জনগণকে তার সংস্কৃতি নির্মাণে কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি-আহমদ ছফা
কলকাতা বইমেলা ’৯৯ সংখ্যার জন্য কলকাতার স্বাধীন বাংলা সাময়িকীর পক্ষে আহমদ ছফার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি বাংলাবাজার পত্রিকা (৩১ জানুয়ারি ১৯৯৯ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) তিন কিস্তিতে আবার ছাপে।এখানে তার অংশ বিশেষ প্রকাশ করা হল। বাকী অংশ নিয়ে করা পোষ্টগুলো পাওয়া যাবে এই পোস্টের শেষে।
প্রশ্ন: স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা মৌলবাদী বাধা কি এখানে আছে?
আহমদ ছফা: না, সেরকম আমি কিছু মনে করি না।
প্রশ্ন: স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করার অধিকার এখানে আছে?
আহমদ ছফা: এটা একটা কথা, আমি যেমন ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না। ধর্মীয় বা মৌলবাদের প্রভাব নয়, এটা একটা অবিকশিত সমাজের লক্ষণ।
আরো দেখবেন মৌলবাদের যে উপাদান সেটা বাংলাদেশের সোসাইটিতে নেই। বাংলাদেশে পাঁচজন লোক খুঁজে পাবেন না, যে আরবি জানেন। পাঁচজন লোক পাবেন না, যে সংস্কৃত জানেন। কিন্তু আপনাদের দেশে তা ভুরিভুরি পাবেন। মৌলবাদ প্রথম জন্মায় ধর্মগ্রন্থ থেকে। বাংলাদেশে তার কোন অবস্থান নেই। এখানে যা আছে তা মধ্যযুগীয়তা। মধ্যযুগীয়তা আর মৌলবাদকে এক করে দেখা ঠিক হবে না।
ভারতবর্ষে মৌলবাদ জন্মাচ্ছে সরাসরি ধর্মগ্রন্থ থেকে। যেমন, রাম মন্দির, রাম মন্দির ছিল কিনা ঐতিহাসিকরা কোন কথা বলতে পারছেন না। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, রাম উপন্যাসের নায়ক। এর পর সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তার পুত্রকে হত্যা করার হুমকি দিল। সুকুমার সেন বলেছেন, রাম শব্দের অর্থ হলো পূর্ণতা। এটি এসেছে ইরান থেকে এবং ‘রামরাজ্য’ শব্দটি গান্ধীজী নিয়েছিলেন টলস্টয়ের Kingdom of God এর ভারতীয় শব্দ হিশেবে। কিন্তু এই শব্দগুলোকে ধর্মীয় অভিধায় যুক্ত করে রাজনীতিতে এটা প্রধান শক্তি হওয়া, সে জিনিস বাংলাদেশে নেই।
প্রশ্ন: রাম শব্দের যে প্রভাব উত্তর ভারতে বা হিন্দি বলয়ে আছে বাংলায় তা নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-এ রামকে এক ক্লীব চরিত্র বা ভিখিরি হিশেবে উপস্থিত করেছেন। এই জন্যে তিনি কারো দ্বারা আক্রান্ত হন নি-
আহমদ ছফা: মাইকেল মধুসূদন দত্তর বই একশ কপির বেশি ছাপা হত না। বঙ্কিমের বই দু’শ আড়াই’শ কপির বেশি ছাপা হত না। একটা বই নিয়ে আজকে যে জনমত তৈরি হয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়, সে যুগে এটা কল্পনা করা যেত না। মাইকেলের আর একটা সুবিধে ছিল তখন শাসকরা ছিলেন ইংরেজ এবং মাইকেল নিজে খ্রীস্টান হয়ে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টানরা তখন রাজার আনকূল্য পেতেন। মাইকেলের পক্ষে মেঘনাদ বধ লেখা সম্ভব হয়েছিল দুটো কারণে। প্রথমত তিনি হিন্দু পরিমণ্ডলের বাইরে মাদ্রাজ চলে গিয়েছিলেন। মাদ্রাজ গিয়ে তিনি মহারাষ্ট্র পুরান পড়েছিলেন। আর তামিলরা রামকে নয়, রাবনকেই পূজা করেন। এসব মাইকেলকে প্রভাবিত করে। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন যখন রাজিয়াকে নিয়ে নাটক লিখতে গেলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। তিনি যখন কারবালাকে নিয়ে ট্রাজেডি লিখতে চাইলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। কাজেই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আমরা যেভাবে চিন্তা করি, তিনি তার অবস্থার কাছে অনেক বেশি নতি স্বীকার করেছেন।
প্রশ্ন: পরবর্তী পর্যায়েও কিন্তু বাংলার পাঠকরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বর্জন করেন নি…
আহমদ ছফা: তা করেন নি। কিন্তু এখনো একটা বিতর্ক থেকে গেছে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত না শ্রী মধুসূদন। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। মোহিতলাল থেকে প্রমথনাথ বিশী, কত বই লেখা হয়েছে। এখনো লেখা হচ্ছে, এমনকি ক্ষেত্র গুপ্তর সাম্প্রতিক বই। এসব আপনাদের নির্ণয় করতে হবে।
আর আমি মনে করি মাইকেল মধুসূদন দত্ত হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক লেখক।অন্যদিকে দেখুন বিসর্জন লেখার পর কালীমন্দিরে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না। রাজর্ষি লেখার পর রামকৃষ্ণ মিশনে রবীন্দ্রনাথের কোনও কিচ্ছু উচ্চারিত হয় না।
প্রশ্ন: যুক্তিবাদী সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে….
আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে) যুক্তিবাদী, সহনশীল, মুক্তবুদ্ধি এগুলি খুব খারাপ শব্দ। পরিবেশ বিশেষে এসব হয়ে যান অনেকে। আসল কথাটি হল জনগণকে তার সংস্কৃতি নির্মাণে কোনও সুযোগ দেওয়া হয় নি।
প্রশ্ন: লালন বা হাছন রাজার গান কী এ ক্ষেত্রে—
আহমদ ছফা: সাহিত্যবিলাসী লোকেরা এসব খুব বলাবলি করে। লালনেরও আগে চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’। হিন্দু সমাজের মানুষ অবশ্য এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাই। বাঙালি জাতিসত্তা হিশেবে লালনকে আমরা চিন্তায় লালন করি, কারণ গৌতম বুদ্ধের যে চিন্তা, তা কবীরের কাছে বাহিত হয়ে লালন তা ধারন করেছেন। লালনের গানগুলোর মধ্যে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও চিন্তা এখনো বেচে আছে। অবচেতনে তা আমাদের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে নাড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথও সেখানে একবার প্রণত হয়েছে। আর একটা জিনিস,
লালনের গানের মধ্যে কবীরের দোহার হুবহু অনুপ্রাণিত গান আছে কয়েকশত। বুদ্ধ দেবের শিষ্যরা বুদ্ধ দেবের শিক্ষাটাকে নানা ছদ্মবেশে বাচিয়ে রেখেছেন। এটা আমাদের খুবই প্রয়োজনীয় ঐতিহ্য। তবে এসব কখনোই সমাজের চালিকা শক্তি হয় নি। থেকে গেছে Sub culture এর স্তরে।
প্রশ্ন: ‘শিক্ষা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে দুইয়ের দশকের ঢাকায় মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন হয়েছিল—
আহমদ ছফা: মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে যাকে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে, তাকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না এই কারণে যে, এদের মধ্যে একজন ছিলেন real serious লোক। He died quite earlier। আবুল হুসেন ছাড়া আর যারা ছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে তারা কী কাজ করেছেন? নজরুল একা যে কাজ করেছেন, এরা সকলে মিলে কী কাজ করেছেন? যেমন আবদুল ওদুদ, এর লক্ষ্য ছিল মুসলিম ব্রাম্মণ হওয়া। হুমায়ুন কবীরের রচনার মধ্যে যে যুক্তিবাদিতা, তার মধ্যে আমি বড় কিছুই খুঁজে পাই নি। বেগম রোকেয়া এর থেকে অনেক বড় কাজ করেছেন। আব্দুল ওদুদ-রা কী মুক্তবুদ্ধি করবেন! আবুল ফজল মুক্তবুদ্ধির একজন লোক, যিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হয়েছিলেন। কাজেই এগুলো যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আমার মনের মিল নেই। আবার এ আন্দোলনটার মধ্যে একেবারেই কিছু ছিল না, তাও ঠিক নয়। অশিক্ষা ও সাম্প্রদায়িকতায় আকীর্ণ বাঙালি মুসলমান সমাজের কিছু তরুণের মধ্যে প্রথম একটা হাওয়া লেগেছে, স্পন্দন লেগেছে, আলো পড়েছে। কিন্তু ঐ চর্চা স্থায়ীত্ব পায় নি, সমাজে তারা প্রভাবও পড়ে নি।
প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা বা বাংলা নবজাগরণ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: হ্যা, ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। তার রেজাল্ট আমরা সবাই কমবেশি ভোগ করেছি। বাংলা ভাষার বিকাশ হয়েছে, আধুনিক সাহিত্য, আধুনিক সংস্কৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা এসব আমরা পেয়েছি ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা থেকে। তবে একে রেনেসাস বলা ঠিক নয়। তবে এর মধ্যে রেনেসাসের অঙ্কুর ছিল। পরবর্তীকালে যা হয়েছে, তা হল রিভাইভিলিজম। বঙ্কিম, ভুদেব থেকে এমনকি রামমোহন রায় হিন্দু রিভাইভলিজাম থেকে মুক্ত নন। আমি জানি না, পশ্চিম বাংলার বিদগ্ধ সমাজ আমার কথা গুলোকে কিভাবে নেবেন। আমি মুসলিম সমাজের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছি। যেমন বিদ্যাসাগর তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন বিধবা বিবাহ, সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে। সাহিত্যের কাজে সময় দিয়েছেন অত্যন্ত কম। একথা রামমোহন রায় এবং তার সহমরণ নিবারণ সম্পর্কেও। এসব মুসলমান সমাজের সমস্যা ছিল না। শুধু মুসলিম নয়, নিম্মবর্গের হিন্দুদেরও সমস্যা ছিল না। এটাকে কেউ সখ করে জাগরণ বললে বলতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত স্মল গ্রুপের জাগরণ। তার বাইরের এর কোন প্রভাব ছিল না এবং জাগরণ তারা এমনভাবে ঘটিয়েছিলেন যাতে অন্যরা অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত থাকেন।
প্রশ্ন: কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম শহরের রেল স্কুলের দেওয়ালে একটি দেওয়াল লিখন চোখে পড়ল। সেই দেওয়াল লিখনে একটি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে –‘বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা বাতিল করা’—
আহমদ ছফা: ধর্মশিক্ষাকে আমি সমর্থন করি না। তবে ধর্মশিক্ষা বাতিল করার যে পদ্ধতিটা বলা হচ্ছে, সেই পদ্ধতির বিরুদ্ধে আমি কথা বলছি। সরকার বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষাগুলো চেঞ্জ করবেন। কিন্তু স্কুল কলেজে ছাত্র যত মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তাদের ওপর জোর করে যদি কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তারা বিরোধীতা করবে। এবং এতে পরিবর্তনটা আটাকে যাবে।
আমার বক্তব্য মাদ্রাসা শিক্ষার লোকাদের সঙ্গে বসো, কনভিন্স করো যুগের প্রয়োজন। অর্থাৎ যাদের জন্য পরিবর্তন করবেন তাদেরও যদি আপনি অংশীদার না করেন, তবে সেটা কার্যকর হবে না। সুতরাং যেভাবে কাজ করলে পরিবর্তনটা সম্ভব, সেই প্রক্রিয়াটা কেউ গ্রহণ করছেন না।
অক্সফোর্ড কেমব্রিজ একসময় মাদ্রাসা ছিল। সেখানে ধর্ম শিক্ষাই দেওয়া হত। যুগের প্রয়োজনে সেখানে কি পরিবর্তন হয় নি? এই মাদরাসাগুলোকে কারিগরি শিক্ষা এবং আরো আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র হিশেবে গড়ে তুলতে পারি। মাদ্রাসার লোকজনদের বুঝিয়ে নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা, তাদেরকে মানসিকভাবে, নৈতিকভাবে তৈরি না করে, তাদের ওপর কতগুলো পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা আর পরিবর্তন হবে না। শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন, হয়েছে কী? উল্টোটা হয়েছে। ধনতন্ত্র হয় নি, সমাজতন্ত্র হয় নি , পরে হয়েছে একটা লুটপাটতন্ত্র।
No comments:
Post a Comment