Tuesday 13 June 2017

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস এবং ঐতিহাসিক মিথ্যাচার ।


নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস এবং ঐতিহাসিক
 মিথ্যাচার ।

অত্যাচারী বর্বর হিন্দু ব্রাহ্মণ সেন রাজাদের হাত থেকে বাংলার মুসলমান ও বৌদ্ধদের রক্ষা করেছিলেন মুসলিম সেনাপতি বখতিয়াত । তাঁর মহান বিজয়কে বিতর্কিত করতে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র মূলক মিথ্যাচার করছে তথাকথিত সেকুলার এবং বর্ণ হিন্দু উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণরা । আর বাংলাদেশের কথিত সেকুলাররাও ব্রাহ্মণদের সেবা দাস হিসেবে এই মিথ্যাচারের পালে হাওয়া দিচ্ছে ।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধবংসের জন্য ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজিকে দায়ী করে ক্ষোভ এবং হতাশা প্রকাশ করা হয় খরহামেশায়॥ এখানেও কৌশলে মানুষের মনে ইসলামের অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এক শ্রেণীর তথাকথিত প্রগতীবাদীরা এই বিষয়টি কে সাম্প্রদায়িকতা বলে প্রচার করছে ইসলামের বিরুদ্ধে ॥ যে মহামানবের হাত ধরে বাংলায় ইসলামের প্রবেশ ঘটলো, সেই মহামানবকে নিয়ে এমন বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার বর্ণবাদী হিন্দু ঐতিহাসিকদের প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেন বাংলার রাজধানী নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন কারণ নদিয়া ছিল বহিঃশত্রুর কাছ থেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চল। বলা হয়ে থাকে যে নদিয়ায় আসার কিছু আগে রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পন্ডিৎ তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এক তুর্কি সৈনিক
তাকে পরাজিত করতে পারে। এতে করে লক্ষন সেনের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন॥ লক্ষন সেনের ধারণা ছিল যে ঝাড়খন্দের শ্বাপদশংকুল অরণ্যদিয়ে কোন সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদীয়া
আক্রমন করা সম্ভব নয় কিন্তু বখতিয়ার সেইপথেই তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসেন। নদিয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ধাড়খন্দের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সাথে মাত্র ১৮ জন সৈনিকইতাল মেলাতে পেরেছিলেন॥ বখতিয়ার সোজা রাজা লক্ষন সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষি ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করেন। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষণ সেন দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপূরে আশ্রয় নেন॥ একে বলে একেবারেই বিনা রক্তপাতে বাংলা বিজয় ॥ তো সেখানে গণহত্যা আর ধ্বংসের কথা আসলো কোথা থেকে

নদিয়া জয় করে পরবর্তীতে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসহ হন এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। এই লক্ষণাবতীই পরবর্তীতে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। গৌড়জয়ের পর আরোও পূর্বদিকে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলয় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজীর আগমনে এদেশের সাধারণ মানুষ নতুন করে চেতনা পেল। সুকুমার সেন তাঁর একটি রচনায় স্বীকার করেছেন যে, অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা বখতিয়ারের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিল, এমনকি কিছুসংখ্যক ব্রাহ্মণও বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনকে বিভ্রান্ত করে দেশত্যাগ করতে সহায়তা করেছিল। মানুষে মানুষে বিভাজন মুসলমান আমলে আর রইল না, পাল আমলেও এটা ছিল না।

 মুসলমানরা একটি নতুন বিশ্বাসকে
আনলেন, এদেশের সংস্কৃতিতে নতুনপ্রাণ সঞ্চার করলেন এবং একটি বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটালেন। আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষ এবং বিকাশকে আলোচনা করতে গেলে পাল আমলের বিস্তৃত পরীক্সা করা প্রয়োজন এং সেনরা যে অসৌজন্যের জন্ম দিয়েছিল, তারও সুস্পষ্ট পরিচিতি উপস্থিত করা প্রয়োজন। অবশেষে মুসলমান আমলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি যে নতুন মানবিক রূপ পরিগ্রহ করল তারও বিস্তৃত সমীক্ষার প্রয়োজন। এ নিয়ে অল্পস্বল্প লিখিত হলেও বিস্তৃতভাবে এ নিয়ে কেউ গবেষণা করেননি।
নালন্দা মহাবিহার:
নালন্দা শব্দটি এসেছে “নালম” এবং “দা” থেকে। “নালম” শব্দের অর্থ পদ্ম ফুল যা জ্ঞানের প্রতীক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে আর “দা” দিয়ে বুঝানো হয়েছে দান করা। তার মানে “নালন্দা” শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “জ্ঞান দানকারী”, প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮০০ বছরধরে জ্ঞান বিতরনের মত দুরূহ কাজটি করে গেছে নিরলসভাবে।

 এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত “বড়গাঁও” গ্রামের পাশেই। পাটনার আদি নাম পাটালিপুত্র। দুই হাজারতিনশ বছর আগে মৌর্যদের রাজধানী ছিল এই পাটালিপুত্র। সম্রাট অশোক এখান থেকেই রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে জনশ্রুতি আছে।
ভাবতে অবাক লাগে তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ তাদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরো ২,০০০ শিক্ষক। গড়ে প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক । কত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রেরবিদ্যা দান সম্ভব তাও আবার থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ, ভেবে সত্যি অবাক না হয়ে উপায় নেই। বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি বেধ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ বিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ  দান চলত এখানে। শিক্ষকদের পাঠ দান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠ। নালন্দার সুশিক্ষার খ্যাতির সুবাতাস এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে অনুন্নত-প্রতিকুল এবরোথেবরো যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি সুদূর তিব্বত, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, গ্রীস, তুরষ্ক থেকে ছুটে আসা বিদ্যা অনুরাগীদের।

নালন্দা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে। যতদূর জানা যায় সেই সংখ্যাটা মোট তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খৃষ্টাব্দে) মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানাদের দ্বারা। উল্লেখ্য  মিহিরকুলার নেতৃত্বে হানারা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধরেরা একে পূণর্গঠন করেন।
প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়’র রাজা। তার রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে তার বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে।

 রাজা হর্ষবধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, তিনি সেই সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও দমন করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ও এর একান্ত অনুরাগী। উল্লেখ্য রাজা শশাঙ্কের সাথে বুদ্ধের অনুরুক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শত্রুতা বিরাজমান ছিল এবং খুব বড় একটি যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থ স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় তীর্থস্থান বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন যাতে এর আর কিছুঅবশিষ্ট না থাকে । হিউয়েন সাঙ এভাবে বর্ণনা করেছেন (চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২৩ সালে গুপ্ত রাজাদের শাসনামলয়ে নালন্দা ভ্রমণ করেন): Sasanka-raja, being a believer in heresy, slandered the religion of Buddha and through envy destroyed the convents and cut down the Bodhi tree (at Buddha Gaya), digging it up to the very springs of the earth; but yet be did not get to the bottom of the roots. Then he burnt it with fire and sprinkled it with the juice of sugar-cane, desiring to destroy them entirely, and not leave a trace of it behind. Such was Sasanka’s hatred towards Buddhism.
হর্ষবর্ধন পরে রাজা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন ও শেষ পর্যন্ত বাংলার কিয়দংশ করায়ত্ত
করেন। তিনি নালন্দাকে পূনর্গঠনে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখেন। সাধারণভাবে প্রচলিত ইতিহাস নালন্দার প্রাচীনত্বকে বুদ্ধের সময় পর্যন্ত নিয়ে যায়। অবশ্য এখানে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে গুপ্ত যুগের আগেকার কোন নিদর্শন
পাওয়া যায় নি। পাল রাজাদের (আট থেকে বারো শতক) সময়েই এটি বিভিন্নকর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।

 ধারণা করা হয় যে, গুপ্ত সম্রাটগণই নালন্দা মহাবিহারের নির্মাতা এবং সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তই সম্ভবত এক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফা-হিয়েন এর ভ্রমণ বিবরণীতে নালন্দায় বৌদ্ধ স্থাপনার কোন উল্লেখ না থাকায় এবিষয়ে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যায়। সাত শতকের দিকে নালন্দা একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং পড়াশোনার জন্য এখানে কয়েক বছর অতিবাহিত করেন। তাঁর সময় থেকেই নালন্দা বিশিষ্ট পুরোহিতগণেরতত্ত্বাবধানে শিক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণের ৩০ বছরের মধ্যে ই-ৎসিঙ (৬৭৫ থেকে ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০ বছর এখানে শিক্ষাগ্রহণ করেন) সহ কমপক্ষে ১১ জন কোরীয় ও চৈনিক তীর্থযাত্রীসহবিশিষ্টজনেরা নালন্দা ভ্রমণ করেন বলে জানা যায়। কনৌজের হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রি.) নালন্দা বিহারের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
বাংলার পাল রাজগণ নালন্দার প্রতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখেন। এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মপাল বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। লামা তারনাথ উল্লেখ করেন যে, ধর্মপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীলা মহাবিহার তত্ত্বাবধানকারী প্রধান ব্যক্তি নালন্দা দেখাশোনা করার জন্যও রাজা কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হন। সুবর্ণদ্বীপের শৈলেন্দ্র রাজা বালপুত্রদেব জাভার ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য দেবপালএর অনুমতি নিয়ে নালন্দায় একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেন। এদের প্রতিপালনের জন্য দেবপাল ৫টি গ্রামও দানকরেন। সে সময় নালন্দা বিহার ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতিজগতের বিশেষ কেন্দ্র  এবং এর অভিভাবক হিসেবে পাল রাজগণ সমগ্র বৌদ্ধ জগতে উচ্চস্থান লাভ করেন। ঘোসরাওয়া শিলালিপি থেকে নালন্দা বিহারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ এবং বৌদ্ধ ধর্ম ওবিশ্বাসের প্রতি দেবপালের গভীর অনুরাগের কথা জানা যায়। ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক। বৌদ্ধগ্রন্থে এদের নাম আছে।
মহাভারতে এদের নাম হেতুবাদী। তারা আসলে নাস্তিক। তারা বলতেন, পরকাল আত্মা ইত্যাদি বড় বড় কথা বেদে আছে কারণ ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোকরাই বেদ সৃষ্টি করেছে, ভগবান নয়। বেদের সার কথা হল পশুবলি। যজ্ঞের নিহত জীবন নাকি স্বর্গে যায়। চার্বাকরা বলেন, যদি তাই হয় তাহলে যজ্ঞকর্তা বাজজমান তার নিজের পিতাকে হত্যা করে স্বর্গে পাঠান না কেন…‘… এই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে বেদ ভক্তদের সংগে বৌদ্ধদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঝাপ দিতে হয়।

 বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে নাস্তিক, চার্বাকদের উক্তিতেই প্রমাণ রয়েছে। অতএব বৌদ্ধরা মূর্তিপূজা যজ্ঞবলি বা ধর্মাচার নিষিদ্ধ করে প্রচার করছিল পরকাল নেই,জীব হত্যা মহাপাপ প্রভৃতি। মোটকথা হিন্দু ধর্ম বা বৈদিক ধর্মের বিপরীতে জাত ভেদ ছিল না।’গতিশীল বৌদ্ধবাদ যখন জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করল তখন থেকে শরু হল ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে বৌদ্ধবাদের বিরোধ। সংঘাত ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠল। উভয় পক্ষই পরস্পরকে গ্রাস করতে উদ্যত হল। হিন্দুরা তাদের রাজশক্তিরআনুকুল্য নিয়ে বৌদ্ধদের উৎখাতের প্রাণান্ত প্রয়াস অব্যাহত রাখে। কখনো কখনো বৌদ্ধরা রাজশক্তির nঅধিকারী হয়ে তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়। বৌদ্ধবাদ কেন্দ্রিক নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাঙন সৃষ্টির জন্য হিন্দুরা চানক্য কৌশল অবলম্বন করে। বৌদ্ধদের মধ্যকার অধৈর্যদের ছলেবলে কৌশলে উৎকোচ ও অর্থনৈতিক আনুকূল্য দিয়ে বৌদ্ধবাদের চলমান স্রোতের মধ্যে ভিন্ন স্রোতের সৃষ্টি করা হয় যা কালক্রমে বৌদ্ধদের বিভক্ত করে দেয়। বৌদ্ধবাদকে যারা একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে থাকে তাদেরকে বলা হতো হীনযান। আর হিন্দু ষড়যন্ত্রের পাঁকে যারা পা রেখেছিল যারা তাদের বুদ্ধি পরামর্শ মত কাজ করছিল তাদেরকে ব্রাহ্মণ্য সমাজ আধুনিক বলে অভিহিত করে। এরা মহাযান নামে অভিহিত।

এরাই প্রকৃত পক্ষে পঞ্চমবাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মহাযান নতুন দল হিন্দুদের সমর্থন প্রশংসা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বৌদ্ধবাদের মূল আদর্শ পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজা শুরু করে। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তিমূলও নড়ে যায়। বৌদ্ধদের এই শ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে প্রথমত নির্ভেজাল বৌদ্ধবাদীদের ভারত ভূমি থেকে উৎখাত করে এবং পরবর্তীতে মহাযানদেরও উৎখাত করে। কিন্তু যারা একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আশ্রয় নিয়ে বৌদ্ধ আদর্শ পরিত্যাগ করে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে তাদের জাতি সত্তাকে বিসর্জন দেয় তারাই টিকেথাকে। সে কারণে আজ বৌদ্ধের সংখ্যা বৌদ্ধবাদের জন্মভূমিতে হাতে গোনা। কোন জাতি তার আদর্শ ও মূলনীতি পরিত্যাগ করে অপর কোন জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহন করলে সেই জাতিকে স্বাতন্ত্রবিহীন হয়ে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। ছয়শতকে যখন আরবে জাহেলিয়াতের অন্ধকার বিদীর্ণ করেইসলামের অভ্যুদয় হয়েছে সে সময় বাংলায় চলছিল বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞ। ৬০০ থেকে
৬৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলার শিবভক্ত রাজা শশাঙ্ক বাংলা থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত গয়ার বোধিদ্রুম বৃক্ষ গুলিতিনি সমূলে উৎপাটন করেন। যে বৃক্ষের উপর সম্রাট অশোক ঢেলে দিয়েছিলেন অপরিমেয় শ্রদ্ধা সেই বৃক্ষের পত্র পল্লব মূলকাণ্ড সবকিছু জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। পাটলিপুত্রে বৌদ্ধের চরণ চিহ্ন শোভিত পবিত্র প্রস্তর ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। বুশিনগরের বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত
করেন।

গয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে বৌদ্ধদেবের মূর্তিটি অসম্মানের সঙ্গে উৎপাটিত করে সেখানে শিব মূর্তি স্থাপন করেন। অক্সফোর্ডের Early History of India গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ মঠগুলিধ্বংস করে দিয়ে মঠ  সন্নাসীদের বিতাড়িত করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান নেপালের পাদদেশ পর্যন্ত বৌদ্ধ নিধন কার্যক্রম চালিয়েছিলেন কট্টর হিন্দু রাজা শশাঙ্ক। ‘আর্য্যা মুখশ্রী মূলকল্প’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম নয় জৈন ধর্মেরওপরও উৎপীড়ন ও অত্যাচার সমানভাবে চালিয়েছিলেন তিনি। জৈন ও  বৌদ্ধ ধর্মের সাংস্কৃতিক চেতনা একই রকম। উভয় ধর্মে জীব হত্যা
নিষেধ। আল্লাহ সম্বন্ধে তাদের ধারণা নেতিবাচক।

 এতদ্সত্ত্বেও ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাত করা হল এবং বৌদ্ধদের নিহত অথবা বিতাড়িত হতে হল অথচ মহাবীরের ধর্মজৈন আজো ভারতে টিকে রয়েছে। এটা বিস্ময়কর মনে হলেও এর পেছনে কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সেটা হল বৌদ্ধরা শুরু থেকে হিন্দুদের দানবীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা প্রতিক্রিয়াশীল-চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।পক্ষান্তরে জৈনরা হিন্দুদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়নি। হিন্দুদের সাথে সহ অবস্থান করেছে তাদের ধর্মীয় রীতি নীতি সভ্যতা সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে। তারা মেনে নিয়েছে হিন্দুদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি, তারা ব্যবসায়ের হালখাতা, গনেশ ঠাকুরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, দুর্গাকালি স্বরস্বতী পূজা পার্বন হিন্দুদের মত উদযাপন করতে শুরু করে। ভারত জনের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে- ‘হিন্দু মতে যদিও জৈন ও বুদ্ধ উভয়ে নাস্তিক তাহা হইলেও হিন্দু ধর্মের সহিত উভয়ের সংগ্রাম তীব্র ও ব্যাপক হয়নি।হিন্দুদের বর্ণাশ্রম হিন্দুদেব দেবী এবং হিন্দুর আচার নিয়ম তাহারা অনেকটা মানিয়া লইয়াছেন এবং রক্ষা করিয়াছেন। আজকের হিন্দু ভারত তাদের পূর্ব পুরুষদের কৃতকর্ম মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ধুয়া তুলসী পাতা হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারে একটি মিথ্যা বানোয়াট ও অমার্জনীয় তথ্য ঝুলিয়েরাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে… বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ খৃস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন।ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ  বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ দিয়েছে ১১০০ খৃস্টাব্দ। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার উদন্তপুরীআক্রমণ করেছেন ১১৯৩ খৃস্টাব্দে আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুভারত মুসলিম বিজেতাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য ইতিহাসের তথ্য বিকৃত করতেও কুণ্ঠিত নয়। প্রকৃত ঘটনা হল একজন ব্রাহ্মণ কর্তৃক সম্রাট হর্ষবর্ধনকে হত্যা তারপর ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ক্ষমতা দখল করেন। এই সময় ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে একদল উগ্রবাদী ধর্মোন্মাদ হিন্দু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস ও ভস্মীভূত করে। ৪০০ খৃষ্টাব্দে চীনা পর্যটক ফা হিয়েন যখন গান্ধারা সফর করেন তখন উত্তর ভারতে বিকাশমান বৌদ্ধ ধর্মের  গৌরবোজ্জল অধ্যায় দেখতে পান। কিন্তু ৬২৯ খৃস্টাব্দে অপর একজন চীনা বৌদ্ধ সন্নাসী ১২০ বছর পর নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। ৬২৯ সালে আর একজন চীনা পর্যটক গান্ধারা সফর করে বৌদ্ধবাদের করুণ পরিণতি দেখে মানসিকভাবে বিপন্ন হন।

 বখতিয়ার বৌদ্ধদের ওপর কোন ধরনের নির্যাতন করেছেন এমন কথা ইতিহাস বলে না বরং বৌদ্ধদের ডাকে বঙ্গ বিজয়ের জন্য বখতিয়ার সেনা
অভিযান পরিচালনা করেন।এমনকি বিজয়ান্তে তিনি বৌদ্ধদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় থেকে বিরত থাকেন। বাংলায় ১৪ শতকের অভিজ্ঞতা: ১২ শতকে বাংলার ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাব ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির উত্থান। ১৩ শতকের প্রথম দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার দুশ’ বছরের মধ্যে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিধ্বস্ত হিন্দু শক্তির উত্থান সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৫ শতকে রাজাগনেশের আকস্মিক উত্থান কিভাবে সম্ভব হল? এ জিজ্ঞাসার জবাব পেতে সমকালীন ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে। উপমহাদেশের বৌদ্ধবাদের উৎখাতের পর বহিরাগত আর্য অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এখানকার মূল অধিবাসীদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হলেও অপরাজেয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের উপস্থিতি তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। মূলত হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার খলজি বাংলার মানুষকে মুক্তি দান করেন।

অত্যাচারিত নির্যাতিত বৌদ্ধরা দুবাহু বাড়িয়ে বখতিয়ার খলজিদের স্বাগত জানালো। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়-‘বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরাব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্য ও নির্মূল অভিযানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলার মুসলিম বিজয়কে দু’বাহু বাড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ড. নিহার রঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস আধিপূর্বে উল্লেখ করেছেন-‘যে বঙ্গ ছিলো আর্য সভ্যতা ওসংস্কৃতির দিক দিয়ে কম গৌরবের ও কম আদরের সেই বঙ্গ নামেই শেষ পর্যন্ত
তথাকথিত পাঠান মুসলিম আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হলো।’ সবচাইতে মজার যে ব্যাপার সেটা হচ্ছে বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন  ১২০৪সালের ১০মে, স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩খৃস্টাব্দে। যে লোকটি ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গে প্রবেশ করেন সে কিভাবে ১১৯৩ খৃস্টাব্দে নালন্দা ধ্বংস করেন এটা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭জন সঙ্গী নিয়ে ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কৌশলে সেনরাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদে হামলা করেন।

 এসময় লক্ষণ সেন দুপুরের খাবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন-
তিনি বখতিয়ারের আগমনের খবর পেয়েভয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান, প্রায় বিনারক্তপাতে বঙ্গবিজয় করেন বখতিয়ার খলজি। সুতরাং বখতিয়ার কতৃক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ঘটনা একটা মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছু নয়। নালন্দার ধ্বংস হয় সর্বোমোট তিনবার, এর মধ্যে প্রথমবার মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা, দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী বাংলার শাসক শশাঙ্ক দ্বারা ও শেষবার অত্যাচারী সেনরাজাদের দ্বারা।

নালন্দাকে প্রথম দুইবার ধ্বংসস্তুপ থেকে দাঁড়করানো গেলেও তৃতীয়বার সম্ভব হয়নি গুপ্ত ও পাল রাজাদের মতো পৃষ্ঠপোষক না থাকায়। দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধদের ব্যাপকহারে দেশত্যাগ ও বৌদ্ধদের জ্ঞানার্জনের চেয়ে তান্ত্রিকতার প্রসারও এর জন্য দায়ী। অপরদিকে পাল রাজাদের হত্যা করে সেন হিন্দু ব্রাহ্মণরা ক্ষমতা দখল করে পাল রাজাদের হত্যা ও বিহার গুলো ধ্বংস করে ॥ ১২৬ বছর বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে॥ এবং করে বৌদ্ধের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে ॥ এবং সৃষ্টি করে বর্ণবাদী জাত প্রথা ॥ এর জন্য সেন রাজাদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাঁচতে দেশ ত্যাগ করে অসংখ্য বৌদ্ধ ॥
বখতিয়ার খলজির অভিযান ছিলো সেনরাজা লক্ষণসেনের বিরুদ্ধে, বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নয়। বৌদ্ধরা বখতিয়ারের অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছিলো। সুতরাং বিনা রক্তপাতে বঙ্গবিজয়ের পরে বৌদ্ধদের বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার কাহিনী মুসলিমবিজয়ীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার বৈ অন্য কিছু নয়।
তথ্যসূত্রঃ http://www.storyofbangladesh.com/…/dui-po…/93-chapter-1.html
http://www.shodalap.org/shams/8918/
http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=93844

No comments:

Post a Comment