তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা by এম এ হামিদ।
লেখকের কথা:
১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সংগঠিত হয়েছিল তিন তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান।
তিনটি অভ্যুত্থানই যুগান্তকারী ঘটনা, শতাব্দীর অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিমণ্ডলে ঘটে ব্যাপক উত্থান-পতন।
এমন কি সরকার পরিবর্তনের মত অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে যায়।
সৌভাগ্যবশত : তিনটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানই অতি নিকট থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।
প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাথে কমবেশি প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত ছিলাম।
অন্যরা যেখানে শুনে শুনে লিখেছেন, আমি সেখানে নিজে প্রত্যক্ষ করে লিখেছি।
ইতিমধ্যে বেশ কিছু লেখক অভ্যুত্থান ঘটনাগুলো না দেখেই শুধু শুনে শুনেই রং চং দিয়ে বিভিন্নভাবে অতিরঞ্জিত করে গল্পাকারে অলংকরণ করে লিখেছেন।
এতে প্রকৃত তথ্য বিকৃত হয়েছে।
১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর,৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানগুলোর উপর আমার লেখার সুবিধা হলো, ঐ সময় সৌভাগ্যক্রমে আমি ঢাকার স্টেশন কমান্ডার হিসেবে অত্যন্ত কাছ থেকে ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানগুলো প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল।
এছাড়া অভ্যুত্থানের প্রধান নায়কদের প্রায় সবার সাথে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও সরাসরি জানাশোনা।
পর্যালোচনা :
'তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' বইটি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনিতে কর্মরত একজন সেনা অফিসারের লিখিত বই। যিনি(এ সংক্রান্ত দলিলে, সংঘটিত অভ্যুত্থানে তিনি জড়িত হিসেবে তার নাম পাওয়া যায়নি) অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের সাথে হাস্যমুখে অন্তরঙ্গভাবে বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আড্ডায় বসেছিলেন বলে তার বক্তব্য থেকে জানা গেছে। এরপরও তিনি তার বয়ানকে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করেছেন বলে লেখকের দাবী। অত্যন্ত নিবিড় পাঠে যা পক্ষপাত দোষেদুষ্ট এবং বেশকিছু তথ্য আড়ালের প্রবণতা এখানে দেখা গেছে। তবে একটি বিষয়ে লেখককে ধন্যবাদ দিতে হবে, তিনি অভ্যুত্থানে জড়িত সবাইকে আকণ্ঠচিত্তে ক্ষমতালোভী হিসেবে বলতে দ্বিধা করেননি, যা অন্যান্য জড়িত বয়ানকারীদের মধ্যে 'আমি না, ও দোষী' এমন বলবার প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা গেছে। হয়ত তিনি এসবে জড়িত ছিলেন না বলে এমনটা বলতে সক্ষম হয়েছেন। তবে বন্ধু, কোর্সমেট, 'তুখোড় প্রতিভার' অধিকারী জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতি বন্ধুবাৎসল্য কিছুতেই গোপন করতে পারেননি অনেক ক্ষেএ্রেই। বিশেষ কিছু কারণে বইটির প্রতি আমি যথেষ্ট মাত্রায় বিরক্ত।
প্রথমতঃ বইটির ভূমিকাতে লেখক কর্ণেল এম এ হামিদ বয়ান শুরু করেন এভাবে "১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সংঘটিত হয়েছিল তিন তিনটি ভয়াবহ সেনা অভ্যুত্থান। তিনটি অভ্যুত্থানই যুগান্তকারী ঘটনা, শতাব্দীর অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিমণ্ডলে ঘটে ব্যাপক উত্থান-পতন। এমন কি সরকার পরিবর্তনের মত অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে যায়।" লেখকের এ বক্তব্যের মধ্যে কিছু শব্দের অভাববোধ করেছি, বাকিতে খুব একটা দ্বিমত নেই। কিন্তু হোঁচট খেতে হয় যখন লেখক বলেন, "সৌভাগ্যবশতঃ তিনটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানই অতি নিকট থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।" স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় দেশটির প্রাণ পুরুষ পরিবারসহ তাঁর বিশ্বস্ত চার সঙ্গীর নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করা ঠিক কিভাবে 'সৌভাগ্যের' বিষয় হতে পারে!!! পরবর্তী অভ্যুত্থানগুলোর ক্ষেত্রেও গ্লান্তি, হতাশা আসবার কথা ছিল, সেনাবাহিনির মত একটি সুশৃঙ্খল বাহিনির শৃঙ্খলা ভেঙে গিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ের খোয়াখুয়ি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখাটা সৌভাগ্যের হতে পারে কী?
দ্বিতীয়তঃ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের হত্যা নিশ্চিতের পর একজন রাজনৈতিক নেতাকে খুনীগোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামনে রাখার প্ল্যান করেছিল। সে অনুযায়ী, মেজর রশিদের কাজ ছিল একজন রাজনৈতিক নেতার সন্ধান করা, যে হবে তাদের মতের অনুসারী, এবং সেটি সে করেও, আওয়ামীলীগে ঘাপটি দিয়ে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মোশতাককে খুঁজে আনার মধ্যে দিয়ে। লেখক এখানে বলেছেন, 'খন্দকার মোশতাক শেখ সাহেবের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট ছিলেন না।' যেন এই অসন্তুষ্টির কারণেই পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টকে সপরিবারে খুন করা জায়েজ এবং সেই শূন্যতা পূরণ তার জন্য খুব সঠিক। তাও দলনেতা, দেশনেতাদের রক্ত মাড়িয়ে! এই শৃগাল বাংলাদেশ সৃষ্টি হোক সে বিষয়ে কতটা আত্ম নিয়োগ করেছিল? তার সচিব মাহবুব আলম চাষী ছিল সি. আই.এ'র মনোনীত এজেন্ট। এসব তথ্যের বিষয়ে লেখক উদাস। মোশতাক এবং চাষীর মত লোকেরা সি. আই. এ'র হয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভেদ তৈরিতে চেষ্টার ত্র্রুটি রাখেনি। বাংলাদেশ সৃষ্টির ব্যাপার নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল না মোশতাক। তার স্বপ্নে অন্য পতাকা, অন্য হিসাব সুপ্ত ছিল, যা বিচক্ষণ কিছু মানুষের রাডারে ধরাও পড়েছিল। জনাব হামিদ সেসব জানেন না এটা অবিশ্বাস্য। এছাড়া লেখকের সবচে' গর্হিত কাজটি হলো তিনি এই পাপীষ্ঠার সাথে, বাংলাদেশের জন্য আত্মনিবেদিত নেতা তাজউদ্দীন আহমদের প্রিয় মুজিব ভাইয়ের প্রতি অসন্তুষ্টিকে সমান্তরালে দাঁড় করিয়েছেন। এ ব্যাপারটি কিছুতেই হজম করা সম্ভব হয়নি।
তৃতীয়তঃ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানসহ বাকি অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কোনো বিদেশী হস্তক্ষেপের প্রমাণ বা উপস্হিতি লেখক মোটামুটি নাকচ করে দেন এবং এ বিষয়ে তার জ্ঞান সীমিত বলে পাশ কাটান। গৎবাঁধা বুলি, সেনাবাহিনির কতিপয় উচ্চাকাঙ্খী সদস্য ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে এবং দেশে চলমান চরম দুর্নীতি প্রতিহত করতে স্বৈরাচারী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে, এর বৃত্ত থেকে তিনিও বের হতে পারেনি বা সচেতনভাবেই সে বৃত্তে থেকেছেন। নইলে সেসময়ে তিনি সেনাবাহিনির যে পোস্টে কর্মরত ছিলেন এবং পরিকল্পনাকারীদের সাথে তার যেরকম ওঠা-বসা ছিল তাতে করে বিদেশি ষড়যন্ত্রের আঁচ বুঝলামই না, বলাটা শুধু হাস্যকর বলে পাশকাটানো যায় না, বরং একে উদ্দেশ্য মূলক ভাবলে ভুল হয় না। রক্ষীবাহিনি প্রধান বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামান ১৫ আগস্টে দেশে ছিলেন না, এই তথ্যটি জনাব হামিদ দিয়েছেন। কিন্তু তাকে যে পরিকল্পনা করেই দেশ থেকে সরানো হয়েছিল সে তথ্যের বিষয়ে তিনি নিরব থেকেছেন। আর সেটি ছিল সি. আই. এ পরিকল্পনার অংশ।
সি.আই.এ'র ছক মত প্রধান বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামানকে যুক্তরাস্ট্রে ডিফেন্স সম্পর্কিত ট্রেনিং কোর্সে আমন্ত্রণ করে সেখানে নেয়া হয়। কিন্তু রটনা করা হয় নূরুজ্জামান রক্ষীবাহিনির জন্য ট্যাংক সংগ্রহের জন্য সেখানে যাচ্ছেন। তিনি ১২ আগস্ট যুক্তরাস্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। পথে লণ্ডনে খবর পান সপরিবারে শেখ মুজিব খুন হয়েছেন। নূরুজ্জামানের অনুপস্হিতিতে দায়িত্বে ছিল কর্ণেল আবুল হাসান, পাকিস্তান প্রত্যাগত, ভীত এবং আক্রমণের সময় পলাতক(তথ্য উৎস: ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস/লেখক: আবু সাইয়িদ)।
১৫ আগস্টে বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবরটি দেশের জনগণ সর্বপ্রথম জানতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের 'ভোয়া'র মাধ্যমে। ভোর সাড়ে পাঁচটার(উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় আনুমানিক ৫:৫০মিনিট) দিকে ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করা হয়। ঐ দিন ভোর ছটায় ঢাকায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্হার অফিসে রয়টারের একটি ছোট খবর আসে যে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উদৃতি দিয়ে প্রেরিত রয়টারের বার্তাটি টেলিপ্রিন্টার যোগে লণ্ডন হয়ে ঢাকায় পৌঁছায়। স্পষ্টতঃই ধারণা করা যায় ভোয়া ও রয়টারের খবরের মূল উৎস ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। সি.আই এ. মুজিব হত্যার ব্যাপারে এতবেশি উদিগ্ন ও জড়িত ছিল বলেই মুজিব হত্যার খবর অত তাড়াতাড়ি ওয়াশিংটনে পৌঁছে গিয়েছিল। জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের পর তার প্রশাসনে বসানো (অধিকাংশ) লোকগুলোর কর্ম বৃত্তান্ত ঘাটলেও পেন্টাগনীয় ছকের স্পষ্ট আলামত পাওয়া যায়। এছাড়াও কর্ণেল তাহের তার জবানবন্দীতে বলেছেন, 'দিন কয়েকের মধ্যেই বুঝতে পারলাম মুজিব হত্যার পেছনে রয়েছে পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্র।' সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত দেশটাকে নতুনভাবে গড়ে তোলাটা যখন খুব জরুরী ছিল, তখন মওলানা ভাসানী 'আমি নতুন পতাকা ওড়াবো'র জিকির, এবং পরে ভুট্টোর আমন্ত্রণে পাকিস্তান সফর শেষে দেশে ফিরে 'ইসলামী বাংলা' গঠনের ঘোষণাও পাকি ও তার বন্ধুমহলের ষড়যন্ত্রেরই অংশ। দৈনিক হলিডে, দৈনিক ইত্তেফাক ইত্যাদি পত্রিকাগুলো বিদেশি ষড়যন্ত্রীদের মুখোপাত্র হিসেবেই সেসময়ে দেশে সক্রিয় ছিল। মুজিবের পুরো শাসনকাল জুড়েই ছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জান্তিক ষড়যন্ত্রের মুষুল বর্ষণের কাল। অথচ লেখক অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সেনাবাহিনির ভেতরের অসন্তোষ, ব্যক্তিগত আক্রোশ ইত্যাদি বাজারে প্রচলিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ থেকেছেন(বাস্তব ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের জাল খুব কম সেক্টর ছিল, যেখানে তা বিছানো হয়নি) আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নিজের জ্ঞান সীমিত বলে দায় সেরেছেন।
এসব বিষয়ে( চাইলে আরো প্রচুর উদাহরণ টানা যেতো) লেখক এম এ হামিদের পাশ কাটানো ভাবের কারণেই বইটিকে আমার কোনোভাবেই নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠতার খাতিরে লেখা মনে হয়নি।
http://www.academia.edu/9766498/109._তিনটি_সেনা_অভ_যুত_থান_ও_কিছু_না_বলা_কথা_-_লে._কর_ণেল_অব_এম_এ_হামিদ_পিএসসি
No comments:
Post a Comment