পলাশীর যুদ্ধ ও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা-এর করুণ মৃত্যু।
মোফাজ্জল হোসেন :
আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গ্লানিকর এবং কলঙ্কিত ঐতিহাসিক দিন ২৩ জুন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ নামের যে মর্মস্পর্শী নাটক অভিনীত হয়েছিল তাতে সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় কেবল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবেরই পতন হয়নি, অবসান হয় বাংলার স্বাধীনতার। পলাশী যুদ্ধের চূড়ান্ত যবনিকাপাত ঘটে ৩ জুলাই সিরাজকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার মাধ্যমে। দেশপ্রেমিক যুবক সিরাজ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সকল চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, দেশদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়েছিলেন।
অবশেষে আপন বক্ষ নিঃসৃত রক্তে রঞ্জিত করেছিলেন বাংলার মাটি। তার পরাজয় ও নির্মম হত্যার পরিণতিতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় ১৭৫৭ সালে।
দুঃখের বিষয় যে, দিনটির সাথে বাঙালির বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের সবচাইতে বেদনাদায়ক স্মৃতিবিজড়িত, আমরা ক’জনে তা স্মরণ করি? বিশ্বাসঘাতকতা, চক্রান্ত ও দেশদ্রোহিতার জঘন্য ইতিহাসের পাশাপাশি সিরাজের দেশপ্রেম ও আত্মবিসর্জনের মহিমাময় স্মৃতি ধারণ করে ২৩ জুন ও ৩ জুলাই বারবার ফিরে আসে আমাদের মাঝে। কিন্তু আমরা হয়তো আত্মবিস্মৃত জাতি বলেই এ দিবসটি পালন করি না। কিংবা এখনো মীরজাফর, জগৎশেঠ, উর্মিচাদ, রাজবল্লভরা অধিকতর শক্তিশালী ও সক্রিয় বলে।
১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। সিংহাসনে আরোহণ করেই দেখলেন সিংহাসনকে ঘিরে নানা কুটিল চক্রান্তের জাল। সেনাপতি মীর জাফর, রাজবল্লভ, উর্মিচাঁদ, দুহাজারী মসনদদার ইয়ার লতিফ, দেশের ব্যাংকারে পরিণত জগৎশেঠ প্রমুখ প্রভাবশালী নানা ষড়যন্ত্রে ও চক্রান্তে লিপ্ত। ইতোমধ্যে স্বার্থ-সন্ধানী ইংরেজদের সাথে এই চক্রান্তকারীদের যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। অন্যদিকে আলীবর্দী খান সিরাজ-উদ-দৌলাকে উত্তরাধিকার নির্বাচন করলেও তা প্রতিবাদহীন সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিশেষ করে ঘষেটি বেগম অন্ধ আক্রোশ ও প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন।
মূলত ১৭০৭ সালে স¤্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে মুগল শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। দিল্লি ছিল শাসনের মূল কেন্দ্র। কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল ও দুর্বল হওয়ার সুযোগে সারা ভারতে হিন্দু, খ্রিস্টান, মারাঠা শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে প্রধান হুমকি হয়ে দেখা দেয় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগত ইংরেজ বণিকরা। ভাগ্যান্বেষী ইংরেজরা তৎকালীন মুগল স¤্রাট আজিম-উশ-শানের আমলে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে হুগলী নদীর তীরবর্তী সুতানটি গ্রামটি ক্রয় করে। পরে এর সাথে যোগ হয় কলকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রাম। এভাবেই বাংলাদেশের বুকে প্রথমে ইংরেজদের প্রবেশাধিকার সূচিত হয়। ইংরেজরা এখানে দুর্গ গড়ে তোলে।
পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আজ্ঞাবহ ঐতিহাসিক ও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে নানাভাবে বিকৃত ও সিরাজ চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার বিচারে এবং ইতিহাসের অনুসন্ধানে এসবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সত্য সন্ধানী ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্র কঠোর পরিশ্রম ও গবেষণা করে তার ‘সিরাজউদ্দৌলা’ গ্রন্থে এসব দোষের ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করেছেন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে কাল্পনিক অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী সাজিয়ে তাকে নিষ্ঠুর হিসেবে চিত্রিত করার যে ষড়যন্ত্র ইংরেজ ঐতিহাসিকরা করেছিলেন, ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচারে তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। অক্ষয় কুমার মৈত্রের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ও নিখিল নাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদ’ কাহিনীতে পলাশী যুদ্ধের ঘটনা সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
ইংরেজ বণিকরা যে বাণিজ্যের আশায় ভারতবর্ষে এসে তৎকালীন পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে এদেশ অধিকারের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল বাংলার সুচতুর দূরদর্শী নবাব আলিবর্দী খান তা সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই মৃত্যুর আগে তার দৌহিত্র ও উত্তরাধিকারী সিরাজ-উদ-দৌলাকে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন ইংরেজদের দমন করার জন্য। ইংরেজদের প্রধান দোসর ও সাহায্যকারী ছিল এদেশের হিন্দু জমিদার ও রাজ কর্মচারীরা। এ. সি. হিল তার বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭ নামক গ্রন্থে লিখেছেন ‘হিন্দু রাজা ও জমিদারগণ মুসলমানদের শাসনে খুবই অসন্তুষ্ট এবং তাহারা এই স্বেচ্ছচারী শাসনের অবসানের জন্য সুযোগ অন্বেষণ করিতেছেন।’
‘হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজ-উদ-দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। তাকে সিংহাসন চ্যুত করার জন্য রাজা মহেন্দ্র, রাজা রামনারায়ণ, রাজা কৃষ্ণদাস, রাজা রাজবল্লভ, মীর জাফর প্রমুখ প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গ মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাটীতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণায় মিলিত হন। জানা যায় এ লক্ষ্যে বেশ কটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভার আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ইংরেজদের সাহায্য নেয়া হবে এবং পরবর্তী সময়ে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কলকাতায় গিয়ে ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল ক্লাইভের সাথে সাক্ষাৎ করে পরিকল্পনা ঠিক করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাইভ মীর জাফরের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেন, চুক্তি অনুসারে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণ করে তার জায়গায় মীর জাফরকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এ চক্রান্তের সাক্ষী ছিলেন জগৎশেঠের প্রতিনিধি ধনকুবের উর্মিচাঁদ।
‘মীর জাফরের সঙ্গে ইংরেজরা যে গুপ্ত সন্ধি প্রণয়ন করেছিলেন ১৭ মে কলকাতা ইংরেজ দরবারের সে সন্ধি পত্রের খসড়া আলোচিত হয়, এই সন্ধিপত্রে সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণের মূল্য স্বরূপ কোম্পানি বাহাদুর এক কোটি টাকা, কলকাতাবাসী ইংরেজ, বাঙালি ও আরমানীগণ সত্তুর লক্ষ টাকা এবং উর্মিচাঁদের জন্য ত্রিশ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল…’।
১৭৫৭ খিস্টাব্দের ১২ জুন কলকাতা ও চন্দননগরে ইংরেজ সেনা একত্রিত হয় এবং ১৩ জুন ব্রিটিশ বাহিনী যুদ্ধযাত্রা করে। গোলাবারুদ নিয়ে গোরারা দুইশত নৌকায় যাত্রা করে আর কালো আদমীরা গঙ্গাতীরের বাদশাহী রাস্তা বরাবর অগ্রসর হতে থাকে, পথে হুগলী ও কাঠোয়ার দুর্গে হুগুলীতে নবাব সেনারা ইংরেজদের পথ রোধ করেনি, মুর্শিদাবাদের গুপ্তমন্ত্রণা হুগলীর ফৌজদারকে কর্তব্যভ্রষ্ট করেছিল। সিরাজ-উদ-দৌলা ঐ পরিস্থিতিতে মীর জাফরকে বন্দি করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তাকে রাজ সদনে আহ্বান করেন। সিরাজউদ্দৌলা ভেবেছিলেন, ইসলামের নামে, আলিবর্দীর নামে, স্বাধীনতার নামে মীর জাফরের বিভ্রান্তি দূর করবেন।
তিনি মীর জাফরকে ক্ষমা প্রদর্শন করে, আল্লাহর নামে, মোহাম্মদ (সা.) এর নামে, ইসলামের গৌরবের নামে, নবাব আলিবর্দীর বংশ মর্যাদার দোহাই দিয়ে মীরজাফরকে ফিরিঙ্গী সংসর্গ ত্যাগ করে তার সঙ্গে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। আবার কোরআন শরীফ আনা হয়, এবার পরম পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ মাথায় নিয়ে অন্নদাতা মুসলমান নবাবের কাছে মুসলমান সেনাপতি জানুপেতে শপথ করেন আল্লাহর নামে। “পয়গম্ববরের নামে ধর্মশপথ করিয়া অঙ্গীকার করিতেছি, যাবজ্জীবন মুসলমান সিংহাসন রক্ষা করিব, প্রাণ থাকিতে বিধর্মী ফিরিঙ্গীর সহায়তা করিব না। এভাবে মীর জাফর সিরাজউদ্দৌলার সন্দেহ দূর করে তাকে প্রতারণা করলেন। হিন্দু যে ব্রাহ্মণের পদস্পর্শ করিয়া মিথ্যা বলিতে পারে, সে কথা সিরাজউদ্দৌলা বিশ্বাস করিতেন না; সে জন্য একবার উমাচরনের (উর্মিচাদ) ধর্ম শপথে প্রতারিত হইয়াছিলেন।
মুসলমান যে কোরআন শরীফ মাথায় লইয়াও মিথ্যা কথা বলিতে সাহস করিবে, তাহা বিশ্বাস করিতে না পারিয়া সিরাজউদ্দৌলা আবার প্রতারিত হইলেন। লোক বলে, সিরাজ পরম পাষ-, ধর্মাধর্ম বিচারহীন, উচ্ছৃংখল যুবক, তাহা হইলে হয়ত তাহার পক্ষে ভালো হইত। তাহা হইলে হয়ত হিন্দু ব্রাহ্মণের পদস্পর্শ করিয়া ফিরিঙ্গী বাইবেল চুম্বন করিয়া এবং মুসলমান কোরআন মাথায় লইয়া তাহাকে যাহা ইচ্ছা তাহাই বিশ্বাস করাইতে পারিতেন না।” (অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সিরাজউদ্দৌলা)।
সিরাজ-উদ-দৌলা এবার যুদ্ধ যাত্রার আয়োজন করেন। সৈন্যদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করে যুদ্ধযাত্রায় সম্মত করানো হয়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা মীরজাফরকে পলাশী অভিমুখে যাত্রার আদেশ প্রদান করে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রথমে কনকরায়, তারপর দাদপুর এবং শেষে ইংরেজরা পলশী পৌঁছার ১২ ঘণ্টা আগে পলাশীতে এসে শিবির সন্নিবেশ করেন।
বিদেশী এবং দেশী ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তের কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ একটি প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। এ যুদ্ধ ছিল পরিকল্পিত ও সাজানো। সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের অধীনে ছিল নবাবের ৫০ হাজার সেনাবাহিনীর ৩৫ হাজার সৈন্য। তিনি পলাশীর যুদ্ধে একটি গুলি ছোড়ারও নির্দেশ দেননি, ২ হাজার মসনবদার ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভও একই ভূমিকা পালন করেন। মীর মদন ও মোহন লালের অধীনস্থ সৈন্যদের ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ সৈন্যের মোকাবেলায় এগিয়ে গেলে তাতেই ক্লাইভ রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হন। মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার সংবাদে ব্যাকুল হয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা মীর জাফরকে ডেকে তার পদতলে উষ্ণীষ রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আবেদন জানান। মীর জাফর সেদিন নবাবকে যুদ্ধে বিরতি দেবার পরামর্শ দেন।
রায় দুর্লভ তাকে মুর্শিদাবাদ যেতে বলেন। নবাব মোহন লালকে আক্রমণ থামানোর নির্দেশ দেন, নবাবের বারংবার আদেশে বিরক্ত হয়ে মোহন লাল আক্রমণ বন্ধ করলে নবাব সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, এই সুযোগে ইংরেজ বাহিনী নবাব বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের সুসজ্জিত বাহিনী ইংরেজদের কোনো প্রকার বাধা না দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কেবল ফরাসী সেনাপতি সিনফ্রে নিজের স্বল্পসংখ্যক সেনানী নিয়ে ইংরেজদের বাধা প্রদান করতে থাকেন। কিন্তু তিনি একা ইংরেজদের গতিরোধ করতে পারলেন না। অপরাহ্ন পাঁচটার সময় ইংরেজ বাহিনী নবাবের পরিখাবেষ্টিত শিবির অধিকার করে নেয়। নবাব অবশ্য ইতিপূর্বেই মুর্শিদাবাদ রওনা হয়ে যান। এভাবে পলাশী যুদ্ধ শেষ হয়।
এই যুদ্ধে নবাবের ৩৫ হাজার পদাতিক, ১৫ হাজার অশ্বারোহী ও ৫৩টি কামান ছিল যার মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার সৈনিক বিশ্বাসঘাতক তিনজন সেনাপতির অধীনে ছিল। ইংরেজদের ছিল ৯০০ ইউরোপিয়ান ১০০ গোলন্দাজ ও ২ হাজার ১০০ দেশীয় সিপাই। এই তথাকথিত যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষে নাকি ৭০ জন হতাহত হয়।
২৩ জুন ক্লাইভ পলাশী থেকে ফিরে তিন ক্রোশ উত্তরে দাদপুরে এসে মীর জফারকে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব বলে অভ্যর্থনা জানান। দাদপুর থেকে প্রথমে মীর জাফর ও পরে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন। ক্লাইভ ২৯ জুন পর্যন্ত কাশিম বাজারে ছিলেন এবং সেদিনই মুর্শিদাবাদ উপস্থিত হয়ে মীর জাফরকে সিংহাসনে বসান।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পলাশীর প্রান্তর থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে পুনরায় যুদ্ধ করার জন্য মিত্র শক্তির সন্ধানে সপরিবারে রাজমহলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন ২৪ জুন সকালে। কিন্তু ভগবান গোলার কাছে দানশাহ নামক এক ফকিরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব মীর কাশিম আলীর হাতে ধরা পড়েন। তাকে বন্দি করে সপরিবারে মুর্শিবাদ নিয়ে আসা হয়।
সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই ২১ বছর বয়স্ক তরুণ সিরাজ একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মুখোমুখি হন। আপন আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত সিরাজের সিংহাসনে আরোহণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সিরাজ ছিলেন অসহায়। ১৭৫৬ সালের এপ্রিল থেকে ১৭৫৭ সালের জুন পর্যন্ত তিনি নিশ্চিন্ত কোনো সময় অতিবাহিত করতে পারেননি। ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত সিরাজ ধূর্ত ওয়াটসের বাইবেল স্পর্শ, জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদের ব্রাহ্মণের গায়ে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা এবং সেনাপতি মীর জাফর আলীর পবিত্র কোরআন হাতে শপথ করাকে বিশ্বাস করে যদি অপরাধ করে থাকেন তাহলে সিরাজ অপরাধী। তাই পলাশীর এই প্রহসন যুদ্ধে সিরাজ ছিলেন ক্রীড়নকদের হাতে পুতুল-তার কিছুই করার ছিল না। বিদেশী ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা, দেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণœ রাখার সিরাজের সকল আবেদন ও সকল প্রত্যাশা ও প্রয়াস ব্যর্থ হয়। ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস, সংঘর্ষের এই টাল-মাটাল পরিস্থিতিতেও সিরাজ-উদ-দৌলার চারিত্রিক মহত্ত আমাদের বিস্মিত করে। ইতিহাস সাক্ষী, এই উদারতা ও মহত্তের প্রায়শ্চিত্তও করতে হয়েছে সিংহাসন হারিয়ে ও নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে।
ইংরেজদের এদেশে শাসন ও রাজ্য বিস্তারের যে পরিকল্পনা লর্ড ক্লাইভ করেছিলেন তাতে সহযোগিতা ও দেশের স্বাধীনতাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেবার জন্য দায়ী এদেশের কতিপয় স্বার্থন্বেষী ও ষড়যন্ত্রকারীরা। পলাশী যুদ্ধের ফলেই প্রায় ২০০ বছর ধরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তথা অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগ্যচক্র আবর্তিত হয় ইংরেজদের হাতে। ক্লাইভ প্রথমে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে কেন্দ্র করে ভারতে যে আঞ্চলিক ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করলেন, অতি অল্পকালের মধ্যেই তা সারা উপমহাদেশে প্রসারিত হয়েছিল।
ইংরেজদের শাসন-শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ দেশের সিপাহিরা ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
পলাশীর ১০০ বছর পর সিপাহিরা ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যর্থতার জন্যও দায়ী স্বদেশী শক্তির চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতা। সেদিন যদি দেশীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশ উদ্ধার বা স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিপাহিদের পাশে দাঁড়াতো তাহলে স্বাধীনতার জন্য আমাদের আরও একশত বৎসর সংগ্রাম করতে হতো না।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার করুণ পরিণতি যে কোনো হৃদয়বান মানুষকেই বিষাদে আপ্লুত করে। মুর্শিদাবাদে আনার পর সিরাজকে এক নিভৃত কারাকক্ষে আবদ্ধ করা হয়। মীর জাফর পুত্র মিরন সিরাজকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং যে তাকে হত্যা করবে তাকে যথোপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়। এ ঘৃণ্য প্রস্তাব সকলেই প্রত্যাখ্যান করে।
কিন্তু মোহাম্মদী বেগ যে আবাল্য আলীবর্দী ও সিরাজ-উদ-দৌলা ¯েœহ ও অনুকম্পায় প্রতিপালিত সেই অর্থলোভে এই নিষ্ঠুর কার্য সমাধা করতে রাজি হয়। মৃত্যুর পর মীরনের নির্দেশে সিরাজের খ-িত দেহ একটি হাতির পিঠে স্থাপন করে নগর প্রদক্ষিণ করানো হয়। সিরাজের মৃত্যু সংবাদ শুনে তার মা আমিনা বেগম রাজ-অন্তঃপুর থেকে পাগলিনীর ন্যায় ছুটে প্রকাশ্য রাজপথে বেরিয়ে পড়েন। সিরাজের খ-িত দেহ বক্ষে ধারণ করে তিনি ধুলায় গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদে বুক ভাসান। পরে তাঁকে বলপূর্বক অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়। সিরাজের লাশ মুর্শিদাবাদ নগরীর দক্ষিণ প্রান্তে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে খোশবাগ নামক স্থানে আলীবর্দীর কবরের পূর্ব পাশে সমাধির ব্যবস্থা করা হয়। সিরাজ পত্নী লুৎফুন্নেছাকে ঢাকায় নির্বাসিত করা হয়।
কিছুকাল পর ইংরেজরা তাকে মুর্শিদাবাদে আনয়ন করে নবাব আলীবর্দী ও সিরাজের সমাধি খোশবাগের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। লুৎফুন্নেছা তার একমাত্র কন্যাকে নিয়ে আজীবন সিরাজের কবরে বাতি দিয়েছেন। সিরাজ শহীদ হওয়ার পর লুৎফুন্নেছা আরো ৩২ বছর জীবিত ছিলেন এবং প্রতিদিনই স্বামীর কবরে গিয়ে কান্নাকাটি করতেন। স্বামীর কবরে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করতে করতেই একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। খোশবাগে স্বামীর ঠিক পায়ের কাছেই তাকে সমাহিত করা হয়।
মুর্শিদাবাদ থেকে সামান্য দক্ষিণে ভাগিরথীর পশ্চিম তীরে প্রাচীরবেষ্টিত সমাধি ভবনে চিরনিদ্রায় শায়িত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার এককালের ভাগ্য বিধাতা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পাশে তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেছা। তার প্রিয় দাদু আলীবর্দীর কবরও ঐ একই সমাধি ভবনে। আজো ভাগীরথীর পানি কুল কুল শব্দে বয়ে যায় সমাধি ভবনের পাশ দিয়ে। প্রত্যহ নিশীথে নির্মল নীলাকাশ থেকে ঝরে পড়ে বিন্দু বিন্দু শিশির বিন্দু যেন সারারাত হাজারো তারার চোখের জলে ¯œাত হয় সমাধি।
সিরাজ-উদ-দৌলার ইতিহাস আমাদের জাতীয় ইতিহাস। এ ইতিহাস নিজেদের শিক্ষা নেয়ার ইতিহাস। এ শিক্ষা দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশী-বিদেশী শক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার শিক্ষা। কারণ এখনো মীর জাফর-উর্মিচাঁদ-জগৎশেঠরা সক্রিয় ও শক্তিশালী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস একদিকে স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে দেশের জন্য অকাতরে জীবনকে বিলিয়ে দেবার মহিমায় উজ্জ্বল; ষড়যন্ত্র ও শপথের দৃপ্ত প্রত্যয়-মহাকালের ¯্রােতধারায় ইতিহাস হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করছে।
লেখক : গবেষক ও পর্যটন করপোরেশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক
No comments:
Post a Comment