Saturday 24 June 2017

বাংলার মুসলিম শাসন পতনের রাজনৈতিক কারণ।



বাংলার মুসলিম শাসন পতনের রাজনৈতিক কারণ।

বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস বই থেকে ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয় ও বাংলার  পতন কোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফল নয়। যেসব রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জের ফল স্বরূপ পলাশীর বিযোগান্ত নাটকের সমাপ্তি ঘটে, তা সত্যানুসন্ধিৎসু পাঠকবর্গের অবশ্য জেনে রাখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে মোগল সাম্রাজ্যের পতন গোটা উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতন ডেকে আনে।

 ১৭০৭ খৃষ্টাব্দে বাহশাহ আওরংজেরবর মৃত্যুর পর থেকে ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত পঞ্চাশ বৎসরে কমপক্ষে সাত জন দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কারো এ যোগ্যতা ছিল না যে পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। অবশ্য কতিপয় অবিবেচক ঐতিহাসিক আওরংজেবকে মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের জন্যে দায়ী করেন। ইতিহাসের পুংখানুপুংখ যাচাই-পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ধ্বংসের বীজ বহু পূর্বেই স্বয়ং বাদশাহ আকবর কর্তৃক বপন করা হয়েছিল এবং তা ধীরে ধীরে একটি বিরাট বিশাল মহীরুহের আকার ধারণ করছিল। আওরংজেব সারাজীবন ব্যাপী তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে সে ধ্বংসকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারীগণ যদি তাঁর মতো শক্তিশারী ও বিচক্ষণ হতেন –তাহলে সম্ভবতঃ ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। শ্রদ্ধেয় আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেনঃ

“আকবরের রাজত্বকালের সকল অপকর্মের পরিণাম ভোগ তাঁহার মৃত্যুর সাথেই শেষ হইয়া যায় নাই। মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তাঁহার সকল উত্তরাধিকারীকে জীবনের যথাসর্বস্ব দিয়া এই অপকর্মের ফল ভোগ করিতে হইয়াছিল। ভারদের দশ কোটি মুসলমান আজ পর্যন্ত আকবরের অপকর্মের দরুন ক্ষতিপূরণের অবশিষ্ট উত্তরাধিকার দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি পায় নাই। মুসলমান পাঠকদের নিকট এই উত্তরাধিকারের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত কোন আলোচনার প্রয়োজন আছে বলিয়া আমরা মনে করিনা”।

বলতে গেলে আকবর ছিলেন নিরক্ষর অথবা অতি অল্প শিক্ষিত। পনেরো-ষোল বৎসর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। একটি নিরক্ষর বালক যুবরাজের পক্ষে শত্রু পরিবেষ্টিত দিল্লীর রাজশাসন পরিচালনা কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি অতি বিচক্ষণ ও পারদর্শী বাইরাম খান, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য না করতেন। সৎ সংসর্গ লাভের অভাবে আকবর বিরাট সাম্রাজ্য লাভের পর স্বভাবতঃই ভোগ বিলাস, উচ্ছৃংখলতা ও নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে নিমজ্জিত হন। বাইরাম খান তাঁকে সকল প্রকার চেষ্টা করেও সুপথে আনতে পারেননি। মদ্যপান ও তার স্বাভাবিক আনুষংগিক পাপাচার এবং তাঁর আশাতীত রাজনৈতিক সাফল্য তাঁর চরিত্র গঠন বা সংশোধনের কোন সুযোগই দেয়নি। কিন্তু তার এই ব্যধিগ্রস্থ প্রতিভা তাঁর ভবিষ্যৎ বংশধর বীজ বপন করে গেছে। মুসলমানদের তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জীবনের সকল শক্তি নিঃশেষ করে দিয়ে তাদেরকে অপরের রাজনৈতিক ও মানসিক গোলামে পরিণত করে যাচ্ছিল, আকবরের তীক্ষ্ণ অথচ অসুস্থ প্রতিভা তার পূর্ণ সহায়ক হয়েছে। ভারতে তাঁর রাজনৈতিক শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে আকবর হিন্দুদের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েই ক্ষান্ত হননি, বরঞ্চ তাদের মনস্তুষ্টির জন্য ‘দ্বীনে এলাহী’ নামে এক উদ্ভট ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্ম ও তামাদ্দুনকে ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আকবরনানায় এর বিস্তারিত বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়।

মজার ব্যাপার এই যে, বিভিন্ন রাজনৈতকি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রয়োজন আকবরের জীবনের বৃহত্তম স্বপ্নসাধ এই স্বকপোলকল্পিত ‘দ্বীনে এলাহী’ হিন্দু জাতিকে মোটেই আকৃষ্ট করতে পারেনি। একমাত্র বীরবল ব্যতীত কেউ এ নবধর্মমত গ্রহণে সম্মত হননি। তাঁর দরবারের নবরত্নের মধ্যে অন্যতম রত্নাবলী মানসিংহ ও তোডরমল এ ধর্মমত প্রত্যাখান করেছেন। আকবর কণ্ঠে রুদ্রাক্ষমালা জড়িত করে চন্দন চর্চিত দেহে হিন্দু সন্যাসীর বেশে দরবারে উপস্থিত হলে হিন্দুপন্ডিত ও সভাসদগণ ‘দিল্লীশ্বরো’ বা ‘জগতীশ্বরো’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করতেন এবং ভারতে একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করে তাঁর প্রতি কৃত্রিম আনুগত্য প্রদর্শন ও শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও তাঁর উদ্ভট ধর্মের প্রতি কণামাত্র আনুগত্য প্রকাশ করেননি। অতএব কোন এক চরম অশুভ শক্তি শুধুমাত্র মুসলমানদের তৌহিদী আকীহাদ বিশ্বাস ও ইসলামী তামাদ্দুন ধ্বংসের জন্যে আকবরের প্রতিভাকে ব্যবহার করেছে, তা বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই সহজে উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু আকবর তাঁর জীবনের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়িত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হন।

এ তো গেল তাঁর জীবনের একদিক। তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও এসেছিল চরম ব্যর্থতা ও নৈরাশ্যের গ্লানি।

আকবর ভারতের তদানীন্তন পাঠানশক্তি তথা দুর্ধর্ষ মুসলিম সামরিক শক্তি ধ্বংস করেছিলেন। এ বিধ্বস্ত সামরিক শক্তির বিকল্প কোন মুসলিম শক্তি গড়ে তোলা তো দূরের কথা, যা অবশিষ্ট ছিল তাও দুর্বল ও নিঃশেষ করে ফেলেন। বাইরাম খান, আহসান খান, মুয়াজ্জাম খান প্রভৃতির হত্যাকান্ডের মধ্যে আকবরের এ ধ্বংসাত্মক নীতির প্রকাশ পাওয়া যায়। এমনকি বহিরাগত বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বিরুদ্ধেও তিনি দমনমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এমনিভাবে শত্রুর ইংগিতে তিনি আপন গৃহ স্বহস্তে আগুন লাগিয়ে ভষ্মীভূত করেন। মোগল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ বিপদের সময় কাজে লাগতে পারে এরূপ সকল শক্তি ও প্রতিভাকে ধ্বংস করে দেয়ার ফলে তিনি ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, পাশ্চাত্যের খৃষ্টান জাতিগুলি দ্রুত তাদের রাজনৈতকি ক্ষমতা বিস্তার করে চলেছিল এবং তাদের অশুভ তৎপরতার ঢেউ মোগল সাম্রাজ্যের সীমান্তে এসে আঘাত করছিল। যে ইষলামের ধ্বংস করেছেন। অতএব খৃষ্টানদের রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে অসম্মানকর সন্ধি স্থাপনে এবং তাদের ধর্মের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য করেও মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথ রুদ্ধ করতে পারলেন না।

বৈদেশিক বিধর্মী শক্তির ন্যায় দেশের অভ্যন্তরেও যে হিন্দুশক্তি দ্রুত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, তাও আকবরের দৃষ্টির অগোচরে ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিনি হয়ে পড়েছিলেন ভারতের হিন্দুশক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অতএব তাদেরকে তুষ্ট করার বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। হিন্দু নারীগণকে মহিষীরূপে শাহীমহলে এনে তথায় মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজার নিয়মিত অনুষ্ঠান করেও মোগল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারলেন না। সর্বশক্তিমান সত্তা পৃথিবী ও আকাশমন্ডলীর খোদাকে পরিত্যাগ করে অন্যান্য বিভিন্ন খোদার আশ্রয়প্রার্থী হয়েও কোন লাভ হলোনা।

ইসলাম ধর্মকে পুরাপুরি পৌত্তলিকতার ছাঁচে ঢেলে এবং হিন্দুধর্ম অক্ষুণ্ণ রেখে ‘দ্বীনে এলাহী’ নামে নতুন এক ধর্মের ছায়াতলে ভারতের হিন্দু মুসলমানকে একজাতি বানাবার হাস্যকর পরিকল্পনাও তাঁর ব্যর্থ হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি যে মনমানসিকতার সৃষ্টি করে অশুভ উত্তরাধিকার রেখে গেলেন তা শুধু তার সুযোগ্য পুত্র জাহাঙ্গীরই আঁকড়ে ধরেনন বরঞ্চ বিংশতি শতাব্দীর শেষার্ধেও এক শ্রেণীর মুসলমান সে উত্তরাধিকার দ্বারা লালিত পালিত হচ্ছেন।

মুসলিম ধর্মীয়, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক অধঃপতনের এ এক চরম বেদনাদায়ক নিদর্শন সন্দেহ নেই।

জাহাঙ্গীর মোগল সাম্রাজ্য ধ্বংস ত্বরান্বিত করেন। ১৬০৯ খৃষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন কহিন্স আগ্রায় আগমন করলে তাকে রাজকীয় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সম্রাট জাহঙ্গীর তাকে ঘনিষ্ঠ সহচর হিসাবে গ্রহণ করেন, খেতাব ও বৃত্তিদান করেন। বিবাহ করে ভারতে বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করলে শাহী মহলের একজন শ্বেতাংগী তরুণীর বিবাহের প্রস্তাব দেন।

শাহী মহলে খৃষ্টধর্মের এতখানি প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, কয়েকজন শাহজাদা খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং হকিন্সের নেতৃত্বে অন্যান্য খৃষ্টান প্রবাসীদের সাথে পঞ্চাশ জন অশ্বারোহী পরিবেষ্টিত মিছিল সহকারে গীর্জায় গমন করতেন। জাহাঙ্গীর তাঁর ইউরোপীয় বন্ধুবান্ধবসহ সারারাত্রি শাহী মহলে মদ্যপানে বিভোর হয়ে থাকতেন। মোগল সাম্রাজ্যের সমাধি রচনার কাজ আকবর নিজেই করেছিলে, তা আগেই বলা হয়েছে। অতঃপর তাঁর আদর্শহীন মদ্যপায়ী পুত্র জাহাঙ্গীর, স্যার টমাস রো ও তাঁর উপদেষ্টা ও গুরু সুচতুর কুটনীনিবিদ রেভারেন্ড ই. ফেবী মিলে এ সমাধি রচনার কাজ ত্বরান্বিত করেন। টমাস রো তাদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া মঞ্জুর করে নিতে জাহাঙ্গীরকে সম্মত করেন।

 সুরাটে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটির দ্বারা ইংরেজগণ শুধু বাণিজ্যিক সুবিধা লাভেরই সুযোগ পায়নি, বরঞ্চ এ কারখানাটি তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। শাহী সনদের শর্ত অনুযায়ী শুধু সুরাটেই নয়, মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও, যথা আগ্রা, আহমদাবাদ ও ব্রুচে ইংরেজদের কারখানা তথা সামরিক ঘাঁটি গড়ে উঠে। এভাবে আকবর নিজেই করেছিলেন, তা আগেই বলা হয়েছে। অতঃপর তাঁর আদর্শহীন আদর্শহীন মদ্যপায়ী পুত্র জাহাঙ্গীর, স্যার টমাস রো ও তাঁর উপদেষ্টা ও গুরু সুচতুর কূটনীতিবিদ রেভারেন্ড ই. ফেবী মিলে এ সমাধি রচনার কাজ ত্বরান্বিত করেন। টমাস রো তাদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া মঞ্জুর করে নিতে জাহাঙ্গীরকে সম্মত করেন। সুরাটে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। শাহী সনদের শর্ত অনুযায়ী শুধু সুরাটেই নয়, মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও যথা আগ্রা, আহমদাবাদ ও ব্রুচে ইংরেজদের কারখানা তথা সামরিক ঘাঁটি গড়ে উঠে। এভাবে আকবর ও জাহাঙ্গীর মোগল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে খাল খনন করে দূরদেশ থেকে সর্বগ্রাসী কুম্ভীর আমদানি করেন।

একদিকে বিদেশী শক্তি ইংরেজ ভারতে উড়ে এসে জুড়ে বসলো, অপরদিকে ভারতের হিন্দুশক্তিও প্রবল হয়ে উঠলো। রাজপুত এবং মারাছা শক্তি মোগল সাম্রাজ্যের পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। আকবর যে মুসলিম শক্তির ধ্বংস সাধন করেছিলেন, আওরংজেব পাদশাহ গাজী সেই লুপ্ত শক্তির পুনরুদ্ধারের আজীবন সংগ্রাম করেন। মারাঠা ও রাজপুত শক্তি দমনে তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তাঁর পর যদি তাঁর উত্তরাধিকারীগণ শক্তিশালী ও বিচক্ষণ হতেন, তাহলে হয়তো পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা যেতো। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আরম্ভ করে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত যাঁরাই দিল্লীর সিংহাসন অলংকৃত করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন শাসন কার্য পরিচালনার অযোগ্য, বিলাসী ও অদূরদর্শী।

একথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ মোগল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের জন্যে একমাত্র আওরংজেবকেই দায়ী করেন। বাংলার হোসেন শাহ ও সম্রাট আকবরের উচ্চ প্রশংসায় যতটা তাঁরা পঞ্চমুখ, ততটা আওরংজেবের চরিত্রে কলংক লেপনে তাঁরা ছিলেন সোচ্চার। তাঁকে চরম হিন্দু বিদ্বেষী বলে চিত্রিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাঁর অনুসৃত হিন্দু স্বার্থের পরিপন্থী শাসননীতি এবং বিশেষ করে জিজিয়া প্রথার পুনঃপ্রবর্তন ভারতের হিন্দুজাতিকে মোগলদের শত্রুতা সাধনে বাধ্য করে। কিন্তু এ অভিযোগগুলি নিছক কল্পনাপ্রসূত ও দুরভিসন্ধিমূলক। ইতিহাস থেকে এর কোন প্রমাণ পেশ করা যাবে না। সত্য কথা বলতে গেলে, রাজপুত এবং মারাঠাগণ ভারতের মুসলিম শাসনকে কিছুতেই মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও শত্রুতার মনোভাব লক্ষ্য করে আকবর তাদেরকে তুষ্ট করার জন্যে অতিশয় উদারনীতি অবলস্বন করেও ব্যর্থ হয়েছেন। শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠাগণ আওবংজেবের চরম বিরোধিতা করেন। তিনি জিজিয়া কর প্রবর্তিত করার এক বৎসর পূর্বে, ১৬৭৯ খৃষ্টাব্দে শিবাজী মৃত্যুবরণ করেন। অতএব জিজিয়া করই হিন্দুজাতির বিরোধিতার কারণ ছিল, একথা মোটেই ন্যায়সংগত নয়।

একথা অনস্বীকার্য যে, তৎকালীন ভারতের ইতিহাস যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা সকলেই বলতে গেলে ছিলেন মুসলমান। তাই সে সময়ের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে অধ্যয়নের প্রয়েঅজন হবে বাদাউনী, আকবরনামা, কাফীখান, তারিখে ফেরেশতা, মা’য়াসিলে আলমগীরী প্রভৃতি। কিন্তু ইউরোপীয় খৃষ্টান ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের বহু ঘটনাকে বিকৃত করে পেশ করেছেন। পরবর্তীকালে অর্ধপৃথিবী জুড়ে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। সর্বত্র তাঁদের সাম্রাজ্য জুড়ে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রচলিত ছিল ইংরেজী ভাষা। এ ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায় মুসলমানদের ইতিহাসের এক বিকৃত ও কল্পিত রূপ তাঁরা তুলে ধরেছেন ইংরেজী ভাষার ইতিহাসের ছাত্রদের সামনে। ভারতে ইংরেজদের দু’শ বছরের শাসনকালে এ বিকৃত ও ভ্রান্ত ইতিহাস ছাত্রদের মসমস্তিষ্কে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছিল।

এ বিকৃতকরণের কারণও ছিল। বাদশাহ আওরংজেবের কথাই ধরা যাক। বাদশাহ আকবর ও জাহঙ্গীর কর্তৃক ইংরেজদেরকে অন্যায়ভাবে অতিমাত্রায় প্রশ্রয় দানের ফলে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তারা একটা শক্তি হিসাবে গড়ে উঠছিল। বাদশাহ আওরংজেব তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর আমলে বাংলার মীর জুমলা ও নবাব শায়েস্তা খান বার বার ইংরেজদের ঔদ্ধত্য দমিত ও প্রশমিত করেছেন। ব্যবসায় দুর্নীতি, চোরাচালান, মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রভৃতির কারণে তাদেরকে বার বার শস্তিও দেয়া হয়েছে, তাদের কুঠি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক পর্যায়ে বাদশাহ আওরংগজেব ইউরোপীয়দের সাথে তাদের সকল ব্যবসা নিষিদ্ধ করে এক ফরমান জারী করেন। আকবর যে মুসলিম সামরিক শক্তি ধ্বংস করে মোগল সাম্রাজ্যকে শত্রুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, বাদশাহ আওরংগজেব সেই মুসলিম সামরিক শক্তি পুনর্গঠনে আজীবন চেষ্টা করেন। খৃষ্টান ও হিন্দুজাতির কাছে উপরোক্ত কারণে আওরংগজেব ছিলেন দোষী। তাই তাঁর শাসনকালকে কলংকময় করে চিত্রিত করতে এবং তাঁর নানাবিধ কুৎসা রটনা করতে তাঁরা তৎপর হয়ে উঠেন। অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে আলমগীর আওরংগজেবের চরিত্রে যেসব কলংক আরোপ করেছেন, ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদির দ্বারা তার সবটাই খন্ডন করেছেন শিবলী নো’মানী তাঁর “আওরংগজেব আলমগীর পর এক নজর” গ্রন্থে। এ সংক্ষিপ্ত অথট তথ্যবহুল গ্রন্থখানিতে তিনি আওরংগজেবের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলির সমুচিত জবাব দিয়েছেন।

অতএব ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে একথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, আওরংগজেবের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগের মধ্যে সত্যতার লেশমাত্র নেই। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্যে তাঁকে কণামাত্র দায়ী করা যেতে পারে না। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আকবর কর্তৃক দুর্ধর্ষ মুসলিম সেনাবাহিনীর বিলোপ সাধনের পর ভারতের হিন্দু মারাঠা রাজপুতদের উপর তাঁর নির্ভরশীলতা, বৈদেশিক ও বিধর্মী ইংরেজদের ব্যবসার নামে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়, মুসলিম শাসন উৎখানের জন্যে হিন্দু ও ইংরেজদের মধ্যে অশুভ আঁতাত এবং তার সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধঃপতন প্রভৃতি বাংলা তথা ভারত থেকে মুসলিম শাসনের বিলোপ সাধন করেছিল। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখি কিভাবে পলাশী ক্ষেত্রে বাংলা-বিহারের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়ে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন করে।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজদের ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তোলার পিছনে বিরাট রাজনৈতিক অভিসন্ধি লুক্কায়িত ছিল। ব্যবসা বাণিজ্য করতে এসে একটা বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক মোখতার হয়ে পড়া কোন আকষ্মিক বা অলৌকিক ঘটনার ফল নয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভৌগলিক আবিষ্কারের ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবসার পথ উন্মুক্ত হয় এবং ইউরোপীয় জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। ফলে আমেরিকায় স্পেন সাম্রাজ্য, মশলার দ্বীপে ওলন্দাজ সাম্রাজ্য, দক্ষিণ পূর্ভ এশিয়ায় ফরাসী সাম্রাজ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংলন্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে অগ্রগতির নীতি (Forward Policy) অবলম্বন করে এবং যেসব বাণিজ্যিক এলাকায় তাদের প্রতিনিধিগণ বাস করতো তারা একটা রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হোক এ ছিল তাদের একান্ত বাসনা।

১৬৮২ খৃষ্টাব্দে ইংরেজগণ ওলন্দাজদের নিকটে ইন্দোনেশিয়ায় মার খেয়ে সেখান থেকে পাততাড়ি গুটায়। পর বৎসর (১৬৮৩ খৃঃ) ইংলন্ডের রাজদরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে যে সনদ দান করা হয় তার বলে তারা ভারতের যেকোন শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সন্ধি করতে অথবা যেকোন চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারতো। দ্বিতীয় জেমস কর্তৃক প্রদত্ত সনদে তাদেরকে অধিকতর ক্ষমতা দান করা হয়। এর ফলে তারা ১৬৮৬ খৃষ্টাব্দে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পরাজয় বরণ করে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্যাপ্টেন হীথের নেতৃত্বে ‘ডিফেন্স’ নামক রণতরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ভারতে পাঠানো হয়। হীথ সুতানটি থেকে যুদ্ধের জন্যে অগ্রসর হয়ে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। এর ফলে কোম্পানীর ডিরেক্টরগণ কিছুটা দমে গেলেও ভারতে অবস্থানকারী প্রতিনিধিগণ নতুন উৎসাহ উদ্যমে কাজ করে যায়। তাদের দৃষ্টি এবার ফরাসী বণিকদের উপর নিবদ্ধ হয়। ফরাসীদের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র ছিল পন্ডিচেরী এবং তার অধীনে মুসলিপট্টম, কারিকল, মাহে, সুরাট প্রভৃতি স্থানে তাদের কারখানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। পক্ষান্তরে ইংরেজদের বাণিজ্যিক হেড কোয়ার্টার ছিল মাদ্রাজে এবং তার অধীনে বোম্বাই ও কলকাতায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ কারখানা ছিল। এদের মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং শেষ পর্যন্ত তা যুদ্দের আকার ধারণ করে। ফরাসীগণ তাদের মনোনীত ব্যক্তি মুজাফফর জং ও চান্দা সাহেবকে যথাক্রমে হায়দরাবাদ ও কর্ণেটিকের সিংহাসন লাভে সাহায্য করে। ১৭৫১ খৃষ্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ কর্ণাটকের রাজধানী আরকট দখল করে। এভাবে ইংরেজ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠে।

No comments:

Post a Comment