Saturday 24 June 2017

পলাশী পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা।



পলাশী পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা।

বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস বই থেকে ।
বাংলার মুসলমানদের অধঃপতন কোন কোন পথে নেমে এসেছিল এবং রংগমঞ্চের অন্তরাল থেকে কোন অশুভ শক্তি ইন্ধন যোগাচ্ছিল, তা সম্যক উপলব্ধি করতে হলে আমাদের জানতে হবে তৎকালে তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ ও সংস্কৃতি কতখানি বিকৃত হয়ে পড়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে বাংলার মুসলমানদের আকীদাহ বিশ্বাস, সমাজ ও সংস্কৃতিতে পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বাংলার শাসনকর্তা আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সময় থেকে। হিন্দু রেনেসাঁ আন্দোলনের ধারক ও বাহকদের দ্বারা পরিপূর্ণ ও পরিবেষ্টিত মন্ত্রীসভার দ্বারা পরিচালিত হোসেন শাহ শ্রীচৈতন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণের বর্ণিত এ কথা সত্য হলে অতঃপর হোসেন শাহের তৌহিদের প্রতি বিশ্বাস কতটুকু ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষ্ণববাদের প্রবল প্লাবন বাংলার মানক সমাজকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিম্নশ্রেণীর হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানকে সহজেই আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল হিন্দু তান্ত্রিকদের অপরাধমূলক অশ্লীল ও জঘন্য সাধন পদ্ধতি, বামাচারীদের পঞ্চতত্ত্ব অর্থাৎ যৌনধর্মী নোংরা আচার অনুষ্ঠান, বৈষ্ণবদের প্রেমলীলা প্রভৃতি। এসব আচার অনুষ্ঠান ও প্রেমলীলা হিন্দু সমাজের পবিত্রতা, রুচিবোধ ও নৈতিক অনুভূতি বহুলাংশে বিনষ্ট করলেও নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভংগের এ অস্ত্র ধর্মবিশ্বাসে ঘুণ ধরিয়েছিল এ সময়ের মুসলিম নামধারী কবি-সাহিত্যিকগণ যাদের কাষ্ঠপুত্তলিকা হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন, বাংলা ভাষার উন্নয়নের নামে প্রকৃতপক্ষে হিন্দু রেনেসাঁ আন্দোলনের ধ্বজাবাহীগণ। দ্বিতীয় যুগের হিন্দু কবিগণকে আর্দশ হিসাবে গ্রহণ করে এসব মুসলিম কবিগণ হিন্দু দেব-দেবীর স্তূতিমূলক কবিতা, পদাবলী ও সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়। তারা শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলা, যৌন আবেদনমূলক কীর্তন, মনসার ভাসান সংগীত, দুর্গা ও গঙ্গার স্তোত্র ও হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনের বহু পুঁথিপুস্তক রচনা করে।

শেখ ফয়যুল্লাহ ‘গোরক্ষ বিজয়’ নামক একখানি মহাকাব্য রচনা করে বাংলার নাথ সম্প্রদায় ও কোলকাতা কালীমন্দির প্রতিষ্ঠাতা গোরক্ষ নাথ ও তার নাথ অনুরক্ত হয়ে সংস্কৃত ভাষায় গঙ্গাস্তোত্র রচনা করে- (বঙ্গভাষা ও সাহিত্যঃ দীনেশ চন্দ্র সেন)। অনুরূপভাবে আবদুস শুকুর ও সৈয়দ সুলতান শৈব ও তান্ত্রিক মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে সাহিত্য রচনা করে। (গোলাম রসূল কর্তৃক প্রকাশিত শুকুর মাহমুদের পাঁচালি দ্রষ্টব্য)।

কবি আলাউল ও মীর্জা হাফেজ যথাক্রমে শিব ও কালীর স্তবস্তুতি বর্ণনা করে কবিতা রচনা করে (বঙ্গভাষা ও সাহিত্যঃ দীণেশ চন্দ্র সেন)। সৈয়দ সুলতান নবী বংশের তালিকায় ব্রক্ষ্ম, বিষ্ণু, শিব এবং কৃষ্ণকে সন্নিবেশিত করে- (ব্রিটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমানঃ এ আর মল্লিক)। হোসেন শাহের আমলে সত্য নারায়ণকে সত্যপীর নাম দিয়ে মুসলমানগণ পূঝা শুরু করে। পূর্বে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

উপরোক্ত কবি-সাহিত্যিকগণের ধর্মমত ও জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে কিছু জানবার উপায় নেই। সাহিত্যক্ষেত্রে শুধু তাদের নাম পাওয়া যায়। হয়তো তারা ধর্মান্তরিত মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে মাত্র এবং পরিপূর্ণ হিন্দু পরিবেশে তাদের জীবন গড়ে উঠেছে। অথবা মুসলমান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে হরিদাসের ন্যায় মুরতাদ হয়ে গেছে। তবে তাদের কবিতা সাহিত্য পাঁচালি সংগীত প্রভৃতি তৎকালীন মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।

পরবর্তীকালে ইসলাম-বৈরীগণ বাদশাহ আকবরকে তাদের অভীষ্ট সাধনে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। জয়পুরের রাজা বিহারীমলের সুন্দরী রূপসী কন্যা যোধবাই আকবরের মহিষী হিসাবে মোগল হারেমের শোভাবর্ধণ করে। আকবরের একাধিক হিন্দু পত্নী ছিল বলে জানা যায়। তৎকালে হিন্দু রাজাগণ আকবরের কাছে তাদের কন্যা সম্প্রদান করে তাঁকে তাঁদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এসব হিন্দু পত্নীগণকে রাজপ্রাসাদের মধ্যে মূর্তিপূজা ও যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়। মুসলমান মোগল বাদশাহের শাহী মহল মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজার মন্দিরে পরিণত হয়। এভাবে আকবরের উপরে শুধু হিন্দু মহিষীগণই নয়, হিন্দু ধর্মেরও বিরাট প্রভাব পড়েছিল। এসব মহিষীর গর্ভে যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করে এহেন পরিবেশে জ্ঞানচক্ষু খুলেছে, পালিত-বর্ধিত হয়েছে, তাদের মনমানসিকতার উপরে পৌত্তলিকতার প্রত্যক্ষ প্রভাব কতখানি ছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়। এর স্বাভাবিক পরিণাম হিসাবে আমরা দেখতে পাই, হিন্দু মহিষীর গর্ভজাত সম্রাট জাহাঙ্গীর দেওয়ালী পূজা করতেন এবং শিবরাত্রিতে ব্রাক্ষ্মণ পন্ডিত ও যোগীদেরকে তাঁর সাথে একত্রে নৈশভোজে নিমন্ত্রিত করতেন। তাঁর শাসনের অষ্টম বৎসরে আকবরের সমাধি সৌধ সেকেন্দ্রায় হিন্দু মতানুসারে পিতার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালন করেন।

শাহজাহান পুত্র দারা শিকোহ তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘মাজমাউল বাহরাইনে’ হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাবে আলীবর্দী খানের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহামত জংগে এবং সাওলান জং মতিঝিল রাজপ্রাসাদে সাতদিন ধরে হোলিপূজার অনুষ্ঠান পালন করেন। এ অনুষ্ঠানে আবির ও কুমকুম স্তূপীকৃত করা হয়। মীর জাফরও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ হোলির অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন। কথিত আছে যে, মীর জাফর মৃত্যুকালে কীরিটেশ্বরী দেবীর পদোদক (মূর্তি ধোয়া পানি) পান করেন। (‘ব্রিটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমান’ : এ আর মল্লিক; ‘মুসলেম বংগের সামাজকি ইতিহাস’ : মওলানা আকরাম খাঁ)

হোলি বলতে গেলে শ্রকৃষ্ণের দোল উৎসর। শ্রীকৃষ্ণের অবতার শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণববাদ প্রতিষ্ঠিতক করেন। তাদের পূজা অনুষ্ঠানের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের দোলউৎসব অন্যতম। অতএব বৈষ্ণববাদের প্রভাব যে মুসলিম সমাজের মূলে তখন প্রবেশ করেছিল, উপরের বর্ণনায় তা স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়।

মুসলিম সমাজের এহেন ধর্মীয় অধঃপতনের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, মুসলিম সমাজে পৌত্তলিক ভাবধারা অনুপ্রবেশের প্রধানতম কারণ হলো ভারতীয় নও-মুসলিমদের পৌত্তলিক থেকে অর্ধমুসলমান (Half-Conversion) হওয়া। অর্থাৎ একজন পৌত্তলিক ইসলামকে না বুঝেই মুসলমান হয়। অতঃপর তার কোন ইসলামী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি। হয়নি তার চিন্তাধারার পরিশুদ্ধি। পৌত্তলিকতার অসারতা ও তার বিপরীত ইসলামের সত্যতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভের সুযোগ তার হয়নি। ইসলামী পরিবেশের মদ্যে জীবনযাপন করে আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র ও মনমানসিকতার পরিবর্তন ও সংমোধন হয়নি। তাই এ ধরনের মুসলমান হিন্দুর দুর্গোৎসবের অনুকরণে শবে বরাতে আলোকসজ্জা ও বাজীপোড়ানো প্রভৃতির মাধ্যমে হয়তো কিছুটা আনন্দ লাভের চেষ্ট করে। আকবর, জাহাঙ্গীর ও বাংলার পরবর্তী শাসকগণ প্রকাশ্যে হিন্দু পূজার অনুষ্ঠানে যোগদান করতে দ্বিধাবোধ করেননি।

ঐতিহাসিক এম. গ্রাসিন ডি ট্যাসিন বলেন, মহররমের তাজিয়া অবিকল হিন্দু দুর্গাপুজার অনুকরণ। দুর্গোৎসব যেমন দশ দিন ধরে চলে এবং শেষ দিন ঢাক-ঢোল বাদ্যবাজনাসহ পূজারিগণ প্রতিমাসহ মিছিল করতঃ তাকে নদী অথবা পুকুরে বিসর্জন দেয়, মুসলমানগণও অনুরূপভাবে দশ দিন ধরে মহররমের উৎসব পালন করে। মেষ দিন দুর্গা বিসর্জনের ন্যায় ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মিছিল করে তাজিয়া পানিতে বিসর্জন দেয়া হয়।

ডাঃ জেমস ওয়াইজ মহররম উৎসবকে হিন্দুদের রথযাত্রা উৎসবের অনুরূপ বলে বর্ণনা করেছেন। মিসেস এইচ আলী বলেন, দীর্ঘনিদ হিন্দুনের সংস্পর্শে থেকে মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলিকে হিন্দুদের অনুকরণে মিছিলের আকারে বাহ্যিক জাঁক-জমকপূর্ণ করে তুলেছে। ইউরোপীয়দের ন্যায় বিদেশী মুসলমানগণ বাংলার মুসলমানদের এ ধরনের ধর্মীয় উৎসবাদিকে ইসলামের বিকৃতকরণ ও অপবিত্রকরণ মনে করেছেন। (বৃটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমানঃ এ আর মল্লিক)।

ইসলাম ও মুসলমানদের এহেন পতন যুদে পীরপূজা ও কবরপূজার ব্যাধি মুসলমান সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক এম টি টিটাসের মতে এ কুসংস্কার আফগানিস্তান, পারস্য ও ইরাক থেকে আমদানী করা হয়। হিন্দুদের প্রাচীন গুরু-চেলা পদ্ধতি এবং স্থানীয় বহু দেব-দেবীর পূজায় তাদের অদম্য বিশ্বাস মুসলিম সমাজকে এ কুসংস্কারে লিপ্ত হতে প্রেরণা যোগায়। তিনি বলেন, ইসলামের বাধ্যতামূলক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান অপেক্ষা বহুগুণ উৎসাহ উদ্যম সহকারে তারা পীরপূজা করে। অতীতে যে সকল অলীদরবেশ ইসলামের মহান বাণী প্রচার করে গেছেন, পরবর্তীকালে অজ্ঞ মুসলমান তাঁদেরই কবরের পূজার কেন্দ্র বানিয়েছে।

একমাত্র বাংলায় যেসব অলীদরবেশের কবরে মুসলমানগণ তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য ফুলশির্ণি ও নজর-নিয়াজ দিত, তার সংখ্যা ডাঃ জেমস ওয়াইজ নিম্নরূপ বলেনঃ

সিলেটের শাহ জালাল, পাঁচ পীর, মুন্নাশাহ দরবেশ, সোনার গাঁয়ের খোন্দকার মুহাম্মদ ইউসূফ, মীরপুরের শাহ আলী বাগদাদী, চট্টগ্রামের পীর বদর, ঢাকার শাহ জালাল এবং বিক্রমপুরের আদম শহীদ। চট্টগ্রামে বায়েজিদ বুস্তামীর দরগাহ বলে কথিত, হয়তো একেবারে কল্পিত একটি দরগাহ আছে তা সম্ভবতঃ ডাঃ জেমস ওয়াইজের পরবর্তীকালে আবিস্কৃত হয়েছে।

বাংলা বিহারে এ ধরনের বহু দরগার উল্লেখ –ব্লকম্যানের গ্রন্থে আছে।

সোনার গাঁয়ের হিন্দু মুসলমান উভয়ে পূজাপার্বণ করতো বলে কথিত আছে। কৃষক ভালো ধান্য-ফসল লাভ করতে কয়েক আঁটি ধান দরগায় দিয়ে আসতো। সকল প্রকার ব্যাধি ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে দরগায় চাউল ও বাতাস দেয়া হতো।

ঢাকা শহরের পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে একটি দরগায় কালো রঙ্গের একটি প্রস্তর রাখা ছিল যাকে বলা হতো কদম রসূল (নবীর (সা) পদচিহ্ন)। অদ্যাবধি তা বিদ্যমান আছে বলে বলা হয়। ডাঃ জেমস ওয়াইজ বলেন, গয়ার ব্রাক্ষ্মণগণ তীর্থযাত্রীদেরকে বিষ্ণুপদ (বিষ্ণুর পদচিহ্ন) দেখিয়ে প্রচুর অর্থ রোজগার করে। অনুরূপভাবে দরগার মুতাওয়াল্লী গ্রামের অজ্ঞ ও বিশ্বাসপ্রবণ লোকদেরকে কদমরসূল দেখিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে।

আজমীরে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রহ) মাজারের গিলাফ সরিয়ে বেহেশতের দরজা (?) দেখিয়ে মাজারের দালালগণ জিয়ারতকারীদের নিকট থেকে প্রচুর অর্থ রোজগার করে।

এ ধরনের অসংখ্য অগণিত কবর ও দরগাহ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা পরিপূর্ণ করে দেয় এক শ্রেণীর ভণ্ড পীর-ফকীরের দল। এমনকি ধর্মের নামে তারা বৈষ্ণব ও বামাচারী তান্ত্রিকদের অনুকরণে যৌন অনাচারের আমদানীও করে। মুসলমান নামে তারা যে মত ও পথ অবলম্বন করে তার উৎস যেহেতু বাংলার বৈষ্ণববাদ, সেজন্যে বৈষ্ণবদের আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির কিঞ্চিৎ উল্লেখ এখানে প্রয়োজন মনে করি। মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর গ্রন্থ থেকে কিঞ্চিৎ পাঠকগণকে পরিবেশন করছি।

“চৈতন্যদেব হইতেছেন বাংলার বৈষ্ণবদের চৈতন্য সম্প্রদায়ের পূজিত দেবতা। হিন্দুদের সাধঅরণ বিশ্বাস অনুযায়ী চৈতন্য শ্রীকৃষ্ণের একজন অবতার অথবা পরিপূর্ণ অর্থেই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। এই কারণেই তাঁহার ভক্তগণ, তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার সত্তা হইতে মানুষ চৈতন্যকে বাদ দিয়া তাঁকাকে সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণচৈতন্যে উন্নীত করে এবং অতি মারাত্মকভাবে কৃষ্ণের প্রেমলীলার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। ধর্মের নামে নেড়া-নেড়ী তথা মুন্ডিত কেশ বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের মধ্যে যে জঘন্য যৌন অনাচারের শ্রোত বহিয়া চলে, তাহা পুরাণে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের যৌন আবেগমূলক প্রণয়লীলার পুনরাবৃত্তি বা প্রতিরূপ ব্যতীত কিছুই নহে।

তান্ত্রিক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দিতেছেন যে, কলিকালে (বর্তমান যুগে) মদ্যপান শুধু সিদ্ধই নহে বরং মদ্যপারেন রীতি প্রচলিত ছিল, তেমনি এই কলি যুগেও বর্ণধর্ম নির্বিশেষে তোমরা ইহা পান করিবে- (মহানির্বাণতন্ত্র, ৪র্থ উল্লাস, ৫৬ শৎ শ্লোক)”।

‘মহাদেব গোরীকে বলিতেছেনঃ পাথবে বীজ বপন করিলে তাহার অংকুরিত হওয়া যেমন অসম্ভব, পঞ্চতত্ত্ব ব্যতীত পূজা উপাসনাও তেমনি নিষ্ফল। অধিকন্তু পঞ্চতত্ত্ব ব্যতীত পূজা উপাসনা করিলে পূজারীকে নানা বিপদ আপদ ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হইতে হয়- (মহানির্বাণতন্ত্র, ৫ম উল্লাস, ২৩-২৪ শ্লোক)’।

মহাদেবের নিজমুখে এ পঞ্চতত্ত্ব রহস্যের ব্যাখ্যা শ্রবণ করিতে আমরা পাঠকগণকে আমন্ত্রণ জানাইতেছিঃ

‘হে আদ্যে, শক্তিপূজা পদ্ধতিতে অপরিহার্য্য করণীয় হিসেবে মদ্যপান মাংস, মৎস্য ও মুদ্রাভক্ষণ এবং সংগরেম নির্দেশ দেয়া যাইতেছে’।

(মদ্যং মাংসর ততো মৎস্যং মৈথুনে মেরচ শক্তিপূজা বিবাবাদ্যে পঞ্চতত্ত্বং প্রকৃতিতম –মহানির্বাণতন্ত্র, ৫ম উল্লাস, ২২ শ্লোক)।

“আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ বামাচারী তান্ত্রিকদের এই পূজা পদ্ধতি সম্পর্কে লিখিতেছেনঃ বামাচারীগণ বেদবিরুদ্ধ এই সকল মহা অধর্মের কার্যকে পরম ধর্মরূপে গ্রহণ করিয়াছে। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও যৌন সংগমের এক বিস্বাদ মিশ্রণকে তাহারা বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে করে। পঞ্চতত্ত্ব অর্থাৎ যৌন সংগমের ব্যাপারে প্রত্যেক পুরুষ নিজেকে শিব ও প্রত্যেক নারীকে পার্বথী কল্পনা করিয়া… মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবেই সংগমে লিপ্ত হইতে পারে। ঋতুবতী স্ত্রীলোকের সহিত সংগম শাস্ত্রে নিষিদ্ধ আছে। কিন্তু বামাচারীগণ তাহাদিগকে অর্থাৎ রজস্বলা স্ত্রীলোকদিগকে অতি পবিত্র জ্ঞান করেন।

“বামাচারীদের শাস্ত্র রুদ্রমংগলতন্ত্রে বলা হইয়াছেঃ রজস্বলার সহিত সংগম পুকুরে স্নাসতুল্য, চন্ডালী সংগম কাশীযাত্রার তুল্য, চর্মকারিনীর সহিত সংগম প্রয়াগে স্নানের তুল্য, রজকী সংগম মথুরা যাত্রার তুল্য এবং ব্যাধ কন্যার সহিত সংগম অযোধ্যা তীর্থ পর্যটনের তুল্য”।

“যখন বামাচারীরা ভৈরবী চক্রে (নির্বিচারে অবাধে যৌনসম্ভোগের জন্য মিলিত নরনারীদের একটি চক্র) মিলিত হয়, তখন ব্রাক্ষ্মণ-চন্ডালের কোন ভেদ থাকেনা। একদল নরনারী অন্যলোকের অগম্য একটি নির্জনস্থানে মিলিত হইয়া ভৈরবীচত্র নামে একটি চক্র রচনা করিয়া উপবেশন করে অথবা দন্ডায়মান হয়। এই কামুকদের সকল পুরুষ একজন স্ত্রীলোককে বাছিয়া লইয়া তাহাকে বিবস্ত্র করিয়া তাহার পূজা করে। অনুরূপ সকল নারী একজন পুরুষকে বাছিয়া বাহির করে এবং তাহাকে উলংগ করিয়া পূজা করে। পূজাপর্ব শেষ হওয়ার পর শুরু হয় উদ্দাম মদ্যপানের পালা। মদ্যপারেন ফলে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইলে পরিধানের সকল বস্ত্র ছুড়িয়া ফেলিয়া তাহারা সম্পূর্ণ উলংগ হইয়া পড়ে এবং যাহাকে যাহার ইচ্ছা তাহার সহিত এবং যতজনের সংগে সম্ভব ততজনের অবাধ যৌন সংগমে মাতিয়া উঠে –যৌন সংগী যদি মাতা, ভগ্নি অথবা কন্যাও হয় তাহাতেও তাহাদের কিছু যায় আসেনা। বামাচারীদের তন্ত্রশাস্ত্রে এইরূপ বিধান করা হইয়াছে যে, একমাত্র মাতা ব্যতীত যৌন সংগম হইতে অবশ্যই অন্য কোন নারীকে বাদ দিবেনা এবং কন্যা হউক অথবা ভগ্নি হউক আর সকল নারীর সংগেই যৌন কার্য করিবে। (জ্ঞান সংকলনীতন্ত্রঃ মাতৃং যোনিং পরিত্যাজ্য বিহারেং সর্বষোনীষু)। -এসব বৈষ্ণবতান্ত্রিক বামাচারীদের আরও এত জঘন্য অশ্লীল ক্রিয়াকলাপ আছে যে তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়”। -(মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস, মওলানা আকরাম খাঁ)।

উপরে বর্ণিত জঘন্য ও নোংরা পরিবেশের প্রভাবে বাংলার তৎকালীন মুসলিম সমাজ ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতন এবং সামাজিক ও তামাদ্দুনিক বিশৃংখলার এক অতি শোচনীয় স্তরে নেমে আসে। এ অধঃপতনের চিত্র পাঠন সমাজে পরিস্ফুট করে তুলে ধরতে হলে এখানে মুসলমান নামধারী মারফতী বা নেড়ার পীর-ফকীরদের সাধন পদ্ধতির উল্লেখ প্রয়োজন। এ ভন্ড ফকীরের দল বিভিন্ন সম্পদ্রায় ও উপসম্পদ্রায়ে বিভক্ত ছিল। যথা আউল, বাউল, কর্তাভজা, সহজিয়া প্রভৃতি। এগুলি হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব ও চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ যাতে করে সাধারণ অজ্ঞ মুসলমানদেরকে বিপথগামী করা যায়।

এদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। মদ্য পান, নারীপুরুষে অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্পদায়েরই সাধনপদ্ধতির মধ্যে অনিবার্যরূপে শামিল। তবে বাউলগণ উপরে বর্ণিত তান্ত্রিক বামাচারীদের ন্যায় যৌনসংগমকে যৌনপূজা বা প্রকৃত পূজা রূপে জ্ঞান করে। তাদের এ যৌনপূজার মধ্যে ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ নামে একটি অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। একে তারা একটি অনিবার্য পবিত্র মনে করে। তাদের মতে মানুষ এ চাচিচন্দ্র বা মানব দেহের নির্যাস যথা রক্ত, বীর্য, মল ও মুত্র পিতার অন্ডকোষ ও মাতার গর্ভ থেকে লাভ করে থাকে। অতএব এ চারিচন্দ্র সাধনের সাথে ‘পঞ্চরস সাধন’ও করে থাকে। পঞ্চরস হচ্ছে তাদের ভাষায় কালো সাদা লাল হলুদ ও মুর্শিদবাক্য। এ চারবর্ণ যথাক্রমে মদ, বীর্য, রজঃ ও মলের অর্থজ্ঞাপক। আপন স্ত্রী অথবা পরস্ত্রীর সাথে সংগমের পর তারা মুর্শিববাক্য পালনে এ চারবর্ণের পদার্থ ভক্ষণ করে থাকে।

শ্রদ্ধেয় মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর উপরে বর্ণিত গ্রন্থে এসব বাউলদের সম্পর্কে বলেনঃ

“কোরআন মজিদের বিভিন্ন শব্দ ও মূলতত্বের যে ব্যাখ্যা এই সমস্ত শয়তান নেড়ার ফকীরের দল দিয়াছে, তাহাও অদ্ভুত। ‘হাওজে কাওসার’ বলিতে তারা বেহেশতী সঞ্জীবনী সুধার পরিবর্তে স্ত্রীলোকের রজঃ বা ঋতুশ্রাব বুঝে। যে পূজাপদ্ধতিতে এ ঘৃণ্য ফকীরের দল বীর্য পান করে, তাহার সূচনায় বীজ মে আল্লাহ (মায়াযাল্লাহ, মায়াযাল্লাহ) অর্থাৎ বীর্যে আল্লাহ অবস্থান করেন –এই অর্থে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করে থাকে।

“এই মুসলিম ভিক্ষোপবীজী নেড়ার ফকীরর দলের পুরোহিত বা পীরেরা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপিনীদের বস্ত্র হরণের অনুরূপ এক অভিনয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। যখন পীর তাহার মুরীদানের বাড়ী তশরীফ আনে, তখন গ্রামের সকল যুবতী ও কুমার উত্তম বসনে সজ্জিত হইয়া, বৃন্দাবনের গোপিনীদের অনুকরণে একটি গৃহকক্ষে পীরের সহিত মিলিত হয়। নাটকের প্রথম অংকে এই সকল স্ত্রীলোক নৃত্যগীত শুরু করে। নিম্নে এই সখীসংগীতের গদ্যরূপ প্রদত্ত হইলঃ

ও দিদি যদি শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসিতে চাও,

আর আত্মপ্রতারণা না করিয়া শীঘ্র আস,

আঁখি তোল, তাহার প্রতি তাকাও

গুরু আসিয়াছে তোমাদের উদ্ধারের জণ্য

এমন গুরুত আর কোথাও পাইবে না।

হ্যাঁ, গুরুর যাহাতে সুখ

তাহা করিতে লজ্জা করিও না-।

‘গানটি গীত হইলে পর এ সমস্ত নারী তাহাদের গাত্রাবরণ খুলিয়া ফেলিয়া সম্পূর্ণ উলংগ হইয়া পড়ে এবং ঘুরিয়া ঘুরিয়া আনন্দে নৃত্য করিতে থাকে। পীর এখানে কৃষ্ণের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং শ্রীকৃষ্ণ যেমন গোপিনীদের বস্ত্র হরণ করিয়া বৃক্ষে তুলিয়া লইয়া গৃহের একটি উচুঁ তাকে রক্ষা করে। এই পীর কৃষ্ণের যেহেতু বাঁশী নাই, তাই সে নিম্নোক্তভাবে মুখে গান গাহিয়াই এইসব উলংগ রমনীগিগকে যৌনভাবে উত্তেজিত করিয়া তোলেঃ

‘হে যুবতীগণ। তোমাদের মোক্ষের পথ ভক্তকুলের পুরোহিতকে অর্ঘস্বরূপ দেহদান কর’।

কোনরূপ সংকোচ বোধ না করিয়া পীরের যৌন লালসা পরিতৃপ্ত করাই ইহাদের প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য, তাহা বলাই বাহুল্য”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)।

যৌনক্রিয়া, আনন্দদায়ক ও সুখকর বস্তু সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষ অবৈধ যৌনসংগমে ভীত শংকিত হয়, লজ্জাসংকোচ অনুভব করে –পাপের ভয়ে, ধর্মের ভয়ে। কিন্তু ধর্ম স্বয়ং যদি ঘোষণা করে যে, এ কাজ পাপের নয়, পুণ্যের এবং এতেই মোক্ষলাভ হয়ে তাকে, তাহলে মানুষ এ পথে আকৃষ্ট হবে না কেন? একশ্রেণীর লম্পট পাপাচারী লোক ধর্মের নামে এভাবে অজ্ঞমূর্খ মানুষকে ফাঁদে ফেলে প্রতারিত ও বিপথগামী করেছে।

উপরে বর্ণিত ভন্ড পীর-ফকীর দলের আরও বহু অপকীর্তি ও অশ্লীল ক্রিয়াকান্ড আছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উপরে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো। এর থেকে তৎকালীন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতন পাঠকবর্গ উপলব্ধি করতে পারবেন সন্দেহ নেই। যদিও গোটা মুসলিম সমাজের অধঃপতন এতটা হয়েছিল না, কিন্তু সমাজে পৌত্তলিক ও বৈষ্ণব মতবাদের প্রবল বন্যা যে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে ভাসিয়ে নিয়ে তাদের সাথে একাকার করে দিচ্ছিল, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা মুসলিম সমাজের ছিল না। কারণ, তৎকালীন মুসলিম শাসকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছিল পৌত্তলিকতাবাদ ও বৈষ্ণববাদের প্রতি। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এসবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ-প্রাচীর গড়ে তুলেছিল সাইয়েদ আহমদ শহীদের (রহ) ইসলামী আন্দোলন, ইতিহাসে যার ভ্রান্ত নাম দেয়অ হয়েছে ‘ওহাবী আন্দোলণ’। যথাস্থানে সে আলোচনা আসবে। সাইয়েদ তিতুমীর এবং হাজী শরিয়তুল্লাহও ওসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তথাপি ওসব গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার বিষক্রিয়া বিংশতি শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত মুসলিশ সমাজের একটা অংশকে জর্জরিত করে রেখেছিল। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় ঈসায়ী ১৯১১ সালের আদমশুমারীর রিপোর্টে বলা হয় যে, লোক গণনার সময় এমন কিছু সম্প্রদায়ের দেখা পাওয়া গেছে, যারা নিজেরা স্বীকারোক্তি করেছে যে, তারা হিন্দুও নয় এবং মুসলমানও নয়। বরঞ্চ উভয়ের সংমিশ্রণ। (Census of India Report, 1911 A.D.)

কিন্তু কিছু সংখ্যক মুসলমানের পৌত্তলিক ভাবধারার রস এখনো সঞ্জীবিত রেখেছে বাংলা ভাষার কতিপয় বৈষ্ণববাদ ভক্ত ও পৌত্তলিক ভাবাপন্ন মুসলিম কবি। ভক্ত কবি লাল মামুদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বৈষ্ণববাদের প্রতি এতটা বিশ্বাসী হয়ে পড়েন যে, একটি বট বৃক্ষমূলে তুলসী বৃক্ষ স্থাপন করে রীতিমত সেবা-পূজা করতে থাকেন। যেদিন গোস্বামীপ্রভু লালুর আশ্রমে উপস্থিত হন, সেদনি নিম্নোক্ত গান গেয়ে প্রভুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

দয়াল হরি কই আমার

আমি পড়েছি ভব কারাগারে, আমায় কে করে উদ্ধার।

শত দোষের দোষী বলে, জন্ম দিলে যবন কুলে

বিফলে গেল দিন আমার।

তারপর আসে কবি লালন শাহের কথা। তাঁর কয়েকটি গান নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ ‘পার কর, চাঁদ গৌর আমায়, বেলা ডুবিল

আমার হেলায় হেলায় অবহেলায় দিনত বয়ে গেল।

আছে ভব নদীর পাড়ি

নিতাই চাঁদ কান্ডারী।

ও চাঁদ গৌর যদি পাই, ও চাঁদ গৌর হে,

কুলে দিয়ে ছাই

ফকীর লালন বলে শ্রীচরণের দাসী হইব’।

উপরে কবি লাল মামুদ আক্ষেপ করে বলেন যে, মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে তাঁর জীবন বিফল হলো। লালন শাহ বলেন, গৌর নিতাইকে পেলে মুসলমানী ত্যাগ করে তাঁর শ্রীচরণের সেবায় রত হবেন।

লালন শাহের কৃষ্ণপ্রেম সম্পর্কীয় গানঃ

কৃষ্ণপ্রেম করব বলে, ঘুরে বেড়াই জনমভরে

সে প্রেম করব বলে ষোলআনা

এক রতির সাধ মিটল নারে।

রাধারাণীর ঋনের দায়

গৌর এসেছে নদিয়ায় বৃন্দাবনের কানাই আর বলাই

নৈদে এসে নাম ধরেছে গৌর আর নিতাই।

মুসলিম সমাজের একশ্রেণীর পৌত্তলিকমনা লোক লালন শাহের মতবাদকে মুসলিম সমাজে সঞ্জীবিত রাখার চেষ্টায় আছে।

মুসলিম সমাজের এহেন অধঃপতনের কারণ বর্ণনা করে ঐতিহাসিকগণ মন্তব্য করেনঃ

“পৃথিবীর অন্যঅন্য জাতিসমূহ যেমন বিজিত জাতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তেমন ভারতীয় মুসলমানগণও বিজিত হিন্দুজাতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। আচার-আচরণ, জীবনের দৃষ্টিভংগী এবং এমনকি বিশ্বাসের দিক দিয়েও এ প্রভাব এখনো সুস্পষ্ট। ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বেগ মুসলিম শাসন আমলে চলেছে। বিভিন্ন সময়ে এ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বেগ মুসলিম শাসকদের উদারনীতির ফলে বর্ধিত হয়েছে। তার ফলস্বরূপ উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতে ইসলাম এমন এক রূপ ধারণ করে যার জন্যে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতীয় মুসলমানগণ, বিশেষ করে বাংলা ও বিহারের মুসলমান তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে এমন সব কুফরী আচার-আচরণ অবলম্বন করেছে, তা ছিল অন্যান্য দেশেল মুসলমানদের মধ্যে বিরল। বাংলা-বিহারে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল যেমন বিরাট, তাদের রীতিনীতি ও আচার-আচরণও ছিল তেমনি ধর্মহীন ও নীতি বিগর্হিত”।–(ব্রিটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমান’: এ আর মল্লিক)।

ভারতীয় ইসলামের মধ্যে অনৈসলামিক রীতিপদ্ধতি অনুপ্রবেশের কারণ হচ্ছে এই যে, অমুসলমানদের ধর্মান্তরগ্রহণ ছিল অপূর্ণ”। (‘ভারতের ইতিহাস’-ইলিয়ট ও ডাউসন) ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থঅর এক চিত্র উপরে বর্ণনা করা হলো। তৌহিদের অনুসারী মুসলমান যখন এমনি বিকৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ এবং তখন ভিতর ও বাইন থেকে যে বিরুদ্ধ শক্তি তাদেরকে পরাভূত ও নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়, সে আক্রমণ প্রতিহত করার কোন প্রাণশক্তি তখন বিদ্যমান ছিল না। যাদের মাত্র সতেরো জন এককালে বাংলার উপরে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল, কয়েক শতাব্দী পরে তাদের লক্ষ লক্ষ জন মিলেও সে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা রক্ষা করতে পারলো না।

No comments:

Post a Comment