Tuesday 28 March 2017

আহমদ ছফার সাহিত্যাদর্শ _সলিমুল্লাহ খান


আহমদ ছফার সাহিত্যাদর্শ

সলিমুল্লাহ খান
‘নজরুলকে আমি আমার নিজের পেটের ছেলের মত মনে করি। নজরুলের জন্য আমার দরদ অপরিসীম। নজরুল যদি একাধারে শ্যামাসঙ্গীত ও ইসলামী গজল লিখে থাকেন ক্ষতি কি তাতে? সে জন্য তিনি সমালোচিত হবেন কেন? তাঁর মার্কসবাদী চিন্তা বা রাজনৈতিক জ্ঞানের মধ্যে কনট্রাডিকশন আছে কি না-আছে সেটিও তাঁর কাব্যালোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
আহমদ ছফা (১৯৯৯)
আহমদ ছফা পরলোক গমন করিয়াছেন ইংরেজি একুশ শতকের সূচনালগ্নে ২০০১ সালের ২৮ জুলাই। দেখিতে দেখিতে পনের বৎসর হইয়া গেল। লেখকের ভাইয়ের ছেলে নূরুল আনোয়ার চাচা সাহেবের একটা স্মৃতিকথা লিখিয়াছেন। নামটা বেশ : ‘ছফামৃত’। স্মৃতিকথা আর জীবনকথায় কিছু পার্থক্য আছে। আশা করি, একদিন না একদিন কেহ না কেহ আহমদ ছফার একটা বড় জীবনকথাও লিখিবেন। জীবন-কাহিনি যিনিই লিখুন, তাঁহাকে কয়েকটি বড় বড় প্রশ্নের উত্তরও সন্ধান করিতে হইবে।
জীবনের একেবারে আদিপর্বে রাজনীতির সহিত জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন আহমদ ছফা। প্রথম জীবনে তিনি বামপন্থী বা আরও গোঁ ধরিয়া বলিলে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সহিত যুক্ত হইয়াছিলেন। সেই সময় তিনি মাও জেদঙ্গের উদ্ধৃতিও অনুবাদ করিয়াছিলেন। মওলানা ভাসানীর দিকে টান থাকিবার পরও তিনি চারিদিকে চোখকান খোলা রাখিয়াছিলেন। তাই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইবার পূর্বক্ষণে দেশের তরুণ লেখক-সাহিত্যিকদেরও সংগঠিত করিয়াছিলেন। গড়িয়াছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা লেখক সংগ্রাম শিবির’। দেশ স্বাধীন হইবার পরে ইহা ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ নামে পরিবর্তিত হয়। যৌবনের মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে বিশেষ মুক্তিযুদ্ধে শামিল হইয়াছিলেন।
দেশ স্বাধীন হইবার পর তিনি কিছুদিন ভিড়িয়াছিলেন আওয়ামী লীগের এক অপভ্রংশ তথাকথিত ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক’ দলের সঙ্গে। একটা সময় তিনি কিছু পরিমাণে এসলামি ধারার রাজনীতির দিকেও ঝুঁকিয়াছিলেন। মোয়াম্মার গাদ্দাফির চিন্তাধারায় তিনি কিছুদিন আলোড়িত হইয়াছিলেন। আরেক সময়ে পশ্চিম জার্মানির একটি দাতব্য সংস্থার সহিত কাজ করিয়াছিলেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাঁহার সম্পর্কেও তাহা কিছুদূর বলা চলে, আহমদ ছফার ‘রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্দিষ্ট করে কি ছিল বলা মুশকিল’।
26c5ae92-bdea-4a91-88a3-a7b7134cf90b
সলিমুল্লাহ খান
আজিকার নিবন্ধে আমি তাঁহার রাজনীতির বিশ্বাস লইয়া আলোচনা করিব না। করিব তাঁহার সাহিত্য-বিশ্বাস লইয়া। আমি জানি, মানুষের সকল সাহিত্য বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে (বা পেটের ভিতর) রাজনীতির বিশ্বাস লুকাইয়া থাকে। আমার প্রস্তাব এই, আহমদ ছফার সাহিত্য-বিশ্বাস কি ছিল বুঝিতে হইলে বুঝিতে হইবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-বিশ্বাস কি ছিল। সবিনয় নিবেদন, আমাদের যুগে বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যে আহমদ ছফার নিকটতম তুলনা কাজী নজরুল ইসলাম। কথাটা একটু বুঝাইয়া বলার দরকার আছে।
জ্ঞান যতদূর যায় দেখিলাম, আহমদ ছফা কাজী নজরুল ইসলাম নামে কোনো আলাদা গ্রন্থ রচনা করেন নাই। তাঁহার কাগজপত্রের মধ্যেও তেমন কোনো অপ্রকাশিত গ্রন্থের সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। তাঁহার প্রকাশিত রচনার মধ্যে মোট পাঁচ কি ছয়টি কুল্লে খুঁজিয়া পাইলাম যাহার মূল (বা দোহার) কাজী নজরুল ইসলাম। চারিটি বাংলা প্রবন্ধ এবং একটি ইংরেজি। ইংরেজি প্রবন্ধটি তিনি লিখিয়াছিলেন খুব সম্ভব ১৯৭১ সালের আগে। ইহার প্রথম প্রকাশ ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় প্রকাশিত বাংলা একাডেমির ইংরেজি গবেষণা পত্রিকা বাংলা একাডেমি জার্নালের জুলাই সংখ্যায়।
আহমদ ছফা ঐ সময় ঢাকায় ছিলেন না। ছিলেন ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত ভারতের এককালীন রাজধানী শহর কলিকাতায়। মজার বিষয়, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের ২৮ তারিখ প্রকাশ পাইয়াছিল আহমদ ছফার প্রবন্ধ সংকলন ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। প্রকাশক স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বা মুক্তধারা) নামের আড়ালে ঢাকার বাংলাবাজারের ব্যবসায়ী চিত্তরঞ্জন সাহা। ঘটনাচক্রে ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ প্রকাশনার ৩০ বছর পর একই দিনে ২০০১ সালের ২৮ জুলাই আহমদ ছফা পরলোক গমন করেন।
আহমদ ছফা মনে হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ নাগাদ শরণার্থী হইয়া প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণের আগেই লেখাটি বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়া গিয়াছিলেন। সেই দুঃসময়ে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী জাতীয় অনুষ্ঠান বাংলা একাডেমির পরিচালক এবং গবেষণা পত্রিকা সম্পাদকও। বোঝা যায়, তাঁহার আগ্রহেই লেখাটি জার্নালে ছাপা হইয়াছিল। লেখার নাম ছিল ‘লিটারেরি আইডিয়েলস অব বেঙ্গল’। এই ইংরেজি লেখাটি বর্তমানে আহমদ ছফা রচনাবলির ৮ম খণ্ডে পাওয়া যায়।
খুব সম্ভব ১৯৭৪ সালের শেষাশেষি (কি ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে) ‘বাংলার সাহিত্যাদর্শ’ নামে আহমদ ছফার একটি প্রবন্ধ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা’য় ছাপা হয়। ইহা পরে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষা: রাজনীতির আলোকে’ নামক বইতে স্থান পায়। লেখাটি এখন আহমদ ছফা রচনাবলির ২য় খণ্ডে পাইবেন। এই লেখায় আহমদ ছফা বাংলার সাহিত্যাদর্শ বলিয়া চারজন পূর্বগামী লেখকের নামোল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে সর্বশেষ কাজী নজরুল ইসলাম। আহমদ ছফার আক্ষেপ : ‘আমাদের সাহিত্যের এ পর্যন্ত সর্বশেষ আদর্শ নির্মাতা এবং শেষতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের পূর্ণ মূল্যায়ন এখনো হয় নি।’
কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ে আহমদ ছফার তৃতীয় (অথবা দ্বিতীয় বাংলা) প্রবন্ধ এখনও রচনাবলীতে ঠাঁই পায় নাই। এই লেখা ছাপা হইয়াছিল লেখকের স্বহস্ত সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’ ২৭ মে/৩ জুন ১৯৮৮ সংখ্যায়। মনে হইতেছে, নজরুল ইসলামের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ/২৫ মে উপলক্ষেই ইহা লেখা হয়। লেখাটি আমরা ‘উত্তরণ’ পত্রিকা হইতে উদ্ধার করিয়াছি। নামটি বেশ দীর্ঘ ‘নজরুল জন্মজয়ন্তী ফলহীন প্রতর্ক : কতিপয় জিজ্ঞাসা’। আমরা ইহার দোহাই সংক্ষেপে ‘কতিপয় জিজ্ঞাসা’ নামেই দিব। ১৯৮৯ সালেও নজরুল ইসলামের জন্মদিন সামনে রাখিয়া তিনি একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। এই চতুর্থ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘নজরুল সাহিত্যে ঐতিহ্য চেতনা’।
কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ে আমার পড়া আহমদ ছফার সর্বশেষ প্রবন্ধের নাম ‘নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ’। ইহার প্রথম প্রকাশ মুস্তাফা নূর উল ইসলাম সম্পাদিত মাসিক ‘সুন্দরম’ পত্রিকায়। যতদূর মনে পড়ে ১৯৯০ সালের কোন এক সংখ্যায়। ইহার বর্তমান প্রাপ্তিস্থান আহমদ ছফা রচনাবলি : ‘উত্তরখণ্ড’। বর্তমান নিবন্ধে আমি প্রথমে ‘বাংলার সাহিত্যাদর্শ’ (১৯৭৪) ও ‘খেটে খাওয়া মানুষের সাহিত্য প্রসঙ্গে,’ (আনু. ১৯৭২-৭৫), দ্বিতীয় স্থানে ‘নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ’ (১৯৯০) ও ‘নজরুল সাহিত্যে ঐতিহ্য চেতনা’ (১৯৮৯), এবং সবশেষে ‘কতিপয় জিজ্ঞাসা’ (১৯৮৮) আলোচনা করিব। উল্লেখ করিতে হইবে, বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার পদবাচ্য রচনায়ও তিনি নজরুল ইসলামের ঐতিহাসিক ও সার্বিক মূল্য নির্ণয় করিয়াছেন। আমরা এই নিবন্ধে সেই উপকারটুকুও কবুল করিব।
আহমদ ছফা দেখাইয়াছেন, বাংলাদেশে ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠার পর যে নতুন ভাষারীতি ও সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছিল তাহার প্রধান আদর্শ চারিজন। একজন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্য তিনজন হইলেন যথাক্রমে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)।

১৯৭৪ সালের ‘বাংলার সাহিত্যাদর্শ’ প্রবন্ধটি লেখকের ১৯৭১ সালে লিখিত আদি ইংরেজি প্রবন্ধের পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ বলিয়া আমাদের মনে হইয়াছে। আমরা এখানে শুদ্ধ বাংলা প্রবন্ধটির কথাই আলোচনা করি। এই প্রবন্ধে আহমদ ছফা দেখাইয়াছেন, বাংলাদেশে ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠার পর যে নতুন ভাষারীতি ও সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছিল তাহার প্রধান আদর্শ চারিজন। একজন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্য তিনজন হইলেন যথাক্রমে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)।
আহমদ ছফার মতে, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তই হলেন বাঙ্গালি বুর্জোয়া শ্রেণির যথার্থ প্রতিনিধি। তাঁর মধ্যেই বুর্জোয়া শ্রেণির বিদ্রোহী জীবনোল্লাস পারিপার্শ্বিকের সমস্ত বাধা লঙ্ঘন করার জন্য উল্লম্ফিত হয়ে উঠেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকৃত প্রস্তাবে বাঙ্গালি বুর্জোয়া শ্রেণীর জাগরণগীতি।’ এই বক্তব্য পাকা ভিতের উপর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে তিনি পূর্বগামী দুইটি তরঙ্গের সহিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের তুলনা করিলেন। এক তরঙ্গের নাম তথাকথিত ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দল। আর তরঙ্গের নাম সংক্ষেপে রাখা যায় ‘সমাজ সংস্কার দল’ বা ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’।
আহমদ ছফার ধারণা, তথাকথিত ‘ইয়ং বেঙ্গল’ ছিল নবজাত বাঙ্গালি বুর্জোয়া শ্রেণির প্রথম প্রতিনিধি। প্রথম হইলেও দলগত পরিচয়ে তাহারা যথার্থ নহেন। আহমদ ছফার ভাষায়, ‘তাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের অত্যন্ত রক্ষণশীলদের একেবারে বিপরীত। এঁরা তাঁদের সত্যপ্রীতি, জ্ঞানতৃষ্ণা, সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন এবং সমাজ বিপ্লবের প্রতি আগ্রহ এসবের মধ্য দিয়ে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে একটা মানসিক পরিবর্তন সম্ভাবিত করে তুলেছিলেন। তার ফলে বাংলার কতিপয় মানুষের সৃষ্টিচেতনা গভীর আবেগে শিহরিত হয়ে ওঠে। বাঙ্গালি মনের এই ঊর্ধ্বমুখী শিহরন, আগে যা কখনো ঘটে নি, তার সৃষ্টিশক্তিকে নানান দিকে প্রবাহিত করে নিয়ে যায়, [তাকে দেয়] তার সৃষ্টিচঞ্চল চিত্তদোলা। একে ইতিহাসে বাংলার নবজাগরণ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
sofa_43
আহমদ ছফা, তরুণ বয়সে
দ্বিতীয় তরঙ্গ আকারে আহমদ ছফা যাহা দেখিয়াছেন তাহাও এই মুদ্রারই অপর পিঠ বৈ নহে। তবে ইহার নাম তিনি রাখিয়াছেন বড় কোমল কোরিয়া ‘সমাজ সংস্কার’। আহমদ ছফার বিচারে, ‘তাঁরা শান্তভাবে বিচার করে প্রতীচীর শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন, কিন্তু পুরোপুরিভাবে প্রতীচ্য সমাজের আদর্শ অন্ধভাবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না।’ আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, ‘শক্তির যে উন্মুখর তরঙ্গ বুর্জোয়া শ্রেণীকে কর্মক্ষেত্রে তাড়িত করেছে বাঙ্গালি সমাজের প্রাথমিক দিকপালদের সাহিত্যকর্মে পুরোপুরি তার উদ্ভাসন মেলে না। তাঁরা ভাষা এবং সাহিত্যকে তাঁদের মতামত প্রকাশের বাহন করে তোলেন।’ এই দিকপালদের মধ্যে আহমদ ছফা মাত্র রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই দুইজনের নাম লইয়াছেন। ইঁহারা বাংলা ভাষায় গদ্য লেখার সূত্রপাত করিয়াছিলেন। শুদ্ধ তাহাই নহে, গদ্যকে তাঁহারা ধর্ম ও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন গড়িবার কাজেও নিয়োগ করিয়াছিলেন। তবু ষোল আনা বুর্জোয়া হইয়া সারেন নাই ইঁহারা। যথার্থ বুর্জোয়া বলিতে যাহা বুঝায় তাহা বুঝাইতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের উদাহরণ দিয়াছেন আহমদ ছফা।
আহমদ ছফার বক্তব্য যৎকিঞ্চিত এ রকম :
মাইকেলের উদ্দাম কল্পনা করার ক্ষমতা, কবিতা রচনার অসাধারণ প্রতিভা, তাঁর ঐতিহ্য, মানস সংগঠন, শিক্ষা, সাধনা, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা, প্রাচীন কবিদের রচনার প্রতি আগ্রহ এবং সর্বোপরি বীররসের কাব্য রচনা করার অনিবন্ত কামনা তাঁকে সম্পূর্ণভাবে নবযুগের অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করে। অন্যান্য মহৎ কবিদের মতো তিনিও তাঁর যুগের চাইতে অনেক দূর অগ্রগামী ছিলেন। রাবণ, ইন্দ্রজিৎ এবং প্রমীলার প্রতি তাঁর জাগ্রত সহানুভূতি। তাঁদেরকে মূল রামায়ণের রাম, লক্ষ্মণ, সীতার চাইতে অধিকতর মহৎ এবং বলিষ্ঠভাবে চিহ্নিত করেছেন [তিনি]। রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, প্রমীলার চরিত্রে সাহিত্যিক মহত্ত্বের প্রতিষ্ঠা দিয়ে মাইকেল ঐতিহ্য এবং সংস্কারের বুকে যে প্রচণ্ড আঘাত করলেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
আহমদ ছফার দুই নম্বর আদর্শ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁহার প্রতিজ্ঞা অন্য : ‘তিনি হিন্দুধর্মে পুনর্জীবন দান করার দিকে সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ রাখলেন।’ আহমদ ছফা বলিয়াছেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের যোগ্য উত্তরসূরী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। তবু দুই মহান শিল্পীর মধ্যে যে পার্থক্য তা দুস্তর।’ এই পার্থক্যের দুই মাত্রা দেখাইয়া দিয়াছেন আহমদ ছফা। একমাত্রা সময়ের। অন্য মাত্রা মনের গঠনের। সময়ের পার্থক্য মানে কি? মানে বঙ্কিমের দিনে ব্রিটিশ শাসন দৃঢ় হইয়া বসিয়াছে এবং একটি ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি’ হইয়া গিয়াছে। লক্ষ করার জিনিশ, আহমদ ছফা বলিতেছেন ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি।’ ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’ বলিতে পারিতেছেন না। কেন পারিতেছেন না, তাহা এই শ্রেণির মনের গঠনপানে তাকাইলেই বুঝিতে পারিব।
আহমদ ছফা দেখাইতেছেন, ‘রাজত্বের প্রথম দিকে ব্রিটিশ জনসাধারণ এ দেশিদের চোখে যে মর্যাদার অধিকারী ছিল বাস্তবের কঠোর সংঘাতে [‘সাম্রাজ্যবাদ ধীরে ধীরে তার স্বরূপ প্রকাশ করতে লেগেছে’ বলিয়া] তাদের অনেক নিচে নেমে আসতে হয়, তারা মর্যাদা হারাতে থাকে। এদেশের চিন্তাশীল মানুষের মনে এ প্রতীতি জন্মাল যে বিদেশি লোকেরা তাদের আষ্টেপৃষ্টে কয়েদ করতে এসেছে, তাদের সাহায্যে জাতীয় মুক্তি কিছুতেই সম্ভব নয়। এই সংশয়ী মনোভাব সে যুগের চিন্তাশীল মানুষদের মন-মানস অধিকার করেছিল।’
তবে এই মনোভাব ছিল মনের একপিঠ। অন্যপিঠও যদি একইভাবে একই সঙ্গে নিজের বুক দেখাইত তবে এই শ্রেণীকে বুর্জোয়া শ্রেণী বলিয়া ভুল করা যাইত। কিন্তু এই শ্রেণীর মতিগতি ছিল ভিন্ন। আহমদ ছফা তাহার সন্ধান দিয়াছেন এইভাবে : ‘পাশাপাশি এক ধরনের জাতীয় চেতনার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল এবং মনের মধ্যে একটা নিরাপদ ভিত্তি সন্ধান করেছিল। ঊনবিংশতি শতাব্দীর মানুষেরা [এয়ুরোপীয়] জাতীয় চেতনার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। বাংলার সে দূরদর্শী স্বাপ্নিকেরা ভুলে গিয়েছিলেন প্রকৃত অতীতের উপরই ভবিষ্যতের ভিত্তি নির্মাণ করা যায়।’
আহমদ ছফা তৎকালীন ভারতীয় চিন্তার দরিদ্রদশা এইভাবে নির্দেশ করেন : ‘এটা খুবই পরিতাপের বিষয় যে তাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের অতীত বলতে বুঝতেন সে সময় যখন আর্যেরা এ সুপ্রাচীন দেশে এসে [এদেশকে] তাঁদের বসবাসের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। [তাঁরা] ভারতীয় হিন্দুদের অতীত একমাত্র সেই সময়ের মধ্যে নিবদ্ধ মনে করতেন। তাই তাঁরা এই উপমহাদেশে প্রায় হাজার বছরের মুসলিম শাসনকে আতঙ্কিত দুঃস্বপ্ন জ্ঞান করে আলাদা করে রাখলেন।’ আহমদ ছফার মতে, এইসব কারণেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক ধরনের দুরারোগ্য হীনম্মন্যতায় ভুগিতেন। তাই তিনি মধুসূদন দত্তের মানববাদী আদর্শ হইতে নামিয়া আসিলেন। বরণ করিলেন হিন্দু সাম্প্রদায়িক আদর্শকেই।
বঙ্কিমের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হল তিনি ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন, কথাটা সত্যি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের একজন সে বিষয়ে কারো সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়।
আহমদ ছফার কথায়, ‘শিল্পী নিজেকে হিন্দুধর্মের আদর্শের সঙ্গে এক করে ফেললেন। অন্য ধর্ম, অন্য জাত এবং দেশের প্রতি মানসিক কারণেই বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠলেন। হিন্দু এবং হিন্দুধর্ম ছাড়া আর কিছুই তিনি ভাবতে পারেন নি।’ এইখানেই ‘বাংলার সাহিত্যাদর্শ’ প্রবন্ধেই আহমদ ছফা ঘোষণা করিয়াছিলেন, ‘সম্ভবত বাংলা বিভক্ত হওয়ার মূল কারণ শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।’ আহমদ ছফার এই বিশ্বাসে কোনোদিন চিড় ধরে নাই। ১৯৯৪ সালে উদযাপিত বঙ্কিমের শতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৯৭ সালে তিনি লিখিয়াছিলেন ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: শতবর্ষের ফেরারী’। সেই প্রবন্ধে তিনি বঙ্কিমের ঐতিহাসিক ভূমিকা আরও বিশদ করিয়াছিলেন।
শয়তানকেও তাঁহার প্রাপ্য দিতে হইবে। বঙ্কিমচন্দ্র কেন বাদ পড়িবেন! মনে রাখিবেন, আহমদ ছফার দ্বিতীয় আদর্শ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি লিখিলেন, ‘বঙ্কিমের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হল তিনি ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন, কথাটা সত্যি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের একজন সে বিষয়ে কারো সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়। তাঁর হাতেই বাংলা গদ্য পূর্ণতা লাভ করে, ভাষা এমন পেলব হয়ে ওঠে যে অন্তরের ভাব অনুভাব ধারণ করার মত বেগবান এবং ক্ষিপ্ররূপ পরিগ্রহ করে।’ বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত তুলনা করিবার মতন মনীষী ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় বিশেষ জন্মায় নাই। একমাত্র ব্যতিক্রম হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আহমদ ছফা তাহা বিশেষ জানেন : ‘উপন্যাস শিল্পে তাঁর যে অবদান তার সঙ্গে কারো তুলনা হয় না। সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটির উৎপত্তি, বিকাশ এবং পূর্ণতাও তাঁর মধ্যেই হয়েছে। এই আনন্দিত কিন্তু কঠিন অভিযানে যে সকল বিদেশি লেখক তাঁকে প্রেরণা দিয়েছেন সাফল্যের দিক দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, তিনি তাঁদেরও ছাড়িয়ে গেছেন।’ তাই বলিয়া অন্ধ কিন্তু হওয়া চলিবে না। প্রদীপের তলায় সমান অন্ধকার। আহমদ ছফা লিখিতেছেন, ‘কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোর চরিত্রে এক ধরনের আর্যামীর ভড়ং দেখা যায়। এটা একটা প্রহেলিকা যা থেকে বঙ্কিমচন্দ্র কোনোদিন মুক্ত হতে পারেন নি।’
আহমদ ছফার তৃতীয় সাহিত্যাদর্শ আগেই জানিয়াছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিও কিন্তু প্রভাব বিচারে বঙ্কিমচন্দ্রের সমান হইতে পারেন নাই। আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, ‘বঙ্কিম সানন্দে যে অন্ধকার ছড়িয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত একজন ব্যক্তিত্বের জীবনভর সংগ্রাম তা দূর করতে পারে নি পুরোপুরি। শয়তান তার প্রাপ্য আদায় না করে ছাড়ে নি।’ তবে প্রতিভার বিচারে রবীন্দ্রনাথই রবীন্দ্রনাথের শেষ তুলনা। আহমদ ছফা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরো অনেক ভালো ভালো কথা জাহির করিয়াছেন। একটি কথা এই রকম :
রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলা সাহিত্যের তুলনাবিহীন কল্যাণ সাধন করেছে। তাঁর প্রশান্ত ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বঙ্কিম এবং অন্যান্য লেখকেরা পূর্বে যে বিদ্বেষবিষ ছড়িয়েছিলেন তার ধার অনেকটা মরে আসে।
তারপরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মধুসূদন দত্তের জায়গায় পৌঁছাইতে পারেন নাই। এই প্রস্তাবের একটি প্রমাণ আহমদ ছফা অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাজির করিয়াছেন : ‘মাইকেলের সময়ের আলোকপ্রাপ্ত সমাজ একটা পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু মাইকেলের অঘটনঘটনপটিয়সী প্রতিভা যা করল তা সহ্য করার মানসিকতা তখনো অনেকের জন্মায় নি। মাইকেলের একচোখা সমালোচক [আর] অন্ধ অনুকারকদের কথা বলে লাভ নেই। এমনকি যৌবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং মাইকেলের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন।’ ‘দুর্বিনীত’ আহমদ ছফাও মধ্যে মধ্যে বিনয়ের অবতার। তাই এই জায়গায় আসিয়া কথাটা ছাড়িয়া দিয়াছেন তিনি। আমরা আরও বিনয়ের সহিত যোগ করিব, শেষ বয়সেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মাইকেলের প্রতি বিরূপ ধারণা’ ছাড়িয়া দেন নাই। দিয়াছিলেন এমন প্রমাণ সহজে মিলিবে না। বিদেশি লেখক এডোয়ার্ড টমসনও তাহার সাক্ষী।
আহমদ ছফা অবশ্য কবুল করিতে কসুর করেন নাই, ‘রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের আঁশগুলো পরীক্ষা করে দেখলে ধরা পড়ে, তিনি ছিলেন একজন মহান সামন্ত, যদিও পরবর্তীকালে বুর্জোয়া গুণপনা প্রশংসা করার মত মানসিকতা [তিনি] অর্জন করেছিলেন।’ আহমদ ছফার বিচারের শেষ এখানেই হয় নাই। যেমন তিনি অন্যত্র বলিতেছেন : ‘তিনি মানুষে মানুষে সহজ সম্পর্কের কথা বলতেন, কেননা এটা সামন্তবাদের একটি অত্যন্ত হাঁ-বোধক মানবিক দিক। বুর্জোয়া শ্রেণী এই সরল সম্পর্ককে টাকার সম্বন্ধে রূপান্তরিত করেছে।’ আহমদ ছফা আরেকটু যোগ করিয়াছেন :
তাঁর মর্জি-মেজাজও ছিল সামন্তোচিত। কিন্তু তাঁকে এমন পৃথিবীতে জীবনধারণ করতে হয়েছে যা পুরোপুরি এই বুর্জোয়া শ্রেণীর অধিকারে চলে গেছে। কবি স্বয়ং তা জানতেন। সে জন্যই তিনি সমাজ থেকে আংশিক আলাদা হয়ে স্বপ্ন এবং ধ্যানের জগতে বাস করতে বাধ্য হয়েছেন। একজন ভগবানের আনন্দিত সান্নিধ্যে তিনি দায়মুক্ত এবং নির্ভার মনে করতেন। এ ভগবানকেই তিনি রামমোহন রায় থেকে বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন।
আহমদ ছফা এক্ষণে তাঁহার সর্বশেষ আদর্শ অর্থাৎ কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত পৌঁছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন, বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তিন দফা পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। এই পরিবর্তনকে প্রায় বিপ্লবের সহিত তুলনা করা চলে। এক নম্বরে, ‘তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা কবিতার ভরকেন্দ্রের পালাবদল ঘটে গেল।’ এই পালাবদলের অর্থ পরিষ্কার। কিংবা কবিতায় একটা সামাজিক বিপ্লবের সূচনা হইল। পরিবর্তন আসিল কাব্যের শ্রেণিচরিত্রে। আহমদ ছফা দেখিলেন, ‘কবিতা গজদন্ত মিনার ছেড়ে রাজপথে নেমে এল এবং সামাজিক শক্তির অংশ হিসেবে স্বরূপ প্রকাশ করল। সমাজের নির্যাতিত মানুষেরা কবিতায় স্বীকৃতি পেল, কাজী নজরুলের কবিতা তাঁদের ভাগ্যলিপি হয়ে দেখা দিল।’ এক কথায় কবিতা গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করিল।
দ্বিতীয় পরিবর্তন বলিতে আহমদ ছফা যাহা দেখাইলেন তাহার অপর নাম বিপ্লবই, তবে এ বিপ্লব ভারসাম্যের। এতদিন ধরিয়া সাহিত্যে বাস্তুচ্যুত বা বাক্যহারা মুসলমান সমাজের সভ্যরাও নজরুল ইসলামের দোহাই-এ কবিতায় স্বীকৃতি পাইতে শুরু করিলেন। এক ঢিলে দুই পাখি বধ করিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি একদিকে মুসলমান সমাজের অভিজ্ঞতা বাংলা সাহিত্যে নতুন করিয়া তুলিয়া আনিলেন, অন্যদিকে হিন্দু সমাজের অভিজ্ঞতাকেও সাদর আলিঙ্গন করিলেন। আগের দিনের মুসলমান পুথি-লেখকদের মতো হিন্দু সমাজের ঐশ্বর্য বাতিল করিবার অসম্ভব চেষ্টা তিনি করিলেন না। তিনি যাহা করিলেন তাহা, আহমদ ছফার কথায়, ‘হিন্দু এবং মুসলিম সমাজ অভিজ্ঞতা, ইতিহাসচেতনা এবং জীবনবোধের আশ্চর্য সমন্বয়’।
সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্য কবি যাঁরা মার্কসবাদী কবি অথবা বিপ্লবের কবি বলে পরিচিত [তাঁরা] নজরুলের প্রভাব বলয় ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি
আহমদ ছফা লিখিত সুসমাচার অনুসারে, কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় এক নতুন দৃশ্যেরও সূচনা হইল। যাহার অপর নাম নিপীড়িত জনগণের ‘সামাজিক মুক্তি’ বা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন। শুদ্ধ বাংলার মুসলমান সমাজ নহে, দুনিয়ার মজদুর শ্রেণিও বাংলা ভাষায় প্রবেশ করিল নজরুল ইসলামের হাতে কাটা এই পথেই। ততদিনে রুশদেশে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করিয়াছে। দুনিয়া জুড়িয়া পরাধীনতা-বিরোধী সংগ্রাম দানাদার হইয়া উঠিয়াছে। গোপনে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হইতেছে। এই বিপ্লবেরও ভাব আছে। এই ভাবের ভাণ্ডারী নজরুল ইসলাম। স্বপ্নের সহিত অন্বেষণের দেখা হইল কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। নজরুল ইসলাম যত স্বপ্ন দেখিলেন তাহার চেয়ে বেশি দেখাইলেন। নজরুলের প্রভাব ছড়াইয়া পড়িল। আহমদ ছফার কথায়, ‘সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্য কবি যাঁরা মার্কসবাদী কবি অথবা বিপ্লবের কবি বলে পরিচিত [তাঁরা] নজরুলের প্রভাব বলয় ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি।’
‘খেটে খাওয়া মানুষের সাহিত্য প্রসঙ্গে’ লিখিতে বসিয়া আহমদ ছফা প্রথমে কবুল করিয়াছিলেন, ‘কথাটা হয়ত একটুখানি অতিশয় উক্তির মতো শোনাবে,’ তবু বলিতে পিছপা হন নাই, ‘কাজী নজরুল ইসলাম যখন তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু করলেন সে সময় বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন যুগান্তর সূচিত হল। নজরুলের অঘটনঘটনপটিয়সী প্রতিভা তার জন্য অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু সে সময়টার কথাও বিবেচনায় আনতে হবে।’ তিনি দেখাইয়াছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে ভুখা নাঙ্গা শোষিত মানুষের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করার পক্ষে যে একটি নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ধারা সৃষ্টি হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তার প্রথম পুরোহিত।’
এখানে আহমদ ছফার বিস্তার খানিকটা উদ্ধার করি :
নজরুল ইসলাম পল্টনে থাকাকালীন সময়ে রুশ বিপ্লবের কথা শুনেছিলেন এবং রুশ বিপ্লবের আদর্শ তাঁকে ভয়ানকভাবে উদ্দীপিত করে তুলেছিল। তিনি তাঁর গদ্য রচনায় রাশিয়ার লাল ফৌজের কথা উল্লেখ করেছেন। লাল ফৌজেরা যেভাবে শোষণের অবসান ঘটিয়ে ইনসাফের রাজত্ব কায়েম করেছে সে রকম একটা সমাজ এই ভারতে কায়েম করা যায় কিনা সে বিষয়টা অল্পদিনের জন্য হলেও নজরুল ইসলামের চিন্তাভাবনার বিষয় হয়ে উঠতে পেরেছিল। রুশ বিপ্লবের আদর্শে নজরুল ইসলাম তাঁর অনেকগুলো কবিতা রচনা করেছিলেন এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালেরই বিখ্যাত সঙ্গীতটির প্রথম দিককার অনুবাদক এবং সুরকার দুইই ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার সময় নজরুল ইসলাম অল্পস্বল্প ভূমিকা পালন করেছিলেন। নজরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসটি নানা কারণে নজরুল সাহিত্যে নয় শুধু, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি বিশিষ্ট রচনা। কারণ যাদের নিয়ে নজরুল এই রচনা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন তারা ছিলেন সমাজে একেবারে নিচুতলার মানুষ। এই নিচুতলার মানুষদের নিজেদের পেশাকে তাঁর উপন্যাসে হাজির করতে নজরুল ইসলাম বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠিত হন নি। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে পাত্রপাত্রীরা নিজেদের আপন ভাষায় কথা বলেছেন। বলা বাহুল্য, সেটা ভদ্রলোকদের ব্যবহৃত শুদ্ধ বাংলা ভাষা নয়।

কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে আহমদ ছফার সর্বশেষ প্রবন্ধের নাম ‘নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ’। এই প্রবন্ধে তিনি নজরুল ইসলাম প্রবর্তিত ভাষারীতি লইয়া আলোচনা করিয়াছেন। তিনি প্রথমেই কবুল করিয়া লইয়াছেন, কাজী নজরুল ইসলাম আপনকার কবিতাবলী রচনা করিয়াছিলেন ‘আধুনিক’ বাংলা ভাষায়। ‘আধুনিক’ বাংলা ভাষা মানে ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে শুরু করে’ ‘যে ভাষাটি গিরিগাত্রের সংকীর্ণা স্রোতম্বিনীর মতো বিকশিত হতে হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবধি এসে ভরাযৌবনা প্রমত্তা পদ্মার আকার ধারণ করেছিল’ সেই ভাষাই। বাংলা ভাষার চলতিরীতি বলিতেও এই দস্তুর। আহমদ ছফার মতে, ইহাতে নজরুল ইসলামের বিশেষ নাই। আছে সামান্য মাত্র। তাঁহার বিশেষ আরবি-ফারসি শব্দ ‘সার্থকভাবে প্রয়োগ’ করার মধ্যে। আহমদ ছফার উপপাদ্য অনুসারে, ‘নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যভাষা নির্মাণে চলতি ভাষারীতিটির পাশাপাশি গৌণভাবে হলেও মুসলমান লিখিত পুঁথিসাহিত্যের ভাষাশৈলীটির দ্বারস্থ হয়েছিলেন।’ অধিক কি, তিনি ‘তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্পর্শে পুঁথিসাহিত্যের ভাষার মধ্যে নতুন একটা ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন।’
আহমদ ছফার বিচারে, বাংলাদেশে ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠার পর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই বাংলা ভাষায় পরিবর্তন একটা সাধিত হইয়াছিল। নদীর পুরানা উপমা ধার করিয়া তিনি বলিতেছেন, ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যুগ থেকে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে।’ তবে ইংরেজ শাসনের সহিত যুক্ত নতুন বাংলা ভাষার একটি বড় দুর্বলতাও ছিল। আহমদ ছফার কথায়, ‘এই ভাষার বলয়টি ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং সংকুচিত।’ এই ভাষার জলে বাংলাদেশের জনসাধারণ অনেকদিন গরুর গা-গতর ধুইয়া দিতে পারে নাই। বিশেষ মুসলিম জনগোষ্ঠী, আধুনিক শিক্ষার দুয়ার যাহাদের সামনে অনেকদিন পর্যন্ত রুদ্ধ, তাহারা বা তাহাদের অনেকেই পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। আহমদ ছফার বাক্যে, ‘এই বিপুল জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ পারস্পরিক সম্পর্কের যোগসূত্র হিসেবে যে ভাষাটি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, পুঁথিসাহিত্যের ভাষার সঙ্গে তার একটি নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান।’
নজরুল ইসলাম কেন এই পুঁথির আরবি-ফারসি শব্দবহুল ভাষাশৈলী (গৌণভাবে হইলেও) অবলম্বন করিলেন? আহমদ ছফার মতে, করিলেন আপন সমাজের ‘আত্মপরিচয়’ ফুটাইয়া তোলার জন্য। আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, ‘পুঁথিসাহিত্যের ভাষা নিয়ে কৃতবিদ্য পণ্ডিতেরা যতই নাসিকাকুঞ্চন করুন না কেন, এই ভাষাটি কদাপি উর্দু, আরবি [কিংবা] ফারসি নয়। এটা বাংলা ভাষারই একটা বিশেষ ফলিত রূপ। একটি সমাজের মধ্যে তার যথেষ্ট আদর রয়েছে এবং সেই বিশেষ সমাজের অন্তরঙ্গ [অভিজ্ঞতা] এই ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।’ নজরুল ইসলাম এই সামাজিক অভিজ্ঞতার দাবিকেই আপনার প্রাণের দাবিতে পরিণত করিয়াছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম নতুন করিয়া পুঁথির ভাষায় ফিরিয়া যান নাই। পুঁথির ভাষাকেই তিনি নতুন করিয়াছিলেন। তিনি এই ভাষাকে আপন ভাষার অঙ্গ বলিয়া স্বীকার [অর্থাৎ অঙ্গীকার] করিয়াছিলেন মাত্র। আহমদ ছফার ভাষায়, পুঁথিসাহিত্যকে নবজীবন দানের সূচনা করিয়াছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি লিখিয়াছেন, ‘শুধুমাত্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের প্রয়াসের ফলে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া একটা ভাষারীতিকে বাংলা সাহিত্যের স্বাভাবিক প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে বাংলা ভাষাকে জনগোষ্ঠীর সত্যিকার প্রতিনিধিত্বশীল ভাষা হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।’ নজরুল ইসলামের মধ্যে পুঁথিসাহিত্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে নাই। তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন না। তাঁহার হাতে যাহা ঘটিয়াছে তাহাকে বরং ‘নবজীবনের ইশারা’ দান বলাই শ্রেয়।
নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,
‘আম্মা! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!
‘বিদ্রোহী’ লেখার আগেই নজরুল ইসলাম এই কবিতা রচনা করেন। ইহা লইয়া আহমদ ছফার মন্তব্য আমাদের দৃষ্টি কাড়িয়াছে। তিনি বলিয়াছেন, ‘এসব পঙ্‌ক্তিতে রয়েছে আশ্চর্য কন্ট্রাস্ট।’ নজরুল ইসলাম যাহা করিয়াছেন তাহা আর কেহ করেন নাই বলা যায়, করিতে পারেন নাই। আহমদ ছফা তাহা জানেন : ‘আমাদের সমাজে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ঐতিহ্য এবং মিথের যে অনিবার্য উপস্থিতি এবং সংমিশ্রণ তার প্রতি সাহিত্যিকদের দৃষ্টি সীমিত, খণ্ডিত। এর প্রতি উদারতা দেখায় নি কেউ।’ অধিক বলার দরকার কি!
নজরুল পুঁথিসাহিত্যের প্রাণের আগুনটুকু গ্রহণ করেছেন, তার জীর্ণ কঙ্কাল বহন করেন নি
নজরুল ইসলামের ভাষা-কাঠামো (অর্থাৎ অন্তর্গত গদ্য) ইংরেজ অধিকারের ছায়াপথ অর্থাৎ অধিপতি বাংলা গদ্যরীতির আনুগত্য অস্বীকার করে নাই। তবে পুথির ভাষাকেও তিনি নিজের মতো করিয়া শাসন করিয়াছেন। অধিপতি ভাষার গাঁটে গাঁটে জায়গা করিয়া দিয়াছেন। আহমদ ছফার প্রস্তাব অনুসারে, ‘নজরুল সাহিত্যে বাংলা কাব্যভাষার যেমন সৃষ্টিশীল প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি এই পুঁথিসাহিত্যের ভাষাটিও সৃষ্টিশীল নির্বাচনের মাধ্যমে বিশিষ্টতা অর্জনের পর সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে।’ আহমদ ছফার বচনে তাঁহার বিশেষত্ব এই : ‘নজরুল পুঁথিসাহিত্যের প্রাণের আগুনটুকু গ্রহণ করেছেন, তার জীর্ণ কঙ্কাল বহন করেন নি। তাই নজরুল-সাহিত্যে পুঁথিসাহিত্যের জীবাশ্ম দৃষ্টিগোচর হলেও সেই ভাষা-কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
আবদুল কাদির আহমদ ছফার ঢের আগে এই কথাটা পরিষ্কার করিয়া বলিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন :
বলা হয়েছে, নজরুল আরবি-ফারসিবহুল প্রচলিত বাংলা ভাষায় তাঁর কোনো সমগ্র কাব্য প্রণয়ন করেন নি। এও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যে কারণে তিনি তাঁর কোনো অক্ষরবৃত্তের কবিতাতেই এ ভাষা গ্রহণ করেন নি, ঠিক সেই কারণেই ‘মুসলমানী বাঙ্গালা’য় তাঁর কোনো গদ্য রচনা নেই।’ আবদুল কাদির অন্যত্রও লিখিয়াছেন, ‘নজরুল যখন সাহিত্যের আসরে প্রথম পদক্ষেপ করেন, সে সময় রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর দৌলতে বাংলা গদ্যরীতি একটা সুসমঞ্জস ও সুগঠিত রূপ লাভ করেছে। নজরুল তাঁর জবরদস্ত হাতে সে রীতি পরিবর্তন করে যদি ‘আলালী’ ভাষার বিকাশসাধনে উদ্যোগী হতেন, তবে হয়ত বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রেও ‘মুসলমানী বাঙ্গালা’র প্রবেশ সুঠাম হতো। যে কারণেই হোক, নজরুল সে প্রয়াস বিশেষ করেননি।
নজরুলের উদাহরণ হইতে শিক্ষা না লইয়া থাকা কঠিন। যেমন ফররুখ আহমদ না লইয়া পারেন নাই। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ সাক্ষ্য দিতেছেন : ‘তাঁর কবিতায় আরবী-ফারসী শব্দের ব্যাপক ও নিপুণ ব্যবহার দেখে অনেকের ধারণা ফররুখ আহমদ বুঝি আরবী ও ফারসী ভাষা খুব ভাল জানতেন। কিন্তু ফররুখ আহমদের নিজের মুখে শুনেছি তিনি এসব [শব্দ] আহরণ করেছেন প্রধানত পুঁথি থেকে, প্যারীচাদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল, নজরুলের কবিতা, প্রমথ চৌধুরীর গদ্য এবং অন্যান্য রচনাবলী পাঠ করে। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ।’ দুঃখের মধ্যে, তিনি লইয়াছিলেন অর্ধেক শিক্ষা। ফররুখ আহমদের পাত্র ছিল পাঁচসেরা। সেখানে নজরুল ইসলামের দশ সের আর ধরে নাই।
কাজী নজরুল ইসলাম যে আলালী ভাষার অধিক বিকাশসাধনে উদ্যোগী হন নাই তাহার কারণটা কি? কারণ, আহমদ ছফার বিচারে, ‘পুথি লেখকেরা বাঙ্গালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যচেতনা উজ্জ্বল করে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই বিশেষ ভাষারীতি তৈরি করেছিলেন। নজরুল স্বাতন্ত্র্যপ্রয়াসী এই মুসলিম সমাজটিকে বাঙ্গালি সমাজেরই একটি অংশ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ওই ভাষা ব্যবহার করেছিলেন।’ এই ব্যাখ্যার সপক্ষে আহমদ ছফা আরও কিছু যুক্তি দিয়াছেন। এই যুক্তি-পরম্পরা কবির বিশ্বাসের সহিত জড়িত। আহমদ ছফার মতে, ‘বাঙ্গালি সমাজ সম্বন্ধে নজরুলের দুই ধরনের স্থির বিশ্বাস ছিল। এক নম্বরে, ‘তিনি হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি এবং ঐক্যে পুরোপুরি বিশ্বাসী ছিলেন।’ দুই নম্বর কথা, ‘মুসলমান সমাজের একেবারে ভিতর থেকে একটা জঙ্গমতা সঞ্চার করার জন্য তিনি সদা তৎপর ছিলেন।’ তার প্রমাণ, তিনি ইসলামি বিষয়-আশয় লইয়া ‘অনেক কবিতা এবং অসংখ্য গান’ লিখিয়াছিলেন।
আহমদ ছফা লিখিতেছেন :
যে সমস্ত বিষয় মুসলমানদের প্রিয়, যেগুলো নিয়ে বাংলার মুসলমান সঙ্গত কারণে গর্ব করতে পারে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে [তার] উদ্ভাসন না ঘটালে ভেতরে একটা তাড়না সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তাঁর রচিত ‘মোহররম’, ‘কোরবানী’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’, ‘কামাল পাশা’, ‘উমর ফারুক’ এ সকল কবিতা তিনি সে কারণে লিখেছেন। কোরানের আংশিক অনুবাদ এবং [হজরত] মুহম্মদের জীবন নিয়ে কাব্য সেই জন্য তিনি রচনা করেছিলেন। হাফিজ, খৈয়াম অনুবাদ করেছিলেন।’ এককথায় ‘মুসলমানদের মধ্যে যে হীনম্মন্যতাবোধের শেকড় প্রোথিত ছিল তার সেই মূলে আঘাত করে মুসলিম তরুণদের সৃষ্টিশক্তির সঙ্গে ঐতিহ্যের একটা সমন্বয়সাধনের প্রয়াস তিনি করে গেছেন।
ফলাফল কি দাঁড়াইয়াছিল এই সাধনার? আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, ‘তাঁর সাধনার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি মুসলমান সমাজ সংস্কৃতিচর্চার একটি নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছে। বাঙ্গালি মুসলমান সমাজ শিল্প এবং সংস্কৃতিচিন্তার ক্ষেত্রে নজরুলের মতো আর কারো কাছে অত বিপুল পরিমাণে ঋণী নয়।’ কোনো কোনো অর্বাচীন নজরুল ইসলামকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ পর্যন্ত বলিয়াছিলেন। জওয়াবে আহমদ ছফা লিখিয়াছিলেন, ‘কেউ কেউ নজরুলকে ধর্মীয় আদর্শের লাশ বহন করেছেন বলে অভিযুক্ত করতে পারেন। কিন্তু নজরুল ইসলাম তাঁর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে যে একটা যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন তার তো কোনো তুলনা হয় না।’ কাজী নজরুল ইসলাম তাঁহার সাহিত্যকর্মের মধ্যে ইসলাম ধর্মের যে উদার ও যুগোপযোগী (অর্থাৎ ফরাশি বিপ্লব পরবর্তী স্বাধীনতা ব্যবসায়ী ও ধর্মনিরপেক্ষ) ব্যাখ্যা হাজির করিয়াছিলেন তাহার সহিত আহমদ ছফা রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগররের ধর্মসংস্কার প্রয়াসের তুলনা যথাযথ মনে করেন।
আহমদ ছফার মতে নজরুল ইসলামের প্রধান সাফল্য এইখানে যে তিনি বাংলা ভাষাকে বিচিত্র করিয়া এক রাখিয়াছেন। আহমদ ছফা বলেন :
নজরুলের কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান ও প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে নজরুল তাদের ভাষাহীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেন। আর নজরুলের কাছে সমগ্র বাঙ্গালি সমাজের ঋণ এই যে নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করে, নব বিকাশধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে, অনেক দূর পর্যন্ত গাঁথুনি নির্মাণ করেছিলেন।

কিন্তু না বাঙ্গালি মুসলমান সমাজ, না বাঙ্গালি হিন্দু সমাজ নজরুলের কাছে যথাসময়ে যথাপরিমাণে তাহাদের ঋণ স্বীকার করিয়াছেন। ‘কতিপয় জিজ্ঞাসা’ (১৯৮৮) প্রবন্ধে আহমদ ছফা এই বিষয়ে আসিয়া তিনটি মন্তব্য যোগ করিয়াছেন। প্রথম মন্তব্য : নজরুল ইসলামের জীবদ্দশাতেই একদা কলিকাতা শহরের বুদ্ধিজীবী সমাজ নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান সম্পর্কে এক রকম আগ্রহহীন হইয়া পড়িয়াছিল। প্রকাশ থাকে যে নজরুল ইসলাম ততদিনে সম্বিৎহারা এবং বাকশক্তিরহিত। আহমদ ছফা দেখিয়াছেন, নজরুল যখন বাকশক্তিহীন তখন ‘বিদগ্ধ সমালোচকদের একাংশ বলতে আরম্ভ করলেন, কাজী নজরুল উল্লেখ করার মত কবি নন।’ তাঁহার জবানি মোতাবেক, ‘এক সময়ে নজরুলের গান গেয়ে যাঁরা নিজেদের শিল্পী হিসেবে ধন্য মনে করতেন, তাঁরা অনেকেই সরে দাঁড়াতে থাকলেন। আর যাঁরা নজরুলের গান গাইবেন বলে ধনুকভাঙ্গা পণ করে পড়ে রইলেন তাঁদের তো ভাতে মরার দশা। উদাহরণস্বরূপ ফিরোজা বেগম এবং কমল দাশগুপ্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁরা নজরুলের গান পরিবেশন করার কোনো ক্ষেত্র না পেয়েই কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে নজরুল গীতির অত্যন্ত পারঙ্গম শিল্পী শ্রীমানবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের একাধিক মন্তব্যের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।’
নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সঙ্গীতের মধ্যে এমন কিছু উপাদান ছিল যা শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সমসূত্রে এসে দাঁড়িয়েছিল। যেমন শাসকগোষ্ঠী উর্দু-বাংলা মিশিয়ে একটা সংকরভাষা সৃষ্টি করতে চাইত।
আহমদ ছফা আক্ষেপ করিয়া লিখিয়াছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে নজরুলচর্চার ক্ষেত্রে অতি সাম্প্রতিককাল ছাড়া মুসলিম বা ইসলাম সম্পর্কিত দিকসমূহ কারও সিরিয়াস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে একথা বোধ করি বলার উপায় নেই।’ ইহা ১৯৮৮ সালের কথা। নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে একটা বিদ্বেষের ভাব যাহারা সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাঁহারা এখনও মাঠেই আছেন। তাঁহাদের শক্তি ও সামর্থ্য এতদিনে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পরাজয়ের পর কেমন আছে জানি না।
আহমদ ছফার দ্বিতীয় মন্তব্য তৎকালীন পূর্ব বাংলা (অথবা পূর্ব পাকিস্তান) সম্পর্কে। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই নজরুলচর্চার একটা পরিপ্রেক্ষিত আপনা থেকেই সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র এবং নজরুল ইসলাম একজন মুসলমান কবি। নজরুলচর্চার পুনরুজ্জীবনের এটাই একমাত্র হেতু নয়। নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সঙ্গীতের মধ্যে এমন কিছু উপাদান ছিল যা শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সমসূত্রে এসে দাঁড়িয়েছিল। যেমন শাসকগোষ্ঠী উর্দু-বাংলা মিশিয়ে একটা সংকরভাষা সৃষ্টি করতে চাইত। নজরুল পাকিস্তানের জন্মের বহু আগেই অত্যন্ত শিল্পসম্মতভাবে আরবি-ফার্সি-উর্দু বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে নতুন স্বাদ, নতুন গন্ধের কবিতা এবং সঙ্গীত রচনা করে ক্ষান্ত থাকেন নি, সেগুলোকে [সর্বজন-] গ্রাহ্য করেও তুলেছিলেন। মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে তিনি এন্তার কবিতা রচনা করেছিলেন। তাছাড়া মুসলমান সমাজের অভিজ্ঞতার কুশলী কাব্য রূপায়ণ তাঁর হাতে ঘটেছে।’
আর এদিকে ‘পাকিস্তান সরকারও চাইছিল এমন একজন মুসলমান স্রষ্টা, কবি হিসেবে, সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে যাঁর পরিচিতি আছে, স্বীকৃতি আছে। সরকার নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্মের একাংশের মধ্যে আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর সন্ধান পেয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানে নজরুলের গানের চর্চায় নতুন একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি হল। তাঁর অন্যবিধ সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কেও মোটামুটি একটা জাগ্রত আগ্রহের ভাব দেখা দিতে থাকল। কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্মের অর্ধাংশের ওপর ভর করেই সরকারী উদ্যোগে ‘দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে দীন-ই-ইসলামী লাল মশাল’ ইত্যাদির ডংকা বাজতে থাকল কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্মের অপর অংশটি—যাতে নজরুল ইসলামের সত্য আরো বেশি প্রকাশমান হতে পেরেছে—সম্পূর্ণ অবহেলিত থেকে গেল। তখন রেডিও টিভি থেকে নজরুলের গজল, নাত, কাওয়ালি ইত্যাদি অধিক মাত্রায় গীত হতে থাকল। শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন বা ভজন জাতীয় গানের ওপর একরকম অলিখিত নিষেধাজ্ঞাই জারি করা হল। বাংলাদেশের নজরুলচর্চা এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই মানসিকতায় আক্রান্ত এবং এই বিদ্বেষবিষে দুষ্ট।’ বলা বাহুল্য নয়, আহমদ ছফা এই বাক্যগুলি যখন লিখিতেছেন তখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয় নাই। সংবিধানে সেই বিধান যুক্ত করা হয় ১৯৮৮ সালের জুন মাসে।
আহমদ ছফার তৃতীয় মন্তব্য স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলচর্চার ধরনধারণ প্রসঙ্গে। তিনি প্রথমে পটভূমি আঁকিয়াছেন : ‘বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি এবং স্বাধীনতা আন্দোলনটিতে ক্রমাগত বেগ এবং আবেগ সঞ্চারিত হতে আরম্ভ করলে রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বাংলাদেশের এলিট শ্রেণির মধ্যে একটা নব অনুরাগ ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এই ক্রমবর্ধিত রবীন্দ্র-অনুরাগ মোকাবেলা করার জন্য কর্তৃপক্ষ নজরুলের ওপর অধিক হারে মনোযোগ দিতে আরম্ভ করে। কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমান্তরাল একজন সাহিত্য এবং সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য একটা সংগোপন প্রয়াস অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। বলা বাহুল্য, সমাজের একটা অংশের মধ্যে তার প্রত্যক্ষ সমর্থনও ছিল। তা এখনও আছে। এই মনোভাবটি হালের বাংলাদেশে স্মরণকালের মধ্যে সর্বাধিক প্রবল রূপ ধারণ করেছে।’ পাকিস্তানি জমানায় নজরুল ইসলামের কবিতার ‘অবাঞ্ছিত অংশ’ বাছাইয়ের কাজও শুরু হইয়াছিল। ১৯৫০ সালে গোলাম মোস্তফা নামক প্রসিদ্ধ কবি এই উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কাটাছেঁড়া ছাড়া উঁহাদের উপায় ছিল না।
আহমদ ছফা টুকিয়া রাখিয়াছেন,
রক্ষণশীল বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ যতদিন পর্যন্ত তাদের প্রচারের ঢাকের কাঠি হিসাবে ব্যবহার করা না যায়, ততদিন নজরুল প্রতিভার বিশেষ-আদর সমাদর করে নি। তৎকালীন প্রতিনিধিত্বশীল মুসলিম ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিরোধিতার এমন একটি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে নজরুলের জীবন ফাঁদে পড়া পশুর মতো হয়ে পড়েছিল। সত্য বটে ইসলাম ধর্মের ‘সাম্য’, ‘মৈত্রী’ এবং ‘সৌভ্রাতৃত্ববোধ’ এ সকল প্রতীতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। মুসলমানদের অধঃপতিত দশা দেখে তিনি দুঃখ পেতেন এবং প্রাণের গভীর থেকে তাঁদের মধ্যে একটা উত্থান কামনা করতেন। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি কখনও তাঁর ধ্যানদৃষ্টিকে কলুষিত করতে পারে নি। নজরুল ইসলামের জীবন, তাঁর কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীত সাম্প্রদায়িক সম্মিলনের সেতুবন্ধন। স্বভাবে, চরিত্রে, জীবনে, আচরণে এই কথাটিকে নজরুলের চাইতে বেশি সত্য প্রমাণ কে করতে পেরেছে?
বাংলাদেশ স্বাধীন হইয়াছে যে আদর্শ শিরে ধরিয়া সে আদর্শই তো কাজী নজরুল ইসলামের সাধনা। কিন্তু বেশিদিন না যাইতেই আবার গোলাম মোস্তফা গয়রহ ফিরিয়া আসিয়াছেন। সে কথা স্মরণ করিয়াই আহমদ ছফার এই বিলাপ :
আমরা আমাদের মাটিতে তাঁকে দাফন করেছি। আর মাটিচাপা দিয়েছি নজরুলের সত্যিকার শিল্পীসত্তাকে। জীবনের অকিঞ্চিৎকর ভগ্নাংশে চৈতন্যহীন কবিকে বড়সড় একটা বাড়িতে থাকতে দিয়ে আজ আমরা মৃত নজরুলের কাছ থেকে যে মূল্য আদায় করতে চাই তার কাছে শাইলকের আধ পাউন্ড মাংসের দাবিকেও তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমরা তাঁকে বৃহত্তর বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে টেনে এনে সাম্প্রদায়িক ফ্রেমে আটকাতে চাইছি। তাঁর বৃহত্তর পরিচয় ঢেকে রেখে ক্ষুদ্রতর পরিচয়টা জাহির করতে চেষ্টা করছি। সভাসমিতিতে শোভন জবানে আমরা যা বলি, তার চাইতে যা বলি না তাই যেন এতদিনে মুখ্য হয়ে উঠছে।

‘বাংলার সাহিত্যাদর্শ’ প্রবন্ধের এক জায়গায় আহমদ ছফা কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ফরাশি ভাষার লেখক রুশো বর্ণিত মহান বর্বরের তুলনা করিয়াছেন। ইংরেজি প্রবন্ধে এই স্থলে তিনি ‘নোবল স্যাবেজ’ কথাটি এস্তেমাল করিয়াছিলেন। ‘নোবল স্যাবেজ’ কথার তর্জমা আমরা করি ‘মহান অসভ্য’ মানে ‘বন্য হইলেও বেশ’। আহমদ ছফা বলিয়াছেন, ‘তাঁর মহৎ অন্তরাবেগ কখনো বুদ্ধির অভিভাবকত্ব স্বীকার করে নেয় নি। নিজের মর্মের বেদনাবোধ চেপে রাখার মত ছলনার শিক্ষা তিনি পান নি। যদি তাই হত বাংলা সাহিত্য নজরুল ইসলামের প্রতিভা থেকে বঞ্চিত হত।’ এই মন্তব্যকে কিছু পরিমাণে আহমদ ছফার দীর্ঘশ্বাস আকারেও শোনা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম দুই মহান। একজনকে তিনি বলিয়াছেন ‘মহান সামন্ত’ এবং আরজনকে ‘মহান বর্বর’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম দুই মহান। একজনকে তিনি বলিয়াছেন ‘মহান সামন্ত’ এবং আরজনকে ‘মহান বর্বর’। সজ্ঞানে বলিয়াছেন, আমি না বৈশাখ না জ্যৈষ্ঠ। মানে না ঠাকুর না ইসলাম। অজ্ঞানে বলিতেছেন আমি উভচর। ফ্রয়েডের বিশ্লেষণ অনুসারে, অজ্ঞানলোকে ‘না’ বলিয়া কোনো লব্ধ নাই। আছে কেবল সমাবেশ। আহমদ ছফার অজ্ঞানলোকের এই সমাবেশকে আমরা কোন আলোকে দেখিব? অকৃত্রিম মুদ্রায় তাঁহার ঋণ স্বীকার করি তো একটা আখ্যা তাঁহাকেও দিতে হয়। আহমদ ছফা ছিলেন আমাদের জ্ঞানে যতদূর কুলায় ততদূর বলিতে মহান বুর্জোয়া। মহান কৃষক, তাই মহান বুর্জোয়া। যাহারা কৃষক বলিতে শুদ্ধ সামন্ত বোঝেন তাঁহারা আমাদের কথার অর্থ উদ্ধার করিতে দেরি করিবেন।
সাহিত্যাদর্শ বলিতে আহমদ ছফা কি বুঝাইতেছেন আশা করি এতক্ষণে তাহা পরিষ্কার। শুদ্ধমাত্র লেখার রীতি বা স্টাইলকে সাহিত্যাদর্শ বলেন নাই তিনি। যাহাকে সমাজের দায় বলিতে হয় তাহাও লেখকের আদর্শ হইয়া দাঁড়ায়। এই প্রশ্নে আহমদ ছফাই কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম অপর। এই অর্থেও আহমদ ছফা আমাদের মহান বুর্জোয়া। প্রথম যৌবনে তিনি ইশতেহার গোছের একটা কবিতার নাম রাখিয়াছিলেন ‘না বৈশাখ না জ্যৈষ্ঠ’। ঘোষণা করিয়াছিলেন, ‘বৈশাখে দেই না ডালি’। একস্বরে আবার শোনাইয়াছিলেন, ‘জ্যৈষ্ঠদিনে করিনে ক্রন্দন’। পাছে লোকে কিছু বোঝে! বিজ্ঞাপন দিলেন : ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী নই আমি’। জাহির করিলেন : ‘নজরুল কিংবা কোনো ফসিলের স্তবে হৃদয়ে পাথর বসে’। কি কঠিন কথা!
শুদ্ধ দুইবার বলিয়া তিনি ক্ষাণ্ত হইতে পারেন নাই। তৃতীয় বারে তাঁহাকে জানাইতে হইল : ‘আমি তো পরের ধনে করিনে পোদ্দারী।’ অধিক জানাইলেন, ‘বিদ্রোহীর অগ্নিকুণ্ডে মৃত অঙ্গারের লোভে চপল শিশুর মতো কখনো যাই নি আমি’। তো আহমদ ছফার সাহিত্যাদর্শ কি দাঁড়াইল? পরের বাসনাই শেষ বিচারে মানুষের বাসনা হইয়া দাঁড়ায়। এ সত্যে সন্দেহ কোথায়! মানুষ আত্মপ্রকাশের নতুন নতুন ভাষা খুঁজিবে। প্রত্যেকেই মনে করিবে সে স্বতন্ত্র। তাই ঈশ্বর। আহমদ ছফাও বলিবেন : ‘আমারো ধ্যানের গাঙ্গে প্রতিদিন জাগে নয়া চর।’
আমার জীবন ক্ষেত্রে ফলেছে এই ভাষা
লোহিত মাংসের মতো ভীষণ রসালো
গিট গিট অস্থিময় কখনো বা ভাঙ্গা কাচ
প্রাণের আলোক লেগে করে ঝলমল।
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠেতে গড়া বাঙ্গালির
সাধের মিনার, চেতনার স্তরে স্তরে
খসে খসে যায় সময়ের নিষ্ঠুর প্রহারে
জীর্ণ অট্টালিকা থেকে যেন চুন বালি ঝরে।
আকণ্ঠ গানের তৃষ্ণা বুকে জ্বলে অগ্নিবর্ণ কথা
বাংলার বারোটি মাস ওড়ায় পতাকা
দুই হাতে ভরে নিয়ে শোণিত অঞ্জলি
নব কাব্যসুন্দরীর রাঙ্গা পায়ে ঢালি।
কাজী নজরুল ইসলামের নামে আহমদ ছফা যাহা আরোপ করিয়াছেন তাহা তাঁহারও জীবনবেদ বিশেষ। ১৯৯৪ সালে মকবুল এক সাক্ষাৎকারযোগে তিনি বলিয়াছিলেন, বাংলাদেশের কৃষক যে বুর্জোয়ার জন্ম দিয়েছে তেমন বুর্জোয়ার বিকাশ মধ্যবিত্ত শ্রেণি হইতে ঘটিতে পারে নাই। এই প্রশ্নে আহমদ ছফার ভাষ্য নিম্নরূপ : ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শিল্পী এস. এম. সুলতান—ওই তিনজন সরাসরি কৃষক সমাজ থেকে উঠে এসেছেন। স্কুল-কলেজের আধুনিক শিক্ষা তাঁরা বিশেষ লাভ করেন নি। নজরুল ইসলাম সম্পর্কেও কমবেশি একই কথা বলা যায়। কিন্তু এঁদের সিদ্ধি এবং অবদান হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে আগত প্রতিভাবান ব্যক্তিদের চাইতে কম নয়, কোনো কোনো অংশে অনেক বেশি। তাতে করে প্রমাণিত হয়, কৃষক সমাজের মধ্যে কি পরিমাণ সৃজনশীল ক্ষমতা সুপ্ত রয়েছে। কিন্তু শিক্ষিত বাঙ্গালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে সব মানুষ তৈরী করেছে তারা বড়জোর মাঝারি। কোনো দিক দিয়েই হিন্দু মধ্যবিত্তদের গৌরবশিখর ম্লান করতে পারে নি।’
দোহাই

 ১. আবদুল কাদির, ‘বাংলা ভাষা ও নজরুল ইসলাম,’ আবদুল কাদির (সম্পাদিত), নজরুল-পরিচিতি, ৩য় মুদ্রণ (ঢাকা: পাকিস্তান পাবলিকেশানস, ১৯৬২), পৃ. ১৩৫-১৪১।
 ২. আহমদ ছফা, ‘বাংলার সাহিত্যাদর্শ,’ নূরুল আনোয়ার (সম্পাদিত), আহমদ ছফা রচনাবলি, ২য় খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮), পৃ. ২০৩-২১৪।
 ৩. ‘নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ,’ নূরুল আনোয়ার (সম্পাদিত), আহমদ ছফা রচনাবলি, উত্তর খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০১১), পৃ. ৯৮-১১১।
 ৪. ‘Literary Ideals in Bengal,’ নূরুল আনোয়ার (সম্পাদিত), আহমদ ছফা রচনাবলী, ৮ম খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮), পৃ. ৩৮৩-৩৯৫।
 ৫. ‘নজরুল জন্মজয়ন্তী ফলহীন প্রতর্ক: কতিপয় জিজ্ঞাসা’, উত্তরণ, ২৭ মে/৩ জুন ১৯৮৮।
 ৬.‘না বৈশাখ না জ্যৈষ্ঠ,’ আহমদ ছফার কবিতা (ঢাকা: শ্রীপ্রকাশ, ২০০০), পৃ. ১২১-১১৩।
 ৭. (অনূদিত), মাও সে-তুং-এর উদ্ধৃতি (ঢাকা: প্রকাশ ভবন, ১৯৬৭)।
 ৮. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: শতবর্ষের ফেরারী (ঢাকা: প্রাচ্যবিদ্যা প্রকাশনী, ১৯৯৭)।
 ৯. ‘নজরুল সাহিত্যে ঐতিহ্যচেতনা,’ উত্তরণ, ২৬ মে/১ জুন ১৯৮৯।
 ১০. ‘খেটে খাওয়া মানুষের সাহিত্য প্রসঙ্গে,’ নূরুল আনোয়ার (সম্পাদিত), আহমদ ছফা রচনাবলি, ৭ম খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮), পৃ. ৩৯৮-৪০১।
 ১১. এবং মীজানুর রহমান মীজান, ‘এক সন্ধ্যার সংলাপ,’ নূরুল আনোয়ার (সম্পাদিত), আহমদ ছফা রচনাবলি, ৩য় খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮), পৃ. ৩৫১-৩৮১।
 ১২. এবং শাহ আলম নিপু গয়রহ, ‘আহমদ ছফার সাথে এক একান্ত সন্ধ্যায় অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা’, কালধারা, ১০ম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৪০৬ (ডিসেম্বর ১৯৯৯), পৃ. ২৬২-২৬৯।
 ১৩. নূরুল আনোয়ার, ছফামৃত (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০১০)।
 ১৪. মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ‘ফররুখ আহমদ: কবি ও ব্যক্তি’, সাহিত্য ও সাহিত্যিক (ঢাকা: মুক্তধারা, ১৯৭৮), পৃ. ১৭০-১৭৬।
 ১৫. Edward Thompson, Rabindranath Tagore: Poet and Dramatist (Oxford: Oxford University Press, 1948).
About Latest Posts
সলিমুল্লাহ খান
সলিমুল্লাহ খান
লেখক, অধ্যাপক।।

জন্ম : ১৮ অগাস্ট ১৯৫৮, কক্সবাজার।।

গুরুত্বপূর্ণ বই : ‘আদমবোমা’ (২০০৯), ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী’ (২০১০),
‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’ (২০১১), ‘আল্লাহর বাদশাহি’, ২য় সংস্করণ, (২০১২)।।

ই-মেইল : salim_khan@yahoo.com
 সূত্র
http://www.porospor.com/পুনর্মুদ্রণ/আহমদ-ছফার-সাহিত্যাদর্শ/

No comments:

Post a Comment