আমলারা নিজেরাই একটা পার্টি- আহমদ ছফা
আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা স্তম্ভ। ইংরেজী গ্রামার সম্পর্কে যে কথাটি চালু আছে ‘A good servant but a bad master’ – আমলাতন্ত্র সম্পর্কেও এ কথাটি বলা যেতে পারে। গুনার মিরডাল ‘এশিয়ান ড্রামা’ গ্রন্থে তৃতীয় বিশ্বের যে রাষ্ট্রগুলোকে Soft States বলে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলোতে আমলাতন্ত্র দোর্দণ্ড প্রতাপের অধিকারী। এই নড়বড়ে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সাধারণত কোনো সরকার স্থায়ী হয় না। হয়তো গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এক সরকার এল, সেই সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে বসে। সামরিক সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ অভ্যুত্থানে ফেটে পড়ল। এই যে বারবার সরকার পরিবর্তনটি হয়, আমলারা এই সকল পরিবর্তনের মধ্যেই রাষ্ট্রের হালটি ধরে থাকে। যেহেতু গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাটা আমলাদের হাতে থাকে যে কোনো ধরনের সরকার আসুক না কেন আমলাতন্ত্রের কাছে সারেণ্ডার করতে হয়।আমলাতন্ত্রের স্বার্থে যে সরকারই আঘাত করুক না কেন তাকে খেসারত দিতে হয়।
সরকারের দফতরগুলো যে সকল ব্যক্তি চালিয়ে থাকেন তাঁরা রক্তমাংসের মানুষ হলেও তাদের মানুষী চেহারাটা দফতরের আড়ালে গোপন থেকে যায়। তাই অনেক সময় আমলারা গর্ব করে নিজেদের Faceless Bureaucrat বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
আমলারা অনেক সময় বলে থাকেন, ‘সরকার আসবে, সরকার যাবে কিন্তু আমরা চিরস্থায়ী। আমাদের অবস্থানের কোনো হেরফের নেই।’ কাবাবে যেমন হাড্ডি, মাছে যেমন কাঁটা তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রে আমলার অবস্থান একটি তর্কাতীত সত্য। অস্থিতিশীল রাষ্ট্রসমূহে আমলাতন্ত্রই সর্বাধিক ক্ষমতার মালিক হয়ে থাকে। যাঁর হাতে অধিক ক্ষমতা দুর্নীতি করার প্রবণতাও তার ততোধিক।
সাধারণ অর্থে আমলাদের দুর্নীতিপরায়ণ বলেই মনে হয়। সরকারের কোর্ট-কাচারী, অফিস-আদালত, দফতরসমূহের চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা পর্যন্ত ঘুষ দাবী করে থাকে। এ জিনিসটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এ কারণে আমলাদের প্রতি সাধারণ জনগণ একটি ঘৃণাব্যঞ্জক মনোভাব পোষণ করে থাকেন। তারপরও একথা সত্য যে আমলাতন্ত্র ছাড়া কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। আমলাদের লোভ-লালসা-দুর্নীতি যদি কোনো সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বন্ধ করতে পারে তাহলে সে সরকারকে অবশ্যই ভালো সরকার বলতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান আমলাতন্ত্র সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমি আমার দুজন বন্ধুর কথা উল্লেখ করব। একবার আমি আমার বন্ধু তপন চক্রবর্তীর কাছে গিয়েছিলাম। সে চাকরী করত বাংলা একাডেমীতে। তপন এবং মোতাহার সাহেব একজন হতাশ আমলা ও তার চামচার ভূমিকা অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন।
চামচা বলছে, ‘স্যার, আপনি তো খুব সুখে আছেন, ভালো আছেন। রিটায়ার করেছেন। ছেলেমেয়েরা বিদেশে। বিবি সাহেব রিটায়ার করবেন। তিনটা বাড়ী, দুটো গাড়ী।’
আমলা ভদ্রলোক জবাব দিচ্ছেন – ‘মোতাহার, আমাকে কেউ বুঝল না। আমার অন্তরে কি দুঃখ কেউ খবর নিল না।’
‘আপনার কেন দুঃখ হবে স্যার? তিনটি বাড়ী দুটো গাড়ী সব মিলিয়ে জমজমাট অবস্থা।’
আমলা ভদ্রলোকের জবাব, ‘মোতাহার, তুমি বাইরেরটা দেখলে, ভেতরটা দেখলে না।
আসল খবর আমি তোমাকে জানাই – তোমাদের রাজনৈতিক পরিভাষায় আমি সর্বহারা মানুষ। যে তিনটে বাড়ীর কথা বলছ তার একটাও আমার নয়। ধানমণ্ডির বাড়ীর মালিক তোমার ভাবী, উত্তরার বাড়ী বড় মেয়ের, লালমাটিয়ার বাড়ীটি ছোট ছেলের। দেখতে পাচ্ছ আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তোমার ভাবী এবং ছেলেমেয়েরা বের করে দিলে আমাকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে।
এখন গাড়ীর কথায় আসি। পাজেরোটার মালিক তোমার ভাবীর বড় ভাই। আমাকে শুধু চালাতে দিয়েছে। টয়োটা মেজো ছেলের। এখন বুঝতে পারছ আক্ষরিক অর্থেই আমি সর্বহারা। মনে দুঃখ থেকে গেল মোতাহার, এই জিনিসটি আমি কাউকে বোঝাতে পারলাম না। মাঝে মাঝে আমার বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাঁদবার অভ্যাস নেই বলেই পারি না।’
আমার বন্ধু ফরহাদ মজহার আনসারদের নির্যাতনের ওপর লেখা ছেপে একমাস জেলে গিয়েছিল। জেল থেকে ফিরে এসে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ‘আজকের কাগজ’-এ একটা লেখা লিখেছিল। সে লিখেছিল –
জেলখানায় ব্যবসায়ী দেখেছে, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী দেখেছে, দু’চারজন মৌলানা সাহেব দেখেছে, এমনকি সামরিক বাহিনীর কিছু লোককে জেল খাটতে দেখেছে। জেলখানাতে কোনো সরকারি আমলার সঙ্গে ফরহাদের দেখা হয়নি। অর্থাৎ আমলারা এমন এক জাত যতই অপরাধ করুক তাদের জেলে যেতে হয় না। জবাবদিহি করতে হয় না।
এমনও দেখা গেছে, নতুন সরকার এলে পুরনো সরকারের লোকদের জেলে পাঠায়। তাদের নামে নানারকম অভিযোগ হাজির করে। আইয়ুব খানের সরকার, মুজিবের সরকার; জিয়া, এরশাদ, খালেদা সবগুলো সরকারের আমলে আমলাদের নামে কেউ টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। আমলাতন্ত্র এমন জিনিস – দুর্নীতি তারা করে কিন্তু প্রমাণ রাখে না। সব দোষ সরকারের লোকদের উপর গিয়ে বর্তায়।
কিন্তু আমি একথাও বলব সমস্ত আমলা খারাপ এবং দুর্নীতিপরায়ণ নন। অনেক সৎ এবং দেশপ্রেমিক আমলাও আমি দেখেছি। আমার একজন উচ্চপদস্থ সচিব-স্তরের আমলা বন্ধু আছেন। যিনি ধার করে কোরবানীর গরু কিনেছিলেন।
এই শিরোনামে আহমদ ছফা একটি প্রবন্ধ লিখেন ১৯৯৬ সালে। এই প্রবন্ধের অংশবিশেষ এই লেখাটি নেয়া হয়েছে সরব ব্লগ থেকে।
No comments:
Post a Comment