চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল ও বাংলার প্রজা আন্দোলন
শনিবার ০৩ নবেম্বর ২০১২ | প্রিন্ট সংস্করণ
দৈনিক সংগ্রাম
র.ম. আওরঙ্গজেব : ইংরেজ আমলে ১৯৭৩ সালে বাংলার বড় লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। ফলে জমির মালিক হন জমিদাররা, অপরদিকে কৃষকরা জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ভিটে মাটি হারান। তখন জমিদাররা বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তানুসারে জমিদাররা ১৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে সরকারকে ৩ কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল। ১৯৩০-এর দশকে খাতাপত্রে ১৮ কোটি টাকা আদায় দেখিয়ে ৪৫ কোটি টাকা মজিদার ও আমলারা ভাগ করে নিত। সামর্থ্যের চেয়ে বেশি খাজনা দিয়ে কৃষকরা সর্বহারা হয়। মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে দাদন নিয়ে কৃষকরা আরও সর্বহারা হয়। ১৮৫৯ সালে বঙ্গীয় ভূমিকর আইনের আশ্রয় নিতে কৃষকরা ব্যর্থ হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফলের কারণে বাংলার কৃষকরা ইংরেজ সরকার ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেন। এটাই ইতিহাসে প্রজা আন্দোলন নামে পরিচিত। বিশ শতকের প্রথম পাদে এ আন্দোলন শুরু হয়ে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কৃষক প্রজার স্বার্থ রক্ষা না হওয়া অবধি চলতে থাকে। বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ কৃষক ও প্রজা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
সমগ্র বাংলায় ময়মনসিংহ জেলাতেই সর্বপ্রথম প্রজা আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় প্রজারা জমিদার কর্তৃক নানাভাবে জুলুম নির্যাতনের শিকার হতো। প্রজারা ইমারত নির্মাণ ও কূপ খনন করতে পারতো না। বার মাসে ১৩ প্রকার খাজনা দিতে হতো। খাজনা বাকি পড়লে তাদেরকে ভিটে মাটি হতে উচ্ছেদ করা হতো। এসবের প্রতিকারে ১৯১২ ঈসায়ী সালের ৪-৫ এপ্রিল মোতাবেক ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ২২-২৪ চৈত্র ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার শেরপুর থানার (বর্তমান শেরপুর জেলা) কামারিয়ার চরে বিশাল প্রজা সম্মীলনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রজা আন্দোলনের উদ্যোক্তা ছিলেন কামারিয়ার চরের খোশ মোহাম্মদ সরকার (পরে চৌধুরী খেতাব পান)। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার কে. আহাদ।
বজ্রকণ্ঠে বক্তব্য রাখেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মৌলভী আবুল কাশেম, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, বগুড়ার রাজীব উদ্দিন তরফদার, খান বাহাদুর আলিমুজ্জামান চৌধুরী, ময়মনসিংহের মওলানা খন্দকার আহমদ আলী আকলুবী প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, হক সাহেব এর আগে ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার এসডিও ছিলেন। সে সময়ই তিনি দরিদ্র প্রজাদের দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। সরকারের সাথে মতবিরোধের জের ধরে ১৯১১ ঈসায়ী সালে এ পদ থেকে ইস্তফা দেন। এ কারণে তার উপস্থিতি প্রজা সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করেছিল। কামারিয়ার চরের প্রজা সম্মিলিনীর পর থেকেই সারা বাংলায় প্রজা আন্দোলনের ঢেউ লাগে। ১৯১৮ ঈসায়ী সালের ২৮-৩০ নবেম্বর মোতাবেক ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ১৪-১৬ অগ্রহায়ণ নাসিম আলীর সভাপতিত্বে কামারিয়ার চরে দ্বিতীয়বার প্রজা সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। কামারিয়ার চরে তৃতীয় ও সর্বশেষ কৃষক, প্রজা ও রায়ত সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯২১ ঈসায়ী সালের ৮-১০ এপ্রিল মোতাবেক ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ২৫-২৭ চৈত্র। এতে সভাপতিত্ব করেন এ কে ফজলুল হক। খোশ মোহাম্মদ সরকার প্রতিটি সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিলেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব ও তাদের অত্যাচার হতে প্রজাদেরকে রক্ষা করা। জমির মালিক হবে কৃষক, প্রজা, রায়ত সাধারণ। কামারিয়ার চরে তিনটি সফল প্রজা সম্মেলনের ৩ মাসের মধ্যে কৃষক ও প্রজারা পুকুর খনন, গাছ কাটা, ইমারত ও ইদারা নির্মাণ করার অনুমতি পায় এবং বারোয়ারী খাজনা রহিত হয়।
১৯১৫ বরিশালে প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২১ সালে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়ায় খান বাহাদুর হাশিম আলী খানের সভাপতিত্বে প্রজা সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে ঢাকায় একে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে প্রজা সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এ সম্মেলনেই দরিদ্র প্রজাদের স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক সংগঠন নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে প্রজা আন্দোলন রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে নবউদ্যমে চলতে থাকে। ১৯২৬ সালে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার ঘিওরে প্রজা সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন একে ফজলুল হক। এরপর হতে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির উদ্যোগে প্রজা আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে। ১৯২৭ সালে হক বঙ্গীয় আইন সভায় মানিকগঞ্জ হতে সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর চেষ্টায় ও প্রজা আন্দোলনের প্রভাবে ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় আইনসভায় বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয় জমিদারদের স্বার্থ রক্ষাকারী কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতা সত্ত্বেও।
সমগ্র বাংলায় ময়মনসিংহ জেলায় নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি সুসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের নেতৃত্বে অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ময়মনসিংহের মোক্তার আব্দুল হাকিম, শ্রীযুক্ত প্রমথ চন্দ্র বসু, উকিল কলম আলী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী, মৌলভী মজিবর রহমান খাঁ ফুলপুরী, জামালপুরের তৈয়ব আলী উকিল ও মৌলভী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, টাঙ্গাইলের উকিল মৌ: খোন্দকার আব্দুস সামাদ, উকিল খোদা বক্স, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, নেত্রকোনার আব্দুর রহিম উকিল, আব্দুস সামাদ তালুকদার, কিশোরগঞ্জের আফতাবউদ্দিন আহমেদ, ইসরাইল উকিল ও আবু আহমেদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রজা সমিতিতে যোগদান করেন। ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান খান বাহাদুর ইসমাইল খাঁ সাহেব প্রজা সমিতির সমর্থক হন। পরে অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলমান মন্ত্রী ধনবাড়ির জমিদার নওয়াব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী ও ময়মনসিংহ নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল মজিদ যোগদান করলে প্রজা সমিতির শক্তি বৃদ্ধি পায়। এ দু'জনের আর্থিক সাহায্যে ও আবুল মনসুর আহমদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ থেকে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির মুখপত্র সাপ্তাহিক চাষী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মৌলভী মজিবর রহমান খাঁ ফুলপুরীর সম্পাদনায় পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা ১৯৩৬ সালের ২৬ জুন প্রজা সমিতির নিজস্ব ছাপাখানা মিলন প্রেস, ময়মনসিংহ হতে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকাটি প্রজা সমিতির প্রচার, প্রসার ও প্রজা আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে সিরাজগঞ্জে মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানীর একক উদ্যোগে বিশাল প্রজা সম্মেলন হয়। সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও সম্মেলনে ১৪৪ ধারা জারি করলে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খান বাহাদুর আব্দুল মমিন গভর্নরের সাথে দেন-দরবার করলে এসডিও সাহেব ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করেন। পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হলে সারা বাংলার নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির নেতা-কর্মীরা এতে যোগদান করলে তা জাতীয় সম্মেলনে রূপ নেয়।
ময়মনসিংহ হতে আবুল মনসুর আহমদ ও অন্য সকল নেতৃবৃন্দ বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়ে সিরাজগঞ্জে আসেন। খান বাহাদুর আব্দুল মমিনের সভাপতিত্বে সম্মেলন উদ্বোধন করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বক্তব্য রাখেন মহাত্মা করম চাঁদ গান্ধী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বিপিন পাল, চিত্তরঞ্জন দাস, অধ্যাপক জেএল বন্দোপাধ্যায়, মৌলভী বজলুল হক, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা আকরম খাঁ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আব্দল্লাহেল কাফী, মওলানা আব্দল্লাহেল বাকী, ময়মনসিংহের আহমদ আলী আকালুবী ও মওলানা বিলায়েত হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তখনো মাইকের প্রচলন না হওয়ায় সম্মেলনস্থলের মাঝখানে নির্মিত মঞ্চে বক্তারা যাত্রাগানের মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বড় গলায় বক্তব্য দেন। সিরাজগঞ্জের প্রজা সম্মেলনে জমিদারী উচ্ছেদ, খাজনার নিরিখ হ্রাস, নজর সেলামী বাতিল, জমিদারদের পিরেমশানিধিকার রদ, মহাজনের সুদের হার নির্ধারণ, চক্রবৃদ্ধি সুদ বাতিল ইত্যাদি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
হেমন্ত কুমার সরকার ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়াতে তিনটি প্রজা সম্মেলন আয়োজন করেন। ১৯২৭ সালে কুষ্টিয়াতে নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলনে হেমন্ত কুমার সরকারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কমিউনিস্ট নেতা সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর, ফিলিপ স্প্যার্ট প্রমুখ। ১৯২৮ সালে কুষ্টিয়ার যতীন্দ্র মোহন হলে আঞ্চলিক প্রজা সম্মেলনে কমরেড মোজ্জাফ্ফর আহমেদের সভাপতিত্বে হেমন্ত কুমার সরকার, ফিলিপ স্প্যার্ট বক্তব্য রাখেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কৃষাণের গান পরিবেশন করেন। কুষ্টিয়াতে শেষে প্রজা সম্মেলন হয় ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসে। হেমন্ত কুমার সরকারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কমরেড মোজ্জাফ্ফর আহমেদ, আব্দুল হালিম, ফিলিপ স্প্যার্ট প্রমুখ। হেমন্ত কুমার সরকারের আমন্ত্রণে এসব সম্মেলনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম কৃষক, শ্রমিক ও তরুণদের উজ্জীবিত করার জন্য জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন এবং কৃষানের গান, জেলেদের গান, শ্রমিকের গান পরিবেশন করেন।
১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সকল দলের সকল শ্রেণীর নেতাদের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল এরকম সাফল্যমন্ডিত প্রজা সম্মেলন বাংলায় আর হয়নি। সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে সুসাহিত্যিক ও আইনবিদ ডা. নরেন্দ্র চন্দ্র সেনগুপ্ত, সহ-সভাপতি খান বাহাদুর ইসমাইল এবং সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। প্রজা সম্মেলন আয়োজনে সার্বিক সহায়তা করেন ময়মনসিংহ পৌরসভার চেয়ারম্যান ডা. বিপিন বিহারী সেন, সূর্য কুমার সোম, নূরুল আমিন, আব্দুল মোমেন খান, ছমেদ আলী, তৈয়ব উদ্দিন আহমদ, গিয়াস উদ্দিন পাঠান এবং মোয়াজ্জেম হোসেন খান প্রমুখ প্রজা নেতৃবৃন্দ।
সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতিতে যোগদান না করেই এ সম্মেলনে সহায়তা করেন। প্রজা সমিতি, কংগ্রেস ও আঞ্জুমান কর্মীরা সকলেই সহযোগিতা করেন। ময়মনসিংহ জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান শরফুদ্দিন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেননি। ময়মনসিংহ শহরের ছোট বাজার ও বড় বাজারের মাঝখানে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ দেন নলিনী রঞ্জন সরকার। স্বাগত ভাষণ দেন কৃষিমন্ত্রী কেজিএম ফারুকী। এ প্রজা সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনী। এতে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্পী, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা স্টল নির্মাণ করে। প্রদর্শনীর প্রবেশ পথে সুউচ্চ মিনারযুক্ত তিনটি তোরণ নির্মিত হয়েছিল। প্যান্ডেলের ঠিক উপরে মাঝখানে ২০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট সুদৃশ্য গম্বুজ ছিল সোনালী কাগজে মোড়া যা বহুদূর হতে দৃষ্টিগোচর হতো।
১৯৩৫ সালে স্যার আব্দুর রহিম আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হলে একে ফজলুল হক নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি হন। ১৯৩৬ সালের ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে নিখিল চন্দ্র প্রজা সমিতির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি)। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কেএসপির কর্মসূচি ছিল বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদ, ডাল ভাতের ব্যবস্থা ও লাঙ্গল যার জমি তার। ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ৩৮, কেএসপি ৪৩, স্বতন্ত্র ৪১ আসন পায়। অবশেষে মুসলিম লীগ ও কেএসপির কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। একে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পলাশীর যুদ্ধের ১৮০ বছর পর বাংলার রাজধানী কলিকাতায় পুনরায় মুসলিম শাসন ফিরে আসে জনগণের ভোটে।
১৯৩৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল মহকুমার গোপালপুর থানার ভেঙ্গুলা গ্রামে সর্বশেষ কৃষক প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মধুপুর গোপালপুর হতে নির্বাচিত আইনসভার সদস্য ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী সম্মেলনের সাফল্যের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেন এবং আর্থিক খরচ নির্বাহ করেন। অজপাড়া গাঁ ভেঙ্গুলায় সুন্দর মঞ্চ, সুবিশাল প্যান্ডেল, দুই ডজন লাউড স্পীকার, একাধিক মাইক্রোফোন লাগানো হয়। আগত নেতৃবৃন্দের থাকা-খাওয়ার এমন সুবন্দোবস্ত কোন প্রজা সম্মেলনে হয়নি। ডেলিগেট দলসহ ১০ লক্ষাধিক লোক সমাগত হয়েছিল। সম্মেলনের দিন সরিষাবাড়ীর পিংনা স্টিমার ঘাটে স্থানীয় বিবাহ রেজিস্ট্রারের নেতৃত্ব ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ভেঙ্গুলা প্রজা সম্মেলনে আসার পথে আগত নেতৃবৃন্দকে কালো নিশান দেখানোর চেষ্টা করলে জনতা বাধা দেয। অপরদিকে করটিয়ার জমিদার মসউদ আলী খান পন্নী একদল লোক নিয়ে গন্ডগোল করতে আসলে জনতা বাধা দেয়। এ দু'টি ঘটনার মাধ্যমে প্রজা আন্দোলনের জনপ্রিয়তা বুঝা যায়। এরপর প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রজা আন্দোলন সমগ্র বাংলায় ঝিমিয়ে পড়ে।
বাংলার প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক সাহেব অনেক সংকটের মধ্যেও দরিদ্র প্রজাদের স্বার্থে অনেক ভাল কাজ করেন। ১৯৩৮ সালে ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন, ১৯৩৯ সালে প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৪০ সালের মহাজনী আইন, স্কুল বোর্ড স্থাপন, অবহেলিত মুসলমানদের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। হক সাহেবের উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ফ্রান্সিস ফ্লাউডকে চেয়ারম্যান করে ভূমি রাজস্ব কমিশন গঠন। এই কমিশন অবশেষে ১৯৪০ সালে জমিদারী প্রথা বাতিলের সুপারিশ করেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালে জমিদারী প্রমা চিরতরে বিলুপ্ত হয়। যার ফলে দরিদ্র কৃষক, প্রজাদের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। এসবই পাঁচ দশকব্যাপী চলতে থাকা প্রজা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল।
No comments:
Post a Comment