Thursday 30 March 2017

পর্ব এক । । মুজিবের শাসন: একজন লেখকের অনুভব – আহমদ ছফা


পর্ব এক । ।
মুজিবের শাসন: একজন লেখকের অনুভব – আহমদ ছফা

নির্ভীক ছফা, নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারতেন কঠিন সত্য। আহমদ ছফার এই লেখাটা সেরকম একটি সত্যভাষন। একটি দলিল। এই ভূখন্ডে হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা, মাথা তুলে দাঁড়ানো মুক্তির চেতনা, স্বাধীনতার চেতনাকে কি করে ক্রমশ হত্যা করা হয়েছিল তারই একটি ছোট্ট দলিল-

চোদ্দই আগস্টের রাতে আমি নতুন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার সাতাশ নম্বর সড়কের একটি হোস্টেলে এক বন্ধুর সংগে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সাতাশ নম্বর আর বত্রিশ নম্বর সড়কের ব্যবধান বড় জোড় তিন থেকে চার’শ গজ। এই বত্রিশ নম্বরেই দারাপুত্র পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আনুমানিক রাত এগারোটা হবে হয়ত। বত্রিশ নম্বর পেরোবার সময় খাকি পোষাক পরা আট দশজন পুলিশ দেখলাম। কয়েকজন অফিসার, বাকিরা সেপাই। বন্দুক উঁচিয়ে রাস্ট্রপতির বাসভবনের সামনের সড়কের মুখে পাহারারত।
এই পথে বেশ ক’দিন থেকে যাওয়া আশা করছি। প্রায়ই দেখতাম ঘুণটি ঘরে দু’জন থেকে তিনজন সেপাই দাঁড়িয়ে। কোন অফিসার দেখেছি মনে পড়ে না। আজ পাহারাদারদের দল ভারি দেখেও মনে কোন ভাবান্তর আসেনি।

আগামিকাল পনেরোই আগস্ট বেলা দশটার দিকে রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এককালের বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আগমন করছেন। হয়ত সেজন্য এই অধিকসংখ্যক সেপাই-সান্ত্রীর আনাগোনা। এখন পর্যন্ত সবকিছু পুর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ঘটে আসছে। কোথাও কোনো ঝঞ্জাট ঘটেনি।

শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনোপলোক্ষে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছে সাজানো গোছানোর পালা। রাস্তার এবড়ো-থেবড়ো গর্তগুলোতে সুরকি পড়েছে। রোলার ঘুরছে, পীচের আস্তরণ বসেছে। গত এক পক্ষকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, কলভবনে, বাণিজ্যভবনে, বিজ্জানভবনে জোর মেরামতির কাজ চলছে। অনেকদিন অনাদরে মৃত জন্তুর কন্কালের মত দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাড়ামুড়ো দেয়ালগুলো চুণ, সুরকির প্রসাধন স্পর্শে হেসে উঠেছে।সমস্ত এলাকাটায় একটা সাজ সাজ রব, তাড়াহুড়ো ব্যস্ততা এসব তো আছেই।
রাতের আঁধারে শক্তহাতে আলকাতরা দিয়ে দাবড়া করে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে চ্যালেন্জ করা দেয়াল লিখনসমূহ নবীন চুনের প্রলেপের তলায় ঢাকা পড়েছে। সুন্দরীর ললাটের সিন্দুর বিন্দুর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সুউচ্চ শুভ্র প্রাচীরের কপোলদেশে শিল্পীর নিপুণ তুলিতে লেখা সুন্দর সুন্দর লিখনমালা দৃস্টিকে দূর থেকে টেনে নিয়ে যা্য়। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির ত্রানকর্তা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মহানায়ক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লৌহমানব ইত্যাদি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নানান রঙের চিত্রলেখায় সেজে সুন্দর হয়ে উঠেছে। চারদিকে একটা উৎসবের হাওয়া।

 বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা কালো কালো সাপের শরীরের মত চেকন বাঁকা রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে উল্লসিত অভিনন্দন বুকে ধারন করে রাতারাতি ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে নানান রঙের প্ল্যাকার্ড। তোরণরাজি মাথা তুলেছে। সর্বত্র একটা উৎকন্ঠার ভাব। আগামীকাল কাঁটায় কাঁটায় বেলা দশটায় তিনি আসছেন।
প্রায় এক পক্ষকাল ধরে দিনে রাতে কাজ চলছে। উপাচার্যের আহার নেই, নিদ্রা নেই। সাড়ে সাত লক্ষ টাকা নগদে বলিয়ে দিয়েও মনে মনে তিনি সস্তিবোধ করতে পারছেন না। দৈবাৎ যদি কোন ত্রুটি থেকে যায়, আর সেখানেই যদি মহামানবের দৃস্টি আটকে যায়, তিনি মুখ দেখাবেন কেমন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্ট্রপতির এটা প্রথম আনুষ্ঠানিক আগমন। তিনি শুধু রাস্ট্রপতি নন, বাঙালি জাতির পিতা, মুক্তিদাতা, বাংলার হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ, মাঠের মানুষের বন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সরকার সমর্থক ছাত্রদলটির হোমরা-চোমরা কর্মীদেরও বেশ ব্যস্তদিন কাটছে। তারা দিবসে কাজের তদারক করে, রজনীতে পাহারায় থাকে। বাংলাদেশে দুস্ট লোকের অভাব নেই। রাস্ট্রপতির আগমনের সন্গে সম্পুর্ণ সংগতিহীন অলুক্ষণে কোন দেয়াল লিখন লিখে যেতে পারে, অনেক অর্থব্যয়ের শ্রমের শিল্পকর্মগুলোর অংগহানি ঘটাতে পারে, সুন্দর চিত্রলেখাসমুহের লাবণ্যহানি করতে পারে, এরকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই আগেভাগেই এই শতর্কতামুলক ব্যবস্থা।
পুরো দায়িত্বটা রাস্ট্রপতির জ্যেস্ঠপুত্র শেখ কামাল গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ দেহ এবং বাহু বিশিস্ট বন্ধুদের নিয়ে অবিরাম চরকার মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের গোঁড়া সমর্থক ছাত্র এবং শিক্ষকদের মনোভংগিটা এরকম যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে চরণ ফেলামত্রই বাংলাদেশে একটি অভিনব যুগের অভ্যুদয় ঘটবে।

শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে আগমটা ছিল কৌশলগত দিক দিয়ে তাঁর নতুন শাসনতান্ত্রিক বিধি চালু করার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। উনিশ শ’ পচাঁত্তর সাল শুরুর দিকে তিনি বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের বেশকিছুকে জেলে ভরেছেন। তাঁর একনায়কত্বের প্রতিস্পর্ধী তরুণ বয়স্ক রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের খুশীমাফিক হত্যা করেছেন এবং সে কথা বলে প্রকাশ্যে গর্ববোধ করতেও তাঁকে দেখা গেছে।

প্রধানমন্ত্রির স্থলে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন রাস্ট্রপতি হয়ে বসেছেন। তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগ অন্য দুটো সমর্থক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়মী পার্টির কেউ কোনো ওজর আপত্তি উত্থাপন করেননি। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার সংগে জড়িত এই তিনটি দলের প্রত্যেকটিরই টিকে থাকার জন্য শেখ মুজিবের ছত্রছায়ায় দাঁড়ানোর ছিল একেবারে অপরিহার্য। মুজিব থাকলে তাঁরা সবাই আছেন, তিনি নেই তো কেউ নেই। তাই তাঁদের কারো পক্ষে এই জননন্দিত অধিনায়কের কোনো সিদ্ধান্তকে দলীয় কিংবা আন্ত:দলীয় শৃংখলা প্রয়োগ করে রাশ টেনে ধরা অসম্ভব ছিল।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই তিনি তাঁর প্রতি সমর্থনবিমুখ পত্র-পত্রিকাসমুহের মুখ প্রায় বন্ধ করে নিয়ে আসছিলেন। বিরোধী পত্রিকাগুলোতে সরকারি বিজ্গ্জাপন বন্ধ করে দিয়ে, সাংবাদিকদের গ্রফতার করে, সম্পাদকদের জেলে পুরে, ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে ইত্যাদি নানা ছলছুতোর সাহায্যে অনেকগুলো দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকার প্রকাশ সাফল্যজনকভাবে বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। এই চরম মার হজম করেও যে গুটিকয়েক পত্রিকা প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে বেঁচেছিল, সগুলোর বিরুদ্ধে কোন রকমের অভিযোগহীনতাকেই অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করিয়ে সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে বন্ধ করে দিলেন।
তারপরে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বিরোধী কোন দলের মালিকানাধীন কোন পত্রিকা ছিলনা। ব্যক্তি মালিকানাধীন পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল একেবারে অল্প।

শেখ সাহেবের নিজের দল আওয়ামী লীগ এবং তাঁর সমর্থক দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দলকে তিনি অংগুলি হেলনে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে যেদিকে ইচ্ছে পরিচালনা করতেন। এই দলগুলোর ঘোষিত রাজনৈতিক দর্শন যা-ই হোক না কেন, কার্যত তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের সব রকম নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। অংগদলসমুহের পরামর্শে নাকি নিজের বিবেচনা অনুসারে তা বলা খুব মুশকিল। তিনি সরকারি দলটি এবং সরকারের অন্ধ সমর্থক দল দুটোকে ভেংগে একটি মাত্র জাতীয় দল গঠন করার সিদ্ধান্ত ঘোষনা করলেন। আর নতুন জাতীয় দলের নামকরন করলেন, “বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ” সংক্ষেপে বাকশাল। বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষনার পরে তখন পর্যন্ত যে কয়টি ব্যক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বাংলাদেশ সরকারের সংগে আপোস রফা করে বেঁচেছিল, সগুলোকে পুরোপুরি সরকারি আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিনি সুদীর্ঘ বাহু প্রসারিত করলেন।

বাংলাদেশে ব্যাক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল একেবারে স্বল্প। অনেকগুলোই সরকারি কোপানলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আইয়ুব আমলে প্রত্যক্ষভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। বাংলা পত্রিকাটির নাম ছিল “দৈনিক পাকিস্তান”। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর “দৈনিক বাংলা” নামে আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজি পত্রিকাটির নাম ছিল “মর্নিং নিউজ”। এ দুটি পত্রিকা ছাড়া স্বাধীনতার পর সরকারের প্রত্যক্ষ এখতিয়ারে আরো তিনটি পত্রিকা চলে আসে। তার দুটি দৈনিকের মধ্যে একটি বাংলা এবং একটি সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র পত্রিকা। ইংরেজি দৈনিকটির পাকিস্তান নাম ছিল, “পাকিস্তান অবজারভার”। স্বাধীনতার পর “বাংলাদেশ অবজারভার” নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা কাগজটি আগে থেকেই “দৈনিক পূর্বদেশ” নামেই পরিচিত ছিল এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির নাম ছিল “চিত্রালী”। এই পত্রিকা তিনটির মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী যিনি ন’মাসের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়ে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের কার্যকলাপ সমর্থন করেছেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্থনের পূ্র্বে পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহন করেছিলেন। তাই পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হিসেবে পত্রিকা তিনটির প্রকাশনার দায়িত্ব সরাসরি সরকারকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে বাংলাদেশ যুব আওয়ামী লীগ প্রসিডিয়ামের সভাপতি কেন্দ্রীয় বাকশালের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা এবং রাস্ট্রপতির বুদ্ধিবিবেচনার একমাত্র ভরসা বলে কথিত জনাব শেখ ফজলুল হক মনি স্বাধীনতার পরে একেবারে শূন্যাবস্থা থেকেই তিন তিনটি পত্রিকার জন্মদান করেছিলেন। একটি ছিল বাংলাদেশের বিচারে ইর্ষাযোগ্য মানের অধিকারী ইংরেজি দৈনিক, নাম “বাংলাদেশ টাইমস”, বাংলা দৈনিকটির নাম “বাংলার বাণী” এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির “সিনেমা” নামে পরিচিত ছিল।

স্বাধীনতার পূর্বে তিনি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সাব এডিটরের কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের শাসনকালে জনাব শেখ ফজলুল হক মনির মত অনেকেই এরকম সামান্য অবস্থা থেকে অকল্পনীয় অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন। অবশ্য তাদের বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক উচ্চাকাংখা ছিলা না বলে টাকা-পয়সাকে এমন সুন্দর লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করতে পারেননি। ওপরে বর্ণিত তিনটি বাংলা এবং তিনটি দৈনিকের প্রত্যেকটিই সরকার সমর্থন করে যেত। এই সমর্থন অনেক সময় এতো দাসোচিত এবং অমার্জিত রুপ গ্রহণ করত যে, রুচিবান মানুষদের পিড়িত না করে ছাড়ত না। এই সকল পত্রিকার সম্পাদক এবং সাংবাদিকেরা সরকারের সুনজরে পড়ার জন্য তোষামোদ এবং তোয়াজে কে কার চাইতে অধিকদুর যেতে পারেন সেজন্য রীতিমত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। যদিও সেসব লেখা পাঠ করে বিবমিষা ছাড়া নিরপেক্ষ পাঠকের মনে আর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত না।

রাজধানী ঢাকা থেকে তখন প্রকাশিত উল্লিখিত ছয়টি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া আরো কয়েকটি পত্রিকা তখোনো ছিল। তার মধ্যে জনপ্রিয়তায় যেটি সবগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে পত্রিকার নাম “দৈনিক ইত্তেফাক”। এই পত্রিকাটির সংগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নানা উত্থান-পতন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি মওলানা ভাসানী এই কাগজটির প্রতিষ্ঠাতা হলেও প্রখ্যাত সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়া ছিলেন পত্রিকাটির মালিক এবং সম্পাদক। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রাতিম্বিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী তফাজ্জল হোসেন সাহেব নিজেও ছিলেন একজন আওয়ামী লীগার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর পরামর্শ-বুদ্ধি-বিবেচনা আওয়ামী লীগ মহলে অপরিসীম মর্যাদা এবং গুরুত্বসহকারে গৃহীত হত। জন্মের শুরু থেকেই এই পত্রিকাটি আওয়ামী লীগকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দান করে আসছিল। উনিশ শ’ পয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিকে তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় করার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমান যে ভুমিকা পালন করেছিলেন, “ইত্তেফাক” পত্রিকা এবং সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের অনন্য সাংবাদিকতার প্রতিভা তাঁর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেননি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের প্রতি জোরাল সমর্থন প্রকাশ করার অভিযোগে আই্য়ুব খান সরকারের গভর্নর মোনেম খান পত্রিকাটির প্রকাশ বন্দ্ধ করেছিলেন এবং ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন। উনিশ শ’ উনসত্তর সালের আইয়ুব বিরোধী অভ্যুত্থানের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে সাময়িক সরকারকে বাধ্য হয়ে এই পত্রিকাটির ওপর থেকে নিষিধাগ্জা প্রত্যহার করে নিতে হয়। “ইত্তেফাক” যেসব সময়ে আওয়ামী লীগকে অকুন্ঠ সমর্থন করে আসছিল ইত্তেফাকের ভুমিকাটি অতটা মর্যাদাবিবর্জিত ছিলনা। এই কাগজে মাঝে মাঝে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নটি তুলে ধরার চেষ্টা করত। ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির সপক্ষে কখনো-সখনো, দু’চার কথা নরমে-গরমে সাহস করে লিখে বসত। “ইত্তেফাক” ছাড়া অপর প্রাচীন দৈনিক পত্রিকাটির নাম “আজাদ”।

পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, মুসলিম লীগের পুরোধা, কৃতবিদ্য পন্ডিত এবং এক সময়ের বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের নাম করা সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন এই প্রাচীনতম পত্রিকাটির প্রতিস্ঠাতা সরকার ঘেঁষা। বাংলাভাষা আন্দোলন ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং কেন্দ্রের মধ্যে স্বার্থ-সংস্লিষ্ট ব্যাপারে যখনই বিরোধ উপস্হিত হত সব সময়েই কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন করত। মওলানা আকরম খাঁ যতদিন বেঁচে ছিলেন এই সুচিহ্নিত ভুমিকা “আজাদ” পত্রিকা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। মাওলানা সাহেবের মৃত্যুর পর আজাদের প্রাক্তন ভুমিকার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও পত্রিকা হিসেবে পূর্বের জনপ্রিয়তা হারিয়ে বসেছিল। পরিচালনার ত্রুটিই সম্ভবত এর মুখ্য কারণ। স্বাধীন বাংলাদেশে কোন রকমের ধারদেনা করে আজাদ পত্রিকার দিন চলছিল। সরকারের বিরোধিতা করার তো প্রশ্নই ওঠেনা। মাঝখানে একবার সরকার পত্রিকাটিকে নিয়েও গিয়েছিলেন।

মোজাফফর আহমদের বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পত্রিকাটির নাম “সংবাদ”। এই কাগজে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সমর্থন জ্জাপন করত। এই দুটি দলই যৌথভাবে ভারত থেকে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কিম্বা বলা যায় তারও আগে থেকে অধিকাংশ বিষয়ে আওয়ামী লীগকে ছায়ার মত অনুসরন করে আসছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই পার্থক্য কমতে কমতে একেবারে শুন্যের কোটায় এসে ঠেকেছিল। অধিকন্তু তিনদল মিলেমিশে একদল সৃষ্টির পরে একদলীয় সরকার পদ্ধতির মুখ্য নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের যাবতীয় কার্যকালাপের প্রতি সমর্থন যোগানো পত্রিকাটির একটি নৈতিক কর্তব্যও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পত্রিকাটিতেও সরকারি কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হত। স্বাধীনতার পর “জনপদ” নামে আরেকটি বাংলা দৈনিক ঢাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের এককালীন সভাপতি এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য জনাব কামরুজ্জামান ছিলেন পত্রিকাটির নেপথ্য মালিক। এটিও ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা। “দি পিপল” নামে একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছুকাল পূর্বে জন্মলাভ করেছিল। জনৈক উঠতি বাঙালী ধনী ছিলেন পত্রিকাটির স্বত্তাধিকারী। উনিশ শ’ একাত্তর সালের মার্চর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে কাগজটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে গাণ্দ্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের অর্থানুকুল্যে কাগজটির পুন:প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে পুনরায় কাগজটির প্রকাশ ঘটার পর থেকে সব সরকারকেই সমর্থন দান করেছিল। উনিশ শ’ একাত্তর সালের পয়লা জানুয়ারি একবার মাত্র সরকারি গুলিবর্ষন করার প্রতিবাদ করে গরম খবর পরিবেশন করেছিল বলে প্রচন্ড হুমকির মুখে ভাল ছেলের মত সুর পাল্টাতে বাধ্য হয়।মরী

No comments:

Post a Comment