উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালী হিন্দু সূবর্ণ বণিক শ্রেণী ধনাঢ্য হলো যেভাবে।
উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সামাজিক ইতিহাসে আরও একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তা হচ্ছে কোলকাতার ধনাঢ্য বাঙ্গালী হিন্দু সুবর্ণ বনিক শ্রেণীর ব্যাপক প্রভাব। এই সুবর্ণ বনিক শ্রেণীর হাতে বিপুল অর্থ সঞ্চিত
হওয়ারও ইতিহাস রয়েছে। এদেশে ইংরেজদের আগমনের প্রথম থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একচেটিয়া বাণিজ্যের সনদ লাভ করেছিলেন। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছাড়া আর কোনো ইংরেজ কোম্পানীর ভারতে বাণিজ্যের অধিকার ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথম থেকেই বাণিজ্যের সুবিধার জন্য এদেশে ‘এজেন্সি হাউস’ স্থাপন করে। এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারনত ৩/৪ জন অংশীদার থাকত এবং এরা সবাই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী। এসব এজেন্সি হাউসগুলো স্থাপন করতে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের কোন মূলধনের পর্যন্ত প্রয়োজন হয়নি। কোম্পানীর কর্মচারীর আমানত ও বাৎসরিক সঞ্চয় প্রাথমিক মূলধন সৃষ্টির মুল সুত্র। স্থানীয় বণিক সম্প্রদায়ও এসব হাউসগুলোতে অর্থ গচ্ছিত রাখতেন। ক্রমান্বয়ে দেখা যায় যে, এরা এক এসময় একচেটিয়াভাবে বাংলা তথা ভারতের রেশম, পাট, নীল ও তুলা প্রভৃতি ব্যবসা করা ছাড়াও ব্যাংকিং এর সমস্ত রকমের কাজ করতে শুরু করেছে। দেশী বিদেশী ব্যবসায়ীদের নিকট প্রদত্ত ধারের সুদের হার ছিল ১৮% থেকে ২০% পর্যন্ত। (বিনয় ঘোষ– বাংলার নবজাগৃতি)
দি বেঙ্গল ডিরেক্টরি এ্যান্ড আলম্যানাক (১৭৯৭)- কোলকাতায় স্থাপিত এ ধরনের প্রায় ১৯টি এজেন্সি হাউস এর নাম পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে মেসার্স ককারেল ট্রেল এ্যান্ড কোং, মেসার্স বারবার পামার এ্যান্ড কোং, মেসার্স টড এ্যান্ড মিলার, মেসার্স ক্যাম্বেল এন্ড ক্লার্ক, মেসার্স হ্যামিলটন এ্যান্ড এবার্ডিন প্রভৃতি অন্যতম। ১৮১০ সাল নাগাদ কোলকাতায় এ ধরনের এজেন্সি হাউসের সংখ্যা প্রায় ২৭টি –তে দাড়ায়। স্বল্পকালের ব্যবধানে এই এজেন্সি হাউসগুলো অকল্পনীয়ভাবে মুনাফা অর্জন করায় খোদ ইংল্যান্ডেও এ ব্যাপারে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। অন্যান্য ইংরেজ কোম্পানীগুলো ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের সনদ বাতিলের দাবি উত্থাপন করে।
ব্রিটেনের হাউস অব কমন্স এর সিলেক্ট কমিটির নিকট প্রদত্ত টমাস ব্রেকোর জবানবন্দী বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তার বক্তব্য হচ্ছে, “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিন উচ্চ পদস্থ সিভিল ও মিলিটারি কর্মচারিরা চাকরি ছেড়ে ক্রমে ব্যবসা–বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেন। তারা দেখলেন যে, কোম্পানির দাসত্ব করার চাইতে এই বণিকবৃত্ত অবলম্বন করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে তারা টাকা গচ্ছিত পেলেন এবং মূলধন হিসেবে সেই টাকা ব্যবসায় খাটিয়ে প্রচুর মুনাফা সঞ্চয় করলেন। এইভাবে তারা এক–একজন বেশ মোটা পুঁজি নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের অধীনে কার্যকলাপের জের হিসেবে ১৮১৩ সালে ভারতে এই কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার বাতিল করা হয়। বিপুল মূলধন নিয়ে স্থাপিত অনেকগুলো ব্রিটিশ কোম্পানি তখন কোলকাতায় আগমন করে। এসব ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পুরোনো এজেন্সি হাউসগুলোর কয়েকটি ছাড়া বাকি সবগুলোই পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হলো। নতুন ইংরেজ কোম্পানিগুলোর মধ্যে মেসার্স র্যালি ব্রাদার্স, ম্যালকম এ্যান্ড কোং বেগ ডানলপ এ্যান্ড কোং, মার্টিন পিলার্স এ্যান্ড কোং প্রভৃতি অন্যতম। এরা এজেন্সি হাউস পরিচালনা এবং রফতানি বাণিজ্য করা ছাড়াও নানা ধরনের শিল্পের মূলধন বিনিয়োগ শুরু করল। এসবের মধ্যে কয়লা, অভ্র, লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি খনিজ শিল্প অন্যতম। এছাড়া চা বাগান স্থাপনের জন্য এরা বিপুল পরিমাণে মূলধন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করল।
হিন্দু সূবর্ণ বণিক শ্রেণী কিভাবে ধনাঢ্য হলো
এটাই হচ্ছে এই উপ–মহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের বণিক স্বার্থের নব অধ্যায়ের সূচনাকাল। এ সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙ্গালি হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে বিপুল ধন–সম্পদ সঞ্চয়। এরা ইংরেজ রাজশক্তির ছত্র–ছায়ায় লালিত পালিত হয়ে দ্রুত বর্ধিত হন। এসব বণিকরা প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ‘এজেন্সি হাউসগুলোর দেওয়ানী, মুৎসুদ্দীগিরি ও দালালী করতেন এবং পরবর্তী সময়ে (১৮১৩ সালের পর) এরাই আবার বড় বড় ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর বেনিয়ান ও এজেন্ট নিযুক্ত হলেন। এ ধরনের দেওয়ানী, দালালী, বেনিয়ানগিরি ও এজেন্টের কাজ করে এরা অভাবনীয় অর্থের মালিকে পরিনত হলেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এসব ব্যবসায়ীদের যেসব নাম পাওয়া গেছে তারা হচ্ছেন : (১) লক্ষীকান্ত বড়াল, (২) দত্তরাম দত্ত, (৩) রামমোহন পাল, (৪) মধুরামোহন সেন, (৫) নিত্যচরণ সেন, (৬) রামসুন্দর পাইন, (৭) স্বরুপ চাঁদ শীল, (৮) জগমোহন শীল, (৯) আনন্দমোহন শীল, (১০) স্বরুপ চাঁদ আঢ্য, (১১) কানাই লাল বড়াল এবং (১২) সনাতন শীল প্রমুখ। এরা সবাই ছিলেন বাঙ্গালি হিন্দু এবং এদের স্বার্থ পরাশক্তি ইংরেজদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। (বার্ষিক ডিরেক্টরি ও আলম্যানাক ১৮০৫–০৬)
বাংলার তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে হলে এসব ব্যবসায়ীদের কাযকলাপ সম্পর্কে কিঞ্চিত ব্যাখ্যাদান অপরিহার্য। গবেষকদের মতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার ব্যবসায়ী লক্ষীকান্ড ধর ওরফে নকুড় ধর, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামহরি বিশ্বাস, সুখময় রায়, রামচরণ রায়, রাজা নবকৃষ্ণ প্রমুখদের ধন–সম্পদ নবাবী আমলের জগৎশেঠ কিংবা উমিচাঁদের তুলনায় নেহায়েত কম ছিল না।পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এ দেশীয়দের মধ্যে যারা কোম্পানি আমলে এজেন্ট হাউসগুলোর দেওয়ানী ও মুৎসুদ্দীগিরি করত, পরবর্তীকালে তারাই নতুন নতুন ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট নিযুক্ত হলো। সবাই ধনাঢ্য ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অর্জন করল।
শ্রী শিবনাথ শাস্ত্রী তার ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, “তখন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ধনী হইয়াছেন।” কথিত আছে যে, নকুড় ধরের অর্থ সাহায্যের দরুন ইংরেজরা পর্ন্তর অনেক সময় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে। তার কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। ফলে তার কন্যার একমাত্র পুত্র সখময় রায় উত্তরাধীকারী সুত্রে বিপুল ধন–সম্পদ লাভ করেন। লর্ড মিন্টোর আমলে সুখময় ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ‘ব্যাংক অব বেঙ্গল’ এর একমাত্র বাঙ্গালি ডিরেক্টর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৭৭০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ইংরেজদের উদ্যেগে শুধুমাত্র কোলকাতা নগরীতে ১১টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এসবের কোনও শাখা ছিল না।
মতিলাল শীল আদিতে বোতল ও কর্কের ব্যবসা করতেন। কিন্তু অচিরেই তিনি ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সংস্পর্শে এসে দালালী ব্যবসায় লিপ্ত হন। তখনকার দিনে কোলকাতার ৫০/৬০টি ইংরেজ কুঠির ২০টির জন্য তিনি বেনিয়ান নিযুক্ত হন। এরপর মতিলাল বিদেশী ‘এজেন্সি হাউস’ –এর অংশীদার হন। এসব হাউস –এর মধ্যে ফার্গুশন ব্রাদার্স এ্যান্ড কোং প্রভৃতি অন্যতম। এছাড়াও মতিলাল শীল জমির ব্যবসা করতেন এবং তিনি কয়েকটা আটা কলের মালিক ছিলেন।বিশ্বম্ভর সেন সামান্য পুঁজি (মাত্র ১০টাকা) নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। অচিরেই তিনি প্রায় ২০টি ইংরেজ বাণিজ্যকুঠির বেনিয়ান নিযুক্ত হন। মৃত্যুকালে তার গচ্ছিত অর্থের পরিমান ছিল দুই লাখ পাউন্ডের মতো।
রাজা নবকৃষ্ণ ছিলেন মীর জাফরের নবার হবার সময় লর্ড ক্লাইভ –এর দেওয়ান এবং তিনি বিপুল অর্থ সঞ্চয় করেন। গভর্ণর ভ্যানসিটাট ও জেনারেল স্মিথ –এর দেওয়ানী করে রামচরণ রায় বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হন। ভুলুয়া ও চট্টগ্রামের লবনের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ানী করে রামহরি বিশ্বাস এবং তদীয় পুত্র প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস ও জগমোহন বিশ্বাস প্রভুত অর্থ উপার্জন করেন। প্রামার কোম্পানির খাজাঞ্চি গঙ্গা নারায়ণ সরকার অচিরেই কোলকাতার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাখ করেন। গোকুল চন্দ্র মিত্র ইংরেজদের সহযোগিতায় রসদের ঠিকাদারী করে সমৃদ্ধি লাভ করেন এবং কৃষ্ণচন্দ্র পাল চৌধুরী লবণের ব্যবসায় বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। রাম দুলাল দে বাণিজ্য সুত্রেই ধন লাভ করেন। সমসাময়িককালে তিনিই ছিলেন কোলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি। দে মহাশয় প্রথমে ফেয়ারলি কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন এবং পরে তার ব্যবসা আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
বাংলার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ দর্প নারায়ণ ঠাকুর হইলার কোম্পানির দেওয়ানী করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। এর পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর প্লাউডেন সাহেবের দেওয়ান নিযুক্ত হয়ে প্রচুর ধন সঞ্চয় করে পৃথকভাবে বাণিজ্য শুরু করেন। এসব বাণিজ্যের মধ্যে নীল ও রেশম রফতানি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার কোম্পানির নাম ছিল ‘টেগোর এ্যান্ড কোং’, তিনি ইউনিয়ন ব্যাংক –এর প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সত্যিকার বলতে গেলে তিনিই ছিলেন এই ইউনিয়ন ব্যাংকের একমাত্র মালিক। এ থেকেই তার সম্পদের পরিমাণ কিছুটা আন্দাজ করা যায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর তার জমিদারির প্রায় সর্বত্রই নীলের কারখানা স্থাপন করেছিলেন। এমনকি তিনি এদেশে চিনি উৎপাদনের নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন এবং কয়লা খনির মালিকানার জন্য আগ্রহী হয়েছিলেন। সরকার ছাড়াও কোলকাতার প্রতিটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল এবং সমাজে তার প্রতিপত্তি ছিল অসাধারণ।
এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ইংরেজ কোম্পানিগুলোর ছত্রছায়া এবং পৃষ্ঠপোষকতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ নাগাদ কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙ্গালি হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে প্রচুর ধন–সম্পত্তি সঞ্চিত হওয়ায় ইংরেজ রাজশক্তি কিছুটা চিন্তিত হলো। তারা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলেন যে, এক্ষনে এই সঞ্চিত মুলধন স্বাভাবিকভাবেই শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ হবে এবং যা কখনই ইংরেজদের কাম্য নয়। ইংরেজরা চা–শিল্প, খনি শিল্প এবং নতুন নতুন শিল্প ও কারখানা স্থাপনের বিষয়গুলো নিজেদের সম্পূর্ণ করায়ত্তে রাখতে আগ্রহী। এসময় দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাম দুলাল দে, মতিলাল শীল, রাম গোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ স্বাধীনভাবে শিল্প স্থাপনের যে উদ্যেগ গ্রহণ করেছিলেন, সেটাই ইংরেজ শাসক গোষ্ঠির উল্লিখিত চিন্তাধারাকে আরও বদ্ধমুল করে। অথচ ইংরেজরা তাদের এই সম্পুরক ও সহযোগী শক্তিকে কোন অবস্থাতেই বৈরী ভাবাপন্ন করতে ইচ্ছুক নন। এজন্যই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে ১৭৯৩ সালে জমিদারি প্রথার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন।
()
উৎসঃ কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি।
No comments:
Post a Comment