়, কোম্পানীর কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতেন। তারা এ দেশে কোম্পানী রাজ্যের প্রতিভূ হিসেবে এবং চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর হোমে প্রত্যাগত হয়ে এরূপ রাজসিক হালে বাস করতেন যে, তাঁরা ‘ইন্ডিয়ান নেবাবস’ রূপে আখ্যাত হতেন।

…ক্লাইভ নিজেই স্বীকর করেছেন, “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা বিশৃংখলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক ধনাপহরণের পাশব চিত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি”। অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণ যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদুদ, পৃঃ ৬০-৬২)।

No comments:

Post a Comment