Friday 23 June 2017

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন |
নদীবিধৌত টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা, জাতির স্থপতি এবং বাঙালি জাতির পিতা হওয়ার ঘটনাপ্রবাহ খুবই উল্লেখযোগ্য। প্রথমত. তিনি ছেলেবেলা থেকেই দুর্দান্ত ছিলেন। তবে মানুষের সেবায়, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। সাহসের তাঁর কমতি ছিল না, স্কুলে পড়ার সময়েই রাজনৈতিক আন্দোলন করেছেন। খুব অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, আবার মুসলিমদের ওপর কোনো অন্যায় হলে তা প্রতিবিধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। নীতির বিষয়ে কোনো আপস কোনো সময় করেননি। এখানে একটি বিষয় বলা দরকার, শেখ মুজিব কখনই তাঁর কোনো রাজনৈতিক মতবিরোধকে ব্যক্তিগত শত্রুতায় পরিণত করেননি। সেজন্য আমরা দেখি, যারা রাজনৈতিকভাবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, যেমন— ইউসুফ আলী চৌধুরী, মোহন মিয়া, ওয়াহিদুজ্জামান ঠান্ডা মিয়া কিংবা খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমদ প্রমুখ তাদের বা তাদের পরিবার সম্পর্কে কথাবার্তা যখনই বলেছেন, তখন ভদ্রতাসহকারে, সংযত হয়ে এবং অত্যন্ত হূদয়স্পর্শীভাবে উক্তি করেছেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীনকালে অনেক রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীর পরিবারকে রাজকোষ থেকে অর্থ সাহায্য পাঠাতেন।

বাঙালি জাতির ইতিহাস খুব ঘটনাবহুল। তবে একটি বিষয় খুব সত্যি, মুঘল-পাঠান শাসন, সেন বংশীয় শাসন, ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ২৩ বছরের পাকিস্তানি আমলে সবসময় পূর্ব বাংলার বাঙালিরা মোটামুটি শোষিত হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। পূর্ব বাংলাকে পশ্চাত্ভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি শেখ মুজিব ছেলেবেলা থেকেই বুঝতে পারতেন। তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সংস্পর্শে আসেন, তাদের মধ্যে অত্যন্ত স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। আর হোসেন সোহরাওয়ার্দীর কাছে শেখ মুজিব নিয়েছিলেন রাজনীতির দীক্ষা। এছাড়া তিনি মানুষের কল্যাণ, সাম্রাজ্যবাদ ও আর্থসামাজিক অবস্থা বিষয়েও যথেষ্ট গবেষণা, চিন্তাভাবনা করেছেন। চীন দেশ ভ্রমণ করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে। সেখানকার অনেক কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে, বিশেষ করে পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে বাঙালির ন্যায্য হিস্যা যে পাওয়া যায়নি, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন। এবং এর প্রতিবিধানকে মোটামুটি তাঁর মূল রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে খুব বন্যা হতো। চুয়ান্ন সালে হয়েছে, পঞ্চান্ন সালেও হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত ক্রুগ মিশন আনা হয়। ওই মিশন দীর্ঘদিন কাজ করে দুটি সুপারিশ করে। নদী শাসন করা দরকার এবং পূর্ব বাংলার সব নদীকে ড্রেজিং করা দরকার। ড্রেজিংয়ের জন্য প্রকল্পের মোট খরচ ছিল ৫০০ কোটি টাকা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল, এই টাকাটা যেন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাইরে বরাদ্দ করা হয়। পাকিস্তানিরা তা মানলেন না। এর বদলে তারা নিলেন টারবেলা ডেম প্রকল্প; এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে পাঞ্জাব এবং সীমান্ত প্রদেশের জন্য। এ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৬০০ কোটি টাকা। এটি ঠিকই তারা পরিকল্পনা বাজেটের বাইরে থেকে দিলেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের এ প্রকল্পের প্রয়োজন সবসময় অনুভূত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের টাকা ছিল না বলে এদ্দিন এ প্রকল্প হাতে নেয়া সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি একনেকে প্রকল্পটি পাস হয়েছে: বাংলাদেশের সব নদীকে ড্রেজিং করা হবে। এর উপকারিতা অনেক। ১৯৫৬ সালে করা হলে বাংলাদেশের চেহারা অন্য রকম হতো। যা-ই হোক, শেখ মুজিব ভাবতেন কেন ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা হলেও তা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নয়। এমনকি স্বর্গত শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষাকে জাতীয় গণপরিষদের কার্যপ্রণালির মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার দাবি তুলেছিলেন। সে প্রস্তাব কিন্তু পাস করা হয়নি। এসব কিছু মিলিয়ে শেখ মুজিবের রাজনীতি, জনগণভাবনা ও দেশপ্রেম।

শেখ মুজিব খুব দৃঢ়ভাবে গণতন্ত্রমনা ছিলেন। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন না বলেই আমার ধারণা। আটান্ন সালে যে সময়ে সামরিক আইন হয়, ঠিক সে সময়ে সারা পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল এবং নির্বাচন হলে বাঙালি জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় আমাদের আইনসঙ্গত ও সংবিধানসম্মত দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে করা হয়েছিল। তার বদলে সামরিক শাসন হলো। শেখ মুজিব জেলে গেলেন। আরো অনেকে জেলে গেলেন। বাঙালির ওপর জুলুম হলো। এতে পরিষ্কার বোঝা গেল, দাবি আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই হবে, কিন্তু জোরদার একতাবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে দু-তিনটা ঘটনা ঘটে। ’৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন হয়। এর পর ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ অনেকের চোখ খুলে দেয়। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। শেখ মুজিব আরো বাস্তববাদী হন এবং সব চিন্তাভাবনা করে রাজনৈতিক আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

এক্ষেত্রে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক. ১৯৬২ সালে নিউক্লিয়াস নামে একটি আধা গোপন সংগঠন তৈরি হয়। সে ছায়াতলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ছাড়াও প্রগতিশীল অনেক লোক জমা হন। সে সম্পর্কে অবশ্য দু-রকম মত আছে। শেখ মুজিব এটিকে মনেপ্রাণে সমর্থন দিয়েছিলেন নাকি শুধু আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। তবে তাঁর যে সমর্থন ছিল, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই তিনি স্বাধীনতা চাননি— এটি বলা মোটেও ঠিক হবে না। ওই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে স্বাধীনতার একটি পথ খোলা রাখা হয়েছিল। আর ১৯৬৬ সালের একটি নজির তো আছেই। খোদ পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে বসে যে ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিব, সেটি অবশ্যই বাঙালির মুক্তিসনদ। সেখানে যেসব দাবি আছে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের যে পর্যায়ের স্বায়ত্তশাসন হবে, সেটি আদতে স্বাধীনতারই নামান্তর। এটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল। তাই এর পর জুলুম-অত্যাচার আরো বেড়ে যায়। শেখ মুুজিবকে বারবার কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়। তিনি বঙ্গবন্ধু হওয়ার প্রেক্ষিতটা তৈরি হয়েছিল এসব কারণে। এর পর আগরতলা মামলা হয়। এটিকে ষড়যন্ত্র মামলা বলা হয়। কিন্তু ঘটনা খুব মিথ্যা ছিল বলে মনে হয় না। কারণ তিনি অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তার কাছে অনেকে আসত। যারা সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন বা অবসর নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আসতেন। পরামর্শ করতেন এবং তিনি সবসময় বলতেন যে, হ্যাঁ, আমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে সংসদীয় পন্থায় আন্দোলন করব, কিন্তু বিকল্প পথ খোলা রাখতে হবে। এজন্য কিছু গোপন সভা-সমিতি হয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো। ওই মামলায় প্রথম দিকে শেখ মুুজিবকে আসামি করা না হলেও পরে তার নাম সংযুক্ত করা হয়। মামলা তুঙ্গে উঠে ১৯৬৯ সালে। শুরু হয় ঘটনা তরঙ্গপ্রবাহ।

আইউব খানের পতন হলো। ইয়াহিয়া খান আসি আসি করছেন। তখন এ দেশের ছাত্র-জনতা, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দশ দল এগার দফার ডাক দেয়, খুব দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে। এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য প্রচণ্ডভাবে উত্তাল হয় দেশ। আইউব খান রাউয়ালপিন্ডিতে একটি সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন।

সেখানে শেখ মুজিব প্যারোলে যাবেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘প্যারোলে যান’ তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্যারোলে যেতে রাজি হননি। সেখানে তিনি বড় সমর্থন পেয়েছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কাছ থেকে। তিনি জেলগেটে দেখা করে বলেছিলেন, ‘দেশ যেভাবে প্রস্তুত, তাতে তোমার প্যারোলে যাওয়ার গ্লানি সওয়ার প্রয়োজন নেই, তোমাকে এমনিতেই মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।’ কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার যখন শুনানি চলছে, তখন ছাত্রজনতার আন্দোলন এত গভীরতা পায়, এত প্রবল রূপ ধারণ করে যে, তার চাপে শেখ মুজিবকে জেল থেকে ছাড়তে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে তখনকার দশ ছাত্র সংগঠনের নেতা ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে পল্টনে বিশাল জনসমুদ্রে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। সত্যি কথা বলতে কি, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে একটা স্বাভাবিক গতিতে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যে বিশালতা, নির্ভীকতা এবং পরার্থপরতা সব মিলিয়ে তাঁর প্রতি একটা বিশ্বাসযোগ্যতা খুব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বমহলে।

আগেই বলা হয়েছে, রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও সেটা নিয়ে কোনো বৈরিতা তৈরি করতেন না বঙ্গবন্ধু। ছয় দফা খসড়া কে তৈরি করেছিলেন, এ নিয়ে মজাদার বিতর্ক আছে। কেউ বলেন অমুক অধ্যাপক করেছেন, কেউ বলেন অমুক সিভিল সার্ভেন্ট করে দিয়েছেন। আবার বামপন্থী নেতাদের মধ্যে জনাব তোয়াহা বলেছিলেন, এটা সিআইএ তৈরি করে দিয়েছে। এসব প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু একেবারে প্রত্যক্ষভাবে খোলাসা করেছেন। মাঝে মাঝেই তাঁর মাথায় জনকল্যাণ রাজনীতি চিন্তা কিলবিল করে উঠত। তিনি মনে করেছিলেন, স্বায়ত্তশাসনটাকে আরো কঠিনভাবে, দৃঢ়ভাবে রূপরেখা দিলে কেমন হয়। বলা বাহুল্য, মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে তিনি দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। অফিস ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ অফিসের উল্টো দিকে দোতলায়। একটা টাইপরাইটার ছিল। তিনি বলতেন ভাঙা টাইপরাইটার আর বলতেন ‘আমার হানিফ’। বলতেন, আমি বলে গেছি আর আমার হানিফ ওই ভাঙা টাইপরাইটারে সেটা টাইপ করেছে। এটাই ছয় দফার মূল কথা। তবে হ্যাঁ, অন্যরা অনেক ধারণা দিয়েছেন। সেটা বঙ্গবন্ধু ধারণ করেছেন। এভাবে আস্তে আস্তে ছয় দফাকে কেন্দ্র করে ঊনসত্তরের সফল গণঅভ্যুত্থানের পথ রচিত হয়।

এদিকে ১৯৬৯ সালে ক্ষমতার পালাবদলে ইয়াহিয়া খান শাসন ক্ষমতায় আসেন। তার খায়েস ছিল যে, গণতন্ত্র দিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি হবেন। তাকে গোয়েন্দা বাহিনী মোটামুটি এই আশ্বাস দিল যে, শেখ মুজিব অনেক বড় মাপের নেতা। তার কথা লোকে শোনে। কিন্তু যখন নির্বাচন হবে, তখন অখণ্ড পাকিস্তানের একটা সমর্থক গোষ্ঠী আছে এবং সব মিলিয়ে পূর্ব বাংলার ভোট ভাগাভাগি হবে। এতে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মুজিববিরোধী ভোট নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের। ছয় দফা টিকবে না। এই আলাপ-আলোচনার মধ্যে বাঙালিদের জন্য একটা বড় ধরনের লাভ হয়ে যায়, ‘এক লোক এক ভোট’। এটা এর আগে কখনো স্বীকৃত হয়নি। এটা গিলানো হয়েছিল ‘দেব আর নেব হিসেবে’। এটা একটা ট্রেড অফ। ইয়াহিয়া খান মানলেন যে, তিনি এক ব্যক্তি এক ভোটে নির্বাচন করবেন। আর এদিক থেকে বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতারা মানলেন, লিগেল ফ্রেইমওয়ার্ক অর্ডার। এলএফওতে কিছু মারাত্মক বিষয় আছে। এটাতে রয়েছে, চার মাসের মধ্যে সংবিধান রচনা করতে না পারলে ওই সংসদ ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জয়ের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত ছিলেন। তখন একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটে। ২৫ নভেম্বর নির্বাচন ছিল। কিন্তু ১৫ নভেম্বর প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। কয়েক লাখ লোক নিহত হন। এবং সেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চীন সফরে যান ইয়াহিয়া। এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বঙ্গবন্ধুর শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর পিছিয়ে দেয়া তারিখে নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, ৩০০ আসনের সংসদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি পায় আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে ছয় দফা দাবি আরো প্রচণ্ডভাবে সমর্থিত হলো।

বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদ অধিবেশন ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাকার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সেটা ৩ মার্চ ডাকলেন। মনে হলো যেন ভুট্টোর পরামর্শে তিনি এটা করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী অধিবেশন বসার কথা শেরেবাংলা নগরে দ্বিতীয় রাজধানীতে। যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়েছিল তাতে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংবিধান রচনা করে ফেলবেন ছয় দফার ভিত্তিতে। তখনই সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু হয়ে যাবে। এটা ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা বুঝলেন। পরে ভুট্টো এলেন ঢাকায়, ইয়াহিয়াও এলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা করলেন। অচলাবস্থা। তার মধ্যে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সাংবাদিকদের বললেন, ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’। একটা ধোঁয়াশার মতো সৃষ্টি করলেন। তারপর ১ মার্চ যখন সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন, ইয়াহিয়া খান বুঝিয়ে দিলেন বাঙালিরা ক্ষমতায় বসতে পারবে না, তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে না। ১ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত হলো প্রচণ্ড গণআন্দোলন, অভূতপূর্ব ঐক্য। প্রকৃতপক্ষে তখন দেশ শাসিত হলো শেখ মুজিবের নির্দেশে। তিনি খুব সতর্কতার সঙ্গে দেশবাসীকে বারবার বলেন, কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। উর্দুবাসী বা পাকিস্তানি লোকের ওপর নির্যাতন-অত্যাচার করা যাবে না। তা সত্ত্বেও কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শুভক্ষণ। দুটো ভাষণকে রাজনীতির শ্রেষ্ঠ কবিতা বলা হয়। একটি হলো শেখ মুজিবের ওই ভাষণ, অন্যটি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস। আমার কাছে ভাষণের দুটো কথা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এক. ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ আর দুই. ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অর্থাৎ তিনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়ে জোর দিলেন বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলে তবেই অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন সম্ভব। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে। তখনো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। সময়ক্ষেপণ হয়েছে। পাকিস্তানিরা এ দেশে সৈন্য আনার সময় পেয়েছে, সৈন্য নিয়ে এসেছে। অনেকেই দোষারোপ করছেন। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, তখন বঙ্গবন্ধু তার দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা কৌশল নির্ধারণ করছিলেন। সব ব্যাপারে যে প্রস্তুতি ছিল তা নয়। কিন্তু নিশ্চয়ই এই প্রস্তুতি ছিল যে, যদি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে, নেতারা কে কোন দিকে কোথায় যাবেন, কীভাবে দিল্লির সরকারের এবং অন্যান্য মিত্র দেশের সাহায্য নেয়া হবে, সেসব বিষয় ঠিক করা ছিল। সেজন্য বড় নেতা কাউকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাড়িতে পায়নি।

২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন এবং ফোন করেছেন এ রকম দাবিদারের সংখ্যা শ’খানেক। তবে সর্বশেষ জনাব তাজউদ্দিনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোনে আলাপ হয় বলেই মনে হয়।

শেখ মুজিব কেন বাড়ি থেকে সরে গেলেন না? এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা আমার কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি পালিয়ে যাওয়ার লোক না। তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তিনি তখন পর্যন্ত স্বাধীনতার কথাটা পরিষ্কারভাবে বলেননি। ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন বটে, আবার তা বলেননিও যে, আজ থেকে আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু অবশ্যই ন্যায়ের পথে ছিলেন। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা পালিয়ে যাবেন? পালিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ নাকি ভারতীয়রা দেন, মার্কিনিরাও দিয়েছিলেন। তৃতীয় একটা ব্যাখ্যা অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দিয়ে থাকেন। সেটা হলো, তাকে খোঁজার নাম করে অপারেশন সার্চলাইট আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করত, অনেক বেশি প্রাণহানি হতো।

অন্য একটি বিষয় খুব তাত্পর্যপূর্ণ ও দুঃখজনক। বলা হয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, পুলিশে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত বিপুল সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা কর্নেল এমএজি ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিল চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা বিমানবন্দর এবং একটা নদীবন্দর বন্ধ করে দিলে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যেতে পারত না। তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হতো। সংসদ বসার সুযোগ না দিয়েই যেন সশস্ত্র সংগ্রাম করা হয়। ওই প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু একদম রাজি হননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এটা তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, সংসদীয় গণতন্ত্রকে একটা সুযোগ দিতে হবে। দেশের ৫৬ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কেন দেশ ভাঙার দুর্নাম নেবেন। তখন বায়াফ্রা যুদ্ধ হচ্ছিল নাইজেরিয়াতে। তিনি জানতেন, বিশ্বের কোনো শক্তি একজন দেশের বিচ্ছিন্নতাকারীকে সমর্থন করে না। কাজেই বিচ্ছিন্নতাবাদী হতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কী মহিমা আজ পর্যন্ত কেউ বলেননি, শেখ মুজিব একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী, তিনি পাকিস্তানকে ভেঙেছেন। সবাই বলেছে, পাকিস্তানি শাসকদের গোঁয়ার্তুমি, সংসদ না ডাকার কারণেই এটা হয়েছে। আমার মনে হয়, শেখ মুজিবের এসব নীতি সারা বিশ্বে অনুকরণীয়।

নয় মাসের যুদ্ধ হয়েছে। আমাদের ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এ শহীদানদের মধ্যে অনেক নারীও ছিলেন। যুদ্ধে

 শহীদ হয়েছেন আপামর জনসাধারণ— ছাত্র, শিক্ষক, জনতা, রাজনৈতিক কর্মী, কৃষাণ-কৃষাণি, শ্রমজীবী, নারী, পুরুষ। এক কোটি মানুষ ভারতে দেশান্তর হলেন। বাকি যে সাড়ে ছয় কোটি লোক দেশে রয়ে গেলেন, তারা প্রায় সবাই মুক্তিবাহিনীকে মনে-প্রাণে সাহায্য করলেন। অনেকে প্রকাশ্যে কেউ কেউ গোপনে। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধটা শুধু যে দুই সেনাবাহিনীর লড়াই, সীমান্তে লড়াই তা কিন্তু নয়। দেশের ভেতরে গেরিলা বাহিনীও যুদ্ধ করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী খুব প্রশিক্ষিত এবং আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সম্মুখে যেমন ছিল যৌথবাহিনী: মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেমেয়েরা সম্মুখে আর পাশাপাশি বা পেছনে ছিল ভারতের সেনাবাহিনী। হ্যাঁ, তারা না থাকলে স্বাধীন হতো না। তারা সংখ্যায় বেশি ছিলেন, সুপ্রশিক্ষিত ছিলেন। তাদের জোর অনেক বেশি ছিল। সে কারণে পাকিস্তানিরা ভড়কে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙালি ছেলেমেয়েরা, শিল্পীরা, শিল্পপতিরা, খোলোয়াড়রা, সাহিত্যিকরা, লেখকরা, সাংবাদিকরা, সংস্কৃতিকর্মীরা যেভাবে প্রত্যেকটা ফ্রন্টে, প্রত্যেকটা ফর্মে যুদ্ধ করেছেন সেটা অসাধারণ। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ একটা আদর্শভিত্তিক যুদ্ধ। ‘বাংলার দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ার’ স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধ করেছে সবাই। সর্বোপরি এটা ছিল সত্যিকারের জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধ সম্মুখে হয়েছে, সীমান্তে হয়েছে, আবার গুপ্তভাবেও হয়েছে। গেরিলা যুদ্ধ। সুতরাং সত্যিকারভাবেই এটা একটা জনযুদ্ধ হয়েছে। কেউ যদি বলেন, এ যুদ্ধ সশস্ত্র বাহিনী করেছে ঠিক হবে না। আবার কেউ যদি বলেন, ভারতীয়রা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, এটাও ঠিক হবে না। একটা জনযুদ্ধ, বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মিত্র বাহিনীর সহূদয় সহায়তায় এতে অংশগ্রহণ করেছেন। শেখ মুজিবের কৃতিত্ব এখানেই; সেজন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ এটাকে হুকুম হিসেবে মেনে নেয় সবাই। এবং ২৫ মার্চের পরে বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় জনসাধারণ হাজার হাজার বাঁশ, বৈঠা, লগি নিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন করে ছাড়ার তাদের দৃঢ় পণ ছিল। তখন একটা ছোট ভুল হয়েছিল। এ ভুলের মাশুল সৌভাগ্যবশত আমাদের দিতে হয়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একবার ঘোষণা করা হলো, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গেই আছেন। যুদ্ধ করছেন।’ এটা কিন্তু খুবই ভুল একটা ঘোষণা ছিল। তাড়াতাড়ি অবশ্য এ সর্বনাশা ঘোষণা বাদ দেয়া হয়। পরে আর বলা হয়নি। এই সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলতে পারত। তারা বোধহয় শোনেনি কিংবা তাদের অত বুদ্ধি ছিল না কোনো কালেই।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে হয়তো অহেতুক একটা বিতর্ক আছে। মেজর জিয়াউর রহমান একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন ২৭ মার্চ। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হান্নান ২৬ মার্চ কালুরঘাট থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার ২৪ ঘণ্টা পর তদনীন্তন মেজর জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন: ‘ইন দ্য নেইম অব আওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিব’। এই ঘোষণাটারও মূল্য আছে বৈকি! যাহোক, এসব বিতর্কের অবসান হওয়া দরকার। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আদর্শবিচ্যুত কিছু মানুষ বাদে প্রায় সবাই স্বাধীনতার পক্ষে এবং স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা করার আদর্শে কেউ কেউ হয়তো বিশ্বাসী নন। বিভিন্ন পথ থাকতেই পারে। স্বাধীনতা তো সহজে আসেনি। অতি মহার্ঘ্য দিয়ে কেনা বাংলার স্বাধীনতা। অনেকেই এর মূল্য বোঝেন না। অনেক দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেক লম্বা হয়েছে। আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে মূল্য আরো বেশি দিতে হয়েছে এবং তাতে স্বাধীনতার প্রতি দরদটা আরো বেশি হয়েছে। আরেকটি বিষয়, যেসব দেশ দীর্ঘকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বাধীন হয়েছে, সেখানে স্বাধীনতার পরে যে বিশৃঙ্খলা হয়েছে, খাদ্যাভাবের ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতির জনক সে রকম হতে দেননি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে খাদ্যাভাবে কিছু মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে থাকতে পারে। কিন্তু বাসন্তীর গল্প যে বানানো গল্প, সেটা এখন পরিষ্কার হয়ে এসেছে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত যে সময়টা, সেটা আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। সারা বিশ্বে চরম অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছিল। খাদ্যশস্যের অভাব, ফসলহানি ছিল ব্যাপক। পেট্রোলিয়ামের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৪ ডলার থেকে ১৪ ডলারে। কাজেই বাংলাদেশের বাজেটের একটা বিপুলাংশ পেট্রোলিয়াম আমদানিতে বেসামাল হয়ে গেল। এছাড়া বাংলাদেশে ভয়ঙ্করভাবে একটা খরা দেখা গেল। ফসলহানি হলো, খাদ্য সংকট দেখা গেল। এ প্রেক্ষিতে জাতির পিতা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) করলেন। খাদ্যসহ সব নিত্যব্যবহার্য পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করলেন। কনজিউমার সাপ্লাই করপোরেশনের মাধ্যমে আমদানি করা খাদ্যপণ্য ও অন্য নিত্যব্যবহার্য সারা দেশে বিতরণের ব্যবস্থা নিলেন। স্ট্যাটিউটেরি রেশনিং এবং মডিফাইড রেশনিং করলেন। কাউকে মরতে দেয়া হলো না। এ কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকে দিতে চান না কেউ কেউ।

শিল্প-কলকারখানা, ব্যাংক, বীমা, কোম্পানির সব মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। তারা পালিয়ে গেল। সেগুলো অধিগ্রহণ করতে হলো। সুইডেন এবং কানাডা নগদ বৈদেশিক মুদ্রা দিলেন। তা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ খোলা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হলো। বাণিজ্যিক ব্যাংক, বীমা সব স্থাপন করা হলো। কল-কারখানা আবার চালু করা হলো। স্কুল-কলেজ পুনর্বাসন করা হলো। রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট মেরামত করা হলো। রাশিয়া সব ধরনের সাহায্য দিল। মাইন পরিষ্কার করা হলো। পূর্ব জার্মানি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। ইরাক খাদ্যশস্য দিয়ে বড় ধরনের সাহায্য করল। ডাচরা উড়োজাহাজ দিল। ডেনমার্ক সাহায্য দিল অকাতরে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশের অবস্থা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল করা হলো। যাতে কেউ না খেয়ে মরে, সে ব্যবস্থা করা হলো।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনৈতিক সাধনা ছিল জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। তার কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনার মধ্যে বিষয়টি গভীর ও বিপুলভাবে সন্নিবেশিত ছিল। তার ধ্যান-ধারণার মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী, নিম্নবিত্ত মানুষ, কৃষাণ-কৃষাণি এবং শ্রমজীবী। তার কল্পনায়, তার চিন্তায়, তার রাজনীতিতে, তার দর্শনে সদা দীপ্তমান ছিল অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা ও ঐশ্বর্যের চিন্তাভাবনা। দেশ স্বাধীন করার আগে যে আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল, তার প্রতিটি অর্থনৈতিক বিষয়কে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়েছিল। যেমন ছয় দফা আন্দোলন।

সেখানেও অর্থনৈতিক বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। কীভাবে দুই অর্থনীতি চলবে এক দেশে। কীভাবে স্বাধীনভাবে বাণিজ্য হবে? কীভাবে আলাদাভাবে মুদ্রাব্যবস্থা পরিচালনা করা যাবে? স্বাধীনতা লাভের পর জাতির জনক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেখানেও অর্থনৈতিক বিবেচনা ছিল মুখ্য। অর্থনৈতিক সংস্কারের অধীন তিন ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। একটি স্বল্পকালীন পরিকল্পনা, একটা মধ্যবর্তী, অন্যটি সুদূরপ্রসারী। দেশ একটি রক্তক্ষয়ী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলো। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইল না বলে যৌথ বাহিনীর কাছেই বশ্যতা স্বীকার করল। এর ২৫ দিন পর আন্তর্জাতিক চাপে মুক্তি পেয়ে জাতির জনক বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। ভাবতে থাকলেন কীভাবে অর্থনীতির চাকা সচল করা যায়। কিছু বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। বন্দর ধ্বংস করা হয়েছিল, মাইন পোঁতা ছিল সব অঞ্চলে। রেল, ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে গেছে পাকিস্তানি পলায়নপর বাহিনী। রাষ্ট্রের কোষাগারে বিদেশী মুদ্রা একেবারেই ছিল না। কোনো খাদ্যশস্য ছিল না, কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেই। ছিল হা-হুতাশ আর স্বাধীন দেশে আলাদীনের প্রদীপে সবকিছু পেয়ে যাবার উচ্চাশা। ভারতসহ মিত্র দেশগুলো থেকে খাদ্য, পণ্য এবং বিভিন্ন সাহায্য এনে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করলেন। বন্দরগুলো মাইনমুক্ত করে কার্যকর করার চেষ্টা করলেন জাতির জনক। সব অবকাঠামোকে পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা নিলেন। পাশাপাশি জনজীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে তিনি কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। সংবিধান প্রণয়ন, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি শুরু হলো। যে ভবন থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদানের ওপর গুলি করার হুকুম দেয়া হয়, সেই বর্ধমান হাউজ হলো বাংলা একাডেমি। স্থাপিত হলো শিশু একাডেমি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, দশটি সেবার করপোরেশনসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান।

স্বাধীনতার পর তাত্ক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধুর সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার মধ্যে প্রথম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত ছিল কৃষি। কৃষিকে আধুনিক করা এবং এ খাত উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। উদ্দেশ্য ছিল যাতে খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা যায়, দরিদ্র কৃষককে বাঁচানো যায়, সর্বোপরি কৃষিতে কীভাবে বহুমুখিতা আনা যায়। লক্ষাধিক সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করা হলো। তার পরিকল্পনার মূলে ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন। তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ। কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, যাতে ১৯৭৩ সালের মধ্যেই হ্রাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো লিফট পাম্প, ২ হাজার ৯০০ গভীর নলকূপ ও ৩ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭২ সালের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য ১৬ হাজার ১২৬ টন ধানবীজ, ৪৫৪ টন পাটবীজ ও ১ হাজার ৩৭ টন গমবীজ সরবরাহ করা হয়। দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে বাংলার কৃষাণ-কৃষাণিকে মুক্তি দেয়া হয় এবং তাদের সব বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা রহিত করা হয় বঙ্গবন্ধুর শাসনকালেই। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেয়া হয়, যাতে কৃষিপণ্যের ন্যায়সঙ্গত মূল্য কৃষকরা পান। দরিদ্র কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক নিম্ন মূল্যের রেশন সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত ছিলেন, দ্রুত বেড়ে যাওয়া জনসংখ্যা ভবিষ্যতে বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই একটি পরিকল্পিত জনসংখ্যা নীতির অধীনে পাইলট ভিত্তিতে কয়েকটি থানায় পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক স্থাপন করা হয়।

 বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত করেন যাতে গ্রামসহ শহরের ছেলেমেয়েরা অবৈতনিকভাবে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সে উদ্দেশ্যে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় গতি আনয়নের স্বার্থে সব প্রাইমারি শিক্ষকদের সরকারীকরণ করা হয়। কৃষকের বন্ধু জাতির জনক স্থায়ী ভিত্তিতে জমির মালিক ও শ্রমজীবী মানুষের সমন্বয়ে বহুমুখী ও উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতি গঠন করে কৃষি উৎপাদনে দুর্বার গতি আনতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৩-৭৮ সময়কালের জন্য প্রণীত মধ্যবর্তী সময়ের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্য নির্মূলের লক্ষ্যকে এক নম্বর জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এতে দ্রুতগতিতে জাতীয় আয় বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি ও তার সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মাথাপিছু আয় প্রতি বছর ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা এবং বিত্তবানদের আয় বৃদ্ধির গতি ধীরে হলেও দরিদ্রদের আয় দ্রুতগতিতে বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। এও বলা হয়, প্রয়োজনে এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে, যেন ধনীদের ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করে সেই রাজস্ব দিয়ে গরিব, কৃষক, শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের প্রয়োজনীয় আয় ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়। ওই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি নিশ্চিত করার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। কর্মের অধিকার মেনে নিয়ে যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার স্বীকৃত হয়। সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি ও পঙ্গুত্বজনিত বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতির জন্য অভাবগ্রস্তদের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। নগর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূরীকরণে কৃষিতে গতিময় অগ্রগতি সাধন, গ্রামগঞ্জে বিদ্যুতায়ন, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ করার ব্যবস্থা। শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করে গ্রামের উন্নতি সাধন।

গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা একটি অভিন্ন ধারার মাধ্যমে পরিচালিত করা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক শিক্ষাদানের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয় জাতির পিতার শাসনামলেই। শিক্ষাকে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে গড়ে তোলা, আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, আরোগ্যের প্রয়োজন বা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্য প্রয়োজন ব্যতীত মদ ও অন্যান্য মাদকপানীয় ও স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধকরণ। সব নাগরিকের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ। মানুষে মানুষে অঞ্চলভেদে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বিলোপ। সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দৃপ্তকণ্ঠে এবং পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। এ কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। বেকার অথচ কর্মক্ষম প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে কো-অপারেটিভের সদস্য করা হবে। আয়-রোজগারের পয়সা যাবে তাদের হাতে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের হাতে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের আওতাধীনে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে টাউটদের বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশ বাঁচানো যাবে না। আপনার জমিতে উৎপাদিত বর্ধিত ফসলে আপনিও আগের তুলনায় বেশি ভাগ পাবেন। অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে সরকারের হাতেও। থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। মহকুমা আর থাকবে না। প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হবে। নতুন জেলায় একটি করে প্রশাসনিক কাউন্সিল থাকবে। এর মধ্যে জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।’

জাতির জনক অবশ্যই বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনামুক্ত সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘমেয়াদি আমূল সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল আঞ্চলিক সহযোগিতা। তার ধারণা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি সম্মিলিতভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে তার শক্তি হবে দুর্বার। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থানে চলে যেতে পারবে। বাংলাদেশে পানির সমস্যা নিয়ে জাতির জনক সবসময় চিন্তিত ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের অনেক আগেই তিনি জাপানিদের সঙ্গে কথা বলে হওয়াকাওয়া কমিটি গঠন করে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। প্রতিবেশী ভারত আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। সে কথা স্মরণ রেখেও বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা নির্ধারণ, গঙ্গার পানিবণ্টন, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাবর্তন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থকে সামগ্রিকভাবে সমুন্নত রেখে আলোচনা করেছেন, চুক্তি করেছেন। এরই মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জিতে বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা ও মহীসোপানে প্রায় আরো একটি বাংলাদেশের সমপরিমাণ এলাকা অর্জন করেছে। সন্ত্রাসী দমনে সহযোগিতা কার্যকর হয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে রাষ্ট্রীয় কেনাকেটায় দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ওঠেনি। এমনকি ৭৫ সালে বর্বরতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পরও মোশতাক সরকার যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার জন্য তদন্ত করেছিল, সেখানেও তাঁর এবং তাঁর পরিবারের কোনো দুর্নীতির লেশমাত্র পায়নি। সবচেয়ে বড় বিষয়, ৭৪-৭৫ সালের যে অর্থনীতি সেখানকার হিসাবে দেখা যায়, সামষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ছয় থেকে সাত শতাংশের মধ্যে। যেটা আমরা এত দিন পরে অর্জন করতে পারলাম ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে। ১৯৭২ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৬৮৭ টাকা (১৭৭ ডলার)। আর এখন ১ লাখ ৮ হাজার ২১২ টাকা (১৪৬০ ডলার)। অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ জাতির পিতার নির্দেশিত পথ ধরে। সব পরিসংখ্যানই তাই বলে। বঙ্গবন্ধুর মূলমন্ত্রের ধারাবাহিকতায় মোটামুটি গণতান্ত্রিকভাবে আমরা অনেক এগিয়েছি। বাংলাদেশে এখন যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সেটা সারা বিশ্বে নন্দিত; তা না হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ বলা হতো না। ফরচুন ম্যাগাজিন বলছে, দশম শক্তিশালী চিন্তাশীল নেতা তিনি। তাঁকে জাতিসংঘের প্যানেলে রাখা হয়। কল্যাণরাষ্ট্রে আর্থসামাজিক উন্নয়নে শেখ হাসিনার মডেল বিশ্ব পরিমণ্ডলে আলোচিত হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন সম্মোহনী ক্ষমতার বিকাশ হয়েছে, যেটা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই তিনি পেয়েছেন। তিনি তার কাজের মাধ্যমে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে স্রোতের গতি পাল্টিয়ে যেন সাধারণ জনগণকে তার সঙ্গে নিতে চান এবং তা পারছেনও।

দু-একটা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বদনাম করার চেষ্টা করা হয়। এক. সিরাজ শিকদারের হত্যা। ২ জানুয়ারি ১৯৭২ সনে জাতির জনককে উত্তরা গণভবন থেকে আমরা ঢাকায় নিয়ে আসছি। ভোরবেলা হেলিকপ্টারে। বিমানবন্দরেই তাঁকে খবর দেয়া হলো সিরাজ শিকদার পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে নিহত হন। তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হলো, আমাদের সামনেই তিনি বললেন, ‘লোকটাকে তোরা মেরে ফেললি’। যে লোকের এমন প্রতিক্রিয়া ছিল তার তো এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান থাকার কথা নয়। অনুমোদন তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে কথা ওঠে, পরবর্তীতে তিনি সংসদে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ শিকদার’। এটা অভিমানের কথা। অভিমানটা এমন, হ্যাঁ তোমরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণ করো, করতেই পারো। কিন্তু হঠকারী রাজনীতি কেন করো? অবশ্যই সেটা জাসদকে উদ্দেশ করে এবং সিরাজ শিকদার যে সর্বহারা পার্টি করতে চেয়েছিলেন, তার জন্য বলেছিলেন। কারণ অনেক দিনের আন্দোলন লাগে এসব বিষয়ে সফল হতে গেলে। সেজন্য তাদের প্রতি অভিমানপ্রসূত অভিযোগ ছিল জাতির পিতার মনে।

এখানে বলা দরকার, একদলীয় শাসন সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন যে, বাকশাল একের মধ্যে বহুর সম্মিলন। যাহোক, সেটা তাঁর চিন্তাভাবনার বিষয়। সেটা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, এমএজি ওসমানী এবং নূরে আলম সিদ্দিকী এ চারজন সংসদে বসে এ কথিত একদলীয় শাসনের আইনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও ভোট দিয়েছিলেন। তাদের কিন্তু কোনো ক্ষতি হয়নি। তাদের প্রতি কোনো সময় রক্তচক্ষু দেখাননি বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ তার মধ্যে একটা সহনশীলতা ছিল।

শেখ কামালকে বদনামি করার চেষ্টা করা হয়। বলা হয়, ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি ব্যাংক লুট করতে গিয়েছিলেন। এটা সর্বৈব মিথ্যা। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বয়সে তরুণ ছিলেন, স্বাভাবিক দেশপ্রেমের একটা উদ্যমতা ছিল তার মধ্যে। যারা সহিংসতা করার চেষ্টা করেছিল, তাদের শেখ কামাল তাড়া করছিলেন মতিঝিলের রাস্তায়। কিন্তু সামনের গাড়িটি ছিল পুলিশের। আর পুলিশ মনে করে, পেছনের গাড়ির আরোহীরা ব্যাংক লুট করে পালাচ্ছে। তাই তারা গুলি করে। ‘একজন জেনারেলের জবানবন্দী’ বইয়ে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মঈন সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন ঘটনাটি। আমরাও জেনারেল মঈনের মতোই নিশ্চিত যে, শেখ কামাল কখনই ব্যাংক ডাকাতি করতে যাননি।

আরো দুটি বিষয় না বললেই নয়, যুদ্ধাপরাধী। এখানে ১ লাখ ৯৬ হাজার পাকিস্তানি আটকা পড়লেন। আর পাকিস্তানে আটকা চার লাখ বাঙালি। তার মধ্যে কয়েকজন শ্রেষ্ঠ সন্তানও ছিলেন। তখন ভুট্টো সাহেব হুঙ্কার দিলেন। যদি আটকে পড়া পাকিস্তানিদের কোনো ক্ষতি করা হয়, এদের ফেরত না দেয়া হয়, তাহলে চার লাখ বাঙালির নিরাপত্তা থাকবে না। দেনা-পাওনার কথা বাঙালিরা ভুলে যেতে পারে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ উর্দুবাসীগণকেও পাকিস্তানের অনুগত হওয়া সত্ত্বেও ফেরত নেবে না তারা। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভুট্টো সাহেব অপ্রকাশ্যে হুঙ্কার দিয়েছিলেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির প্রস্তাব, তাতে ভেটো দেয়ার ব্যবস্থা করবে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপে এবং রাশিয়া ভারতের মৈত্রী চুক্তির ভয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তান। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব, রাশিয়া এমনকি ভারতও চায়নি যে, ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলাদেশে হোক। তাই ত্রিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ওই ১৯৫ জনকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে ভুট্টো সাহেব অনানুষ্ঠানিকভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী যারা জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছিল, তাদের পাকিস্তানে বিচারের আওতায় আনা হবে। সে কথা অবশ্য আজো তারা রাখেনি।

আজকের বাংলাদেশের বিশ্বের নজরকাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি আর হূদয় উষ্ণ করা অসামান্য সামাজিক অগ্রগতি জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবের প্রদর্শিত পথে তারই সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে সংঘটিত হচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন কল্যাণরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুর ‘দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নের অবশিষ্ট কাজগুলো সুসম্পন্ন করা হবে। আর তখনই আমরা শোধ করতে পারব জাতির পিতার রক্তের ঋণ।



লেখক: বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য

https://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/127/বঙ্গবন্ধু-শেখ-মুজিবুর-রহমান--/

No comments:

Post a Comment