Sunday 26 March 2017

কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের ভুয়া রেনেসাঁ


কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের ভুয়া রেনেসাঁ
এম আর আখতার মুকুল

১৮৭২-৭৩ সালে এক প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে, মধ্যস্বত্যের বিস্তারের ফলে জমিদারির সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লাখের বেশি হয়েছে। বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারির সংখ্যা পাঁচশর কিছু বেশি, ত্রিশ হাজার থেকে পাঁচশ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারি প্রায় ষোল হাজার এবং এবং পাঁচশ ও তার কম ছোট জমিদারির সংখ্যা দেড় লাখের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার-পত্তনিদার-জোতদারদের গোমস্তা, নায়ে্‌ তহশীলদার, পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যের সংখ্যা যোগ করা যায় তাহলে দেখা যাবে উনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভুমি রাজস্ব নীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজে কমপক্ষে সাত-আট লাখ লোকের এমন একটি শ্রেণী তৈরী হয়েছে, যে শ্রেণী ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভসরুপ। অবশ্য সামাজিক শ্রেণী হিসেবে বলতে গেলে একটি শ্রেণী বলা যায় না, দুটি শ্রেণী বলতে হয়- একটি নতুন জমিদার শ্রেণী আর একটি নতুন মধ্যসত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্য শ্রেণী। নামে দুই শ্রেণী হলেও, কাজ ও স্বার্থের দিক থেকে এদের চিন্তা-ভাবনা ও আচরন এক শ্রেণীর মতোই।

নব সৃষ্ট হিন্দু মধ্য শ্রেণীর ভুয়া রেনেসাঁ

….. এ পাশে নাগরিক সমাজে, যেমন কোলকাতা শহরে, ব্রিটিশ শাসকরা তাদের বিশ্বাসভাজন আরও দুইটি শ্রেণী তৈরী করেছিলেন– একটি নতুন নাগরিক ধণিক শ্রেণী, আর একটি নতুন নাগরিক মধ্য শ্রেণী। এই মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ছোট ছোট ব্যবসায়, দোকানদার, দালাল প্রভৃতির সংখ্যা অনেক, বাকিরা নানা রকমের চাকরিজীবি। নাগরিক মধ্য শ্রেণীর একটি বিশেষ স্তর হিসাবে গড়ে উঠেছিল বাঙালি ইংরেজি শিক্ষিত এলিট শ্রেণী। ব্রিটিশ আমলে বাঙালি সমাজের এই শ্রেণী রুপায়ন নিশ্চয় একটা বড় রকমের পরিবর্তন এবং আগেকার পিরামিডের মতো স্তরিত সমাজের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। কেননা নবযুগের নতুন শ্রেণী বিণ্যাস অচল নয়, সচল-উর্ধ্বাধ: গতিশীল এবং সেই গতির প্রধান চালিকা শক্তি টাকা। টাকা সচল, শ্রেণীও তার ছন্দে সচল। বাঙালি সমাজে আঠারো উনিশ শতকে এ সত্যও নির্মম বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার জন্যই কি তাকে রেনেসাঁস বলা যায়?

পরবর্তী কালে অনেকেই উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার এই নব সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্রুত বিকাশের পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় কিংবা ষোড়শ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এদের মতে, বাংলার এই যুগই হচ্ছে নব জাগরনের যুগ। বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী তখন ইংরেজী শিক্ষায় দীক্ষিত হতে শুরু করেছে- তাদের সম্মুখে তখন পশ্চিমের নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। মানববাদী দর্শন সুচতুর আবরনে পাশ্চাত্যের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়াও আচার-ব্যবহার রীতি নীতি সব কিছুই এদের দৃষ্টিতে সজীব ও মহান। রেনেসাঁ আর নব জাগরনের ধ্বজা উত্তোলন করে বাংলার বর্ধিঞ্চু বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি শ্রেণী তখন বাবু কালচারের পাশাপাশি সাহেবী কালচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপকভাবে প্রয়াসী হয়েছে।

কিন্তু একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আক্রমনকারী দুর্ধর্ষ হিম্পানী আর্মাডাকে যখন ইংরেজরা পর্জুযদস্ত করতে সক্ষম হয়, তখন থেকেই তীব্র জাতীয়তাবাদ বোধের ভিত্তিতে সমগ্র ইংল্যান্ডে রেনেসাঁ বা নব জাগরনের জোয়ার বয়ে যায়। ইংরেজদের এই নব জাগ্রত দেশপ্রেমের প্রতীক এবং এর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রানী এলিজাবেথ। তাই ইংল্যান্ডের রেনেসাঁর শুরু যেখানে হিম্পানী আর্মাডার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়ের মাঝ দিয়ে; সেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রেনেসাঁর সুচনা হচ্ছে জাতির পরাজয়ের মাঝ দিয়ে। এই রেনেসাঁবা নব জাগরণই হচ্ছে কখনও পরোক্ষভাবে আবার কখনওবা নগ্নভাবে সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীর গুণকীর্তন করে।

অত্যন্ত দু:খজনকভাবে বলতে হয়, সে আমলে বাংলার মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর নবজাগরণ হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে। এই নব জাগরণের মোদ্দা কথাটাই হচ্ছে বশ্যতা মেনে নিয়ে পরাধীনতার শৃংখল সুদৃঢ় করা। বাংলার নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী ও উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে আপোস করে, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণীকে সরকারী চাকরির মাধ্যমে নিম্নস্তরের উচ্ছিষ্ট দিয়ে সন্তুষ্ট করে। সে আমলের এই মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি সমাজ বাঙালি হিন্দুয়ানীকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বলে এক রকম নিশ্চিত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্যন্ত এই চিন্তাধারা অনেকের কাছেই সঠিক বলে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাস্তবে এই ব্যাপারটা কত নাজুক ও ঠুনকো ছিল।

একটা ভ্রমাত্মক আদর্শ কোনও ইজম-এর জন্য সুদৃঢ় ভিত্তি হতে পারে না। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালি হিন্দুয়ানীকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাকে বিলীন করতে অপরিপক্ক প্রতিপক্ষের চার যুগের বেশি সময়েল প্রয়োজন হলো না। প্রথম পর্যায়ে ধর্মীয় স্লোগান উচ্চারন করে এই প্রতিপক্ষ বাঙালি হিন্দুয়ানীকে পদ্মার ওপারে বিশাল অবাঙালি জনসমুদ্রে ঠেলে দিল। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিপক্ষ মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে নির্ভেজাল বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্লোগান উচ্চারন করে রক্তাক্ত পতে ধর্মান্ধদের হটিয়ে দিয়ে পৃথক আবাসভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করল।

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই গাঙ্গের বদ্বীপ এলাকার পুরো জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮৮ ভাগই ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে এখানকার দ্রুত সৃষ্ট নয়া মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি এর কিছুটা স্পর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। তবুও একথা- স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, প্রচন্ড বাধা বিপত্তির দুর্গম পথ অতিক্রম করে প্রকৃত ও পরিপূর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। এটাই হচ্ছে ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ। এখন বাংলাদেশে প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদের শৈশবকাল চলছে। অবশ্য টাকার এ-পিঠে বাঙালি হিন্দুয়ানীর মতো ও-পিঠের বাঙালি মুসলামানীর প্রবক্তারা মাঝে মাঝে কিছুটা ধুলিঝড়ের সৃষ্টি করবে বৈকি। কিন্তু তা হচ্ছে নিতান্তই সাময়িক। বাংলাদেশের তরুন সমাজই এদের মোকাবেল করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে সক্ষম।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অর্থাৎ, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিত্বের দাবিদার কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু এই বুদ্ধিজীবি সমাজ নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে কীভাবে ইংরেজ পরাশক্তির লেজুড় হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে তা বিশেষভাবে লক্ষনীয়। পর্যলোচনা করলে দেখা যায় যে, আদর্শ দেশপ্রেম আর রেনেসাঁর কথাবার্তা বলে এরা যত ধুলিঝড়ের-ই সৃষ্টি করুক না কেন এ কথা আজ গবেষণার মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে যে, এই বুদ্ধিজীবি শ্রেণী আলোচ্য সময়ে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে গণমানুষের আন্দোলনে নেতৃত্বদান কিংবা ভ্যানগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তো দুরের কথা সাধারণ মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমস্ত প্রচেষ্টাকে হয় এরা বিদ্রুপ করেছে- না হয় উলঙ্গভাবে বিরোধীতা করেছে।

এই প্রেক্ষিতে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন সংবাদপত্রের ভুমিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। সে আমলে অবিভক্ত বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ কিংবা নীলচাষিদের বিদ্রোহ কোনটাকেই এসব পত্র-পত্রিকা সুনজরে দেখেনি। সর্বত্রই শ্রেণী স্বার্থ রক্ষার উদগ্র বাসনায় এসব সংবাদপত্রের পরাশক্তির সমর্থক হিসেবে অতি নিন্দনীয় ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সিপাহী বিদ্রোহ’র সময়ে কোলকাতার সংবাদপত্রগুলোতে সিপাহীদের এসব কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের মন-মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তা ইংরেজদের প্রতি দাসসুলভ মনোভাবে পরিচায়ক বলে উল্লেখ করা যায়।

(চলবে)

উৎসঃ কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী

No comments:

Post a Comment