১৯৭১ সালের যুদ্ধে RAW ও ISI এর ক্যাট এন্ড মাউস গেম
সাজিদ করীম
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ রাজের স্বায়ত্তশাসিত কাশ্মীর রাজ্য নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সদ্য জন্ম নেয়া দুই রাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুযাফফারাবাদ, গিলগিট-বাল্টিস্তান মুক্ত করতে সক্ষম হলেও মূল কাশ্মীর ভ্যালি থেকে যায় ভারতের অধিকারে। যুদ্ধের দুই দশক পর, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের বাসিন্দা ১৭ বছর বয়স্ক তরুণ হাবিব কুরেইশি পাকিস্তানের আযাদ কাশ্মীরে যান তার বোনের বিয়ে উপলক্ষে। এদিকে আযাদ কাশ্মীরে মকবুল ভাটের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল একটি সংগঠন, জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট বা জেকেএলএফ। লক্ষ্য ভারতের হাত থেকে জম্মু-কাশ্মীরের মুক্তি। কিছুদিনের মধ্যে এরই একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আল-ফাতাহ।
স্বাধীনতার স্বপ্নে কাশ্মীরের যুবকেরা গোপনে তাতে যোগ দিতে শুরু করে। যদি কাশ্মীরে ভারতের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে হয় তাহলে প্রয়োজন স্থানীয় যুবকদের দলে রাখা যারা সেই স্থান ভালোভাবে চিনে। হাশিম কুরেইশি শ্রীনগরের ছেলে, আযাদ কাশ্মীরে আসার কিছুদিন পরই তার ডাক আসলো মকবুল ভাটের সাথে দেখা করার। হাশিম ‘জেকেএলএফ’এর সক্রিয় সদস্য হয়ে গেল। মকবুল ভাট তরুণ হাশিমকে একটা বড় দায়িত্ব দিবেন বলে ঠিক করলেন।
ভারতের কাশ্মীর প্রশাসন ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কিছুদিন থেকেই খবর পাচ্ছিলেন কাশ্মীরের মুসলিম যুবকেরা আশঙ্কাজনক হারে ভারত-বিরোধী সংগঠনগুলোতে যোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে একটা সংগঠন তাদের মাথা-ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ালো, আল-ফাতাহ। ভারতের কর্মকর্তারা মাঠে নেমে পড়লেন। ৩৬ জন আল-ফাতাহ’র সক্রিয় কর্মীকে গ্রেফতার করা হল। কিন্তু তবু RAW এর কর্মকর্তারা স্বস্তি পাচ্ছিলেননা। তারা কাউকে চাচ্ছিলেন যাকে দিয়ে আল-ফাতাহ বা জেকেএলএফ এর মধ্যে ইনফিল্ট্রেট করানো যাবে যাতে করে ভেতরকার খবর পাওয়া যায়। অবশেষে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে পেলেন; হাশিম কুরেইশি। শ্রীনগরে থাকাকালে সে ঘনিষ্ঠভাবে বিএসএফের সাথে কাজ করতো। RAW আর বিএসএফের কর্মকর্তারা হাশিমকে জেকেএলএফে ইনফিল্ট্রেট করার দায়িত্ব দিয়ে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরে পাঠালেন।
বেশ কিছুদিন পর RAW এর এজেন্ট হাশিম ভারতে ফিরে এলেন। হাশিম আশা করেছিলেন তার সফল মিশনের জন্য হয়তো অভ্যর্থনা জানানো হবে কিন্তু ফিরে এলে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর পরিবর্তে গ্রেফতার করে RAW এর ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে আসা হলো। হাশিম হচকিয়ে গেলেন। তার উপর চালানো হল চরম নির্যাতন। অবশেষে অল্পবয়সী ক্লান্ত হাশিম মুখ খুললো। অতঃপর যা বলল তা শুনে ভারতীয় কর্মকর্তারা চমকে গেলেন। কাহিনী মোটামুটি এমনঃ হাশিম পাকিস্তানে আসার পরপরই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ISI টের পেয়ে যায় যে হাশিম ভারতীয় এজেন্ট। তার সাথে ISI এর কর্মকর্তারা দেখা করেন, তাকে বোঝান। হাশিম অনুতপ্ত হয়, ISI এর কর্মকর্তারা তাকে রাজী করান তাকে কাশ্মীরের স্বার্থে একজন ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে। তাকে একটা মিশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তার মিশন ছিল এই যে তাকে একটি প্লেন হাইজ্যাক করতে হবে , যে প্লেনের পাইলট আর কেউ নন, স্বয়ং রাজীব গান্ধী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র। এ উপলক্ষে এক সাবেক পাকিস্তানি পাইলট তাকে প্রশিক্ষণ দেন। RAW এর কর্মকর্তারা সাথে সাথে এ সংবাদ শীর্ষ পর্যায়ে পাঠিয়ে দিলেন। এখানেই বিষয়টি শেষ হয়ে যেতে পারতো, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ও RAW এর আরেকটা প্ল্যান ছিল। তারা শত্রুর দানেই তাকে কুপোকাত করতে চাইলেন।
হাশিম কুরেইশিকে জানানো হল বিচারে তার রায় ফাঁসি হবে। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া হাশিম ভয়ে কুঁকড়ে গেল। এবার RAW এর কর্মকর্তারা জানালেন, তবে হ্যা, তাকে মাফ করে দেয়া হবে যদি সে তাদের একটা মিশনে সাহায্য করে। ভীত হাশিম এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন। মিশনঃ তাকে ISI এর কথামত ভারতের একটা প্লেন হাইজ্যাক করতে হবে। সময় ১৯৭১ সালে পা দিল। একটি পুরনো ফকার এফ-২৭ ফ্রেন্ডশীপ বিমান, গঙ্গা, অনেকদিন থেকেই পরিত্যক্ত অবস্থায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের হ্যাঙ্গারে পড়ে ছিল। জিরো আওায়ারের কয়েকদিন আগে এটাকে কিছুটা সেরেসুরে আবার শ্রীনগরে চালু করা হল।
৩০ জানুয়ারী,১৯৭১
শ্রীনগরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান গঙ্গায় চড়লেন হাশিম কুরেইশি ও তার কাজিন আশরাফ বাট। তাদের সঙ্গে ছিল ফেইক গ্রেনেড আর খেলনা পিস্তল যা দেখতে অনেকটা আসলের মতই। এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির “চোখে ধুলো দিয়ে” তারা সেগুলো নিয়ে বিমানে আরোহন করলেন। কিছুক্ষণ পরই অল ইন্ডিয়া রেডিও খবরে জানালো তাদের একটি প্লেন হাইজ্যাক করা হয়েছে। এবং অবশ্যই সে বিমানের ককপিটে রাজীব গান্ধী ছিলেননা। হাইজ্যকার হাশিম কুরেইশি ও তার ভাইয়ের নির্দেশে প্লেন লাহোর এয়ারপোর্টে গিয়ে অবতরণের অনুমতি চাইলো। অনুমতি পাওয়া গেলো। হাইজ্যাকাররা দাবি জানালো, সকল যাত্রী এবং ক্রুকে নিরাপদে মুক্তি দেয়া হবে যদি ভারত সরকার তাদের কারাগারে বন্দী ৩৬ জন আল-ফাতাহ সদস্যকে মুক্তি দেয়। ভারত অস্বীকার করলো। হাশিম কুরেইশি পাকিস্তানে পলিটিকাল অ্যাসাইলাম পেলেন আর তাকে জাতীয় হিরোর মর্যাদা দেয়া হলো; তৎকালীন পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো স্বয়ং হাশিম কুরেইশির সাথে সাক্ষাত করলেন। এয়ারলাইন্সের যাত্রী আর ক্রুদেরও মুক্তি দেয়া হল। তারা সড়কপথে ভারতে ফিরে গেলেন। এরপর পাকিস্তান যা করলো তা ভারতের প্রত্যাশারও অনেক বেশী ছিল। ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ এ তারা প্লেনটি পুড়িয়ে ফেললো।
এবার ইন্দিরা সরকার তার তুরুপের সবচেয়ে বড় তাসটি চাললো। ভারতের মদদে তখন পূর্ব-পাকিস্তানে অস্থিরতা তুঙ্গে। ভারতও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদের জন্য। সংঘাতের আশংকা জমে উঠেছে; যে কোন সময় যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সেই আশঙ্কায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন বাংলাদেশে সৈন্যসংখ্যা বাড়াতে শুরু করেছে। নৌপথের দীর্ঘসূত্রিতা এড়ানোর জন্য সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো ভারতের উপর দিয়ে আকাশপথ ব্যবহার করা। ভারত বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের দুই দূরবর্তী অংশ, যোগাযোগের জন্য ভারতের আকাশপথ ব্যবহার করতো। হাইজ্যাকিংয়ে সহায়তা ও বিমান পুড়ানোর অভিযোগে সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ভারত সরকার তার ভুখন্ডের উপর সকল পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধের দামামা বাজলো। রসদ, গোলাবারুদ ও অন্যান্য লজিস্টিক পাঠাতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়লো পাকিস্তান। বাংলাদেশের তিন দিন থেকে ঘিরে ছিলে ভারত। এখন যেকোন কিছু পাঠাতে গেলেই বিমানকে প্রথমে আরব সাগর, এরপর ভারত মহাসাগরে শ্রীলংকায় গিয়ে রিফুয়েলিং করে তারপর বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণে ঢুকতে হবে। এতে তিনগুণ সময়, ও তিনগুণ বেশী খরচ লাগবে। এটা পুরো যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য একটা বড় স্ট্র্যাটেজিক ডিসএডভান্টেজ হিসেবে প্রভাব ফেললো।
সাবেক RAW কর্মকর্তা বি রমন এর ভাষায়ঃ “ভারতের আকাশ সীমায় পাকিস্তানের বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধীর নাটকীয় সিদ্ধান্ত পূর্ব পাকিস্তানে বিজয় অর্জনকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়। পাকিস্তানি বিমান বহর সমুদ্রের উপর দিয়ে ঘুরে পূর্ব পাকিস্তান যেতে শ্রীলঙ্কার কাছে রিফুয়েলিং সুবিধা চায়। ইন্দিরা গান্ধী এ সুবিধা বন্ধের জন্য কলম্বো সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। এটি পশ্চিম পাকিস্তানের সদর দফতর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে রসদ, গোলাবারুদ ও জনবল সরবরাহ ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে দূর্বল করে ফেলে”।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের মাধ্যমে এ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। RAW এর কর্মকর্তা ভারতের জাতীয় হিরোতে পরিণত হন। পাকিস্তান সরকার বুঝতে পারে যে পুরো হাইজ্যাকিংটাই ছিল একটা সাজানো নাটক। মকবুল বাট ও হাশিম কুরেইশির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা ও ভারতের সাথে মিলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। মকবুল বাট আদালতে মুক্তি পেলেও হাশিম কুরেইশি অনেক বছর জেল খাটার পর মুক্তি পান।
তথ্যসূত্রঃ
1. 5 Successful RAW operations You Had No Clue About. http://defencelover.in/2015/04/02/successful-mindblowing-operations-of-raw/
2-1971 Indian Airlines Hijacking; www.wikipedia.com
3- Hashim Qureshi; www.wikipedia.com
4- র এর কাউবয়েরা, বি রমন, প্রতীতি প্রকাশনী, ২০০৮।
Copyright © 2015 by The Gobalnews24
No comments:
Post a Comment