Friday 23 June 2017

সিরাজের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী



সিরাজের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী
 

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: অশোক কর্মকার
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
মে ২০১৫
৫০৪ পৃষ্ঠা
দাম: ৭০০ টাকা।

রাজকীয় শাসনের ইতিহাস বিশ্বজোড়া প্রায় অভিন্ন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। ঈর্ষা, দ্বেষ, ক্ষমতার লোভ, নাম ও যশের আকাঙ্ক্ষা, ব্যভিচার, লাম্পট্য, হত্যা, পররাজ্য গ্রাস, যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ—এসবই নিত্যকার ঘটনা। সেই প্রেক্ষাপটে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা শিরোনামের বইটি পড়তে পড়তে আমরা যদি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রের বিচারে বসি, সবকিছু ছাপিয়ে পেয়ে যাব ভিন্ন এক সিরাজকে।

সিরাজ-উদ-দৌলার আলোচ্য এই জীবনী-রচনার পটভূমিটি জানা খুবই জরুরি। জরুরি এ কারণেই যে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র বিখ্যাত জীবনীর পাশাপাশি অন্য আরও কিছু জীবনী আছে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে।

আলোচ্য বইয়ের লেখক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর ‘গ্রন্থ রচনা সম্পর্কে দুটি কথা’ শীর্ষক ভূমিকা মারফত জানাচ্ছেন, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নবাবি আমলের ইতিহাস নিয়ে সমসাময়িক কালের ফারসি ভাষায় রচিত সাত-আটজন ঐতিহাসিকের রচনা পড়ার সুযোগ আমার হয়।...কিন্তু এসব বই পাঠ করে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার প্রতি যুগের সব কজন ঐতিহাসিকের বিষোদ্গারের প্রচেষ্টা দেখে। আমি লক্ষ করি, সিয়ার (সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন) রচয়িতা ছাড়া যুগের আর সব ঐতিহাসিক সিরাজ-উদ-দৌলা সম্বন্ধে যা লিখে গেছেন, তার সবই সিরাজের দোষ-ত্রুটি ও কল্পিত ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত, বিকৃত ও খণ্ডিত বিবরণ। সেসব বর্ণনায় ইচ্ছাকৃতভাবে সিরাজ-উদ-দৌলাকে মোটামুটিভাবে অমানুষ হিসেবেই রূপায়িত করা হয়েছে।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘ফলে সত্যকে বের করার জন্য আমার মনে একটা বাসনা জেগে উঠল।’ বস্তুত সেই বাসনারই বাস্তব ফসল তাঁর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। গ্রন্থকার এখানে বাস্তব উদাহরণসহযোগে সিরাজের বাল্য ও কৈশোর জীবন, শিক্ষাদীক্ষা এবং ওই বয়সেই তাঁর প্রখর বুদ্ধি ও আত্মসম্মানজ্ঞানের পরিচয় তুলে ধরেছেন।

নবাবি আমলের সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও লেখকেরা সিরাজের ব্যক্তিগত চরিত্রের যেসব বর্ণনা তুলে ধরেছেন, সেসবের খণ্ডনে যাকারিয়া যেন খড়্গহস্ত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার আগে থেকেই অপপ্রচার ছিল সিরাজের নামে। কোম্পানি তার ব্যবসা বৃদ্ধির পাশাপাশি নানা কায়দায় সিরাজের বিরুদ্ধে জোরদার করতে থাকে অপপ্রচার, এমনকি বাস্তব ষড়যন্ত্রও। কোম্পানির নবাব-বিরোধী এই ষড়যন্ত্রের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সহযোগী হয় মিরজাফর, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ—এদের সেই ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচক বিবরণ দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত দিয়ে তুলে ধরেছেন লেখক।
নবাবের আনুগত্য না মেনেই বাংলায় ব্যবসা করতে চেয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফলে কলকাতায় তাদের বিরুদ্ধে সিরাজকে সেনা অভিযান চালাতে হয়েছিল দুবার। এ সময়ই তাঁর নামে ছড়ানো হয় সেই কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডের অপপ্রচার। অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ড যে গল্পের চেয়েও অলীক, বহু পরে উপযুক্ত প্রমাণ হাজির করে তা তুলে ধরেছিলেন ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।

তবে নবাবের বিরুদ্ধে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মিরজাফর ও ইংরেজদের যে গোপন চুক্তি হয়, তা-ই ডেকে আনে সিরাজের অন্তিম ভাগ্য বিপর্যয়—পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ, যুদ্ধক্ষেত্রে মিরজাফরের কৌশলী ভূমিকা, চালাকি। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। করুণ মৃত্যুর ভেতর দিয়ে কিংবদন্তি হয়ে গেলেন সিরাজ-উদ-দৌলা। তাঁকে নিয়ে লেখা হতে থাকল গাঁথা, পুঁথি, কবিতা, গান, ছড়া ও লোকপ্রবাদ, নাটক ও জীবনী।
কিন্তু সিরাজ-উদ-দৌলার একটি বিস্তারিত বা পূর্ণাঙ্গ জীবনীর অভাব ছিল এতকাল পর্যন্ত। এই বই পূরণ করেছে সেই অভাব। ফারসি, ইংরেজি, বাংলা গ্রন্থধৃত তথ্যসূত্র ঘেঁটে আবুল কালাম মোহম্মদ যাকারিয়া সবিস্তারে সিরাজের যে জীবনী লিখেছেন, তাতে তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে উঠেছেন সিরাজ-উদ-দৌলাকে তাঁর প্রকৃত চরিত্রসমেত তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াসের জন্য। লেখকের সার্থকতা এখানেই।

No comments:

Post a Comment