পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহন ও খ্রিষ্টধর্মের মোকাবেলায় হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের উদ্যেগ
১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে কমন্স সভায় আইন পাসের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বন্ধ এবং সর্বপ্রথম খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি প্রদান করা হলে বিশেষ করে ইংল্যান্ডের উচ্চ মহলে দারুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আলোচনায় উঠে আসে, অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং ইংরেজ স্বার্থে ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের লক্ষ্যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমীচীন হবে এটা ভেবে কাজ করা। উল্লেখ্য, ১৭৯৩ সালে যখন কমন্স সভায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য অধিকার আরো ২০ বছর নবায়ন করা হয় তখন খ্রিষ্টধর্ম প্রচার প্রস্তাবটি নাকোচ হয়ে গেলেও সতিদাহ প্রথা (সদ্য বিধবা মহিলা আগুনে পোড়ানো) বন্ধকরণ আইন প্রনয়নের প্রস্তাবটি স্থগিত রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা আইন বিরুদ্ধ ঘোষনা করলে কোলকাতার সনাতনপন্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
সে আমলে ইংরেজরা পদানত ভারতবর্ষ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করেছিল- পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রাচ্যের (ভারতের) দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সে রকম কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ফলস্রুতিতে ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভারতে ইংরেজ এলাকায় সর্বপ্রথম খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি দেয়া হলেও পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে রাষ্ট্রীয় কোন পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে না।তৎকালিন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় এর প্রতিক্রিয়া তেমন দেখা যায় নি। কারণ উপমহাদেশে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সে আমলে ইংরেজদের প্রধান সম্পুরক শক্তির ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। সুবর্ন শ্রেনী তখন তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার ও পাশ্চাত্য শিক্ষার বিষয়ে মতামত দেন।
এক শ্রেণী বক্তব্য হচ্ছে, অবাধ অর্থনীতি থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য ইংরেজী শিক্ষা এবং ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সবটুকুই গ্রহণ করতে হবে। এই শ্রেণীর মধ্যে ছিলেন, রামতুন লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন, প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকচাঁদ ঠাকুর। পরবর্তীতে অবশ্য এদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
দ্বিতীয় শ্রেণীর বক্তব্য ছিল, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির বেড়াজাল ভেদ করে কিঞ্চিত সংশোধনের মাধ্যমে এবং সুষ্ঠু ব্যাখাদানের ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের আদর্শকে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব। অতএব পাশ্চাত্য দর্শন এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গলাধঃকরণের সমস্ত প্রচেষ্টা বর্জনীয়।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শ ছিল রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত চিন্তাধারা। তিনি হিন্দু যুবকদের দলে দলে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পথ বন্ধ করতে ১৮২৮ সালে ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করেন। অথচ রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইংরেজী শিক্ষার গোঁড়া সমর্থক। তিনি প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত দিন ধরে ইউরোপীয় পোষাক পরিধান করে ইউরোপীয় আদব-কায়দায় ইংরেজদের সঙ্গে উঠা-বসা করলেও সন্ধার পর ভারথীয় দর্শন এমনকি ইসলামী ভাবধারা সম্পর্কিত বিষয়ে পড়াশুনা করতেন।
ইতিহাসের বহু ঘাত প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে বঙ্গীয় এলাকার সমাজ জীবনে ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক একটি পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীর উদ্ভবের পাশাপাশি সংস্কারপন্থী মনোভাবের ভিত্তিতে সদ্য হামাগুড়ি দিতে শুরু করে বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এরপর জীবনযুদ্ধে শুরু হলো এই দুই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা।
যেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর কোলকাতা কেন্দ্রিক এদেশীয় সুবর্ন শ্রেণী এবং ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের কর্নওয়ালিশ মার্কা জমিদার শ্রেণীর মাঝ থেকে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণীর জন্ম হয়েছে, সেখানে কিন্তু বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের পূর্ণ জন্মলগ্নে এ ধরনের দুটি স্তর প্রায় সম্পুর্ণ অনুপস্থিত ছিল। মুসলমানদের অবস্থা বুঝতে নিম্নোক্ত বক্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য, মুসলমানদের সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শ্লথ অভ্যুত্থান। অথচ আধুনিককালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই একটি জাতির সকল প্রকার উন্নতির সোপান। ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্যেও অংশগ্রহণ করেনি (ব্রিটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান : বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৮২)।
কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিত্তিটা যে সুদৃঢ় ছিল তা অনুধাবন করতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু করে ইংরেজ ও বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সমিতি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নাম ও পরিচিতি এবং এদের কর্মপদ্ধতি উল্লেখযোগ্য :
এশিয়াটিক সোসাইটি: ১৭৮৪ সালের ১৫ই জানুয়ারী কোলকাতায় স্থাপিত যার কর্তৃত্ব ভার ছিল ইংরেজ স্যার উইলিয়াম জোনস এর হাতে। যেখানে প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পরে এদেশীয় লোকদের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মুসলমানদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্তি ছিল না।
আত্মীয় সভা : রামমোহন রায় কর্তৃক ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতায় স্থাপিত। এই সভার বৈঠকে বাল্যবিবাহ সমস্যা, জাতিভেদ সমস্যা, নিষিদ্ধ খাদ্য সমস্যা, সতীদাহ সমস্যা, বহু বিবাহ সমস্যা নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা ও বৈঠকের সমাপ্তিতে ব্রাহ্মসঙ্গীত পরিবেশিত হতো।
হিন্দু কলেজ : ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে ২০ শে জানুয়ারী প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় এর নেতৃত্বে কলিকাতায় হিন্দু কলেজ যা পরবর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ক্যালকাটা বুক সোসাইটি : রামমোহন রায় কর্তৃক ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে কলিকাতায় স্থাপিত। নতুন ইংরেজি শিক্ষার উপযোগী পাঠ্যপুস্তক রচনার লক্ষ্যে এই সোসাইটি স্থাপিত হয়।
ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি : রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কলিকাতায় এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। ইংরেজি শিক্ষার দ্রুত প্রসারের জন্য নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং পুরাতন স্কুলগুলোতে ইংরেজি শিক্ষাদানের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
ইংরেজদের উদ্যোগে গঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় মুলত: বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে। এগুলোর মধ্যে ছিল, লিটারেরি সোসাইটি, ওয়রিয়েন্টাল লাইব্রেরী সোসাইটি, এগ্রিকালচার এন্ড হর্টিকালচার সোসাইটি, কমার্শিয়াল এন্ড প্যাট্রিয়াটিক এসোসিয়েশন যার কোষাধক্ষ্য ছিলেন রাম মোহন রায়, লেডিস সোসাইটি সহযোগী হিসেবে ছিলেন রাজা বৈদ্যনাথ রায় এবং কাশীনাথ মল্লিক, ক্যালকাটা মেডিক্যাল এন্ড ফিজিক্যাল সোসাইটি।
গৌড়ীয় সমাজ: সম্পূর্ণভাবে বাঙালি বর্ণ হিন্দদের উদ্যোগে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কোলকাতায় এই সমাজ স্থাপিত হয়। এর বৈঠকগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল উভয় মতাদর্শের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকতো। একদিকে যেমন রামমোহন রায়ের দলভুক্ত দ্বারকানাথ ঠাকুর (রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের পিতামহ), প্রসন্নকুমার ঠাকুর, কাশীনাথ মল্লিক, রাজা বৈদ্যনাথ, তাঁরাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ। অন্যদিকে হিন্দু রক্ষণশীল দলীয় রাধাকান্ত দেব, ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়, রামদুলাল দে, কাশীনাথ, তর্ক পঞ্চানন প্রমুখ। এরা মুলত বাঙালি সমাজ বিশেষ করে নিজেদের গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় সম্পর্কে বিশেষ মাত্রায় অতিরিক্ত সচেতন ছিলেন।
উৎসঃ কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী (পৃষ্ঠা ১১৩- ১২৫)
No comments:
Post a Comment